মুসলিম দেশে ঘরের শত্রু ও বিদেশী শত্রুর কোয়ালিশন এবং নাশকতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 শত্রুগণ ইসলামের দুর্গ চিনতে ভূল শত্রু করে না

শয়তান ও তার অনুসারীগণ ইসলামের মূল দুর্গকে চিনতে কখনোই ভূল করেনা। ইসলামে সে দুর্গটি হলো খেলাফত। এটিই হলো ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্সটিটিউশন। এটিই হলো ইসলামের রাষ্ট্রীয় কাঠামো -যার প্রতিষ্ঠা দিয়ে যান খোদ নবীজী (সা:)। মহান নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত সে ইসলামী রাষ্ট্রে প্রচুর রাজতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক দূষণ ঘটলেও মুসলিম উম্মাহকে এই খেলাফতই যুগে যুগে জান-মাল, ইজ্জত-আবরুর ও স্বাধীনতার সুরক্ষা দিয়েছে। সেরূপ সুরক্ষা দেয়ার কাজটি কখনোই লক্ষ লক্ষ মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণ করে হয়না। এজন্যই শুরু থেকেই শত্রুদের মূল টার্গেট ছিল খেলাফতকে বিলুপ্ত করা। খেলাফত বিলুপ্ত করার কাজে শয়তানী শক্তির স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগী হয় জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী ও স্বার্থান্বেষী সেক্যুলারিস্টগণ। এরাই মুসলিমদের ঘরের শত্রু। সব সময়ই এদের দেখা গেছে বিদেশী শত্রুর সাথে কোয়ালিশন করতে। এবং সে কোয়ালিশনের মূল টার্গেট সব সময়ই ছিল বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রকে ক্ষুদ্রতর করা।  সে কোয়ালিশনটি আরব বিশ্বে দেখা গেছে ১৯১৭ সালে। এবং সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে দেখা গেছে ১৯১৭ সালে। এ কোয়ালিশন সফল হয় যেমন উসমানিয়া খেলাফতকে বিলুপ্ত করতে, তেমনি সফল হয় পাকিস্তান ভাঙ্গতে। তাই মুসলিমদের শত্রু শুধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নয়, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতীয়ানহুও নয়; এরা হলো মুসলিম দেশে বেড়ে উঠা শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা ও মক্কার শরিফ হোসেনদের ন্যায় গাদ্দারগণ।   

খেফাফত ভেঙ্গে যাওয়াতে আরব বিশ্বের মুসলিমগণ আজ এতিম। ফিলিস্তিনীদের পাশে দাঁড়াবার মত কেউ নেই। আরবগণ ২২টি রাষ্ট্রে বিভক্তি হওয়ায় ৪০ কোটি আরব ব্যর্থ হচ্ছে ৬০ লাখ ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়াতে মার্কিন ও রুশ হামলার শিকার হয়েছে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও লিবিয়া।  অপর দিকে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে অভিভাবকহীন হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমগণ। ফলে ভারত ও কাশ্মীরের মুসলিমগণ হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হলেও তাদের পক্ষ কেউ খাড়া হয়না। এমনকি বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা বাংলাদেশীদের নির্বিচারে হত্যা করে। কিন্তু ঢাকাতে ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলও করতে দেয়া হয়না।  

বৃহৎ একটি মুসলিম রাষ্ট্রকে ক্ষুদ্রতর করাটি সব সময়ই কাফির শক্তির এজেন্ডা। ক্ষুদ্রতর করলে মুসলিম দেশগুলিকে দখলে নেয়ার কাজটি সহজ হয়। বিশাল উসমানিয়া খেলাফত ছিল আরব ভূমির উপর ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের আধিপত্যবাদী শোষণ প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। শক্তিশালী উসমানিয়া খেলাফতের কারণেই ইংরেজদের উপনিবেশ খুঁজতে বহু সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলা ও ভারতে যেতে হয়েছে। নিকটবর্তী  আরব ভূমিতে তারা দখল জমাতে পারিনি। এজন্যই ব্রিটিশ ও ফরাসীদের ন্যায় ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের লক্ষ্য হয় উসমানিয়া খেলাফতকে বিলুপ্ত করা। একাজে ব্রিটিশ ও ফরাসীদের সহযোগী হয় আরব বর্ণবাদী ও জাতীয়তাবাদী স্বার্থান্বেষীগণ। তাদের নেতা শরিফ হোসেনকে লোভ দেখানো হয়, তাকে খলিফা বানানো হবে। শরিফ হোসেন ছিলেন উসমানিয়া খলিফার পক্ষ থেকে মক্কার গভর্নর। বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো, আরবগণ খেলাফতের গুরুত্ব বুঝতে পুরাপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এদিক দিয়ে ভারতীয় মুসলিমদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল প্রশংসনীয়। ব্রিটিশ আগ্রাসন থেকে খেলাফত বাঁচাতে ভারতীয় মুসলিমগণ সমগ্র ভারত জুড়ে বিশাল গণ-আন্দোলনের জন্ম দেয় -যা ইতিহাসে খেলাফত আন্দোলন নামে প্রসিদ্ধ। ভারতের বুকে এমন গণ-আন্দোলন আর কখনো হয়নি। খেলাফত আন্দোলনর জনপ্রিয়তা দেখে কংগ্রেস নেতা গান্ধিও সেটিকে সমর্থন দেন।

অথচ আরবদের আচরণ ছিল অবাক করার মত। প্রায় ১০ লক্ষ আরব যোগ দেয় ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে। ব্রিটিশদের অস্ত্র নিয়ে তারা খলিফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এবং তাদের সহায়তা নিয়ে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ বাহিনী বিজয়ী হয়। জেনারেল এ্যালেন বাই’য়ের নেতৃত্ব যে ব্রিটিশ বাহিনী জেরুজালেম দখল করে -সে বাহিনীর অর্ধেকের বেশী সৈন্য ছিল অ-ইংরেজ।  সে সময় ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৮ ভাগেরও কম। কিন্তু ইসরাইল গড়ার লক্ষ্যে সে অধিকৃত ভূমিতে পরিকল্পিত ভাবে শুরু হয় ইহুদীদের জন্য দ্রুত কলোনী নির্মাণ। ইসরাইল প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৪৮ সালে; ঐ বছরেই ৫ শতের বেশী আরব গ্রামকে ধুলিস্যাৎ করা হয়। প্রায় ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনীকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করা হয়। খালিকৃত সে আরব ভূমিতে বসানো হয় বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানীকৃত ইহুদীদের। সে সাথে দখলে নেয়া হয় তেল ও গ্যাস সমৃদ্ধ আরব ভূমির উপর। এই হলো একটি বিশাল মুসলিম রাষ্ট্রকে ক্ষুদ্রতর করার আযাব। সে অনিবার্য আযাব থেকে বাঁচতেই আল্লাহতায়ালা বিভক্তিকে হারাম করেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমগণ সজ্ঞানে বেঁছে নিয়েছে সে বিভক্তির হারাম পথকে।  

আরবদের ন্যায় বিভক্তির পথ বেছে নিয়েছে বাঙালি মুসলিমগণও। এবং আরবদের ন্যায় তাদের পরিণামও সুখের হয়নি। পাকিস্তান ছিল ভারতের  প্রধানতম শত্রু। বৃহৎ শক্তি রূপে ভারতের উত্থানের পথে পাকিস্তানই ছিল মূল বাধা। তাই তারা পাকিস্তানের সৃষ্টি যেমন চায়নি, তেমনি দেশটি বেঁচে থাকুক সেটিও চায়নি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ভারতের প্রধানতম এজেন্ডা হয় দেশটিকে  খণ্ডিত করা -অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করা। ভারতের সে এজেন্ডা পূরণে এগিয়ে আসে চরম স্বার্থান্বেষী এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী শেখ মুজিব। ষাটের দশকেই মুজিব বভারতীয় চরদের সাথে মিলে আগরতলা ষড়যন্ত্র করে। পাকিস্তান সরকারের কাছে সে ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায় এবং মুজিবকে গ্রেফতার করে আদালতে তোলা হয়। কিন্তু মুজিবের ভাগ্য ভাল যে, ১৯৬৯’য়ের গণ-আন্দোলনের ফলে বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত রেখে জেল থেকে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তবে আগরতলা ষড়যন্ত্র যে সত্য ছিল -সে কথাটি বলেছে আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদের সাবেক ডিপুটি স্পীকার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী লে.কর্নেল শওকত আলী। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে এখন গর্ব করে বহু আওয়ামী লীগ নেতাও। পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজটি ভারত নিজ খরচে ও নিজ সেনাবাহিনী দিয়ে  সমাধা করার জন্য বহু পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল। এজন্য কোন মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন ছিল না। ভারত অপেক্ষায় ছিল শুধু মোক্ষম একটি সুযোগের। সে সুযোগটি আসে একাত্তরে। তাই মুক্তিবাহিনীকে যুদ্ধ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি জেলা দূরে থাক, একটি মহকুমা বা একটি থানাকেও স্বাধীন করতে হয়নি। সে কাজটি ভারতের দুই লক্ষাধিক সৈন্য নিজেরা যুদ্ধ লড়ে সমাধা করে দিয়েছে। তাই বাংলাদেশ বানানোর মধ্যে আওয়ামী বাকশালীদের কৃতিত্ব কোথায়? অথচ এ ঐতিহাসিক সত্যকে বাংলাদেশের ইতিহাসের বই’য়ে পড়ানো হয়না। বরং বড়াই করে পড়ানো হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে মুক্তিবাহিনী।

 

যুদ্ধটি হতে হয় দুর্বৃত্ত শাসক নির্মূলে, মুসলিম দেশকে ক্ষুদ্রতর করায় নয়

এ নিয়ে বিরোধ নাই, পাকিস্তানে আঞ্চলিক বৈষম্য ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণও ছিল। তবে সে দেশে ভারতের ন্যায় একটি হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী দেশের গোলামী ছিল না। গুম, খুন, ধর্ষণ, ভোটডাকাতি, ব্যাংক ডাকাতি ও বাকশালী ফ্যাসিবাদ ছিল না। শত শত আলেমকে সেদিন কারাগারে তোলা হয়নি, কোন ইসলামী দলের নেতাকে ফাঁসীতে চড়ানো হয়নি। সৃষ্ট হয়নি শাপলা চত্বরের গণহত্যার ন্যায় গণহত্যা। বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনার সমাধান কখনোই দেশ ভাঙ্গার মাঝে থাকে না। দেশ ভাঙ্গলে আসে শক্তিহীনতা। আসে গোলামী। বিশ্বের দরবারে তখন ইজ্জতও কমে। তারই প্রমাণ, আজকের বাংলাদেশ। দেশটিকে আজ বাঁচতে হচ্ছে ভারতীয় রাডারের নিচে। বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনা দেরিতে হলেও দূর করা যায়। কিন্তু পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গতে শত শত বছর লেগে যায়। ১৯০ বছর লেগেছে ব্রিটিশের পড়ানো শিকল ভাঙ্গতে। ব্রিটিশগণ সীমান্ত-ঘেঁষা প্রতিবেশী ছিল না। কিন্তু ভারতের অবস্থান তো তিন পাশ ঘিরে। বাংলাদেশের উপর আজ যেরূপ ভারতীয় আধিপত্য, হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির প্লাবন, অর্থনৈতিক শোষণ, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা এবং ভারতের সেবাদাস আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের যে নৃশংস শাসন -তার মূলে তো একাত্তরে ভারতের বিজয়।

বস্তুত বাঙালি মুসলিমের সকল বিপর্যের কারণ একাত্তর। ভারতের একাত্তরের বিশাল বিজয় বাঙালি মুসলিমের গলায় পরাধীনতার যে শিকল পড়িয়ে দিয়েছে -তা থেকে মূক্তির পথ আছে কি? স্বাধীন ভাবে বাঁচার বিশাল খরচ আছে -বিশেষ করে আগ্রাসী দেশ যখন ভারতের ন্যায় হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী প্রতিবেশী দেশ হয়। সে খরচ জোগানোর সামর্থ্য কি বাংলাদেশের আছে? এখন বুঝা যায়, শেরে বাংলা ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দীন, হোসেন শহীদ সহরোওয়ার্দী, মৌলভী তমিজুদ্দীন, নূরুল আমীন এবং ১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতার অন্যান্য নেতাদের ঈমান, প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণচিন্তা শেখ মুজিব, মাওলানা ভাষানী, তাজুদ্দীন ও মেজর জিয়ার ন্যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের চেয়ে কতই না শ্রেষ্ঠতর ছিল। অখণ্ড পাকিস্তানের গুরুত্ব এবং পাকিস্তান ভাঙ্গার বিপদ এমন কি বহু আওয়ামী লীগারও বুঝতেন। তাই মুজিব যখন ১৯৬৬ সালে লাহোরে এক সম্মেলনে ৬ দফার ঘোষণা দেয় তখন পূর্ব পাকিস্তানের ১৭ জেলার মধ্যে ১৩ জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি আওয়ামী পরিত্যাগ করেন। কারণ তারা মনে করতেন ৬ দফার মধ্যে পাকিস্তান ভাঙ্গার উপাদান রয়েছে। এমন কি একাত্তরের যুদ্ধ চলাকালে আওয়ামী লীগের বহু সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধ ছেড়ে পাকিস্তানের সংহতির পক্ষ নিয়েছিল।    

মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো বাঁচতে হয় প্রতি পদে মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা-পূরণ ও তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার স্বপ্ন নিয়ে। সে সাথে বাঁচতে হয় শয়তানের এজেন্ডাকে ব্যর্থ করার জিহাদ নিয়ে। শয়তানী শক্তিবর্গ তাদের এজেন্ডাকে কখনোই গোপন রাখে  না। তারা চায়, মুসলিম ভূমির বিভক্তিকরণ, মুসলিমদের শক্তিহানী এবং তাদের উপর দখলদারী। অপর দিকে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাও গোপন নয়। তিনি চান, মুসলিমদের মাঝে প্রতিষ্ঠা পাক সীসাঢালা দেয়ালের ন্যায় একতা এবং মুসলিম ভূমির সংহতি। তাই একতাবদ্ধ হওয়াকে তিনি ফরজ করেছেন এবং বিভক্তি গড়া এবং মুসলিম দেশ ভাঙ্গাকে হারাম করেছেন। অপর দিকে শয়তান ও তার অনুসারীগণ চায়, বহু টুকরোয় খণ্ডিত মুসলিম ভূগোল। মুসলিম বিশ্বে শয়তানের এজেন্ডাই বিজয়ী হয়েছে। ফলে মুসলিমগণ ৫০টির বেশী রাষ্ট্রে বিভক্ত এবং আরবগণ বিভক্ত ২২টি রাষ্ট্রে।  দেশের ভূগোল ক্ষুদ্রতর করার অর্থই হলো, সামরিক ভাবে দুর্বল হওয়া। তখন বিলুপ্ত হয় শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সামর্থ্য। ফলে বিলুপ্ত হয় স্বাধীনতা এবং শুরু হয় শত্রুর অধীনে নৃশংস পরাধীনতা। প্রতিরোধের সে সামর্থ্য বিলুপ্ত হওয়াতেই ৪০ কোটি আরব ব্যর্থ হচ্ছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে খাড়া হতে। ফলে দুর্বিসহ পরাধীনতার নির্মম ঘানি টানছে ফিলিস্তিনের জনগণ। অর্ধেকে বেশী ফিলিস্তিনী জনগণ নিজ ভিটা-বাড়ী ছেড়ে পরদেশে উদ্বাস্তু। যারা এখনো ঘর ছাড়েনি তাদেরকে বাস করতে হচ্ছে জেলখানার নৃশংস যাতনা নিয়ে। প্রতিরোধে খাড়া হওয়ায় গাজার বন্দী নারী-পুরুষ-শিশুদের হতে হচ্ছে ইসরাইলী বোমা, মিজাইল ও গোলা-বারুদের খাদ্য।  

                                                                                                                                        

ভয়ানক অপরাধ শুধু গণহত্যা নয়, মুসলিম দেশভাঙ্গাও

আল্লাহতায়ালার শুধু হত্যা, ধর্ষণ ও চুরিডাকাতিকে হারাম করেননি, হারাম করেছেন মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি গড়া ও মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করাকেও। তাই অপরাধ শুধু গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুন্ঠন নয়, গুরুতর অপরাধ হলো মুসলিম দেশ ভাঙ্গা। এবং গুরুতর অপরাধ হলো, কোন মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করার লক্ষ্যে ইসলামের চিহ্নিত শত্রুশক্তির সাথে কোয়ালিশন গড়া। কারণ, কোন মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করার অর্থ সে দেশের মুসলিমদের স্বাধীনতা এবং জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা কেড়ে নেয়া। কারণ, দেশ ক্ষুদ্রতর হলে বিলুপ্ত হয় সেগুলিকে প্রতিরক্ষা দেয়ার সামর্থ্য। এটি এখন আর অজানা নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গণে মুসলিমদের শত্রু রূপে খাড়া হয়েছে ব্রিটিশ, ফরাসী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। আর দক্ষিণ এশিয়ার বুকে সে চিহ্নিত শত্রুশক্তি হলো ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীগণ।  যারা মুসলিম ভূমিকে ক্ষুদ্রতর করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করে তারা কখনোই ইসলাম ও মুসলিমদের বন্ধু নয়, তারা মূলত শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করে। তারা এজেন্ট কাফির শক্তির।

পরিতাপের বিষয় হলো শয়তানের এমন এজেন্ট রয়েছে প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রে ও প্রতিটি মুসলিম জনপদে। মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধটি আরবদের মাঝে দেখা গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে। সেটি উসমানিয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে। ১০ লাখের বেশী আরব সেদিন যুদ্ধ করেছে ব্রিটিশ কাফির বাহিনীকে বিজয়ী করতে। বাঙালি মুসলিমের জীবনে তেমন একটি যুদ্ধ দেখা গেছে ১৯৭১ সালে। সে যুদ্ধে বহুহাজার বাঙালি মুসলিম যুদ্ধ করে বিজয়ী করেছে হিন্দুত্ববাদী ভারতকে। ১৯১৭ সালে খলিফার বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিজয়ী হওয়াতে আরবভূমি ২২ টুকরোয় বিভক্তি হয়েছে; তাতে বিপন্ন হয়েছে আরব মুসলিমদের স্বাধীনতা ও জান-মালের নিরাপত্তা। ১৯৭১ সালে ভারতের বিজয়ী হওয়াতে বিপন্ন হয়েছে দক্ষিন এশিয়ার মুসলিমদের স্বাধীনতা।   

প্রতিটি অপরাধই শাস্তিকে অনিবার্য করে ।  মহান আল্লাহতায়ালা সবকিছুই দেখেন। প্রতিটি অপরাধেরই তিনি বিচার করেন এবং অপরাধীকে শাস্তি দেন। এ দুনিয়ায় শাস্তি না দিলে অবশ্যই আখেরাতে দিবেন।  ১৯১৭ সালে এবং ১৯৭১ সালে কৃত গুরুতর অপরাধও সর্বদ্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালার দৃষ্টি এড়ায়নি। মুসলিম ভূমিতে হিন্দুত্ববাদী কাফিরদের বিজয়ী করার অপরাধ কি কখনো পুরস্কৃত হয়? সেটি তি প্রতিশ্রুত শাস্তি ডেকে আনে। অপরাধীদের শাস্তি দিতে তিনি শুধু সুনামী, প্লাবন, ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টির ন্যায় নানারূপ দুর্যোগই শুধু দেন না, জালেম শাসকদেরও পাঠান।  আরবগণ সে অপরাধের শাস্তি ভোগ করছে দেশী ও বিদেশী জালেমদের হাতে অধিকৃত হয়ে। আজ ফিলিস্তিনের অধিকৃতি ও গাজার উপর বোমাবর্ষণ তো তারই অংশ। ইরাক ও সিরিয়ার জনগণ শাস্তি ভোগ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্টের হাতে অধিকৃত হয়ে। মহান আল্লাহতায়ালার আযাব যখন কোন ভূমিতে আঘাত হানে তখন সে ভূমির ধার্মিক মানুষ ও মাছুম শিশুরাও তা থেকে রেহাই পায়না।  আরবগণ যদি ব্রিটিশ সেনাদলে শামিল হয়ে খেলাফতের নির্মূল না করতো -তবে কি তারা এরূপ নৃশংস নির্যাতনের মুখে পড়তো? একই কারণে বাঙালী মুসলিমগণও সুখে নাই। তারা শাস্তি ভোগ করছে ভারতসেবী বাকশালী ফ্যাসিস্টদের নৃশংস শাসনে পিষ্ট হয়ে। এবং হারাতে হয়েছে স্বাধীন ভাবে বাঁচার অধিকার। গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, ব্যাংকডাকাতি ও সন্ত্রাসের অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছে কেবল ভারতসেবী আওয়ামী বাকশালীরা।

যারা প্রকৃত ঈমানদার, তাদের যুদ্ধটি হয় জালেম শাসকের নির্মূলে; কখনোই সেটি মুসলিম দেশের ভূগোলকে ক্ষুদ্রতর করার জন্য হয় না।  তাদের যুদ্ধটি হয় মুসলিম দেশের ভৌগলিক অখণ্ডতা বাঁচাতে অথবা ভৌগলিক আয়তন বাড়াতে। এমন একটি চেতনার কারণেই খেলাফত ১৩ শত ব্ছর বেঁচেছে। তেমন একটি চেতনার কারণেই কোন ইসলামী দল, কোন হাক্কানী আলেম এবং কোন পীর একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধকে সমর্থণ করেনি। তাদের মধ্য থেকে কেউ ভারতে যায়নি এবং ভারতীয় প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে সে দেশের কাফির সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধও করিনি।  এটি ছিল ইসলাম থেকে দূরে সরা আওয়ামী ফ্যাসিস্ট, হিন্দু, কম্যুনিস্ট ও সেক্যুলারিস্টদের প্রকল্প। মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করার যুদ্ধ কোথাও শুরু হলে বিশ্বের তাবত কাফির শক্তি তখন সে যুদ্ধে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। সেটি যেমন ১৯১৭ সালে দেখা গেছে আরব ভূমিতে এবং তেমনি ১৯৭১ সালে দেখা গেছে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে।  

ভারত ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ অবধি এই ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানীদের জন্য একটি টাকাও সাহায্য দেয়নি। বরং ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সরকারি রিজার্ভের অর্থের হিস্যা দিতেও গরিমসি করেছে। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এমন কোন বন্দর ছিল না যেখানে কোন সামুদ্রিক জাহাজ ভিড়তে পারে। পাকিস্তান সরকার তখন ভারতের কাছে ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি চায়। কিন্তু ভারত সরকার সে সুযোগ এক দিনের জন্যও দিতে রাজী হয়নি। এই হলো বাঙালি মুসলিমদের প্রতি ভারতের দরদ। সেই ভারতই ১৯৭১’য়ে অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও আড়াই লক্ষ সৈন্য নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে পূর্ব পাকিস্তানে হাজির হয়। কারণ, সে যুদ্ধ ছিল ভারতের নিজ স্বার্থে। প্রথম  বিশ্বযুদ্ধ কালে সে অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ও ফ্রান্স হাজির হয় মধ্যপাচ্যে। আরব মুসলিমদের কোন কালেই কোন অর্থ বা অস্ত্র সাহায্য তারা দেয়নি। কিন্তু আরব জাতীয়তাবাদীরা যখন উসমানিয়া খেলাফত ভাঙ্গার লক্ষ্যে যুদ্ধ শুরু করে তখন বৃহৎ কাফির শক্তিবর্গ বিপুল অর্থ, অস্ত্র ও বহু লক্ষ সৈন্য নিয়ে আরব ভূমিতে হাজির হয় এবং আরব ভূমিকে ২২ টুকরোয় বিভক্ত করতে সমর্থ হয়। এভাবেই মুসলিম উম্মাহর মেরুদন্ড ভেঙ্গে তাদের দুর্বলতা ও পরাধীনতা বাড়িয়েছে। এভাবে বিজয়ী হয়েছে শয়তানের এজেন্ডা। পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমদের পতন, চেতনাশূণ্যতা ও ঈমানশূণ্যতা এতটাই প্রকট যে, বিভক্ত ভূগোল গড়ার দিনগুলিকে জাতীয় উৎসবের দিনে পরিণত করেছে। ১৪/১১/২০২৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *