তাবলীগ জামায়াত কতটা দূরে সরেছে ইসলাম থেকে?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

নবীজী (সা:)’র ইসলাম এবং তাবলীগ জামায়াতের ইসলাম

বাংলাদেশীদের ভয়ানক ব্যর্থতা শুধু রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা, প্রশাসন, অর্থনীতি ও সভ্য ভাবে বাঁচার ক্ষেত্রে নয়। বরং প্রচণ্ড ব্যর্থতা, ভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তি হলো নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলাম অনুসরণের ক্ষেত্রেও। এবং সেটি বিপুল সংখ্যক দেশবাসীর মাঝে। সে ব্যর্থতা, ভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তি থেকে যে সামান্য সংখ্যক ব্যক্তি নিজেদের বাঁচাতে সমর্থ হচ্ছে -তাদের সংখ্যা এতোই নগন্য যে তাতে দেশের ভাগ্য পাল্টচ্ছে না। বরং দেশ একই গতিতে নীচে নামছে। দেশেটির রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে অসভ্যতা, নীতিহীনতা ও নৃশংস ফ্যাসিবাদ। সমগ্র দেশ ডাকাতি হয়ে গেছে দুর্বৃত্ত ডাকাতদের হাতে। এ ডাকাতগণ সফল ভোটডাকাতি ও ব্যাংক ডাকাতিতে রেকর্ড গড়েছে। ডাকাতদের দখলদারীর কারণে জনগণ হারিয়েছে মৌলিক মানবিক অধিকার। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি পরিণত হয়েছে অসভ্য, দুর্বৃত্ত ও ডাকাত চরিত্রের জীব উৎপাদনের আখড়ায়। শিক্ষাঙ্গণে ধর্ষণে সেঞ্চুরী হয়। ভারত বিরোধী মত প্রকাশ করায় আবরার ফাহাদের ন্যায় ছাত্রদের পিটিয়ে লাশ বানানো হয়। এ দুর্বৃত্তরাই চলতি শতাব্দীর শুরুর বছরগুলোতে দেশকে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বের মঞ্চে ৫ বার প্রথম স্থানে পৌছে দিয়েছে। এরূপ ভয়ানক নৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার পাশাপাশি বাঙালি মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে ইসলাম থেকে দূরে সরার ক্ষেত্রেও। দেশটির বুকে তাবলীগ জামায়াতের ন্যায় ইসলাম থেকে দূরে একটি ধর্মীয় দলের সভায় ২০ লাখের বেশী মানুষের উপস্থিতি বস্তুত সে ব্যর্থতা ও ভ্রষ্টতাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এরূপ ভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতির কারণে দেশটিতে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলাম বিলুপ্ত হয়েছে।   

কিন্তু তাবলীগ জামায়াত কতটা সত্যিকার ইসলামের পথে আছে –তা নিয়ে বিচার বা মূল্যায়ন ক’জনের? প্রশ্ন হলো, ইসলামের উপর থাকার অর্থ কি? ইসলামের উপর থাকার অর্থ হলো, পবিত্র কুরআনের বিধান এবং নবীজী (সা:)’র সুন্নাহর উপর থাকা। মহান নবী (সা:) বিদায় হজ্জের দিনে বলেন, “আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। একটি হলো পবিত্র কুর’আন। অপরটি হলো আমার ‌‌‌‌ সুন্নত।” তাই ইসলামের পথে থাকার অর্থ: কুর’আনী বিধান এবং নবীজী (সা:)’র সুন্নতের উপর থাকা। অতএব বলা যায়, যারা আঁকড়ে ধরে পবিত্র কুর’আন ও সূন্নাহকে, একমাত্র তারাই নবীজী (সা:)’র ইসলামের প্রকৃত অনুসারী। তবে পবিত্র কুর’আন ও নবীজী (সা:)’র সূন্নত তো তারাই অনুসরণ করতে পারে -যারা কুরআন বুঝতে সমর্থ এবং নবীজী (সা:)’র সূন্নতের জ্ঞান রাখে। অজ্ঞতায় সেটি অসম্ভব। সেজন্যই কুর’আনের জ্ঞানার্জন ইসলাম ফরজ। এই জ্ঞান অর্জন না করে সত্যিকার মুসলিম হওয়া অসম্ভব। এখানেই তাবলীগ জামায়াতের মূল সমস্যা। তাদের আগ্রহ কুর’আন বুঝায় ততটা নজরে পড়ে না। বরং কুর’আন না বুঝে তেলাওয়াতেই তারা খুশি।

ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়টি হলো, আল্লাহর রাসূল (সা:) নামাজ-রোজা দিয়ে ইসলামের প্রচারের কাজ শুরু করেননি। তিনি শুরু করেছিলেন কুর’আন শিক্ষার মধ্য দিয়ে। মক্কায় অবস্থান কালে ১১টি বছর সে জ্ঞান বিতরণের কাজ অবিরাম চলে। তখন নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, জিহাদ ছিল না। এটিই মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। ইসলামে জ্ঞানার্জন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এ থেকেই বুঝা যায়। এরপর মিরাজ থেকে ফেরার পর ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। তার কিছুকাল পর ফরজ হয় রোজা, হজ্জ ও যাকাত। কিন্তু তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা কুর’আন শিক্ষা নিয়ে ভাবেনা। তাদের কাজের শুরুও করেনা। এই জন্যই তাদের আগ্রহ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় নজরে পড়ে না। বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট, কিন্তু কোথায় তাদের নির্মিত মাদ্রাসা? আরো লক্ষণীয় বিষয় হলো, মসজিদে নামাজের পর যে তা’লিমী বৈঠক করা সেখানে পবিত্র কুর’আন থেকে পাঠ করা হয়না। বরং পাঠ করা ফাজায়েলে আমল নামক একটি বই থেকে।

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে পথ দেখানোই ইসলামের এজেন্ডা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন অঙ্গকে তাই ইসলামের বিধানের বাইরে রাখা যাবে না। মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ: উদখুলু ফিস সিলমি কা’ফফা। অর্থ: প্রবেশ করো ইসলামে পূর্ণাঙ্গ ভাবে। কিন্তু তাবলীগ জামায়াত সে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম নিয়ে ভাবে না। তাদের কাছে পবিত্র কুর’আন ও হাদীসের জ্ঞানদান, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি, দুর্বৃত্তির নির্মূল ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জিহাদ এবং শরিয়তী বিচারের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও গুরুত্ব পায় না। অথচ নবীজী (সা:)’র ইসলামের এর সব কিছুই ছিল।

 

একাত্ম নয় আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা সাথে

মুসলিম হওয়ার শর্ত হলে তাকে বাঁচতে হয় মহান আল্লাহ সুবহানা ওয়াতায়ালার এজেন্ডার সাথে পুরাপুরি একাত্ম হয়ে। পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার নিজের ভাষায় সে এজেন্ডাটি হলো: “লিয়ুয’হিরাহু আলাদ’দীনি কুল’লিহি”। অর্থ: সকল ধর্ম, সকল মতবাদ ও সকল জীবন ব্যবস্থার উপর ইসলামের বিজয়। এটি একটি শত ভাগ রাজনৈতিক এজেন্ডা। রাজনীতি থেকে দূরে থেকে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসায় বসে সে কাজ করা সম্ভব নয়। এজন্যই নবীজী সা: ও সাহাবাদের জীবনে রাজনীতি ছিল। রাজনীতির লক্ষ্য আল্লাহ সুবহানা ওয়াতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা হলে সেটি তখন জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতে পরিণত হয়। কিন্তু তাবলীগের জামায়াতের লোকেরা মহান আল্লাহ সুবহানা ওয়াতায়ালার কুর’আনে ঘোষিত সে এজেন্ডা নিয়ে ভাবে না। এজন্যই তারা ইসলামের বিজয় নিয়েও ভাবে না। তারা শুধু মানুষকে নামাজের দিকে ডাকা নিয়েই খুশি। ইসলামকে বিজয়ী করার ভাবনা থাকলে রাষ্ট্রের উপর দখলদার দুর্বৃত্ত শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদের ভাবনাও তাদের মধ্যে এসে যেত।

তাই কেউ যদি তবলীগ জামায়াতের কাজ করার পাশাপাশী সেক্যুলার ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের কর্মী হয় বা সে রাজনীতির পক্ষে ভোট দেয় -তবে তার ইসলাম কোথায়? তাবলীগের কাজে চিল্লা দেয়, গাশত করে ও নিয়মিত এজতেমায় যোগ দেয়, এমন ব্যক্তি যদি শরিয়ত বিরোধী আইনের আদালতে গিয়ে বিচার ভিক্ষা করে, তবে তার ঈমান কোথায়? তাবলীগ করে আবার ব্যাংকে বসে সুদের লেনদেন করে বা সূদী ব্যাংকে চাকরি করে -তবে তার ঈমান কোথায়? অথচ বাংলাদেশে তো সেটিই হচ্ছে। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইসলামের পূর্ণ পালন যে সম্ভব নয় –সে বোধটুকুও নাই্। এর কারণ কুর’আনী জ্ঞানের অজ্ঞতা।

গ্রামবাসীর গৃহে ডাকাতের হামলা হলে বা কার ঘরে আগুন লাগলে তখন কি মসজিদে বসে ফাজায়েলে আমল পাঠ করা যায়? তখন কি কোন পীরের ওরশে যোগ দেয়া যায়? যোগ দেয়া যায় কি তাবলীগের বিশ্ব ইজতেমায়? তখন তো ফরজ হলো ডাকাত তাড়ানো বা আগুন নেভানো। বাংলাদেশের সমস্যা হলো, দেশ আজ ডাকাতদের দখলে। সমগ্র দেশ দুর্বৃত্তদের হাতে ডাকাতি হয়ে গেছে। চলছে নানারূপ গুম, খুন, দুর্বৃত্তি, চুরিডাকাতি ও সন্ত্রাসের প্লাবন। ঘরের আগুন থামানোর  ন্যায় এখন তো ফরজ হলো এই দুর্বৃত্ত শাসনের নির্মূল। সে লক্ষ্যে অপরিহার্য হলো জিহাদ। এরূপ দুর্যোগের সময় নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকাই তো কবিরা গুনাহ। কিন্তু সে দিকে তাবলীগ জামায়াতের লোকদের খেয়াল নাই। তাবলীগ জামায়াতের টঙ্গি এজতেমায় প্রায় ২০ লাখের বেশী মানুষ জমা হলেও দেশ থেকে দুর্বৃত্ত ডাকাত তাড়ানোর জিহাদে তাদের থেকে ১০ হাজার মানুষও  অংশ নিতে রাজী নয়।

অথচ দেশ থেকে ইসলাম বিরোধী জালিম শাসককে নির্মূল করা উত্তম জিহাদ।‌‌ জালেম শাসকের বিরুদ্ধে হক্ক কথা বলাও উত্তম জিহাদ। এজতেমায় যোগ দেয়া ফরজ নয়, কিন্তু দুর্বৃত্ত শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরজ। নবীজী (সা:)’র জামনায় শত্রু শক্তির পক্ষ থেকে বার বার হামলা হয়েছে। কিন্তু তখন কি এরকম ইজতেমা হয়েছে? বসেছে কি দোয়ার মজলিস? তখন দোয়ার শ্রেষ্ঠ স্থান রূপে গণ্য হয়েছে তো জিহাদের ময়দান।

আল্লাহ সুবাহানা ওয়াতায়ালা চান, মুসলিমগণ বাঁচবে পূর্ণ ইসলামের প্রতিষ্ঠা দিয়ে। আংশিক ইসলাম নিয়ে নয়। সেটি যেমন ব্যক্তি জীবনে, তেমনি রাষ্ট্রীয় জীবনে। কিন্তু তবলীগ জামায়াতের লোকেরা পূর্ণাঙ্গ ইসলামের কথা বলে না। তারা পূর্ণাঙ্গ ইসলাম পালন করেনা। তারা মানুষকে শুধু নামাজের দাওয়াত দেয়, কিন্তু পূর্ণ ইসলামের প্রতি দাওয়াত দেয় না। তারা শরীয়ত প্রতিষ্ঠার কথাও বলে না। স্কুল-কলেজে কুরআন সুন্নাহ শিক্ষা দেয়ার কথাও বলে না। সংস্কৃতিতে যে অশ্লীলতা বাড়ছে তা নিয়েও তারা চিন্তিত নয়। দেশের অর্থনীতি থেকে সূদের ন্যায় ভয়ানক পাপকে বিদায় দেয়া নিয়েও তারা ভাবে না। তাদের কাছে গুরুত্ব পায় মানুষকে নামাজে ডাকা এবং প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমা করা। তাদের এজেন্ডা রাষ্ট্রের বুকে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা দেয়া নয়। ইসলামী বিধানকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার বদলে বিশ্ব ইজতেমাই তাদের কাছে বড় অর্জন ও সবচেয়ে বড় গর্বের কাজ মনে করে। অথচ ইজতেমা ও মোনাজাত ফরজ নয়। ফরজ হলো ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দেয়া এবং সে রাষ্ট্রে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দেয়া ফরজ।

শরিয়ত ছাড়া যারা বিচার করে না তাদেরকে পবিত্র কুর’আনের সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে কাফির, ফাসিক ও জালেম বলা হয়েছে। অথচ তাবলীগের ইজতেমায় না গেল কেউ কাফির, ফাসিক বা জালেম হয় না। অথচ কি বিস্ময়! যে পাপ ব্যক্তিকে কাফির, ফাসিক ও জালেম বানায় -সে পাপ থেকে বাঁচায় তাবলীগের লোকদের মধ্য কোন ফিকির নাই!  বাংলাদেশের আদালতে শরিয়তের আইন নাই। বিচার কার্য পরিচালিত হয় কাফিরদের প্রণীত আইনে। এরূপ বিচার করা যেমন হারাম, তেমনি মেনে নেয়াও হারাম্। এখানে বিদ্রোহ তো মহান আল্লাহতায়ালার আইনের বিরুদ্ধে। নিজ দেশে এরূপ বিদ্রোহ দেখে ঈমানদারের মনে মাতম উঠবে এবং শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় সে জিহাদে নামবে -সেটিই তো অতি কাঙ্খিত। কিন্তু তাবলীগীগণ সে জিহাদে নাই। তা নিয়ে তারা কথাও বলে না।

পৃথিবী পৃষ্ঠে ভ্রান্ত পথ, মত ও ধর্মের সংখ্যা হাজারো। কিন্তু জান্নাতের পথ মাত্র একটি। সে পথটিকে পবিত্র কুর’আনে সিরাতুল মুস্তাকিম বলা হয়েছে। একমাত্র এ পথটিই মানুষকে জান্নাতে নেয়। শয়তান শুধু মানুষের সামনে মুর্তি পূজা নিয়ে হাজির হয় না। মুসলিমদের মাঝে হাজির হয় মুছল্লীর লেবাস পরে। হাজির হয় টুপি, দাড়ি, পাগড়ি, মেছওয়াক নিয়ে। হাজির হয় জাতিপূজা, গোত্রপূজা, সেক্যুলারিজম, কম্যুনিজমের ফেতনা নিয়েও। মিথ্যা ধর্ম, মিথ্যা মতবাদ ও দুষ্ট সংস্কৃতির ন্যায় ভ্রষ্ট ধর্মীয় ফিরকাও হলো শয়তানের হাতিয়ার। তাই মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো সে সিরাতুল মুস্তাকিমটি চেনা। মানব জীবনে সবচেয়ে কঠিন হলো এটি। সে জন্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দোয়া হলো: “এহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম।” অর্থ হলো: (হে আল্লাহ) আমাকে সিরাতুল মুস্তাকিম দেখান। প্রতি নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতেহার মধ্যে এ দোয়াটি পাঠ করি।

অথচ তাবলীগের লোকেরা সিরাতাল মুস্তাকিম চেনার বিষয়কে গুরুত্ব দেয় না। অন্যদেরও সে কাজে উৎসাহিত করে না। গুরুত্ব দিলে জ্ঞানার্জনে আগ্রহী হত। কারণ, সিরাতাল মুস্তাকিম চেনার কাজটি কখনোই অজ্ঞতায় হয় না। জাহেল ব্যক্তির পক্ষে সিরাতুল মুস্তাকিম চেনা অসম্ভব। শুধু ফাজায়েলে আমল কুর’আন শেখায় না। তাই এ কিতাব পাঠ করে সিরাতাল মুস্তাকিম চেনা অসম্ভব। সেজন্য তো কুর’আন বুঝতে হয়। হাদিস জানতে হয়। নবীজী (সা)’র জীবনী ও ইসলামের ইতিহাস পড়তে হয়। কিন্তু সে কাজে তাবলীগ জামায়াতের লোকদের আগ্রহ নেই।

 

 তাবলীগ জামায়াতের অপূর্ণাঙ্গ ইসলাম

কোন ব্যক্তি, পরিবার, সংগঠন ও দেশে নবীজী (সা:)’র ইসলাম কতটা বেঁচে আছে সেটি বুঝতে হলে দেখতে হয় সে জায়গাগুলিতে ইসলামের বিধানগুলি কতটা বেঁচে আছে। শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও তাবলীগ আছে,  কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার ভাবনা নাই, আদালতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নাই, বিদ্যালয়ে কুর’আন শিক্ষা নাই এবং রাজনীতিতে দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ নাই –বুঝতে হবে সেখানে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ভাবে বেঁচে নাই। কারণ নবীজী (সা)’র ইসলামে এর সবগুলিই ছিল।  তাঁর ইসলামে শুধু তাবলীগ ছিল না। তিনি ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। সে লক্ষ্যে তাঁকে ইসলামী রাষ্ট্র গড়তে হয়েছে। সে কাজে তাকে যুদ্ধে নামতে হয়েছে। সে যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছেন ও মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু তাবলীগ জামায়াত নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত সে ইসলামের উপর নাই। নবীজী (সা:) যে ইসলামী রাষ্ট্র গড়লেন, সে রাষ্ট্র গড়তে তিনি ও তাঁর সাহাবাগণ যে লাগাতর জিহাদ করলেন -সে রাষ্ট্র ও জিহাদের কথা তাবলীগ জামায়াতের নেতা-কর্মীগণ মুখে আনে না। এক্ষেত্রে তাদের পলিসি অবিকল তাই যা সেক্যুলারিস্ট, সোসালিস্ট ও ন্যাশনালিস্ট রূপে পরিচিত ইসলামের শত্রুপক্ষের মুখ থেকে শোনা যায়। এজন্যই এই শত্রুপক্ষের সাথে তাবলীগ জামায়াতের কোন বিরোধ নাই্।

তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা মানুষকে নামাজে ডাকেন। কিন্তু তারা সমগ্র ইসলাম প্রতিষ্ঠা দিতে ডাকেন না।  তারা ইজতেমা করেন, গাশত করেন এবং চিল্লা দেন। কিন্তু এগুলির বাইরে যায় না। অথচ নবীজী (সা:) ইসলামের তাবলীগ করেই দায়িত্ব সারেননি। তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল শরিয়তী বিধান, দুর্বৃত্তির নির্মূল, সুশাসন, সুবিচার এবং সমাজ-কল্যানমূলক নীতিমালা। এসবই হলো ইসলামের মূল এজেন্ডা। এগুলো প্রতিষ্ঠা না পেলে ইসলামের বিধানগুলো শুধু কিতাবে থেকে যায়। তবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজে নামলে জিহাদও অনিবার্য হয়ে পড়ে। সে জিহাদে জান, মাল, শ্রম ও মেধার কুরবানি অনিবার্য হয়ে পড়ে। এমন কি শহীদও হতে হয়। অর্ধেকের বেশী সাহাবা এ জিহাদে শহীদ হয়ে গেছেন। সে জিহাদের বরকতেই মুসলিমগণ রোমান সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় সে সময়ের দুটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করে তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র গড়তে পেরেছিলেন। এবং জন্ম দিতে পেরেছিলেন সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তির এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার। কিন্তু সেরূপ ভাবনা নিয়ে তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বাঁচেনা।

 

 ব্যর্থতা ইসলাম চেনায়

 তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা ইসলামকে চিনতেই ভুল করেছে। ইসলামের অর্থ শুধু তাবলীগ, নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত নয়। এগুলির সাথে তাতে যেমন পবিত্র কুর’আন-হাদীসের জ্ঞানলাভ আছে, তেমনি আছে ইসলামী রাষ্ট্র, শরীয়তের বিচার, সূদমুক্ত ইসলামী অর্থনীতি এবং জনকল্যাণমূলক পলিসি। সে সাথে আছে অন্যায় ও দূর্বৃত্তির নির্মূল এবং ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা। এরূপ সবকিছু নিয়েই তো পূর্ণাঙ্গ ইসলাম। কিন্তু তাবলীগ জামায়াতের লোকদের মাঝে সে পূর্ণাঙ্গ ইসলামের ধারণা নাই। তারা বাঁচছে পূর্ণাঙ্গ ইসলামকে বাদ দিয়ে।

মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হওয়া। আংশিক মুসলিম বলে ইসলামে কোন মুসলিম নেই। আংশিক মুসলিম হওয়ার অর্থ হলো, ইসলামের বহু হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিয়ে বাঁচা। অথচ যে কোন হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহই ব্যক্তিকে কাফির বানায়। অথচ আজ মুসলিম বিশ্ব ভরে উঠেছে আংশিক মুসলিমদের দিয়ে। তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, আদালত, সংস্কৃতি, শিক্ষা নীতি চলছে আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিয়ে। সেই একই রূপ বিদ্রোহ দেখা যায় তাবলীগ জামায়াতের লোকদের মাঝেও। অথচ মহান আল্লাহ সুবহানাতায়ালার হুকুম, ইসলামের মধ্যে পূর্ণভাবে প্রবেশ হওয়ার। যে কোন একটি হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ব্যক্তিকে কাফির বানায়। একটি মাত্র হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাতে শয়তান অভিশপ্ত কাফিরে পরিণত হয়েছে। অথচ পূর্ণ ইসলাম পালনে তাবলীগীদের আগ্রহ নাই। 

 

অনিহা রাজনীতিতে

মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম রাজনীতি। রাজনীতির মধ্যেই প্রকাশ পায় প্রকৃত মানবতা। পশুদের ও সাধুদের জীবনে রাজনীতি থাকে না। পশুর তাড়নাটি পানাহারে মোটাতাজা হওয়া নিয়ে। সমাজ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন সাধুর সাধনা হলো আর বড় সাধু বা ঋষিতে পরিণত হওয়া নিয়ে। সমাজ ও রাষ্ট্র পাল্টানোর ভাবনা পশুর ন্যায় তাদেরও থাকে না। অথচ ইসলামী রাষ্ট্র গড়াই হলো মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। সে ইবাদতের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রের বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মিত হয়। তেমনটি দেখা গেছে মুসলিমদের গৌরব কালে। ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার সে কাজটি না হলে সভ্য মানব এবং সভ্য সমাজ গড়ার কাজটিও হয় না। আজকের ব্যর্থ মুসলিমগণ সেটিও প্রমাণ করেছে।

আজ মুসলিমদের মাঝে ইসলামী রাষ্ট্র নাই, ফলে সভ্য মানব ও সভ্য সভ্যতা গড়ার আয়োজনও নাই। একই কারণে বাংলাদেশ তো ইতিহাস গড়ছে দুর্বৃত্তি, ভোটডাকাতি ও নানা রূপ অসভ্যতায়। একটি ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে যা সম্ভব তা দশ লক্ষ মসজিদ বা লক্ষাধিক মাদ্রাসা গড়েও সম্ভব নয়। তখন সমগ্র রাষ্ট্র মাদ্রাসায় পরিণত হয়ে যায়। রাষ্ট্র প্রধান ও সরকারি কর্মকর্তারা তখন ইমাম, খতিব ও মোয়াজ্জেন হয়ে পরিণত হয়। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকগণ তখন দ্বীনের দায়ীতে পরিণত হয়। তখন নামাজের দিকে ডাকতে কারো গাশত ও চিল্লায় বেরুনো লাগে না। সে কাজটি স্কুল-কলেজের প্রতিটি শিক্ষক করে। সে সাথে দেশের মিডিয়াও করে। এজন্যই শয়তান ও তার অনুসারীগণ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোরতর বিরোধী। কারণ তাতে তাদের নিজেদের এজেন্ডা মাঠে মারা পড়ে।

মানব রূপে বাঁচতে হলে অবশ্যই রাজনীতি নিয়ে বাঁচতে হয়। মানব রূপে বাঁচার অর্থ একটি মানবিক ভাবনা, দর্শন ও এজেন্ডা নিয়ে বাঁচা। সেরূপ একটি দর্শন ও এজেন্ডা নবীজী (সা:)’র ছিল বলেই তাঁর জীবনে রাজনীতি ছিল। রাজনীতি না থাকার অর্থ হলো মনুষত্ব বাদ দিয়ে পশুত্ব নিয়ে বাঁচা। একই যুক্তিতে গ্রীক দার্শনিক এরিস্টোটল মানবকে রাজনৈতিক পশু বলেছেন। রাজনীতির মধ্যেই ধরা পড়ে একজন ব্যক্তির বাঁচার এজেন্ডা। তাই যার জীবনে রাজনীতি নাই, বুঝতে হবে তার জীবনে কোন এজেন্ডা নাই। এর অর্থ দাঁড়ায় এমন ব্যক্তি ইসলামের বিজয় নিয়ে আগ্রহী নয়।

দরবেশ হওয়া সহজ। কিন্তু রাষ্ট্রে বিপ্লব আনতে হলে সে কাজটি দরবেশীতে হয় না। যে কোন কল্যাণ কর্মে রাজনীতিই হলো মূল হাতিয়ার। আর মুসলিম মানেই তো আমৃত্যু বিপ্লবী। ইসলামের আলোকে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে পাল্টানোই তাঁর কাজ। রাজনীতি এ কাজে তাঁর হাতিয়ার। রাজনীতিই হলো মু’মিনের জিহাদ। এ জিহাদে যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই ও ভোটের লড়াই আছে, তেমনি শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধও আছে। এ জিহাদে মু’মিন ব্যক্তি তার জান, মাল, শ্রম ও মেধার বিনিয়োগ করে। সে জিহাদটি না থাকার অর্থ, ঈমান না থাকা। ঈমানের দাবীতে কে কতটা সাচ্চা -সেটি তো তার জিহাদই বলে দেয়। মহান আল্লাহতায়ালা সে কথাটিই অত সহজ ভাষায় বলেছেন সূরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে।

কিন্তু পবিত্র কুর’আনের সে পবিত্র বয়ানটি তাবলীগ জামায়াতের লোকদের কাছে গুরুত্ব পায় না। এজন্যই তাদের জীবনের রাজনীতির জিহাদ নাই। রাজনীতি প্রসঙ্গে তাদের বয়ানটি সেক্যুলারিস্টদের ন্যায়। সেক্যুলারিস্টগণ রাজনীতিতে ইসলামের জন্য কোন জায়গা ছেড়ে দিতে চায় না। তাবলীগ জামায়াতও রাজনীতিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা নিয়ে হাজির হতে রাজী নয়। এ জন্যই সেক্যুলারিস্টগণ তাদের প্রতি অতি প্রসন্ন। অথচ  নবীজী (সা:) তাঁর জীবনের শেষ দিন অবধি রাজনীতি করেছেন। দশটি বছর তিনি রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন।‌ নবীজী (সা:)র পর তাঁর সাহাবাগণ রাজনীতি করেছেন। তাঁরাও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তাই যারা রাজনীতিতে নাই, বুঝতে হবে তারা নবীজী (সা:)’র সূন্নতের বিরোধী। আর যারা নবীজী (সা:)’র সূন্নতের বিরোধী তার ইসলামের অনুসারী হয় কি করে?

 

তাবলীগ জামায়াত একটি ফিতনা

মুসলিম জাহানের বুকে তাবলীগ জামায়াত এখন এক ভয়ানক ফিতনা। প্রশ্ন হলো, ফিতনা কি? আরবী ভাষার প্রসিদ্ধ অভিধান “আল মাওয়ারিদ” ফিতনা বলতে যা লিখেছে তা হলো: যা কিছু মানুষকে বিদ্রোহী করে, বিভক্ত করে, কোন কিছুতে প্রলুব্ধ বা আকৃষ্ট করে এবং কোন পথ থেকে দূরে সরায়। তাই মুসলিম সমাজে ফিতনা দেখা দিলে সঠিক ভাবে পূর্ণাঙ্গ ধর্ম-পালন তথা সিরাতুল মুস্তাকিমে চলা অসম্ভব হয়। ফিতনার কাজ হলো, আল্লাহতায়ালার হুকুম ও নবীজী (সা:)’র সূন্নতের বিরুদ্ধে মানুষকে বিদ্রোহী করা। দেশে গোলযোগ সৃষ্টি করা বা ইসলামের বিধানগুলোকে ভুলিয়ে দেয়া। সমাজে ফিতনা বিজয়ী হলে অসম্ভব হয় পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হওয়া। তাবলীগ জামায়াত তো সে কাজগুলি করছে। ফলে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ  তাবলীগ জামায়াতের সদস্য হলেও তাতে ইসলামের বিজয় বাড়ছে না। বরং ধর্ম পালনের নামে মানুষকে তারা নবীজী (সা:)’র ইসলাম থেকে দূরে সরাচ্ছে। বিশেষ করে সে ইসলাম থেকে -যে ইসলামে রয়েছে রাষ্ট্রের বুকে ইসলামকে বিজয়ী করার মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা। তাবলীগ জামায়াত তাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সহয়তা দিচ্ছে ইসলামের শত্রু পক্ষকে তথা শয়তানের পক্ষকে। এরই ফল হলো, বাংলাদেশে যতই বাড়ছে তাবলীগ জামায়াতের অনুসারীদের সংখ্যা, ততই বলবান হচ্ছে ভারতসেবী ইসলামের শত্রু শক্তির প্রতিপত্তি। তাই ইসলামের চিহ্নিত শত্রু শক্তিগুলি দেশের ইসলামী দলগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলেও তাবলীগ জামায়াতের সাথে তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। বিশ্ব ইজতেমাতেও তারা হাজির হয়।

পরিপূর্ণ মুসলিম হওয়াই মুসলিম জীবনের মূল সাধনা। মুসলিমকে কিভাবে মুসলিম হতে হয় -সেটি দেখিয়ে গেছেন নবীজী ‌সা:। বস্তুত তা নিয়েই নবীজী (সা:)’র সূন্নতের ভান্ডার। তিনিই হলেন সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে অনুকরণীয় সর্বশ্রেষ্ঠ মডেল তথা উসওয়াতুন হাসানা। নবীজী (সা:)’র জীবনে দ্বীনের তবলিগ ছিল। নামাজ-রোজা এবং হজ্জ-যাকাতও ছিল। তাঁর জীবনে রাজনীতিও ছিল। সে রাজনীতিতে ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদ ছিল। তিনি যুদ্ধের ময়দানে আহত হয়েছেন। তাঁর দাত ভেঙ্গে গেছে শত্রুর আঘাতে। তিনি দশটি বছর রাষ্ট্র নায়ক ছিলেন। তাঁর রাষ্ট্রে ইসলামী আইন তথা শরীয়তের প্রতিষ্ঠা ছিল। তিনি অন্যায় ও অবিচারের নির্মূল করেছেন এবং ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। যারা মুসলিম হতে চায় তাদের সামনে নবীজী (সা:)’র এ মডেল ছাড়া অন্য কোন মডেল আছে কি? কিন্তু তাবলীগ জামায়াত নবীজী (সা:)’র সে মডেল নিয়ে বাঁচতে রাজি নয়। বরং তারা গড়েছে নিজস্ব মডেল –যা নবীজী (সা:)’র সূন্নত থেকে ভিন্ন। এভাবে ধর্মের মুখোশ পড়ে তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। তাবলীগ জামায়াত এ জন্যই এক ফিতনা।

আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশে যতই বাড়ছে তাবলীগ জামায়াতের কর্মকাণ্ড ও  সদস্যদের সংখ্যা,  ততই দেশ দুর্নীতিতে ডুবছে। বাংলাদেশের তাবলীগ জামায়াতের শুরু ১৯৬৭ সাল থেকে। তখন এ দেশ পূর্ব পাকিস্তান ছিল। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হয়নি। কিন্তু তাবলীগ জামায়াতের ইজতেমায় যখন থেকে লোকের জমায়েত ২০-৩০ লাখ হওয়া শুরু করলো তখনই বাংলাদেশ ভিত্তিতে বিশ্বে পাঁচবার প্রথম হলো। এখনও সে দুর্নীতি থামছে না। অথচ একটি ধর্মীয় সংগঠনের প্রসার ও প্রভাব বাড়লে জনগণের চরিত্রে বিপ্লব আসার কথা। যে দেশে কম্যুনিস্টগণ ২০ বা ৩০ লাখ মানুষের জনসভা করতে পারে সে দেশে কম্যুনিজমের বিপ্লব আসে। তেমনি যে দেশে ২০-৩০ লাখ ইসলামী মানুষের জনসভা হয় সে দেশে ইসলামের বিজয় আসার কথা। অথচ বাংলাদেশে সেরুপ বিপ্লব আসেনি। এ ব্যর্থতার সাথে জড়িত তাবলীগ জামায়াতও। কারণ, তাদের বিশাল সংগঠন ব্যর্থ হচ্ছে দেশবাসীর চরিত্রে পরিবর্তন আনতে। ব্যক্তির চরিত্রে তো তখনই বিপ্লব আসে, যখন জ্ঞানে বিপ্লব আসে। অজ্ঞ ও জাহিলকে মানুষকে মসজিদে আনা যায়। তাকে নামাজীও বানানো যায়। কিন্তু তাকে চরিত্রবান বানানো যায় না। ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া যায়না। এজন্যই তো নামাজ ফরজ করার আগে মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা কুর’আনের জ্ঞানার্জন ফরজ করেছেন। কিন্তু সে ফরজ পালন নিয়ে তাবলীগ জামায়াতের কোন আগ্রহ নাই।

 

জন্ম দিচ্ছে বিভ্রান্তির

তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা শুধু ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরেই সরেনি, বরং অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মারাত্মক বিভ্রান্তিও সৃষ্টি করেছে। সেটি বুঝা যায় তাদের বহুল পঠিত বই ফাজায়েলে আমল পাঠ করলে। তাবলীগ জামায়াত ফাউন্ডেশন ও তাবলীগ কুতুবখানা থেকে ২০০৫ সালে প্রকাশিত ফাজায়েলে আমলের ১২৬  পৃষ্ঠায় মাওলানা ইদ্রিস আনসারী নামক একজন হুজুরের লেখা “মেরি নামাজ” বই থেকে যে উদ্ধৃতিটি পেশ করা হয়েছে সেটি অতি বিভ্রান্তিকর। তিনি বলেছেন, নামাজ হলো আমার জিহাদ। প্রশ্ন হলো নামাজ জিহাদ হয় কি করে? নামাজ থেকে জিহাদের পার্থক্য বুঝার জন্য কি মাওলানা হওয়া লাগে?  

জিহাদ বলতে কি বুঝায় সেটি পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালা নিজেই সংজ্ঞায়িত করেছেন। এরপর নবীজী (সা:) জিহাদ করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন জিহাদ কীরূপে করতে হয় এবং জিহাদ বলতে কি বুঝায়। হাজার হাজার সাহাবায়ে কেরামও জিহাদ করেছেন। তাদের নামাজ যেমন নামাজ ছিল, তেমনি তাদের জিহাদও জিহাদ ছিল। নামাজকে তারা কখনোই জিহাদ মনে করেননি। জিহাদের অর্থ হলো, ইসলামের শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সে যুদ্ধে জান ও মালের বিনিয়োগ থাকে। কিন্তু নামাজে তো অর্থের বিনিয়োগ নেই। রক্তের বিনিয়োগও নেই। তাই নামাজ জিহাদ হয় কি করে?

“ফাজায়েলে আমল” কিতাবের এক জায়গায় এক হুজুরের স্বপ্নের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, একজন লোক শহীদ হয়ে গেল এবং তার এক বছর পর আরেক জন লোক মারা গেল।‌‌ সে ব্যক্তি স্বপ্নে দেখলেন যে ব্যক্তি পরে যারা গেল সে শহীদ হওয়া ব্যক্তির আগে জান্নাতে প্রবেশ করলো। তিনি নবীজী (সা:)কে জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কেমনে হলো? নবীজি বললেন, কেন তুমি বুঝলে না? ঐ ব্যক্তি এক বছর বেশি বেঁচে ছিল এবং শহীদ হওয়া ব্যক্তির চেয়ে এক বছর বেশি নামাজ পাঠ করেছিল! এ কাহিনী বলে জিহাদের মর্যাদাকে খাটো করা হয়েছে এবং নামাজকে জিহাদের উপর স্থান দেয়া হয়েছে। একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং পবিত্র কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক। যারা শহীদ হয়,  তাদের অপেক্ষা করতে হয় না। তারা সরাসরি জান্নাতে যায়। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা তো শহীদদের সে মর্যাদাটিই বার বার তুলে ধরেছেন। কিন্তু “ফাজায়েলে আমল” কিতাবে শহীদদের মর্যাদা ভুলিয়ে দেয়ার জন্য ভিন্ন বয়ান খাড়া করা হয়েছে। যেহেতু তারা মানুষকে শুধু নামাজের জন্য ডাকে, তাই উক্ত কিচ্ছায় নামাজের গুরুত্বটি অধিক দেখানো হয়েছে, জিহাদকে নয়। লক্ষণীয় হলো, তাদের এই মনগড়া বয়ানের পক্ষে সকল হাদীস গ্রন্থ খুঁজে নবীজী (সা)’র একটি হাদীসও সংগ্রহ করতে পারিনি। ফলে স্বপ্নের আশ্রয় নিয়েছে। নবীজী (সা)কে স্বপ্নে হাজির করে তাঁর মুখ থেকে নিজেদের পছন্দের কথাটি বের করা হয়েছে।

 

ভারতীয় মডেল

 তাবলীগ জামায়াত যে ইসলামের প্রচার করে সেটি হলো ইসলামের ভারতীয় মডেল। নবীজী (সা:)’র মডেল নয়। তাবলীগ জামায়াতের জন্ম ভারতে।  বিজিপি’র চরম হিন্দুত্ববাদী নেতারাও এদেরকে নিজেদের জন্য শত্রু মনে করে না। অথচ শয়তান ও শয়তানের অনুসারী এই ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীগণ নিজেদের শত্রুদের চিনতে কখনোই ভূল করে না। এজন্যই ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের বিরামহীন যুদ্ধ। কিন্তু তাদের সে যুদ্ধ তাবলীগ জামায়াতের বিরুদ্ধে নাই। এর অর্থ দাড়ায় শয়তানও তাদেরকে প্রকৃত ইসলামী মনে করেনা। যারা নিজেরাই বিভ্রান্ত, তাদের বিভ্রান্ত করা শয়তানের এজেন্ডা নয়। অথচ ভারতের হিন্দুত্ববাদীগণ জাকির নায়েকের মত একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে কথা বলার সুযোগ দিতে রাজি নয়। নির্যাতন এড়াতে তাকে ভারত ছাড়তে হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর বিজিপি সরকার পিস টিভির ন্যায় একটি অরাজনৈতিক টিভি চ্যানেলকেও ভারত কাজ করতে দেয়নি। অথচ তারা তাবলীগ জামায়াতকে কাজ করার পূর্ণ সুযোগ দেয়। এ বিষয়টি লক্ষ্য করার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের ন্যায় বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী ভারতসেবীদেরও একই নীতি। বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী সরকার কোন ইসলামিক সংগঠনকে কাজ করতে দিতে রাজি নয়। শাপলা চত্বরে এরা হেফাজতে ইসলামের নিরীহ মুসল্লীদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী’র নেতাদের উপর চলছে নৃশংস নির্যাতন।‌ দলটির শত শত নেতাকর্মীকে কারাবন্দী করা হয়েছে এবং শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতেও ঝুলিয়েছে। কিন্তু ভোটডাকাত হাসিনার সরকার তাবলীগের ইজতেমা সফল করতে সাহায্য করে। এবং হাসিনা নিজে হাজির হয় তাবলীগ ইজতেমার দোয়ার মজলিসে। কারণ, ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে তাবলীগ জামায়াতের কোন এজেন্ডা নাই।‌‌‌‌‌ তারা বাঁচে হাসিনার ন্যায় জালিম শাসকের কাছে আত্মসমর্পণ ও বন্ধুত্ব নিয়ে‌ -যা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। অথচ মুসলিম হওয়ার শর্ত হলো অন্যায়কারী জালেমের বিরুদ্ধে জিহাদ নিয়ে বাঁচা। এরূপ বাঁচাই নবীজী (সা:)’র শ্রেষ্ঠ সুন্নত। অথচ সে সুন্নত নিয়ে তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা ভাবেনা। সে জিহাদী চেতনা নিয়ে তারা রাজনীতিও করে না। নবীজী (সা:)’র ইসলাম থেকে তারা যে কতটা দূরে সরেছে -সেটি তাদের এরূপ পলিসি ও কর্মকাণ্ডই বলে দেয়। তাই এই ইসলাম নিয়ে মুসলিম উম্মাহর কোন কল্যাণ আছে কি? ১৯/০১/২০২৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *