হজ্ব কেন ব্যর্থ হচ্ছে?

পূর্ণ আত্মসমর্পণই ইসলাম –

এ বিশ্বচরাচরে প্রতিটি মানব সন্তানের সামনে পথ মাত্র দুটি -যার একটিকে বেছে নেয়া ছাড়া সামনে কোন তৃতীয় বিকল্প পথ নেই। মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাটি স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় না, বরং সেটি হয় এ দুটি পথের মাঝে সঠিক পথটি বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে। এখানে ফেল করলে জীবনের অন্যান্য অঙ্গণে হাজারো সফলতাতেও কোন লাভ হয় না; বরং অনন্ত-অসীম কালের জন্য ভয়ানক আযাবে পড়তে হয়। প্রথম পথটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের। দ্বিতীয়টি, তাঁর বিরুদ্ধে অবাধ্যতা বা বিদ্রোহের। প্রকৃত সফলতা মেলে পূর্ণ আত্মসমর্পণে; এটিই মানব সৃষ্টিকে স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিতে পরিণত করে। অপর দিকে যেখানেই আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে অবাধ্যতা, সেখানেই আসে পথভ্রষ্টতা ও বিপর্যয় -যা মানুষকে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীবে পরিণত করে এবং পরকালে জাহান্নামে নিয়ে হাজির করে। তখন এ জীবনে বাঁচাটিই অন্তহীন আযাবের কারণ হয়।

ইসলামের মূল লক্ষ্য মূলতঃ সমগ্র মানব জাতির সামনের সাফল্যের সঠিক পথটি দেখানো। এটিই হলো ইসলামের সবচেয়ে বড় অবদান। মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে চাষাবাদ, বিজ্ঞান, ঘরবাড়ি বা রাস্তানির্মাণ শেখাতে নবী-রাসূল পাঠাননি, বরং লক্ষাধিক নবীরাসূল পাঠিয়েছেন জীবনের সঠিক পথটির সন্ধান দিতে। এবং পাঠিয়েছেন স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ কীরূপে -সেটি শিক্ষা দিতে। এ দিক দিয়ে হজ্বের গুরুত্বটি বিশাল ও অনন্য। মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি আত্মসমর্পণ কাকে বলে এবং সেটি কীরূপে –সেটি স্রেফ কোন কিতাবী বিষয় না। বরং তা চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়েছেন মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ তিন ব্যক্তি।  তাঁরা হলেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ), বিবি হাজেরা ও হযরত ইসমাইল (আঃ)। আলোচ্য নিবন্ধে তাঁদের আত্মসমর্পণের কিছু বিবরণ পেশ করা হবে। মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি আত্মসমর্পণে তারা যে রেকর্ড গড়েছিলেন –সেটিকে স্রেফ ইতিহাসের পাতায় না রেখে সে স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করে হজ্ব করাকে ইসলাম ইবাদতে পরিণত করেছেন। হজ্বের মঞ্চে মূল চরিত্র মূলতঃ তারাই। মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি আত্মসমর্পণে তাদের অর্জনটি বিশাল। বিশ্বের নানা কোনের নানা শহর ও নানা গ্রামগঞ্জ থেকে লক্ষ লক্ষ ব্যস্ত মানুষকে মক্কার মরুপ্রান্তরে নিয়ে হজ্ব যেমন জীবনের মূল এজেন্ডা নিয়ে গভীর ভাবনার সুযোগ করে দেয়, তেমনি তাদের ধ্যানমগ্ন চেতনার ভূমিতে মানব ইতিহাসের উপরুক্ত তিন বিখ্যাত ব্যক্তিকে অনুকরণীয় মডেল রূপে খাড়া করে। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি আত্মসমর্পণের এরূপ মডেল এবং তাদের আদর্শে লোকগড়ার এরূপ সৃষ্টিশীল আয়োজন কি আর কোন ধর্মে আছে?

 

গুরুত্ব দর্শনের

কোন অনুষ্ঠানই শুধু ধর্মীয় হওয়ার কারণে শ্রেষ্ঠতর হয় না। সে সব অনুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েত হওয়াতেও তা কল্যাণকর বা শ্রেষ্ঠতর হয় না। কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠতর হয় অন্তর্নিহিত দর্শনের কারণে। মানুষ দৈহিক বল পায় পেশীবলের কারণে; কিন্তু চারিত্রিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বলটি আসে দর্শনের বলের কারণে। দর্শন তো তাই যা মানুষের মনকে আলোকিত করে এবং ভাবতে ও বুঝতে শেখায়। ইসলামের অন্যান্য ইবাদতগুলির ন্যায় হজ্বের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই। হজ্বের প্রতি আচারের গভীরে লুকিয়ে আছে বিশাল এক দর্শন -যা মানুষকে তাঁর স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পিত এক দাস হতে শিক্ষা দেয়। সামর্থ্য দেয় সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করতে।  কিন্তু অন্যান্য ধর্মে বিস্তর আচার আছে কিন্তু তাতে দর্শন বা মনকে আলোকিত করার বিষয় কতটুকু?  ভারতে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবছর গঙ্গাস্নানে হাজির হয়।পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে বহুমানুষ মন্দিরে যায়। প্রশ্ন হলো, মন আলোকিত হলে কেউ মানুষ মুর্তির পদতলে ভেট দেয়? গরু, শাপশকুন,পাহাড়-পর্বত ও লিঙ্গকে পূজনীয় মনে করে? এটি তো অন্ধকারাচ্ছন্ন মনের কাজ। মনের এ অন্ধকার নিয়ে আরবের লোকেরা এক কালে তাদের কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত। হিন্দুরা স্বামীহারা বিধবাদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করতো। ক্যাথলিক খৃষ্টানদের বিশ্বাস, শিশুর জন্মই পাপ নিয়ে। তাই বাপ্টিটিজমের নামে শিশুকে গোছল দিয়ে পবিত্র করে। কিন্তু পানিতে কি পাপ দূর হয়? পরিষ্কার হয় কি চেতনা ও চরিত্রের ময়লা? পবিত্র হয় কি মন? বিপ্লব আসে কি আচরনে? চারিত্রিক বিপ্লব তো দেহ ধৌত করায় আসে না। বিচিত্র বেশধারণ বা দেব-দেবী, সাধুসন্নাসী ও ভগবানের নামে নানারূপ রূপকথা, লোককথা বা অলৌলিক কিচ্ছাকাহিনী পাঠেও আসে না।

চরিত্র জন্ম নেয় চেতনার ভূমিতে। চেতনার সে ভূমি দুষ্ট চিন্তা ও দর্শনে অধিকৃত হলে চরিত্রে আসে দুর্বৃত্তি ও মিথ্যাচার। স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ, জাতিয়তাবাদ, বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ ও কম্যুনিজমের ন্যায় ইতর মতবাদের জন্ম তো দুষ্ট দর্শনের কারণে। মানবের কল্যাণে এজন্যই অপরিহার্য হলো এমন এক বিপ্লবী দর্শন যা মানব মনের গভীরে প্রবেশ করে এবং আঘাত হানে চিন্তা-চেতনার মূল ভূমিতে। এবং বিলুপ্ত করে ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নামে জমে উঠা অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারের বিশাল আবর্জনাকে। চেতনার ভূমিতে পরিশুদ্ধি ও বিপ্লব এলেই পরিশুদ্ধি ও বিপ্লব আসে চরিত্রে। তখন বিপ্লব আসে রাষ্ট্রজুড়ে। এভাবেই তো উচ্চতর সভ্যতা নির্মিত হয়। ইসলামের আগমনে আরবের আলো-বাতাস, জলবায়ু ও খাদ্যপানীয়ে বিপ্লব আসেনি। বরং বিপ্লব এসেছিল তাদের চেতনার ভূমিতে। এবং সেটি কোরআনী জ্ঞানের আলোকে। ফলে আরবের বুকে গড়ে উঠেছিল মানব ইতিহাসের সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। হজ্ব তো সে বিপ্লবী দর্শন ও সৃষ্টিশীল ধ্যানমগ্নতা দেয়।

মানব জীবনে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বা বিপর্যয়টি খাদ্যাভাবে বা অর্থাভাবে আসে না। ভগ্ন স্বাস্থ্যেও নয়। সেটি আসে সত্যকে খুঁজে না পাওয়া বা সত্য থেকে বিচ্যুতি তথা পথভ্রষ্টতার কারণে। অপর দিকে মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যানটি আসে সত্যকে খুঁজে পাওয়া, সে সত্যের পূর্ণ অনুসরণ ও বিভ্রান্তু থেকে মুক্তির মধ্য দিয়ে। মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার তাই বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক আবিস্কার নয়। বরং সেটি হলো জীবন ও জগতের স্রষ্টা নিয়ে সত্যের আবিষ্কার। যারাই সত্যের আবিস্কারে সফল হয় তারাই সাফল্যের সিরাতুল মুস্তাকীম। আর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি হলো সে সত্যকে না চেনা,বা সেটিকে খুঁজে না পাওয়ার ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতা জীবনের অন্য সকল সফলতাকে বিফল করে দেয় এবং অবশেষে জাহান্নামের আগুণে হাজির করে। তখন সমাজ এবং রাষ্ট্র ভরে উঠে দুর্বৃত্তদের দিয়ে। দুনিয়ার বুকে তখন জাহান্নামের আযাব নেমে আসে। অপর দিকে সত্য-আবিস্কার ও সত্যের পথে চলার সফলতাটিই এ জীবনের সকল ব্যর্থতা ভূলিয়ে অনন্ত অসীম কালের জন্য জান্নাতপ্রাপ্তির অন্তহীন আনন্দ দেয়। এর চেয়ে বড় বিজয় এ জীবনে আর কি হতে পারে?

 

অনুকরণীয় মডেলঃ কেন অপরিহার্য?

ইতিহাসের আরেক সত্য হলো, ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে বিপ্লবের জন্য শুধু বিপ্লবী দর্শনই জরুরী নয়, অপরিহার্য হলো এমন কিছু বিপ্লবী মহানায়ক যারা শুধু কথা দিয়ে নয়, নিজেদের কর্ম, চরিত্র ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েও মানুষকে পথ দেখায়। যাদের কর্ম ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে তাদের সত্য-সুন্দর দর্শনটি কথা বলে। তখন তাদের সে দর্শনটি জানতে বই পড়তে হয় না, তাদের কর্মময় জীবনই দর্শনের বই’য়ে পরিণত হয়। এবং তাদের কারণেই অন্যরা অনুকরণীয় আদর্শ ও উন্নত চরিত্র পায়। মানব ইতিহাসের সে আদর্শ মহানায়কগণ হলেন নবী-রাসূলগণ। এবং তাঁরাই অনুকরণীয় মডেল রূপে নিয়োগপ্রাপ্ত মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। প্রতিটি ব্যক্তির অপরিহার্য দায়িত্ব হলো তাদের প্রদর্শিত পথে চলাকে নিজ জীবনের মিশন বানিয়ে নেয়া। এটিই মু’মিনের ঈমানদারি। ব্যক্তি একমাত্র এভাবেই পায় সিরাতুল মুস্তাকীম। পায় নিজ জীবনে পরিশুদ্ধি ও পবিত্রতা। এবং পরকালে পায় নেয়ামত ভরা জান্নাত। পবিত্র কোরআনে তাই বলা হয়েছেঃ “তিনিই সেই মহান আল্লাহ যিনি উম্মীদের মাঝে তাদের মধ্য থেকেই একজনকে রাসূল নিযুক্ত করেছেন যিনি তাদের সামনে পাঠ করে শোনান তাঁর আয়াত এবং তাদের মধ্যে আনেন পরিশুদ্ধি ও পবিত্রতা, এবং শিক্ষা দেন কিতাব এবং প্রজ্ঞা। এবং এর পূর্বে তারা ছিল সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে।”–(সুরা জুমু’আ, আয়াত ২)।

ব্যক্তি বা রাষ্ট্রীয় বিপ্লবে এমন আদর্শনীয় ব্যক্তিদের গুরুত্ব অপরিসীম। যে ব্যক্তি জীবনে নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ও জিহাদের নির্দেশ শুনেছে কিন্তু কোনদিনই কাউকে সেগুলি পালন করতে দেখেনি, সে কী করে সেগুলি পালন করবে? তাই মানব জাতিকে পথ দেখাতে মহান আল্লাহতায়ালা শুধু আসমানি কিতাবই নাযিল করেননি, বরং সমাজের মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে রাসূল রূপে নিযুক্ত করেছেন। তাই ইসলাম শুধু মহান আল্লাহতায়ালার উপর বিশ্বাসকেই অপরিহার্য করে না,বরং অপরিহার্য করে নবীরাসূলদের বিশ্বাস করা ও তাদেরকে মেনে চলাকেও। পবিত্র কোরআনে তাই “আতিউল্লাহ”র সাথে “আতিউর রাসূল” ফরজ করা হয়েছে। ঈমানদার ব্যক্তি নামায-রোযা, হজ-যাকাত, জিহাদসহ ইবাদত পালনের হুকুম পায় পবিত্র কোরআন থেকে; কিন্তু সেগুলি কিভাবে পালন করতে হয় সেটি বাস্তবে দেখিয়ে গেছেন মহান নবীজী (সাঃ)। ইবাদতের নামে এর বাইরে নিজেদের মনগড়া কোন নিয়ম চালু করা এজন্যই ইসলামে হারাম।

 

হযরত ইব্রাহিম (আঃ): শ্রেষ্ঠ মডেল

সমগ্র মানব-ইতিহাসে বিশ্বজগতের স্রষ্টা এবং মানব জীবনের মূল এজেন্ডা আবিস্কারে সবচেয়ে সফল ও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্তটি রেখেছেন হযরত ইব্রাহিম (আঃ)। হজ্বের মঞ্চে তিনিই প্রধান চরিত্র। তাঁর মূল কৃতিত্বটি হলো, ঘরসংসার, পানাহার, রুটিরুজী বা পেশাদারীর সন্ধানে তিনি হারিয়ে যাননি। বরং তাঁর জীবনে প্রবল তাড়নাটি ছিল এ বিশ্বজগতের প্রকৃত স্রষ্টা ও এ জীবনের মূল এজেন্ডাকে জানার। তাঁর সে প্রচেষ্ঠা ব্যর্থ হয়নি। তিনি যেমন মহান আল্লাহতায়ালাকে এ বিশ্বজগত ও সকল সৃষ্টিকূলের লা-শরিক স্রষ্টা রূপে সনাক্ত করেন, তেমনি তাঁর প্রতিটি হুকুমের প্রতি আত্মসমর্পণকে মানব জীবনের মূল এজেন্ডা রূপে নির্ধারণ করেন। মহান আল্লাহতায়ালাতে পুরাপুরি আত্মসমর্পিত সে ব্যক্তিকে ‘মুসলিম’ রূপে অভিহিত করাটিও তাঁর নিজের আবিস্কার। এভাবে তিনি দেখিয়েছেন মানব জীবনের প্রায়োরিটি। ঘর বাধা, সন্তান পালন ও পানাহারের প্রচেষ্ঠা তো পশুপাখির জীবনেও থাকে। মানবের মানবতা ও শ্রেষ্ঠত্ব তো সত্যকে গ্রহণ এবং মিথ্যাকে বর্জন করে বাঁচায়। এটিই ছিল হযরত ইব্রাহিম (আঃ)’য়ের জীবনের মূল মিশন। সত্যের আবিস্কারে তাঁর সে অবিরাম ভাবনা মহান আল্লাহতায়ালাকে এতটাই খুশি করেছিল যে সে ভাবনাকে অমর করতে এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য তাঁকে অনুকরণীয় আদর্শ করতে তিনি পবিত্র কোরআনে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। এই একটি মাত্র কারণেই তিনি সমগ্র মানব ইতিহাসে অতি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ)’য়ের জন্ম কোন পয়গম্বরের ঘরে হয়নি। বরং জন্ম হয়েছিল এক পৌত্তলিক পিতার ঘরে। মুর্তিপুজা ও মুর্তিনির্মাণই ছিল তার পেশা। সে সাথে ছিল নমরুদের দুর্বৃত্ত শাসন। সত্যের অনুসন্ধান এবং সত্যের পথে  চলা সে পরিবেশে অতি দণ্ডণীয়  অপরাধ গণ্য হতো। কিন্তু  সে দুষ্ট পরিবেশে জন্ম নিয়েও পৌত্তলিকতার স্রোতে তিনি ভেসে যাননি। বরং সত্যের আবিস্কারে তিনি নিজের সকল প্রতিভা ও সামর্থ্যকে নিয়োজিত করেছিলেন। বস্তুতঃ তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি হলো, চলমান মিথ্যার স্রোতে ভেসে না যাওয়া। যখন তিনি এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালাকে খুঁজে পেলেন তখন তিনি সে সত্যকে নিয়ে নীরবে বসে থাকেননি। বরং শুরু হয় জীবনের প্রতি পদে তাঁর হুকুম মেনে চলায় প্রচন্ড আপোষহীনতা। মহান আল্লাহতায়ালার পথে চলায় জীবন দানও তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল। নমরুদের বাহিনী যখন জ্বলন্ত আগুনে ফেলে তাঁকে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল তখনও মানব ইতিহাসের এ মহান ব্যক্তিটি সত্য থেকে সামান্যতম বিচ্যুত হননি। এমন কি নিজের একমাত্র শিশুপুত্র ইসমাঈলের কোরবানীর হুকুম এলো তখনও সে হুকুম পালনে তিনি সামান্যতম ইতস্ততঃ করেননি।?

শত্রুর মোকাবেলায় হযরত ইব্রাহিম (আঃ)এর অধীনে নিজের কোন সেনাদল বা ক্যাডারবাহিনী ছিল না। ভক্তদের বিশাল কোন দলও ছিল না। তিনি ছিলেন একা। অথচ একাকী হয়েও তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন স্বৈরশাসক নমরুদ, নমরুদের আজ্ঞাবহ সেনাবাহিনী ও তার অনুসারি পৌত্তলিক সমাজ ও জনগণের বিরুদ্ধে। ঈমানদারদের থেকে মহান আল্লাহতায়ালার তো সেটিই প্রত্যাশা। লোকবলের অপেক্ষায় বসে থাকাটি ঈমানদারি নয়। পবিত্র কোরআনে নবীজী (সাঃ)র প্রতি সে নির্দেশটি এসেছে এভাবেঃ “বলুন (হে মুহাম্মদ), তোমাদের প্রতি আমার একটি মাত্র নসিহত, (সেটি হলো) খাড়া হয়ে যাও আল্লাহর জন্য, সঙ্গি পেলে তাকে নিয়ে নতুবা একাকীই।” –(সুরা সাবা, আয়াত ৪৬)। মহান আল্লাহতায়ালার উপর হযরত ইব্রাহিম (আঃ)’য়ের বিশ্বাস যে কতটা অটল ছিল এবং তাঁর দ্বীন অনুসরণে তিনি যে কতটা নির্ভীক ও আপোষহীন ছিলেন –সে সাক্ষ্যটি এসেছে খোদ মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। নিজের সে সাক্ষ্যকে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন পবিত্র কোরআন। বিশ্বের তাবত সত্যান্বেষী মানুষের জন্য এ মহান যোদ্ধাকেই তিনি আদর্শরূপে খাড়া করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালার সে পবিত্র ঘোষণাটি হলোঃ “তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে ইব্রাহিম ও তার সঙ্গিদের মাঝে” –(সুরা মুমতিহানা আয়াত ৪)। কিন্তু কেন তিনি উত্তম আদর্শ সে কারণটি তুলে ধরা হয়েছে উপরুক্ত আয়াতেরই বাঁকি অংশে। নিজের পরিবার ও দেশবাসীর উদ্দেশ্যে হযরত ইব্রাহিম (আঃ)’য়ের সে অবিস্মরণীয় ঘোষণাটি ছিল এরূপঃ “আমি নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করছি তোমাদের থেকে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যা কিছুর ইবাদত করো তা থেকে। আমার বিদ্রোহ তোমাদের বিরুদ্ধে। শুরু হলো, তোমাদের সাথে আমার অবিরাম যুদ্ধ ও শত্রুতা যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর একাত্ব অস্তিত্বকে মেনে না নিচ্ছো”।

মহান আল্লাহতায়ালা মানব ইতিহাসের এ সত্যসন্ধানী, সাহসী, জিহাদী ও আল্লাহর পথে অবিচল এ মহান ব্যক্তিকে সম্মানিত করেছেন শুধু মানবজাতির জন্য আদর্শ রূপে ঘোষণা দিয়ে নয়, বরং তাঁকে নিজের বন্ধু রূপে গ্রহন করার মধ্য দিয়েও। প্রশংসা করেছেন তাদেরও যারা তাঁর সে মহান আদর্শকে অনুসরণ করে। তাই পবিত্র কোরআনের ঘোষণাঃ “তাঁর অপেক্ষা দ্বীন পালনে কে উত্তম যে সৎকর্মপরায়ণ হয়ে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং একনিষ্ঠ ভাবে ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করে? এবং আল্লাহ ইব্রাহিমকে নিজের বন্ধু রূপে গ্রহণ করেছেন।”-(সুরা নিসা, আয়াত ১২৫)। সত্যের অন্বেষণ ও অনুসরণে প্রবল সদ্বিচ্ছা ও লাগাতর প্রচেষ্টা থাকলে আল্লাহর সাহায্য লাভও ঘটে। তখন সফলতাও জুটে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ)এর জীবনের সেটিও আরেক শিক্ষা। মানুষ তো পুরস্কার পায় তার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা কারণে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ মহান আল্লাহতায়ালার বন্ধু হওয়ার সৌভাগ্য পেয়েছেন তো সে মহান নিয়েত ও প্রচেষ্টার বলেই।

হযরত ইব্রাহিমকে মহান আল্লাহতায়ালা ভূষিত করেছেন মুসলিম মিল্লাতের আদি পিতা রূপে। অথচ মানব ইতিহাসে প্রতিভাধর ব্যক্তির সংখ্যা কি কম? তাদের হাতে আবিষ্কারের সংখ্যাও কি কম? কোরআন নাযিলের শত শত বছর আগেও এসব প্রতিভাধরদের হাতে মিশরের পিরামিড, চীনের প্রাচীর ও ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগিচা নির্মিত হয়েছে। ইতিহাসে সেগুলো বিস্ময়কর আবিস্কার রূপে স্বীকৃতিও পেয়েছে। কিন্তু মানব-প্রতিভার সে বিনিয়োগ নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা খুশি হননি,কারণ সে প্রতিভাবান মানুষেরা ব্যর্থ হয়েছে সত্যকে খুঁজে পাওয়ার ন্যায় অতি মৌলিক কাজে। আজও  কি এরূপ প্রতিভাধারিদের ব্যর্থতা কম? বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে তারা নবেল প্রাইজ পেলেও সত্যকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা আদিম বর্বর যুগের মানুষের ন্যায়ই মুর্খ। তাদের সে মুর্খতা কি হাজার হাজার বছর আাগের উলঙ্গ গুহাবাসীর চেয়ে কম? ফলে তাদের জীবনে বেড়েছে সত্য-চ্যুতি ও বিভ্রান্তি। অসভ্য গুহাবাসীর ন্যায় তাদের জীবনেও এসেছে তাই আদীম অজ্ঞতা ও পাপাচার। সনাতন মিথ্যা তো আজও  বেঁচে আছে মিথ্যার পক্ষে এসব প্রতিভাধারিদের অস্ত্র ধরার কারণে।এসব প্রতিভাবান আবিষ্কারকদের দুস্কৃতির কারণেই বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ দিতে হয়েছে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে। তারা আজও  হত্যা পাগল ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মিরসহ বিশ্বের নানা প্রান্তরে। আজও তাদের হাতে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। হাজার হাজার নারীকে তাই আজও ধর্ষিতা হতে হচ্ছে। মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় বড় ক্ষতিগুলো হয়েছে সত্য আবিষ্কারে ব্যর্থতা ও ভ্রান্ত পথে মেধার বিপুল বিনিয়োগের ফলে। তাই সত্য আবিস্কারে হযরত ইব্রাহীমের নানা প্রচেষ্টার কথা পবিত্র কোরআনে বার বার বর্নিত হলেও এসব প্রতিভাধর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকদের নিয়ে এক ছত্র উল্লেখও নাই। মহান আল্লাহতায়ালা জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনে শুধু চোর-ডাকাত,খুনি,ব্যাভিচারি ও সন্ত্রাসীদেরই নিক্ষেপ করবেন না,নিক্ষেপ করবেন সত্য আবিস্কারে ও সত্যের অনুসরণে যারা বিফল তাদেরও। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় বন্ধু এবং মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্য-আবিষ্কারক হযরত ইব্রাহিম (আঃ)কে সমগ্র হজ্ব অনুষ্ঠানের মধ্যমঞ্চে রেখে বিশ্ববাসীকে বহু কিছুই শেখাতে চান।সে মূল শিক্ষাটি হলো,সত্যের আবিস্কার ও সত্যের আপোষহীন অনুসরণে আমৃত্যু লেগে থাকার। সেটি সত্যের শত্রুর বিরুদ্ধে লাগাতর লড়াইয়ের। সে সাথে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের কাছে আজীবন আত্মসমর্পণের। সেটিই হযরত ইব্রাহিম (আঃ)র পবিত্র সূন্নত। হজ্বের এখানেই অনন্যতা। কারণ, হজ্বে পালিত হয়, হযরত ইব্রাহিম (আঃ)’য়ের সূন্নত। হজ্ব এজন্যই মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় অনুষ্ঠান।

 

 

মহড়া বিশ্বজনীন মুসলিম ভাতৃত্বের

ঈমানের প্রকাশ শুধু নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ও দান-খয়রাতে ঘটে না। সেটির প্রবল প্রকাশ ঘটে বিশ্বজনীন মুসলিম ভাতৃত্বের মধ্য  দিয়ে। তাই ইসলামের গৌরব যুগে বিলুপ্ত হয়েছিল ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও ভৌগলিক ভিন্নতার ভিত্তিতে গড়ে উঠা বিভক্তির দেয়াল। মুসলিম ভূগোলে বিভক্তির দেয়াল বস্তুত ইসলাম থেকে দূরে সরার আলামত। মুসলিমগণ যখনই ইসলাম থেকে দূরে সরা শুরু করেছে তখনই ঐক্যের বদলে গড়ে উঠেছে অনৈক্য। প্রতিবছর মুসলিম জীবনে হজ্ব আসে ইসলামের বিশ্বজনীন ভাতৃত্বের ছবক নিয়ে। এবং সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয়, ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও ভৌগলিক পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভক্ত মানচিত্র নিয়ে বাঁচাতে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে কোন পুরস্কার নাই। বরং সেরূপ বিভক্তির জন্য অনিবার্য প্রাপ্তিটি হলো কঠিন আযাব। সে হুশিয়ারিটি এসেছে এভাবে, “এবং তোমরা কখনোই তাদের মত হয়োনা যারা (আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে) সুস্পষ্ট বিধান আসার পরও বিভক্ত হলো; এবং তাদের জন্য রয়েছে বিশাল আযাব।” –(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১০৫)।

উপরুক্ত আয়াতের উপর যার বিশ্বাস আছে সে কি ভাবতে পারে, মুসলিম দেশে বিভক্তি আসবে অথচ আযাব আসবে না? তাছাড়া প্রশ্ন হলো, মুসলিম বিশ্বের ৫৭টি রাষ্টে বিভক্ত মানচিত্রটি উম্মহর জীবনে কোন গৌরবটি বাড়িয়েছে? এ বিভক্তির ফলে মুসলিম ভূমিতে শত্রুর অধিকৃতি, রাজনৈতিক গোলামী, নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, ঘর-বাড়ী থেকে উচ্ছেদ এবং ধ্বংসের তাণ্ডবই কি শুধু বাড়েনি? এগুলিকে কি আল্লাহর রহমত বলা যায়? অথচ আজকের মুসলিমদের প্রতিদিনের বসত তো এ আযাবগুলি নিয়েই। এবং যতদিন ত বিভক্ত থাকবে ততদিন এ আযাব ও অপমান থেকে যে মুক্তি নাই তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে?  অথচ মুসলিমদের মাঝে নানা বর্ণ, নানা ভাষা, নানা গোত্র ও নানা রূপ ভৌগলিক ভিন্নতা ইসলামের গৌরবযুগেও ছিল। কিন্তু তা নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভক্তির রাষ্ট্রীয় দেয়াল গড়া হয়নি। মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুত আযাব থেকে বাঁচতে প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ হলো দেয়াল ভাঙ্গার কাজে নিজ নিজ মেধা ও সামর্থ্যের বিনিয়োগ, দেয়াল গড়ার কাজে নয়। তাই ঈমানদারের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো, প্যান-ইসলামিক ভাতৃত্বের বন্ধনে একতা গড়া। সে ছবকটি দিতেই মহান আল্লাহতায়ালা হজ্বের দিনগুলিতে মক্কার বুকে নানা বর্ণ, নানা গোত্র ও নানা ভাষার মানুষকে পৃথিবীর নানা প্রান্তর থেকে একই মঞ্চে হাজির করেন। হজ্বের এটি এক অনন্য শ্রেষ্ঠত্ব। হজ্বের মঞ্চে পৃথিবীর সবচেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিটি যেমন জমা হয়, তেমনি তার পাশেই খাড়া হয় সবচেয়ে শেতাঙ্গ ব্যক্তিটিও। এভাবেই প্রকাশ ঘটে প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্বের। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে হজ্ব করতে এসে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষকে হৃদয় কাঁপানো “লাব্বায়েক” (আমি হাজির) বলতে শোনে এবং ক্বাবাকে ঘিরে তাওয়াফ করতে দেখে -তখন তাঁর ঈমান আরো গভীরতর হয়। এবং দৃঢ়তর হয় তাঁর আত্মবিশ্বাস। তখন বুঝতে পারে, মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে সে একা নয়, সাথে রয়েছে বহুদেশের বহুবর্ণের কোটি কোটি মানুষ। এরূপ অনুভুতি কি বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন মানুষের জীবনে আসে?

একতার মধ্যেই বিস্ফোরণ ঘটে শক্তির, বিভক্তিতে নয়। একতা যে ইসলামে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, হজ্ব হলো তারই নিদর্শন। হজ্বের একই মঞ্চে জমা হয় নানা দেশের শিয়া-সূন্নী,হানাফী-শাফেয়ী,হাম্বলী-মালেকী,দেউবন্দী-বেরেলভীগণ। তাদের মাঝে ফেকাহগত বিরোধ থাকলেও হজ্ব নিয়ে কোন বিরোধ নাই। সুযোগ নেই, হজ্বের দিন-ক্ষণ নিয়ে বিরোধের। কারণ, সেগুলী বেঁধে দিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। এমন মহামিলন ও এমন আচার কি আর কোন ধর্মে আছে? বাঙালী হিন্দুর দুর্গা পুজায় কি কোন বিহারী,গুজরাতী,মারাঠি বা পাঞ্জাবী হিন্দু যোগ দেয়? আবাঙালী হিন্দুর দেউয়ালীতেই বা ক’জন বাঙালী যোগ দেয়? তেমনি কাথলিক খৃষ্টানদের কোন অনুষ্ঠানে কি ইউরোপীয় প্রটেষ্টান্ট,মিশরীয় কপটিক,গ্রীক অর্থোডক্স বা আর্মেনিয়ান খৃষ্টানগণ নজরে পড়ে? খৃষ্টান ধর্মে কি এরূপ কোন অনুষ্ঠান আছে যেখানে ইউরোপীয় খৃষ্টানদের সাথে আফ্রিকান বা ভারতীয় খৃষ্টানদের যোগ দেয়াটি ফরজ?

অন্য ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি তো এভাবে বেঁচে আছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা,বর্ণ ও ভূগোলের পরিচয় নিয়ে। হিন্দু ধর্ম,বৌদ্ধ ধর্ম,শিখ ও জৈন ধর্মের ন্যায় বহু ধর্মের ভিত্তিটা এতটাই বর্ণ ও আঞ্চলিকতায় আচ্ছন্ন যে এসব ধর্মের অনুসারিদের মাঝে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ও ইউরোপ-আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের খুঁজে পাওয়া কঠিন। এভাবে এ ধর্মগুলি কাজ করেছে মানব সমাজে বিভক্তি, সংঘাত ও অকল্যাণ বাড়াতে। অথচ হজ্ব শেখায় বিশ্বজনীন ভাতৃত্ব। শেখায়, নানা ভাষা, বর্ণ ও রাষ্ট্রের নামে গড়া বিভক্তির প্রাচীর ভাঙ্গতে।একতা গড়ার মিশনটি জোরদার করতেই হজ্ব পৃথিবীর সকল দেশ ও সকল ভাষার মুসলমানদের একই সময়ে,একই সাথে একই মঞ্চে হাজির করে। আল্লাহর বিধান যে কতটা নিখুঁত ও কল্যাণধর্মী -এ হলো তারই নমুনা। অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানগুলির ন্যায় হজ্ব নিছক ধর্মীয় আচার নয়। পাদ্রী ও পুরোহিতের মন্ত্র পাঠে তা শেষ হয় না। এ অনুষ্ঠানে তাই কোন পুরোহিত নাই, কোন ইমামও নাই। বহু শ্রম, বহু অর্থ ব্যয়ে নিজের হজ্ব নিজেকেই পালন করতে হয়। হজ্ব দেয় মহান আল্লাহতায়ালার পথে আত্মত্যাগ ও কষ্টস্বীকারের শিক্ষা। শুরুটি হয় দীর্ঘ দিন যাত্রাপথের শারিরীক ক্লেষ ও বিপুল অংকের অর্থব্যয় দিয়ে। এভাবে হজ্ব গড়ে শুধু সম্পদ-ব্যয়ের অভ্যাসই নয়, শারিরীক কসরতেরও।

 

 

হজ্ব ও মুসলিম উম্মাহর ব্যর্থতা

যে পাঁচটি খুঁটির উপর ইসলামের ভিত্তি, তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি হলো হজ্ব। তাই হজ্বকে বাদ দিয়ে ইসলামের পূর্ণ ইমারত নির্মাণ করা যায় না। এবং ইসলামের এ বিশাল ইমারতটি ধ্বসিয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজন নেই পাঁচটি খুঁটির সবগুলি ধ্বংসের, যে কোন এই একটি খুঁটির বিনাশই সে জন্য যথেষ্ট? প্রশ্ন হলো, হজ্ব যে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান -সে চেতনাটি ক’জন মুসলিমের? মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ এ আয়োজন থেকে শিক্ষা হাসিলের আয়োজনই বা কতটুকু? হজ্ব পালিত হয় জিলহজ্ব মাসের ৮ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত লাগাতর নানা পর্ব দিয়ে। হজ্বের সাথে আসে ঈদুল আযহা। হজ্ব পর্বটি মক্কা শরীফে পালিত হলেও ঈদুল আযহা পালিত হয় সমগ্র বিশ্বজুড়ে। হজ্বের শিক্ষাটিই বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয় এই ঈদুল আযহা। কিন্তু কি সে শিক্ষা? কি এর দর্শন? ঈদুল আযহা কি শুধু পশু কোরবানী? ছোট্ট একটি সামাজিক অনুষ্ঠানেরও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। হজ্বের লক্ষ্য কি স্রেফ হজ্ব পালন? বহু অর্থ ও বহু শ্রম ব্যয়ে বিশ্বের নানা দেশ থেকে প্রায় তিরিশ লাখ মানুষ কেন মক্কায় হাজির হয়? সামর্থ্যবানদের উপর কেন এটি ফরজ? ক্বাবাকে ঘিরে কেন ৭ বার তাওয়াফ? কেন মিনায় তিন দিন অবস্থান? আরাফাতে কেন মহাজমায়েত? মোজদালেফায় খোলা অকাশের নিচে কেন শয়ন? শয়তানের স্তম্ভে কেন তিন দিন ধরে পাথর নিক্ষেপ? কেন সাফওয়া ও মারওয়ার মাঝে নারী-পুরুষ,যুবক-বৃদ্ধার দৌড়াদৌড়ি? সেটিও একবার নয়,সাতবার!কেন লক্ষ লক্ষ পশু কোরবানী? এগুলি কি নিছক আচার? এগুলির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ কোন দর্শন ও উদ্দেশ্য থাকলে সেটিই বা কি? যে ইবাদতে এত অর্থব্যয়, শ্রমব্যয় ও সময়ব্যয় তা থেকে মুসলিম উম্মাহই বা কতটুকু লাভবান হচ্ছে? প্রতিবছর হাজী হয়ে ফিরছে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ,তাতেই বা তাদের কি কল্যাণ হচ্ছে? বিষয়গুলি অতিশয় ভাবনার। কিন্তু মুসলমানদের মাঝে সে ভাবনা কই? হজ্বের প্রতিপর্বের প্রতিটি অনুষ্ঠানের মূল পরিকল্পনাকারি যে মহান আল্লাহতায়ালা সে হুশ বা ক’জনের?

ব্যক্তির উপর অর্পিত দায়ভারটি যখন গুরুত্বপূর্ণ হয় তখন তাকে ময়দান নামতে হয় পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে। বস্তুতঃ প্রশিক্ষণ হয় দায়িত্বের গুরুত্ব অনুসারে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের জন্য এ কারণেই চলে লাগাতর ট্রেনিংয়ের কার্যক্রম। এদিক দিয়ে একজন ঈমানদারের উপর অর্পিত দায়িত্বটি তো গুরুতর। সে দায়িত্বটি কোন রাজা বা শাসক বা কোন কোম্পানীর বেতনভোগী কর্মচারি হওয়া নিয়ে নয়। বরং সেটি খোদ মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা তথা ভাইসরয় রূপে দায়িত্ব পালনের। সুনির্দিষ্ট সে দায়ভারটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা। মজুরীটি এখানে লাখ বা কোটি টাকার নয়; বরং নেয়ামত ভরা জান্নাতের। ফলে এরূপ বিশাল দায়িত্বপ্রাপ্ত  খলিফাদের ট্রিনিংয়ের আয়োজনটি যে বিশাল ও নিবীড় হবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? পবিত্র কোরআনের গভীর জ্ঞানার্জন, প্রতিদিনের ৫ ওয়াক্ত নামায, মাসভর মাহে রামাদানের রোযা, হজ্ব, যাকাত ও লাগাতর জিহাদ তো সে প্রশিক্ষণেরই প্যাকেজ। প্রতিটি ঈমানদারের উপর ফরজ হলো এ প্রশিক্ষণে নিয়মিত অংশ নেয়া। প্রশিক্ষণ দেয় আধ্যাত্মীকতা, দেয় আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনের সামর্থ্য। দেয় সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রূপে বেড়ে উঠার যোগ্যতা।

মহান আল্লাহতায়ালা চান, প্রতিটি ঈমানদার নারী ও পুরুষ সে প্রশিক্ষন নিয়ে বেড়ে উঠুক। কারণ, একমাত্র সে ভাবে বেড়ে উঠার মধ্যেই মু’মিন ব্যক্তির সফলতা। তখন সে সফল হয় পৃথিবী পৃষ্ঠে খেলাফতের দায়িত্বপালনে। যার মধ্যে সে প্রশিক্ষণ গ্রহণে আগ্রহ নাই, বুঝতে হবে তাঁর মাঝে আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনেও কোন আগ্রহ নাই। এমন ব্যক্তি পরকালে কি পুরস্কার পেতে পারে? আল্লাহপাক তো মু’মিনের জীবনে তাঁর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনের সফলতাটিই দেখতে চান। মু’মিন জান্নাত পাবে খেলাফতের দায়িত্ব পালতে সফল হওয়ার বিনিময়ে। যার মধ্যে সে প্রশিক্ষণ নাই, বুঝতে হবে তার মধ্যে আল্লাহর খলিফা রূপে দায়িত্বপালনের সামর্থ্যও নাই।

প্রশিক্ষণের অঙ্গণে হজ্বের অবদানটি অপরীসীম। প্রশিক্ষণের এটি এক অতি নিবীড় ও গভীর কার্যক্রম। হজ্বের প্রতিটি বিধান বেঁধে দেয়া হয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। উচ্চমানের কোন প্রাসাদ গড়তে আর্কিটেক্টের আঁকা নকশা লাগে, তেমনি উচ্চ চরিত্র গড়তে কাঙ্খিত চরিত্রের মডেল লাগে। হজ্বের মঞ্চে শ্রেষ্ঠ চরিত্র ও অনুপ্রেরণার সে মডেল রূপে খাড়া হয় হযরত ইব্রাহিম (আঃ)কে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তাঁর  চরিত্রের মধ্যে আছে বিশেষ শিক্ষণীয় দিক। সমগ্র অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর পরিকল্পনা ও নির্দেশনায়,তাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ জমায়েতের পরিকল্পনা ও পরিচালনা নিয়ে কোন বিরোধ নাই। ফলে হজ্বের সাথে অন্যধর্মের কোন অনুষ্ঠানের কি তুলনা হয়? সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যার মধ্যে হজ্ব নাই, বুঝতে হবে আল্লাহর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনে তার মধ্যে কোন আগ্রহ নেই। অথচ সে আগ্রহটি মুসলিম হওয়ার জন্য অতিজরুরী। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ্ব না করে যার মৃত্যু হলো সে খৃষ্টানরূপে না ইহুদীরূপে মারা গেল তা নিয়ে তাঁর কিছু  যায় আসে না।” অর্থাং তার জন্য নবীজী (সাঃ)সুপারিশ করতে রাজি নন। বোখারী শরীফের হাদীসে বর্নীত হয়েছে, নবীজী (সাঃ) হযরত আয়েশাকে বলেছেন,হজ্বই তাঁর জন্য জিহাদ।

 

 

হজ্ব কেন শ্রেষ্ঠ ইবাদত?

ইসলামে প্রতিটি ইবাদতই অতি গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম রূপে বাঁচতে হয় এ ইবাদতগুলি নিয়েই। তবে সেগুলির মাঝে কোনটি শ্রেষ্ঠ ইবাদত তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন। সে প্রশ্ন জেগেছিল ইমাম হযরত আবু হানিফার (রহ) মনেও। হজ্ব সমাপনের পর তিনি বলেছেন, হজ্বই শ্রেষ্ঠ ইবাদত। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (রহ) বলেছেন,যাদের মনে আল্লাহতায়ালার প্রতি প্রবল ভালোবাসা,তারা তৃপ্তি পেতে পারেন হজ্বে গিয়ে। কিন্তু তবুও প্রশ্ন থেকে যায়,হজ্ব কেন শ্রেষ্ঠতম ইবাদত? কেনই বা এটি আল্লাহতায়ালার আশেকদের আত্মতৃপ্তি লাভের মাধ্যম? ইসলামে ইবাদত মূলতঃ দৈহিক, আর্থিক ও আত্মীক। একমাত্র হজ্বেই ঘটে সবগুলোর সমন্বয়। হজ্বের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই। কালেমায়ে শাহাদত উচ্চারনে দৈহিক কসরত নেই। তাতে অর্থব্যয়ও নেই। এতে পাহাড়-পর্ব্বত,বিজন মরুভুমি, নদনদী বা সমুদ্র-মহাসমুদ্র অতিক্রমেরও প্রয়োজন পড়ে না। তেমনি হজ্বের যে দৈহিক কসরত ও অর্থ ব্যয় -সেটি জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নামায আদায়ে নেই। এতো কষ্টস্বীকার, অর্থব্যয় ও সময়ব্যয় রোজাতেও হয় না। যাকাতে অর্থব্যয় হলেও তাতে হজ্বের ন্যায় অর্থব্যয় নেই। শ্রমব্যয় এবং সময়ব্যয়ও নেই। বস্তুতঃ হজ্বের মধ্যে রয়েছে ইবাদতের সমগ্রতা তথা পূর্ণ প্যাকেজ। এ যুগে বিমানযোগে হজ্বের যে সুযোগ সেটি নিতান্তই সাম্প্রতিক। বিগত চৌদ্দ শত বছরের প্রায় সমগ্রভাগ জুড়ে মুসলমানরা হজ্ব করেছে পায়ে হেঁটে বা উঠ,ঘোড়া ও গাধার মত যানবাহনে চড়ে। তখন দৈহিক ক্লান্তির ভারে হজ্বে গিয়ে অনেকেই আর নিজ ঘরে ফিরে আসতেন না,পাড়ী জমাতেন পরপারে। তাই সে আমলে শেষ বিদায় নিয়ে দূর-দেশের লোকেরা মক্কার পথে বেরুতেন। হজ্ব পালনে যে প্রচন্ড শারিরীক কসরত তার মূল্যয়াণ করতে হবে সে আঙ্গিকেই।

তাছাড়া হজ্বের শ্রেষ্ঠতর হওয়ার আরেকটি কারণ, এখানে আছে আরাফা’র সমাবেশ। প্রতিশ্রুতি রয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে দোয়া করলে দোয়া কবুলের। প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে অতীতের সকল পাপমোচনের। বলা হয়েছে, শিশু যেমন নিষ্পাপ জন্মগ্রহণ করে, পবিত্র হজ্ব পালেনর পর তেমনি নিষ্পাপ হয় হাজী। এরূপ প্রতিশ্রুতি কি নামায, রোযা ও যাকাতের ন্যায় ইবাদতে আছে? সেগুলিতে আছে কি আরাফা? আছে কি অতীত পাপমোচনের অঙ্গিকার। যারা হজ্বে যায় তাদেরকে বলা হয়, মহান আল্লাহতায়ালার মেহমান। এ এক বিশাল মর্যাদা। মানব জীবনে এর চেয়ে বড় মর্যাদা এর চেয়ে বড় অর্জন আর কি ভাবা যায়? এ জগতে যারা তাঁর মেহমান হওয়ার গৌরব অর্জন করে আখেরাতেও যে তাঁর মেহমান হবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? সে মর্যাদা কি অন্য কোন ইবাদতে হাছিল হয়? প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার মেহমান হওয়ার মর্যাদা যারা পেল তাঁরা ফিরবে পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘরে -তা কি ভাবা যায়? কোন মুসলিম ইয়াওমুল আরাফার দিনে সে ময়দানে দাঁড়িয়ে মোনাজাতে হাত তুললে মহান আল্লাহতায়ালা দোয়া কবুল না করে তাঁর হাত ফিরিয়ে দেন না, তিনি তাঁর দোয়া কবুল করেন। প্রতি মহান আল্লাহতায়ালা দোয়া কবুলের সে প্রতিশ্রুতি কোন মুনাফিককে দেননি। মুনাফিক তো তারাই যারা হ্জ্ব করে, উদাত্ত কণ্ঠে লাব্বায়েকও বলে, কোরবানিও দেয়, কিন্তু তারা বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমগুলির বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিদ্রোহ নিয়ে। দোয়া কবুলের শর্ত হলো, হজ্বটি হতে  হবে প্রকৃত মুসলিমের হজ্ব। মুসলমি তো সেই যে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমে লাব্বায়েক বলে। দোয়া কবুলের ব্যাপারে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ঘোষিত শর্তটি হলো, যে ব্যক্তি তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেন, তিনিও তার ইচ্ছা পূরণ করেন। পবিত্র কোরআনে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে, “আমার বান্দা যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, (তাঁকে বলুন) নিশ্চয়ই আমি তাঁর অতি নিকটে। (তাঁকে আরো বলুন) আমাকে যে ডাকে আমি তাঁর ডাকে জওয়াব দেই। তবে (এটিও জানিয়ে দিন) তাদেরকেও অবশ্যই আমার ডাকে সাড়া দিতে  হবে এবং অবশ্য আমার উপর ঈমান আনতে হবে। সম্ভবতঃ এতে তাঁরা সঠিক পথের নির্দেশনা পাবে।” –সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৬)।

এক্ষেত্রে মুসলিমদের ব্যর্থতা কি কম? নিজেদের ইচ্ছা পূরণে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তাদের মোনাজাতের ফিরিস্তি তো দীর্ঘ, কিন্তু মহান রাব্বুল আ’লামীনের ইচ্ছা পূরণে তাদের আগ্রহ ও উদ্যোগ সামান্যই। বরং মুসলিম ভূমিতে যা প্রবল ও লাগাতর তা হলো মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবাধ্যতা ও বিদ্রোহ। তিনি চান, মুসলিম উম্মাহর একতা, আর মুসলিমগণ বেছে নিয়েছে বিভক্তির পথ। ৫৭টি রাষ্ট্রে বিভক্ত মুসলিম উম্মাহর মানচিত্র এবং ২২ রাষ্ট্রে বিভক্ত আরব ভূমি তো সে বিদ্রোহেরই প্রতীক।  আরো বিভক্তি নিয়ে অধীকাংশের মাঝে কোন দুঃখবোধও নাই। বরং সে দেয়ালে ঘেরা বিভক্তিকে স্বাধীনতা বলা হয় এবং তা নিয়ে উৎসব করা হয়। মহান আল্লাহতায়ালা চান তাঁর নাযিলকৃত শরিয়ত ও হুদুদের আইন প্রতিষ্ঠা পাক। কিন্তু মুসলিমগণ সেটিও মানতে রাজী নয়। বরং তারা আদালতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে বৃটিশ বা ফরাসীদের দেয়া কুফরি আইন। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এরূপ বিদ্রোহ নিয়ে মুসলিমগণ বার বার হজ্ব করলেও কি সে হজ্ব কবুল হয়?  শবে ক্বদরের রাতে এমন বিদ্রোহী ব্যক্তি সারা রাত জেগে দোয়া করলেও কি সে দোয়া কবুল হয়?

ইসলামের আরেক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো হিজরত। মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে গড়ে তোলার এটি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ। মুসলিমের যেখানে পূর্ণ আত্মসমর্পণের প্রশ্ন, সেখানে আপোষ চলে না। মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি আত্মসমর্পণকে পূর্ণতর করতেই মুসলিম জীবনে আসে হিজরত। হিজরত এখানে নিজ ঘর, নিজ পরিবার, নিজ ব্যবসা-বাণিজ্য ও নিজ সহায়-সম্পদ পরিত্যাগ করে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ার। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম মক্কায় তাঁদের ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ ছেড়ে নিঃস্ব হাতে মদিনায় গিয়ে ঘর বেঁধেছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তাঁর জন্মভূমি ছেড়ে ফিলিস্তিন, মিশর ও হিজাজের পথে পথে হাজার হাজার মাইল ঘুরেছেন। হিজরত করেছেন হযরত ইউসুফ (আঃ), হযরত ইয়াকুব (আঃ)ও হযরত মূসা (আঃ)এর ন্যায় আরো বহু নবী-রাসূল। নিজ দেশ, নিজ ঘর, নিজ ব্যবসা-বাণিজ্য ও পরিবার-পরিজনের বাঁধনে যে স্থবির জীবন, সে স্থবিরতা ছিন্ন করে হজ্ব গড়ে হিজরতের অভ্যাস। ব্যক্তিকে তার আপন ঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসে। এভাবে ব্যক্তির জীবনে আনে গতিময়তা। উচ্চচতর জীবনবোধ ও সভ্যতার নির্মাণে জরুরী হলো এ গতিময়তা। ইতিহাসের সবগুলো উচ্চতর সভ্যতাই তাই মহাজিরদের সৃষ্টি।

জ্ঞানার্জন ইসলামে ফরয। বলা হয়ে থাকে,‘সফর নিছফুল ইলম”। এর অর্থঃ জ্ঞানের অর্ধেকটাই অর্জিত হয় ভ্রমন থেকে। ঈমানদারের জ্ঞানে সমৃদ্ধি আনতে হজ্বের অবদানটি তাই বিশাল। কারণ, হজ্বে রওনা দেয়ার সাথে সাথে যেমন সফর শুরু হয়, তেমনি জ্ঞানার্জনও শুরু হয়। সফরে রওনা দিলে শুধু চোখই খুলে না, মনের জানালাগুলিও খুলে যায়। আর নানা জনপদের নানা মানুষ ও নানারূপ পরিবেশ দেখলে মনের অঙ্গণে বইতে শুরু করে গভীর চিন্তার ঝড়। এভাবে হজ্ব সুযোগ সৃষ্টি করে অন্যদের দেখার এবং তাদের থেকে শেখার। দীর্ঘ যাত্রা পথে হজ্ব দেয় নানা দেশের নানা জনপদের বিচিত্র মানুষ ও বিচিত্র ভূ-প্রকৃতি নিয়ে চিন্তাভাবনা ও ধ্যানমগ্নতার সুযোগ। সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে সকাল -এরূপ বৃত্তাকারে ঘূর্ণায়নমান যে ব্যস্ত জীবন, সে জীবনে উচ্চতর লক্ষ্য ও মহত্তর কর্ম নিয়ে ভাববার অবসর কোথায়? অথচ জীবনের নানা বিষয় নিয়ে গভীর উপলদ্ধি ও সঠিক মূল্যায়নে চিন্তাভাবনার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

নবীজীর হাদীসঃ “আফজালুল ইবাদাহ তাফাক্কুহ”। অর্থঃ শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো চিন্তাভাবনা করা। ইবাদতে মনযোগ ও ওজন বাড়ে তো চিন্তাভাবনার সংমিশ্রনে। মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে গুরুত্ব পায় তো ইবাদতের ওজন, সংখ্যা নয়। চিন্তাশূণ্য মানব ভাবনাশূণ্য গাধায় পরিণত হয়। চিন্তাভাবনার গুরুত্ব বোঝাতে মহাজ্ঞানী আল্লাহতায়ালা এ জন্যই পবিত্র কোরআনে বহু আয়াত নাজিল করেছেন। চেতনার ভূবনে সাড়া জাগাতে প্রশ্ন তুলেছেন, “আফালা তাফাক্কারুন”, “আফালা তাদাব্বারুন”, “আফালা তাক্বীলুন”। অর্থঃ অতঃপর তোমরা কেন চিন্তা ভাবনা করোনা? কেন ধ্যানমগ্ন হও না? কেন বুদ্ধি-বিবেককে কাজে লাগাও না? কোরআন থেকে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রেও চাই একাগ্র ধ্যানমগ্নতা। “ফিকর” তথা চিন্তার সাথে চাই যিকর তথা স্মরণ। তাই পবিত্র কোরআনে বার বার প্রশ্ন তোলা হয়েছে, “হিদায়েত ও (আল্লাহর প্রতি) দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই আমি কোরআনকে  নিশ্চয়ই সহজ করে নাযিল করেছি। কেউ কি আছে তা থেকে শিক্ষা নেয়ার?” -( সুরা আল-কামার, আয়াত ১৭,২২,৩২,৪০। মোজাদ্দিদ শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভি এবং বাংলার হাজী শরিয়াতুল্লাহ, দুদু মিয়া ও তিতুমীরের মত মহান ব্যক্তিবর্গ তাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবক ও জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনাটি পেয়েছেন হজ্বে গিয়ে। হজ্বে গিয়েই ইরানের বিপ্লবী লেখক ড.আলী শরিয়তি এবং বিখ্যাত মার্কিন নওমুসলিম ম্যালকম এক্স-য়ের ন্যায় শত শত ব্যক্তি তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠটি পেয়েছিলেন। হজ্ব শেষে তারা নিজ দেশে ফিরেছিলেন আমুত্যু মোজাহিদ রূপে। হজ্বে গিয়ে পেয়েছিলেন আল্লাহর খলিফা রূপে সুগভীর দায়বদ্ধতার প্রেরণা। পেয়েছিলেন এক মহৎ প্রশিক্ষণ। অথচ ভাবনাশূণ্য মানুষগুলো হজ্ব থেকে ফিরে স্রেফ হাজির খেতাব নিয়ে। এটি কি তাদের কম ব্যর্থতা?

 

লক্ষ্যঃ সামর্থ্য সৃষ্টি আমৃত্যু লাব্বায়েক বলায়

হজ্বের লক্ষ্য এ নয়, ঈমানদার ব্যক্তি স্রেফ হজ্বের কয়েকটি দিন মহান আল্লাহতায়ার ঘর ক্বাবার তাওয়াফে লাব্বায়েক বলবে এবং বাঁকি সময়ে লাব্বায়েক বলবে নিজের নাফসের খায়েশ মেটাতে অথবা জাতিয়তাবাদী,বর্ণবাদী, ফ্যাসিবাদী, পূজিবাদী, স্বৈরাচারি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নানা রূপ হুকুম পালনে। মহান আল্লাহতায়ালার উপস্থিতি, হুকুমত ও সার্বভৌমত্ব তো সমগ্র বিশ্বজুড়ে। ফলে তাঁর ডাকে লাব্বায়েক বলার জজবা শুধু তাঁর ঘর ক্বাবার তাওয়াফে সীমিত থাকবে কেন? এটি কি ঈমানদারি? বরং প্রকৃত মু’মিন তো সেই যে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমে লাব্বায়েক বলবে সমাজ ও রাজনীতি প্রতি অঙ্গণে এবং জীবন যুদ্ধের প্রতি প্রান্তে। ঈমানের প্রমান তো এরূপ লাব্বায়েক বলাতে। দেহ যেমন ফুসফুসের উঠানামা ও হৃৎপিণ্ডের কম্পন নিয়ে বাঁচে থাকে তেমনি মু’মিনের ঈমান বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমে লাগাতর লাব্বায়েক বলা নিয়ে। সে সামর্থ্য না থাকার অর্থ ঈমান না থাকা। তবে সে সামর্থ্য এমনিতেই সৃষ্টি হয় না। সে সামর্থ্য সৃষ্টিতে মূল উপাদানটি হলো পবিত্র কোরআনের গভীর জ্ঞান। অক্সিজেন ছাড়া যেমন দেহ বাঁচে না, তেমনি কোরআনের জ্ঞান ছাড়া ঈমানও বাঁচে না। অন্য ধর্ম থেকে এখানেই ইসলামের পার্থক্য। অন্যধর্মে জ্ঞানার্জন বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু ইসলামে জ্ঞানার্জন শুধু বাধ্যতামূলক তথা ফরজই নয়, বরং অজ্ঞ থাকাটি কবিরা গুনাহ।

ঈমান বাঁচাতে ও ঈমানকে শক্তিশালী করতে মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র স্ট্রাটেজীটিও অতি লক্ষ্যণীয়।  নবীজীর উপর নবুয়তের দায়ভার দেয়ার সাথে সাথে তিনি নামায-রোযা, হজ-যাকাতের হুকুম দেননি। বরং হুকুম দিয়েছেন ইকরা’র তথা কোরআন পড়ার। এভাবে ফরজ করেছেন পবিত্র কোরআনের জ্ঞানলাভকে। সুরা মুজাম্মিল সর্বপ্রথম নাযিলকৃত সুরাগুলির একটি। এ সুরায় নবীজী (সাঃ)কে ৫ ওয়াক্ত নামাযের হুকুম  দেয়া হয়নি। বরং হুকুম দেয়া হয়েছে রাতের অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ বা তার চেয়ে কিছু বেশী বা কম সময় আস্তে আস্তে পবিত্র থেকে কোরআন থেকে তেলাওয়াত করে কাটাতে। একই নির্দেশ ছিল সাহাবাদের প্রতিও। কোরআনের জ্ঞান তো এভাবেই সাহাবায়ে কেরামদের মনে বদ্ধমূল হয়েছিল। খাওয়ার অর্থ খাদ্যকে গেলা। গেলার কাজটি না হলে তাকে খাওয়া হয়না। তেমনি কোন বই পড়ার অর্থ তার অর্থ উদ্ধার করা। অর্থ উদ্ধার না হলে তাকে পড়া বলাটি বেওকুপি। এমন কি শিশুও সেটি বুঝে; তাই কোন কিছু স্রেফ পড়ার খাতিরে সে পড়ে না। বুঝার সামর্থ্য না থাকলে কোন শিশুই কোন বই স্পর্শ করে না। প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ মহান আল্লাহতায়ালার সে পবিত্র স্ট্রাটেজীটি বুঝতে ভূল করেনি। ফলে স্রেফ পবিত্র কোরআনের অর্থ বুঝার খাতিরে মিশর, ইরাক, সিরিয়া, মরক্কো, সুদান, আলজিরিয়া, লিবিয়ার, মালি, মৌরতানিয়ার ন্যায় প্রায় ২০টি দেশের জনগণ -যাদের মাতৃভাষা আরবী ছিল না, মাতৃভাষাকে দাফন করে কোরআনের ভাষাকে নিজেদের  ভাষা রূপে গ্রহণ করেছিল। এরফলে মহান আল্লাহতায়ার পক্ষ থেকে প্রেরীত পয়গামটি বুঝতে কোন ধর্মগুরুর প্রয়োজন পড়েনি। একজন সাধারণ মুসলিমের পক্ষেও তখন সম্ভব হয়েছিল জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ যে পাঠটি সরাসরি বুঝা ও তাঁর সাথে একাত্ম হওয়া। মানব জাতির ভাষার ইতিহাসে সেটিই ছিল সবচেয়ে বিপ্লবী সিদ্ধান্ত।  তাতে সম্ভব হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তি রূপে মুসলিম উম্মাহর উত্থান। এবং সম্ভব মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণ।

অথচ মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে আজকের মুসলিমদের বিদ্রোহটি কোন গোপন বিষয় নয়। চাকরি-বাকরি ও আয়-উপার্জন বাড়াতে দুনিয়ার যে কোন কাফেরদের ভাষা শিখতে জীবনের দশটি বা পনেরটি বছর কাটিয়ে দিতে তাতে রাজি, কিন্তু আগ্রহ নাই কোরআনের ভাষা শেখায়। মুসলিম দেশের শিক্ষা বাজেট ও সিলেবাসের বিশাল ভাগ ব্যয় হয় বিদেশী ভাষা বুঝা ও সে ভাষায় কথা বলার সামর্থ্য বাড়াতে। অপর দিকে কোরআনের ভাষা শিক্ষাকে গুরুত্ব না দিয়ে না বুঝে কোরআন তেলাওয়াতকে সওয়াবের কাজ গণ্য হয়। অথচ মহান আল্লাহতায়ার সবচেয়ে বড় এ নিয়ামতটি না বুঝে পড়ার মধ্যে কল্যাণই বা কি? কল্যাণ না হলে সওয়াবই বা কেন হবে? মহান আল্লাহতায়ার হুকুম তো কোরআন থেকে পথ-নির্দেশনা ও হুশিয়ারি নেয়ার। না বুঝলে সেটি সম্ভব কি করে? সমগ্র বিশ্ব মাঝে কি এমন কোন জাতি আছে যারা না বুঝে কোন বই পড়ে? এক্ষেত্রে মুসলিমরাই শুধু ব্যতিক্রম যারা না বুঝে কোন বই পড়ে। এমন বিদ্রোহ, এমন বেওকুপি কি মহান আল্লাহতায়ালা থেকে কোন ছওয়াব বা পুরস্কার আনতে পারে? বিদ্রোহ বা অবাধ্যতা তো শাস্তি আনে, সওয়াব নয়।  ফলে যে ঈমান সামর্থ্য দেয় মহান আল্লাহতায়ার প্রতি হুকুমে লাব্বায়েক বলার, সে ঈমানের মৃত্যু ঘটেছে বহু আগেই। ফলে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়তি আইন, হুদুদ, খেলাফত ও মুসলিম  উম্মাহর একতা বিলুপ্ত হয়েছে খোদ মুসলিম সংখ্যগরিষ্ঠ দেশগুলোতে। মহান আল্লাহতায়ার হুকুমের সাথে গাদ্দারিটি এরূপ পর্যায়ে পৌছেছে যে, যারা নিজেদেরকে আলেম, মুফতি, ফকিহ, ইমাম রূপে জাহির করে তারা লাব্বায়েক বলছে ইসলাম বিরোধী স্বৈরাচারী শাসকদের ডাকে।

 

দেয় ধ্যানমগ্নতা এবং জন্ম দেয় বিপ্লবের

পবিত্র কোরআনের জ্ঞানার্জনের সাথে অপরিহার্য হলো, নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতের ন্যায় ইবাদতগুলোতে গভীর ধ্যান-মগ্নতা। চাই, আল্লাহতায়ালার পথে চলার প্রগাঢ় অঙ্গিকার ও তীব্র গতিময়তা। যাদের জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাপূরণে প্রগাঢ় অঙ্গিকার ও গতিময়তা নাই, তাদের পক্ষে অসম্ভব হয় সিরাতুল মোস্তাকিমে চলা। তাদের জীবনে তখন ভর করে নিজের ঘরে, পীরের খানকায় বা কর্মস্থলে ডুবে থাকার প্রচণ্ড স্থবিরতা। অপরদিকে ভাবনা-শূন্যতাই মানুষকে ঈমানশূন্য করে। এমন ভাবনাশূণ্য ব্যক্তিগণই সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে সকাল এক আমৃত্যু চক্রে বন্দী। এ বন্দীদশাতেই অবশেষে তারা একদিন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হারিয়ে যায়। অসংখ্য উদ্ভিদ ও কীটপতঙ্গের ন্যয় এভাবেই অতীতের গর্ভে হারিয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি মানুষ। হজ্বে মহান আল্লাহতায়ালা জীবনের সকল জড়তা ছেড়ে তাঁর ঘরে জমায়েত হওয়ার ডাক দেন। মিনা,আরাফাত ও উম্মুক্ত আকাশের নীচে মোযদাফিফায় অবস্থানকে বাধ্যতামূলক করে তার জীবনে ধ্যানমগ্ন হওয়ার সুযোগ করে দেন।

হিদায়েত দেয়ার মালিক একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালা। এটিই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ দান। যে হিদায়েত পেল সেই জান্নাত পেল। তবে সে বিশাল দানই এমনিতেই জুটে না। ব্যক্তির দায়িত্ব হলো, সে দান-প্রাপ্তির জন্য নিজেকে যোগ্যবান রূপে গড়ে তোলে। হজ্ব মূলতঃ সে যোগ্যতা অর্জনে সাহায্য করে। সেজন্য উপযোগী পরিবেশও সৃষ্টি করে। বহু কষ্টে, বহু অর্থ ব্যয়ে এবং বহু হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে যে ব্যক্তি তাঁরই ঘরে গিয়ে লাব্বায়েক তথা ‘আমি হাজির’ বলে তাঁর সাথে মহান আল্লাহতায়ালার যে সংযোগ ঘটে –সেটি কি আর কোন ইবাদতে সম্ভব? এ দিক দিয়ে হজ্ব তুলনাহীন। এরূপ সংযোগের ফলে মহান আল্লাহতায়ালা তাঁকে যেমন পথ দেখান তেমনি তাঁর চেতনার গভীরে জীবনের মূল মিশনটি বদ্ধমূল করে দেন। তাঁরই ফযিলতের বরকতে মু’মিনের চেতনায় তখন ঈমানের প্লাবন শুরু হয়। এমন ব্যক্তির জীবনে লাব্বায়েক বলাটি হজ্ব শেষ হওয়াতেও শেষ হয় না। বরং সেটি আমৃত্যু চলে। জীবনের প্রতি মুহুর্তে, পথচলার প্রতিপদে এবং রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির  প্রতি রণাঙ্গণে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমে সে লাব্বায়েক বলে। ইসলামের শত্রুশক্তির রণহুংকার শুনে এমন ব্যক্তি আত্মগোপন বা আত্মসমর্পণ করে না। ববং বীরদর্পে লাব্বায়েক বলতে সে রণাঙ্গণে হাজির হয়। এবং তাঁরই বাস্তব চিত্র দেখা গেছে সাহাবায়ে কেরামের জীবনে।

মহান আল্লাহতায়ালার ডাকে লাব্বায়েক বলার বিপরীতটি হলো তাঁর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহ ব্যক্তিকে নিরেট পথভ্রষ্টতা দেয় এবং পরিণামে জাহান্নামে পৌঁছায়। হজ্ব এবং ইবাদতের অন্যান্য বিধানগুলি যেমন লাব্বায়েক বলার সামর্থ্য বাড়ায়, তেমনি বিদ্রোহ বাড়াতে পৃথিবীর প্রতি প্রাঙ্গণে রয়েছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। সেগুলি কাজ করে শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধর্ম, প্রশাসন, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির নামে। এগুলির কারণে এমন কি খোদ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে বেড়েছে ইসলামের ফরজ বিধানগুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ফলে মহান আল্লাহতায়ালার কোরআনী বিধানগুলি স্রেফ কোরআনেই রয়ে গেছে। মুসলিমদের সংখ্যা যখন কয়েক লাখের বেশী ছিল না, ইসলামের পরাজয় তখনও এমনটি হয়নি। প্রশ্ন হলো, সমগ্র মুসলিম জাহান জুড়ে যেখানে আল্লাহর অবাধ্যতা, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব যেখানে ভূলুন্ঠিত এবং রাজনীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি যেখানে পরিণত হয়েছে আল্লাহর বিরুদ্ধে অবাধ্যতার প্রতীক -সেখানে ক্বাবার চার পাশে কেবল লাব্বায়ক উচ্চারনের মূল্য কতটুকু? মহান আল্লাহতায়ালা কি বান্দাদের এমন ফাঁকা বুলিতে খুশি হন? লাব্বায়েক শুধু হজ্বে নয়, সেটি বলা উচিত ছিল আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের জবাবে এবং তাঁর শত্রুদের নির্মূলে।

 

 

আত্মসমর্পণ ও ঈমানদারি

ঈমান লুকিয়ে থাকার বিষয় নয়। আগুনের প্রকাশ যেমন উত্তাপে, ঈমানের প্রকাশ তেমনি মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমে ‘লাব্বায়েক’ বলায়। লাব্বায়েক বলার সে সামর্থ্যটি না থাকায় সন্দেহ থাকে ঈমানদারিতে। নিজেকে মুসলিম রূপে দাবী করলেই অন্তরে ঈমানে প্রবেশ করে না। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, “বেদুইনরা বলে, “আমরা ঈমান এনেছি।” (হে নবী) তাদেরকে বলুন: “তোমরা এখনো ঈমান অর্জন করতে পারনি।” বরং তোমরা বলো, “আমরা আত্মসমর্পণ করেছি তথা মুসলিম হয়েছি। এখনো তোমাদের হৃদয়ে যথার্থ ঈমান প্রবেশ করেনি। যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা পালন করো (অর্থাৎ আল্লাহর হুকুমে লাব্বায়েক বলো), তাহলে তিনি তোমাদের সামান্যতম নেক কর্মও বিনষ্ট হতে দিবেন না; কেননা আল্লাহ অতি ক্ষমাময় ও মেহেরবান।” -(সুরা হুজরাত, আয়াত ১৪)।

মহান আল্লাহতায়ালায় আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুসলিম জীবনের শুরু। আত্মসমর্পণের অর্থ আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিলুপ্তি। আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির মনে বিপ্লবের শুরু মাত্র, কিন্তু তাতে পূর্ণতা মেলে না। বরং আত্মসমর্পিত ব্যক্তিটির মাঝে মহান আল্লাহতায়ালার ডাকে লাব্বায়েক বলার সামর্থ্য সৃষ্টি নাও হতে  পারে। সে সামর্থ্য অর্জনে তাকে বহুদূর এগিয়ে যেতে হয়। সে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই বস্তুতঃ ঈমানদারী। এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই কাজ করে নানাবিধ ইবাদতের বিধান। ঈমানদারীর অর্থ স্রেফ আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিলুপ্তি নয়, বরং ইসলামের বিজয়ে নিবেদিত প্রাণ সৈনিক হওয়াও। তবে সৈনিক তো তারাই হতে পারে যারা মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি ডাকে আমৃত্যু লাব্বায়েক বলে। সারা জীবন নামায-রোযা পালন করেও যদি সে সামর্থ্য সৃষ্টি হয়না, তবে বুঝতে হবে ফাঁকিবাজি আছে ইবাদতে।

মু’মিনের জীবনে লাব্বায়েক বলার সামর্থ্য সৃষ্টিতে হজ্বের গুরুত্বটি অপরিসীম। সে লক্ষ্যে হজ্ব মূলতঃ মহান আল্লাহতায়ালার নিজস্ব ইন্সটিটিউশন। এ ইন্সটিটিউশনে যে জ্ঞান লাভ ঘটে তা বিশ্বের অন্য কোন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রসায় জুটে না। এখানে শিক্ষক স্রেফ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) নন, তাঁর সাথে মানব ইতিহাসের আরো দুই মহান ব্যক্তিত্ব। তাঁরা হলেন তাঁর স্ত্রী হযরত হাজেরা ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ)কে। আল্লাহতায়ালার প্রতি ডাকে লাব্বায়েক বলার ক্ষেত্রে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর ন্যায় তাঁরাও বিস্ময়কর সামর্থ্য দেখিয়েছেন। ঘরবাড়ী, গাছপালা, খাদ্যপানীয় বিহীন মক্কার মরু প্রান্তরে যখন বিবি হাজেরাকে তাঁর শিশুপুত্র ইসমাইলসহ একাকী বসবাসের হুকুম শোনানো হয়েছিল তখন তিনি শুধু এটুকু জানতে চেয়েছিলেন এ হুকুম আল্লাহতায়ালার কিনা। যখন বলা হয়, হ্যা, এ হুকুম আল্লাহতায়ালার তখন তিনি লাব্বায়েক বলতে বিলম্ব করেননি।

মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমে লাব্বায়েক বলায় বালক ইসমাইল সে সামর্থ্য দেখিয়েছেন সেটি সমগ্র মানব-ইতিহাসে অনন্য। মসজিদ-মাদ্রাসায় যারা দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে দেন স্রেফ তাদের মাঝেও যদি বালক ইসমাইলের ন্যায় আল্লাহতায়ালার ডাকে লাব্বায়েক বলার সামর্থ সৃষ্টি হতো তবে শুধু মুসলিম বিশ্বে নয়, সমগ্র পৃথিবী জুড়ে ইসলামের বিজয় আসতো। মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা পূরণে বালক ইসমাইল যেরূপ স্বতঃস্ফুর্ত লাব্বায়েক বলেছিলেন তাতে প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর ঈমানের গভীরতা। মহান আল্লাহতায়ালা তাতে এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে তাঁর সে কথাগুলিকে তিনি নিজের পবিত্র কিতাবে লিপবদ্ধ করে রেখেছেন। এভাবে বুঝিয়েছেন, ঈমান বলতে কি বুঝায়। ক্বিয়ামত অবধি যারাই নিজেদেরকে ঈমানদার রূপে দাবী করবে, হযরত ঈসমাইলের সে কথাগুলো তাদের চেতনায় গভীর খোরাক জোগাবে। মহান আল্লাহতায়ালার নিজের লিপিবদ্ধ সে হৃদয়স্পর্শী বিবরণটি হলো এরূপঃ “অতঃপর সে (ইসমাইল) যখন তাঁর পিতার সাথে কাজে অংশ নেয়ার মত বয়সে উপনিত হলো তখন ইব্রাহিম বল্লো, “হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি তোমাকে যবেহ করছি। এখন তোমার কি মত, বলো।” সে (ইসমাইল) বল্লো, “হে আমার পিতা! যে বিষয়ে আপনাকে হুকুম দেয়া হয়েছে তা পালন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আপনাকে ধৈর্যশীল পাবেন।” –(সুরা সাফফাত, আয়াত ১০২)। হযরত ইসমাইলের স্বতঃস্ফুর্ত লাব্বায়েক ধ্বনিটি ছিল প্রাণদানে নিজের প্রস্তুতির। হজ্ব এবং হ্জ্ব-পরবর্তী কোরবানীর মূল লক্ষ্য তো ঈমানের যেরূপ প্রকাশ হযরত ইসমাইল (আঃ) ঘটিয়েছেন, সেটিকে প্রতিটি মুসলিমের জীবনে জীবন্ত রাখা। মুসলিমগণ অতীতে তখনই ইজ্জত পেয়েছে এবং মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিতে পেরেছে যখন হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)’য়ের ন্যায় তারাও আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা পূরণে প্রাণদানে হাজির হয়েছে। অপরদিকে পরাজয়, অপমান এবং দুর্গতির শুরু তো তখন থেকেই যখন আল্লাহতায়ালার প্রতি দায়বদ্ধতা ভূলে ব্যক্তি, গোত্র, বর্ণ, ভাষা ও দলের নামে নিজেদের জান, মাল ও মেধার কোরবানী দিতে শুরু করেছে।

 

কেন ব্যর্থ হচ্ছে হজ্ব?

মুসলিম জীবনে হজ্বের আজকের ইতিহাসটি প্রচণ্ড ব্যর্থতার। ইসলামের এ শ্রেষ্ঠ ইবাদতটি পরিণত হয়েছে স্রেফ আনুষ্ঠিকতায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর হাজী হচ্ছে বটে, কিন্তু খুব কম সংখ্যকই আল্লাহতায়ালার সৈনিক হচ্ছে। তারা ব্যর্থ হচ্ছে হজ্বের শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠতে। অধীকাংশের জীবনে লাব্বায়েক বলা শেষ হচ্ছে হজ্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথে। মহান আল্লাহতায়ালার নির্ধারিত এ গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং কোর্সটি প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের যেভাবে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)’য়ের আদর্শের অনুসারি রূপে গড়ে তুলতে পেরেছিল -আজ সেটি হচ্ছে না। পরিতাপের আরো কারণ, গরজ নাই ব্যর্থতার কারণগুলি খুঁজে বের করায়। আঁখকে চিনি বানাতে ব্যর্থ হলে চিনিকলের উপর গবেষণা শুরু হয়। ত্রুটি বের করে তার মেরামতও হয়। কিন্তু হজ্ব যে ব্যর্থ হচ্ছে চরিত্রে পরিশুদ্ধি আনতে -তা নিয়ে অধীকাংশ মুসলিমেরই কোন চিন্তা-নেই।

হজ্বের মূল শক্তিটি তার দর্শনে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)’য়ের আদর্শে ব্যক্তির রূপান্তরটি নিতান্তই আত্মীক। আত্মার ভূবনে বিপ্লব ঘটানোর সে কাজটি করে ওহীর জ্ঞান-ভিত্তিক দর্শন। এখানে দর্শনের সাথে ঘটে ব্যক্তির আত্মার একাত্মতা। ব্যক্তির জীবনে মূল্যসংযোজনের এ এক বিস্ময়কর প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মানুষ মহামানবে পরিণত হয়। এরূপ আত্মীক বিপ্লব থেকেই জন্ম নেয় চারিত্রকি বিপ্লব। মুসলিমের জীবনে সে বিপ্লবী দর্শনটি জোগায় পবিত্র কোরআন। যার মধ্যে কোরআনের জ্ঞান বা দর্শন নাই, হজ্ব তাঁর জীবনে স্রেফ অনুষ্ঠানই থেকে যায়। বার বার হজ্ব করেও এমন ব্যক্তি ইসলামের ডাকে লাব্বায়েক বলে না। বরং লাব্বায়েক বলে কাফেরের ডাকে। এরূপ নিষ্প্রাণ হজ্ব ও ওমরা ইসলাম-পূর্ব জাহিলিয়াত যুগেও ছিল।  ক্বাবাকে ঘিরে সে যুগের আরবগণও বার বার তাওয়াফ করতো। কিন্তু তাতে তাদের চরিত্রে সামান্যই পরিবর্তন আসতো। বরং যেসব পাপের ক্ষেত্রগুলো থেকে উঠে তারা আসতো, হজ্ব শেষে আবার সে একই পাপাচারে ফিরে যেত।

ইসলামের মিশন এবং মহান আল্লাহতায়ালার ভিশন নিয়ে ধারণাটি যথার্থ না হলে হজ্বের গুরুত্ব সঠিক ভাবে বুঝে উঠা তখনই অসম্ভব। মহান আল্লাহতায়ালার ভিশন হলো, তিনি পৃথিবীতে সকল ধর্মের উপর তাঁর দ্বীনের বিজয় দেখতে  চান। পবিত্র কোরআনে সে ভিশনটি কয়েকবার ঘোষণা হয়েছে এভাবেঃ “লিইউয’হিরাহু আলা দ্বীনি কুল্লিহি”; (অর্থঃ যেন সমগ্র ধর্ম উপর তার দ্বীন বিজয়ী হবে)। তিনি চান, প্রতিটি ঈমানদারকে জান্নাতে নিতে। জান্নাতে পৌঁছার সে কাজটি সহজ করতে সে যাত্রাপথের একটি নির্ভূল রোডম্যাপও পেশ করেছেন। সে রোডম্যাপটি  হলো পবিত্র কোরআন। এটিই হলো বহুঘোষিত সিরাতুল মুস্তাকীম। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ দান। জান্নাতের পৌঁছার এছাড়া দ্বিতীয় রাস্তা নেই। সে পথে যাত্রা কোথা থেকে শুরু করতে হবে এবং কোথায় শেষ করতে হবে -সেটি জিবরাইল (আঃ) মারফত নবীজী (সাঃ)কে শিখিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। এবং তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন, বিশ্ববাসীর সামনে জান্নাতের এ পথকে পরিচিত করার।

সিরাতুল মুস্তাকীম বেয়ে চলার কাজটি শুরু হয় মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনা ও পবিত্র কোরআনের জ্ঞানার্জন দিয়ে। এ পথে সামনে চলার কাজটি অব্যাহত রাখতে হয় নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত, হিজরত, জিহাদ ও ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এ যাত্রা পথেই আসে শরিয়ত, হুদুদ, একতা ও খেলাফতের প্রতিষ্ঠা এবং আসে ইসলামিক সভ্যতার নির্মাণ। তাই জান্নাতের এ যাত্রাপথে স্রেফ জ্ঞানার্জন, তাবলিগ, নামায-রোযা বা হজ্ব-যাকাতের ন্যায় কোন একটি স্তরে বন্দি থাকার অবকাশ নেই, ঈমানদারকে সামনে চলতে হয় প্রতিটি স্তর অতিক্রম করে। মর্দে মু’মিন তো এভাবেই ইনসানে কামেল তথা পূর্ণ মানুষে পরিণত হয়। রোডম্যাপ কি কখনো স্রেফ তেলাওয়াতের বিষয়? এটি তো পদে পদে অনুসরণের বিষয়। মুসলিমদের অপরাধ এবং সে সাথে ব্যর্থতার কারণ হলো, তারা রোড়ম্যাপকে স্রেফ তেলাওয়াতের বিষয় বানিয়েছে। এরই ফল হলো, মুসলিমগণ আজ বিভক্ত, পরাজিত, অপমানিত ও শত্রুর হাতে অধিকৃত।

প্রতি মুসলিমের ঈমানী দায়বদ্ধতা হলো, কোরআনী রোডম্যাপ তথা সিরাতুল মুস্তাকীমকে আমৃত্যু অনুসরণ করা। লম্বা যাত্রাপথের কোন একটি স্টেশনে থেমে গেলে কি গন্তব্যস্থলে পৌঁছা যায়? ইবাদতের কোন একটি স্তরে নিজেকে সীমিত রাখলে তেমনি ব্যাঘাত ঘটে প্রকৃত ঈমানদার রূপে বেড়ে উঠা। এজন্যই মুসলিমের ইবাদত স্রেফ নামায-রোযা-যাকাতে এসে থেমে গেলে চলে না। ইবাদতের অঙ্গণে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার জিহাদও থাকতে হয়। নইলে কি সে নিজেকে সত্যিকার মুসলিম রূপে গড়ে তুলতে পারে? মুসলিম হওয়ার অর্থ তো মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুম পালনে আত্মনিয়োগের সামর্থ্য। মানব জীবনের সেটিই শ্রেষ্ঠ সামর্থ্য। একমাত্র এ সামর্থ্যটিই ব্যক্তিকে জান্নাতে নেয়। চলার পদে মূলতঃ সে সামর্থেরই পরীক্ষা হয়। হযরত ইব্রাহীমের জীবন থেকে সেটিই তো মূল শিক্ষ্যণীয় বিষয়। মুসলিমের জীবনে সে সামর্থ্য সৃষ্টির জন্যই ফরজ করা হয়েছে প্রতিটি ইবাদত। হজ্ব হলো, সে সামর্থ্য সৃষ্টিতে এক ইনটেনসিভ ট্রিনিং কোর্স। এবং যাকে এ কোর্সে শিক্ষক রূপে হাজির করা হয়েছে তিনি হলেন হযরত ইব্রাহিম (আঃ)। তাঁর জীবনের মূল শিক্ষাটি হলো, মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি হুকুমে লাব্বায়েক বলা। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ছিলেন মানব ইতিহাসের অতি সাহসী যোদ্ধা। যখন তাঁকে লেলীহান আগুণের মাঝে ফেলার সিদ্ধান্ত শোনানো হয়েছে, তখনও তিনি বিচলিত না হয়ে লাব্বায়েক বলেছেন। যখন মাতৃভূমি ছেড়ে ফিলিস্তিনে হিজরত করার নির্দেশ এসেছে তখনও লাব্বায়েক বলেছেন। যখন স্ত্রী ও শিশু পুত্র ইসমাইলকে খাদ্য-পানীয় শুণ্য মক্কায় রেখে আসার নির্দেশ এসেছে তখনও তিনি লাব্বায়েক বলেছেন।  একমাত্র সন্তান ইসমাইলকে যখন কোরবানী করার নির্দেশ এসেছে তখনও তিনি লাব্বায়েক বলেছেন। এভাবে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি হুকুমে লাব্বায়েক বলার যে সূন্নত তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সেটিই হলো মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। এবং শিক্ষার এ পাঠটি দেয়া হয় হজ্বের ইবাদতে। সে সামর্থ্য সৃষ্টি হলে বুঝতে সে হজ্ব ব্যর্থ্য হয়েছে। হজ্বের জন্য মক্কার চেয়ে উত্তম স্থান আর কোথায় হতে পারে? পৃথিবীর আর কোন নগরীতেই মহান আল্লাহর হুকুমে লাব্বায়েক বলার এতবড় ঘটনা আর কোন শহরেই ঘটেনি। শহরের পত্তন হয়, দেশের মানচিত্রে পরিবর্তন আনা হয় বিশেষ  এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু মক্কার নগরীর পত্তন ঘটেছে স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশে এবং তাঁরই দ্বীনের এজেন্ডাকে প্রতিষ্ঠা দিতে। এবং মক্কা নগরীতেই গড়ে তোলা হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার প্রথম ঘরটি।

 

অধিকৃতি ঘরের শত্রুর

মুসলিম উম্মাহর বুকে চলমান বিদ্রোহটি কোন কাফের শক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের বিরুদ্ধে। মুসলিম ভূমিতে ইসলামের ঘোরতর শত্রু তো তারাই যারা নিজেদেরকে মুসলিম রূপে পরিচয় দেয়। তাদের কারণেই খোদ মুসলিম ভূমিতে ইসলামের প্রতিষ্টা রুখতে কোন কাফির শক্তিকে মাঠে নামতে হচ্ছে না। সে কাজটি ইসলামের এ ঘরের শত্রুরাই করছে। মুসলিম দেশগুলিতে এরাই মূলতঃ বিজয়ী শক্তি। তাছাড়া রূঢ় বাস্তবতা হলো, এমনকি বিদেশী কাফের শক্তিও মুসলিম ভূমির উপর অধিকৃতি জমাতে এবং ইসলামের উত্থান ঠেকাতে মুসলিমদের মধ্য থেকে বিপুল সংখ্যক কলাবোরেটর পাচ্ছে। এরাই আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া ও চেচনিয়ায় শত্রুর অধিকৃতিকে সহজতর করেছে। অথচ মুসলিমের ঈমানী দায়বদ্ধতার গণ্ডিটি বিশাল। এটি স্রেফ মুর্তিপূজা বা নানারূপ শিরক থেকে বাঁচা নয়, বরং ইসলাম ও শরিয়তি অনুশাসনের বিরুদ্ধে শত্রুদের যে বিদ্রোহ চলছে তা থেকে নিজেকে বাঁচানো। সে সাথে জরুরী হলো, মহান আল্লাহতায়ালার নিবেদিত-প্রাণ সৈনিক হওয়া। পবিত্র কোরআনে সেরূপ সৈনিক হওয়ার মধ্যেই জান্নাত প্রাপ্তির নিশ্চয়তা শোনানো হয়েছে।  বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদেরকে কি এমন এক ব্যবসার সন্ধান দিব যা তোমাদেরকে জাহান্নামের কষ্টদায়ক আযাব থেকে মুক্তি দিবে। সেটি হলো,তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনো এবং নিজেদের সম্পদ ও জান দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করো। এর মধ্যেই তোমাদের জন্য কল্যাণ -যদি তোমরা জানতে।” –( সুরা সাফ, আয়াত ১০-১১)।

ইসলামের শত্রু হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে হলে অতি জরুরী হলো, মানব জাতির বিভাজনটি সঠিক ভাবে বুঝা। আরো জরুরী হলো, কারা ইসলামের শত্রু ও কারা আল্লাহর পথের সৈনিক – এ দুটি পক্ষকে সনাক্ত করার যোগ্যতা অর্জন। ইসলামে নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাতই শুধু ফরজ নয়, বরং ফরজ হলো ইসলামের শত্রু-মিত্রদের চেনার সামর্থ্য অর্জন। এখানে ব্যর্থ হলে নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত কোন ফায়দা দেয় না। বরং শত্রুপক্ষে শামিল হওয়া এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামা তথা মুনাফিক হওয়াটিও সহজ হয়ে যায়। সেরূপ ব্যর্থতায় যা অনিবার্য হয় তা হলো, জাহান্নামে পৌঁছা। কোটি কোটি মুসলিম-সন্তান তো সে পথই ধরেছে।

মহান আল্লাহতায়ালা কাছে সমগ্র মানব জাতির বিভাজনটি মূলতঃ তিন শ্রেণীতে। এক). কাফের, দুই). মুনাফিক এবং তিন). ঈমানদার। পবিত্র কোরআনে এ তিন শ্রেণীর মানুষের বিবরণ বার বার এসেছে। এর বাইরে কোন চতুর্থ শ্রেণী নাই। কি কি কারণে মানুষ কাফের, মুনাফিক ও ঈমানদার হয় -সে বিষয়টিও পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট করা হয়েছে। মুসলিমদের শুধু হিংস্র জীবজন্তু ও পোকামাকড় চিনলে চলে না, চিনতে হয় কারা কাফের, মুনাফিক ও ঈমানদার সেটিও। নইলে মুসলিমগণও দলে দলে কাফির ও মুনাফিকদের দলে শামিল হয়। তখন বিনা যুদ্ধেই মুসলিম রাষ্ট্রের উপর শত্রুশক্তি অধিকৃতি জমায়। তখন পরাজিত হয় ইসলাম ও ইসলামের সৈনিকগণ। এমন অধিকৃত দেশে ইসলামের বিজয়ী করার প্রচেষ্ঠা গণ্য হয় ভয়ানক অপরাধ রূপে। এবং যুদ্ধ শুরু হয় ইসলামের প্রতিষ্ঠা রুখতে। অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলিতে তো সেটিই হচ্ছে। ফলে সে দেশগুলিতে যেমন মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব নেই, তেমনি শরিয়তের প্রতিষ্ঠাও নাই। এসব দেশের শাসকগণ নিজেরাই যেহেতু ইসলাম ও মুসলিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত, পৃথিবীর অন্য কোথাও মুসলিম নিধন চললে সেটি তাদের কাছে সেটি কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। ফলে মিয়ানমার, কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, চেচনিয়া, জিংজিয়াং, মিন্ডানাও এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকার মত দেশগুলিতে যেরূপ মুসলিম নির্মূল চলছে –এসব মুসলিম দেশগুলির নেতাদের তা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। তাদের মাথা ব্যাথাটি শুধু ক্ষমতায় থাকা নিয়ে।

 

 

লাব্বায়েক’য়ের সংস্কৃতি ও মানব জাতির বিভাজন

মানুষ শুধু তার ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস নিয়ে বাঁচে না; বাঁচে তার সংস্কৃতি নিয়েও। সংস্কৃতি বস্তুতঃ ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের প্রকাশ। এবং ব্যক্তির জীবনে সে প্রকাশটি ঘটে তার ধর্ম-কর্ম, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য-পানীয়, ঘর-সংসার, সাহিত্য-সংগীত, রাজনীতি ও যুদ্ধ বিগ্রহে। এজন্যই একজন পৌত্তলিকের ধর্মবিশ্বাস যেমন এক নয়, তেমনি এক নয় তার সংস্কৃতিও। এক নয় সচারাচর উচ্চারিত মুখের বুলিও। কেউ মন্ত্র পাঠ করে এবং সাড়া দেয় গুরু, ঋষি, পুরোহিতের ডাকে, কেউ সাড়া দেয় কোরআনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমে। মু’মিন ব্যক্তি তাই হজ্বে যায় এবং আল্লাহতায়ালার ডাকে লাব্বায়েক (অর্থঃ আপনার হুকুম পালনে আমি হাজির) বলে।

মানব জাতির মূল মূল ও গুরুত্বপূর্ণ বিভাজনটি তাই ভাষা, বর্ণ, গায়ের বংয়ের ভিত্তিতে হয় না। সেটি হয় মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমে প্রতি লাব্বায়েক বলার ভিত্তিতে। যে জীবনে লাব্বায়েক নাই, বুঝতে হবে সে জীবনে নিশ্চিত আছে বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহটি যেমন গোপনে হতে পারে, তেমনি প্রকাশ্যেও হতে পারে। মহান করুণাময়ের ডাকে নিরব থাকাটিও অঘোষিত বিদ্রোহ। তবে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে যাদের বিদ্রোহটি প্রকাশ্যে ঘোষিত হয় -তারাই কাফের। যাদের জীবনে সে বিদ্রোহটি চলে সংগোপনে -তারাই হলো মুনাফিক। গোপন বিদ্রোহ নিয়ে মুনাফিকগণ বসবাস করে প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজে। তারাই হলো মুসলিমদের ঘরের শত্রু। মুনাফিকগণ যেমন প্রকাশ্যে নিজেদেরকে মুসলিম  রূপে পরিচয় দেয়, তেমনি নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাতও পালন করে। তবে বিদ্রোহ কখনোই গোপন থাকার বিষয় নয়। সেটি প্রকাশ পায়, ইসলামী রাষ্ট্র ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিরোধীতার মধ্য দিয়ে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলিতে যারা শরিয়ত ও হুদুদ প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধীতা করে এবং ভাষা, গোত্র ও ফেরকার নামে বিভক্তির দেয়াল গড়ে -তারা তো কাফের নয়। তারা তো মুসলিম সমাজের মাঝে লুকিয়ে থাকা ঘরের শত্রু। তাদের বিদ্রোহ মহান আল্লাহতায়ার সে সব নির্দেশের বিরুদ্ধেও যাতে রয়েছে সমাজ থেকে কুফরি আইন, দুর্বৃত্তি, সুদ-ঘুষ ও পতিতাবৃত্তির নির্মূল। ইসলামের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার পরও তাদের মুখে নিজেদেরকে কাফের বা অমুসলিম রূপে দাবী করার সাহস নেই। ইসলামের এ কপট শত্রুগণ এজন্যই মুনাফিক। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এরাই হলো সর্বনিকৃষ্ট। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তাদের স্থান হবে জাহান্নামের নিম্নতম স্থানে।

মহান আল্লাহতায়ালার একটি মাত্র হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে ইবলিস অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়েছে। তেমন এক প্রেক্ষিতে প্রশ্ন হলো, পবিত্র কোরআনে ঘোষিত কোন একটি হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিয়ে কেউ কি তাই জান্নাতে পৌঁছতে পারে? বস্তুতঃ সে বিদ্রোহ থেকে বাঁচাই হলো মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সামর্থ্য। মু’মিন ব্যক্তির তাকওয়া হলো, সে বিদ্রোহ  থেকে নিজেকে বাঁচানোর প্রতি মুহুর্তের সতর্কতা। মহান আল্লাহতায়ালাকে যারা অস্বীকার করে এবং তাঁর শরিয়তি আইন ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যাদের বিদ্রোহটি  সুস্পষ্ট –তারাই নিজেদের প্রতিষ্ঠা দেয় কাফের রূপে। এবং ঈমানদার হলো তারাই যারা রাব্বুল আলামীনের প্রতি হুকুমে লাব্বায়েক বলে। অপর দিকে যারা নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করে বটে কিন্তু আগ্রহ নাই তাঁর হুকুমে লাব্বায়েক বলার -তারাই হলো মুনাফিক। মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ধোকাবাজী ও অসামর্থ্যতা হল এটি। এখানে ধোকাবাজীটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার সাথে। এমন ধোকাবাজী ও অসামর্থ্যতা মানব জীবনের সকল অর্জনকে পুরাপুরি ব্যর্থ করে দেয়। মদিনার বুকে এমন চরিত্রের মানুষগণই মুনাফিক রূপে পরিচিতি পায়। আযানের ডাকে এরা মসজিদে গিয়ে নবীজী (সাঃ)র পিছনে নামায পড়তো বটে, কিন্তু আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে যখন জিহাদের হুকুম এলো তখন সে হুকুমের তারা বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। তারা লাব্বায়িক বলেছিল নফসের খায়েশের ডাকে।  তাদের নিজেদের খায়েশ সেদিন শয়তানের খায়েশের সাথে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

আজকের মুসলিমগণ যেরূপ শরিয়তের আইন পালনে ব্যর্থ হচ্ছে তার কারণ, আল্লাহর হুকুমে লাব্বায়েক বলার সামর্থ্যহীনতা। তাদের সামনে আল্লাহর কোরআন আছে, কোরআনের হুকুমও আছে এবং নবীজী (সাঃ)র মহান সূন্নতও আছে, কিন্তু যা নাই তা হলো সে হুকুমের ডাকে লাব্বায়েক বলার সামর্থ্য। এমন অসামর্থ্যতাই মূলত আযাব ডেকে আনে। শুধু আখেরাতে নয়, দুনিয়াতেও। মহান আল্লাহর নাযিলকৃত তাওরাত নিয়ে ইহুদীরা খুবই গর্ব করতো –যেরূপ গর্ব করে আজকের মুসলিমগণ পবিত্র কোরআনকে নিয়ে। কিন্তু ইহুদীদের আগ্রহ ছিল না তাওরাতে বর্নিত মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমগুলি পালনে। সে অপরাধে মহান আল্লাহতায়ালা ইহুদীদেরকে ভারবাহি গর্দভ রূপে আখ্যায়ীত করেছেন। পবিত্র কোরআনে সে বর্ণনাটি এসেছে এভাবে, “যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্বভার দেয়া হয়েছিল অথচ তারা সেটি বহন করেনি -তাদের দৃষ্টান্তটি হলো ভারবাহি গর্দভের ন্যায়। কতই না নিকৃষ্ট সে সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত যারা আল্লাহর আয়াতগুলিকে অস্বীকার করে। আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।” –(সুরা জুমু’আ, আয়াত ৫)।

ভারবাহি পশুদের পিঠে মূল্যবান কিতাবের বিশাল বোঝা শোভা পেলেও সে কিতাবগুলির শিক্ষা ও হুকুম-আহকাম নিয়ে তারা ভাবে না। সেগুলির প্রতিষ্ঠাও তাদের কাছে গুরুত্ব পায় না। ইহুদীগণ তাই শুধু তাওরাতকে যুগ যুগ বহন করেই বেরিয়েছি, কিন্তু তার প্রতিষ্ঠায় কখনোই মনযোগী হয়নি। শরিয়ত হাওয়ার উপর প্রতিষ্ঠা করা যায় না; সে জন্য রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিতে হয়। মিসর থেকে মুক্তি দেয়ার পর মহান আল্লাহতায়ালা যখন তাদেরকে ফিলিস্তিনে গিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার হুকুম দিলেন, সে দায়িত্ব পালনে তারা সরাসরি অস্বীকার করলো। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজটি দোয়াদরুদে হয় না। সে জন্য জিহাদে প্রাণদানের প্রয়োজন হয়। মক্কার ন্যায় ফিলিস্তিনও সেদিন কাফের শক্তির হাতে অধিকৃত ছিল। তারা বলেছিল, “হে মুসা তুমি ও তোমার  আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ করো, আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।” তাদের কাপুরুষতার জন্যই মুসা (আঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিতে ব্যর্থ হন এবং ব্যর্থ হন শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দিতে। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে ইহুহদীগণ একারণেই ভয়ানক অপরাধী। এরূপ অপরাধীগণ কি কোন পুরস্কার পেতে পারে? তাদের জন্য ফিলিস্তিনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। শাস্তি স্বরূপ ঘুরতে হয় নানা দেশের পথে পথে। একই পথ ধরেছে আজকের মুসলিমগণ। মুসলিম ভূমিগুলি আজ ইসলামের শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃত। সে অধিকৃতি থেকে মুসলিম ভূমিকে মুক্তি করার লড়াই যেমন নাই, তেমনি নাই ইসলামের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং শরিয়ত পালনে আগ্রহ। ফলে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুত আযাব ঘিরে ধরেছে তাদেরও।

 

মু’মিনের লাব্বায়েক ও ঈমানদারি

লক্ষ লক্ষ হাফেজ, আলেম ও মুসল্লি ব্যস্ত শুধু কোরআনের আয়াতগুলি তেলাওয়াত ও মুখস্ত করা নিয়ে, কিন্তু সেগুলি বুঝাতে এবং তার উপর আমল করাতে আগ্রহ অতি সামান্যই। অথচ যে আয়াতে শরিয়তের হুকুম -সেটি তো শুধু পাঠের বা মুখস্ত করার বিষয় নয়। সেটি তো রাষ্ট্রের উপর প্রয়োগের বিষয়। নইলে অবাধ্যতা হয় মহান রাব্বুল আলামীনের। অথচ মুসলিমগণ বেঁচে আছে সে অবাধ্যতা নিয়ে। সে অবাধ্যতার কারণেই তাদের জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে রাষ্ট্রে বিজয়ী করার লক্ষ্যে জিহাদও নেই। ফলে ইহুদীগণ যেমন তাওরাতের বিধান পালনে ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি প্রায় একশত পঞ্চাশ কোটি মুসলিম ব্যর্থ হচ্ছে ইসলাম পালনে। ফলে ৫৭টি মুসলিম দেশের কোনটিতেও শরিয়তি বিধানের প্রতিষ্ঠা নেই। অথচ কোন রাষ্ট্রে কতটা ধর্ম পালন হয়, সেটির হিসাব কি মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা গুণে হয়? নামাযী, রোযাদার ও হাজীদের সংখ্যা দিয়ে কি সে বিচার চলে? সে বিচার তো হয় মহান আল্লাহর হুকুমের কতটা আনুগত্য হলো এবং তাঁর শরিয়তি বিধান কতটা প্রতিষ্ঠা পেল তা থেকে। ইসলামের আগমণ কি শুধু কারী ও হাফিজদের সংখ্যা বাড়াতে? ইসলামের মিশন কি শুধু নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতের প্রতিষ্ঠা দেয়া? ধর্মপালন এভাবে সীমিত ও সিলেকটিভ হলে পবিত্র কোরআনে যে শরিয়তি আইন নাযিল করা হয়েছে -সেগুলির কি হবে? সেগুলি কি শুধু তেয়াওয়াতের জন্য? নিজের প্রণীত আইনের এরূপ আমলহীন তেয়াওয়াতে কি মহান আল্লাহ ছোবহানা ওয়া তায়ালা কি খুশি হবেন? নবীজী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণ কি কখনো শরিয়তের প্রতিষ্ঠা বাদ দিয়ে ইসলাম পালন করেছেন?

অন্যায়ের নির্মূল এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় আইন-আদালতের বিকল্প নাই।  রাষ্ট্রের বুকে আইনের প্রয়োগ না হলে জুলুমের সয়লাব শুরু হয়। দুর্বৃত্তিতে মুসলিম দেশগুলি যে বিশ্ব-রেকর্ড গড়ছে তার মূল কারণ তো শরিয়তি আইনের অনুপস্থিতি। শরিয়তি আইনের প্রতিষ্ঠা ছাড়াই দুর্বৃত্তি নির্মূল হবে এবং শান্তি-শৃঙ্খলা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে -সেটি বিশ্বাস করাই তো হারাম। গুরুতর রোগী ঔষধ ছাড়াই ভাল হয়ে উঠে –এমন বিশ্বাস কি কোন সুস্থ্য ব্যক্তির হতে পারে? অথচ মুসলিমদের মাঝে তেমনি একটি বিশ্বাস শরিয়তি আইনের বিরুদ্ধে। কোরআন-পাঠ, এবং নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত পালন এমন কি মোনফেক,ফাসেক বা জালেমের পক্ষেও সম্ভব। অথচ আল্লাহপাক চান, শুধু তেলাওয়াত নয়, তাঁর প্রতিটি হুকুমের পূর্ণ প্রয়োগ। ঈমানদারের প্রতিটি কথা, কর্ম ও আচরণে প্রকাশ পাক, শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় তাঁর পূর্ণ অঙ্গিকার। মু’মিন ব্যক্তি তো এভাবেই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমে “লাব্বায়েক” বলে। এবং এরূপ “লাব্বায়েক” বলার মাঝেই ঈমানদারি। নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাতের ন্যায় ইবাদতের মূল কাজ তো ঈমানদারের জীবনে আমৃত্যু “লাব্বায়েক” বলার সামর্থ্য সৃষ্টি। নামায-রোয ও হজ্ব-যাকাতের ন্যায় ইবাদতগুলি ব্যক্তির জীবনে কতটা সফল হলো -সেটি পরিমাপের নির্ভূল মিটারটি হলো “লাব্বায়েক” বলার সামর্থ্য। সে অর্জিত সামর্থ্যের বলে যেখানেই আল্লাহর নির্দেশ, সেখানেই ঈমানদার ব্যক্তি সে নির্দেশ পালনে বলে উঠে “আমি হাজির”। যারা মধ্যে সে সামর্থ্য নাই, বুঝতে হবে ইবাদত থেকে এমন ব্যক্তির অর্জন অতি সামান্যই। এমন ব্যর্থ ইবাদত কি কল্যাণ দিবে পরকালে?

ঈমানদারের পুরস্কার যেমন বিশাল,দায়বদ্ধতাও তেমনি বিশাল। বিশাল পুরস্কারটি হলো অনন্ত অসীম কালের জন্য অফুরন্ত নিয়ামত ভরা জান্নাতলাভ। আর দায়বদ্ধতা হলো,আমৃত্যু আল্লাহর সৈনিক রূপে কাজ করা। আল্লাহতায়ালা ঈমানদারের জানমাল কিনে নেন জান্নাতের বিনিময়ে। মহান আল্লাহর সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে,“নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনের জান ও মাল এ মূল্যে কিনে নিয়েছেন যে তাদের জন্য হবে জান্নাত। (এবং বিনিময়ে) তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে করে,সে যুদ্ধে তারা (শত্রুদের) হত্যা করে এবং (নিজেরাও শত্রুদের) হাতে নিহত হয়।” –(সুরা তাওবাহ, আয়াত ১১১)। মু’মিন হওয়ার অর্থ তাই মহান আল্লাহর ক্রয় করা সৈনিকে পরিণত হওয়া। তখন তার উপর একমাত্র আল্লাহর মালিকানার প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ায় এমন ব্যক্তির মাঝে কোন ভয় থাকে না। কারণ, শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে ঈমানদার ব্যক্তি তাঁর নিজের উপর অর্পিত আল্লাহতায়ালার আমানতকে ফেরত দেয় মাত্র। আল্লাহর ভয় তাদেরকে মুক্তি দেয় মৃত্যুর ভয় থেকে। এমন এক বিশ্বাস থাকার কারণেই সংখ্যায় ক্ষুদ্র হয়েও মুসলিমগণ অতীতে বিশাল বিশাল কাফের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে।

যারা আল্লাহর সৈনিক, তাদের মুখে রাজা, স্বৈরাচারি শাসক বা সেক্যুলার নেতার ডাকে লাব্বায়েক বলাটি শোভা পায় না। তাদের বাঁচাতে তাঁরা যুদ্ধও করে না। যুদ্ধ করে না কোন দল, বর্ণ, গোত্র, ভাষা বা মতবাদের গৌরব বাড়াতে। বরং যুদ্ধ করে এবং সে যুদ্ধে নিহত হয় একমাত্র আল্লাহর দ্বীনের বিজয় আনতে। এবং যুদ্ধ করে মুসলিমদের স্ট্রাটেজিক স্বার্থ বাঁচাতে। এ পৃথিবীতে আর কোন নবী আসবেন না। তবে মুসলিমদের প্রতি মহান আল্লাহর পথে লড়াইয়ের হুকুমটি সুরক্ষিত রয়েছে পবিত্র কোরআনের ফরমানের মাঝে। মুসলিমদের মাঝে আজও সে পবিত্র কোরআন আছে। সে কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে জিহাদের হুকুমও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মুসলিম জীবনে আল্লাহতায়ালার দ্বীনের প্রতিষ্ঠায় সে জিহাদ কই? অথচ মুসলিম জীবনে অসংখ্য যুদ্ধ আছে, সেসব যুদ্ধে জান ও মালের বিশাল ক্ষয়ক্ষতিও আছে। কিন্তু সেগুলি ব্যক্তি, দল, ভাষা, গোত্রের বিজয় ও গৌরবকে নিশ্চিত করতে। এভাবে মুসলিম মারছে ও মরছে জাহিলিয়াতের পথে। তাদের কোরবানী শুধু পশু কোরবানীতে সীমিত হয়ে আছে। এবং তারা নিজেরা বিপুল সংখ্যায় কোরবান হচ্ছে জাহিলিয়াতকে বাঁচাতে। পবিত্র জিহাদের বদলে তাদের জীবনে এসেছে সন্ত্রাস। মুসলিম দেশগুলির বিশাল বিশাল পুলিশ ও সেনাবাহিনীগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সৃষ্টির কাজে। ইসলামের বিজয় বাড়াতে এসব বাহিনীর কোন ভূমিকাই নেই। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনে মুসলিমের বাঁচা ও মরা -সেটিই তো ইব্রাহীম (আঃ)’য়ের জীবনের মূল আদর্শ। কোরবানীর এটিই তো মূল শিক্ষা। কিন্তু বছর ঘুরে প্রতি বছর হ্জ্ব আসলেও মুসলিম জীবনে  মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে বাঁচা ও মরার আয়োজন অতি সামান্যই।

মহান আল্লাহতায়ালার ডাকে সর্বাবস্থায় লাব্বায়েক বলতে গিয়ে ইব্রাহিম (আঃ) দেশছাড়াও হয়েছেন। বিচ্ছিন্ন হয়েছেন একমাত্র পুত্র ঈসমাইল ও বিবি হাজেরা থেকে। আল্লাহর নির্দেশে লাব্বায়েক বলতে তিনি তাদেরকে খাদ্য-পানীয়হীন অবস্থায় ছেড়েছেন জনবসতিহীন মক্কার মরুর প্রান্তরে। যখন হুকুম পেয়েছেন একমাত্র পুত্রের কোরবানীর, তখনও তিনি দ্বিধাদ্বন্দে পড়েননি। প্রবল ঈমানী বল নিয়ে সে হুকুম পালনে তখনও লাব্বায়েক বলেছেন। মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি এভাবে লাব্বায়েক বলার ক্ষেত্রে ইব্রাহিম (আঃ) হচ্ছেন সমগ্র মানব ইতিহাসে এক শ্রেষ্ঠ আাদর্শ। শুধু হযরত ইব্রাহিম (আঃ) নন, তাঁর সাথে “লাব্বায়েক” বলেছেন হযরত ইব্রাহিম (আঃ)এর স্ত্রী বিবি হাজেরা এবং শিশু পুত্র ঈসমাইল(আ)ও। হযরত ঈসমাইল(আ)কে যখন বলা হয়েছিল, আল্লাহতায়ালা তোমার জানের কোরবানী চান তখন তিনিও সাগ্রহে বলেছিলেন,“লাব্বায়েক”। অথচ বাঁচবার সাধ কার না থাকে? কিন্তু আল্লাহর ডাকে লাব্বায়েক বলার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এ জীবনে আর কি থাকতে পারে? শিশু ঈসমাইলও সেটি বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন তাঁর মহান বিবি হাজেরাও। ফলে ঘরবাড়ী ও গাছপালা নেই,খাদ্য-পানীয় ও কোন প্রাণীর আলামত নেই -এমন এক রুক্ষ মরুর বুকে শিশু পুত্রকে নিয়ে একাকী অবস্থানের হুকুম এলে তিনিও তখন লাব্বায়েক বলেছিলেন। অতি কষ্টে প্রতিপালিত একমাত্র সে শিশু ইসমাইলককে যখন কোরবানী করার হকুম হলো বিবি হাজেরা তখনও দ্বিধান্বিত হননি। তিনি নবী ছিলেন না। কিন্তু আল্লাহর ডাকে লাব্বায়েক বলার চেয়ে বাঁচবার অন্য কোন উচ্চতর প্রেরণার কথা তিনিও ভাবতে পারেননি। তাই তিনি মহান আল্লাহর প্রতি নির্দেশে লাব্বায়েক বলেছেন সমগ্র অস্তিত্ব ও অঙ্গিকার নিয়ে। এভাবে আল্লাহর ডাকে সর্বাবস্থায় লাব্বায়েক বলার যে শিক্ষা ইব্রাহিম (আ) এবং তাঁর পরিবার রেখেছেন তা সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে আজও  অনন্য হয়ে আছে। প্রতি যুগের মুসলমান বাঁচবে সে ইব্রাহিমী মিশন নিয়ে। আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এবং তাঁর পরিবারের মিশনে ও আত্মত্যাগে এতই খুশি হয়েছিলেন যে সেটিকে পবিত্র কোরআনে বার বার উল্লেখ করেছেন। তাঁর সে মহান সূন্নতকে আল্লাহতায়ালা হ্জ্ব রূপে ফরয করেছেন। এভাবে সুস্পষ্ট করেছেন,আল্লাহপাক মোমেনের কোন ধরণের আমলে খুশি হন সেটিও।

 

লাব্বায়েক শয়তানের ডাকে

কিছু নামায-রোযা পালন, কিছু অর্থদান, কিছু সময়দান বা হজ্ব করে যারা আল্লাহকে খুশি করার স্বপ্ন দেখেন ইব্রাহিম (আঃ)’য়ের শিক্ষা থেকে তাদের বোধোদয় হওয়া উচিত। কারণ আল্লাহ চান, তাঁর হুকুমের প্রতি সর্বাবস্থায় পূর্ণ-আনুগত্য। তাই শুধু হজ্বে গিয়ে লাব্বায়েক বলায় কল্যাণ নেই। আল্লাহর নির্দেশের প্রতি লাব্বায়েক বলতে হবে দেশের রাজনীতি,সমাজনীতি, অর্থনীতি,শিক্ষা-সংস্কতি তথা সর্বক্ষেত্রে। তাই যে দেশে আল্লাহর শরিয়ত ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা নেই এবং সে লক্ষ্যে কোন চেষ্টাও নেই –বুঝতে হবে আল্লাহর হুকুমের ডাকে সেদেশে লাব্বায়েক বলার লোকও তেমন একটা নেই। সূদী অর্থনীতি, পর্দাহীনতা, নাচ-গান, অশ্লিল যাত্রা-সিনেমা যে দেশের সংস্কৃতি, সে দেশে দৃশ্যমান হয় তো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা। যে মহিলা হজ্ব করে অথচ বেপর্দা ভাবে জনসম্মুখে চলাফেরা করে, বুঝতে হবে হজ্বের সময় তাঁর মুখে লাব্বায়েক ধ্বনিত হলেও তাতে সাচ্চা ঈমানদারি ছিল না। সেটি ছিল নিছক আচার, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ঈমানদারি নয়। এমন হাজীরা তো শয়তানের ডাকেও লাব্বায়েক বলে। তাদের বেপর্দাগী ও রাজনীতিতে পুঁজিবাদ, জাতিয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠায় তাদের আগ্রহটি তো তারই আলামত। এমন ভন্ডদের কারণেই বাংলাদেশে মত মুসলিম দেশগুলিতে হাজীর সংখ্যা বাড়লেও আল্লাহর শরিয়তী বিধানের প্রতিষ্ঠার জিহাদে লাব্বায়েক বলা লোকের সংখ্যা বাড়েনি। বরং বিপুল ভাবে বেড়ে চলেছে শয়তানের হুকুমের প্রতি লাব্বায়েক বলার লোক। তাদের কারণে লোকবল বাড়ছে শয়তানের দলে। ফলে বাড়ছে সূদী ব্যাংক, বাড়ছে পতিতাপল্লি, বাড়ছে দূর্নীতি, বাড়ছে মদ্যপান, বেপর্দাগী ও ব্যাভিচার। বাংলাদেশের রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে তো এরূপ বিদ্রোহীরাই বিজয়ী। এরা হজ্ব পালন করে নিছক আচার রূপে, আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের মিশনকে নিজ জীবনে গ্রহণ করার সংকল্প নিয়ে নয়।

আল্লাহতায়ালা চান, তাঁর বান্দাহ ইসলামে পুরাপুরি প্রবেশ করুক। জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচার এটিই একমাত্র পথ। পবিত্র কোরআনে তাই বলা হয়েছে,“উদখুলুস সিলমে কা’ফ্ফা” অর্থাৎ ইসলামে দাখিল হও পুরাপুরি ভাবে। তাই ঈমানদারির অর্থ শুধু নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত পালন নয়, বরং সেটি মিথ্যাচর্চা, সূদ-ঘুষ, ব্যাভিচারি, বেপর্দাগীর ন্যায় সকল প্রকার অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকা। নইলে নেমে আসে কঠিন আযাব। মহান আল্লাহর সে কঠোর ঘোষণাটি এসেছে এভাবে,“তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখান কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তির মধ্যে নিক্ষপ্ত হবে। তারা যা করে আল্লাহ সে সম্বন্ধে বেখবর নন।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ৮৫)। ইসলামে পুরাপুরি প্রবেশের সে ছবকটি দেয় হজ্ব। এবং সেটি লাব্বায়েক বলার সামর্থ্যটি চেতনার গভীরে প্রথীত করার মধ্য দিয়ে। তখন মু’মিন ব্যক্তিটি শুধু আযানের ডাকে বা হজ্বের ডাকে লাব্বায়েক বলে না, বরং লাগাতর লাব্বায়েক বলে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি হুকুমে। লাব্বায়েক বলে জিহাদের ডাকেও। হজ্বকালে ক্বাবার পবিত্র অঙ্গণ যেমন প্রবল ভাবে মুখরিত হয় “লাব্বায়েক” ধ্বণিতে, তেমনি “লাব্বায়েক” বলার জোয়ার শুরু হয় মুসলিম দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্মকর্মেও। এবং সেটি মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তি হুকুম পালনে। ইসলামের গৌরব কালে সেটিই তো ছিল মুসলিম সমাজের সংস্কৃতি। ফলে আল্লাহতায়ালার সাহায্য এসেছিল এবং তাতে বিজয় এসেছিল মুসলিমদের।

 

 

আযাবের গ্রাসে

কোন জনপদে রহমত নাযিলের যেমন প্রেক্ষাপট থাকে, তেমনি থাকে আযাবেরও। আযাবের রয়েছে নানারূপ।  মুসলিমদের আজকের যে পরাজয়, অপমান, শত্রুশক্তির অধিকৃতি ও ধ্বংস-প্রক্রিয়া –এগুলিকে কি রহমত বলা যায়? এগুলো তো আল্লাহতায়ালার বহু প্রতিশ্রুত আযাব এবং অর্জিত হয়েছে তাদের নিজেদের হাতে। বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মুসলিমের মানসম্মান ও ইজ্জতের এখনো কি কিছু অবশিষ্ঠ আছে? স্রেফ খাদ্য-উৎপাদন, শিল্প-উৎপাদন, সড়ক-উন্নয়ন বা শিক্ষার হার বাড়িয়ে কি এ হীনতা ও অপমান থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? আযাব আসে ব্যর্থতার শাস্তি রূপে। মুসলিমদের মাঝে সে ব্যর্থতা কি কম? নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত পালন করে, এমন লোকের সংখ্যা মুসলিম বিশ্বে কোটি কোটি। কিন্ত ক’জনের মাঝে মহান আল্লাহতায়ালার ডাকে লাব্বায়েক বলার সামর্থ্য। বরং বিপুল ভাবে বেড়েছে এমন মানুষের সংখ্যা যারা লাব্বায়েক বলছে শয়তানী শক্তিবর্গের ডাকে। এটিই মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এরূপ ব্যর্থতা আযাব ডেকে আনবে সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?

মুসলিমদের ব্যর্থতাটি প্রকট ভাবে ধরা পড়ে ইসলাম থেকে তাদের দুরে সরা ও ইসলামি বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাঝে। এর ফলে মুসলিম দেশগুলিতে বিপুল সংখ্যায় বেড়েছে চোর-ডাকাত, খুনি, সন্ত্রাসী, সূদখোর, ঘুষখোর, মদখোর ও ব্যাভিচারির সংখ্যা। মুসলিম রাষ্ট্রগুলির রাজনীতি, অর্থনীতি ও আইন-আদালত মূলতঃ তাদের হাতেই জিম্মি। দেশের সর্বাঙ্গণ জুড়ে বেড়েছে মহান আল্লাহতায়ালার অবাধ্যতা। এবং কোথাও বাস্তবায়ন ঘটেনি শরিয়তের। অথচ পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণাটি হলো,“যারা আল্লাহতায়ালার নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী যারা বিচার ফয়সালা করে না তারা কাফের, …তারা জালেম ..তারা ফাসেক।” –(সুরা মায়েদা,আয়াত ৪৪-৪৭)।” ধর্মপালনের নামে মুসলমানদের মাঝে যা বেড়েছে তা হলো ইসলামের আংশিক অনুসরণ মাত্র। ইসলামের বাঁকি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলির বিরুদ্ধে চলছে লাগাতর বিদ্রোহ। এবং সে বিদ্রোহের কারণে পরাভুত হয়েছে শরিয়ত, হুদুদ, মুসলিম ঐক্য ও খেলাফতের প্রতিষ্ঠা। এরূপ আংশিক অনুসরণ ও বিদ্রোহ মহান আল্লাহতায়ালার আযাব ডেকে আনবে –সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?

মন-মগজ ও চিন্তা-চেতনার ভূমি কখনোই খালি থাকে না। সে ভূমিতে আল্লাহর জিকর ও তাঁর ডাকে লাব্বায়েক বলার চেতনাটি স্থান না পেলে তা ত্বরিৎ অধিকৃত হয় শয়তানের  হাতে। শয়তানের অধিকৃত সে চেতনার ভূমিতে শয়তানের বিধান প্রতিষ্ঠায় লাব্বায়েক ধ্বনি উঠবে –সেটিই তো স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে পতিতাবৃত্তি, সূদ-ঘুষ ও দূর্নীতি যেরূপ প্রবলতর হয়েছে -সেটি তো শয়তানের অধিকৃতিরই দলিল। এরূপ অধিকৃতির কারণেই শিরক, জাতিয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, গোত্রবাদ, বর্ণবাদ, সমাজবাদ, পূজিবাদের ন্যায় দুষ্ট মতবাদগুলোও মুসলিম ভূমিতে বিপুল সংখ্যক অনুসারি পায়। একই কারণে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের যে অঙ্গণগুলিতে ইসলামী বিধান-শূণ্য, সে অঙ্গণগুলি অধিকৃত হয়েছে শয়তানের এজেন্ডা ও ধ্যানধারণায়। এবং আদালত শরিয়তশূণ্য হওয়াতে সে অঙ্গণ অধিকৃত হয়েছে কাফেরদের প্রণীত আইনের হাতে। মুসলিম দেশের রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশের ক্ষেত্রগুলি অধিকৃতি হয়েছে তাদের হাতে যাদের অধিকাংশই ‘লাব্বায়েক’ বলে শয়তানের ডাকে। মুসলিম উম্মাহর জন্য এর চেয়ে বড় বিপর্যয় আর কি হতে পারে? মুসলিম দেশগুলিতে আজ যে বিধান প্রতিষ্ঠিত সেটি আল্লাহর বিধান নয়,সেটি মানুষের গড়া। ইসলামের বদলে প্রতিষ্ঠা পেযেছে সেকুলারিজম। শয়তানের অধিকৃত ভূমিতে মহান আল্লাহতায়ালার রহমত নেমে আসবে সেটি কি আশা করা যায়?

 

ইব্রাহিমী ইনষ্টিটিউশন

হজ্ব মূলতঃ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও তাঁর পরিবারের সূন্নত। এটি হল আদি পিতার আদর্শের সাথে পরবর্তীকালের মুসলমানদের একাত্মতার মহড়া। আল্লাহপাক তাঁর এই মহান বান্দাহ ও তাঁর পরিবারকে এভাবেই মহাসন্মানিত করেছেন। আল্লাহতায়ালা চান তার অনুগত বান্দাহগণ হযরত ইব্রাহীমের (আ) আদর্শে গড়ে উঠুক। গড়ে তুলুক এমন এক বাহিনী যার প্রতিটি সৈনিক হযরত ইব্রাহিম (আ)এর মতই আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশে দ্বিধাহীন চিত্তে লাব্বায়েক বলবে। অনুগত বান্দাদের জন্য তিনিই শ্রেষ্ঠতম মডেল। সে মডেলের অনুসরণে নবীজী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম শতকরা শতভাগ সফল হয়েছেন। ফলে নবীজী(সাঃ)র সে সফলতার কারণেই তাঁর ও তাঁর সাহাবাদের যুগকে মানব জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ বলা হয়। ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কোন নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেননি। বরং তিনি হযরত ইব্রাহিম (আঃ)’য়ের ধর্মকেই নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেছিলেন, এবং সে দ্বীনকেই ফরজ করা হয়েছে সকল মানব জাতির জন্য। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নবীজী (সাঃ)র উপর নাযিল কৃত সে নির্দেশটি হলো এরূপঃ “আপনি বলে দিনঃ আমার প্রতিপালক আমাকে সরল পথ প্রদর্শন করেছেন। সেটি একাগ্রচিত্ত ইব্রাহিমের বিশুদ্ধ ধর্ম। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।” –(সুরা আনয়াম, আয়াত ১৬১)।

বস্তুতঃ হজ্ব হলো সূন্নতে হযরত ইব্রাহিম (আঃ)এর আলোকে সত্যনিষ্ঠ মর্দে মু’মিন গড়ার পবিত্র ইনষ্টিটিউশন। এ ইনষ্টিটিউশনের শিক্ষক শুধু হযরত ইব্রাহিম (আঃ) নন, তাঁর সাথে পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) ও স্ত্রী বিবি হাজেরা। হজ্ব ও ওমরা পালনকারি প্রতিটি ব্যক্তি হলো এ ইনষ্টিটিউশনের ছাত্র। ছাত্র তারাও যারা প্রতিবছর ঈদুল আযহা’তে অংশ নেয় ও কোরবানী দেয়। প্রতি ইনষ্টিটিউশনই সুনির্দিষ্ট একটি দর্শন দেয়; দেয় বিশেষ চেতনা ও মূল্যবোধের পরিচর্যা। এখানে সে দর্শনটি হলো, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে আত্মসমর্পণ ও তাঁর প্রতি হুকুমে লাব্বায়েক বলা। পবিত্র কোরআনে আত্মসমর্পণের সে দর্শনটি বর্ননা করা হয়েছে এভাবে, “ক্বূল, ইন্নাস সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন।’’ অর্থঃ “বলুন (হে মুহাম্মদ), নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানী, আমার বেঁচে থাকা ও আমার মৃত্যু -সবকিছুই রাব্বুল আলামীনের জন্য।” –(সুরা আনআম, আয়াত ১৬২)। হাদীসে এসেছে, নবীজী (সাঃ) এ আয়াতটি পাঠ করতেন পশু কোরবানী কালে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ছিলেন আল্লাহতায়ালার প্রতি দ্বিধাদ্বন্দহীন আত্মসমর্পণের প্রতীক। প্রতীক ছিলেন তাঁর প্রতি হুকুমে লাব্বায়েক বলায়। এমন ব্যক্তিকে বলা হয় হানিফ তথা অতি নিষ্ঠাবান মুসলিম। এবং তাঁকেই বলা হয় মুসলিম উম্মাহর আদি পিতা। কোরবানী নিছক পশু কোরবানী নয়,বরং নিজের মধ্যে বেড়ে উঠা পশু-চেতনা তথা স্বার্থ-চিন্তার কোরবানী। মুসলিমের পরিচয়টি হলো, সে নিজেকে খুশি করতে বাঁচে না; বরং বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার লক্ষ্যে। হজ্ব ও ঈদুল আযহার পশু কোরবানীর মধ্যে দিয়ে সে চেতনাকেই প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়। ঈমানদারের জীবনে এটিই হলো বাঁচবার মূল প্রেরণা। হজ্ব ও ওমরাহ’র অনুষ্ঠানগুলি এবং ঈদুল আযহার পশু কোরবানী মূলতঃ সেটিই শেখায়।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্রের দ্বীনে হানিফের সাথে ঈমানদারকে একাত্ম করার লক্ষ্যেই হজ্ব ও ওমরায় ফরজ করা হয়েছে নানা রূপ রসম বা অনুষ্ঠান। সেগুলো পালন না করলে হজ্ব হয় না। বিবি হাজেরা তার শিশুপুত্রের তৃষ্ণা মেটাতে যেভাবে পানির খোঁজে সাফওয়া ও মারওয়ার মাঝে দৌড়িয়েছিলেন আজও  প্রতিটি হাজীকে -তা বৃদ্ধ হোক বা জোয়ান হোক, নারী হোক বা পুরুষ হোক, রাজা হোক বা প্রজা হোক, সকলকেই সেভাবে দৌড়াতে হয়। ‘সায়’ অর্থ প্রচেষ্ঠা। পানিহীন মরুভূমির মাঝেও হতাশ না হয়ে বিবি হাজেরা যেরূপ পানির খোঁজে স্বচেষ্ট হয়েছিলেন, তেমনি স্বচেষ্ট হতে হবে প্রতিটি মুসলমানকে জীবন-সমস্যার সমাধানে। তথা কল্যাণকর কাজে। এখানে কোন অলসতা চলে না। তাঁর সে নিরলস প্রচেষ্ঠাটি মানব জাতির জন্য এতটাই শিক্ষণীয় যে বিবি হাজেরার সে সূন্নত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে হজ্বের ফরজ বিধান রূপে। সভ্যতা সভ্যতর হয় এবং মানব-জীবন উন্নততর হয় তো কল্যাণ কর্মে এমন প্রাণান্তকর প্রচেষ্ঠার কারণেই। এ চেতনাতেই মুসলিম ভিক্ষুক হয়না, হতাশ ও হতোদ্যম হয় না। এবং কর্ম থেকে অবসরও নেয় না। বরং সর্বাবস্থাতে আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশে নিজের মেধা, অর্থ, শ্রম, সময় ও রক্তের বিনিয়োগ করে। মু’মিনের “সায়” তাই স্রেফ সাফা ও মারওয়ার মাঝে শেষ হয় না, বরং সেটি আমৃত্যু চলে। মু’মিনের জীবনে এজন্য কোন অবসর বা রিটায়ারমেন্ট নাই। কর্ম থেকে অবসর নেয়াটি মূলতঃ সেক্যুলার ধারণা।

বিবি হাজেরা ছিলেন একজন দাসী। তাই ইব্রাহিম (আ)এর নিঃসন্তান প্রথম স্ত্রী বিবি সারার আপত্তি ছিল না তাঁকে স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করায়। আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠাপূর্ণ আনুগত্যের কারণেই বিবি হাজেরা পুরস্কৃত হয়েছেন। আল্লাহপাক এভাবে সম্মানিত করেছেন এক নারীকে। তার মর্যাদা এতই বিবি হাজেরার সূন্নত পালন না করলে হজ্ব হয় না। এমন সম্মান কোন রাজাবাদশাহ বা সম্ভ্রান্ত বংশের কোন অভিজাত নরনারীর ভাগ্যে জুটেনি। কোন পয়গম্বরের ভাগ্যেও জুটেনি। বরং পেয়েছে এমন এক বৃদ্ধা মা, ঈমানের পরীক্ষায় যার অর্জনটি ছিল অতি উচু লেভেলের। যখন মক্কার নির্জন মরুপ্রান্তরে তাঁকে খাদ্যহীন, পানীয়হীন ও ঘরহীন স্থানে বসবাসের নির্দেশ পান তখন নির্দ্বিধায় লাব্বায়েক বলেন। এ ছিল করুনাময় আল্লাহর উপর তাঁর গভীর ঈমানের প্রমাণ। তাঁর অটল বিশ্বাস ছিল, এ বিশ্বে সব কিছুই চলে মহাকরুণাময় আল্লাহতায়ালার পরিকল্পনা মাফিক। যার পক্ষ থেকে মক্কা থাকার নির্দেশ এসেছে, নিশ্চয়ই এর মধ্যে তাঁর কোন পরিকল্পনা আছে। এ বিজন ভূমিতে জীবন-ধারণের সামগ্রী জোগানোর দায়িত্ব করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালার। তিনি মরুর বুকে কীটপতঙ্গদের খাদ্য জোগান। বান্দা রূপে ঈমানদারের দায়িত্ব তাঁর হুকুম পালন। তাই নিঃসংকোচে সেদিন লাব্বায়েক বলেছিলেন।

আমলের পুরস্কৃত তো হয় তার নিয়তের ভিত্তিতে। আল্লাহতায়ালা দেখেন বান্দার কোরবানীর নিয়ত ও আত্মনিয়োগটি। সে নিয়ত ও আত্মনিয়োগে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ) এর মাঝে কি কোন কমতি ছিল? হযরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন নিজের চোখ বেঁধে পুত্র ইসলামের গলায় ছুড়ি চালাচ্ছিলেন, তখন হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ)-এ দুজনের কেউ জানতেন না যে আল্লাহতায়ালা হযরত ইসমাইল (আঃ)’য়ের বদলে ভেড়াকে সেখানে কোরবানীর জন্য পেশ করবেন। খালেছ নিয়তের কারণেই তাদের কোরবানী সেদিন মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে গৃহীত হয়েছিলে। পশু কোরবানীর মধ্য দিয়ে তাদের সে কোরবানীর সূন্নত পালন করতে হয় বিশ্বের মুসলিমদের। এটি না করলে হাজীদের হজ্ব পালনই হয় না।

হজ্ব নিজেই কোন লক্ষ্য নয়, মানুষকে একটি মহত্বর লক্ষে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া মাত্র। আল্লাহর চুড়ান্ত লক্ষ্যটি হলো ধর্ম, মতবাদ, ঐতিহ্যের নামে প্রচলিত সকল মিথ্যার উপর তাঁর দ্বীনকে তথা ইসলামকে বিজয়ী করা। বস্তুতঃ এটি হলো মিথ্যার উপর সত্যের বিজয়। মানব সভ্যতার বুকে এর চেয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নাই। কোন বিবেকমান মানুষ এ ইস্যুতে নিরব থাকতে পারে? পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,”হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ তিনি তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন এ জন্য যে দুনিয়ার সকল দ্বীনের উপর এটি বিজয়ী হবে।-(সুরা ছফ,আয়াত ৯)। তবে এ বিজয় এমনিতে আসে না। এ কাজ ফেরেশতাদেরও নয়। বরং একাজ নিতান্তই মানুষদের। এ কাজ সমাধার জন্য ফেরেশতা হওয়ার যেমন প্রয়োজন নেই, তেমনি সুফি বা দরবেশ হওয়াও জরুরী নয়। বরং চাই জিহাদ। চাই সে জিহাদে অর্থদান, শ্রমদান, রক্তদান, এমনকি প্রাণদান। ইসলাম-বিরোধীদের নির্মূলে জরুরী হলো এমন এক বাহিনীর যারা আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশের প্রতি নিষ্ঠারসাথে লাব্বায়েক বলবে। যেমনটি হযরত ইব্রাহিম (আ) বলেছিলেন। নইলে বিজয় অসম্ভব। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ফেরেশতাকুল নেমে আসে একমাত্র তখনই যখন পৃথিবী পৃষ্ঠে এমন একটি বাহিনী আল্লাহর পথে জান ও মালের কোরবানীতে প্রস্তুত হয়ে যায়। আল্লাহর শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এমন একটি বাহিনী গড়তে পেরেছিলেন বলেই তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। মুসলমানরাই হচ্ছে এ কাজে তার একমাত্র বাহিনী। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা সে বাহিনীকে আখ্যায়ীত করেছেন ‘হিযবুল্লাহ’ বা আল্লাহর দলরূপে। তবে নিছক দলই যথেষ্ট নয়। সে দলের জন্য লাগাতর ট্রেনিংও অপরিহার্য। সে ট্রেনিং শুধু দৈহিক নয়; আর্থিক ও আত্মীক হওয়াটাও জরুরী। নইলে অর্থ, রক্ত ও অর্থদানের জজবা আসবে কীরূপে? হজ্বের মধ্যে সমন্বয় ঘটেছে সবগুলোরই। লাব্বায়েক হলো বস্তুতঃ এ বাহিনীর শপথ বাক্য। এখানে শপথ আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের। এটি হলো তাঁর লা-শরিক ওয়াহদানিয়াতের স্বীকৃতি এবং সে সাথে আল্লাহর ডাকে সদাসর্বদা লাব্বায়েক বলার। হাজীদের তাই বলতে হয়,”লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক,লাব্বায়েক লা-শারিকা লাকা লাব্বায়েক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়ামাতা লাকাওয়াল মুলক, লা-শারিকা লাকা লাব্বায়েক।”

 

উম্মূক্ত মিউজিয়াম

ইসলামের বিজয় আনার দায়ভারটি একার নয়, এ কাজ সমষ্টির। একাকী সাধু, সুফি বা দরবেশ হওয়া যায়, কিন্তু তাতে আল্লাহতায়ালার মুজাহিদ হওয়া যায় না। ইসলামকে বিজয়ী করার মিশনে শরীকও হওয়া যায় না। তাই সাধু, সুফি বা দরবেশের বৃদ্ধিতে আল্লাহতায়ালার ভিশন বিজয়ী হয়না। তাতে মুসলিম বিশ্ব থেকে কাফেরদের অধিকৃতি নির্মূল হয় না। ইসলামের বিজয় আনতে অন্যদের সাথে একতা গড়তে হয়। তাই প্রয়োজন, আল্লাহতায়ালার বাহিনীর অন্যদের সাথে একত্রে বসার। প্রয়োজন হলো, নানা বর্ণ, নানা ভাষা ও নানা দেশের এ বিশ্ববাহিনীর সৈনিকদের পারস্পারিক পরিচয়ের। প্রয়োজন হলো, একে অপরের সমস্যার অনুধাবনের এবং একসাথে চিন্তাভাবনা ও স্ট্রাটিজী প্রণয়নের। এজন্য জরুরী হলো বিশ্বমুসলিমের সম্মেলন। জরুরী প্যান-ইসলামিক ভাতৃত্ব। তাই মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো প্যান-ইসলামিক চেতনার সৈনিক হওয়া। বিশ্বভাতৃত্ব তাই মুসলমানের রাজনৈতিক শ্লোগান নয়, বরং তাঁর ঈমানের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফুর্ত প্রকাশ। ফলে ঈমানদার ব্যক্তি পুতুল-পুজাকে যতটা ঘৃনা করে, ততটাই ঘৃনা করে বর্ণবাদ, গোত্রবাদ ও জাতীয়তাবাদকে। কারণ এগুলো হলো মুসলিম উম্মাহর বিশ্বজনীন ভাতৃত্বের চেতনা-বিনাশী ভাইরাস। আজ  মুসলিমগণ যেভাবে বিভক্ত ও বিপর্যস্ত -সেটি মূলতঃ ভূগোল, ভাষা, বর্ণ ও গোত্র-ভিত্তিক চেতনার নাশকতার ফসল।

পারস্পরিক বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতার কবিরা গুনাহ থেকে বাঁচাতে হজ্ব নানা ভাষা, নানা বর্ণ, নানা মজহাব ও নানা দেশে বিভক্ত মুসলিমদেরকে এক বিশ্বসম্মেলনে হাজির করে। এখানে ধনি-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, সাদা-কালো সবার পোষাক যেমন এক, তেমনি আত্মার আকুতি এবং উচ্চরণও অভিন্ন। লক্ষ্য একটিই এবং সেটি হলো, মহান আল্লাহতায়ালার ডাকে লাব্বায়েক বলা এবং তাঁকে খুশি করা। মুসলিম উম্মাহর এমন এক মহামিলনের লক্ষ্যেই আল্লাহপাক তার নিজের ঘর বায়তুল্লাহ গড়েছিলেন। সেটিও নির্মিত হয়েছিল ইব্রাহিম (আঃ) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আঃ)র হাত দিয়ে। এটিই হলো মানব জাতির ধর্মীয় ইতিহাসে প্রাচীনতম ইন্সটিটিউশন। মক্কা নগরীটি সে ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত এক উম্মুক্ত মিউজিয়াম। এখানে পা রেখেছিলেন হযরত ইব্রাহিম, হযরত ঈসমাইল, বিবি হাজেরা, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর বিখ্যাত সাহাবাগণ। এ নগরের প্রতিটি প্রান্তর, প্রতিটি অলিগলি, প্রতিটি পাহাড় এবং প্রতিটি ধুলিকণায় জড়িত রয়েছে মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের স্মৃতি। এখানে রয়েছে হাজরে আসওয়াদ, মাকামে ইব্রাহিম, আরাফা, মিনা ও মোজদালেফা। মারেফাতের তথা আল্লাহর সান্নিধ্যলাভের প্রানকেন্দ্র হলো এগুলি। আল্লাহতায়ালার সৈনিকদের শপথ বাক্য উচ্চারণের এর চেয়ে পবিত্রতম আয়োজন আর কি হতে পারে? মহান আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা মানব সভ্যতার এ শ্রেষ্ঠ ভূমিতে দাঁড়িয়েই আল্লাহতায়ালার নির্দেশের জবাবে লাব্বায়েক বলেছিলেন। ফলে গড়ে উঠেছিল মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মানব। ইতিহাসের সেই একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে একই শপথ উচ্চারন করে বিশ্বের নানা কোন থেকে আগত আধুনিক যুগে ঈমানদারগণও। আধ্যাত্মিক উন্নয়নের এর চেয়ে পবিত্রতম স্থান এবং পবিত্রতম আয়োজন আর কি হতে পারে?

 

 

গুরুতর ভাবনার বিষয়

আন্তর্জাতিক এ মহাসম্মেলনের আয়োজক মহান আল্লাহতায়ালা খোদ নিজে। নইলে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এ সম্মেলনটি চৌদ্দ শত বছর ধরে সম্ভব হত না। নানা যুদ্ধ-বিগ্রহ ও দুর্যগের মাঝেও এ বিশাল সম্মেলনটি সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। অন্যরা এখানে মেহমান, আল্লাহতায়ালা এখানে মেজবান। উদ্দেশ্য  মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন হওয়ায় এ সম্মেলনে যোগ হয় পবিত্রতা। লক্ষ্য যখন এক ও অভিন্ন, তখন দ্বন্দ থাকে না। দলাদলিও থাকে না। নানা বিভিন্নতা থেকে এসে এখানে এসে সবাই অভিন্ন হয়ে যায়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ এখানে ছুটে আসে নিজস্ব অর্থে। কারো অনুদানের প্রয়োজন হয়না। হেজাজের পুণ্যভূমি যখন বৈষয়িক সম্পদে দরিদ্র্য ছিল তখনও এ হজ্ব আয়োজিত হয়েছে মানুষের নিজস্ব উদ্যোগে। মক্কা হলো ইসলামের মূক্ত নগরী। এখানে আসার জন্য অনুমতিরও প্রয়োজন নেই। আসতে বাধা দেওয়াই পরম অধর্ম। বাধা দিলে সে বাধা অপসারণ করা সকল মুসলমানের ধর্মীয় দায়িত্ব হয়ে পড়ে। এভাবেই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে এ বিশ্ব সম্মেলনে।

মিনায় অবস্থান, আরাফার মহাজমায়েত, মোযদালিফায় রাত্রিযাপন, ক্বাবার তোয়াফ এবং শয়তানের স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপের পর মুসলিম বিশ্বে আসে ঈদুল আযহা। আনে ঈদ তথা খুশি। ঈদের কারণটি নিজের বা অন্যের জন্ম নয়, বরং নিজের অর্জিত সাফল্য। মাতৃগর্ভ থেকে নিজের জন্মলাভে ব্যক্তির নিজের কোন কৃতিত্ব থাকে না, সে দানটি তো মহান আল্লাহর। ফলে প্রশংসা তো একমাত্র তারই প্রাপ্য। তাই অন্যান্য ধর্মে ধর্মীয় নেতার জন্মদিবস পালনের রীতি থাকলেও ইসলামে সেটি নাই। সাহাবায়ে কেরাম নবীজী (সাঃ)র জন্ম দিন পালনে করেছেন সে নজির নেই। মুসলমানের জীবনে প্রকৃত ঈদ মাত্র দুটি। একটি মাহে রমযানের,অপরটি ঈদুল আযহার। এ দুটি ঈদে উযপাপিত হয় ঈমানদারের জীবনের দুটি বিশাল বিজয়। একটি মাহে রমযানের মাসব্যাপী রোযা পালনের, অপরটি হজ্ব পালনের তথা আল্লাহর ডাকে লাব্বায়েক বলার।

হজ্ব যেন রোজ-হাশরের মহড়া। সর্বত্র এক পোষাক, এক বর্ণ, এবং একই আওয়াজ। সবার মধ্যে একই পেরেশানী। নানা দেশের ও নানা ভাষার মানুষ এখানে এক মানবসমুদ্রে লীন। মাথায় টুপি নেই, পায়ে জুতা নেই, গায়ে জামা নেই, আভিজাত্য প্রকাশের কোন মাধ্যমও নেই। দুই টুকরো সিলাই হীন কাপড় নিয়ে সবাই এখানে একই সমতলে। কাফনের কাপড় পরে লাশেরা যেন কবর থেকে লাখে লাখে বেরিয়ে এসেছে। সাদা-কালো, আমির-ওমরাহ, নারী-পুরুষ সবাই এখানে একাকার। সবাই ছুটেছে একই লক্ষ্যে। বান্দার মন নিংড়ানো লাব্বায়েক ধ্বনি স্মরণ করিয়ে দেয় মহান আল্লাহতায়ালার উপস্থিতিকে। আল্লাহতায়ালার স্মরণে কেঁপে উঠে বান্দার দেহ, মন তথা সমগ্র অস্তিত্ব। এখানে ভয়, বিনয় ও আনুগত্যের ভাব সর্বত্র। সবাই ঘুরছে আল্লাহতায়ালার ঘরকে কেন্দ্র করে। রোজ হাশরের দিনে মানুষ যে কতটা অসহায় হবে হজ্ব সেটিই স্মরণ করিয়ে দেয়। মৃত্যূবরণ না করেও যেন মৃত্যুর অভিজ্ঞতা। ফলে প্রেরণা মেলে সময় থাকতে জীবনের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের। ছবক দেয় রোজ হাশরের প্রস্তুতির। গুরুত্ব পায় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে হিসাব দেওয়ার আগে নিজেই নিজের হিসাব নেয়ার। পরকালীন সাফল্য লাভে এ মূল্যায়নটুকুই তো মূল। এরূপ উপলদ্ধি ছাড়া আল্লাহতায়ালাতে পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও শয়তানের দাসত্ব থেকে মূক্তি কীরূপে সম্ভব? হজ্ব সে সুযোগই এনে দেয়। কিন্তু আজকের মুসলিম জীবনে হজ্বের সে শিক্ষাটি কই? কোথায় সে আত্মসমর্পণ? কোথায় মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের জবাবে লাব্বায়েক? মুসলিম উম্মাহর জীবনে এটাই কি সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা নয়? এরূপ ব্যর্থতা নিয়ে কি মুক্তি মিলবে কি আখেরাতে? বিজয় ও গৌরব জুটবে কি এ জীবনে? প্রশ্ন হলো, এ ব্যর্থতা নিয়ে ভাবনা কোথায়? প্রথম সংস্করণ ২০/১০/২০১২, দ্বিতীয় সংস্করণ ১২/১০/২০১৩, তৃতীয় সংস্করণ ২৮/৯/২০১৪ চতুর্থ সংস্করণ ২৭/৮/২০১৮। Tweet:@drfmkamal; facebook.com/firozkamal

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *