সর্বশ্রেষ্ঠ স্বপ্ন, সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম

ফিরোজ মাহবুব কামাল

প্রকৃত মুসলিমের পরিচয় হলো, সে বাঁচে সকল স্বপ্নের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ স্বপ্নকে নিয়ে। সে সাথে বাঁচে সে স্বপ্ন পূরণের আমৃত্যু লড়াই নিয়ে। স্বপ্নটি হলো, একটি শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ। আর বিরামহীন লড়াইটি হলো, সে রাষ্ট্রের নির্মাণ এবং শত্রুর হামলার মুখে সেটির সুরক্ষা দেয়া নিয়ে। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত না হলে ইসলাম কখনোই পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পায় না, তখন মুসলিম জীবনের নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতাও থাকে না।  ইসলামের পূর্ণ-পালনও তখন সম্ভব হয়না। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন ও লড়াই দেখা গেছে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের জীবনে। বস্তুত সে লড়াইটিই হলো ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। সেটিই হলো পবিত্র জিহাদ। যার মধ্যে সে স্বপ্ন নেই এবং সে রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদও নাই, বুঝতে হবে তার মধ্যে প্রকৃত ইসলাম বা ঈমান বলতে কিছু নেই। স্রেফ দাড়ি-টুপি, পাগড়ি, নামাজ-রোজা মানুষকে মুসলিম বানায় না। সেগুলি মদিনার মুনাফিক সর্দার আব্দুল বিন উবাই ও তার তিন শত সঙ্গিরও ছিল। প্রকৃত মুসলিম তো তারাই যারা ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখে এবং সে রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ নিয়ে বাঁচে। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার সে আমৃত্যু জিহাদে তাদের বিনিয়ো্গটি অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের।

বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলির জনগণের সমস্যা শুধু ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখা নিয়ে নয়, বরং গভীরতর সংকটটি হলো কীরূপে সেটি সম্ভব -তা নিয়ে। এ প্রসঙ্গে নানা দল ও নানা নেতার নানা মত। বাংলাদেশের ন্যায় প্রতিটি মুসলিম দেশে এমন ভাবনা নিয়ে ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত বহুদল বহুবছর ধরে কাজ করছে। কিন্তু তারা কোন বিজয় পায়নি। তারা ইতিহাস গড়েছে ব্যর্থতায়। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো, তাদের পথ ও প্রক্রিয়া নিয়ে আজও কোন গবেষণা হয়নি।  কোথায় তাদের ত্রুটি -সেগুলো নিয়েও কোন চিন্তাভাবনা হয়নি। এ কাজে অনুসরণ করা হয়নি নবীজী (সা:)‌’র সূন্নত। বরং প্রতিটি দলই নিজ নিজ পদ্ধতির আবিস্কার করেছে। এ নিয়ে বিতর্ক নেই, বাংলাদেশের ন্যায় বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলাম একটি পরাজিত জীবন বিধান। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, শ্রেষ্ঠ সমাজ ও শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র নির্মাণের কুর‌’আনী রোডম্যাপটি অতি সীমিত পরিসরে বেঁচে আছে মাত্র। রাষ্ট্র ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো দখলে গেছে ইসলামের বিপক্ষ শক্তির হাতে। যে কোন সত্যিকার মুসলিমের কাছে ইসলামের এরূপ পরাজয় মেনে নেয়াটি অতি অসহ্য ও পীড়াদায়ক।

কিছু মানসিক বিকলাঙ্গ ও দৈহিক ভাবে পঙ্গু ব্যক্তি ছাড়া প্রতিটি ব্যক্তিকেই মহান আল্লাহতায়ালা বহুবিধ দৈহিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অর্থনৈতিক গুণাবলী ও সামর্থ্য দিয়েছেন। এগুলি হলো তাঁর দেয়া অতি মূল্যবান নিয়ামত। মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া সে সামর্থ্যগুলিকে মানব কি শুধু নিজের লিপ্সা ও স্বার্থপূরণে কাজে লাগাবে? সেটি তো পশুর কাজ। পশুকে জান্নাত নিয়ে ভাবতে হয় না, তাই পশুর জীবনে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের নির্মূলের জিহাদ থাকে না। কিন্তু ঈমানদারকে তো পশুর পর্যায় থেকে অনেকে উপরে উঠতে হয়। তাকে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ নিয়ে বাঁচতে হয়। এ কাজের মধ্য দিয়েই সে নিজেকে জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তোলে। অর্ধেকের বেশী সাহাবা এ জিহাদে শহীদ হয়েছেন। এবং তাদের সে জিহাদের কারণেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং মুসলিমগণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে। জিহাদ যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত; তেমনি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই হলো সমগ্র মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম। এটিই হলো নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত। নবীজী (সা:)’র হাতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাওয়াতে কোটি কোটি মানব জাহান্নামের পথ থেকে মুক্তি পেয়েছে। তারা যেমন সিরাতাল মুস্তাকীমের সন্ধান পেয়েছে, তেমনি নিজেদেরকে জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তুলতে পেরেছে। নিজ শ্রম, নিজ মেধা, নিজ অর্থ ও নিজ রক্ত দিয়ে মানব জাতির এতো বড় কল্যাণ আর কোন কালেই কোন জনগোষ্ঠিই করেনি। এজন্যই প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণই হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব।

কোন মুসলিম কি কখনো কোন শত্রু -শক্তির কাছে পরাজয় ও আত্মসমর্পণ মেনে নেয়? মেনে নেয় কি নিজ দেশে শত্রুশক্তির অধিকৃতি ও ইসলামের পরাজয়? মুসলিম ভূমিতে শত্রুর হামলা হলে জিহাদ ফরজ হয়ে যায়। সে সময় নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকা হারাম। নীরব ও নিষ্ক্রিয়তা ব্যক্তিকে মুনাফিকে পরিণত করে। নামাজে কাজা আছে কিন্তু জিহাদে কাজা নাই। কোন মুসলিম ভূমিতে ইসলামের পরাজয় হলে বিচার দিনে সে পরাজয় নিয়ে আল্লাহতায়ালার দরবারে অবশ্যই তার নিজের কৈফিয়তটি দিতে হবে। পরাজয় ও শয়তানী শক্তির বিজয় নিরবে মেনে নেয়াটি মহান আল্লাহতায়ালার সাথে চরম গাদ্দারী। সে গাদ্দারী জাহান্নামে নেয়। তখন নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও দান-খয়রাত কোন কাজ দেয় না। এগুলি তো বহু সূদখোর, ঘুষখোর ও দুর্বৃত্ত মুনাফিকও করে।

মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া কুর’আনী জীবনবিধানের প্রতি অবহেলা এবং সেটিকে পরাজিত রাখার যে কোন প্রচেষ্ঠাই মূলত নিরেট কাফির ও মুনাফিকদের কাজ। কোন ঈমানদার কখনো সেটি করতে পারে না। এমন পাপ যা অনিবার্য করে তা হলো কঠোর আযাব। অথচ আজকের মুসলিমগণ বাঁচছে সে পাপ ও নিজ হাতে অর্জিত আযাব নিয়ে। তারা যেন নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করেই খুশি, যেন শত্রুর দখলদারী থেকে মুক্তি পাওয়া এবং ইসলামের বিজয় নিয়ে তাদের কোন দায়বদ্ধতাই নাই। ফলে তাদের কাছে গুরুত্ব পায় না কুর’আনী রোডম্যাপ। কারণ, রোডম্যাপ তো তখনই গুরুত্ব পায়, যখন কাঙ্খিত গন্তব্যস্থলটিতে পৌঁছার জন্য নিজে রাস্তায় নামে। যারা পথেই নামে না, এবং কোন গন্তব্যে পৌঁছাই যেখানে উদ্দেশ্য নয়, তাদের কাছে আবার রোডম্যাপের গুরুত্ব কী? কোনটি সঠিক পথ আর কোনটি ভূল পথ -সে প্রশ্নটি তো আসে রাস্তায় নামার পরে। বাংলাদেশের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা মূলত এক্ষেত্রটিতে। তারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভাবেনা। ফলে সে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে কীরূপ ছিল নবীজী (সা:)’র সূন্নত -তা নিয়েও তারা ভাবে না। ঘুমন্তু মানুষের হাতে রোডম্যাপ তুলে দেওয়ার অর্থ হয় না। প্রথমে তার ঘুম ভাঙ্গাতে হয়। কিন্তু সে ঘুম ভাঙ্গানোর কাজটিও বাংলাদেশে হচ্ছে না। কারণ, যে আলেমগণ ঘুম ভাঙ্গাবে তারাই আছে গভীর ঘুমে। তারা নবীজী (সা:)‌’র টুপি-পাগড়ি, লম্বা দাড়ি, মিষ্টি খাওয়ার সূন্নতের ন্যায় ঝুঁকিমুক্ত নানা সূন্নত নিয়ে কথা বললেও ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের সূন্নত নিয়ে কথা তারা বলে না। সে সূন্নত পালনের জন্য নবীজী (সা:)’র ন্যায় তারা জিহাদেও নামে না। কারণ, সে সূন্নত পালনে জান ও মালের কুরবানী দিতে হয়।  

নবীজী (সা:)’র গৃহে শুধু জায়নামাজ ছিল না,  ৯টি তরবারীও ছিল। ঢাল এবং বর্মও ছিল। সুরা আনফালের ৬০ নম্বর আয়াতে হুকুম দেয়া হয়েছে সর্বশক্তি দিয়ে শত্রু শক্তির হামলার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে। বলা হয়েছে, সে সামরিক প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে শত্রুদের সন্ত্রস্ত করতে। মহান আল্লাহতায়ালার সে নির্দেশটি এসেছে এভাবে:

وَأَعِدُّوا۟ لَهُم مَّا ٱسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍۢ وَمِن رِّبَاطِ ٱلْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِۦ عَدُوَّ ٱللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ

 অর্থ: “শত্রুদের মোকাবেলায় তোমাদের সর্বশক্তি দিয়ে প্রস্তুত হও। এবং প্রস্তুত রাখো তোমাদের অশ্ববাহিনীকে। এগুলি দিয়ে তোমরা সন্ত্রস্ত করো আল্লাহর শত্রুকে এবং তোমাদের শত্রুদেরকে।” মহান আল্লাহতায়ালার সে হুকুম মোতাবেক যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি দেখা গেছে নবীজী (সা:) ও সাহাবাদের ঘরে ঘরে।  কিন্তু আজ কোথায় সে প্রস্তুতি?  মুসলিম দেশগুলি আজ শত্রু-শক্তির হাতে অধিকৃত। ফলে বেঁচে নাই নবীজী (সা:)’‌র ইসলাম। আজকের মুসলিমগণ বাঁচছে ইসলামের শত্রুদের কাছে আত্মসমর্পণ নিয়ে। প্রশ্ন হলো, ইসলামের শত্রু-শক্তির এরূপ অধিকৃতি কি নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ কখনো মেনে নিতেন? তারা কি কখনো মেনে নিতেন আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের বিলুপ্তি? প্রশ্ন হলো, যারা নিজেদেরকে আশেকে রাসূল (সা:) রূপে জাহির করে, তাদের মাঝে কোথায় সে নবীজী (সা:)’র সূন্নত।  আলেমদের অনেকে নিজেদেরকে আল্লাহতায়ালার ওলী বলে জাহির করে। অথচ আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন মুসলিম দেশগুলিতে বিলুপ্ত। শিক্ষাঙ্গণে বিলুপ্ত হয়েছে পবিত্র কুর’আন ও হাদীস থেকে শিক্ষাদান। বেঁচে নাই ইসলামের অর্থনীতি ও জনকল্যাণমূলক সমাজ নীতি (welfare social policy) । মুসলিম রাষ্ট্রগুলি পরিণত হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শো-কেসে। শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকলে তারা কি এ অবস্থায় নিরব ও নিষ্ক্রিয় থাকতো? নিরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা তো মৃত ঈমানের আলামত। ঈমান থাকলে তো তারা আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তারা শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠার জিহাদ শুরু করতো -যেমনটি হয়েছিল নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের আমলে । 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *