সাফল্যের পথ এবং ব্যর্থতার পথ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

ব্যর্থ জীবন ও সফল জীবন

এ জীবনে সবাই সফল হতে চায়; এবং বাঁচতে চায় বিফল হওয়া থেকে। তাই এ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো কিসে সফলতা ও কিসে বিফলতা –সে বিষয়টি সঠিক ভাবে জানা। এখানে ভূল হলে এ জীবনের সমগ্র বাঁচাটাই ব্যর্থ হয়ে যায়। সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও জান-মালের সকল কুর’বানী তখন ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়। এবং সে ক্ষতিটি শুধু এ পার্থিক জীবনে নয়; বরং পরকালে তা অনন্ত কালের জন্য জাহান্নামের আগুনে হাজির করে। বিষয়টি তাই গুরুতর। পশুর জীবনে সফলত নিছক দৈহিক ভাবে বাঁচায়। এজন্যই পশুর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হলো পানাহারে হৃষ্টপুষ্ট হওয়া। পশুকে তাই দর্শন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, আইন ও পথচলায় সঠিক পথ তথা সিরাতুল মুস্তাকীম নিয়ে ভাবতে হয়না। রাষ্ট্র ও সভ্যতা নির্মাণ নিয়েও পশুকে তাই যুদ্ধ করতে হয় না। তাছাড়া পশুকে সে সামর্থ্য দেয়াও হয়নি।

কিন্তু মনুষ্য জীবনে পানাহারে বাঁচা ও বাঁচার জন্য ঘরবাঁধাই একমাত্র এজেন্ডা নয়। তাকে বাঁচতে হয় স্রষ্টার পক্ষ থেকে বেঁধে দেয়া এজেন্ডা নিয়ে। সে এজেন্ডাটি হলো জীবনের প্রতি পদে মহান আল্লাহতায়ালার পূর্ণ দাসত্বের। এখানে দাসত্বটি পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত শরিয়তী হুকুমের। মুসলিম জীবনে স্বেচ্ছাচারীতা তাই ভয়ানক অপরাধ। সেটি মহাশক্তিমান মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহটি যেমন পানাহার, পোষাক-পরিচ্ছদ, কর্ম ও রাজনীতির ক্ষেত্রে হতে পারে, তেমনি হতে পারে রাষ্ট্র নির্মাণ, দল গঠন, দলাদলী ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ক্ষেত্রেও হতে পারে। এরূপ বিদ্রোহ জীবনের পুরা বাঁচাটি ও বাঁচার লক্ষ্যে সাধিত সকল প্রচেষ্টাগুলিকে ব্যর্থ করে দেয় এবং বিদ্রোহীকে জাহন্নামের আগুনে পৌঁছায়। এবং সেটি মৃত্যুহীন এক জীবনের জন্য।

মানব জীবনের সফলতা ও বিফলতার বিচারটি করেন মহান আল্লাহতায়ালা। সে বিচারে হিসাবে আনা হয় তাঁর কুর’আনে ঘোষিত এজেন্ডা ও শরিয়তী হুকুম পালনে কে কতটা সফল বা বিফল হলো –তা থেকে। তাই পানাহার, পরিবার পালন ও গৃহনির্মাণের বাইরে প্রতিটি ব্যক্তিকে সঠিক ভাবে জানতে হয় মহান আল্লাহতায়ার এজেন্ডাকে; এবং জানতে হয় তাঁর প্রতিটি হুকুম ও শরিয়তী বিধানকে। এগুলি না জানলে সেগুলি সে পালন করবে কীরূপে? এ বিষয়গুলি জানা এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের আগে সে বিষয়গুলির উপর জ্ঞানার্জনকে ফরজ করা হয়েছে। বস্তুত ইসলামই একমাত্র ধর্ম -যা জ্ঞানলাভকে বাধ্যতামূলক ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছে। তবে মুসলিমের দায়িত্ব জ্ঞানলাভে শেষ হয় না, জ্ঞানলাভের সাথে ফরজ হলো আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা ও কুর’আনী হুকুমগুলির পালনে সর্ব সামর্থ্য দিয়ে আত্মনিয়োগ করা। মানব জীবনের ব্যর্থতার শুরুটি কখনোই কৃষি, শিল্প বা বাণিজ্যের অঙ্গণ থেকে হয় না, বরং সেটি হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা ও হুকুমের বিষয়ে জ্ঞানার্জনের ব্যর্থতা এবং সেগুলি পালনে ব্যর্থতা থেকে।

মানব জীবনের চুড়ান্ত সফলতাটি নির্ভর করে পরিপূর্ণ মুসলিম হওয়ার উপর। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার শাস্তি জাহান্নাম। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের মুসলিমগণ এক্ষেত্রে সফল কতটুকু? বাস্তবতা হলো, উন্নয়ন পরিমাপের যতগুলো মাপকাঠি আছে সেগুলির বিচারে বাংলাদেশ হলো দারুন ভাবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। এ ব্যর্থতা কোন একটি বিশেষ ক্ষেত্রে সীমিত নয়, বরং তা বিস্তৃত শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, আইন-আদালত, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ সর্বস্তর জুড়ে। গুম, খুন, ফাঁসি ও সন্ত্রাসের রাজনীতি, নির্বাচনে ভোটডাকাতি, ঋণনির্ভর অর্থনীতি, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ধর্ষণে সেঞ্চুরি, দুর্নীতিতে ৫ বার বিশ্ব-শিরোপা, বিধ্বস্ত শিক্ষাব্যবস্থা, ভেসে যাওয়া আইন-শঙ্খলা – সবকিছুই হলো এ ব্যর্থতার দলিল। ৭০ বছর পূর্বেও বাঙালি মুসলিমের অবস্থা এতোটা শোচনীয় ছিল না।

অথচ বাঙালি মুসলিমদের সামনে মুক্তির একটি নির্ভূল পথ ছিল। সেটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া রোড ম্যাপ তথা পবিত্র কুর’আন। এটিই বান্দাহর কল্যাণে মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। সমগ্র মানব ইতিহাসে এটিই হলো একমাত্র পরীক্ষিত সফল রোডম্যাপ। এ রোডম্যাপ অনুসরণ করেই মরুর নিঃস্ব ও বর্বর আরবগণ সবচেয়ে শক্তিশালী ও সভ্য বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং গড়ে তুলেছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।  কিন্তু বাঙালি মুসলিমগণ সে পরীক্ষিত কুর’আনের পথকে গ্রহণ করেনি। তারা বাঁচছে ইসলামে অজ্ঞতা ও অঙ্গীকারহীনতা নিয়ে। বেছে নিয়েছে পরীক্ষিত পরাজয়ের পথ। বাংলাদেশের আলেম তথা ধর্মীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতাও কি এক্ষেত্রে কম? বিশ্বের অন্য কোন দেশে এতো নামাজী নেই, এতো মসজিদ-মাদ্রাসাও নেই। নেই এতো মৌলানা ও মৌলভী। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো, শতকবার ৯০ ভাগ মুসলিমের এ দেশটির আদালতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নাই। অথচ শরিয়ত হলো সিরাতাল মুস্তাকীমের অপরিহার্য ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শরিয়ত না থাকার অর্থ সিরাতাল মুস্তাকীম না থাকা। তাই দেশের আদালতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা না দিয়ে সিরাতাল মুস্তাকীমে চলার কথা ভাবাই যায় না। এ বিষয়টি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে যাদের বিচার-আচারে শরিয়তের অনুসরণ নাই তাদেরকে পবিত্র কুর’আনের সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে কাফির , জালেম ও ফাসেক বলে আখ্যায়ীত করা হয়েছে। এমন মানুষেরা নামাজী, রোজাদার ও হাজী হতে পারে, কিন্তু তারা যে সিরাতাল মুস্তাকীমে নাই –তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? অথচ দেশের আইন-আদালতে শরিয়তের বিলুপ্তি মেনে নিয়েই বাঙালি মুসলিমের রাজনীতি, ধর্মকর্ম ও বেঁচে থাকা?

সভ্য মানুষ কোথাও বসতি গড়লে শুধু ঘরই গড়ে না, রাস্তাও গড়ে। রাস্তায় বাতি ও সিগনাল পোষ্টও স্থাপন করে। সে সিগনালগুলী পদে পদে মানতে হয়, নইলে পথ চলায় বিভ্রান্তি আসে, দূর্ঘটনায় প্রাণনাশও হয়। তেমনি জীবন চালনায় প্রতিটি ব্যক্তিকে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য, শ্লীল-অশ্লীল, কল্যাণ-অকল্যাণ -এরূপ হাজারো পথের মোহনায় প্রতিনিয়ত দাঁড়াতে হয়। কোন দিকে যেতে হবে -সে পথটি নিজে আবিস্কার করতে গেলেই মহাবিপদ। কারণ সে সামর্থ্য দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়নি। এমনকি নবী-রাসূলদেরও নয়। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনের সুরা লাইলের ১২ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “ইন্না আলায়না লাল হুদা” অর্থাৎ নিশ্চয়ই পথ দেখানোর দায়িত্ব আমার। মানুষকে যে সামর্থ্য দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে -সেটি হলো প্রদর্শিত সে পথের পূর্ণ অনুসরণের। পবিত্র কুর’আনে প্রদর্শিত এ পথটির ইসলামী পরিভাষা হলো শরিয়ত। কতটা সে পথের অনুসরণ করা হলো এবং কতটা অবাধ্যতা করা হলো -সে হিসাব পরকালে প্রতিটি নর-নারীকে দিতেই হবে। একমাত্র এ পথটিই  হলো জান্নাতে পৌঁছার পথ। ফলে যারা এ পথে নাই, বুঝতে হবে তারা চলছে জাহান্নামের পথে। এবং পৃথিবী পৃষ্ঠে সবচেয়ে কল্যাণকর নেক আমলটি হলো মানুষকে জান্নাতের পথ দেখানো ও সে পথে নেয়া। এটিই ছিল সর্বকালে নবী-রাসূলদের কাজ।

 ইসলামী রাষ্ট্রনির্মাণ: সর্বশ্রেষ্ঠ নেককর্ম

পৃথিবীপৃষ্ঠে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটি হলো রাষ্ট্র। যে কোন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ন্যায় রাষ্ট্রেরও লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও এজেন্ডা থাকে। রাষ্ট্রের জীবনেও উত্থান, পতন ও ধ্বংস আছে। একটি বিশাল বাহনের ন্যায় রাষ্ট্র জনগণকে দুটি গন্তব্যস্থলের একটিতে নিতে পারে: হয় জান্নাতে, অথবা জাহান্নামে। তৃতীয় কোন গন্তব্যস্থল নাই। লক্ষভেদে রাষ্ট্র ইসলামী হতে পারে, অনৈসলামীও হতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানতম দায়িত্বটি রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা কলকারখানা গড়া নয়, বরং সেটি হলো রাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিকদের জান্নাতের যোগ্য রূপে তোলা। রাষ্ট্ররূপী বিশাল জাহাজটি তখন জান্নাতের বাহনে পরিণত হয়। কাউকে হাজার কোটি টাকার দেয়ায় এমন কল্যাণ নাই। রাষ্ট্র সে কাজটি একমাত্র তখনই করতে যখন সে রাষ্ট্রে ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়। সে রাষ্ট্রের রাজনীতি, প্রশাসন ও আদালতের মূল মিশন হয় অন্যায়ের নির্মূল ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা দেয়া। সে জন্য  অপরিহার্য হলো, রাষ্ট্রের বুকে শরিয়তের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা দেয়া। এমন রাষ্ট্রকেই ইসলামী রাষ্ট্র বলা হয় –যার প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন খোদ মহান নবীজী (সা:)। কোন রাষ্ট্রকে ইসলামী করার জিহাদ না হলে সেটি অনৈসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং সেটি জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার বাহন হয়। মক্কায় ১৩ বছর বসবাস কালে নবীজী (সা:)’র পক্ষে তেমন একটি ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ সম্ভব হয়নি। কিন্তু মদিনায় হিজরতের পর প্রথম দিন থেকেই তেমন একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেন। এবং ১০ বছর যাবত সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। আজও সর্ব কালের এবং সকল দেশের প্রতিটি মুসলিমদের জন্যই এটিই হলো নবীজী (সা:)’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত। নবীজী (সা:)’র সূন্নত অসংখ্য। তবে মুসলিমগণ সমগ্র মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার প্রতিষ্ঠা দিতে সফল হয়েছিলেন নবীজী (সা:)’র এই সূন্নতটি অনুসরণ করার কারণে। তাতে সম্ভব হয়েছিল মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে তাঁর নিজের জমিনে বিজয়ী করার এবং মুসলিমদের বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে উঠার।

রাষ্ট্র তো বিশ্বের বহু জাতিই গড়ে। বহু নৃশংস দুর্বৃত্তও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, পিতা ও নেতা হয়। কিন্তু মুসলিমগণ রাষ্ট্র গড়লে সে রাষ্ট্রে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা দেয়া হবে এবং সেটিকে জান্নাতে পৌঁছার বাহন রূপে গড়ে তোলা হবে -সেটিই তো কাঙ্খিত ও স্বাভাবিক। তাতেই তো ঈমানের প্রকাশ। কিন্তু সেটি না হলে বুঝতে হবে নবীজীর সূন্নত পালিত হয়নি। আরো বুঝতে হবে, মহান নবীজী (সা:) যে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছেন -সে ইসলামের বাস্তবায়ন হয়নি। তখন প্রকাশ পায়, মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র এজেন্ডার সাথে মুসলিমদের গাদ্দারী। তখন রাষ্ট্র অধিকৃত হয় শয়তানী শক্তির হাতে। তাই একটি দেশের জনগণ ও শাসকগণ মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র এজেন্ডা নিয়ে বাস করে, না শয়তানের এজেন্ডা নিয়ে বাস করে –সেটি সুস্পষ্ট টের পাওয়া যায় রাষ্ট্রের রাজনীতিতে অন্যায়ের নির্মূল ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং আদালতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা আছে কি নাই -সেটি দেখে। 

ইসলামী রাষ্ট্র গড়া এবং সেখান শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজটি কোন নিছক কোন দল বা নেতার দায়িত্ব নয়। প্রতিটি মুসলিমকে যেমন নিজের নামাজ-রোজা নিজে পালন করতে হয়, তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে নিজের শ্রম, নিজের অর্থ, নিজের মেধা ও নিজের রক্তের বিনিয়োগও করতে  হয়। একাজ প্রত্যেকের। নবীজী (সা:)’র যুগে এমন কোন সাহাবী ছিলেন না যিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজে জিহাদ করেননি। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সেটিকে প্রতিরক্ষা দেয়ার কাজে প্রায় ৬০ ভাগের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। কোন ব্যক্তি বা দলকে বিজয়ী করার মধ্যে আখোরাতে কোন কল্যাণ নেই। কল্যাণ তো ইসলামী রাষ্ট্র ও সে রাষ্ট্রে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার কাজে কতটা বিনিয়োগ হলো নিজ মেধা, নিজ অর্থ, নিজ শ্রম ও নিজ রক্তের -তার উপর। ঈমানদার তো এমন বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে নিজেকে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মাগফিরাত-লাভ ও জান্নাত-লাভের উপযোগী করে। একমাত্র এ পথেই একজন ব্যক্তি যেমন পূর্ণ ঈমানদার রূপে বেড়ে উঠে, তেমনি নির্মিত হয় সভ্যতর রাষ্ট্র ও সমাজ। এবং এভাবেই মুসলিমদের গড়া রাষ্ট্র জান্নাতে পৌঁছার বাহনে পরিণত হয়।

এজন্যই মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নেক কর্মটি রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা বা হাসপাতাল নির্মাণ নয়, বরং সেটি হলো ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ। এমন একটি রাষ্ট্র নির্মিত হলে সে রাষ্ট্রে উচ্চতর সভ্যতাও নির্মিত হয়।  রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা বা হাসপাতালের কল্যাণ অনেক; কিন্তু সেগুলি জান্নাতে নেয় না। কিন্তু  ইসলামী রাষ্ট্র নেয়। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্রের মিশন তো অন্যায়ের নির্মূল ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা দেয়া। এবং রাষ্ট্রের কাজ হয়, এ পবিত্র মিশনের সাথে জনগণকে সংশ্লিষ্ট করা এবং জীবনের প্রতি পদে সিরাতাল মুস্তাকীম দেখিয়ে এবং সে পথে টেনে জনগণকে জান্নাতে নেয়া। তাছাড়া মাথা টানলে যেমন চোখ, কান ও নাকও আসে, তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ করলে, আইনের শাসন, উন্নত প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ন্যায় সকল কল্যাণকর্মেরও জোয়ার সৃষ্টি হয়। পবিত্র কুর’আন যেমন মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত, তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র হলো মানুষের গড়া সর্বশ্রেষ্ঠ নেককর্ম। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা বা হাসপাতাল তো কাফির, জালেম, ফাসেক শাসকগণও গড়ে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র গড়া এবং জনগণকে জান্নাতের পথ দেখানোর সামর্থ্য সে দুর্বৃত্তদের থাকে না।

ইসলামী রাষ্ট্র নামাজ-রোজা ও দোয়া-দরুদের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পায় না। পৃথিবীর প্রতিখন্ড ভূমি কোন না কোন পক্ষ, গোত্র বা শাসকের হাতে অধিকৃত। ইসলামী রাষ্ট্র গড়তে হলে জরুরি হলো সে অধিকৃতি থেকে মুক্তি লাভ। সে মুক্তির লড়াইয়ে জান ও মালের বিনিয়োগ হলো জিহাদ। তেমন একটি রাষ্ট্র গড়তেই হযরত মূসা (আ:)কে অধিকৃত কানানে (আজকের ফিলিস্তিন) গিয়ে সে ভূমি মুক্তি করে সেখানে তাওরাতে ঘোষিত শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দিতে বলা হয়েছিল। বনি ইসরাইলের লোকেরা সেদিন আল্লাহতায়ালার সে হুকুমের সাথে গাদ্দারী করেছিল। নইলে সেদিন খেলাফর প্রতিষ্ঠা পেত। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ তো মদিনার বুকে সেটিই করেছেন। কথা হলো, ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার ন্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ এই নেক কর্মটি সফল করার লক্ষ্যে মুসলিম দেশের নাগরিকদের মাঝে জিহাদ থাকবে না -সেটি কি ভাবা যায়? অথচ কি বিস্ময়! বাংলাদেশের ন্যায় শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশে এ লক্ষ্যে কোন জিহাদ নাই। তবে ইসলামী দল ও আলেম সমাজের মাঝে ইসলামের নামে কিছু রাজনৈতিক দল ও আন্দোলন আছে। অথচ দল বা আন্দোলন কোন ইসলামী বা কুর’আনী পরিভাষা নয়। এটি সেক্যুলার রাজনীতির বিষয়। এতে থাকে দলীয় রাজনৈতিক এজেন্ডাকর বিজয়ী করার কথা। এরূপ আন্দোলন যেমন নবীজী (সা:)’র সূন্নত নয়, তেমনি জিহাদও নয়। মুসলিমকে অবিরাম জিহাদ নিয়ে বাঁচতে হয়, আন্দোলন নিয়ে নয়। আন্দোলনে মরলে কেউ শহীদ হয়না। শহীদ হতে হলে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে জিহাদে নিহত হতে হয়।

বাংলাদেশে আন্দোলনের নামে বহু আন্দোলন অতীতে বহুবার হয়েছে। তাতে বহু মানুষের রক্তও ঝরেছে। সরকারও পরিবর্তিত হয়েছে। নুতন দল ক্ষমতায় এসেছে। অথচ যে মহান কাজটি সামনে এগোয়নি সেটি হলো ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা সেসব আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল না। এজন্যই ১৭ কোটি মুসলিমের দেশে যে আইনের ভিত্তিতে বিচার ফয়সালা হয় -তা কাফিরদের রচিত। বাংলার মুসলিম ভূমিতে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্বের কোন স্বীকৃতি নাই এবং আদালতে তাঁর শরিয়তী আইনেরও কোন স্থান নাই। নিজ রাষ্ট্রের বুকে মহান আল্লাহতায়ালার কুর’আনী আইনের এরূপ অবমাননা দেখে যার অন্তরে শরিষার দানা পরিমান ঈমান আছে -সে কি শান্তিতে ঘুমুতে পারে? অথচ বাংলাদেশের মুসলিমগণ মসজিদ-মাদ্রাসা এবং নামাজী-রোজাদারদের সংখ্যা নিয়েই খুশি। মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তাঁর শরিয়তী আইনের বিলুপ্তি নিয়ে তাদের চিত্তে কোন দাহন নাই। বরং ধুমধামে চলছে  তাদের প্রতিদিনের কায়-কারবার! এবং ভাবে, তারা মহান নবীজী (সা:)’র উম্মত। প্রশ্ন হলো, নিজ দেশে নবীজী (সা:)’র সূন্নতকে পদদলিত করে এবং শয়তানের বিজয় বাড়িয়ে কি নবীজী (সা:)’র উম্মত হওয়া যায়?  

 পাপের উৎসব মুসলিম ভূমিতে

শুধু খাদ্য ও পানীয় সামগ্রী হালাল হলেই চলে না। হালাল হতে হয় শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, অর্থনীতি, আইন-আদালত ও পোষাক-পরিচছদও। কিন্তু সে হালাল বিষয়গুলিতে আগ্রহ ক’জনের? ফলে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ঢুকেছে হারাম পৌত্তলিকতা ও অসভ্য অশ্লীলতার তান্ডব। শত শত মূর্তি স্থাপিত হচ্ছে রাজপথে। নগরে বন্দরে গড়ে উঠেছে হাজারো পতিতাপল্লী। পতিতারা উপচে পড়ছে শহরের পার্কে, রাজপথে এবং নদীতে ভাসা নৌকাগুলিতে। এমনকি আবাসিক মহল্লাতেও। ইসলামে যে অপরাধের শাস্তি প্রানদন্ড, সে অপরাধ উল্লাস ভরে হয় শহরের প্রাণকেন্দ্রের পতিতাপল্লী গুলিতে। এ জঘন্য অপরাধও দেশের আইনে সিদ্ধ ব্যাবসা রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তাজ্জবের বিষয়, এসব প্রকাশ্য পাপাচারের বিরুদ্ধে দেশের আলেম ও ইসলামী জনতার পক্ষ থেকে কোন প্রতিবাদ-প্রতিরোধ নাই, জিহাদও নাই। বরং তাদের কাজ হয়েছে ট্যাক্সের পয়সায় পুলিশ নিয়োগ করে এ জঘন্য পাপাচারের দিবারাত্র প্রতিরক্ষা দেয়া। এ পাপাচারের নির্মূলে বিক্ষোভ করে কোন আলেম বা মুছল্লী মার খেয়েছেন বা কারারুদ্ধ হয়েছেন -সে ইতিহাসও নেই। অথচ মুসলিম জীবনের মূল মিশনটি হলো, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও দুর্বৃত্তির নির্মূল। অতীতের ন্যায় এখনো দেশে প্রচুর আন্দোলন হয়। এমনকি অতিশয় তুচ্ছ বিষয়েও হরতাল হয়। অথচ পবিত্র জিহাদ নাই শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিয়ে। এ ক্ষেত্রে গাদ্দারী হচ্ছে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে। ইসলামে বড় পাপ হলো উম্মাহর মাঝে অনৈক্য গড়া এবং মুসলিম ভূগোলে বিভক্তি গড়া। এ পাপও কি বাংলাদেশে কম হচ্ছে? অথচ এ পাপ ভয়ানক আযাব নামিয়ে আনে। সে পাপের প্রসার বাড়ানো হচ্ছে দল, নেতা, ফেরকা, গোত্র, অঞ্চল ও ভাষার নামে। এ পাপের পথে নেমে কি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেয়া যায়? অথচ এ পাপকর্ম নিয়ে আলেমদের মাঝেও কোন দুঃখবোধ নাই। বরং নিজেরাও সে বিভক্তির সাথে জড়িত। অপর দিকে বিভিন্ন জাতীয় রাষ্ট্র ও দলের নামে উম্মাহর বিভক্তিকে অহংকার ও উৎসবের বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে।

অথচ একজন মুসলিমের রাজনীতির মূল এজেন্ডা হতে হয় শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। যে রাজনীতি সে মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে সহায়তাই দেয় না, সে রাজনীতে কি কোন মুসলিম জড়িত হতে পারে? এ কাজ তো শতভাগ হারাম। অথচ পরিতাপের বিষয়, শরিয়ত প্রতিষ্ঠার নাম মুখে আনতে রাজী নয় এমন নেতাকেও বাংলাদেশে ভোট দিয়ে, অর্থ দিয়ে ও শ্রম দিয়ে বিজয়ী করা হয়। এভাবেই তো মুসলিমের শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় হচ্ছে ইসলামের পরাজয়ে ও শয়তানী এজেন্ডাকে বিজয়ী করার কাজে। দেশে মসজিদ-মাদ্রাসা বাড়ছে। কিন্তু মসজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য কি?  শুধু নামাজ-রোজা এবং ধর্মশিক্ষার মাঝে ধর্মকর্ম সীমিত হলে রাষ্ট্রীয় জীবনের ইসলামের প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব? প্রতিটি ধর্ম বা মতবাদই সমাজে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান চায়। প্রতিষ্ঠান চায় এমনকি পাপীষ্ঠরাও। পতিতাপল্লী, মদের দোকান, জুয়ার ক্যাসিনো, যাত্রা ও নাচের ক্লাব, সূদী ব্যাংক, সেক্যুলার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় –এসব তো তাদেরই প্রতিষ্ঠান। নির্জন কুঠিরে, বনে জঙ্গলে বা তাঁবুতে ইসলামী সমাজ বেড়ে উঠে না। এজন্য দুর্বৃত্তমুক্ত দল চাই, ইসলামী পরিবার চাই, মসজিদ চাই, পাপমুক্ত সমাজ চাই, ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র চাই এবং সে সাথে পরিপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্রও চাই। এগুলোর কোন একটি সঠিক ভাবে কাজ না করলে সে সমাজে মুসলিম সন্তানের পক্ষে প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাই ব্যাহত হয়। আর যে ব্যক্তি মুসলিম রূপে বেড়ে উঠতে ব্যর্থ হয় তার জন্য সহজ হয় শয়তানের সৈনিক হওয়া।

 অনৈসলামী রাষ্ট্র: পথভ্রষ্টতার দলিল

ইঞ্জিনের হাজারো যন্ত্রের মাঝে একটি ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ যদি যথাস্থানে না থাকে, উড়োজাহাজ উড়তে পারে না। তেমনি অবস্থা ইসলামেরও। পরিবার, সমাজ, মসজিদ, শিক্ষালয়, আইন-আদালত, প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, হাটবাজার, রাষ্ট্র – এ সবগুলীই হলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সমাজ পরিবর্তন ও ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে এগুলোর রয়েছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ব্যক্তি ও সমষ্ঠির জীবনে ইসলামের প্রতিষ্ঠা পূর্ণাঙ্গতর করার ক্ষেত্রে এ সব প্রতিষ্ঠানগুলির সক্রিয় ভূমিকা শুধু প্রয়োজনীয়ই নয়, অপরিহার্যও। আর রাষ্ট্র তো  ইঞ্জিন। আর এ ইঞ্জিনকে পথ দেখায় মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া রোডম্যাপ তথা শরিয়ত। ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে কোন পথে চলতে হবে শরিয়ত সেটিরই সিগনাল দেয়। যে সমাজে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নেই, সে সমাজে সত্য ও ন্যায়ের দিকে দিক-নির্দেশনাও নেই। তখন মানুষ ধাবিত হয় পাপচার, জুলুম ও কুফরির দিকে। এজন্যই মুসলিম যেখানেই ঘর বাঁধে সেখানে শরিয়তেরও প্রতিষ্ঠা দেয়। সে লক্ষ্যে ইসলামী রাষ্ট্রও গড়ে। মদিনায় হিজরতের পর নবীজী (সা:) এ কাজটিই প্রথমে করেছিলেন।

কিন্তু বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলোতে সে কাজটিই হয়নি। ফলে লক্ষ লক্ষ মুসলিম নির্বিচারে সূদ খাচেছ, ঘুষ খাচেছ এবং যুবকেরা ঢুকছে অশ্লীল নাচ-গানের আসরে, এমনকি বেশ্যালয়েও। সিনেমা হলে বসে অগণিত মানুষ আনন্দ ভরে উলঙ্গতা দেখছে। নামাজী জনগণও ট্যাক্সের পয়সা জুগিয়ে পতিতাপল্লীতে পুলিশ বসিয়ে পাহারাদারীর ব্যবস্থা করছে। যেসব নেতারা এমন পাহারাদারীর ব্যবস্থা করে, তাদেরকেই জনগণ গায়ে-গতরে খেটে নির্বাচিত করে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মূর্তি গড়ার খরচও তারা জোগাচেছ। আদালেত কুফরি আইনের ফয়সালাও এরা মাথা পেতে মেনে নেয়। ইসলাম থেকে বিচ্যুতির এর চেয়ে বড় দলিল আর কি হতে পারে? এটি তো ভয়ংকর পাপ এবং নিশ্চিত জাহান্নামের পথ। নিছক মসজিদ গড়ে, নামাজ পড়ে, প্রতি বছর রমযানে রোজা রেখে, বার বার হজ্জ ও উমরাহ পালন করে কি এ পাপের সাজা থেকে মূক্তি মিলবে?

 হেতু কী?            

মুসলিমদের এহেন বিচ্যুতির কারণ বহুবিধ। তবে মূল কারণ হলো, কুর’আনী জ্ঞানের বিলুপ্তি ও ইসলামী প্রতিষ্ঠান সমূহের বিনাশ। ধর্মীয় চেতনার মূলোৎপাটনে এটিই শত্রুর মূল স্ট্রাটেজী। ইসলামের পরিচর্যা দেয় যেসব প্রতিষ্ঠান, সেগুলির ধ্বংস করে শত্রু পক্ষ জন্ম দিয়েছে ইসলাম-নাশক অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের। মুসলিম দেশগুলি দখলে নেয়ার পর বৃটিশ শাসকেরা সর্বপ্রথম সেটিই করেছিল। ইসলামের প্রতিষ্ঠানগুলি বিলুপ্ত হলে অবস্থা কতটা ভয়ানক হয় তারই উজ্বল দৃষ্টান্ত হলো বসনিয়া, কসোভো এবং সোভিয়েত রাশিয়ায় বসবাসকারি মুসলিমগণ। তারা সংযোগ হারিয়েছে ইসলামে সাথে। এককালে দাস হিসাবে আফ্রিকা থেকে যে অসংখ্য মুসলিমদের বলপূর্বক আমেরিকায় নেওয়া হয়েছিল তারাও হারিয়ে গেছে একই কারণে। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে লক্ষ লক্ষ মুসলিম যেভাবে বিলুপ্ত হচেছ সেটিও ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহ না থাকার কারণে।

তবে ইসলামের প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংসের যে কাজটি শুরু করেছিল বিদেশী কাফির  শত্রুগণ, সরকারি উদ্যোগে আজ সেই একই রূপ নাশকতা হচেছ বাংলাদেশের ন্যায় সেক্যুলারিস্ট শাসিত দেশগুলোতে। কারণ, এসব মুসলিম দেশে ইসলামে অঙ্গীকারহীন পাশ্চাত্যের মানসিক গোলামদের সংখ্যাটি বিশাল। মুসলিম দেশগুলোর শাসন ক্ষমতা মূলত তাদেরই হাতে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন বিলুপ্ত হলেও তাদের গড়া সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানগুলি বিলুপ্ত হয়নি। ফলে টিকে আছে তাদের গড়া পতিতালয়, ক্লাব, জুয়া ও নাচের আড্ডা, সিনেমা হল, শিক্ষানীতি, আইন-আদালত ও শাসন ব্যবস্থা। ড্রেনে দুষিত পানি থাকলে যেমন মশার আবাদ বাড়ে, তেমনি এসব পাপের প্রতিষ্ঠানের কারণে বৃদ্ধি পায় পাপাচারীদের সংখ্যা। বরং পাশ্চাত্যের মানসিক গোলামদের হাতে শাসনক্ষমতা থাকায় এ পাপের প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন আরো আধুনিকতা পাচেছ। এ আধুনিকতাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে মোড়ল রাষ্ট্রগুলির পক্ষ থেকে অবিরাম আর্থিক, কারিগরি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাহায্যও পাঠানো হচেছ।

 নিবে না কি ব্যর্থতার হিসাব?

জনগণের কর্ম, চরিত্র, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় দেশে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত আইনের প্রভাবটি চুড়ান্ত। জনমনে সিদ্ধ-অসিদ্ধের ধারণাটি আইনই নির্ধারণ করে দেয়। ভারতের মুসলিম জীবনে বিপর্যয় তখন থেকেই শুরু হয় যখন বৃটিশেরা আদালত থেকে শরিয়তের আইনকে সরিয়ে নিজেদের কুফরি আইনকে প্রতিষ্ঠা দেয়। এবং কুর’আনকে বন্দী করে মসজিদ-মাদ্রাসার বদ্ধ আঙ্গিনায়। মুসলিমদের জন্য তখন অসম্ভব করা হয় পূর্ণ ইসলাম পালন। এবং শুরু হয় ইসলাম থেকে দ্রুত দূরে সরা। সে পরাজয় থেকে আজও বাংলাদেশের মুসলিমদের মুক্তি মেলেনি। কারণ, মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন দেশের আইন-আদালত ও প্রশাসন থেকে আজও অপসারিত। আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইন সরাতে বৃটিশ সরকার কখনোই কোন গণরায় নেইনি। তাদের প্রতিষ্ঠিত পেনাল কোড, বিচার-পদ্ধতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সূদীব্যাংক, পতিতাপল্লী, মদ্যশালার ন্যায় কোন আবর্জনাই নির্বাচনের মাধ্যমে চাপানো হয়নি। সেগুলি তারা চাপিয়েছে নিজেদের স্বৈরাচারী খায়েশ অনুযায়ী। তাই এসব সরাতেই বা  নির্বাচন লাগবে কেন? এগুলো হলো বৃটিশ আমলে জেঁকে বসা আগাছা-আবর্জনা। জাতীয় জীবন থেকে আগাছা ও আবর্জনা সরানোর দায়িত্ব তো প্রতিটি নাগরিকের। এ দায়িত্ববোধের প্রেরণাতেই শুরু হতে পারে এক গণজিহাদ। এ জিহাদের সুস্পষ্ট মিশন হবে পাপের সকল প্রতিষ্ঠানের নির্মূল। সে সাথে বিলুপ্ত করতে হবে শরিয়তের সাথে সাংঘর্ষিক সকল আইন। ইসলামের শত্রুদের দমনে প্রণয়ন করতে হবে কঠোর ব্লাসফেমি আইন। করতে হবে শিক্ষার বিশুদ্ধকরণ। সে সাথে থাকতে হবে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা।

পাপাচারের প্রতিষ্ঠানগুলো যতই বেঁচে থাকবে, ততই বাড়বে পাপীর সংখ্যা। রোগের ভাইরোসের ন্যায় পাপের ভাইরাসও দ্রুত ছড়ায়। ৫০ বছর পূর্বে দেশে পাপাচারীর যত সংখ্যা ছিল, এখন সে সংখ্যা বহু গুণ। এ পাপাচারীরাই দেশকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের পর্যায়ে। কারণ, পাপের প্রতিষ্ঠানের নির্মূলে কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। ফলে পাপ বেড়েছে কোন রূপ বাধা-বিঘ্নতা ছাড়াই। এ কাজে প্রচুর বিলম্ব হয়েছে, অধিকতর বিলম্ব শুধু ইসলাম ও মুসলিমদেরই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকেও বিপন্ন করবে।

তাছাড়া শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়ও নয়। মহান আল্লাহতায়ালার খাতায় নিজেদের নাম যারা মুসলিম রূপে লেখাতে চায়, তাদের সামনে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দেয়া ছাড়া ভিন্ন পথ নাই। নইলে পরিচিতি মিলবে বিদ্রোহী কাফির  রূপে। যে দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলিম, সে দেশে শরিয়ত আজও কেন প্রতিষ্ঠিত নয় -সে হিসাব কি মহান আল্লাহর দরবারে দিতে হবে না? বাংলাদেশের একটি থানার জনসংখ্যার চেয়ে কম সংখ্যক মুসলিম নিয়ে নবী পাক (সা:) শরিয়তের বিজয় এনেছিলেন। অথচ বাংলাদেশের মুসলিমগণ ১৬ কোটি হওয়া সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে তারা চরম ব্যর্থ। এ বিশাল ব্যর্থতা নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে তারা মুখ দেখাবো কীরূপে?  মহান আল্লাহতায়ালার কাছে হিসাব দেওয়ার আগে এ ব্যর্থতার হিসাব কি তারা নিজে নিবে না?  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *