বিবিধ ভাবনা (৪৬)

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 ১. অবহেলা সর্বশ্রেষ্ঠ নেককর্মে

মানুষকে শুধু রোগভোগ ও দারিদ্র্য থেকে বাঁচানোই বড় বাঁচানো নয়। হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ ও রাস্তাঘাট নির্মাণই শ্রেষ্ঠ সমাজকর্ম নয়। বরং সবচেয়ে বড় বাঁচানো এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজকর্মটি হলো শয়তানী শক্তির অনুসারি হওয়া থেকে বাঁচানো। রোগভোগ ও আর্থিক দূরাবস্থা কাউকে জাহান্নামে নেয় না, কিন্তু শয়তান ও তার অনুসারীগণ নেয়। আর জাহান্নামের আগুনে পৌঁছার চেয়ে ভয়ানক বিপদ আর কি হতে পারে? যে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচলো -সেই অনন্ত কালের জন্য জান্নাত পেল। নবী-রাসূলগণ তাই মানুষের দৈহিক ব্যাধি ও দারিদ্র্য থেকে বাঁচাতে প্রেরীত হননি। তাঁরা এসেছেন সবচেয়ে বড় কল্যাণটি করতে। এটিই মানব সমাজে সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। এ কাজের জন্যই নবী-রাসূলগণ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার পাবেন। এবং যারা নবী-রাসূলদের সে সূন্নতকে অনুসরণ করেন তারাই পরকালে শ্রেষ্ঠ মানব রূপে সন্মানিত হবেন।

মানুষকে জাহান্নামে নেয়ার কাজে শয়তানের বাহিনী কাজ করে ধর্ম, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের অঙ্গণে। এসব অঙ্গণে শিকার ধরার কাজে শয়তান বিছায় তার নিজের ষড়যন্ত্রের জাল। এবং ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবকাঠামো। জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার শয়তানী কৌশলগুলি রুখার কাজটি তাই মসজিদ-মাদ্রাসায় বসে হয় না। স্রেফ দোয়া-দরুদের মাধ্যমেও হয় না। ঈমানদারকে সশরীরে এসব অঙ্গণে নামতে হয় এবং অর্থ, শ্রম, বুদ্ধি ও রক্তের বিনিয়োগ করতে হয়। কুর’আনের জ্ঞান হলো এ কাজে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তা্ই সে কাজে সামর্থ্য বাড়াতে যারা নিজেকে কুর’আনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে তারাই প্রকৃত জ্ঞানী।

জনগণকে জান্নাতে নেয়ার কাজে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটি হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্র ইসলামী হলে তার শিক্ষানীতি, সংস্কৃতি, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নীতিমালা জনগণকে জান্নাতে নেয়ার বাহনে পরিণত হয়। অপরদিকে শয়তানী শক্তির হাতে অধিকৃত হলে রাষ্ট্র পরিণত হয় জাহান্নামে নেয়ার বাহনে। তাই শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো রাষ্ট্রকে শয়তানী শক্তির হাত থেকে মুক্ত করা ও সেটিকে ইসলামী করার জিহাদ। কোটি কোটি মানুষ তাতে লাভবান হয়। শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবা এ জিহাদে শহীদ হয়ে গেছেন। তাই যারা প্রকৃত ঈমানদার তারা কখনোই রাজনীতি থেকে দূরে থাকে না। সে কাজটি সুচারু ভাবে করার জন্যই নবীজী (সা:) ১০ বছর রাষ্ট্র প্রধান ছিলেন। আজকের মুসলিমদের বিপদে কারণ, নবীজী (সা:)’র সে গুরুত্বপূর্ণ সূন্নতটি মুসলিমদের মাঝে বেঁচে নাই্। এমনকি যারা নিজেদের আলেম রূপে পরিচয় দেন তারাও নিজেদের অরাজনৈতিক বলে ঘোষণা দেন। কিছু দান-খয়রাত করা তাদের কাছে গুরুত্ব পায়, কিন্তু জনগণকে শয়তানী শক্তির খপ্পর থেকে বাঁচানোর ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নয়।   

২. ভালবাসা ও ঘৃণার সামর্থ্য এবং বিমূর্ত বেঈমানী

 কাউকে ভালবাসা ও ঘৃণা করার সামর্থ্য মহান আল্লাহতায়ালা সবাইকে দিয়েছেন। কারো চেতনা বা বিবেকের ভূমিতেই জালেমের লাঠির আঘাত পড়ে না। ফলে প্রতিটি ব্যক্তি এক্ষেত্রে স্বাধীন। তাই ফিরাউনের প্রাসাদে বসেও হযরত আসিয়া ফিরাউনকে গভীর ভাবে ঘৃণা করতেন। বস্তুত ব্যক্তির ঈমানদারী ও বেঈমানী ধরা পড়ে ভালবাসা ও ঘৃণার সামর্থ্যের প্রয়োগের মাঝে। নীরব থাকাটি কোন দেশেই দন্ডনীয় অপরাধ নয়। ঘৃণার স্বাধীনতা প্রকাশ্যে প্রয়োগে ভয় থাকলে নীরব থাকায় বাধা কোথায়? তাই যে ব্যক্তি খুনি, গণতন্ত্রের হত্যাকারী, ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারী ও ইসলামের শত্রুকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতা, দেশের বন্ধু বলতে সোচ্চার -সে ব্যক্তি  নামাযী বা রোযাদার হলেও তাকে কি ঈমানদার বলা যায়? তারা বেঈমানী ধরা পড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চোর ও ভোটডাকাতদের পক্ষ নেয়ায়। ঈমান থাকলে সেটি প্রকাশ পেত দুর্বৃত্তকে ঘৃণা করার মধ্যে।

৩. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটিই সবচেয়ে অবহেলিত

 কুর’আনের জ্ঞানই আল্লাহতায়ালার ভয় তথা তাকওয়া বাড়ায়। জাহেল তথা অজ্ঞ ব্যক্তির অজ্ঞতাটি তার স্রষ্টাকে নিয়ে। ফলে তার পক্ষে তাকওয়া অর্জন যে অসম্ভব -সে ভাষ্যটি মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার। কুর’আনের জ্ঞানই নেক আমলের ওজন বাড়ায়। জ্ঞানই মহান রবের দরবারে ঈমানদারের মর্যাদা বাড়ায়। পানাহার ছাড়া যেমন দেহ বাঁচে না, তেমনি কুর’আনের জ্ঞান ছাড়া ঈমান বাঁচে না। এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো কুর’আনের জ্ঞানলাভ। তাই নামাযের আগে ইলম অর্জন ফরজ করা হয়েছে।

অথচ সে জ্ঞানের উৎস্য পবিত্র কুর’আন ক’জন মুসলিম বুঝে? মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে সে জ্ঞান বিতরণের আয়োজনই বা কোথায়? অথচ এটিই হলো মুসলিম জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। দেশে রাস্তাঘাট ও কল-কারখানা কম হওয়াতে কেউ জাহান্নামে যাবে না। অথচ অজ্ঞতা টানে জাহান্নামের দিকে। কারণ, তাতে অসম্ভব হয় মুসলিম হওয়া। অথচ মুসলিমগণ বাঁচছে কুর’আনী জ্ঞানের গভীর অজ্ঞতা নিয়ে। আর সে অজ্ঞতাই মুসলিমদেরকে মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করেছে। মুসলিমদের মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার মূল বাধা তো এখানেই। আর এজন্যই মুসলিম ভূমিতে ইসলাম পরাজিত।  

৪. অবহেলা বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে

 শয়তানের সৈনিকদের নিরস্ত্র করার কাজটি যুদ্ধের ময়দানে হয় না। যুদ্ধের ময়দানে মূল কাজটি হয় শত্রুর নির্মূলের। শত্রুর সৈনিকদের নিরস্ত্র করা ও যুদ্ধ থেকে তাদেরকে দূরে রাখার কাজটি করতে হয় বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে। ফলে যে দেশে ইসলামের পক্ষে বুদ্ধিবুত্তিক জিহাদ নাই -সে দেশে মুসলিমগণ বিপুল সংখ্যায় শয়তানের দলে যোগ দেয়। তখন সে দলের লোকেরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বেশে রণাঙ্গণে হাজির হয়।

মুসলিমদের মাঝে সে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজটি না হওয়ায় ঔপনিবেশিক কাফেরগণ মুসলিম দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ সৈনিক পেয়েছে মুসলিমদের হত্যা করা ও মুসলিম দেশ দখল করার কাজে। যেমন ভারতের ২ লাখের বেশী মুসলিম ব্রিটশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছে ইরাক ও ফিলিস্তিন দখলের কাজে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন বাংলার কবি কাজী নজরুল ইসলামও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীও। বহু লাখ মুসলিম যোগ দিয়েছে হেজাজ, মিশর ও মরক্কো থেকে। এবং ১৯৭১’য়ে বাঙালী মুসলিমদের দেখা গেছে ভারতীয় কাফেরদের পাশে তাদেরকে বিজয়ীর করার যুদ্ধ করতে।

মুসলিম ইতিহাসের এগুলো অতি কলংকিত অধ্যায়। এবং এর কারণ, বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা। বুদ্ধিবৃত্তিক এ ব্যর্থতার কারণেই কাফেরদের অস্ত্র নিয়ে মুসলিমদের হত্যা করা ও মুসলিম দেশকে কাফেরদের হাতে তুলে দেয়ার ন্যায় অতি ঘৃণ্য কর্মটিও মুসলিম সমাজে অপরাধ রূপে গণ্য হয়নি। একই রূপ বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতার কারণে হাসিনার নেতৃত্বে লক্ষ লক্ষ বাঙালী ভারতের পদসেবা দিয়ে যাচ্ছে। ফলে আবরার ফাহাদদের লাশ করতে কোন ভারতীয়কে নামতে হয়নি। সে নৃশংস কর্মটি বাঙালী মুসলিম সন্তানেরাই দল বেঁধে নিজ উদ্যোগে করে দিয়েছে। 

৫. পতনের শুরু ও কারণ

 মুসলিমগণ তাদের পতনমুখী যাত্রায় যে জায়গায় আজ পৌঁছেছে সেখানে একদিনে পৌঁছেনি। পতনের শুরুটি বহু বছর আগে থেকে। পতনের শুরুটি পবিত্র কুর’আন থেকে দূরে সরা ও বিভক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে।এটি শুধু পতনের পথ নয়, জাহান্নামের পথও।

এ পতনযাত্রা থেকে উদ্ধারের একটিই পথ। সেটি কুর’আনের পথে ফিরে যাওয়া। এবং কুর’আনের পথে ফিরার অর্থ একতার পথে ফিরা। একমাত্র তখনই অনিবার্য হবে বিজয়।

৬. বিচারহীনতার অসভ্যতা

বিশ্বের সকল দেশেই চোরডাকাতদের ঘৃনা করা হয়। তাদের শাস্তিও হয়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো বাংলাদেশ। এদেশে সরকারী দলের চোর-ডাকাতদের বিচার হয় না। বরং সরকারি উদ্যোগে চুরিডাকাতি হয়। এবং গুম, খুন ও সন্ত্রাস হয়। হাসিনা যেরূপ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট চুরি করে বিজয়ী হলো -সেটি কি বিশ্বের অন্য কোন দেশে কখনো হয়েছে? জনগণের ভোট চুরি হয়ে গেলো -কিন্তু সে অপরাধে কারো শাস্তি হলো না। বিচারে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের খুনি ভা্‌ইয়ের শাস্তি হয়েছিল। কিন্তু তাকে হাসিনা সরকার জেল থেকে বের করে এনেছে। কোন সভ্য দেশে কি এটি ভাবা যায়?  

৭. মাতমের দিন

 ঈমানদারের উৎসবের দিন নাই। হৃদয়ে এতো গভীর বেদনা নিয়ে কি উৎসব হয়? কারণ দেশে দেশে মুসলিমদের বেঈমানী, ব্যর্থতা, কদর্যতা ও ভোগান্তিগুলি তো সীমাহীন। কোন ঈমানদার কি মুসলিমদের এমন বিপর্যয় দেখে খুশি হতে পারে? নামতে পারে কি উৎসবে?

উৎসবের জন্য তো বিজয় চাই। সে জন্য মনে প্রচুর আনন্দ চাই। কোথায় সে বিজয়? কোথায় সে আনন্দ? মুসলিম দেশগুলি অধিকৃত ইসলামের শত্রুশক্তির হাতে। পরাজয় এখানে ইসলাম ও মুসলিমের। অসম্ভব করা হয়েছে পূর্ণ ইসলাম পালন করা। ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে প্রতিবাদ জানানোর মৌলিক মানবিক অধিকার। সে অধিকার নিয়ে বাঁচতে গেলে লাশ হতে হয়। গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশে ২২ জনকে লাশ করা হলো খুনি নরেন্দ্র মোদী আগমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর অপরাধে। কোন সভ্য দেশে কি এরূপ ঘটে? এ তো হৃদয়বিদারক ঘটনা। হৃদয়ে এরূপ গভীর বেদনা নিয়ে কেউ কি উৎসব করতে পারে? যে দেশে মানবাধিকার বিলুপ্ত -সে দেশে প্রতিটি দিন তো মাতমের। ০২/০৫/২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *