ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তির নামে দুর্বৃত্তি

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 বুদ্ধিবৃত্তি কী?

বুদ্ধিবৃত্তি, বুদ্ধিজীবী ও বুদ্ধির মুক্তি -এসব কথাগুলো বাংলাদেশের মত অধিকাংশ মুসলিম দেশেই বহুল পরিচিত বুলি। তবে এ শব্দগুলো নিয়ে বিভ্রান্তিও প্রচুর। প্রতি সমাজেই বুদ্ধিবৃত্তি বা বুদ্ধির প্রয়োগ গণ্য হয় শ্রেষ্টকর্ম রূপে। কারণ, মানব সকল সৃষ্টির সেরা শুধু এ বিশেষ গুণটির কারণেই, দৈহিক শক্তি বা অন্য কোন কারণে নয়। তবে প্রশ্ন হলো বুদ্ধিবৃত্তি বলতে আমরা কি বুঝি? সমাজে বুদ্ধিবৃত্তির ভূমিকা কি এবং এনিয়ে ইসলামের বক্তব্যই বা কি? ইংরাজেীতে যা ইনটেলেকচুয়ালিজম, বাংলাতে সেটিই বুদ্ধিবৃত্তি। যারা একাজে জড়িত তাদেরকে বলা হয় বুদ্ধিজীবী। প্রশ্ন হলো এ ধরণের সংজ্ঞায়ন কতটুকু সঠিক। তাছাড়া এমন বুদ্ধিবৃত্তির সাথে ইসলামের সম্পর্কই বা কি? বুদ্ধির প্রয়োগই হলো বুদ্ধিবৃত্তির ভিত্তি। তবে এ সমাজে বুদ্ধির প্রয়োগ কে না করে? সব পেশার মানুষকেই কম-বেশী বুদ্ধি খাটিয়েই রুজী-রোজগার বাড়াতে হয়, তা দিয়েই তাদেরকে বেঁচে থাকতে হয়। এমনকি পশুকেও বুদ্ধি খাটিয়ে শিকার ধরতে হয় বা শিকারীর ফাঁদ থেকে বেড়িয়ে আসতে হয়। তাহলে সবাই কি বুদ্ধিজীবী? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরকে যেমন বুদ্ধিখাটাতে হয় তেমনি একজন কৃষক বা শ্রমিককেও বুদ্ধি খাটাতে হয়। বুদ্ধি খাটিয়ে একজন প্রফেসর যেমন তার উপার্জন বাড়ায়, একই ভাবে একজন কৃষক বা শ্রমিককেও তার উপার্জন বাড়াতে হয়। একজন বিজ্ঞানী বা প্রকৌশলীও তেমনি বু্দ্ধি খাটিয়ে নিত্যনতুন আবিস্কার করে। কিন্তু তা হলে কি সবাই বুদ্ধিজীবী? সে সাথে আরেকটি প্রশ্নও এসে যায়। নিছক বুদ্ধি খাটিযে সব কাজ হয় না। বুদ্ধির সাথে কায়িক শ্রমও কাজে লাগাতে হয়। এমন শ্রমদান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বা বিজ্ঞানীরও নিস্তার নেই। ফলে যারা বুদ্ধিজীবী তাদের শ্রমজীবীও হতে হয়। তাই প্রশ্ন উঠে, কাকে শ্রমজীবী আর কাকে বুদ্ধিজীবী বলা হবে? এরূপ বিভাজন কি ন্যায়সঙ্গত? ধর্মে যারা অঙ্গিকারহীন বা ইসলামে যারা অবিশ্বাসী -সেসব সেক্যুলারদের ধ্যান-ধারণার সাথে মুসলিমদের এখানেই বিশাল পার্থক্য। কারণ, মুসলিমকে শুধু বুদ্ধিবৃত্তি বা ইলম নিয়ে থাকলে চলে না, তাকে আমলেও নামতে হয়। ময়দানে নামতে হয় সে ইলমের বাস্তব প্রয়োগে। ফলে ঈমানদারের জীবনে বুদ্ধিবৃত্তি ও কর্ম একত্রে চলে।

ইউরোপে ইনটেলেকচুয়ালিজম বা বুদ্ধিজীবী শব্দটির প্রয়োগ তখন শুরু হয়, যখন সেখানে রেনেসাাঁ শুরু হয়। রেনেসাাঁ-পূর্ববর্তী কালে ধর্মযাযকেরা ইউরোপে বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রগুলোকে নিজেদের অধিকারে রেখেছিল। তাদের নিজেদের ভূল ধারণাগুলোকে সঠিক বলে চালু রেখেছিল এবং যারাই এর বিরোধীতা করতো তাদেরকে ধর্মাদ্রোহী বলে হত্যা করতো। স্বাধীন জ্ঞানচর্চার সকল পথকেই তারা বন্ধ রেখে ছিল। নিজেদের অজ্ঞতাগুলোকে তারা শুধু ধর্মশাস্ত্রে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং ভূগোল, সুষ্টিরহস্য ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও ছড়িয়ে দিয়েছিল। তারা হযরত ঈসা (আ:)কে একদিকে খোদা, অপরদিকে খোদার পুত্র বলে গাঁজাখোরীর জন্ম দিয়েছিল। বলতো, তেমনি পৃথিবীটা থালার মত এবং রোম তার কেন্দ্রবিন্দু। গীর্জার পক্ষ থেকে এ রকম হাজারো মিথ্যার জন্ম দেয়া হয়েছিল। জনগণের মাঝে সেসব মিথ্যার প্রভাবও গভীর। থালার মত পৃথিবীর কেনারা ডিঙ্গিয়ে নীচে নরকের মাঝে পড়ে যাবে -এ ভয়ে নাবিকেরা সমুদ্র যাত্রায় যেতে ভয় পেত। কলম্বাস যখন পৃথিবীকে গোলাকার মনে করে পূর্ব দিকের বদলে পশ্চিম দিক দিয়ে ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে, তখন যাযকদের মতে বিশ্বাসী জাহাজের মাল্লারা তাকে সাগরে ফেলা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তারা ভেবেছিল কলম্বাস তাদের পৃথিবীর পশ্চিম কেনারা ডিঙ্গিয়ে নরকে ফেলে দিবে। ধর্মযাযকদের এ সব বক্তব্যে বুদ্ধির সামান্যতম প্রযোগও ছিল না। ছিল কল্পনাপ্রসূত আহাম্মকি। বরং বিবেক-বুদ্ধিকে তারা শৃঙ্খলিত করেছিল। জনগণের মন ও মননের উপর প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল মিথ্যার স্বৈরাচার। সে মিথ্যার বিরুদ্ধে যে কোন প্রতিবাদ ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অনেক বিজ্ঞানীকে শুধু তাদের বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের জন্য গীর্জার পক্ষ থেকে হত্যা করা হয়েছিল। ধর্মযাযকদের অজ্ঞতার কবল থেকে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে সেদিনের জ্ঞানী ব্যক্তিরা বুদ্ধিবৃত্তিকে অস্ত্র রূপে ব্যবহার করেছিল। ইউরোপে ইনটেলেকচুয়ালিজম বা বুদ্ধিবৃত্তির প্রতিষ্ঠা ও প্রচার বলতে গেলে তখন থেকেই।

 

বুদ্ধিবৃত্তির নামে দুর্বৃত্তি

বুদ্ধিবৃত্তির ফায়দাটি বিস্ময়কর। জ্ঞান-বিজ্ঞান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি হয়না। সেটি হয় মানুষের মগজে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো ছাত্র-ছাত্রীদের মগজকে চিন্তা-ভাবনায় সক্রিয় করা। সে কাজটি সঠিক ভাবে হলে মগজ জ্ঞান-উৎপাদনে পাওয়ার হাউসে পরিণত হয়। ইতিহাসের সক্রেটিসগণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি হননি, তারা গড়ে উঠেছেন তাদের মগজগুলো চিন্তায় সক্রিয় হওয়ায়। একই কারণে স্কুল থেকে ঝড়েপরা মার্কিন বিজ্ঞানী আলভা এডিসন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝড়েপরা বিল কিটস বিশ্বের খ্যাতনামা আবিস্কারে পরিণত হয়েছেন। এমন কি মুসলিম ইতিহাসের যারা শ্রেষ্ঠ মনিষী তারাও কোন বিশ্ববিদ্যায়ের সৃষ্টি নন। তারাও গড়ে উঠেছেন নিজেদের মগজ চিন্তাভাবনায় সক্রিয় হওয়ায়। মগজ সক্রিয় না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিও কোন কাজ দেয় না, শিক্ষাঙ্গণ তখন খুনি ও নানা প্রকার দুর্বৃত্ত উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়। এবং তারই উদাহরণ হলো বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্বাদলয়গুলো। এখানে ছাত্ররা খুন হয় এবং ছাত্রীরা ধর্ষিত হয়।

সূর্যোদয়ে যেমন পৃথিবী আলোকিত হয়, বুদ্ধিবৃত্তিতে তেমনি আলোকিত হয় জনগণের মন। আলোকিত মন নিয়ে ছাত্রগণ তখন ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা চিনবার সামর্থ্য পায়। পায় চরিত্র, জেগে উঠে দায়িত্ববোধ। তখন প্রতিষ্ঠা পায় সুনীতি এবং নির্মূল হয় দুর্বৃত্তি। তখন দেশজুড়ে সুনামী আসে নেক আমলে। মুসলিমগণ যখন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মাণ করেছিল তখন তো সেটিই ঘটেছিল। নেক আমল বাড়াতে তাঁরা নিজের সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মত দেশে ঘটেছে উল্টোটি। সুনীতির বদলে সুনামী এসেছে দুর্বৃত্তির। ফলে দুর্বৃত্তিতে দেশটি বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়েছে। দেশ ছেয়ে হয়েছে চুরি-ডাককাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস ও ফাঁসির রাজনীতিতে। দোষ সেই একই জায়গায়; বুদ্ধিবৃত্তির নামে হচ্ছে চরম দুর্বৃত্তি।

বুদ্ধিবৃত্তির শক্তি শুধু সৃষ্টিশীলতায় নয়, নাশকতাতেও। সেটি যেমন সুকর্মের জোয়ার আনতে পারে, তেমনি জোয়ার আনতে পারে অতি নৃশংস দুষ্কর্মেও। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির নামে যা হচ্ছে তাতে সুনামী এসেছে দুর্নীতিতে। সত্য তো এটাই, সৃষ্টিহীন বুদ্ধিবৃত্তির নাশকতায় মানুষের বাঁচা-মরা ও রাজনীতির এজেন্ডাই পাল্টে যায়। তখন শিক্ষা-সংস্কৃতির নামে অর্থ, শ্রম, মেধা ও সময়ের বিনিয়োগ হয় অন্যায়ে প্রতিষ্ঠায় এবং ন্যায়ের নির্মূলে। ফলে দেশে তখন চুরি-ডাকাতি ও ভোটডাকাতি যেমন হয়, তেমনি হয় গুম-খুন-সন্তাসের রাজনীতি। হয় গণহত্যাও। ইসলামের প্রতিরোধ ও ইসলামপন্থিদের নির্মূল তখন রাজনীতির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। তখন ইতিহাস গড়া হয় মিথ্যার পাহাড় দিয়ে।

ইউরোপে বুদ্ধিবৃত্তির জন্ম হয়েছিল বুদ্ধির মুক্তি কল্পে। অথচ বাংলাদেশে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে বুদ্ধি ও বিবেককে শৃঙ্খলিত করার কাজে। এটি ব্যবহৃত হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়ার কোর’আনী রোডম্যাপকে জনগণের দৃষ্টি থেকে আড়াল করার লক্ষ্যে। বুদ্ধিবৃত্তি পরিণত হয়েছে শয়তানের হাতিয়ারে। প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাসিবাদ –যা রাজনীতিতে জন্ম দিয়েছে নৃশংস স্বৈরাচার। দেশে যারা বুদ্ধিজীবী নামে খ্যাত, তারা খাটছে বস্তুবাদ, সেক্যুলারিজম ও মার্কসবাদের মত ভ্রান্তি মতবাদগুলোর পক্ষে। এভাবে বিভ্রান্তি বাড়ানো হচ্ছে জনগণের মনে। ফলে অসম্ভব করছে সিরাতুল মুস্তকীমে চলে। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির নামে এটিই হলো সবচেয়ে বড় নাশকতা।

বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীদের সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তুটি হলো, এরা ইসলামকেও খৃষ্টান ধর্মের ন্যায় বুদ্ধিচর্চার প্রতিপক্ষ মনে করে। খৃষ্টান ধর্মের এজেন্ডা ছিল  মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা দেয়ায়, পাদ্রীদের ব্যস্ততা ছিল যীশুর মুর্তিকে গীর্জায় স্থাপিত করায়। পবিত্র কোর’আনে এজন্যই তাদেরকে “দোয়াল্লীন”তথা পথভ্রষ্ট বলা হয়েছে। সে ভ্রষ্টতা ও মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা দেয়া এবং সত্যকে দাবিয়ে রাখার কাজে শক্তির প্রয়োগ ছাড়া তাদের সামনে বিকল্প পথ ছিল না। নইলে সুস্থব্যক্তির মগজে সে প্রকান্ড মিথ্যাগুলো ঢুকানো সম্ভব ছিল না। খৃষ্টান ধর্মের অবস্থান এজন্যই ছিল বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। ফলে বিদ্যাশিক্ষাকে চার্চের কবল থেকে মুক্ত করা ভিন্ন বিজ্ঞানের অগ্রগতি সেদিন অসম্ভব ছিল।

অপরদিকে ইসলামের শিক্ষা ও ঐতিহ্যই সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা প্রথম দিন থেকেই বিদ্যালাভকে ফরজ বা অবশ্য পালনীয় ইবাদতে পরিণত করেছিল। শুধু পুরুষদের জন্য নয়, নারীদের জন্যও। অজ্ঞতায় অসম্ভব হয় শুধু মুসলিম হওয়া -এমন কি মানবিক গুণে বেড়ে উঠাও। কারো জীবন বাঁচানো ছাড়া জ্ঞানলাভ ও জ্ঞানদানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কল্যাণ-কর্ম দ্বিতীয়টি নেই। এটি শুধু নেক কর্মই নয়, প্রতিটি নরনারীর মৌলিক অধিকারও।  অথচ এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বুঝতে পাশ্চাত্যের খৃষ্টানদের হাজার বছরের বেশী সময় লেগেছে। অপর দিকে বিজ্ঞানের বিরোধীতা দূরে থাক বরং বিজ্ঞানের জন্মই হয়েছিল ইসলামের কোলে। পাশ্চাত্য জগত আজ যে বিজ্ঞান মনষ্কতার কথা বলে -তারা সেটি শিখেছে স্পেনে প্রতিষ্ঠিত মুসলিমদের মাদ্রাসাগুলো থেকে।  

 

কারা আলেম এবং কারা জাহেল?

বুদ্ধির প্রয়োগকে ইসলাম শুধু সিদ্ধই বলেনি বরং এটির প্রতি অতি গুরুত্বও দেওয়া হয়েছে। “আ’ফালা তাক্বীলুন” (কেন বুদ্ধিকে কাজে লাগাওনা?), “আ’ফালা তাফাক্কারুন” (কেন চিন্তাভাবনা করোনা?), “আ’ফালা তাদাব্বারুন” (কেন ভাবনায় নিবিষ্ট হওয়া না?) -মানবের প্রতি সরাসরি এ প্রশ্নগুলো তো মহান আল্লাহতায়ালার। বুদ্ধিবৃত্তি যে মহান আল্লাহতায়ালার কত পছন্দের এবং সেটি যে কীরূপ শ্রেষ্ঠ ইবাদত – এ প্রশ্নগুলো কি সেটাই প্রমাণ করে না? তাই সে ইবাদত না করলে অবাধ্যতা হয় তাঁর হুকুমের। তাই মুসলিমকে শুধু নামায-রোযা নিয়ে বাঁচলে চলে না, তাকে বুদ্ধিবৃত্তি নিয়েও বাঁচতে হয়। ক্ষণিকের চিন্তাভাবনাকে ইসলামের নবীজী(সা:) সারারাতের নফল ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর বলেছেন।

অথচ সেক্যুলারিষ্টদের কান্ড হলো, সে পবিত্র বুদ্ধিবৃত্তিকে তারা ইবাদতের বদলে একটি পেশা এবং উপার্জনের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। এবং বুদ্ধিজীবী রূপে একটি শ্রেণীকে খাড়া করেছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বুদ্ধিজীবীগণ পরিণত হয়েছে শয়তানী এজেন্ডার সেবাদাসে। তাদের সাথে ইসলামের এখানেই ঘোরতর বিরোধ। বুদ্ধিচর্চা করবে একটি শ্রেণী এবং ধর্মচর্চা করবে আরেকটি শ্রেণী -এমন বিভক্তিকরণ ইসলামে নেই। মুসলিম সমাজে এ ব্যাধী এসেছে বস্তুতঃ খৃষ্টান ধর্ম ও হিন্দু ধর্ম থেকে। খৃষ্টান ধর্মে যেমন যাযকদের আধিপত্যটি বিশাল, হিন্দুধর্মে তেমনি আধিপত্য মন্দিরের পুরোহিতদের। পূজা-পার্বন ও ধর্মশিক্ষার সব ঠিকাদারী ধর্মগুরুদের; সাধারণ মানুষের সে সব না শিখলেও চলে। জন-জীবনে ধর্মকর্ম বলতে যা বুঝায় তা হলো গীর্জায় বা মন্দিরে হাজিরা দেয়া এবং পুরোহিতদের ভেট ও প্রতিপালন দেয়া। অথচ ইসলামে ধর্মশিক্ষা, ধর্মপ্রচার ও ধর্মপালেনর কাজটি নারী-পুরুষ সবার। ইমামের ন্যায় একজন নামাযীকেও নামাযের সুরা-কেরাত সঠিক ভাবে শিখতে হয়। এ দায়িত্ব সবার। কেউ ধর্ম পালন করবে, অন্যরা তা দেখবে -এরূপ বিভক্তিকরণ ইসলামে শুধু নিষিদ্ধই নয়, নিন্দনীয়। কারণ এতে মানুষ শুধু ইবাদতশূণ্যই হয় না, চিন্তাশূণ্যও হয়। এরূপ চিন্তাশূণ্য জীবদের সন্মন্ধেই পবিত্র কোর’আনে বলা হয়েছে, “তাদের চোখ আছে কিন্তু দেখে না, কান আছে কিন্তু শোনে না এবং কালব আছে কিন্তু তা দিয়ে ভাবে। এরাই হচ্ছে তারা -যারা গবাদী পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট।”

অপর দিকে ধর্মকর্ম বাদ দিয়ে যারা শুধু বুদ্ধিচর্চা করে -তাদের বিদ্যার গর্ব যতই হোক, আসলে তারা অজ্ঞ। কারণ, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে জ্ঞানের পরিমাপ দেয় তাঁর ইবাদত ও আল্লাহভীতি। জ্ঞান, ইবাদত ও আল্লাহভীতি ঈমানদারের জীবনে একত্রে চলে। জ্ঞান বাড়লে তাই ইবাদত ও আল্লাহভীতিও বাড়ে। সত্যিকার জ্ঞানী ব্যক্তি মাত্রই তাই ইসলামের মুজাহিদে পরিণত হয়। মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করতে সে তখন জিহাদে নামে। সেটিই দেখা গেছে সাহাবাদের জীবনে। সে ভীতি না থাকাটাই অজ্ঞতার পরিচায়ক। তাই আলেমকে চিনতে হলে তার আমলকে দেখতে হয়। দেখতে হয়, তাঁর জীবনে আল্লাহভীতি ও জিহাদ আছে কিনা -সেটি। ধর্মজ্ঞানে অজ্ঞতা কখনোই গোপন থাকে না। তেমন অজ্ঞতার কারণে মুসলিম নামধারী বুদ্ধিজীবী যেমন জিহাদশূণ্য হয়, তেমনি হিন্দু বিজ্ঞানী ভন্ড সাধুকে অবতার ভেবে তার কাছে দয়া ভিক্ষা করে। এবং গোমুত্রও সেবন করে।

 

হযরত ইব্রাহীম (আ:)’য়ের সূন্নত

অপর দিকে জ্ঞানহীন ধার্মিকদের অবস্থাও গোপন থাকার নয়। জিহাদ শুধু রক্তাত্ব রণাঙ্গণেই হয় নয়, অবিরাম জিহাদ হয় বুদ্ধিবৃত্তির আঙ্গণেও। সে লড়াইয়ে বিনিয়োগ হয় ঈমানদারের রাতদিনের ভাবনা, আজীবনের লব্ধ জ্ঞান, মেধা ও কলমের কালি। অথচ সে লড়াইয়ে জ্ঞানহীন ধার্মিকগণ ব্যর্থ হন ইসলামকে প্রতিরক্ষা দিতে। এবং সেটি ইলমের ভান্ডারে প্রয়োজনীয় রশদ না থাকাতে। অথচ মহান আল্লাহতায়ালা প্রচণ্ড খুশী হন যদি কেউ তাঁর চিন্তাশক্তিকে শয়তানী শক্তির সামনে তাঁর মহান কুদরত ও দ্বীনকে শ্রেষ্ঠতর করার কাজে ব্যবহার করে। ইসলাম তো এভাবেই লক্ষ লক্ষ মানুষের মনের ভূবন জয় করে। হযরত ইব্রাহীম (আ:) তাঁর জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করেছিলেন নমরুদের সামনে। আর তাতে মহান আল্লাহতায়ালা এতোই খুশী হয়েছিলেন যে, হযরত ইব্রাহীম (আ:)’য়ের সে সংলাপ পবিত্র কোর’আনে লিপিবদ্ধ করে বিশ্ববাসীর সামনে আদর্শ বুদ্ধিবৃত্তির নমুনা রূপে পেশ করেছেন।    

ইসলামে প্রকৃত আলেম হওয়ার জন্য শুধু ইলম থাকাটাই জরুরি নয়। বরং জরুরি হলো মহান আল্লাহতায়ালার ভয় থাকা এবং সে ভয়ের কারণে তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে আমৃত্যু জিহাদ থাকা। জিহাদ না থাকলে বুঝতে হবে, তার মধ্যে মহান আল্লাহতায়ালা ভয় বলতে কিছু নাই। ইলমও নাই। আলেমের লেবাসধারী সে একজন জাহেল মাত্র। তার আসল পরিচয়, সে একজন ধর্ম-ব্যবসায়ী। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে মত মুসলিম দেশগুলিতে আলেমের লেবাসধারী এরূপ জাহেল ও ধর্মব্যবসায়ীদের সংখ্যাই বিপুল ভাবে বেড়েছে। ফলে ১৭ কোটি মুসলিমের দেশে জিহাদ নাই। দ্বীনের প্রতিষ্ঠাও নাই। বরং যা প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তা হলো ধর্ম-ব্যবসা। মহান আল্লাহতায়ালা সার্টিফিকেট দেখেন না। তিনি দেখেন তাকওয়া ও আমল। তবে সার্টিফিকেট যেহেতু ব্যবসায়ে কাজ দেয়, ফলে ধর্ম-ব্যবসায়ীদের কাছে বেড়েছে ইলমের চেয়ে সার্টিফিকেটের কদর। তাই সার্টিফিকেট পেয়ে শেখ হাসিনার ন্যায় ভোটাচোর ও গুম-খুন-সন্ত্রাসের দুর্বৃত্ত নেত্রীকে “কওমী জননী”র খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। এটি কি কম লজ্জার?     

ইসলাম প্রতিটি ব্যক্তিকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ তথা “ইনসানে কামেল” বানাতে চায়। তবে এজন্য শর্ত হলো “ইলমুল অহি” (কোর’আনের জ্ঞান) এবং “ইলমুল আক্বল” (বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান) এর মিশ্রণ। পৃথিবীর বুকে রয়েছে মহান আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শন বা আয়াত, সেগুলোকে একমাত্র আকলমন্দরাই দেখতে পায়। চন্দ্র-সূর্যের উদয়-অস্ত, বৃক্ষের পত্র-পল্লব, পাখীর কল-কাকলী ও মহাআকাশের নক্ষত্ররাজী -এসবের মধ্যেও কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার কুদরত  দৃশ্যমান। কিন্তু জ্ঞানীরা ছাড়া অন্য কেউ এগুলোকে দেখতে, শুনতে ও বুঝতে পারে না। অথচ যারা প্রকৃত জ্ঞানবান -তাদের কাছে সমগ্র বিশ্বটাই পাঠশালা মনে হয়। মহান আল্লাহতায়ালা চান তাঁর সৃষ্ট পাঠশালা থেকে সবাই শিক্ষা নিক। তাই ইসলাম শুধু কোর’আন শিক্ষাকেই ফরজ করেনি, ফরজ করেছে চিন্তাভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিকেও। ইসলামে উভয়টিই সার্বজনীন। প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার জন্য উভয়ই অপরিহার্য। ইসলামের প্রাথমিক যুগে শ্রেষ্ঠ আলেম বা বুদ্ধিজীবী গড়ে উঠেছেন বিশ্বজুড়া এ পাঠশালা থেকেই। তাদের অধিকাংশই ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, রাখাল ও শমিক। নবীজী (সা:) বলেছেন, “আমি ইলমের ঘর হয় এবং আলী (রা:) হলো তার দরজা।” অথচ হযরত আলী (সা:) ছিলেন একজন ক্ষেটে খাওয়া কায়িক শ্রমের দরিদ্র মানুষ। অথচ বাংলাদেশে বুদ্ধিচর্চার বাহনায় আজ যারা বুদ্ধিজীবী এবং বুদ্ধিবৃত্তিই যাদের প্রতিদিনের কাজ -তাদের অবদানটি কি? বুদ্ধিবৃত্তির কোন ক্ষেত্রটিতে তারা সাফল্য দেখাতে পেরেছে? বাংলাদেশে বড় ব্যর্থতাটি বস্তুত এক্ষেত্রটি। বুদ্ধিবৃত্তির নামে বিপুল সংখ্যক পেশাজীবী বেড়েছে, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি বাড়েনি। ফলে দেশে ইলমের ভান্ডারও বাড়ে না। বরং যা বেড়েছে তা হলো বুদ্ধিবৃত্তির নামে সীমাহীন দুর্বৃত্তি। ১ম সংস্করণ ১০/০১/২০০৫; ২য় সংস্করণ ০২/০১/২০২১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *