বিভক্ত মুসলিম এবং অর্জিত আযাব

ফিরোজ মাহবুব কামাল

পরাজিত মুসলিম

বিভক্তি পরাজয় আনে এবং একতা বিজয় আনে। মুসলিমগণ বিভক্ত হয়ে এবং পরাজয় এনে সে সত্যকে প্রমাণ করে চলেছে। ইতিহাসের কোন পর্বেই মুসলিমগণ শত্রুমুক্ত ছিল না। হযরত আদম (আ:)’র সৃষ্টির পর থেকেই অভিশপ্ত শয়তান মানবের পিছে লেগেছে। মহান স্রষ্টার এ সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে তার জীবনের মূল মিশন থেকে সরিয়ে জাহান্নামে নিতে শয়তান ও তার দল সদা তৎপর। এটিই শয়তান শক্তির সার্বক্ষণিক এজেন্ডা। ঈমান নিয়ে বাঁচার বিপদ এখানেই। কারণ, ঈমান আনার সাথে সাথেই ঈমানদার ব্যক্তি শয়তানের টার্গেটে পরিণত হয়। মু’মিনের সামনে দুটি মাত্র পথ: এক). শয়তানের কাছে আত্মসমর্পণের; দুই). লড়াইয়ের। ঈমানদারকে এজন্যই বাঁচতে হয় লড়াই নিয়ে; একমাত্র সে লড়াই তাঁকে শয়তানের পথ থেকে বাঁচায়। মুসলিম জীবনে এ লড়াইটি হলো জিহাদ। একারণেই মুসলিম জীবনে নামায-রোযার ন্যায় জিহাদকে ফরয় করা হয়েছে। জিহাদ ছাড়া সিরাতুল মুস্তাকিমে এগোনো অসম্ভব।

যেখানে জিহাদ নাই, শয়তানের বাহিনী সেখানে বিনাযুদ্ধে বিজয়ী হয়। স্রেফ নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিল দিয়ে শয়তানের সে বিজয় রুখা যায় না। বিশ্বজুড়ে পরাজয়টি এজন্যই মুসলিমদের। এবং বিজয় এসেছে ইসলামের শত্রুদের। মুসলিম দেশগুলোতে শয়তানী শক্তির বিশাল বিজয় এবং মহান আল্লাহতায়ালার অবলুপ্ত সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের বিলুপ্তির কারণ বহুবিধ। তবে মূল দুটি কারণ হলো মুসলিম জীবনে অনৈক্য ও জিহাদশূণ্যতা। মুসলিমগণ বাঁচছে শয়তানের  কাছে আত্মসমর্পণ নিয়ে। ইসলামকে বিজয়ী করার ভাবনা তাদের মাঝে নাই। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তাদের পরিচয় তাঁর পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত খলিফা রূপে। এখানেই মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। বিশ্বের ১৫০ কোটি মুসলিম যদি তাঁর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালন করতো -তবে কি মুসলিম দেশগুলোত বিজয়ী হতো শয়তানের খলিফাগণ? বিলুপ্ত হতো কি শরিয়ত? তাদের উপর ফরজ করা হয়েছিল জিহাদ এবং সে জিহাদে সিসাঢালা দেয়াল-সম একতাবদ্ধ হওয়া। অথচ তারা বেছে নিয়েছে আত্মঘাতী বিভক্তির পথ।

মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে চলছে শত্রুদের ঘোষিত ক্রুসেড। এবং সে ক্রসেড কোন একক মুসলিম দেশে সীমিত নয়। এখন এটি বিশ্বময়। কোথাও হচ্ছে সেটি সামরিক আগ্রাসন রূপে -যেমন ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও আরাকানে,উইঘুর, লেবানন ও চেননিয়ায়। আবার কোথাও হচ্ছে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের বেশে –যেমন বাংলাদেশ। সামরিক ক্রসেডে বহুলক্ষ নিরপরাধ মানুষ মারা পড়ছে অধিকৃত মুসলিম দেশগুলোতে। অপর দিকে অসামরিক ক্রসেডে হিজাব নিয়ে রাস্তাঘাটে বিপদে পড়ছে ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাসকারি মুসলিম মহিলারা। এবং জানমাল ও ইজ্জত-আবরু নিয়ে বেঁচে থাকায় দায় হচ্ছে ভারত, মায়ানমার, থাইলান্ড, চীন, ফিলিপাইনসহ বহু অমুসলিম দেশে বসবাসকারি বহু কোটি মুসলিমের। শুধু দাড়ি রাখা ও টুপি রাখার দায়ে রাস্তায় চড়-থাপ্পড় খেতে ভারতীয় মুসলিমদের। ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে উঠাকে বন্ধ করতে চীনে প্রায় ১০ লাখ মুসলিমকে তোলা হয়েছে প্রশিক্ষণ শিবিরের নামে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। এগুলো আসলে ডি-ইসলামাইজেশন সেন্টার। মায়ানমার সরকার ঘরবাড়ীতে আগুন দিয়ে প্রায় ১০ লাখ মুসলিমকে আপন ভিটামাটি থকে বিতাড়িত করেছে। দেশটিতে ভয়ানক যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে, কিন্তু সে অপরাধে কাউকে আদালতে তোলা হচ্ছে না।

মহান আল্লাহতায়ার খাতায় যারা নিজেদেরকে মুসলিম রূপে তালিকাভূক্ত করতে চায় -তাদের উপর অর্পিত হয় কিছু অলংঘনীয় দায়ভার। সে দায়ভার পালনের মধ্য দিয়ে তাঁকে জান্নাতের মূল্য পরিশোধ করতে হয়। মু’মিনের উপর সে দায়ভারটি হলো, দেশের আদালতে মহান আল্লাহর আইন তথা শরিয়ত প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজটি। একমাত্র তখনই আল্লাহতায়ালার জমিনে প্রতিষ্ঠা পায় তার সার্বভৌমত্ব। খলিফার অধিকার নাই সার্বভৌম হওয়ার; এ অধিকার একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার। থাকে না আইন প্রণোয়নের অধিকারও; সে অধিকারটিও একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার। “মা হুকমু ইল্লা লিল্লাহ” অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কারোই হুকুম (আইন) দেয়ার হক নাই। শরিয়ত ভিন্ন অন্য আইনে আদালতে বিচার করা তাই হারাম। ভারতের বুকে মোঘল ও সুলতানী আমলের শাসকগণও সে দায়বদ্ধতা পালন করেছিলেন নিষ্ঠার সাথেই। নবাব সিরাজুদ্দৌলার শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় শরিয়তী আইনের শাসন ছিল। আদালত থেকে আল্লাহতায়ালার আইন সরানোর ন্যায় কুফরি কাজটি সে আমলের কোন মুসলিম শাসকই করেননি। সে কাজটি হয়েছে ঔপনিবেশিক কাফেরদের হাতে। বাংলাদেশ সরকারের কাজ হয়েছে কাফেরদের সে শরিয়ত বিরোধী নীতিকে বহাল রাখা। ইসলামের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় গাদ্দারী আর কি হতে পারে? আর জনগণের কাজ হয়েছে ইসলামবিরোধী এ শাসকচক্রকে রাজস্ব জুগিয়ে প্রতিপালন দেয়া। এভাবেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বিজয় পেয়েছে শয়তানী প্রজেক্টকে। তবে ক্ষমতাসীন সেক্যুলারিস্টদের অপরাধ শুধু মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইনের বিলুপ্তি নয়, বরং ভাষা, দল ও অঞ্চলের নামে মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি গড়ার অপরাধটিও তাদের।

 

 অনৈক্যের নাশকতা

মার্কিন নেতৃত্বাধীন ক্রুসেডে ১০ লাখের বেশী মানুষকে নির্মম হত্যা করা হয়েছে একমাত্র ইরাকে। বহু লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে আফগানিস্তানে। হত্যাকান্ড হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে সিরিয়ায়। মার্কিন বাহিনীর বিমান, মিজাইল ও ড্রোন আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, সোমালিয়া এবং ইয়েমেনের বহু শত নগর ও গ্রামকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। এসব দেশের জনগণ যেন মশামাছি। মার্কিনীগণ তাদের হাতে নিহত মুসলিমদের মৃতদেহ গণনা করে না। ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তার বক্তৃতায় ক্রুসেড রূপে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে সে ক্রসেডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একা নয়। সহচর শুধু ইসরাইল এবং ইংল্যান্ডও নয়। যোগ দিয়েছে ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী, ডেনমার্ক, হলান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজল্যান্ড, পোলান্ড, বুলগেরিয়া, চেক রিপাবলিকসহ নানা দেশ। মুসলিম বিরোধী এ ক্রসেডটি এখন এক বহুজাতিক প্রজেক্ট। সিরিয়া ও লিবিয়াতে হাজির হয়েছে রাশিয়াও।

শত্রুগণ যেখানে একতাবন্ধ, মুসলিমগণ সেখানে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত। একটি বিভক্ত জাতিকে ধ্বংসের জন্য বড় রকমের শক্তি লাগে না, ক্ষুদ্র শক্তিও তাদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে পারে। মুসলিমগণ যখনই বিভক্ত হয়েছে, মহাবিপদ তখনই তাদের ঘাড়ের উপর এসে হাজির হয়েছে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে হালাকু খাঁ তার সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে মুসলিম রক্তে দজলা-ফুরাতের পানিকে লাল করেছে। অথচ মঙ্গলদের সমুদয় জনসংখ্যা বাগদাদ বা দামেস্কের ন্যায় একটি শহরের সমান ছিল না। কিন্তু তাদের ছিল ঐক্য। এবং মুসলিমগণ ছিল বিভক্ত। একটি জাতিকে শক্তিহীন করার জন্য অনৈক্যই যথেষ্ঠ। দেয়ালের মাঝ থেকে সিমেন্ট সরে গেলে ইটগুলো শিশুও খুলতে পারে। দেওয়াল তখন সামান্য ধাক্কাতেই বিধ্বস্ত হয়। মার্কিন কোয়ালিশন এখন সে সামান্য ধাক্কা দেওয়ার কাজটিই করছে।  ফলে মুসলিম নিধনে বা মুসলিম-ভূমি দখলে নিতে তাদের তেমন শক্তিহানি ও রক্তক্ষয় হয়নি। অনৈক্যের কারণেই সামান্য সংখ্যক ইংরেজের হাতে ভারতের মুসলিমগণ স্বাধীনতা হারিয়েছিল। একই কারণে পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও কাশ্মীরের মুসলিমগণ অতীতে পরাজিত, ধর্ষিত ও নিহত হয়েছিল মুষ্টিমেয় শিখদের কাছে।

 

অনৈক্য মুসলিমদের জন্য যে কতটা ভয়ানক – মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার চেয়ে সেটি আর কে বেশী জানে? তিনিই তো মুসলিমদের প্রকৃত বন্ধু। তাদের জন্য পরকালে যেমন জান্নাত তৈরী করে রেখেছেন, তেমনি দুনিয়াতেও তাদেরকে বিজয়ী দেখতে চান। সে বিজয় কীরূপে অর্জন করতে হয় সে পথও তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। সেটি ঐক্য এবং জিহাদের পথে। পবিত্র কোর’আনে তাই নির্দেশ দিয়েছেন, “ওয়া’তাছিমু বি হাবলিল্লাহে জামিয়াঁও ওয়া লা তাফাররাকু..” অর্থ: “এবং তোমরা আল্লাহর রশি (কোর’আন)’কে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” উপরুক্ত আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা বিভিক্তি গড়াকে হারাম রূপে ঘোষণা দিয়েছেন -যেমনটি হারাম করেছেন মদ্যপান, সূদ, জুয়া, জ্বিনা বা মানব হত্যাকে।

 

অর্জিত আযাব

বিভক্তি যে জাতির জীবনে আযাব অনিবার্য করে – মহান আল্লাহতায়ালা সেটির ঘোষণাও দিয়েছেন। বলেছেন, “ওয়া লা তাকুনু কাল্লাযীনা তাফাররাকু ওয়াখতালাফু মিম বা’দে মা যা’আ হুমুল বা’ইয়েনা, ওয়া উলায়েকা লাহুমু আযাবুন আজিম।” -(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১০৫)। অর্থ: “তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা নিজেদের কাছে সুস্পষ্ট ঘোষনা আসার পরও বিভক্তি হলো এবং পরস্পরে মতবিরোধ গড়লো। এরাই হলো তারা যাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে কঠিন আযাব।”  তাই বিভক্তি গড়া মহাপাপ। এবং এ পাপ আযাবকে যে অনিবার্য করে -তা নিয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণার পরও কি অস্পষ্টতা থাকে? বিষ পানে মৃত্যু অনিবার্য। বিষপানকারীকে বাঁচানো তাই মহান আল্লাহপাকের সূন্নত নয়। এমন ব্যক্তির মৃত্যু না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক। অনৈক্যও তেমনি জাতির পতন ডেকে আনে। পবিত্র কোরআনে সেটি জানিয়ে দেওয়ার পরও যারা বিভক্তির পথকে বেছে নেয় -তাদের উদ্ধার করাও মহান আল্লাহতায়ালার নীতি নয়। বরং পবিত্র কোর’আনে ঘোষিত তাঁর নীতিটি হলো, আযাবকে অনিবার্য করা। ফলে সে শাস্তি না আসাটিই বরং অস্বাভাবিক। তাই মুসলিম দেশে শত্রুশক্তির হামলা, এবং সে হামলায় গণনিধন, ধর্ষণ, শোষন ও নানাবিধ অত্যাচার – এগুলো মূলত প্রতিশ্রুত আযাব। আসে নিজ হাতের কামাই রূপে।

মুসলিমগণ আজ এমন এক জাতি যারা একতার পথ ছেড়েছে বহু আগেই। তারা বরং ভাষা, বর্ণ, ভূগোল, অঞ্চল, মজহাব, ফেরকা, দল, এমনকি জেলাওয়ারী পরিচয় নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভক্তি গড়াকে নিজেদের কালচারে পরিণত করেছে। ভিন্নভাষী মুসলিমদের অর্থলুটই শুধু নয়, তাদেরকে হত্যা করা, তাদের ঘরবাড়ী দখল করা এবং তাদের নারীদের ধর্ষণকেও তারা আচারে পরিণত করেছে। বাঙালী মুসলিমের তেমন এক আচারের কারণে ১৯৭১’য়ে বাংলাদেশে বহু লক্ষ বিহারী মুসলিম ঘরবাড়ি, চাকুরি-বাকুরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। লক্ষাধিক নিহত হয়েছে এবং বহু হাজার বিহারী মহিলা ধর্ষিতাও হয়েছে।

এমন এক ট্রাইবাল চেতনার নাশকতা থেকে মুক্ত নয় এমনকি পবিত্র মক্কা মদিনার পূর্ণভূমিও। ইসলামপূর্ব যুগের বর্বর জাহেলরাও নিজেদের গোত্রের নামে হেজাজের পবিত্র ভূমির নাম রাখেনি। এমন কাজ তাদের কাছেও রুচিহীন লেগেছে। কিন্তু আজকের সৌদি স্বৈর-শাসকেরা সেটিকেও হার মানিয়েছে। ইসলামের পবিত্র ভূমির নাম সৌদি আরব রেখে তারা প্রমান করেছে, তাদের অঙ্গীকার স্রেফ নিজ গোত্রের প্রতি। নিজেদের গোত্রীয় শাসনকে বাঁচাতে হেজাজের পবিত্র ভূমিতে মার্কিনী কাফির বাহিনীকে ডেকে আনাটিও অপরাধযোগ্য মনে হয়নি। মুসলিম দেশে রাজতন্ত্র এই প্রথম নয়। উমাইয়ারা এসেছে, আব্বাসীয়ারা এসেছে, উসমানিয়ারাও এসেছে। তবে ইসলামের পবিত্র ভূমিতে কাফের সৈন্যদের ঘাঁটি নির্মাণের কাজ এই প্রথম। অথচ মুসলিম বিশ্বে তা নিয়ে প্রতিবাদ উঠেনি।  নিন্দাবাদও হয়নি। বরং আরবভূমির স্বৈর-শাসকদের কাছে বিশ্বাসভাজন হওয়ার নেশাই বরং প্রচণ্ড। এমনকি সে বিষাক্ত চেতনাটি সংক্রামিত হয়েছে মুসলিশ বিশ্বের আলেম, নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের মাঝে। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের চেয়ে তারা বরং স্বৈরাচারি রাজাদের উপঢৌকন লাভকেই জীবনের বড় উপার্জন মনে করেছে। শুধু আরবদের জন্যই নয়, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্যও কি এটি কম অপমানকর -যে মক্কা-মদীনার ন্যায় ইসলামের পূণ্যভূমি আজ মার্কিন যুক্তরাষ্টের কাছে আত্মসমর্পিত একটি রাজশক্তির কাছে জিম্মি। মুসলিমদের প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দিস হাতছাড়া হয়েছে একই কারণে। নিজেদের প্রতিরক্ষায় যারা অসমর্থ এবং আত্মসমর্পিত যেখানে অমুসলিমদের কাছে, পবিত্র ভূমির প্রতিরক্ষা কি তাদের দ্বারা সম্ভব?

ভাষা, ভূগোল ও গোত্র-ভিত্তিক জাতীয় ও উপজাতীয় অপচেতনার আধিপত্য শুধু হেজাজেই নয়, এটি জেঁকে বসেছে সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে। এরূপ দূষিত চেতনার প্রভাবেই মুসলিম উম্মাহ আজ ৫৭ টুকরোয় বিভক্ত। হিন্দুদের জন্য ঐক্য কোন ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নয়। কিন্তু তারপরও তারা ঐক্যবদ্ধ। ভারতের প্রায় ১০০ কোটি হিন্দু নানা ভাষা, নানা অঞ্চল ও নানা বর্ণে বিভক্ত হওয়া সত্বেও একশত তিরিশ কোটি মানুষের বিশাল দেশ গড়ছে। ফলে ভারত আজ এক বিশাল সামরিক শক্তি। আমেরিকাও তাদের সমীহ করে চলে। কারণ, শক্তির কাছে কে না নরম? এবং ভারতের এ শক্তি ও মর্যাদার কারণ সম্পদ নয়। বরং ভারতেই বাস করে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ দরিদ্র জনগোষ্ঠি। তাদের এ শক্তির কারণ তাদের একতা। হাজার খানেক বাঁশের কঞ্চি একত্রিত হলে হাতিও তা ভাঙ্গতে পারে না। ভারতের ক্ষেত্রে সেটিই হয়েছে। অথচ ১৫০ কোটি হয়েও মুসলিমগণ ভারতের সিকি ভাগ জনসংখ্যার একটি দেশও গড়তে পারেনি। নীচে নামার ক্ষেত্রে মুসলিমগণ হিন্দুদের ছাড়িয়ে গেছে। মুসলিমদের ব্যর্থতা যাচায়ের এর চেয়ে বড় মানদন্ড কি হতে পারে? যারা একসাথে ভদ্রভাবে বসবাসের সামর্থ্য রাখে না, তারা কি ইজ্জত পায়?

 

তান্ডবটি মনের ভূগোলে

জনগণের মনের ভূগোলই রাজনৈতিক ভূগোল নির্মাণ করে। যে জাতির মনের ভূগোল জুড়ে জাতীয়, উপজাতীয়, গোত্রীয়, ভাষাগত, দলীয় চেতনার তান্ডব, তারা কি কখনো বৃহৎ ভূগোল নির্মাণের গৌরব পায়? পায় কি বৃহৎ শক্তির মর্যাদা? পায় যে না -সেটিরই বড় প্রমাণ আজকের মুসলিমগণ। মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু এ নয় যে, সে মসজিদে যাবে বা হজ্ব করবে। বরং অন্য ভাষা ও অন্য বর্ণের মুসলিমের সাথে একত্রে বসবাস, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় মানবিক গুণটিও অর্জন করবে। নানাভাষা ও নানা বর্ণে বিভক্ত ভারতীয় হিন্দুদের সেটি আছে। মার্কিনীদেরও আছে। মুসলিমদের মাঝে সে সামর্থ্যটি নাই বলেই তারা পরাজিত ও অপমানিত। এ ব্যর্থতা নামায-রোযা পালন ও মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে দূর হবার নয়। বিদ্যা-বুদ্ধি বা জনসংখ্যা বাড়িয়েও দূর হবার নয়।  সম্ভব নয় কোটি কোটি কপি কোরআন শরিফ ছেপে বা লক্ষ লক্ষ হাফিজে কোর’আন পয়দা করে। সারা রাতের নফল নামাজ কল্যাণ দেয় না, যদি না প্রতিদিনের ফরয কাজগুলো সঠিক ভাবে পালিত না হয়। অতি গুরুত্বপূর্ণ সে ফরযটি হলো মুসলিমদের মাঝে একতা গড়া। একতার বিকল্প একমাত্র একতাই। কিন্তু সে ফরয পালিত হয়নি। হয়নি বলেই মুসলিমদের আজ এ বিপন্ন দশা।

সারা বছর রোযা রাখলেও নামাযের ফরজ আদায় হয় না। তেমনি সারা রাত ইবাদত করলেও একতা প্রতিষ্ঠার ফরয আদায় হয় না। একই কারণে সারা জীবন তসবিহ-তাহলিল করেও বিভক্তি গড়ার ন্যায় হারাম কাজের পাপ মোচন হয়না। এ পাপ নিয়ে বিজয় ও ইজ্জত জুটেনা। বরং ভুগতে হয় পরাজয়ের কুফল। এবং পরকালে জুটে মহান আল্লাহতায়ালার অবাধ্য হওয়ার কঠিণ আযাব। মুসলিম দেশগুলোতে নামাযীর সংখ্যা কি কম? তাসবিহ-তাহলিল করা লোকের সংখাই কি কম? কিন্তু তাতে মুসলিম বিশ্বের কোথাও কি গৌরব বেড়েছে? এসেছে কি বিজয়? অন্য ধর্মের মানুষেরা ইতিহাস গড়েছে ভাষা, বর্ণ, গোত্র, দল ও আঞ্চলিক ভিন্নতা সত্ত্বেও একত্রে বসবাস, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও যুদ্ধবিগ্রহে। কিন্তু মুসলিমদের ব্যর্থতা এক্ষেত্রে বিশাল। তারা ইতিহাস গড়ছে কলহ-বিবাদ ও আত্মঘাতী সংঘাতে। ভাঙ্গার কাজকে উৎসবে পরিণত করছে। এটি কি কম পাপ? ফলে তাদের অর্জনটি বিজয় নয়; বরং সেটি বাংলাদেশের ন্যায় স্বৈরাচার-কবলিত ও মানবিক-অধিকার বর্জিত দেশ হওয়ার কলংক।

 

দায়িত্বটি প্রতিটি ঈমানদারের

ঈমান নিয়ে বাঁচার অর্থ, ইসলামের বিজয়ে নিজ দায়িত্ব নিয়ে বাঁচা। নইলে ঈমানের অর্থ থাকে না। বস্তুত দায়িত্ব নিয়ে বাঁচার মধ্যেই প্রকৃত ঈমানদারী। যার মধ্যে সে দায়িত্ববোধ নাই, বুঝতে হবে তার মধ্যে ঈমানও নাই। দায়িত্ব নিয়ে বাঁচতে গেলে মুসলিম জীবনে জিহাদ আসে, একতা আসে, বিজয়ও আসে এবং সে সাথে ইজ্জতও আসে। সাহাবাগণ মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হতে পেরেছিলেন তো দায়িত্ব নিয়ে বাঁচার জন্যই। সে দায়িত্ব পালনে শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। আজকের মুসলিমদের পরাজয়ের মূল কারণ, তাদের দায়িত্বহীন জীবন। দায়িত্বহীনতা জীবন যা অনিবার্য করে তা হলো, পরাজয় ও অপমান। এরূপ পরাজয় ও অপমান থেকে বাঁচার একটি মাত্র পথ: সেটি হলো প্রতিটি মুসলিমকে ঈমানী দায়িত্ব নিয়ে বেড়ে উঠা। সে ঈমানী দায়িত্বশীলতার মূল কথা, মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে বাঁচা। তখন এ খলিফাদের সাহায্য করা মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত হয়ে দাঁড়ায়।

দেশে দেশে মুসলিমগণ আজ যেরূপ বিপন্নদশার মুখোমুখী তা থেকে বাঁচাতে অন্য কেউই এগিয়ে আসবে না। সাম্প্রতিক ইতিহাসই তার বড় প্রমাণ। বসনিয়ার মুসলিমগণ যখন লাখে লাখে নিহত হলো -তখন কেউ এগিয়ে যায়নি। বরং জাতিসংঘের ডাচ সৈনিকগণ এগিয়ে গিয়ে সার্ব ঘাতকদের হাতে প্রায় ৭ হাজার নিরস্ত্র মুসলিমকে তুলে দিয়েছিল। তাদেরকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারনে গণভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাব পাশ করেও জাতিসংঘ কিছুই করেনি। বরং আজও ভারতের গণহত্যাকে নিরবে সমর্থণ দিচ্ছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের চোখের সামনেই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে আফগানিস্তান, ইরাক, কাশ্মীর, ভারত ও মায়ানমারে। তাছাড়া যা বসনিয়ায় হলো, আগামী কাল সেটি বাংলাদেশসহ অন্য যে কোন মুসলিম ভূমিতেও হতে পারে।

আযাব কোন দেশেই নোটিশ দিয়ে হাজির হয় না। বসনিয়াতেও সেটি নোটিশ দিয়ে আসেনি। আরো লক্ষণীয় হলো, কোটি কোটি মুসলিমের দীর্ঘ দীর্ঘ দোয়া সত্ত্বেও মুসলিমদের উপর দয়াময় মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য নেমে আসেনি। কারণটি সুস্পষ্ট। বিভক্ত, বিভ্রান্ত ও ইসলামে অঙ্গীকারহীন জনগোষ্ঠির বিজয়ে সাহায্য পাঠানো মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত নয়। বরং এ শ্রেণীর মানুষের জন্য তাঁর সূন্নতটি হলো আযাব পাঠানো। সেটিই বার বার ঘোষিত হয়েছে পবিত্র কোর’আনে। তবে এ আযাবের এখানেই শেষ নয়। শেষটি এর চেয়েও ভয়ানক হতে পারে। তখন কাফেরদের মতা বেশ ভূষা, তাদের আদর্শের কাছে আত্মসমর্পণ এবং তাদের সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েও রক্ষা হবে না। বাংলাদেশের মুসলিমগণ ভারতের সাথে বন্ধুত্ব করেছে, ভারতের এজেন্ডা পূরনে ১৯৭১’য়ে তাদের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে, সে যুদ্ধে ভারতকে বিজয়ী করেছে –কিন্তু তারপরও ভারতীয় নৃশংস শোষণ ও আধিপত্য থেকে মুক্তি পায়নি। ভারতীয় শোষণের কারণেই বাংলাদেশে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ এসেছিল এবং পেয়েছিল তলাহীন আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলির খেতাব। বাংলাদেশে যখন কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, এবং ছিল না কোন কল-কারখানা -তখনও এ কলংকযুক্ত খেতাব জুটেনি।

 

একমাত্র ভরসা

মুসলিমদের একমাত্র ভরসা মহান আল্লাহতায়ালা। একমাত্র তাঁর সাহায্যই এ বিপন্নদশা থেকে বাঁচাতে পারে। অতএব উপায়, মহান আল্লাহতায়ালার সে সাহায্যলাভে সর্বশক্তি দিয়ে মনযোগী হওয়া। সে সাহায্যলাভের পথ কোনটি সেটিও পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা অতি সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় বান্দাদের সাহায্যে অতি উদগ্রীব। তাঁর বিশাল ফেরেশতা বাহিনী এজন্য সদাপ্রস্তুত। হযরত মুসা (আঃ)’র নিরস্ত্র জনগণকে তিনিই ফিরাউনের বিশাল বাহিনীর কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাদের জন্য সমুদ্রের বুক চিরে রাস্তা গড়েছেন এবং ডুবিয়ে মেরেছেন ফিরাউন ও তার বাহিনীকে। হযরত ইউনুসকে (আঃ) তিনিই তিমি মাছের পেট থেকে উদ্ধার করেছিলেন। তিনিই বাদশাহ আবরাহার বিশাল বাহিনীকে ধ্বংস করে অরক্ষিত ক্বাবাকে বাঁচিয়েছিলেন। গাছের একটি শুকনো পাতাকে মাটিতে ফেলা যতটা তুচ্ছ, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে ততটাই তুচ্ছ হলো ফেরাউনের ন্যায় কোন রাজার বিশাল বাহিনীকে ধ্বংস করা। এ যুগের নব্য ফেরাউনরাও এর ব্যতিক্রম নয়। মহান আল্লাহপাক আজও সে সাহায্যদানে সদা প্রস্তত।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার সে সাহায্যলাভে আগ্রহী বান্দাহ কই? প্রস্তুতিই বা কই? নিশ্চয়ই তিনি এমন কোন বাহিনীকে সাহায্য করেন না যারা শয়তানের বাহিনীকে ইসলামের পবিত্র ভূমিতে ঘাঁটি নির্মাণের অধিকার দেয়। তিনি তাদেরও সাহায্য করেন না যারা তার শরিয়তী আইনকে তাঁর নিজের সৃষ্ট ভূমিতে নিষিদ্ধ করে। অথচ সকল মুসলিম রাষ্ট্রের শাসক ও জনগণই এ মহাপাপে পাপী। ফলে এ বিদ্রোহ নিয়ে কি তারা মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য আশা করতে পারে? দয়াময় মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকেও সাহায্য করেন না যারা আল্লাহর অন্য বান্দাকে ঘৃনা করে, হত্যা করে ও ঘর-বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করে শুধু এ জন্যই যে তাদের ভাষা, গায়ের রং বা জন্মস্থান ভিন্ন। যে কুকর্মগুলো ১৯৭১’য়ে বাংলাদেশে হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালার বিচারে এগুলো তো শাস্তিযোগ্য জঘন্য অপরাধ। অতএব এরূপ অপরাধীগণ কি তাঁর সাহায্য পেতে পারে? বরং তারা তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি হবে, দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হবে, গুম-খুন-ধর্ষণে প্লাবন আনবে এবং পৃথিবীপৃষ্টে জাহান্নাম নির্মাণ করবে -সেটিই তো স্বাভাবিক।

মহান আল্লাহতায়ালা কাদের ভালবাসেন এবং সাহায্য করেন সেটি কোন গোপন বিষয় নয়। পবিত্র কোর’আনে তাঁর ঘোষণা, “ইন্নাল্লাহা ইউ’হিব্বুল্লাযীনা ইউকাতেলুনা ফি সাবিলিহি সাফ্ফান কা আন্নাহুম বুনইয়ানুন মারসুস।” অর্থ: “আল্লাহতায়ালা নিশ্চয়ই তাদেরকে ভালবাসেন যারা তার রাস্তায় এমন ভাবে যুদ্ধ করে যেন তারা সিসাঢালা প্রাচীর।” –(সুরা সাফ, আয়াত ৪)। নিছক নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিলের মধ্য দিয়ে যারা মহান আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন -এ আয়াতে তাদের জন্য রয়েছে বড়ই দুঃসংবাদ। মহান আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দাহ হতে হলে ইবাদতকে শুধু নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিলে সীমিত রাখলে চলে না। সেজন্য অপরিহার্য হলো, আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদ এবং সে জিহাদে সিসাঢালা প্রাচীরসম ঐক্য। নামায-রোযা, হজ-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিলের ন্যায় ইবাদত ঈমানদারের জীবনে জিহাদ এবং জিহাদের লক্ষ্যে সীসাঢালা ঐক্য গড়বে –সেটিই কাঙ্খিত। ব্যক্তির জীবনে ইবাদত কতটুকু সফল -সেটির পরিমাপ দেয় তো এই জিহাদ এবং ঐক্য। তাই যে সমাজে জিহাদ এবং ঐক্য নাই -সে সমাজে ইবাদতের প্রক্রিয়া যে সঠিক ভাবে কাজ করছে না -সেটি কি প্রমাণের অপেক্ষা রাখে? সাহাবায়ে কেরাম তো জিহাদ ও ঐক্যের পথেই মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয় হতে পেরেছিলেন।

সাহাবায়ে কেরাম মাত্র ৩০ বছরে যতগুলো জিহাদ করেছেন বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশে বিগত হাজার বছরেও তা হয়নি। আর সিসাঢালা প্রাচীরসম ঐকের কথা? ঐকের বদলে গড়া হয়েছে বিভক্তির প্রাচীর। এ প্রাচীর হিমালয়ের চেয়েও দুর্গম। হিমালয় অতিক্রম করা যায়, কিন্তু বিভক্তির এ প্রাচীর অতিক্রম করতে গেলে প্রতিবেশী মুসলিম দেশের সীমান্ত-প্রহরির হাতে গুলীর খাদ্য হতে হয়। এ সীমাহীন বিভক্তি গড়ে উঠেছে ভাষা, গোত্র, বর্ণ ও পৃথক পৃথক ভূগোলের নামে। মুসলিম বিশ্বের এ ভৌগলিক বিভক্তি গড়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের দাসদের হাতে। আরব বিশ্বে উপনিবেশিক ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের প্রবেশের আগে আরবগণ কি ২২ টুকরায় বিভক্ত ছিল? চিহ্নিত এ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ মুসলিম বিশ্বের এ বিভক্ত মানচিত্রের সবচেয়ে বড় পাহাড়াদারই শুধু নয় বরং ভয়ানক ভাবে ব্যস্ত কিভাবে আরো বিভক্ত করা যায়। মুসলিমদের অপরাধ, ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিভক্তিকে অক্ষয় রাখতে তারা শুধু রাজস্বই দেয় না, যুদ্ধ করে এবং প্রাণ দেয়। অথচ ইসলামের মৌল বিধান হলো, বিভক্তি গড়া যেমন হারাম, তেমনি এ বিভক্তিকে বাঁচিয়ে রাখাও হারাম। অথচ মুসলিম দেশগুলোতে সে হারাম কাজই বেশী বেশী হচ্ছে। এ বিভক্তিকে স্থায়ী করতে প্রতি মুসলিম দেশে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল সেনা বাহিনী। কিন্তু এসব সেনা বাহিনীর হাতে মুসলিম উম্মাহর কোথায়ও কি কোন গৌরব বেড়েছে? প্রতিরক্ষা পাচ্ছে কি মুসলিমদের জানমাল ও ইজ্জত-আবরু? বাঁচছে কি স্বাধীনতা? বরং মুসলিম দেশ অধিকৃত হচ্ছে এবং জনগণ গোলামে পরিণত হচ্ছে নিজ দেশের সামরিক বাহিনীর হাতে।

প্রায় তিরিশ কোটি মানুষের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের কোন নিভৃত জংগলে মার্কিন নাগরিকের গায়ে পাথর ছুঁড়লেও তার বিচার হয়। কারণ, তারা ঐক্যবদ্ধ। অপরাধীদের আদালতে তোলার শক্তিও রয়েছে। কিন্ত একই বিশ্বে লাখে লাখে মুসলিম নিধন হলেও তার বিচার নেই। এর কারণ, মুসলিমদের শক্তিহীনতা, অনৈক্য এবং জিহাদে অনাগ্রহ। মার্কিনীরা যেখানে বিশ্বের সর্বপ্রান্তে যুদ্ধে লিপ্ত, অথচ মুসলিমগণ অনাগ্রহী এমন কি নিজদের প্রতিরক্ষাতেও। গরু-ছাগলের জন্মায় জবাই হওয়ার জন্য। তাদের মৃত্যুতে তাই বিচার নেই, মাতমও নেই। বিচার তো তারাই পায় যারা সেটি আদায় করতে পারে। দেশে দেশে মুসলিম গণহত্যার বিচার না হওয়ার কারণ তো এ শক্তিহীনতা। ইসলামে তাই শক্তিহীন থাকাটি হারাম। নির্দেশ দেয়া হয়েছে সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার এবং তা দিয়ে শত্রুকে সন্ত্রস্ত করার। (সূত্র: সুরা আনফাল, আয়াত ৬০)।

ভারতের গুজরাতে হাজার হাজার মুসলিমকে হত্যা করা হলো। অনেককে জীবন্ত আগুণে ফেলে পুড়িয়ে মারা হলো। শত শত মুসলিম নারী ধর্ষিতা হলো। অথচ এ অপরাধে আজও কারো শাস্তি হলো না। একই রূপ অপরাধ হচ্ছে ইরাক, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, সিরিয়া, মায়ানমার ও আফগানিস্তানে। কিন্তু কোথাও কি এ অপরাধে কেউ কাঠগড়ায় উঠেছে? বরং গুজরাতে যে খুনি নরেন্দ্র মোদি এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তার পদসেবা দেয়াই বাংলাদেশে পররাষ্ট্র নীতি। কাশ্মীরের গণহত্যার বিরুদ্ধেও কোন প্রতিবাদ নাই। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে আজ এক নিদারুন বিপন্নদশা। অনৈক্য নিজেই মহাপাপ, আর এ পাপই আজ মুসলিম জীবনে নিদারুন শক্তিহীনতা ও ভয়ানক আযাব ডেকে এনেছে। আযাবমুক্তির জন্য সর্বপ্রথম পাপমোচন ঘটাতে হয়। এবং সে পাপমোচনের পথ হলো, অনৈক্য থেকে বাঁচা এবং আল্লাহর রশিকে (ইসলামকে) একতাবদ্ধ ভাবে আঁকড়ে ধরা। পবিত্র কোর’আনে আরো বলা হয়েছে, “মাই ইয়াতিছিম বিল্লাহ ফাকাদ হুদিয়া ইলা সিরাতুল মুস্তাকিম।” অর্থ: “যারাই আঁকড়ে ধরলো আল্লাহকে তথা তাঁর কোর’আনকে তারাই পেল সিরাতুল মুস্তাকিম।” এবং যারা পায় সিরাতুল মুস্তাকিম, তারাই তো পায় জান্নাত। ১ম সংস্করণ ২৪/০৬/২০০৭; ২য় সংস্করণ ১৫/০১/২০২১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *