রাজনৈতিক জিহাদে অনীহা এবং ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে ব্যর্থতা

 ফিরোজ মাহবুব কামাল

ব্যর্থতা রাজনীতির জিহাদে

রাজনীতিকে সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, সোসালিস্ট বা অমুসলিমগণ যে ভাবে দেখে, যারা প্রকৃত ঈমানদার তারা কখনোই বিষয়টিকে সেভাবে দেখে না। রাজনীতিকে অন্যরা পেশা, নেশা, ইত্যাদি যাই ভাবুক, ইসলামে এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। এটিই হলো ঈমানদারের পবিত্র জিহাদ। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা বা দ্বীন একটি দেশে কতটা বিজয়ী হবে -সেটি সেদেশের মুসলিম জনসংখ্যা বা মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যার উপর নির্ভর করে না। সেটি নির্ভর করে সে দেশের মুসলিমগণ আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদ নিয়ে কতটা বাঁচে -তার উপর। যে দেশে জিহাদ নাই, সে দেশে ইসলামের বিজয় বা প্রতিষ্ঠাও থাকে না। বিজয় সেখানে ইসলামের শত্রুপক্ষের। পবিত্র কুর’আনে মুমিনদের প্রতি যে হুকুমটির ঘোষণা বার বার দেয়া হয়েছে তা হলো, “জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ তথা আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদ”। এর অর্থ: মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ।

মাহে রমজানে রোজার  হুকুম পবিত্র কুর’আনে মাত্র একবার এসেছে। সেটি সুরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে। তাতেই রোজা ফরজ হয়ে গেছে। কিন্তু যে “জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ” য়ের হুকুম পবিত্র কুর’আনে অসংখ্য বার এসেছে সে জিহাদের ফরজ ক’জন মুসলিম পালন করছে? নবীজী (সা:)’র যুগে কোন সাহাবীর জীবনে এ হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা যায়নি। তাদের প্রত্যেকে সশস্ত্র জিহাদে অংশ নিয়েছেন; অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। ফলে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা তখন বিজয়ী হয়েছে। এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র। মুসলিমদের উত্থান ঘটেছে বিশ্বশক্তি রূপে। অথচ আজকের মুসলিমগণ বাঁচছে ফরজ জিহাদের বিরুদ্ধে পূর্ণ বিদ্রোহ নিয়ে। সেদিনের মুসলিমদের থেকে আজকের মুসলিমদের মূল পার্থক্যটি এখানেই; সে পার্থক্যটি টুপি-দাড়ি, ওজু-গোছল,  কুর’আন তেলাওয়াত, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে নয়।

 প্রতিটি ঈমানদারকে যেমন রাজনীতি নিয়ে বাঁচতে হয়, তেমনি সে রাজনীতিতে একটি এজেন্ডাও থাকতে হয়। রাজনীতির সমগ্র লড়াইটি হয়, সে এজেন্ডাকে বিজয়ী করা নিয়ে।  আগুনের পরিচয় যেমন তার উত্তাপে, তেমনি ঈমানদারের পরিচয় হলো তার রাজনৈতিক জিহাদে। তবে মুমিনের রাজনীতির এজেন্ডাটি তাঁর নিজের নয়, কোন দলেরও নয়। সেটি হলো খোদ মহান আল্লাহতায়ালার। পবিত্র কুর‌’আনে সে এজেন্ডাটি সুরা তাওবাহ, সুরা ফাতাহ ও সুরা সাফ’য়ায় ঘোষিত হয়েছে। সেটি হলো: “লি’ইউয হিরাহু আলা দ্দীনি কুল্লিহি”। অর্থ: সকল ধর্ম, সকল জীবন দর্শন ও সকল মতবাদের উপর ইসলামের পূর্ণ বিজয়। প্রতিটি ঈমানদারের দায়িত্ব হলো, সে এজেন্ডার বিজয়ে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বক্ষনিক সৈনিক হয়ে যাওয়া। বেঈমানী হলো, মহান আল্লাহতায়ালার সে ঘোষিত এজেন্ডার সাথে বেঈমানী করা। অধিকাংশ মুসলিম দেশে চলছে এ বেঈমানদের শাসন। সেটি বুঝা যায়, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে তাদের সুস্পষ্ট গাদ্দারী দেখে। সে গাদ্দারীর কারণেই নির্মিত হয়নি কোন ইসলামী রাষ্ট্র -যেমন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল নবীজী (সা:)’র হাতে। এ ব্যর্থতার কারণেই মুসলিম দেশগুলিতে প্রতিষ্ঠা পায়নি আল্লাহতায়ালার দ্বীন তথা তাঁর সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তী আইন। বরং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, রাজতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, পুঁজিবাদের ন্যায় জাহিলিয়াত।      

আধুনিক আরবী ভাষায় রাজনীতিকে বলা হয় “সিয়াসা”।  ইসলামী শব্দমালায় এটি এক নতুন পরিভাষা। নবীজী (সা:‍)’র যুগে সিয়াসা শব্দের ব্যবহার ছিল না। পবিত্র কুর’আনেও সিয়াসা শব্দের উল্লেখ নজরে পড়ে না। তবে রাজনীতির নামে আজ যা কিছু হয়, সেটি নবীজী (সা:)’র যুগেও ছিল। রাজনীতি বলতে বুঝায় রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রের সুরক্ষা, উন্নয়ন, জনকল্যাণ, আইনের শাসন ও রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে নানাবিধ বিধিমালা প্রণয়ন ও সেগুলির বাস্তবায়ন। রাজনীতির অঙ্গণটি কখনোই কোন খালি জায়গা নয়; পুরাপুরি এক পক্ষেরও নয়। সেখানে নানা পক্ষ থাকে; তাদের নানাবিধ এজেন্ডাও থাকে।  প্রতিটি পক্ষই লড়াই করে নিজেদের এজেন্ডাকে বিজয়ী করা নিয়ে। এ কারণেই রাজনীতির অঙ্গণে সর্বদাই একটি যুদ্ধাবস্থা থাকে। মুসলিম দেশের সে যুদ্ধাঙ্গণে ঈমানদারগণও একটি প্রবল পক্ষ। তাদের এজেন্ডা হলো ইসলামকে বিজয়ী করা এবং মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠ দেয়া। সে লড়াইয়ে যারা নিহত হয়, তাদের বলা হয় শহীদ।  নবীজী (সা:)’র যুগে জিহাদই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল এবং মুসলিমদের বিশ্বশক্তির মর্যাদায় আসীন করেছিল। ঈমানদারদের রাজনীতি তাই কখনো সেক্যুলার রাজনীতি বা ‍“সিয়াসা” হয় না; সেটি হয় পবিত্র জিহাদ। জিহাদ তো একমাত্র সে লড়াইকেই বলা হয়, যেখানে থাকে মহান আল্লাহতায়ার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার এজেন্ডা। রাজনৈতিক অঙ্গণের সে লড়াইকে শুধু রাজনীতি বা “সিয়াসা” বললে সে পবিত্র এজেন্ডাটি প্রকাশ পায়না। এ জন্যই নবীজী (সা:) ও সাহাবাদের যুগে সিয়াসা’র ন্যায় সেক্যুলার রাজনৈতিক পরিভাষা বাজার পায়নি -যেমনটি আজ পেয়েছে। ঈমানদারদের কাছে বৈধ আইন মাত্র একটিই -সেটি হলো শরিয়তের আইন। শরিয়ত বিরোধী কোন আইন মানলে কাফির হতে হয়। তেমনি রাজনীতির অঙ্গণেও একমাত্র হালাল রাজনীতি হলো জিহাদের রাজনীতি। সেক্যুলার রাজনীতিতে জান, মাল ও মেধা বিনিয়োগ হলে তাতে পরাজয় বাড়ে ইসলামের। তাই সে রাজনীতিও হারাম।

রাজনীতি শুধু রাষ্ট্র নির্মাণ, রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষা দেয়ার হাতিয়ার নয়, বরং সেটি হলো নানা ভাষা, নানা বর্ণ, নানা ধর্ম ও নানা অঞ্চলের মানুষের মাঝে সৌহাদ্য, সম্প্রতি ও সংহতি গড়ার হাতিয়ার। রাজনীতি দেয় জনগণের জীবনে ভিশন, দেয় বাঁচবার মিশন এবং দেয় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এজেন্ডা। যে দেশে বা যে ভূমিতে সুস্থ রাজনীতি নাই, মানুষ সেখানে বিভ্রান্ত, বিভক্ত এবং বিচ্যুতির শিকার হয়; এবং গোত্র, বর্ণ ও ভাষার নামে রক্তাক্ত সংঘাতে নামে। রাজনীতি হলো দুর্বৃত্তির নির্মূল, সুবিচারের প্রতিষ্ঠা এবং সমাজ থেকে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আবর্জনা সরানোর হাতিয়ার। রাজনীতির মধ্য দিয়েই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিশুদ্ধ হয়। তখন নির্মিত হয় সভ্যতর মানব, কল্যাণকর রাষ্ট্র ও উচ্চতর সভ্যতা। তাই যাদের মাঝে দুর্বৃত্তির নির্মূল, সুবিচারের প্রতিষ্ঠা এবং উন্নত ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতা গড়ার প্রবল তাড়না থাকে, তাদোর মাঝে রাজনীতির তাড়নাটিও প্রবল। এদেরকেই রাজনীতির লড়াইয়ে দেখা যায়। তারা অর্থ, শ্রম ও রক্তের বিনিয়োগও করে।

 

বেঁচে নাই নবীজী (সা)’র রাজনৈতিক সূন্নত

 রাজনীতির তাড়না না থাকাটি শুধু বিবেকহীনতা নয়; সেটি দায়িত্বহীনতা এবং মানবতাশূণ্যতাও। এমন মানুষদের দিয়ে কখনোই কোন সভ্য সমাজ ও সভ্য রাষ্ট্র গড়ে উঠে না। এমন মানুষেরা দুর্বৃ্ত্তের নির্মূল ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা নিয়ে মাথা ঘামায় না। পশু যেমন শুধু নিজের জন্য বাঁচে, এরাও তেমনি শুধু নিজের বাঁচে। বাংলাদেশে এমন রাজনীতিবিমুখ মানুষদের সংখ্যাটি বিশাল। এদের কারণেই বাংলাদেশ দুর্বৃত্তিতে বার বার রেকর্ড গড়েছে -যেমন এ শতাব্দীর শুরুতে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়েছে।  পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশে রাজনীতির জিহাদ থেকে মুসলিমদের দূর রাখা হচ্ছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। অনেকে রাজনীতিকে দুনিয়াদারি বলছে। যারা এমন কথা বলে, তারা আশেকে রাসূল (সা:) হওয়ারও দাবী করে। নবীজী (সা:)’র সূন্নতের অনুসারী হওয়ার দাবীও করে। কিন্তু নবীজী (সা:) যে ১০টি বছর রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন -সে কথাটি তারা বলে না।

রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার মধ্য দিয়েই নবীজী (সা:) রাজনীতি তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের অঙ্গণে অনুকরণীয় সূন্নত রেখে যান। কোন ঈমানদার ব্যক্তি যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে, তাঁর দায়িত্ব হয় নবীজী (সা:)’র সে মহান রাজনৈতিক সূন্নতকে অনুসরণ করা।  এবং যে কুর’আনের বাণী হলো: যে অনুসরণ করে রাসূলকে সে অনুসরণ করে আল্লাহকে। নবীজী (সা:)’র গৃহে শুধু জায়নামাজ ছিল না, ৯ খানি তরবারি ছিল এবং ছিল ঢাল-বর্ম। শত্রু শক্তির নির্মূলে তিনি নিজে যুদ্ধে নেমেছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন। সাহাবাগণ নবীজী (সা:)’র সে সূন্নতকে অনুসরণ করেছেন। কোন মুসলিম রাষ্ট্র যখন শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃত হয় তখন নবীজী (সা:)’র এ সূন্নত পথ দেখায়।  কিন্তু নবীজী (সা:)’র সে মহান রাজনৈতিক সূন্নত আজ মুসলিমদের মাঝে বেঁচে নাই। ভূয়া আশেকে রাসূলগণ নবীজী (সা:)’র এ রাজনৈতিক সূন্নতের কথা কখনোই মুখে আনে না। তাদের কথা শুনে মনে হয়, নবীজী (সা:) রাজনীতির ধারে কাছেও ছিলেন না।  এভাবেই এসব ভূয়া আশেকে রাসূলগণ চালিয়ে যাচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে নানারূপ নাশকতা। এরা জালেম শাসক নির্মূলের জিহাদে নাই। ইসলামী রাষ্ট্র ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার জিহাদেও নাই। দুর্বৃত্তমুক্ত একটি সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদেও তারা নাই। এরা বাঁচছে ইসলাম বিরোধী সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ নিয়ে। তাদের অনেককেই দেখা যায় স্বৈরশাসকের প্রশংসা গীত গাইতে।

মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একমাত্র তাঁরাই একাত্ম হয় যারা তাঁদের রবের কাছে বিক্রয় করে নিজেদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে। নামাজ-রোজা, হজ্জ-উমরাহ তো বহু ঘুষখোর, সূদখোর, মিথ্যবাদীও পালন করে। কিন্তু তারা মহান আল্লাহতায়ালার রাজনৈতিক এজেন্ডার সাথে একাত্ম হয় না। বরং একাত্ম হয় শয়তানের এজেন্ডার সাথে। তাদের কারণেই বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বিলুপ্ত হয়েছে শরিয়তী আইন। এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কুফুরি আইন। এবং দীর্ঘকাল শাসন চলছে হিন্দুত্ববাদী ভারতের সেবাদাসদের। অথচ যারা প্রকৃত ঈমানদার তারা কাজ করে মহান আল্লাহতায়ালার আনসার তথা সাহায্যকারী রূপে। মুমিনের উপর মহান আল্লাহতায়ালার আনসার তথা সাহায্যকারী  হওয়ার হুকুমটি এসেছে সুরা সাফের ১৪ নম্বর আয়াতে। হুকুমটি যেহেতু মহান আল্লাহতায়ালার, ফলে সেটি ফরজ প্রতিটি মুমিনের উপর। সত্যিকার ঈমানদার মাত্রই তাই সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহতায়ালার আনসার। এমন ঈমানদারগণই ইসলামের বিজয়ে বিনিয়োগ করে তাঁদের অর্থ, শ্রম, মেধা, রক্ত ও সর্ববিধ সামর্থ্যের।  সে বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে গড়ে তোলে জান্নাতের যোগ্য রূপে। দেশের রাজনীতিতে এমন বিনিয়োগ না থাকলে প্রতিষ্ঠা পায় দুর্বৃত্ত ও অপরাধীদের দখলদারী। তখন সাধারণ মানুষের জীবন থেকে তখন বিলুপ্ত হয় শান্তি, শৃঙ্খলা এবং জান-মালের নিরাপত্তা। তখন একতা ও সংহতির বদলে বিভক্তি, দলাদলি ও দেশভাঙ্গার কাজও উৎসবে পরিণত হয়।

  

সভ্য রাজনীতি এবং অসভ্য রাজনীতি

রাজনীতি হলো সভ্য মানব, সভ্য সমাজ, সভ্য রাষ্ট্র ও সভ্য সংস্কৃতি গড়ার শিল্প।  সে সাথে সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প হলো দুর্বৃত্ত নির্মূলের ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার। তাই যে জাতি জন্ম দেয় মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, রাষ্ট্র, সভ্যতা ও সংস্কৃতি -বুঝতে হবে সে জাতির রাজনীতিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ। নবীজী (সা:) ও সাহাবায়ে কেরামদের আমলে তো সেরূপ অতি উচ্চমানের মানব, রাষ্ট্র, সভ্যতা ও সংস্কৃতি নির্মিত হয়েছিল। সর্বশ্রেষ্ঠ সে রাজনীতি ছিল,  নবীজী (সা:) ও সাহাবায়ে কেরামের। তাদের সে রাজনীতি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের তথা জিহাদের। এ পৃথিবী পৃষ্ঠে আর কেউই রাজনীতিকে এরূপ উচ্চমার্গীয় ইবাদতে পরিণত করতে পারিনি। ইবাদতের সে তাড়না নিয়ে শুধু শাসকগণই নন, নাগরিকগণও রাজনীতি করতেন। ইবাদতের তাড়না ছিল বলেই বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৫০ গুণ বৃহৎ রাষ্ট্রের খলিফার জন্য কোন প্রাসাদ নির্মিত হয়নি। যে গৃহে তিনি আগে থেকেই থাকতেন সে গৃহে থেকেই খলিফার দায়িত্ব পালন করেছেন। মধ্য রাতে জনগণের অবস্থা জানতে রাস্তায় একাকী টহল দিতেন। আটার বস্তা নিজে কাঁধে নিয়ে গরীবের গৃহে পৌঁছে দিতেন। মদিনা থেকে জেরুজালেম -প্রায় ৭৫০ মাইলের পথ, অতিক্রম করেছেন একজন মাত্র সহচরকে সাথে নিয়ে। চলার পথে কখনো খলিফা উঠের পিঠে চড়েছেন এবং কখনো উঠে চড়েছেন তার সঙ্গি এবং খলিফা নিজে উঠের রশি টেনেছেন। সমগ্র মানব ইতিহাসে এমন ঘটনা কি কখনো ঘটেছে? এ সব কিছুই মহান আল্লাহতায়ালা দেখেছেন। গৌরব যুগের সে মুসলিমদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রূপে আখ্যায়ীত করেছেন সর্বদ্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালা। সেটি সুরা আল-ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে। কেন সে মহান মর্যাদা পেয়েছে -উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা সেটিও উল্লেখ করেছেন। সেটি হলো ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা এবং দুর্বৃত্তির নির্মূলের রাজনীতি। সে সাথে বলা হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার উপর তাদের অটল বিশ্বাসের কথাও। তাদের সে বিশ্বাসটি ছিল সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া কুর’আনী রোডম্যাপের উপরও।

উপরিউক্ত আয়াতে রাজনীতির উল্লেখ করা হয়নি। তবে এটুকু সহজবোধ্য যে, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং দুর্বৃত্তির নির্মূলের ক্ষমতা একমাত্র তাদেরই থাকে -যাদের হাতে থাকে চুড়ান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা। একমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতাধারীদের হাতেই থাকে দেশের পুলিশ, প্রশাসন ও আইন-আদালত। এ ক্ষেত্রে মোল্লা-মৌলভী, মসজিদের ইমাম ও সাধারণ জনগণের সামর্থ্য অতি সামান্য। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও দুর্বৃত্তির নির্মূলই হলো সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের একমাত্র পথ। তবে এ আয়াতটর মধ্যে অন্তর্নিহিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও রয়েছে। সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, কি করে একটি জনগোষ্ঠি সর্বনিকৃষ্ট জাতির মর্যাদা পাবে সেটির। সর্বনিকৃষ্ট সে জাতির পর্যায়ে তারাই পৌঁছে যারা বিশ্বরেকর্ড গড়ে দুর্বৃত্তিতে ও মুখ ফিরিয়ে নেয় সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা থেকে। এটিই হলো অসভ্য রাজনীতির পথ। পরিতাপের পথ হলো, সে পথটিই ধরেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সেটি প্রমাণ করেছে গুম, খুন, ধর্ষণ, অপহরন, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি ও সন্ত্রাসের প্লাবন সৃষ্টি করে এবং দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়ে। ফলে বুঝা যায়,  বাংলাদেশের রাজনীতি কতটা নিম্ন মুখী। এ থেকে আরো বুঝা যায়, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে  সভ্যতর করার কাজ এ রাজনীতিতে কিছু হয়নি। বরং শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তির নামে বহু কিছুই হয়েছে দেশবাসীকে নিছক অসভ্যতর করার লক্ষ্যে।

পশুদের মাঝে রাজনীতি নাই। ফলে তাদের মাঝে সভ্যতার হওয়ার প্রক্রিয়াও নাই। হাজার হাজার বছর আগে পশুরা যেভাবে বাস করতো ও পানাহার করতো আজও সেভাবেই করে। পশুরা শুধু পানাহার, যৌন জীবন ও বংশ বিস্তার নিয়ে বাঁচে। ফলে ব্যর্থ হয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়তে। পশুর ন্যায় শত শত জনগোষ্ঠিও এমন রয়েছে যারা ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র ও সভ্যতা গড়তে। এ পৃথিবী পৃষ্ঠে ভাষার সংখ্য বহু হাজার। সেসব ভাষার জনগোষ্ঠির সংখ্যাও বহু হাজার। কিন্তু সবার দ্বারা সভ্য রাষ্ট্র গড়ে উঠেনি। তাদের ব্যর্থতার প্রধান কারণ, তারা ব্যর্থ হয়েছে পানাহার, ঘরবাঁধা, কৃষিপালন, পশু পালন ও মৎস শিকারের বাইরে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে। পরিতাপের বিষয় হলো, সভ্য রাষ্ট্র গড়তে চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশও। যেদেশে গুম, খুন, অপহরণ, সন্ত্রাস, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, অর্থলুট ও ধর্ষণের জোয়ার -সেদেশে কি কখনো সভ্য রাষ্ট্র নির্মিত হয়?  

                                                                                                                                                      ইসলামী রাষ্ট্রের এজেন্ডা ও অনৈসলামী রাষ্ট্রের এজেন্ডা

মুসলিমকে শুধু ইসলামী লেবাস, হালাল খাবার, মসজিদ-মাদ্রাসা, কুর’আন তেলাওয়াত ও ইবাদত নিয়ে বাঁচলে চলে না, তাকে বাঁচতে হয় ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস নিয়ে। পশুপাখীরাও বসবাসের জন্য নিরাপদ আস্তানা খুঁজে। ইসলামী রাষ্ট্রই হলো মুসলিমের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ও দ্বীন পালনের জন্য সবচেয়ে সহায়ক স্থান। সেরূপ রাষ্ট্র না থাকলে সেরূপ একটি রাষ্ট্রকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠা দিতে হয়। যেমন নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। এটিই হলো মুসলিম জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ কাজটি না হলে পূর্ণ ইসলাম পালন যেমন অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব হয় পূর্ণ মুসলিম হওয়া।  একটি রাষ্ট্র কতটা ইসলামী এবং কতটা অনৈসলামী -সেটি খালি চোখেই দেখা যায়। সেটি বুঝতে গবেষণা লাগে না। ইসলামী রাষ্ট্রে অবশ্যই নিম্নের বৈশিষ্ঠগুলি থাকতে হয়:  

এক). ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার; কোন রাজা, দল, বর্ণ, শ্রেণী বা জনগণের নয়। শাসক ও জনগণ কেবল খলিফা মাত্র, কখনোই সার্বভৌম নয়। সার্বভৌম হওয়াটাই আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। দুই). ইসলামী রাষ্ট্রের আইন-কানুন মানুষের রচিত হবে না, সেগুলি অবশ্যই হবে শরিয়তের -অর্থাৎ কুর’আন-হাদীস, এজমা ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে।  জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব আইনের প্রণয়ন নয়, বরং সে আইনের পূর্ণ প্রয়োগ। সরকারের ক্ষমতা থাকবে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, হাসপাতাল, ইমরাত, স্কুল-কলেজ, শিল্প কারখানা, অস্ত্র নির্মাণ ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরীর ব্যবস্থা নেয়া। তিন). রাষ্ট্রের কাজ হবে জনগণকে সিরাতাল মুস্তাকীম চেনানো ও তাদের জন্য সে পথে চলাটি সহজ করা এবং মিথ্যা ধর্ম, মিথ্যা মতবাদ ও দুর্বৃত্তির ফেরিওয়ালাদের কাজকে অসম্ভব করা।  চার). রাষ্ট্র সুচিশ্চিত করবে প্রতিটি নাগরিকের ইজ্জত-আবরু ও জীবন নিয়ে বাঁচার স্বাধীনতাকে। থাকতে হবে প্রত্যেকের মতপ্রকাশ, ধর্ম পালন, সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা। গুরুত্ব পাবে জনগণের মতামত। পাঁচ). রাষ্ট্রে থাকবে আইনের শাসন। কেউই আইনের উর্দ্ধে থাকবে না। আইন কাজ করবে তার নিজ গতিতে। লক্ষ হবে দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুনীতির প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্র কখনোই অপরাধীর পক্ষ নিবে না।  ছয়). রাষ্ট্র হবে জনকল্যাণমূলক তথা welfare state ; অভিভাবক হবে দুস্থ, এতিম, অক্ষম, অসুস্থ, পঙ্গু, আশ্রয়হীনদের। খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান হলো প্রতি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সেগুলিকে সুনিশ্চিত করা। সাত). রাষ্ট্র যেমন বিশেষ কোন জনগোষ্ঠির উপর শোষন, শাসন ও নির্যাতন করবে না, তেমনি কোন বিশেষ জনগোষ্ঠিকে বৈষম্যমূলক সুযোগ-সুবিধাও দিবে না।  

 নবীজী (সা:) যখন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেন তখন আরব ভূমিতে কোন রাষ্ট্রই ছিলনা। ছিল গোত্রীয় শাসন। গোত্রীয় প্রধানের পুত্রই গোত্রীয় প্রধান হতো। গোত্রপতির উক্তিই আইন রূপে গণ্য হতো। আরবদের প্রতিবেশী ছিল পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য। সেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল রাজতন্ত্র। এসব দেশে নাগরিকদের কোন অধিকার ছিল না। সকল অধিকার ভোগ করতো তারাই যারা রাজ পরিবারের সদস্য ও রাজপরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট। ছিল না কোন আইনের শাসন। রাজার হুকুমই গণ্য হতো আইন রূপে। হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ন্যায় গুরুতর অপরাধ করলেও অপরাধীদের কোন শাস্তি হতো না। আদালতের কাজ ছিল, রাজার বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহী তাদেরকে প্রাণদন্ড দেয়া। ছিল না কোন সামাজিক সুবিচার। যারা ছিল রাজার স্তাবক বা পক্ষের লোক, সরকারি উদ্যোগে তাদের ধনি করা হতো। জায়গা-জমি দিয়ে তাদেরকে জমিদার বা সামন্ত রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়া হতো। এরা গণ্য হতো অভিজাত রূপে।  ফলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সমাজে ধনি-দরিদ্রের বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি করা হতো।

জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আজকের মত হাজার হাজার পুলিশ ছিল না, সে কাজটি করতো স্বৈরশাসক-সৃষ্ট জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনী। যুদ্ধ শুরু হলে এসব সামন্ত জমিদারদের কাজ ছিল রাজার সেনা বাহিনীতে সৈন্য জোগানো।  নারী-পুরুষ তখন গবাদি পশুর ন্যায় হাটে বাজারে বিক্রি হতো। রাজার জন্য যুদ্ধ করা, প্রাসাদ নির্মাণ করা, দুর্গ গড়া, পেটুয়া সেনবাহিনী গড়া ও রাজ পরিবাবের সদস্যদের জন্য আরাম আয়াশের ব্যবস্থা করা -এসবই ছিল সরকারের মূল এজেন্ডা। এগুলি করতেই রাজস্বের সব অর্থ শেষ হয়ে যেত।  স্কুল গড়া, জনগণকে শিক্ষিত করা, দুস্থ মানুষের জন্য বাসস্থান নির্মাণ করা, অভাবী জনগণের জন্য খাদ্য-বস্ত্রের ব্যবস্থা করা -এরূপ জনকল্যাণ মূলক কাজগুলি সরকারের এজেন্ডাই মধ্যেই থাকতো না।  বিপুল সংখ্যক মানুষ তাই অনাহারে থাকতো এবং প্রাণ বাঁচাতে তাদেরকে ভিক্ষায় নামতে হতো। যেসব প্রাসাদে রাজা-বাদশাহগণ বসবাস করতো সেগুলির চিহ্ন আজও বেঁচে আছে, কিন্তু সাধারণ জনগণ কোথায় বাস করতো তার চিহ্ন মাত্র নাই। খড়কুটোর মতো সেগুলি ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে।                                                                                                

রাষ্ট্র নির্মাণ, শাসক নির্বাচন ও জনকল্যাণে ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব বিপ্লব আনে ইসলাম। রাজা বা  সম্রাটের ধারণাই বিলুপ্ত করা হয়। চালু করা হয় খলিফার ধারণা। খলিফা সার্বভৌম শাসক নয়, তিনি প্রতিনিধি। খোলাফায়ে রাশেদাগণ শাসন করতেন নবীজী (সা:)’র খলিফা বা প্রতিনিধি রূপে। তবে পবিত্র কুর’আনের বয়ান অনুযায়ী প্রতিটি মানবকে সৃষ্টি করা হয়েছে এ লক্ষ্যে যে, সে কাজ করবে মহান আল্লাহতায়ালার  খলিফা রূপে।  এর অর্থ দাঁড়ায়, সে একাত্ম হবে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে। এজন্যই প্রতিটি মানুষের জন্য প্রথম ফরজ হলো এটি জানা যে, মহান আল্লাহতায়ালার সে এজেন্ডাটি কি? নবী-রাসূলগণ সে জ্ঞানটি প্রথমে দিতেন। নববী-রাসূলদের অবর্তমানে সে বিষয়ে জ্ঞান দানের দায়িত্বটি রাষ্ট্রের।  

ইসলামই প্রথমে প্রতিষ্ঠা দেয়, রাষ্ট্রপ্রধান হতে রাজপুত্র হওয়াটি শর্ত নয়। এ আসনটি তার জন্য যে তাকওয়া ও যোগ্যতার বিচারে সর্বশ্রেষ্ঠ। এজন্যই নবীজী (সা:) বেঁচে থাকতে সে আসনে বসেছেন খোদ নবীজী (সা:)। নবীজী (সা‍)’র ইন্তেকালের পর সে আসনে বসেছেন হযরত আবু বকর (রা:), হযরত উমর (রা:), হযরত উসমান (রা:) ও হযরত আলী (রা:)। সে আসনে বসতে তাদের কাউকে রাজপুত্র হতে হয়নি। তারা সে আসনটি পেয়েছেন তাকওয়া ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে। জনগণ স্বেচ্ছায় তাদের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছেন।  সমগ্র মানব ইতিহাসে এরূপ ঘটনা এটিই ছিল প্রথম। তখন পৃথিবীর সর্বত্র জুড়ে রাষ্ট্র প্রধানের জন্য প্রাসাদ নির্মাণের রীতি ছিল। তাদের প্রহরা দিতে প্রাসাদের পাশে দুর্গ নির্মিত হতো। কিন্তু খোলাফায়ে রাশেদার খলিফাদের জন্য কোন প্রাসাদ নির্মিত হয়নি। কোন দুর্গও নির্মিত হয়নি। সেগুলি নির্মিত হলে সেগুলির নিদর্শন আজও বেঁচে থাকতো। তারা পূর্বেকার নিজ গৃহে বসে খলিফার দায়িত্ব পালন করতেন। তাদের জন্য পাহারাদারও ছিল না। পথেঘাটে তারা একাকী চলা ফেরা করতেন। সাধারণ জনগণের সাথে মসজিদে নামাজে হাজির হতেন। যে কেউ তাদের সাথে কথা বলতে পারতেন। অথচ তারা যে রাষ্ট্র শাসন করতেন তার আয়োতন ৫০টি বাংলাদেশের চেয়ে বৃহৎ ছিল। খলিফাদের কেউই আইনের উর্দ্ধে ছিলেন না। তাই সাধারণ মানুষের মত হযরত উমর (রা:) ও হযরত আলী (রা:) কাজীর আদালতে হাজির হয়েছেন। এবং কাজীর বিচার নিজের বিরুদ্ধে গেলেও সে রায় মেনে নিয়েছেন। ইতিহাসে এমন নজিরও কি কোথাও কখনো দেখা গেছে? এমন রাষ্ট্র মুসলিমদের জন্য আজও মডেল। এটি নবীজী (সা:)’র ও সাহাবায়ে কেরামের সূন্নত। এটিই রাষ্ট্র পরিচালনার সিরাতাল মুস্তাকীম। কিন্তু আজকের মুসলিমগণ সে সূন্নত নিয়ে বাঁচে না। তারা সিরাতাল মুস্তাকীমেও নাই|। তারা বাঁচে কাফির রাজা-বাদশাহদের সূন্নত নিয়ে। ফলে মুসলিম জীবনে কল্যাণ আসবে কীরূপে? 

ইসলামই প্রতিষ্ঠা দেয় সমগ্র মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম welfare state তথা সমাজ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। ওয়েলফেলার রাষ্ট্র বলতে সে রাষ্ট্রকে বুঝায় -যা জনগণের খাদ্য,বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ন্যায় মৌলিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা দেয়। খোলাফায়ে রাশেদার সময় খোদ সরকার জনগণ থেকে যাকাত ও ওশর সংগ্রহ করতো; সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ছিল এটি। এ বিভাগের দায়িত্ব ছিল সমাজে দুস্থ মানুষদের খুঁজ খুঁজে বের করে তাদের হাতে যাকাত ও ওশরের অর্থ পৌঁছে দেয়া হত। এ অর্থের পরিমাণ ছিল বিশাল। ধনির অর্থ এ ভাবেই গরীবের হাতে পৌঁছতো। ফলে কাউকে বস্ত্রহীন, খাদ্যহীন ও বাসস্থানহীন হতে হতো না। কাউকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হতো না। খলিফা উমর (রা:) বলতেন, রাষ্ট্রে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে থাকে তার জন্য আমি দায়ী। এই ছিল জনকল্যাণে খলিফার অঙ্গিকার।                                                                                                                     

সে সময় মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় অর্থে। সেগুলি শুধু নামাজের স্থান রূপে নয়, সেগুলি ব্যবহৃত হয়েছে জ্ঞানদানের কাজেও। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে শুরু হয় জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতার বিরুদ্ধে অবিরাম জিহাদ। বাণিজ্য রূপে নয়, জ্ঞানদান ও জ্ঞানার্জনের কাজ তখন ইবাদত রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। মুসলিম রাষ্ট্রের এটিই ছিল খরচের অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত। কারণ, এ জিহাদ প্রতিরক্ষা দেয় মুসলিমদের চেতনার ভূমিকে -সীমান্ত রক্ষার চেয়ে যা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।  কুর‌’আনের জ্ঞান ও কুর’আনের ভাষাকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে হাজার হাজার আলেমকে মুসলিম রাষ্ট্রের নানা প্রান্তরে প্রেরণ করা হয়। এ কাজে তৎকালীন মুসলিম রাষ্ট্র-নায়কদের সাফল্য ছিল চোখে পড়ার মত। সিরিয়া, ইরাক, মিশর, সুদান, লিবিয়া, আলজিরিয়া, মক্কো, তিউনিসিয়ার, মৌরতানিয়ার মত দেশের মানুষের মাতৃভাষাই পরিবর্তিত হয়ে যায়। তারা সবাই স্বেচ্ছায় আরবী ভাষাকে গ্রহণ করেছে। ইসলাম কবুলের সাথে সাথে তাদের মনে জেগে উঠে মহান আল্লাহতায়ালার বাণীকে সরাসরি বুঝার অদম্য আগ্রহ। বিশাল বিশাল সামাজ্য গ্রীক, রোমান, পারসিক, মঙ্গোল এরূপ অনেক জাতিই গড়েছে। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞান, ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গণে এরূপ বিপ্লব সমগ্র মানব ইতিহাসে আর কেউই ইসলামের পূর্বে আনতে পারিনি।       

 

অনৈসলামী রাজনীতি এবং ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের রাজনীতি

ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণে অতি জরুরি হলো, পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানে আলোকিত জনগণ। কারণ, অজ্ঞ ও জাহিল মানুষকে যেমন মুসলিম বানানো যায় না, তেমনি তাদেরকে দিয়ে কখনোই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায় না। পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানার্জন এজন্যই নামাজ-রোজার আগে ফরজ করা হয়েছে। নবীজী (সা:) তাঁর ১৩ বছরের মক্কী জীবনে সে আলোকিত মানুষ গড়ার কাজটিই করেছেন।  সে সাথে জরুরি হলো সমাজ থেকে দুর্বৃত্তদের নির্মূলের কাজ। হিংস্র বন্যপশু অধ্যুষিত গহিন জঙ্গলে ঘর বাঁধা যায় না। তেমনি দুর্বৃত্তের প্লাবনে ভাসা ভূমিতে কখনোই কোন সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায় না। এজন্যই আরব ভূমি থেকে আবু জেহেল, আবু লাহাব ও ইহুদী কুচক্রীদের নির্মূল করতে হয়েছে।  বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের পথে মূল বাধাটি এখানেই। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্ত-অধিকৃত রাষ্ট্রে। দেশ ভাসছে গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, সন্ত্রাসের জোয়ার। এমন দেশে ইসলামী রাষ্ট্র দূরে থাক অতি সাধারণ মাপের একটি সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণও সম্ভব নয়।

একটি দেশের জনগণের চেতনা, চরিত্র ও ঈমানের পরিচয় মেলে কাদেরকে তারা সম্মান করে এবং কাদেরকে তারা ঘৃণা করে -তা দেখে। যারা গরু-বাছুর, মুর্তি ও মুর্তির যৌনাঙ্গকে পূজা দেয় -তাদের কি সভ্য, বিবেকবান ও রুচিশীল মানব বলা যায়? এটি তো মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত বিবেক-বুদ্ধির সাথেব গাদ্দারী। এরূপ অসভ্য ও অশ্লীল কাজ তো পশুও করে না। পবিত্র কুর’আনে কিছু মানুষকে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট  বলা হয়েছে। এরাই তো তারা। মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার বিচারে এরা এতোই নিকৃষ্ট যে, তাদেরকে তিনি শাস্তি দিবেন অনন্ত কালের জন্য জাহান্নামের আগুনে ফেলে।  

বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ তেমনি বিবেকহীনতা ও ঈমানহীনতার পরিচয় দিয়েছে শেখ মুজিবের ন্যায় ভয়ানক অপরাধী ব্যক্তিকে নেতা, পিতা ও বন্ধুর আসনে বসিয়ে। খুন করা, ধর্ষণ করা, চুরিডাকাতি করাই শুধু অপরাধ নয়। ভয়ানক অপরাধ হল ফিরাউন, আবু জেহেল ও আবু লাহাবদের মত ব্যক্তিদের সম্মান দেখানো। অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে খুন, ধর্ষণ ও চুরিডাকাতির জন্য নয়, বরং অপরাধীদের প্রশংসা করা এবং তাদের পক্ষে সাক্ষী দেয়ার কারণে। সিরাতাল মুস্তাকীমে চলতে মুমিন ব্যক্তিকে প্রতি পদে পরীক্ষা দিতে হয়। তাকে অবশ্যই ঈমান-আক্বীদার পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। কিন্তু সে পরীক্ষায় ক’জন বাঙালি পাশ করেছে?

শেখ মুজিবের অপরাধী চরিত্র কোন গোপন বিষয় নয়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভাঙ্গতে শেখ মুজিব ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার সাথে আগরতলা ষড়যন্ত্র করেছিল ষাটের দশকেই। তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলা উঠেছিল ১৯৬৮ সালে। সে ষড়যন্ত্র যে সত্য ছিল সে সাক্ষ্য দিয়েছে সে মামলার আরেক আসামী এবং আওয়ামী লীগ নেতা লে.কর্নেল শওকত আলী। মুজিবের সে ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য ছিল ভারতকে শক্তিশালী করা এবং পাকিস্তানকে দুর্বল করা। এটি তো মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। মুসলিম উম্মাহর শক্তি, কল্যাণ ও ইজ্জত নিয়ে যার মধ্যে সামান্য পরিমাণ চিন্তা-ভাবনা আছে -সে কি এমন ভয়ানক অপরাধীকে বলে সম্মানিত করতে পারে? মুসলিমের কাছে প্রিয় হতে হলে তাকে তো পৌত্তলিক হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। মুসলিম দেশ ভাঙ্গা নয়, বরং ভূগোল বাড়ানোর নিয়েত ও প্রচেষ্ঠা থাকতে হয়। জনগণের ভোটকে ইজ্জত দিতে হয়। সর্বোপরি জনগণকে কথা বলা, লেখালেখি, সভা-সমিতি ও সংগঠিত হওয়ার অধিকার দিতে হয়। অথচ সকল গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে মুজিব একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। বাংলাদেশে বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড প্রথম শুরু করে শেখ মুজিব। সে কাজের জন্য গড়ে তোলে রক্ষি বাহিনী। বহু হাজার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী এ বাহিনী হত্যা করে। সুশাসনের বদলে মুজিব দিয়েছিল ভয়াবহ দুর্বৃত্তি ও দুঃশাসন -যা ১৯৭৩ সালে ডেকে এনেছিল এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ যাতে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়। এই তো বাংলাদেশীদের জন্য মুজিবের উপহার! মুজিব দাঁড়িয়েছিল জনগণের প্রতিপক্ষ রূপে। প্রশ্ন হলো, যে ব্যক্তি মুজিবের ন্যায় খুনি, প্রতারক, গণতন্ত্র হত্যাকারি ফ্যাসিস্ট, ইসলামের শত্রু ও হিন্দুত্ববাদের সেবককে নেতা, পিতা ও বন্ধুর আসনে বসিয়ে সম্মানিত করে -সে কি কখনো ঈমানের পরীক্ষায় পাশ করতে পারে? আর ঈমানের পরীক্ষায় যারা ফেল করে তাদের দিয়ে কি ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায়?                                                                                             

ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ দূরে থাক, দুর্নীতি ও দুঃশাসনমুক্ত একটি অতি সাধারণ সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণেও বাংলাদেশের ব্যর্থতাটি বিশাল। এর মূল কারণ, দেশটির অধিকাংশ মানুষের জীবনে কোন সভ্য রাজনীতি নাই। সভ্য বুদ্ধিবৃত্তিও নাই। রাজনীতি বলতে অনেকে মনে করে শুধু দল গড়া, মিটিং-মিছিল করা ও নির্বাচন কলে ভোট দেয়া।  অথচ রাজনীতির প্রকৃত অর্থ তা নয়। রাজনীতি হলো সভ্যতর মানব, সভ্যতর সমাজ ও সভ্যতর রাষ্ট্র নির্মাণের সার্বক্ষণিক তাড়না ও কর্ম নিয়ে বাঁচা। এটিই মুমিনের সার্বক্ষণিক জিহাদ। নামাজের ওয়াক্ত দিনে মাত্র ৫ বার। রোজা বছরে মাত্র এক মাস। কিন্তু রাজনীতির ওয়াক্ত সব সময়। নামাজ-রোজায় ক্বাজা আছে, কিন্তু রাজনীতিতে কোন ক্বাজা নাই।  রাজনীতি হলো জুলুম, দুর্বৃত্তি, স্বৈরাচার, মিথ্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে খাড়া হওয়া। এ রাজনৈতিক ইবাদত ছাড়া কোথাও কোন সভ্য রাষ্ট্র নির্মিত হয়না। ধর্মকর্ম স্রেফ নামাজ-রোজায় সীমিত রাখলে সে কাজটি হয়না। চোখের সামনে খুন, ধর্ষণ ও ডাকাতি হলেও গরু যেমন নীরবে ঘাষ খায়, এরাও তেমনি নিরাপদ দূরত্বে বসে তৃপ্তি ভরে পানাহার করে ও যৌন সম্ভোগ করে। এটিই হলো পশুত্ব। এরা নিজেদের মুসলিম বলে দাবী করে, কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন বিলুপ্ত করা হলেও এরা রাস্তায় নামে না। এরূপ চরিত্রের লোকদের দেখা গেছে নবীজী (সা:)’র যুগেও। নবীজী (সা:)’র পিছনে এরা নিয়মিত নামাজ পড়েছে, রোজা রেখেছে, এবং দান-খয়রাতও করেছে। কিন্তু মক্কার কাফিরদের পক্ষ থেকে যখন হামলা হয়েছে, তখন এরা শান্তিবাদী সেজেছে এবং জিহাদ থেকে দূরে থেকেছে। এরাই হলো মুসলিম ইতিহাসের অতি পরিচিত মুনাফিকা। এরা ইসলামের ও মুসলিমের বিজয় চায় না, বরং পরাজয় চায়। এদের সর্দার ছিল আব্দুল্লাহ বিন উবাই। মদিনার বুকে মুনাফিকগণ জিততে পারিনি। কিন্তু বাংলাদেশে তারাই বিজয়ী; পরাজয় এখানে ইসলামপন্থীদের।

অনেকের রয়েছে প্রচণ্ড রাজনীতি ভীতি। কারণ, রাজনীতিতে অর্থ, শ্রম ও রক্তের খরচ আছে। এজন্যই রাজীনীতিকে তারা আপদ মনে করে। ফলে ঝামেলামুক্ত জীবনের জন্য রাজনীতি থেকে দূরে থাকাকে তারা জরুরি মনে করে। তাদের কাছে রাজনীতি হলো কিছু স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থ হাছিলের পেশা। সেক্যুলারিস্ট দুর্বৃত্তদের বেলায় কথাটি সত্য। রাজনীতি হলো একটি ধারালো অস্ত্রের ন্যায়। অস্ত্র দিয়ে খুন-ডাকাতি যেমন করা যায়, তেমনি তা দিয়ে খুনিকেও হত্যা করা যায়। নবীজী (সা:)ও নিজ গৃহে তাই তরবারি রাখতেন।  ফিরাউনের রাজনীতি ছিল অসভ্য ও বর্বর রাষ্ট্র নির্মাণের হাতিয়ার। অথচ নবীজী (সা:)’র কাছে রাজনীতি ছিল সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সভ্যতা নির্মাণের হাতিয়ার। নবীজী (সা:)’র কাছে রাজনীতি গণ্য হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত তথা জিহাদ রূপে। জনগণের জীবনে জিহাদের রাজনীতি না থাকার অর্থ: তাদের জীবনে নাই সভ্যতর মানব, সভ্যতর সমাজ ও সভ্যতর রাষ্ট্র নির্মাণের ভাবনা ও তাড়না। তাদের মাঝে নাই  দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ। এরাই হলো তারা যারা চাষাবাদ, পশুপালন, মৎসপালন, ব্যবসা-বানিজ্য ও পেশাদারী নিয়ে ভাবে, কিন্তু দুর্বৃত্তমুক্ত রাষ্ট্র নির্মাণে কিছু করতে রাজী নয়। বাংলাদেশে রাজনীতি নেই এমনকি দেশটির আলেম, মুফতি, মসজিদের ইমাম, পীর এবং মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝেও। তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণের বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশের রাজনীতি ও শাসন ক্ষমতা ইসলামের শত্রুপক্ষের দখলে।

প্রখ্যাত গ্রীক দার্শনিক এরিস্টোটল মানবকে সংজ্ঞায়ীত করেছেন রাজনৈতিক পশু রূপে। তার মত হলো, কোন ব্যক্তির জীবন থেকে রাজনীতি বাদ পড়লে সে ব্যক্তিটি আর মানুষ থাকে না। সে পশুতে পরিণত হয়। অতীতে মুসলিমগণ সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তির জন্ম দিয়েছিল। সেটি এজন্য নয় যে, তারা লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন এবং কোটি কোটি মানুষ নামাজ-রোজা পালন করতেন। বরং এজন্য যে, মুসলিমদের মাঝে শতকরা শতভাগ সেদিন রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন। তাদে সে রাজনীতি স্রেফ ভোটদান ও মিটিং-মিছিলের রাজনীতি ছিল না। বরং সেটি ছিল নিজ অর্থ, নিজ মেধা, নিজ শ্রম ও নিজ রক্তের বিনিয়োগের রাজনীতি। সেটি ছিল জিহাদের রাজনীতি।  সে রাজনীতি নিয়ে বাঁচতে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। সে রাজনীতি প্রতিষ্ঠা দিতে নবীজী (সা:) ১০টি বছর রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন এবং অস্ত্র হাতে নিজে রণাঙ্গণে যুদ্ধে নেমেছেন। এটি হলো নবীজী (সা:)’র সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও গুরুত্বপূর্ণ সূন্নত; মুসলিম জীবনে সে সূন্নত প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কারণেই মুসলিমগণ বিশ্বশক্তির জন্ম দিতে পেরেছিল। এ সূন্নতকে বাদ দিয়ে শুধু  দাড়ি রাখা, খেজুর খাওয়া, পাগড়ি বাধা, মেছওয়াক করার ন্যায় সূন্নতগুলি নিয়ে বাঁচলে কি সেটি সম্ভব হত? বাংলাদেশের শতকরা ৯১ ভাগ জনগণ নিজেদেরকে মুসলিম রূপে পরিচয় দেয়। কিন্তু তাদের অধিকাংশের মাঝে নবীজী (সা:)’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে সূন্নতটি বেঁচে নাই। তবে তারা যে রাজনীতিশূণ্য -তা নয়। তাদের জীবনেও রাজনীতি আছে। সেটি হলো ইসলাম থেকে দূরে সরা সেক্যুলারিস্ট চোরডাকাত, ভোটডাকাত দুর্বৃ্ত্তদের বিজয়ী করার রাজনীতি।  এবং সে সাথে ইসলামকে পরাজিত রাখার রাজনীতি।। সে রাজনীতি বাঁচাতে তারা সভা-সমিতিতে যায়, প্রচার করে, লাঠি ধরে এবং ভোট দেয়। আর যে রাজনীতিতে ইসলাম ও তার শরিয়তী আইনকে বিলুপ্ত রাখা হয়, সে রাজনীতি যে জাহান্নামে নেয়ার শয়তানী রাজনীতি -তা নিয়ে কি সামান্যতম সন্দেহ আছে?

                         

শ্রেষ্ঠতম বীর এবং জঘন্যতম অপরাধী

 মুসলিম ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম বীর তো তারাই যারা দেশে দেশে ইসলামের দ্রুত প্রসার বাড়িয়েছে, মুসলিম উম্মাহর ভূগোলে বিশাল বৃদ্ধি এনেছে এবং মুসলিমদের বিশ্বশক্তির  আসনে বসিয়েছে। সে কাজটি সাধিত হয়েছে গৌরব যুগের মুসলিমদের দ্বারা। তাদের জান, মাল, মেধা ও শ্রমের বিশাল কুরবানীর কারণেই মদিনার ক্ষু্দ্র শহরে জন্ম নেয়া ইসলামী রাষ্ট্র দ্রুত বিস্তার পেয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বৃহৎ ভূ-ভাগ জুড়ে। তাদের কারণে মুসলিমগণ পেয়েছে অপরাজেয়  বিশ্বশক্তির মর্যাদা। সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে এরাই হলো শ্রেষ্ঠতম সন্তান। তাদের কারণে মুসলিম নর-নারীগণ পেয়েছে জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা। আজকের মত সেদিন গোত্র, বর্ণ ও ভাষার ভিত্তিতে মুসলিম ভূমিতে বিভক্তির প্রাচীর ছিল না।

অপর দিকে মুসলিম ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গাদ্দার ও সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি তো তারাই যারা মুসলিম দেশকে টুকরো টুকরো করে দুর্বল করেছে, শত্রুশক্তির হাতে মুসলিম ভূমিকে তুলে দিয়েছে এবং মুসলিম জনগণকে তাদের গোলামে পরিণত করেছে। এরাই উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গেছে, পাকিস্তান ভেঙ্গেছে এবং অখণ্ড আরব ভূমিকে ২২ টুকরোয় বিভক্ত করেছে। এরাই হলো সেসব ঘৃণীত জীব -যারা মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি সাধনে কোয়ালিশন গড়েছে কাফির শক্তির সাথে। এরাই হলো ইসলাম থেকে দূরে-সরা মুসলিম নামধারী সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, গোত্রবাদী ও রাজতন্ত্রী।  আরব বিশ্বে এদের দেখা গেছে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ, ফরাসী ও ইতালীয়দের সাথে তাদের এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে। সেটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে। একমাত্র ব্রিটিশ বাহিনীতেই প্রায় ১০ লাখ আরব যোগ দিয়েছিল খলিফার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। এরাই ফিলিস্তিনকে অধিকৃত করে ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছে। সে অধিকৃত ভূমিতে নির্মিত হয়েছে ইসরাইল।  ১৯৭১ সালে এদের দেখা গেছে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে পৌত্তলিক ভারতীয় সৈন্যদের পাশে। ভারতীয়দের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে এরা মুসলিমদের হত্যা করেছে এবং ভারতকে বিজয়ী করেছে।

 দেশে দেশে ইসলামের এই ঘরের শত্রুদের কারণেই ১৫০ কোটি মুসলিমদের হাতে কোন শক্তিশালী রাষ্ট্র নাই। তারা মুসলিম উম্মাহকে  বিভক্ত করে রেখেছে ৫০টির বেশী রাষ্ট্রে। মুসলিমদের শক্তিহীনতা ও পরাজয়ের মূল কারণ হলো এই ভৌগলিক বিভক্তি, জনসংখ্যা ও সম্পদের কমতি নয়।  এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা বিভক্তিকে হারাম করেছেন; কিন্তু ইসলামের এই ঘরের শত্রুরা মুসলিম উম্মাহর এ বিভক্ত মানচিত্র নিয়ে উৎসব করে। মুর্তিপূজারীরা যেমন মুর্তিকে পূজা দেয়, ইসলামের এই ঘরের শত্রুরা পূজা দেয় বিভক্ত মানচিত্র এবং বিভক্তির প্রতীক ট্রাইবাল রাষ্ট্রের পতাকাকে।  মুসলিম রাষ্ট্রের সরকার, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কাজ হয়েছে শুধু পতিতাপল্লী, সূদী ব্যাংক ও মদের দোকানের ন্যায় হারামকে বাঁচিয়ে রাখা নয়, বরং সীমান্ত-ঘেরা বিভক্তির মানচিত্রকে বাঁচিয়ে রাখাও। এরূপ বিভক্তির কারণেই ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ভারত, উইঘুর ও আরাকানের মুসলিমদের পাশে দাঁড়াবে এমন কোন শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র নাই। ফলে অসহায়ের মত অতিশয় যাতনা নিয়ে দেখতে হচ্ছে মুসলিম ভূমিতে চলমান নৃশংস গণহত্যাকে। অথচ তেমন শক্তিশালী রাষ্ট্র আছে নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা অঞ্চলে বিভক্ত ভারতীয় হিন্দুদের। আছে খৃষ্টান, ইহুদী এবং চীনাদেরও।

 খণ্ডিত দেহ নিয়ে কেউ দাঁড়াতে পারেনা, তখন মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি খণ্ডিত ভূগোল নিয়েও কোন জাতি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। মুসলিমদের মাথাপিছু আয় যদি শতগুণ বৃদ্ধি পায় এবং তাদের জনসংখ্যা যদি বেড়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয় তবুও সেটি সম্ভব হবে না। একতা ও বৃহৎ ভূগোলের কোন বিকল্প নাই। মুসলিমদের গৌরব কালে যেমন অটুট একতা ছিল, তেমনি ছিল বিশাল ভূগোল। কিন্তু আজ এ দুটির একটিও নাই। ফলে তেল, গ্যাস, বহুবিধ খনিজ সম্পদ এবং জনসম্পদ বিপুল হারে বৃদ্ধি পেলেও কোন লাভ হচ্ছে না। ফলে পথ সামনে একটাই। ইজ্জত, স্বাধীনতা ও নিরপত্তা নিয়ে বাঁচতে হলে ভৌগলিক বিভক্তির দেয়ালগুলি ভেঙ্গে নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা এলাকার মুসলিমদের নিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রের ভূগোল বাড়াতেই হবে। মুসলিমদের গৌরব যুগে আরব, ইরানী, তুর্কী, কুর্দি, মুর মুসলিমগণ যেরূপ এক বিশাল ভূগোলের মানচিত্রে একতাবদ্ধ হয়েছিলেন -সে পথে আবার ফিরে যেতে হবে। একমাত্র এ পথেই মুসলিমগণ নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নতকে আবার জীবিত করতে পারে? এ সূন্নতের প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইজ্জত, নিরাপত্ত ও স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার কোন ভিন্ন রাস্তা নাই। যারা নিজেদেরকে আশেকে রাসূল (সা:) রূপে পরিচয় দেয়, তাদের অন্তত এ সূন্নতের প্রতিষ্ঠায় ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। নইলে গাদ্দারী হবে নবীজী (সা:)’র সাথে। আর সে গাদ্দারী নিয়ে কেউ কি নবীজী (সা:)’র শাফায়াত আশা করতে পারে? যারা নবীজী (সা:)’র অনুসারী হয়, একমাত্র তারাই তো আল্লাহতায়ালার অনুসারী হয় -যা বলা হয়েছে সুরা নিসার ৮০ নম্বর আয়াতে।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *