অধ্যায় ছত্রিশ:জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যর্থতা ও অপরাধ

জেনারেল ইয়াহিয়ার অযোগ্যতা

ইয়াহিয়া খানের অযোগ্যতাটি বহুবিধ ও বিশাল।একদিকে যেমন রাজনৈতিক,তেমনি সামরিক।পাকিস্তানে তখন দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল রাজনৈতিক সংকট।অথচ তার রাজনৈতিক কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। সামরিক দিক দিয়েও তিন যে কতটা অযোগ্য ছিলেন,সেটি বুঝা যায় একাত্তরে তার যুদ্ধ-প্রস্তুতি থেকে।এমন একজন অযোগ্য ব্যক্তি কি পাকিস্তানের ন্যায় সমস্যাবহুল রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হয়? দেশ যে ভয়ানক একটি যুদ্ধের দিকে ধেয়ে চলছে এবং ভারতের যুদ্ধপ্রস্তুতি যে বিশাল ও দীর্ঘ দিনের -সেটি বুঝে উঠতেও ইয়াহিয়া খান ব্যর্থ হয়েছেন। রাজপথে যখন রীতিমত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে,ঢাকার বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়েছে এবং খোদ মুজিব সে পতাকা টানিয়ে তার সাথে বৈঠকে আসছেন -প্রেসডেন্ট ইয়াহিয়া খান তখনও বুঝতে উঠতে পারেননি দেশ কোন দিকে যাচ্ছে।তবে ইয়াহিয়ার ন্যায় অযোগ্য ব্যক্তির উচ্চ পর্যায়ে উঠে আসার জন্য দায়ী তার পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী শাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান।স্বৈরাচারী শাসনের বড় বিপদ,দেশের রাজনীতিতে যোগ্য ব্যক্তিগণ গণ্য হন শত্রু রূপে।ফলে নানা ভাবে তাদের দমিয়ে রাখা হয়।ক্ষমতার মঞ্চে তখন ভিড় বাড়ে অযোগ্য ও চাটুকর মোসাহেবদের।তাই অযোগ্যতা শুধু যে ইয়াহিয়ার একার -তা নয়।তার টিমে যারা ছিলেন তাদের অনেকেরই।সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন এ্যাডমিরাল আহসান এবং সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান।তারাও পরিস্থিতি বুঝে উঠতে ব্যর্থ হন।পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে মুজিব ও তার অনুসারিদের গোপন স্ট্রাটেজী তাদের কাছে শেষ অবধি অজানাই থেকে যায়।মুজিব ১৯৭০’য়ের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন,আর তাতেই তারা ভেবে নিয়েছিলেন অখণ্ড পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনা ও দেশটিতে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি ও তার দল আগ্রহী।একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ তাই স্রেফ ভারতীয় আগ্রাসন বা মুজিবের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি নয় -সে সাথে পাকিস্তানের শাসক মহলে নেতৃত্বের গভীর সংকট।সে সময় এক ঝাঁক অযোগ্য ও দুর্বৃত্ত নেতাদের হাতে অধিকৃত হয়েছিল পাকিস্তানের রাজনীতি।সে দুর্বৃত্তি প্লাবিত করে বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানকেও।সমস্যার জটিলতা বুঝবার সামর্থ্য ইয়াহিয়ার যেমন ছিল না,তেমনি ছিল না তার টিম মেম্বারদের।

ইয়াহিয়ার সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা হলো, পূর্ববর্তী গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর বহু কষ্টে অর্জিত অর্জনগুলির গুরুত্ব বুঝতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে সমাধানকৃত জটিল বিষয়কে তিনি আবার বিতর্কিত করেন। পাকিস্তানে সর্বদলীয় ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সংবিধান প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৫৬ সালে।সেটিকে মেনে নিয়ে শেরে বাংলা ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হোন।আওয়ামী লীগ নেতা জনাব সহরাওয়ার্দি বলতেন, ১৯৫৬’য়ের সংবিধানে শতকরা ৮০ ভাগ স্বায়ত্বশাসন দেয়া হয়েছে।সে সংবিধানটি বিলুপ্তি করে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেন আইয়ুব খান।ইয়াহিয়া খানের সবচেয়ে বড় ভূলটি হলো আইয়ুব খানের সে বেআইনী কাজটিকে বেআইনী ঘোষণা দিয়ে ১৯৫৬ সালের সংবিধানটি পুনর্জীবিত না করা।পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে “স্বৈরাচারী আইয়ুবের ১৯৫৬ সালের সংবিধানটি বিলুপ্ত করাই বেআইনী ছিল তাই পুনরায় বহাল করা হলো”– সামান্য এই একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণই যথেষ্ট ছিল। তাতে নিমিষেই পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সমস্যাটি সমাধান হয়ে যেত।অথচ সেটি না করে মীমাংসিত বিষয়কে তিনি আবার বিতর্কিত করেন। ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণোয়নে ৯ বছর লাগে। সংবিধান তৈরীতে অনেক বছর লেগেছে ভারতেও।ইয়াহিয়া খানের বেঁধে দেয়া ১২০ দিনের মধ্যে নতুন সংবিধান তৈরীর বিষয়টি ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার।তাই সে সময় পাকিস্তানপন্থীদের প্রধান দাবী হওয়া উচিত ছিল,বাতিলকৃত সংবিধানের পুনর্জীবন,নতুন সংবিধান তৈরী নয়।বড়জোর সংসদে বসে নতুন সংসদ সদস্যগণ ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সংশোধনী আনতে পারতেন।আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালে তাঁর মৃত্যু অবধি বিরোধী দলীয় জোট ন্যাশনাল ডিমোক্রাটিক ফ্রন্ট (এন.ডি.এফ) নিয়ে ১৯৫৬’য়ের সংবিধান পুনপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে গেছেন।কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সে পথে আন্দোলন না করাই ছিল সবচেয় বড় ভূল।সে ভূল থেকে পুরা ফায়দা নেয় পাকিস্তানের শত্রুগণ।সে গভীর খাদ থেকে দেশটি ১৯৫৬ সালে সফল ভাবে উঠে আসতে পেরেছিল,১৯৭১ সালে সে গভীর খাদেই পুনরায় নিক্ষিপ্ত হলো।কিন্তু এবার আর সুযোগ মেলেনি সে সংকট থেকে পুনরায় বেরিয়ে আসার।

শেখ মুজিব যে পাকিস্তানকে ভাঙ্গতে চায় সেটি পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের কাছে অজানা ছিল না।পাকিস্তান ভাঙ্গার সে কাজে মুজিব যে ভারতীয় ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত -সেটিও পাকিস্তান সরকারের অজানা ছিল না;সেটি প্রকাশ পেয়েছিল আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৮ সালে।তখন মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আদালতে উঠেছিল।সে মামলার পিছনে গোয়েন্দাদের নির্ভরযোগ্য রিপোর্ট ছিল।শেখ মুজিব তার দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে বৈঠকে পাকিস্তান ভাঙ্গার যে পরিকলন্পনাটি ব্যক্ত করেন,সে বক্তব্যের ক্যাসেটও সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দারা ইয়াহিয়াকে দেখিয়েছিল।– (Chowdhury, G.W: 1974)।১৯৬৯’য়ের গণআন্দোলনের সময় বিরোধী দলগুলির সম্মিলিত জোট DAC (Democratic Action Committee)’য়ের রাজনৈতিক চাপে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি তুলে নিতে বাধ্য হন। DAC’য়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সকল প্রধান বিরোধী দল। তাতে যেমন জনাব নূরুল আমীনের পিডিপি (পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক পার্টি)ছিল,তেমনি জামায়াতে ইসলামীও ছিল।সে জোটে ছিলেন,প্রখ্যাত পশ্চিম পাকিস্তানী আওয়ামী লীগ নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান এবং পাঞ্জাবের কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা জনাব দৌলাতানা।আওয়ামী লীগের একার পক্ষ্যে সে সময় সে ষড়যন্ত্র মামলাটি প্রত্যাহার করিয়ে নেয়ার সামর্থ্য ছিল না।কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো,সে জন্য শেখ মুজিব সেসব বিরোধী দলীয় নেতাদের প্রতি সামান্যতম সৌহার্দ্যও দেখাননি। বরং যখনই সুযোগ পেয়েছেন,তাদের মাথা ভাঙ্গার কোন চেষ্টাই বাদ দেননি। রাজনৈতিক চাপে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি তুলে নেয়া হলেও তাতে মুজিব যে নির্দোষ -সেটি প্রমাণিত হয়নি। অথচ মুজিবের মূল্যায়নে ইয়াহিয়া এ বিষয়টিকে আদৌ বিবেচনায় আনেননি। তিনি হয়তো বিশ্বাস করেই নিয়েছিলেন,নির্বাচনের পর মুজিবের সমর্থণ নিয়ে তিনিই হবেন পাকিস্তানের সিভিল প্রেসিডেন্ট।

 

ইয়াহিয়ার অপরাধ

ইয়াহিয়া খানের অপরাধ,পাকিস্তান সরকারের বিশ্বস্ত গোয়েন্দাদের বিশ্বাস না করে তিনি মুজিবকে বিশ্বাস করেছিলেন।শুধু বিশ্বাস নয়,নির্বাচনে অন্য দলগুলির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে তাকে প্রচুর প্রশাসনিক সহয়তাও দিয়েছেন।ফলে বুঝা যায়,শেখ মুজিবের চরিত্র ও রাজনৈতিক রোডম্যাপ নিয়ে তিনি ও তার টিম সামান্যতম হোমওয়ার্কও করেননি। প্রশ্ন হলো,যে ব্যক্তি ভারতীয় গুপ্তচরদের সাথে দেখা করতে চোরা পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যেতে পারেন,এবং যার বিরুদ্ধে রয়েছে পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের সুনির্দ্দিষ্ট রিপোর্ট –সে গুরুতর বিষয়টি দেশের প্রেসিডেন্ট উপেক্ষা করে কি করে? সরকারি প্রশাসন পক্ষে থাকায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডারগণ প্রতিদ্বন্দী দলগুলোর নির্বাচনি জনসভাগুলোতে সহজেই সন্ত্রাস প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়।ফলে অন্য দলগুলির পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।সন্ত্রাসের মাত্রা এতই অধীক ছিল যে অন্য কোন দলই ঢাকার পল্টন ময়দানো কোন জনসভা করতে পারিনি।এবং নির্বাচনের দিনে আওয়ামী লীগ জোয়ার আনে জাল ভোটের।ফলে দলটির নির্বাচনি বিজয় সহজতর হয়।মুজিব চাচ্ছিলেন,স্বায়ত্বশাসনের বিষয়কে সংজ্ঞায়ীত না করে সেটি নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি। লক্ষ্য ছিল,যে কোন উপায়ে নির্বাচনি বিজয়;বিজয়ের পর সে স্বায়ত্বশাসনের দাবীকে স্বাধীনতার দাবীতে পরিণত করা।নির্বাচনি বিজয়ের পর দাবী তোলা,স্বাধীনতার দাবীটিই পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের রায়।এটিই ছিল মুজিবের সত্তরের নির্বাচনী কৌশল এবং নির্বাচন পরবর্তী রোডম্যাপ –যা থেকে মুজিব কখনোই বিচ্যুত হননি।মুজিবের সে রোডম্যাপের প্রতি পূর্ণ সমর্থণ দিয়েছে ভারত।

ষাটের দশরেক মাঝামাঝিতে যখন ছয় দফা পেশ করা হয় তখন বলা হয়,এটি হলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের দাবী।কিন্তু শেখ মুজিব নিজ অনুসারিদের সাথে গোপন বৈঠকে বলতেন ভিন্ন কথা।তিনি বলতেন,৬ দফা হলো এক দফা তথা স্বাধীনতার পথে পাড়ী দেয়ার সিঁড়ি।-(আব্দুর রাজ্জাক;১৯৮৭)।৬ দফা পেশের এক দশক আগে ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব বেইজিং যান বিশ্বশান্তি কনফারেন্সে যোগ দিতে।সেখানে পশ্চিম বাংলার বামপন্থী লেখক মানুজ বসুর সাথে তার দেখা হয়। মানুজ বসু এক প্রবন্ধে লেখেন,শেখ মুজিব তার সাথে পূর্ব বাংলার বিচ্ছিন্নতার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি ১৯৭২ সালে ঢাকা আসেন এবং মুজিবের সাথে সাক্ষাত করেন। মুজিব তাকে ধন্যবাদ জানান পরিকল্পনাটি গোপন রাখার জন্য।-(মানুজ বসু,১৯৭৭)।ফলে পাকিস্তান ভাঙ্গার বিষয়টি একাত্তরের বিষয় নয়,মুজিবের মাথায় সেটি ছিল পঞ্চাশের দশক থেকেই।ক্যান্সারের বীজ যেমন দেহের গভীরে গোপনে বেড়ে উঠে,মুজিবও তেমনি বেড়ে উঠেছেন পাকিস্তানের গভীরে। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব তো ক্যান্সারের বীজকে শুরুতেই সনাক্ত করা। মুজিব কি চাইতেন,সেটি জানা কোন কালেই কঠিন ছিল না। ফলে সে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি পাকিস্তান সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনেকেরই জানা ছিল।কিন্তু ইয়াহিয়া খান সেটি জানায় আগ্রহ দেখাননি।ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রী জি,ডব্লিও চৌধুরীর পরামর্শ ছিল,স্বায়ত্বশাসনকে প্রথমে সংজ্ঞায়ীত করে তার ভিত্তিতে রেফারেণ্ডাম করা হোক।কিন্তু ইয়াহিয়া সে পরামর্শও গ্রহণ করেননি।অথচ ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রীদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাপারে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন জি,ডব্লিও চৌধুরী। তিনি নিজে ছিলেন বাঙালী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সায়েন্সের শিক্ষক;রাজনীতি নিয়ে গবেষনাই তার পেশা ছিল। জি,ডব্লিও চৌধুরী র পরামর্শ মেনে নিলে মুজিব নির্বাচনী বিজয়ের পর রায় হাইজ্যাকের সুযোগ পেতেন না।

 

প্রস্তুতিহীন যুদ্ধ

একাত্তরে পাকিস্তান সরকারের আদৌ যে কোন যুদ্ধ প্রস্তুতি ছিল না -সেটি সুস্পষ্ট বোঝা যায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েনকৃত সৈন্য সংখ্যা থেকে।পুর্ব পাকিস্তানে তখন জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি।দেশটির সীমানা ছিল ৩ হাজার মাইলের অধীক।এর মধ্যে প্রায় ২৫০০ মাইল ছিল স্থল এবং প্রায় ৫০০ মাইল উপকূলীয়। ভারত যে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় এবং সে লক্ষে যুদ্ধ করতে চায় সেটি প্রকাশ পায় ১৯৬৮ সালে। অথচ তেমন একটি যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানের আদৌ কি কোন প্রস্তুতি ছিল? একাত্তরের ফেব্রেয়ারিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর মাত্র এক ডিভিশন (১৪তম ডিভিশন)।সৈন্যদের সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার।(খন্দকার,একে;২০১৪ এবং Williams, L.F. Rushbrook;1972)।বিমান বাহিনীতে ছিল এক স্কোয়ার্ডন যুদ্ধ বিমান এবং মাত্র ১ হাজার ২ শত সদস্য যার অর্ধেকের বেশী ছিল বাঙালী।-(খন্দকার,একে;২০১৪)।মার্চে দ্রুত সৈন্য আনা শুরু হয়। কিন্তু এরপরও ৯ মাসের যুদ্ধকালীন সময়ে সর্বমোট নিয়মিত সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪ হাজার। তার সাথে ছিল ১১ হাজার সিভিল অক্সিলারি ফোর্স -যাদের হাতে ছিল সেকেলে ৩০৩ রাইফেল।(Niazi, A.A.K;1998)। অথচ দুইশত বছরের বেশী কাল আগে ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাতে তার চেয়ে বেশী সৈন্য ছিল। ঘরের দরজা-জানালা খোলা রেখে নিদ্রা গেলে চুরির উদ্দেশ্যে রাস্তায় বের হয়নি এমন চোরও ঘরে ঢুকতে উৎসাহ পায়।শত্রুর হামলা থেকে বাঁচার সফল উপায় হলো,নিজেদের ব্যাপক যুদ্ধ-প্রস্তুতি।পাকিস্তানী সেনবাহিনীর যুদ্ধের অপ্রস্তুতি ও বেহাল অবস্থা ভারতীয় গুপ্তচরদের কাছে অজানা ছিল না। পাকিস্তানের সে অপ্রস্তুত অবস্থাই ভারতকে যুদ্ধ শুরুতে উৎসাহী করে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য এটি ছিল চরমতম নাজুক অবস্থা।কাশ্মীরে ভারতীয় প্রস্তুতিটির তূলনায় পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রস্তুতিটি ছিল অতি নগন্য। কাশ্মীরের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ।সেখানে রয়েছে ভারতীয় সেনা বাহিনীর ৬ লাখের বেশী সৈন্য।কোন কোন সূত্র মতে ৭ লাখ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মাত্র ৩৪ হাজার সৈন্য এবং এক স্কোয়ার্ডন বিমানই বলে দেয়,যুদ্ধের জন্য দেশটি কতটা অপ্রস্তুত ছিল।মুজিব ও তার সমর্থকদেরও কাছে পাকিস্তানের সে নাজুক অবস্থাটি অজানা ছিল না। মুজিবের আত্মবিশ্বাস ছিল,পাকিস্তান আর্মির সাথে যদি যুদ্ধ শুরু হয়,তাতে বিদ্রোহীরা সহজেই মুষ্টিমেয় পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর বিজয়ী হবে।প্রয়োজনে ভারত যে সর্বাত্মক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসবে তাতেও মুজিবের সন্দেহ ছিল না।তেমন ভারতীয় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি শেখ মুজিব ষাটের দশকেই পেয়েছিলেন।ফলে পাকিস্তানের নাজুক অবস্থা থেকে ফায়দা নিতে মুজিবের আগ্রহ ছিল একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে। তেমন একটি ত্বরিৎ যুদ্ধের আহবান জানিয়ে শেখ মুজিব ৭ই মার্চের ভাষনে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেন,হাতের কাছে যা আছে তা নিয়ে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে।নির্দেশ দেন,পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যদের ভাতে ও পানিতে মারতে।নির্দেশ দেন,ঘরে ঘরে দুর্গ গড়তে।৭ই মার্চের পূর্ব থেকেই চলছিল ছাত্রলীগ,যুবলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের সামরিক প্রশিক্ষণ।পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আনা হচ্ছে জানতে পেরে শেখ মুজিব ঢাকাস্থ্ ভারতীয় ডিপুটি হাই কমিশনের কে সি সেনগুপ্তার কাছে ক্যাপ্টেন সুজাত আলী নামক এক ব্যক্তির মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে ভারতকে সৈন্য সমাবেশ করার জন্য অনুরোধ করেন -যাতে পাকিস্তানে সেখান থেকে সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে আনতে না পারে।-(Raghavan, S; 2013)।তবে ভারতের কাছে মুজিবের এরূপ পরামর্শ দেয়াটি ছিল নিতান্তই অহেতুক। পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে এমন একটি যুদ্ধ ভারত নিজ খরচে লড়ার জন্য ১৯৪৭ সাল থেকেই প্রস্তুত ছিল।এ লক্ষ্যে বরং মুজিবই চলছিল ভারতীয়দের গোয়েন্দাদের পরামর্শে।তাই মুজিবের সাহায্য চাওয়ার আগেই পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য সমাবেশ রুখতে ভারত বন্ধ করে দিয়েছিল তার আকাশের উপর দিয়ে পাকিস্তানী বিমানের চলাচল।পাকিস্তানের যাত্রী বাহিনী বিমানকে তখন দীর্ঘ পথ ঘুরে শ্রীলংকার উপর দিয়ে আসতে হতো।পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাকে জায়েজ করতে ১৯৭১’য়ের ফেব্রেয়ারি মাসে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’য়ের এজেন্টগণ কাশ্মীর থেকে গঙ্গা নামক একটি সাঁজানো বিমান ছিনতাইয়ের নাটক মঞ্চস্থ করে।র’য়ের সে কাণ্ডটি পরে ফাঁস হয়।

 

অসত্য অভিযোগ

আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও নেতাকর্মীদের অভিযোগ,পাকিস্তান সরকার সত্তরের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়নি।বলা হয়,তারা বাঙালীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষপাতী ছিল না।-(একে খন্দকার,২০১৪)।এ অভিযোগটি যে ডাহা মিথ্যা -তার প্রমাণ বহু।সে অভিযোগটি সত্য হলে,বাঙালীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দীর্ঘকালীন যুদ্ধ অনিবার্য ছিল।কারণ যুদ্ধ ছাড়া সেটি কীরূপে সম্ভব ছিল? কিন্তু কোথায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সে যুদ্ধ-প্রস্তুতি? সেটি কি মাত্র এক ডিভিশন সৈন্য এবং এক স্কোয়ার্ডন বিমান নিয়ে? সাড়ে ৭ কোটি বাঙালীর বিরুদ্ধে ১৪ হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ? সেটি কি কোন সুস্থ মানুষ ভাবতে পারে? তাছাড়া একটি দীর্ঘ যুদ্ধের প্রস্তুতি কি রাতারাতি নেয়া যায়? যুদ্ধের পরিকল্পনা থাকলে সৈন্য সমাবেশ শুরু হতো অন্ততঃ কয়েক বছর আগে থেকেই।তখন দেখা যেত বিশ্বের নানা দেশ থেকে অস্ত্র কেনার দৌড়াদৌড়ি।কিন্তু পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে তেমন উদ্যোগ নজরে পড়ে না।বরং তেমন তৎপরতা নজরে পড়ে ভারতের পক্ষ থেকে।ভারত সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে দ্বি-পক্ষীয় সামরিক চুক্তি স্থাপন করে।পাকিস্তান যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে আলাপ-আলোচনা ভেঙ্গে যাওয়ার পর।কারণ পাকিস্তান সরকার জানতো আওয়ামী লীগের সাথে সংঘাতে নামার অর্থই হলো,ভারতের সাথে সরাসরি যু্দ্ধে নামা।ফলে এরূপ সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে তা ছিল পরাজয়ের পথে দ্রুত ধাবিত হওয়া।

তবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পক্ষ থেকে যুদ্ধ শুরুর বহু আগেই আওয়ামী লীগের ক্যাডারগণ যুদ্ধ শুরু করে।সে জন্য তারা শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের বক্তৃতার অপেক্ষা করিনি।১লা মার্চ ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অনুষ্টিতব্য বৈঠক মুলতবির করার সাথে সাথে অবাঙালীদের উপর হামলা শুরু হয়।সেনানীবাস গুলোতে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়।সেনাবাহিনীর গাড়ি যাতে জ্বালানী না পায় সে জন্য স্থানে স্থানে সড়ক অবরোধ বা সড়ক কেটে দেয়া শুরু হয়।-(একে খন্দকার,২০১৪)।অবাঙালীদের ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ হয়ে যায়,তাদের হাটে-বাজারে বের হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়।নিরাপত্তার অভাবে যেসব অবাঙালীগণ পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তান যাওয়ার উদ্যোগ নেয়,বিমান বন্দরের যাওয়ার পথে তাদের থেকে অর্থ,গহনা ও মূল্যবান সামগ্রী কেড়ে নেয়া শুরু হয়।-(একে খন্দকার,২০১৪)।রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন বিচ্ছিন্নতার সুর।সেটিকে বলবান করতে ঢাকা শহরে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা।সে পতাকা নিজ গাড়িতে টানিয়ে শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সাথে বৈঠকে যোগ দিয়েছেন।প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে যখন শেখ মুজিবের বৈঠক চলছিল তখন কলকাতায় অস্ত্র সংগ্রহে পাঠানো হয় ডা.আবু হেনা নামক আওয়ামী লীগ দলীয় প্রাদেশিক পরিষদের এক সদস্যকে।-(সাপ্তাহিক মেঘনা,১৮ই মার্চ,১৯৮৭)।৭ই মার্চ শেখ মুজিবের ভাষনের পর প্রশাসন চলতো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হুকুমে।অসহযোগিতা শুরু হয় কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে।শেখ মুজিব জনগণকে রাজস্ব না দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন।কবে অফিস বন্ধ থাকবে,কবে কর্মচারিদের বেতন দেয়া হবে -সে হুকুমও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেয়া শুরু হয়।একাত্তরের ২৫ মার্চের মধ্যে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের দখলে চলে যায়।অবস্থা এতোটাই সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় যে,ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট,ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনীর সৈন্য ও অফিসারদের সাথে বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনিক কর্মচারি,থানার পুলিশ,কোর্টের বিচারপতিগণ এবং বিভিন্ন পেশার শান্তিপ্রিয় নাগরিকগণও পাকিস্তান সরকারের প্রতি আস্তা হারিয়ে ফেলে এবং অধিকাংশই অবাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।এমন কি ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি গভর্নরের শপথ বাক্য পাঠ করাতেও ভয় পায়।এমনকি যারা মুসলিম লীগ,জামায়াতে ইসলামী,নেজামে ইসলামী,পিডিপি ও অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী তারাও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে যে,পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অধিকৃতি থেকে আবার কখনো মুক্তি পাবে।এমন একটি অবস্থার মধ্যেও ইয়াহিয়া খান একটি রাজনৈতিক মীমাংসার চেষ্টা করছিলেন।তারা সামরিক বাহিনীকে কোনরূপ কড়া এ্যাকশনে যাওয়ার বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছিল।ফলে সমগ্র প্রদেশ বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়।আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হাতে বেশ কিছু সেনা অফিসার এবং বহু অবাঙালী নিহত হয়।অবশেষে আলাচনা পুরাপুরি ব্যর্থ হওয়ার পর সামরিক এ্যাকশন শুরু হয় ২৫ মার্চের রাতে।তখন থেকে ৯ মাস ব্যাপী যুদ্ধের শুরু।

দেশে নির্বাচন,নির্বাচন শেষে শাসনতন্ত্র প্রণোয়ন,তারপর ক্ষমতা হস্তান্তর –এরূপ একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিল ইয়াহিয়া সরকার। কিন্তু আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় সবই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। যুদ্ধের প্রস্তুতি ছাড়াই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়।পাকিস্তান সরকারের জন্য এটি ছিল অত্যন্ত নাজুক অবস্থা। সকল জেলা,মহকুমা ও থানা শহর মার্চের মধ্যেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতে চয়ে যায়।পাকিস্তান বেঁচে থাকে স্রেফ ক্যান্টনমেন্টগুলোর মধ্যে।২৩শে মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। ১৯৪০ সালের এই দিনে লাহোরের মিন্টো পার্কে মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় সম্মেলনে শেরে বাংলা ফজলুল হক স্বাধীন পাকিস্তানের পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বছরের এ দিনটিতে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করাই রীতি।কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চে একমাত্র ক্যান্টনমেন্টগুলি ও গভর্নর হাউস ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়নি।

সেনানীবাসগুলি থেকে বেরিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আবার পুরা দেশ দখলে নিবে -সেটি এতোটা সহজ কাজ ছিল না।অনেকেই সেটি অসম্ভব মনে করতো।সেনা চলাচলের উপর স্থানে স্থানে ছিল প্রবল বাধা।কিন্তু সকল বাধা অতিক্রম করে এপ্রিলের মাঝামাঝিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আবার সমগ্র দেশ নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়।সেটি ছিল সেনাবাহিনী অতি অভাবনীয় সফলতা।তাতে অবাক হয়েছিল দেশী-বিদেশী সবাই। অতি অবাক বিস্ময় নিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনের ভারতী দূতকে বলেছিলেন,“I am afraid, we are very badly advised. All our experts in the Pentagon and elsewhere were dead sure that West Pakistan military forces could not overpower the people of East Bengal, but it seems they have done so. What option do we now have? We must be Machiavellian and accept what looks like a fait accompli – don’t you think? (Jha to Kaul, 1971). অনুবাদঃ “আমি বিব্রত, আমরা খুবই খারাপ পরামর্শ পেয়েছি। আমাদের পেন্টাগণের সকল বিশেষজ্ঞগণ এবং সে সাথে অন্যান্যরা নিশ্চিত ছিলাম যে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা বাহিনী পূর্ব বাংলার জনগণের উপর বিজয় লাভ করতে পারবে না।কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে তারা তো সেটি করে ফেলেছে।আমাদের সামনে এখন আর কি রাস্তা আছে? আমাদের অবশ্যই এখন ম্যাকিয়াভেলিয়ান হতে হবে;এবং যা ঘটেছে সেটিকে অপরিবর্তনযোগ্য বাস্তবতা রূপে মেনে নিতে হবে।আপনি কি মনে করেন?”

 

স্মায়ু যুদ্ধের জের

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধটি স্রেফ মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধ ছিল না।সেটি ছিল সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে। মাত্র ৩৪ হাজার সৈন্য (Niazi, A.A; 2001)এবং এক স্কোয়ার্ডন বিমান (একে খন্দকার;২০১৪) নিয়ে কি বিশাল ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করা যায়? বরং চলছিল অপমানজনক পরাজয়ের প্রস্তুতি।এখানেই ছিল ইয়াহিয়া খানের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।সে সাথে অপরাধও। জেনারেল নিয়াজীর ভাষায় যা ছিল “betrayal of East Pakistan”। তাছাড়া যুদ্ধে মুজিব একাকী ছিলেন না।মুজিবের পক্ষে ভারতও একাকী ছিল না।ভারতের পক্ষে ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার ন্যায় তৎকালীন এক বিশ্বযুদ্ধ।ভারত মহাসাগরে তখন সোভিয়েত রাশিয়ার ১৬টি যুদ্ধ জাহাজ –যার মধে ৫টি বা ৬টি ছিল সাবমেরিন।ছিল রাশিয়ার বিশাল নৌহর।বিশ্বে তখন স্মায়ু যুদ্ধের যুগ।সে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া –এ দুটি বিশ্বশক্তি একে অপরের বিরুদ্ধে একটি তীর না ছুড়লে কি হবে,তারা বদলা নেয় প্রতিপক্ষ শিবিরের দুর্বল রাষ্ট্রগুলির ঘর তছনছ করার মধ্য দিয়ে। সেন্টো ও সিয়াটো চুক্তিতে শামিল থাকার কারণে পাকিস্তান চিত্রিত হয় মার্কিন শিবিরের দেশ রূপে। স্মায়ু যুদ্ধের অংশ রুপেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিলি,পেরু,কলোম্বীয়ার ন্যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশে বামপন্থী সরকারগুলোর ঘর ভেঙ্গেছে। সোভিয়েত রাশিয়া এবং চীনও তেমনি কিউবা,ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশ থেকে মার্কিনপন্থী সরকারকে উৎখাত করেছে।একই কারণে একাত্তরের রাজনৈতিক সংকটটি পুর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন লাভ নিয়ে সীমিত থাকেনি। ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় অখণ্ড পকিস্তানের খণ্ডিতকরণ।সে সাথে মার্কিন বলয়ের একটি রাষ্ট্রকে পরাজিত করা।

 

পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাটি স্রেফ স্বায়ত্বশাসন বা ৬ দফা হলে তার সমাধানও সম্ভব হতো। ইয়াহিয়া ও ভূট্টো উভয়ই ৬ দফা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সমাধান হয়নি। পাকিস্তান তখন স্নায়ুযুদ্ধের উত্তপ্ত রণাঙ্গন।ভারতের কাছে স্বাধীন পাকিস্তানের অস্তিত্বই অসহ্য ছিল। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হওয়ায় দেশটির উপর সোভিয়েত রাশিয়ার আক্রোশও ছিল প্রচণ্ড। ফলে মুজিবের অভিলাষের সাথে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার লক্ষও একাকার হয়ে যায়। তাদের পক্ষ থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রতি পাওয়াতে ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনায় মুজিব এতোটা আপোষহীন ছিলেন যে,পাকিস্তান ভাঙ্গা ছাড়া কোনরূপ রাজনৈতিক মীমাংসায় মুজিবের সামান্যতম আগ্রহ ছিল না। তাছাড়া ভারতের সাথে সোভিয়েত রাশিয়ার সে সাহায্যের প্রতিশ্রুতিটি ফাঁকা ছিল না। সেটি বুঝা যায় যুদ্ধকালীন সময়ে। নইলে বিশাল সোভিয়েত নৌবহর কেন ভারত মহাসাগরে আসবে? অথচ পাকিস্তানের পক্ষে সেদিন কেউ আসেনি।পাকিস্তান ইসরাইল নয় যে মার্কিন শিবিরের দেশ রূপে পরিচিত হওয়ায় পাকিস্তানকে বাঁচাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধেয়ে আসবে। হিন্দুস্তান ও রাশিয়ার মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও আনন্দ তো একটি মুসলিম দেশকে ক্ষুদ্রতর করায়। ইরাক ও সিরিয়াতে তো সে লক্ষেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রাশিয়া একত্রে হাজার হাজার টন বোমা ফেলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *