বাঙালি মুসলিমের সাহিত্য-সংকট ও বিপন্ন মুসলিমত্ব

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 সংকটটি সাহিত্যে

দেহ ও আত্মার যোগফলেই মানুষ। দেহের ন্যায় আত্মাও পুষ্টিকর খাদ্য চায়। ব্যক্তির দুটি সত্ত্বাই যখন পর্যাপ্ত পুষ্টি পায়, একমাত্র তখনই সে সুস্বাস্থ্য পায়। তাই শুধু দেহ বাঁচালে চলে না, আত্মাকেও বাঁচাতে হয়। দেহ খাদ্য পায় পানাহারের মধ্য দিয়ে, আত্মা খাদ্য পায় জ্ঞানলাভে। তাই শুধু চাষাবাদ, পশু পালন ও ফলমূলের আবাদ বাড়ালে চলে না, জ্ঞানের আবাদও বিপুল ভাবে বাড়াতে হয়। এজন্যই ইসলামে জ্ঞানার্জন নামাজ-রোজার ন্যায় ফরজ। কোন ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠি কীরূপ শারীরিক বল বা সুস্থ্যতা পাবে -সেটি নির্ভর করে কি খায় এবং কি পান করে তার উপর। কিন্তু কীরূপ ধর্ম, চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতা পাবে -তা নির্ভর করে কি সে পাঠ করে তার উপর। তাই ঘরে খাদ্যের মওজুদ বাড়ানোর সাথে সাথে জ্ঞানের ভান্ডার তথা বইয়ের ভান্ডারও বাড়াতে হয়। মৃত বা রুগ্ন আত্মা নিয়ে মুসলিম হওয়া দূরে থাক মানবিক পরিচয় বেড়ে উঠাও অসম্ভব হয়। পবিত্র কুর’আনে এদেরকেই পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলা হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা পানাহার ফরজ করতে কুর’আন বা কোন ওহী নাযিল করেনি। প্রাণী মাত্রই পানাহারের গুরুত্বটি বুঝে। জন্মের পর এমন কি শিশুও সেটি বুঝে। কিন্তু লক্ষাধিক নবীরাসূল পাঠিয়েছেন এবং ওহী নাযিল করেছেন যেমন জ্ঞানার্জনকে ফরজ করতে, তেমনি সে বিশুদ্ধ জ্ঞানের একটি বিশাল ভান্ডারকে সুনিশ্চিত করতে। কিন্তু যখনই কোন জনগোষ্ঠি সে জ্ঞানের ভান্ডার থেকে দূরে সরে তখনই তাদের যাত্রা শুরু হয় নীচে নামার দিকে। তখন তারা রেকর্ড গড়ে শুধু দুর্বৃত্তিতেই নয়, বরং নৃশংস স্বৈরাচার, সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতি ও গুম-খুনের অসভ্যতায়। বাংলাদেশের আজকের যাত্রা তো সে পথেই।

বাঙালি মুসলিমের সংকটের কারণ শুধু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইন-আদালত ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং অতি গুরুত্বপূর্ণ সংকটটি দেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রেও। সাহিত্যই জনগণের চেতনায় পুষ্টি জোগানোর পাইপ লাইন। সাহিত্যে দূষন দেখা দিলে চরম দূষন দেখা দেয় দেশবাসীর বিবেক, আচার-আচরণ, দর্শন, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মূল্যবোধ। তখন সাহিত্যের মাধ্যমে গণহারে বিষ পান শুরু হয়। সাহিত্য তখন বিষ-ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মিতে পরিণত হয়। তখন নৈতিক মড়ক আসে শুধু নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর মাঝেই নয়, বরং অত্যাধিক বিষ পানের ফলে বিবেক ও মূল্যবোধে মহামারি আসে বেশী বেশী ডিগ্রিধারি, সাহিত্যসেবী ও অর্থশালীদের মাঝে। তাই দেশের কবিসাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, আদালতের বিচারপতি, দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী এবং সংসদ-সদস্যগণও তখন প্রচণ্ড দুর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসী হয়। তখন সমগ্র জাতি অসুস্থ্য হয় নীতি ও নৈতিকতায়। দেহের রোগ যেমন জ্বর, দুর্বলতা, ক্ষুধা-হ্রাস ও ওজন-হ্রাসের ন্যায় নানারূপ লক্ষণ নিয়ে হাজির হয়, তেমনি নানারূপ লক্ষণ দেখা দেয় চেতনার রোগেও। দেশ তখন দুর্নীতিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ে। প্রচণ্ডতা পায় পাপাচার। রাজনীতিতে বাড়ে স্বৈরাচার, দুর্বৃত্তি, নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস।

যে নাশকতার শুরু ইংরেজ শাসনামলে

পশু-পাখীরও ভাষা থাকে। তবে ভাষাকে শুধু মুখের ভাষা হলে চলে না, তাকে বুদ্ধিবৃদ্ধি ও দর্শনের ভাষাও হতে হয়। সমৃদ্ধ চেতনা, চরিত্র ও মূল্যবোধ গড়ে উঠে তো সে বুদ্ধিবৃত্তি ও দর্শনের গুণে। মানব জীবনে এটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তিকে ইবাদত বলা হয়েছে। মানুষর মানবতায় সমৃদ্ধ করতে হলে শুধু খাদ্যের বাজারে সমৃদ্ধ আনলে চলে না, জ্ঞানের বাজারেও সমৃদ্ধ আনতে হয় –সে সত্যটি সর্ব প্রথম ইসলামই প্রতিষ্ঠা দেয়। বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে মিথ্যা ধর্ম, মিথ্যা মতবাদ ও মিথ্যা জীবনবোধ বা দর্শনকে পরাজিত করার লক্ষ্যে চিন্তা, যুক্তি ও জ্ঞানের ক্ষুরধার অস্ত্র নিয়ে যে লাগাতর লড়াই -সেটিকেও এক উত্তম জিহাদে মর্যাদা দেয়া হয়। জ্ঞানীরাই কোটি কোটি মানুষের চেতনা রাজ্যে ইসলামকে সত্য দ্বীন রূপে বিজয়ী করে। তাই জ্ঞানীর কলমের কালিকে শহীদের রক্তের ন্যায় পবিত্র বলা হয়েছে।

কুর’আনের আগে আরবী ভাষায় কোন গ্রন্থ ছিল না। ছিল কিছু কবিতা ও কাছিদা। কিন্তু ইসলামের আগমনে বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে যে জিহাদ শুরু হয় তাতে আরবী ভাষা অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত হয়। এবং সে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ বন্ধ হলে ভাষাও তার সমৃদ্ধি হারাতে থাকে। তখন ভাষা শুধু মুখের ভাষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাষা রূপে বেঁচে থাকে, বুদ্ধিবৃত্তির ভাষা রূপে নয়। পরবর্তীতে বুদ্ধিবৃত্তির সে লড়াই আরবী ভাষার সাথে বিশাল ভূ-ভাগ ফার্সী ও উর্দু ভাষাতেও শুরু হয়। ফলে এ দুটি ভাষাও দ্রুত সমৃদ্ধি অর্জন করে। কিন্তু তেমন একটি বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই বাংলাতে না হওয়ায় বাংলা ভাষায় তেমন ইসলামী সাহিত্য রচিত হয়নি। বাংলা ভাষা তাই বহুলাংশে বাঙালি হিন্দুদের ভাষাই রয়ে গেছে। নিজেদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োজন মেটাতে হিন্দুগণই আধুনিক বাংলাকে সমৃদ্ধ করে। তবে সম্প্রতি কিছু ইসলামী বই বাংলাতে লেখা হচ্ছে –তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। গ্রেট ব্রিটেনে ইংরাজী ভাষা ছাড়াও স্কটিশ, আইরিশ, ওয়েলশ -এ তিনটি আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে। সেগুলি স্থানীয় জনগণের মুখের ভাষা হলেও বুদ্ধিবৃত্তি বা দর্শনের ভাষা নয়। বুদ্ধিবৃত্তি ও দর্শনের লড়াইটি হয়েছে ইংরেজী ভাষাতে। ফলে দ্রুত সমৃদ্ধি পেয়েছে ইংরেজী ভাষা। একই কারণে ইংরেজী ভাষা ব্যাপক ভাবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরো অনেক দেশে।

মুসলিম শাসনামলে ভারতে শতাধিক আঞ্চলিক ভাষা ছিল।কিন্তু চেতনায় পুষ্টি জোগানোর সামর্থ্য কোন ভারতীয় স্থানীয় ভাষারই ছিল না। ফলে চেতনায় পুষ্টি জোগানোর কাজে ফার্সি ভাষা ব্যবহৃত হতো। মোগল আমলে রাষ্ট্র ভাষা ছিল ফার্সি। আমির খসরুর ন্যায় ফার্সি ভাষার বড় বড় কবি ছিলেন ভারতে। আল্লামা ইকবাল তাঁর বেশীর ভাগ কবিতা লিখেছেন ফার্সিতে। এমন কি হিন্দুদের মাঝেও ফার্সি ভাষার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। বহু হিন্দু ফার্সি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। ফার্সি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজ ভাষাও ছিল। কলকাতার ঠাকুর পরিবারে চর্চা হতো ফার্সি ভাষা। কবি রবীন্দ্রনাথ যখন ইরান সফরে যান তখন তার দর্শণীয় স্থানের তালিকায় ছিল বিখ্যাত ফার্সি কবি হাফিজ সিরাজীর কবর। বাংলায় হিন্দু জাগরণের গুরু রাজা রামমোহনের বুদ্ধিবৃত্তির ভাষা ছিল ফার্সি।

বাঙালি মুসলিমগণ আত্মার পুষ্টি জোগাতে পারে এমন সমৃদ্ধ সাহিত্য বাংলা ভাষায় কোন কালেই গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে ৬ শত বছরের বেশী কাল মুসলিম শাসনামলে সে পুষ্টি জোগাতে বাঙালি মুসলিমগণ পুরাপুরি নির্ভর করেছে ফার্সি ভাষার উপর। এই ভাষার সাহায্যেই তারা গড়ে তোলে কুর’আনী দর্শনের সাথে সংযোগ। তখন মাওলানা রুমির মসনদ, শেখ সাদীরগুলিস্তাঁ ও হাফিজের কবিতা বাঙালি মুসলিম আলেমদের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো। ব্রিটিশের জঘন্য অপরাধ শুধু এই নয় যে, তারা শুধু বাঙালির খাদ্যভান্ডারে হাত দিয়েছে। তারা কেড়ে নিয়েছে বাঙালি মুসলিমদের চেতনার খোরাকও। সীমাহীন লুন্ঠনের মধ্য দিয়ে ছিয়াত্তরের মনন্তরের ন্যায় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ উপহার দিয়েছিল -যাতে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ জনগণের মৃত্যু ঘটেছিল। অপর দিকে বাঙালি মুসলিমের চেতনা পুষ্টির জোগান বন্ধ করে দেয় ফার্সি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে নিষিদ্ধ করে। এভাবেই মুসলিমদের জন্য ডেকে আনে অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক মড়ক। তাতে সহজ হয়ে যায় ইসলাম থেকে জনগণকে দূরে সরানোর কাজ। ফলে সাধারণ মুসলিমের মাঝে অজ্ঞতা বাড়ে খিলাফত, জিহাদ, আদালতে শরিয়ত, হুদুদ এবং জিহাদে ন্যায় ইসলামের মৌল বিষয়গুলো নিয়ে।

মুসলিম শাসনামলে বাংলার প্রায় সিকি ভাগ চাষাবাদী জমি বরাদ্দ ছিল দেশের শিক্ষাখাতকে বাঁচিয়ে রাখতে। এটিই ছিল সরকারী ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত।সে মাদ্রাসাগুলোতে কুর’আন শিক্ষার পাশাপাশি ফার্সিও ভাষা শিক্ষা দেয়া হত। সে সময় ফার্সি শুধু ইংরেজী ভাষা থেকেই নয়, বিশ্বের সকল ভাষা থেকে শ্রেষ্ঠতর ছিল। শেখ সাদী, হাফিজ সিরাজী, মাওলানা রুমী, ফরিদ উদ্দীন আত্তার, জামী, ওমর খাইয়ামের ন্যায় যে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক ফার্সি ভাষায় জ্ঞানের যে বিশাল ভান্ডার গড়ে তোলে তা ইংরাজী কেন, বিশ্বের অন্য কোন ভাষাতেই ছিল না। তখন তুরস্কের সীমান্ত থেকে বাংলার পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত ছিল ফার্সি ভাষার বিস্তার। ফার্সি শুধু ভাবের ভাষা ছিল না, ছিল দর্শনের ভাষাও। ইরান, আফগানিস্তান, ভারত থেকে মধ্য এশিয়ার সমরকন্দ, তাসখন্দ, বোখারাতেও এ ভাষায় বিদ্যাচর্চা হত। বিশ্বের আর কোন ভাষাই বিশ্বের এত বড় বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে বিস্তৃত ছিল না।

ইংরেজ শাসনের বড় নাশকতা শুধু অর্থনৈতিক ডাকাতি ছিলনা। সবচেয়ে বড় নাশকতাটি ছিল ইসলামী জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে। তার মুসলিমের চেতনায় আনে ভয়ানক অপুষ্টি। আজ বাংলাদেশের বুকে যেরূপ সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট তার মূল কারণ ইংরেজদের সৃষ্ট ১৯০ বছরের বুদ্ধিবৃত্তিক নাশকতা। মহল্লারগৃহগুলোতে পানির সংযোগ কেটে দিলে জনগণ পানির সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হয়। তখন স্বাস্থ্যে মড়ক লাগে। তেমনি চিত্তে মড়ক লাগে ভাষার সংযোগ বা সাহিত্যের সংযোগ কেটে দিলে। ব্রিটিশগণ তেমনই এক মহামারি উপহার দিয়েছে ভারতীয় এবং সে সাথে বাঙালি মুসলিমদের চেতনার রাজ্যে। জমিতে ফসল ফলাতে কয়েক মাসে লাগে, কিন্তু সাহিত্যের জগতে ফসল ফলাতে বহু যুগ ও বহু শতাব্দী লাগে। ফলে বাঙালি মুসলিমগণ আজও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে ইংরেজদের সৃষ্ট সে রুগ্নতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বাঙালি মুসলিমের সাহিত্য সংকটের মূল কারণ এটিই। এ রুগ্তার সুযোগ নিয়েছে বাঙালী হিন্দুগণ। ফলে সৃষ্টি হয়েছে হিন্দু সংস্কৃতির জোয়ার। এরই প্রমাণ, বাংলাদেশে মুসলিমদের মাঝেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বসন্ত যাপন, মঙ্গল প্রদীপ, মুর্তি গড়া, মুর্তি ও স্তম্ভে ফুল দেয়া, আলপনা কাটার সংস্কৃতি। 

 বাঙালি হিন্দুর নাশকতা

হিন্দু বাঙালির এবং মুসলিম বাঙালির চিত্তের প্রয়োজন এক নয়। হিন্দুদের হিন্দু রূপে বেড়ে উঠার জন্য যা প্রয়োজন -সেটি মেটাতে হিন্দু কবি সাহিত্যিকগণ বাংলা ভাষায় বহু বই লিখেছেন।হিন্দুদের হিন্দু রূপে বেড়ে উঠার যুগটাকে বলা হয় বাঙালি হিন্দুর রেনেসাঁ যুগ। সেটি ছিল প্রতিবেশী মুসলিমদের বাদ দিয়ে বাঙালি হিন্দুদের একাকী বেড়ে উঠা ও এগিয়ে যাওয়ার স্বার্থপর চেষ্টা। তাদের কারণে বাঙলা সাহিত্য পরিপূর্ণ হয়েছে মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক সাহিত্য দিয়ে। এ সাম্প্রদায়িকতা শুধু বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্রের ন্যায় উগ্র সাম্প্রদায়িক সাহিত্যিকদের কাজ ছিল না, তা থেকে রবীন্দ্রনাথও মুক্ত ছিলেন না। তারা বাঙালির যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন সেখানে বাঙালি মুসলিমদের কোন স্থান ছিলনা। তাই শরৎ চন্দ্রের ন্যায় সাহিত্যিকও লিখেছেন: “আমাদের পাড়ায় বাঙালিদের সাথে মুসলিমদের খেলা।”

অথচ ফার্সি সাহিত্যে এরূপ সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। ফলে ছিল না হিন্দু-মুসলিম সংঘাত। ফার্সি ভাষায় বহু বড় মাপের কবি ছিলেন হিন্দু। তাই সে সাহিত্য চেতনায় যে পুষ্টি জুগিয়েছে তাতে ভারতের বুকে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। অথচ যতই বাঙালি হিন্দুদের সাহিত্য চর্চা বেড়েছে ততই বেড়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং বেড়েছে মুসলিম বিদ্বেষ। ফলে বেড়েছে সাম্প্রদায়িক বিবাদ। এ বিবাদের পরণতিতেই ১৯৪৭ সালে বাংলা রাজনৈতিক ভাবে বিভক্ত হয়। এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের ভারতে বিজয় এসেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদের। লক্ষণীয় হলো, ভারতের বুকে আজ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যে বিজয় তার শুরুটি হয়েছিল বাঙালি হিন্দুত্ববাদী সাহিত্যিক বঙ্কিম চ্যাটির্জি ও উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মত বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। হিন্দুত্ববাদী ভারতের জাতীয় সঙ্গীত যে “বন্দে মাতরম” গানটি -সেটিও নেয়া হয়েছে বঙ্কিম চ্যাটার্জির “আনন্দ মঠ” উপন্যাসের একটি গান থেকে। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি জন্ম দেন হিন্দু মহাসভার। পরে সেটি জনসংঘ এবং আরে পরে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজিপি)তে পরিণত হয়। বাঙালি মুসলিমদের বিপদ হলো তাদের নিত্যদিনের বসবাস হলো বাঙালি হিন্দুদের গড়া মুসলিম বিদ্বেষী বাংলা সাহিত্যে অবগাহন করে। ১৯৭১’য়ে ভারতের বিজয়ের পর বাংলাদেশে হিন্দু সাহিত্যের সে জোয়ার আরো তীব্রতর হয়। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের পানির ন্যায় বাংলাদেশে ঢুকতে থাকে কলকতার বই ও পত্র-পত্রিকা।

বাঙালি মুসলিমদের বড় ব্যর্থতা হলো, মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার জন্য সাহিত্যের যে সমৃদ্ধ ভান্ডারটির প্রয়োজন, সেটি তারা গড়ে তুলতে পারিনি ফার্সি ভাষা নিষিদ্ধ করার পর বাংলা ভাষা সে শূণ্যস্থান পূরণ করতে পারিনি। ভারতের অন্যান্য এলাকার মুসলিমগণ ফার্সির শূণ্যস্থান পূরণে উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের জন্ম দেয়। তাদের চেষ্টায় আরবী ও ফার্সির পর উর্দু মুসলিমদের জন্য তৃতীয় সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত হয়। পরিণত হয় ভারতীয় মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তির যৌথ ভাষা তথা লিঙ্গুয়া ফ্রাংকাতে। ব্রিটিশ আমলে পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম এবং কাশ্মির থেকে মাদ্রাজ –এবিশাল ভূ-ভাগের শিক্ষিত মুসলিমদের মাঝে যোগাযোগের ভাষা ছিল উর্দু। উল্লেখ্য হলো, হিন্দুদের তেমন কোন সর্বভারতীয় ভাষা ছিল না। এবং এখনো নাই। ফলে উর্দু নিয়ে হিন্দুদের ছিল প্রচণ্ড ইর্ষা।

ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় বাংলার মাদ্রাসাগুলোতে উর্দুকে শিক্ষাদানের মাধ্যম রূপে গ্রহণ করা হয়। পাকিস্তান আমলের ২৩ বছর যাবতও সেটি বহাল ছিল। কিন্তু উর্দুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয় বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের দ্বারা। ভাষা পূজার নামে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় উর্দুর সাথে। ফলে শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তিক অপুষ্টি। ১৯৫২‘য়ের ভাষা আন্দোলনটি পরিণত হয় বাঙালি মুসলিমের চেতনা রাজ্য থেকে প্যান-ইসলামী চেতনা বিলুপ্তির ষড়যন্ত্রে। হিন্দু, বাঙালি জাতীয়তাবাদী, কম্যুনিস্টগণ জোটবদ্ধ হয় উর্দুর বিরুদ্ধে। এ ষড়যন্ত্রে তারা বিজয়ী হয়। ১৯৪৭ সালের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এটি ছিল প্যান-ইসলামীদের সবচেয়ে বড় পরাজয়। তখন দেয়াল গড়া হয় উর্দু সাহিত্যের বিরুদ্ধে। এবং দরজা খুলে দেয়া হয় পশ্চিম বাংলা থেকে হিন্দু সাহিত্যের অনুপ্রবেশে। বেগবান হয় রবীন্দ্র সাহিত্যের চর্চা। বাংলা ভাষায় যত বই তার প্রায় শতকরা ৮০ ভাগের রচিয়তাই হলো হিন্দু বাঙালি। আজ থেকে শত বছর আগে শতকরা ৯৫ ভাগ বইয়ের রচিয়তা ছিল তারাই। ফলে বাংলা সাহিত্যে শুরু থেকেই ছিল হিন্দু সাহিত্যের প্রবল জোয়ার। হিন্দু সাহিত্যের এমন জোয়ারে কি মুসলিমদের ঈমান পুষ্টিপায়? প্রবল সাহিত্য সংকটের কারণে বাঙালি মুসলিমদের মাঝে কখনোই কোন বুদ্ধিবৃত্তিক রেনেসাঁ আসেনি।

চিত্ত পুষ্টি পায়নি

মানব শিশুর দৈহিক ভাবে বেড়ে উঠাটি নির্ধারিত হয় তার পানাহার থেকে। কিন্তু তার সুস্থ মানব রূপে বেড়ে উঠাটি নিশ্চিত হয় তার জ্ঞানের পুষ্টি থেকে। সে পুষ্টির জোগান বন্ধ হলে ব্যহত হয় সুস্থ মানব রূপে বেড়ে উঠাটি। বাংলাদেশে ব্যাপক দুর্নীতি, সন্ত্রাস, স্বৈরাচার ও নানাবিধ অপরাধের বিপুল বিস্তার দেখে এটুকু নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, বিপুল সংখ্যক মানুষের দর্শন, বিবেক, চেতনা ও নৈতিকতা আদৌ সুস্থ্য নয়। এ থেকে বুঝা যায়, তাদের চিত্ত পুষ্টি পায়নি। জ্ঞানের পুষ্টিহীনতায় তারা পেয়েছে মারাত্মক বুদ্ধিবৃত্তিক অসুস্থ্যতা। এবং এটি কোন মামূলী বিষয়ও নয়। বাঙালি মুসলিমের সকল রাজনৈতিক, সমাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের শুরু গুরুতর এই নৈতিক অসুস্থ্যতা থেকেই। ফলে বিশ্ব মাঝে মাথা তুলে দাঁড়ানো দূরে থাক, ইজ্জত নিয়ে বাঁচাই তাদের জন্য দিন দিন কঠিনতর হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুর্নীতিতে ৫ বার বিশ্বে প্রথম হওয়ায় বিশ্বাবাসীর সামনে পরিস্কার হয়ে গেছে নৈতিক সে রোগটি বাংলাদেশে কতটা প্রবল। সংকট এখানে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ও সাহিত্যে। বিপদের আরো ভয়াবহতা হলো, বাঙালি মুসলিমদের মাঝে এ বিশাল সংকট নিয়ে চিন্তা-ভাবনা নাই। এবং ভাবনা নাই এ বিপদ থেকে উদ্ধার কীরূপে -তা নিয়ে। শয্যাগত মুমূর্ষ রোগীর নিজের চিকিৎস্যা নিয়ে ভাবনা থাকে না। বোধও থাকে না। কোথায় এবং কীরূপে চিকিৎসা সম্ভব -সে হুশটি লোপ পায় অনেক আগেই। লোপ পায় তার নিজের কল্যাণ-চিন্তাও। এমন ব্যক্তি অপেক্ষা করে মৃত্যুর জন্য। অনুরূপ অবস্থা হয় অধঃপতিত জাতির জীবনেও।দুর্নীতিতে ডুবা এমন অসুস্থ্য জাতির জীবনে দুর্নীতি থেকে মুক্তি নিয়ে তাড়না থাকে না। এমন এক ভয়ানক অবস্থা ঘিরে ধরেছে আজকের বাংলাদেশকে।

ব্যক্তি, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে সাহিত্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে ভাবনাই বা ক’জনের? অথচ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বাঙালি মুসলিমের প্রচণ্ড গর্ব। জাতীয় জীবনে দিন দিন বিপর্যয় বাড়লে কি হবে, রাষ্ট্র-ভাষা রূপে বাংলার প্রতিষ্ঠাতেই অনেকের আনন্দ। তাদের আরো গর্ব যে ২১ ফেব্রেয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছে। প্রশ্ন হলো, ভাষার গর্ব কি স্রেফ রাষ্ট্র ভাষা হওয়াতে। ভাষার প্রয়োজনীতাটি কি সে ভাষায় কথা বলায়? সরকারি নথি, চিঠিপত্র ও দলিল-দস্তাবেজ লেখায়? কথোপকথন, দোকান-পাঠ-অফিস বা ব্যাবসা-বাণিজ্যের কাজ চালনা ছাড়াও ভাষাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। ভাষার মূল কাজ তো দেশবাসীর চেতনায় পুষ্টি জোগানো নইলে চরিত্র ও চেতনায় অসুস্থ্যতা অনিবার্য। ইতিহাসের ছবক হলো, দেশের ভূমি যত সুজলা-সুফলাই হোক, সাহিত্যে সমৃদ্ধি না এলে সে দেশে চেতনাসমৃদ্ধ মানুষ গড়া যায় না। জনগণের চেতনা সমৃদ্ধ না হলে তারা চরিত্র পায় না। সে ভূমিতে তখন উচ্চতর সভ্যতাও গড়া যায় না। সভ্যতা স্রেফ ভাত-মাছ, সম্পদ ও ভাল জলবায়ুর কারণে গড়ে উঠে না। সে জন্য জরুরি হলো সভ্য, উন্নত ও সমৃদ্ধ চেতনার মানুষ।     

 বিপ্লব কীরূপে আসে?

নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মূল ভিত্তি হলো সাহিত্যের ভূবনে বিপ্লব। গাড়ির আগে যেমন ঘোড়া ছুটে, তেমনি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আগে আসে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব। ইসলামের গৌরব যুগে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের মূলে ছিল মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব পবিত্র কুর’আন। ফলে জনবিরল আরব মরুর বুকে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণ ও বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিমদের উত্থানটি সেদিন সম্ভব হয়েছিল। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্রটি ভিন্নতর। শস্য-শ্যামল বিশাল মুসলিম জনসংখ্যার দেশটিতে বার বার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও কখনোই কোন বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব আসেনি। ফলে গুণগত কোন পরিবর্তন আসেনি দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও জীবন যাত্রায়। এর কারণ, বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা ও বাংলা সাহিত্যের নিদারুন দৈন্যতা।ভাষা ও ভাষালব্ধ দর্শন ও সাহিত্যের বিচারে সেকালের আরব এবং আজকের বাংলাদেশের মাঝে বিরাজমান পার্থক্যটি বিশাল। সেটিরই প্রতিফলন ঘটেছে সভ্যতার নির্মাণে আরবদের তুলনায় বাঙালি মুসলিমদের ব্যর্থতায়। আরবী ভাষা যখন শ্রেষ্ঠতায় সমগ্র বিশ্বে প্রথম, বাংলা সাহিত্যের তখনও জন্মই হয়নি।

আরবী ভাষাতে অবতীর্ণ হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল-কুর’আন। বিশাল একটি সোনার খনি একটি দেশের অর্থনৈতিক ভাগ্য পাল্টে দিতে পারে। তেমনি চেতনার ভূবন পাল্টে দিতে পারে জ্ঞানের অতি শ্রেষ্ঠ একখানি কিতাব। আর চেতনার ভূমিতে বিপ্লব এলে, বিপ্লব আসে শিক্ষা, সংস্কৃতি, চরিত্র, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও সভ্যতায়। জ্ঞানের সে মহান কিতাবটি যদি মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল-কুর’আন হয় -তবে সে বিপ্লবটি ঘটে অবিশ্বাস্য ভাবে। তখন খোদ মানুষ পরিণত হয় খাঁটি সোনার চেয়েও দামী এবং ফেরেশতাদের চেয়েও উন্নত গুণাবলীর।বস্তুত সে কিতাবের গুণেই সে যুগের মুসলিমগণ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন।

সাহিত্যের অঙ্গণে বাংলা ভাষার দারিদ্র্যতা অতি প্রকট। বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম উপকরণ কুর’আন নয়। হাদিসও নয়। হাফিজ শিরাজী, রুমী, সাদী, গালিব বা ইকবালের ন্যায় কবিদের উচ্চতর দর্শন-নির্ভর সাহিত্যও নয়। বরং সেটি হল শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, মনসা-মঙ্গল, চণ্ডি-মঙ্গল, বৈষ্ণব পদাবলী, খনার বচন, পুঁথি-সাহিত্য, বঙ্কিম-সাহিত্য, রবীন্দ্র-সাহিত্য, ইত্যাদি। এ সাহিত্যে প্রবল প্লাবনটি পৌত্তলিকতার। এমন সাহিত্যে কি উন্নত চেতনা, দর্শন, মূল্যবোধ ও সভ্যতা গড়ে উঠার সামগ্রী মেলে? পাইপ লাইনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে বিশুদ্ধ পানি যেমন পৌঁছতে পারে, তেমনি পৌঁছতে পারে বিষাক্ত পানিও। সাহিত্য তেমনি ঘরে ঘরে উন্নত দর্শন, মূল্যবোধ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান যেমন পৌঁছাতে পারে, তেমনি মিথ্যা মতবাদ, ভ্রান্ত দর্শন, কুসংস্কার এবং মানব মনের অশ্লীল ও কুৎসিত ভাবনাগগুলোও পৌঁছাতে পারে। সাহিত্য এভাবে আলোর বদলে আঁধারের দিকেও টানতে পারে। মানব মনে ভয়ানক আবর্জনাও পৌঁছাতে পারে।ফলে দুষিত সাহিত্য সভ্যতার নির্মাণে সহায়ক না হয়ে বরং ভয়ানক দুর্গতি ও অবক্ষয়েরও কারণ হতে পারে। কিন্তু সে চিন্তা ক’জনের? যখন বাংলা ভাষার ন্যায় বহু ভাষার জন্মই হয়নি, তখনও শত শত রাষ্ট্র, সমাজ ও গোত্র গড়ে উঠেছে। বহু হাজার বছর ধরে সে সব রাষ্ট্র, সমাজ ও গোত্রের নিত্যদিনের কার্যাবলী যেমন সমাধা হয়েছে তেমনি তাদের মনের যোগযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কথোপকথনও হয়েছে। কিন্তু সব ভাষায় ও সব রাষ্ট্রে সভ্যতা গড়ে উঠেনি। উন্নত সভ্যতা একমাত্র তখনই নির্মিত হয়েছে যখন কোন ভাষা উন্নত দর্শন ও সাহিত্যের বাহন হয়েছে এবং জনগণের চেতনা, কর্ম, আচরণ, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিতে আমূল বিপ্লব এনেছে। তখন গড়ে উঠে উন্নত রাষ্ট্র ও সে রাষ্ট্রের উন্নত রাজনীতি, প্রশাসন, বিচার-আচার, সমাজ নীতি, অর্থনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি। উন্নত সভ্যতার নির্মাণে এগুলোই মূল।

সমগ্র সৃষ্টির মাঝে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব দেহের গুণে নয়; সেটি চিন্তা-ভাবনা বা দর্শনের গুণে। এই গুণটিই মানুষকে পশু থেকে পৃথক করে। এবং অসভ্য থেকে সভ্যতর করে। উন্নত সভ্যতার নাগরিকগণ দর্শনের বলেই অনুন্নত বা বর্বর মানুষদের থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায়। চিন্তা-ভাবনার সে বিস্ময়কর সামর্থ্য থেকেই জন্ম নেয় জ্ঞান-বিজ্ঞান।গড়ে তোলে সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি। তখন নির্মিত হয় উচ্চতর সভ্যতা। গাছ যেমন প্রতিদিন বাড়ে, তেমনি প্রতিদিন বেড়ে উঠতে হয় প্রতিটি ব্যক্তিকেও। সেটি শুধু দেহের গুণে নয়, নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক গুণেও। বেড়ে উঠার সামর্থ্য বাড়াতে প্রতি মুহুর্তে তাকে নতুন কিছু যেমন শিখতে হয়, তেমনি ভাবনা ও কর্মের মধ্য দিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টিও করতে হয়। বেড়ে উঠার কাজটি সবার জীবনে সমান ভাবে হয়না। কেউ দ্রুত সামনে এগুয়, আবার কেউ আস্তে এগুয়। কেউ আবার না এগিয়ে পিছিয়েও যায়। ভারতে বহু প্রদেশ ও বহু ভাষাভাষী মানুষের বাস। কিন্তু সবাই একই বেগে সামনে এগুচ্ছে না। বেড়ে উঠায় পার্থক্য সৃষ্টি হয় প্রতিকূল জলবায়ু ও পানাহারের কমতিতে নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক পুষ্টির কমতিতে।

জ্ঞানের সংগ্রহে ও বুদ্ধিবৃত্তিতে বেড়ে উঠার বিষয়টি ইসলামে এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলামের নবী (সা:) বলেছেন, “যার জীবনে পর পর দুটি দিন অতিবাহিত হলো অথচ তার জ্ঞানের রাজ্যে কোন বৃদ্ধি ঘটলো না -তার জন্য ধ্বংস।” সম্পদের উপর প্রতিদিনের সংযোজিত সমৃদ্ধিকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় এ্যাডেড ভ্যালু বা সংযোজিত মূল্য।জাতির জিডিপ (গ্রস ডমিস্টিক প্রোডাক্ট) হলো সে সংযোজিত মূল্যের যোগফল। তবে উচ্চতর সভ্যতার নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ঘটে অন্যত্র। মূল্য সংযোজনের সে মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ঘটে প্রতিটি ব্যক্তির চিন্তা, চরিত্র, কর্ম ও বুদ্ধিবৃত্তিতে। তখন ব্যক্তির জীবনে সৃষ্টিশীলতা চলে আজীবন। সেটি যেমন জ্ঞানের রাজ্যে, তেমনি কৃষি, শিল্প, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে। শিক্ষা ও সাহিত্যের কাজ হলো, সে সৃষ্টিশীলতা বা মূল্য সংযোজনের কাজে জনগণের সামর্থ্য বাড়ানো। সেটি যেমন বিদ্যালয়ে ও তেমনি বিদ্যালয়ের বাইরেও। বিদ্যালয়ের বাইরের সে কাজটি বেগবান করে সাহিত্য। মূল্যসংযোজনের কাজে যে দেশ এগিয়ে যায়, সে দেশই দ্রুত সামনে এগুয়।   

সৃষ্টিশীলতার বিপরীত যেটি সেটি হলো স্থবিরতা ও নিষ্ক্রিয়তা। স্থবিরতা ও নিষ্ক্রিয়তা প্রাণহীন জড় বস্তু বা মৃত ব্যক্তির গুণ, জীবিতদের নয়। জাতীয় জীবনে এমন স্থবিরতা ও নিষ্ক্রিয়তা ব্যাপকতর হলে অনিবার্য হয় পতন। অপরদিকে অতি ক্ষুদ্র পরমাণুর উপর যখন সৃষ্টিশীলতা বা এ্যাডেড ভ্যালু যোগ হয়, তা থেকে জন্ম নেয় বিস্ময়কর পারমানবিক শক্তি। সেরূপ একটিবিস্ময়কর এ্যাডেড ভ্যালু যখন কোন ব্যক্তির জীবনে যোগ হয়, সে মানুষটি ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর হয়। এমন লাগাতর সৃষ্টিশীলতার ফলেই সৃষ্টিশীল বিপ্লব আসে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে। সমৃদ্ধি আসে অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে।

একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিমাপ হয় সে দেশের সম্পদের উপর বছরে সর্বসাকুল্যে কতটা মূল্য সংযোজিত হল বা নতুন সম্পদ সৃষ্টি হলো তা থেকে। আর জাতির মানবিক উন্নয়নের পরিচয়টি মেলে মানবিক গুণে জনগণের জীবনে সর্বসাকুল্যে কতটা সমৃদ্ধি আসলো এবং চারিত্রিক ও নৈতিকতার উপর কতটা উন্নয়ন ঘটলো তা থেকে। সেটি ব্যাপক ভাবে বাড়লে তখন বিপ্লব আসে দেশের সংস্কৃতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে। তখন গড়ে উঠে উচ্চতর সাহিত্য আর সাহিত্য তো তাই যা গড়ে উঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবনা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কল্পনা ও আবেগের সাথে ব্যক্তির সৃষ্টিশীল প্রতিভার সংযোজনের ফলে। হাফিজ শিরাজী, জালালুদ্দীন রুমী, শেখ সাদী, আসাদুল্লাহ গালিব বা আল্লামা মহম্মদ ইকবাল তাদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য গড়ে তুলেছেন তো এ পথেই। এমন সাহিত্য যেমন নিজেই এক সৃষ্টিশীলতার অমূল্য ফসল, তেমনি তা থেকে অনুপ্রেরণা পায় বিপুল সংখ্যক সৃষ্টিশীল মানুষ।

অপর দিকে মুসলিম হওয়ার অর্থই হল সৃষ্টিশীল হওয়া। এটিই হলো তার ফিতরাত। তবে সৃষ্টিশীলতার জন্য সবচেয়ে জরুরি চিন্তাশীলতা। ইসলামে চিন্তাশীলতাকে শ্রেষ্ঠ ইবাদত বলা হয়েছে। চিন্তাশীলতার অভাবে মানুষ পরিণত হয় ইতর জীবে। যার মধ্যে চিন্তাশীলতা নেই, পবিত্র কুর’আন থাকে তাকে পশুর চেয়েও অধম বলেছে। চিন্তাশীলতার মধ্য দিয়ে যা বাড়ে তা হলো ঈমান ও তাকওয়া। ঈমানের বলেই মোমেন পায় লাগাতর নেক আমলের প্রেরণা তথা সৃষ্টিশীলতা। মোমেনের প্রতিটি নেক আমল মূলত সে সৃষ্টিশীলতারই ফসল। প্রতিটি দিন এবং প্রতিটি মুহুর্তই ব্যক্তির জীবনে হাজির হয় নেক আমল তথা সৃষ্টিশীলতার বিশাল সুযোগ নিয়ে। একটি দিন অতিবাহিত হলো, অথচ সে কিছু শিখলো না, কাউকে কিছু শেখালোও না, কিছু করলোও না -এতে অপচয় ঘটে তাঁর জীবনের মূল্যবান একটি দিনের। অর্থের অপচয়ের চেয়েও সময়ের এ অপচয়টি কি কম ক্ষতিকর? মহান আল্লাহতায়ালার কাছে অতি অপছন্দের হলো এই অপচয়। নবীজী (সা:) এমন অপচয়কারিদের শয়তানের ভাই বলেছেন। বস্তুত ঈমানদারের প্রতি মুহুর্তের ব্যস্ততাটি হয় নেক আমলের মাধ্যমে মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করা।এভাবেই সে নিজেকে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মাগফেরাত লাভ ও জান্নাত লাভের যোগ্য করে গড়ে তোলে।

 কুর’আন যেভাবে বিপ্লব আনে

মানব উন্নয়নে ও উচ্চতর সভ্যতার নির্মাণে কুর’আনের ভূমিকা অতূলনীয়। ঈমানদার তার প্রতিটি সৃষ্টশীল কর্মে প্রেরণা পায়, নির্দেশনা পায় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানটি পায়টি পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান থেকে। কুর’আনী জ্ঞানের মূল কথাটি হল, এ জীবন মানুষের জন্য পরীক্ষাস্থল। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনে সে কথাটি বলেছেন এভাবে, “আল্লাযী খালাকাল মাওতা ওয়াল হায়াতা লি ইয়াবলুয়াকুম আইয়োকুম আহসানু আমালা।” -(সুরা মুলক,আয়াত ১)। অর্থ: “তিনিই সেই (মহান আল্লাহ) যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমাদের মধ্যে কে কর্মের দিক দিয়ে উত্তম -সেটির পরীক্ষা হয়।” ফলে এ পার্থিব জীবনে প্রতিটি ব্যক্তিই একজন পরীক্ষার্থী। আর পরীক্ষায় বসে পরীক্ষার্থীর লক্ষ্য হয়, প্রতি মুহুর্তে পরীক্ষার খাতায় নাম্বার বাড়ানো। একই ভাবে ঈমানদার ব্যক্তি প্রতি মুহুর্তে স্কোর বাড়ায় তার আমলনামায়। সেটি নেক আমলের মাধ্যমে। যেমন সৎ কর্মে, তেমনি জ্ঞানের রাজ্যে। দুইটিই অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। লক্ষ্য,পরকালে জান্নাত লাভ। তাই যে দেশে ঈমানদারের সংখ্যা বাড়ে সেদেশে নেক আমল ও জ্ঞানের রাজ্যেও দ্রুত সমৃদ্ধি আসে। ইসলামের বিজয়ের আরবে তো সেটাই ঘটেছিল। তাই কোন দেশে মুসলিমের সংখ্যা বাড়লো অথচ সেদেশে সম্পদে ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধি আসলো না -সেটি অভাবনীয়। এমনটি হলে বুঝতে হবে, সমস্যা রয়েছে জনগণের মুসলিমত্বে তথা ইসলাম পালনে।  

মুসলিম হওয়ার অর্থ তাই শুধু নামাজ-রোজা ও তাসবিহ পাঠে মনযোগী হওয়া নয়। বরং সেটি হলো নেক আমল বৃদ্ধির কাজে আমৃত্যু এবং প্রতি মুহুর্ত লেগে যাওয়া। সৃষ্টিশীল এমন মিশনে লেগে থাকার কারণেই ব্যক্তির জীবনে লাগাতর উৎকর্ষ আসে; যেমন তার কর্মে, তেমনি তার ভাবনায়। আরবের মানুষগুলো ঈমান ও আমলে অতি দ্রুত উপরে উঠেছিল তো এ পথেই। তাঁরা পরিণত হয়েছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবে। যারা এক কালে নিজেদের কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত, তাঁরাই হাজার হাজার মাইল দূরের মানুষদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে ছুটে গিয়েছিলেন। দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছেন বড় বড় পাহাড়-পর্বত, নদীনালা ও মরুপ্রান্তর অতিক্রম করে। বাংলাদেশের চেয়ে ৫০ গুণ বৃহৎ রাষ্ট্রের খলিফা তার ভৃত্যুকে উঠের পিঠে চড়িয়ে নিজে উঠের রশি ধরে টেনেছেন। খলিফা নিজে আটার বস্তা কাঁধে নিয়ে ক্ষুদার্ত মানুষে জনগণের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। এ ছিল তাঁদের সভ্যতার মান। সে সময় যে দেশেই ইসলামের প্রবেশ ঘটেছিল সে দেশেই এসেছিল এরূপ মানবিক গুণের বিপ্লব।এসেছিল প্রচণ্ড সৃষ্টিশীলতা ও চিন্তাশীলতা। আরবদের ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে সে দেশে শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত আসেনি, বিপুল সমৃদ্ধি এসেছে তাদের ভাষা ও সাহিত্যে। ফলে আরবী ভাষায় অতি অল্প সময়ে গড়ে উঠে এক বিশাল জ্ঞান-ভান্ডার। আর এ ফলে গড়ে উঠে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। অথচ কুর’আনের পূর্বে আরবী ভাষায় কোন গ্রন্থ  ছিল না। ইসলামের প্রবেশের ফলে সাহিত্য ও বিজ্ঞানে দ্রুত বিপ্লব এসেছিল ইরান দেশেও। ইরানের ইতিহাস বহু হাজার বছরের। কিন্তু সে দেশের মানুষের যা কিছু মহান সৃষ্টি তা গড়ে উঠেছে ইসলাম আগমনের পর। ইসলাম মহান বিপ্লব এনেছিল তুর্কিদের মাঝেও।তারা গড়ে তুলেছিল ওসমানিয়া খেলাফত যা ছিল ছয় শত বছর ধরে সমগ্র বিশ্বের প্রধানতম বিশ্বশক্তি। ইসলাম কবুলের পর বিপ্লব এসেছিল আফগানদের জীবনেও। সুলতান মাহমুদের সময় তার রাজ্যে যত বিজ্ঞানীর বসবাস ছিল, তা সমগ্র বাকি  বিশ্বে ছিল না। তখন মুসলিমদের মাঝে ইসলামের প্রকৃত রূপটি দেখা যেত। মুসলিম ব্যবসায়ীদের চরিত্র দেখে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার জনগণ দলে দলে মুসলিম হয়ে যায়। সেখানে কোন মুসলিম সেনাদলের যুদ্ধজয় করতে হয়নি।

 সমৃদ্ধ ভাষা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

কোন জাতির সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও মানবিক উন্নয়নের মান যাচায়ে সে জাতির লোকসংখ্যা, রাস্তাঘাট, মাঠঘাট বা কলকারখানার খতিয়ান নেয়াটি জরুরি  নয়। বরং সে পরিচয়টি সঠিক মেলে সে জাতির ভাষা ও সাহিত্য থেকে। জাতির বিজয় বা উন্নয়নের আগে সে জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যের উন্নয়নটি পূর্বশর্ত। ভাষার মধ্যেই ধরা পড়ে জাতির ধর্ম-কর্ম, চরিত্র, বুদ্ধিবৃত্তি ও মূল্যবোধ। পরবর্তী বংশধরদের জন্য সাহিত্যের মধ্যে থাকে সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার। তবে সে উত্তরাধিকার যেমন কল্যাণকর হতে পারে, তেমনি অকল্যাণকরও হতে পারে। সন্তানের দেহে পিতামাতা যেমন সংক্রামক ব্যাধীর বীজ ছড়িয়ে মারা যেতে পারে, তেমনি শিশুর চেতনায় সংক্রামক অজ্ঞতা,পথভ্রষ্টতা বা কুসংস্কার রেখেও মারা যেতে পারে। শত শত বছর ধরে মানব সমাজে নানারূপ অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতা যে বেঁচে থাকে তা তো এমন পারিবারীক বিশ্বাস ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বা ধারাবাহিকতায়। নিকোবার ও পাপুয়া নিউগিনির মানুষ আজও যেরূপ উলঙ্গ ভাবে বনে জঙ্গলে জীবন কাটায় সেটি তো একারণেই। পূর্বপুরুষের লোকেরা পরিবারে অগ্নিপূজা, পুতুলপূজা, সর্পপূজা, লিঙ্গপূজা, গরুপূজার অজ্ঞতা ও অসভ্যতা রেখে মারা গেলে পরবর্তী বংশধরগণও গর্বভরে সেটাই অনুসরণ করে। সেটি বেঁচে থাকে দেশের আবহমান ধর্ম, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মাধ্যমে। ভারতের শত কোটি হিন্দুর মাঝে হিন্দু ধর্ম তো বেঁচে আছে এ কারণেই।  

মুসলিমদের কাজ তাই শুধু ইসলাম প্রচার নয়, বরং সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নামে যে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার মানুষকে পথভ্রষ্ট করে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে সেগুলির বিলুপ্তি ঘটানো। সে কাজটি যথার্থ ভাবে না হলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি। সাহিত্য ও সংস্কৃতির নামে পথভ্রষ্টতাও তখন প্রবলতর হয়।এমন এক অপরিহার্য তাগিদেই মিশর, ইরান, আফগানিস্তানের মানুষ ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে তাদের বহু শত বছরের পুরনো ভাষা, সাহিত্য ও ঐতিহ্যের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল। ইসলামের প্রবেশের আগে মিশরীদের নিজস্ব ভাষা ছিল, সে ভাষায় শত শত বছর ধরে ফিরাউনদের রাষ্ট্রও পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু মিশরীয়রা সে মাতৃভাষাকে দাফন করে আরবীকে গ্রহণ করেছিল। নিজস্ব ভাষা ছিল ইরানীদেরও, সেটি হলো ‘দারী’ ভাষা। সে ভাষায় সে আমলের বিশ্বশক্তি সাসানীদের রাজকার্য, ধর্ম-কর্ম ও শিক্ষার কাজ চলতো। কিন্তু ইরানীরা ইসলাম কবুলের সাথে সাথে ‘দারী’ বর্জন করে কুর’আনের শব্দ, উপমা ও দর্শন নিয়ে নতুন ভাষা ফার্সির জন্ম দেয়। ফার্সি ভাষার শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশী শব্দ আরবী ভাষা থেকে নেয়া।

ভারতে মুসলিমদের যখন আগমন ঘটে তখন এদেশে যে ভাষা বা সাহিত্য ছিল না তা নয়। তখন সংস্কৃত ভাষা ছিল, সে ভাষায় সাহিত্যও ছিল। তবে সংস্কৃত ভাষা ও সে ভাষায় রচিত রামায়ন, মহাভারত, বেদ,উপনিষদের কেচ্ছাকাহিনীপূর্ণ সাহিত্য দিয়ে চেতনা পূর্ণ করলে মুসলিমদের পক্ষে ঈমান বাঁচানোই অসম্ভব হত। ঈমান বাঁচাতে গিয়ে ভারতীয় মুসলিমগণ তাই নতুন ভাষা উর্দুর জন্ম দিয়েছে এবং সে ভাষায় বিশাল সাহিত্য-ভান্ডারও গড়ে তুলেছে। বস্তুত আরবী ও ফার্সির পর মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষা হলো উর্দু। তবে ভারতের মুসলিমগণ উর্দুর পাশাপাশি সাহায্য নিয়েছে আরবী ও ফার্সি থেকে। পাকিস্তানে পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পশতু ও বেলুচি ভাষা বিপুল সংখ্যক মানুষের মাতৃ ভাষা হলেও সে ভাষাগুলিতে মনের পুষ্টি জোগানোর মত জ্ঞানের ভান্ডারটি বিশাল নয়। ফলে কোন একটি আঞ্চলিক ভাষাাকে রাষ্ট্র ভাষা না বানিয়ে তারা উর্দুকে বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করেছে। অথচ উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরইও আঞ্চলিক ভাষা নয়। কিন্তু উর্দু যে ভারতীয় উপমহাদেশের নানা ভাষী মুসলিমের সম্মিলিত অবদানের ফসল –তা নিয়ে বিতর্ক নেই। উর্দু ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে যেমন পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বিহারী, মারাঠী, এলাহাবাদী, হায়দারাবাদী, ভূপালী, গুজরাতি তথা ভারতের নানা প্রদেশের মুসলিমদের অবদান রয়েছে, তেমনি বিশাল অবদান রয়েছে বাঙালি মুসলিমদের। বাংলার সকল মাদ্রাসার শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দু। বাঙালিগণ উর্দু ভাষায় বহু প্রসিদ্ধ কবিতা ও গ্রন্থ লিখেছেন। এক সময় করাচী, লাহোর, হায়দারাবাদ, এলাহাবাদ, পেশোয়ার বা যে কোন ভারতীয় শহরের তূলনায় উর্দু ভাষায় সবচেয়ে বেশী উর্দু পত্রিকা বের হতো বাংলার রাজধানী এবং সে সাথে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে।

পাকিস্তানীরা বুঝেছে ঈমান বাঁচানো ও দেশ বাঁচানোর জন্য উর্দু ভাষার বিকল্প পথ নেই্‌। পাঞ্জাবী, সিন্ধি ও পশতু ভাষার ন্যায় প্রাদেশিক ভাষার সে সামর্থ্য নাই। যদিও শিখদের রাজত্বকালে পাঞ্জাবী ভাষা রাষ্ট্র ভাষা ছিল। তারা এটিও বুঝেছে, জান-মাল, ইজ্জত-আবরু বাঁচায় পানাহার, ভাষা বা জলবায়ু নয়, বাঁচায় দেশ। দেশ বাঁচাতে ভাষার ক্ষেত্রে তাই আপোষ করতে  হয়। তখন গড়ে তুলতে হয় দেশ ব্যাপী লিঙ্গোফ্রাংকা। এদিক দিয়ে পাকিস্তান সফল। পাকিস্তানের পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচগণও উর্দুকে তাদের রাষ্ট্র ভাষা রূপে গ্রহণ করেছে। তবে তাতে তাদের মাতৃভাষা বিলুপ্ত হয়নি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর এটিই ছিল পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত। সে প্রজ্ঞা না দেখালে আজকের পাকিস্তান আনবিক শক্তিধারী এক শক্তিশালী রাষ্ট্র না হয়ে ৪ টুকরোয় বিভক্ত চারটি দুর্বল দেশ হতো। ভারতীয়রা এখনো তেমন কোন লিঙ্গোফ্রাংকা গড়ে তুলতে পারিনি। এ ব্যর্থতার জন্য ভারত দেরীতে হলেও একদিন ভেঙ্গে যাবে।

তবে সে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা বাঙালি মুসলিমগণ ১৯৫২ সালে দেখাতে পারিনি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় সেক্যুলারিজমের জোয়ার এবং ইসলামের শত্রুপক্ষের রাজনীতি এতোই শক্তিশালী হয়ে উঠে যে পাকিস্তান বাঁচানোই তাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। বরং বিপুল সংখ্যক মানুষ তখন পাকিস্তানের শত্রুতে পরিণত হয়। তাদের হাতেই শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে পাকিস্তান ধ্বংসের যুদ্ধ। সে যুদ্ধ ১৯৫২ সালে শুরু হয় এবং ১৯৭১ সালে শেষ হয়। সেক্যুলারিস্টদের কাছে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাটি গুরুত্ব পায়নি। ফলে গুরুত্ব পায়নি বাঙালি মুসলিমের ঈমানে পুষ্টি জোগানোর ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ  বিষয়টি। বরং ইসলামি চেতনার পুষ্টি বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার যে কোন প্রচেষ্টাকে বাঙালি সেক্যুলারিস্টগণ নিজেদের  জন্য বিপদ মনে করে। ফলে তারা বিরুদ্ধে খাড়া হয়। উর্দু ভাষাকে বাংলা ভাষার শত্রু রূপে চিত্রিত করে। ছাত্রদের ভয় দেখানো হয় উর্দু শিখলে বাংলা ভাষার মৃত্যু ঘটবে। যেন উর্দুর কারণে অবশিষ্ট পাকিস্তানে পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পশতু ও বেলুচ ভাষার মৃত্যু ঘটেছে। মিথ্যাচার আর কাকে বলে? এবং সে মিথ্যাচার নিয়েই শুরু হয় বাঙালিদের মাঝে উর্দু বর্জন। এবং রাজপথে নামানো হয় ছাত্রদের। তাতে রাজনীতির  ময়দানে বিজয়ী হয়েছে ইসলামের শত্রুপক্ষ।

বাংলা ভাষার দৈন্যতার কারণে ভয়ংকর পুষ্টিহীনতা শুরু হয় বাঙালি মুসলিমের বুদ্ধিবৃত্তি এবং ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠাতে। উর্দু ভাষায় দর্শনের যে সমৃদ্ধি -তা বাংলাতে নাই। কারণ উর্দু গড়ে উঠেছে মুসলিমদের হাতে। ফলে দ্রুত বুদ্ধিবৃত্তিক বৈষম্য সৃষ্টি হয় পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালী নাগরিকদের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের। বুদ্ধিবৃত্তিতে অবাঙালি পাকিস্তানীরা এগিয়ে যায়, বাঙালি পাকিস্তানীরা পিছিয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান ও বেলুচ জনগণ যেরূপ প্রাদেশিক পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে পাকিস্তানী মিল্লাতে পরিণত হয়েছে –সেটির কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে তাদের অগ্রসর অবস্থান। ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার মূল কারণটি অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়, বরং সেটি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিতে বেড়ে উঠার ক্ষেত্র দুই প্রদেশের জনগণের মাঝে বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে চরম বৈষম্য। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলিমের পক্ষে অসম্ভব হয় প্যান-ইসলামিক তথা কসমোপলিটন হওয়া। বস্তুত বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির কারণেই পাকিস্তান খণ্ডিত হওয়ার পরও এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গণতন্ত্র চর্চা ও মানবাধিকারের বিচারে পাকিস্তান আজ ৫৭ মুসলিম দেশের মাঝে প্রথম। অথচ বাংলাদেশ অনেক পিছনে।  গণতন্ত্র আজ বাংলাদেশে কবর শায়ীত। চলছে চরম ফ্যাসিবাদী অসভ্যতার তান্ডব। পাকিস্তান পারমানবিক শক্তির অধিকারি। তারা যুদ্ধ বিমান, ট্যাংক ও দূরপাল্লার মিজাইল বানায়। অথচ বাংলাদেশ একটি বন্দুকও তৈরী করতে পারে না। পাকিস্তান স্বাধীন, আর বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের রাডারের নীচে। মাথা তুলে দাঁড়ানোর উপায় নাই। ভারতের এক সাবেক সেনাপ্রধানের উক্তি: বাংলাদেশকে ভারতের রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবেনা।

দৈহিক পুষ্টিহীনতা দূর না হলে দেহ নিজ পায়ে খাড়া হওয়ার বল পায় না। বিবেকের অঙ্গণে পুষ্টিহীনতা ঘটলে দেশের শিক্ষিত জনগণ তখন অতিশয় বিবেকহীন, নীতিহীন এবং চরিত্রহীন হয়। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় ২০০টি রাষ্ট্রকে পিছনে ফেলে যে কারণে দুর্বৃত্তিতে ৫ বার প্রথম হয়েছে -সেটি পানাহারে কমতি বা দৈহিক পুষ্টিহীনতার কারণে নয়; বরং জ্ঞানের রাজ্যে এবং সে সাথে পুষ্টিহীনতার কারণে। আবর্জনার স্তুপে যেমন পোকামাকড় ও মশামাছি মোটা-তাজা হয়, তেমনি ইসলামশূণ্য সাহিত্যে প্রবলতর হয় জাতীয়তাবাদী, সমাজবাদী, নাস্তিকতাবাদী, ভারতসেবী, রুশসেবী, চীনসেবী এবং মার্কিনসেবীরা। বাংলাদেশের রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে আজও যেরূপ ভারতসেবী দাসদের বিজয় কেতন উড়ছে -তার মূল কারণ তো বাঙালি মুসলিমের আদর্শিক পুষ্টিহীনতা এবং তা থেকে সৃষ্ট ভয়ানক নৈতিক ভ্রষ্টতা। 

বিপদের মুখে বাঙালি মুসলিম

অতীতে মুসলিমগণ যেখানেই বসতি গড়েছে, সেখানে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা ও রাষ্ট্রই নির্মাণ করেনি, নতুন নতুন ভাষা এবং সে ভাষায় সমৃদ্ধ সাহিত্যেরও জন্ম দিয়েছে। কিন্তু ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে মিশর, ইরান, আফগানিস্তান, তুরস্ক এবং আজকের পাকিস্তানে যা কিছু ঘটেছে, বাংলাদেশে সেটি আদৌ ঘটেনি। বাঙালি মুসলিমদের মূল এবং ভয়ংকর বিপদটি এখানেই। আধুনিক বাংলা ভাষাটি গড়ে উঠেছে মূলত বাঙালি হিন্দুদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে। সেটির প্রমাণ মেলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে। বাংলা সাহিত্যের জন্ম বৌদ্ধদের দ্বারা। এবং সেটি চর্যাপদের মাধ্যমে। ১৯০৭ সালে হর প্রাসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয় পাঠাগারে ২৩ জন কবীর ৪৭টি চর্যাপদের সন্ধান পেয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের সেটাই প্রাচীন কাল এবং এ চর্যাপদগুলিই সে আমলের সাহিত্য-ভান্ডারের একমাত্র সঞ্চয়। বলা হয়ে থাকে, এগুলো রচিত হয়েছিল দশম শতাব্দীতে। কিন্তু এরপর বাংলা সাহিত্যে বৌদ্ধদের অবদান আর নজরে পড়ে না। সম্ভবতঃ এর কারণ হলো, হিন্দুদের দ্বারা ব্যাপক বৌদ্ধনির্মূল শুরু হলে তাদের দ্বারা সাহিত্য সৃষ্টি দূরে থাক, প্রাণে বাঁচাই কঠিন হয়ে পড়ে। তখন বাংলায় বৌদ্ধ পাল রাজাদের শাসনই শুধু বিলুপ্ত হয়নি, প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মও। জীবন বাঁচাতে বৌদ্ধরা তখন নেপাল, ভূটান, শ্রীলংকা, বার্মা ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেয়। শরণার্থী বৌদ্ধদের সাথে চর্যাপদগুলি নেপালে পৌঁছানোর ফলে সেগুলি বেঁচে যায়। এরপর শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগ। মধ্যযুগীয় সে সাহিত্যের প্রায় সবটুকুই বাঙালি হিন্দুদের সাহিত্য। সেটি বুঝা যায় সে সাহিত্যের উপকরণগুলির দিকে তাকালে। সেগুলি হলো: এক). বৈষ্ণব সাহিত্য, দুই). শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, তিন). বিদ্যাপতির পদাবলী, চার). চন্ডিদাশ পদাবলী, পাঁচ). মঙ্গল কাব্য, ছয়). সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অনুবাদ, সাত). মহাভারতের অনুবাদ, এবং আট). বাউল গান। সে সাহিত্যে স্থান পেয়েছিল শ্রীকৃষ্ণ, রাম, সর্প, মনসা, রামায়ন ও মহাভারতের কথা। বাঙালি মুসলিমদের পক্ষে সে সাহিত্য থেকে চেতনায় পুষ্টি লাভ দূরে থাক, সে গুলির ভাষা, উপমা ও চরিত্র থেকে অর্থ-উদ্ধারই দুরূহ। শুধু একালে নয়, সেকালেও সেগুলি দূর্বোধ্য ছিল। বাংলায় মুসলিমদের বিজয় ত্রয়দশ শতাব্দীতে হলেও মুসলিম কবিদের সাহিত্যচর্চার শুরু হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। প্রশ্ন হলো, ত্রয়দশ থেকে পঞ্চদশ এ দুইশত বছর ধরে বাঙলার মুসলিমদের চেতনায় পুষ্টি জোগানো হলো কি ভাবে? পঞ্চদশ শতাব্দীতে যে সাহিত্য রচনা শুরু হলো সে সাহিত্যই বা কতটা সমৃদ্ধ ছিল? পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম সারীর কবি হলেন শাহ মুহম্মদ ছগির। তিনি রচনা করেন ইউসুফ জুলেখা। পবিত্র কুর’আনে ইউসুফ জুলেখার বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু শাহ মুহম্মদ ছগির তার “ইউসুফ জুলেখা”য় যা লেখেন তা হলো তাঁর নিজস্ব কল্পনাপ্রসূত। এ আমলের অন্যরা হলেন দৌলত উজির বাহরাম খান, শাহ বারিদ খান, মুহম্মদ কবীর প্রমুখ। দৌলত উজির বাহরাম খান রচনা করেন লায়লী মজনু, শাহ বারিদ খান লেখেন বিদ্যাসুন্দর এবং হানিফা-কয়রপরী কাব্য। মুহম্মদ কবীর রচনা করেন মধু মালতী।দুই শতাব্দী ধরে মাত্র ৫ জন কবির হাতে রচিত হয় মাত্র ছয়খানি আখ্যানকাব্য। (সুত্র: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, ২০০৮; বাংলা একাডেমী প্রকাশিত)। মধ্য যুগে অন্যান্য মুসলিম কবিগণ হলেন আলাওল, সৈয়দ সুলতান, মুজাম্মিল, ফয়জুল্লাহ প্রমুখ। এ আমলে মুসলিমদের রচিত সাহিত্যের কলেবর যেমন নগন্য, তার চেয়েও নগন্য হল জনগণের উপর তার প্রভাব।

এর পর শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ। প্রাচীন ও মধ্য যুগের ন্যায় আধুনিক যুগের সাহিত্যকর্মের শুরুও অমুসলিমদের হাতে। শুরুর কাজটি এবারও ঘটে ধর্মীয় প্রয়োজনে। তবে সেটি খৃষ্টানদের হাতে এবং খৃষ্টান ধর্মের প্রচারের স্বার্থে। শুরু হয় শ্রীরামপুর মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে। খৃষ্টানগণই সর্বপ্রথম এদেশে ছাপা খানা গড়ে তোলে এবং পত্রিকার প্রকাশও শুরু করে। খৃষ্টানদের মাঝে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন উইলিয়াম কেরী। তাদের দ্বারাই সর্ব প্রথম গদ্য সাহিত্যের জন্ম।এ আমলের সাহিত্য জগতের উল্লেখযোগ্য তারকা হলেন রাজা রাম মহন রায়, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজ নারায়ন বসু, অক্ষয় কুমার দ্ত্ত, পেয়ারী চাঁদ মিত্র, কালী প্রসন্ন সিংহ, মাইকেল মধুসূদন, ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চ্যাটার্জী, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, বিহারীলাল চক্রবর্তী, দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোশাররফ হোসেন, শরৎচন্দ্র, সত্যন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, নজরুল ইসলাম, বিভূতি ভূষন বন্দোপাধ্যয়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যয়, মানিক বন্দোপাধ্যয় এবং আরো অনেকে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সাহিত্যিকদের রচিত গল্প, উপন্যাস, নাটক, কাব্য ও মহাকাব্যের মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোকে শক্তিশালী করা এবং তাদের কল্যাণচিন্তাকে বলবান করা। সে সাহিত্যের প্রভাবেই বাংলার হিন্দুদের মাঝে দেখা দেয় রেনাসাঁ। সেটি যেমন শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে, তেমনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও। মুসলিমের মনে পুষ্টি জোগানো দূরে থাক, সে সাহিত্যে মুসলিমদের উল্লেখটিও ছিল অতি সামান্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে উল্লেখগুলি ছিল মুসলিমদের চরিত্রহননের লক্ষ্যে। বরং বাস্তবতা হলো, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে মুসলিম সেটি হিন্দুদের রচিত মধ্য যুগীয় ও আধুনিক কালের বাংলা সাহিত্যে পড়লে বুঝাই যায় না। বাংলার মাঠঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, নগর-বন্দর ও অফিস-আদালতসহ সর্বত্র জুড়ে যেন শুধু হিন্দুই, মুসলিমের খোঁজ সে সাহিত্যে তেমন মেলে না। তাই মুসলিমদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় প্রয়োজন মেটোনোর সামর্থ্য  এ সাহিত্যের ছিল না। বরং বিস্তর সামর্থ্য  ছিল মুসলিমদের মনবল ভেঙ্গে দেয়ার। মীর মোশাররফ হোসেনের মত ব্যক্তিদের রচিত সাহিত্যও মুসলিমদের কল্যাণে কাজের কাজ কিছুই করেনি। বঙ্কিম চন্দ্র চ্যাটার্জী মীর মোশাররফ হোসেনের লেখা বই পড়ে বলেছিলেন, তাঁর লেখা পড়ে মনেই হয় না, সেটি কোন মুসলিমের লেখা। ইসলামের ইতিহাসের অতি বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটেছিল কারবালায়।কারবালার সে ঘটনাকে তিনি রংচঙ চড়িয়ে ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচনা করলেও সে গ্রন্থে কারবালার মূল শিক্ষাকে তিনি আড়াল করেছেন। কারবালার অতি করুণ ঘটনাকে তিনি প্রেমের কেচ্ছা বানিয়েছেন। সাহিত্যকে তিনি বিনোদনের বাহন বানিয়েছেন, জনগণের চেতনা ও দর্শনে সুস্থ্যতা বাড়ানোর কাজে তার অবদান তাই নগণ্য।

 চেতনায় প্রতিরোধ গড়ার কাজটি সাহিত্যের

মুসলিমের প্রতি কাজের মধ্যে থাকে ইবাদতের প্রেরণা। পরীক্ষার খাতায় প্রতি শব্দ লেখার মধ্যে যেমন থাকে পাশের চিন্তা, তেমনি ঈমানদারের প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি উচ্চারণ, প্রতিটি কর্ম ও প্রতিটি ভাবনার মধ্যেও থাকে আখেরাতে মুক্তির ভাবনা। তাই যারা ঈমানদার কবি-সাহিত্যিক তারা শুধু সাহিত্যিকই নন, সাধক, দার্শনিক এবং মুজাহিদও। কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আলতাফ হোসেন হালি, শেখ সাদী, মাওলানা রুমী তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সাহিত্যের মূল কাজ শুধু ঈমানে পুষ্টি জোগানো নয়, বরং অসুস্থ্য ভাবনা, মিথ্যা দর্শন, সামাজিক কুসংস্কার এবং অসত্য ও অধর্মের বিরুদ্ধে মানব মনে প্রতিরোধ বাড়ানো। ইসলামী সাহিত্য এভাবেই মানব মনে ভ্যাকসিনেশনের কাজ করে। সে ভ্যাকসিন ইম্যুনিটি বা প্রতিরক্ষা দেয় মিথ্যা, পাপাচার ও অধর্মের বিরুদ্ধে। পাপাচার কবলিত সমাজে সুস্থ্যতা নিয়ে বাঁচার জন্য এমন ইম্যুনিটি জরুরি । মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সম্পদ তেল গ্যাস নয়, জন-সম্পদও নয়। সেটি হলো পবিত্র কুর’আন-হাদীস, এবং সে কুর’আন-হাদীসের ভিত্তিতে রচিত ইসলামী সাহিত্য। এ সাহিত্য থেকে সে পায় ঈমানের বল। তেল-গ্যাসের অর্থে এমন ইম্যুনিটি আসে না। বরং বিপদ হলো, সাহিত্যের বদলে দেশে অপ-সাহিত্য গড়ে উঠলে সেটি অসুস্থ দর্শন, মিথ্যা মতবাদ, দুষিত সংস্কৃতি এবং পাপের বাহনও হতে পারে। বইয়ের পাতা বয়ে কোটি কোটি মানুষের চেতনায় তখন পৌঁছে বিষাক্ত বিষ। এমন বিষ প্রচণ্ড নেশাগ্রস্ততাও আনে। সে নেশাগ্রস্ততা হিরোইনের চেয়ে কম নয়। হিরোইনসেবীরা যেমন পুষ্টিকর খাদ্যে রুচি হারায়, তেমনি অপসাহিত্যের নেশাগ্রস্ত পাঠকগণ রুচি হারায় কল্যাণকর সাহিত্যে। জাতীয় জীবনে তখন বিপর্যয় নেমে আসে ভয়ানক ভাবে। কবি, নাট্যকার ও উপন্যাসিকের ছদ্দবেশে বাংলাদেশে এমন বিষ-ব্যাবসায়ীর সংখ্যাটি বিশাল। এরাই বাঙালির জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক মড়ক ডেকে এনেছে।  দূষিত খাদ্য-পানীয়ের ন্যায় দুষিত সাহিত্যও পরিহার এজন্যই জরুরি এজন্যই আরবের মুসলিমগণ ইমরুল কায়সদের মত কবিদের সৃষ্ট অসুস্থ্য ও অশ্লীল সাহিত্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।

অথচ অসুস্থ্য ও অশ্লীল সাহিত্য জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বাংলাদেশে। সাহিত্য পরিণত হয়েছে নিছক বিনোদনের মাধম্যে। কোন কোন ক্ষেত্রে সেটি প্রবল অশ্লীলতার আশ্রয়ে। ফলে এ সাহিত্য জনমনে ইম্যুনিটি না বাড়িয়ে বরং সেটির ব্যাপক বিনাশ ঘটাচ্ছে। এইডস একটি ভয়ানক রোগ। কারণ এ রোগটি দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বিলুপ্ত করে। সুস্থ্য মানুষ দীর্ঘকাল বাঁচে কোন ঔষধের গুণে নয়। বরং সেটি আল্লাহপ্রদত্ত প্রতিরোধ ক্ষমতার গুণে। সুস্থ্য দেহের নানা স্থানে লক্ষ লক্ষ জীবাণুর বাস, কিন্তু সেগুলি দেহের প্রতিরক্ষা বুহ্য ভেদ করতে পারে না। ফলে সে জীবাণুগুলো দেহে বছরের পর বছর বাস করলেও তা থেকে রোগ সৃষ্টি হয় না। কিন্তু এইডস রোগীর জীবনে এ দুর্বল জীবাণু গুলোই ত্বরিৎ মৃত্যু ডেকে আনে। চেতনা রাজ্যে তেমনি এইডস সৃষ্টি করে অপ-সাহিত্য। বাংলাদেশে সে বিনাশী কর্ম যে কতটা ভয়ানক ভাবে হচ্ছে সেটি বুঝা যায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দুরাবস্থা ও দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার দেখে।নৈতিক ইম্যুনিটি বিনষ্ট হওয়ার ফলেই বাংলাদেশ দূর্নীতে বিশ্ব-রেকর্ড গড়ছে।

নবীজী (সা:)’র আমলে মুসলিমগণ প্রথম ১৩টি বছর কাটিয়েছেন মক্কায়। সেখানে যেমন মদ-জুয়া ছিল, তেমনি উলঙ্গতা, অশ্লীলতা, দুর্বৃত্তি এবং ধর্মের নামে অধর্মও ছিল। সে সমাজ ছিল নৈতিক ব্যাধীতে পরিপূর্ণ। কিন্তু সেগুলি ঈমানদারদের স্পর্শ করতে পারেনি। ব্যর্থ হয়েছে তাদের মাঝে নৈতিক রোগ সৃষ্টি করতে। সেটি সম্ভব হয়েছিল তাদের চেতনায় প্রবল ইম্যুনিটির কারণে। আর সে ইম্যুনিটি প্রবল ভাবে বেড়েছিল আল-কুর’আনের জ্ঞানে। অতীতে ভারতে আগত শক, হুন, জৈন, আর্য-অনার্য -নানা ধর্মের মানুষ ভারতীয় হিন্দুদের মাঝে হারিয়ে গেছে। কিন্তু হারিয়ে যায়নি মুসলিমগণ। হারিয়ে যাওয়া থেকে মুসলিমগণ বেঁচে গেছে কুর’আনী জ্ঞানলব্ধ ইম্যুনিটির কারণে। কিন্তু সে ইম্যুনিটি বিনাশের লক্ষ্যে প্রচণ্ড আগ্রাসন শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। আর সে লক্ষ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে সাহিত্য।এবং সে সাথে জনগণকে পরিকল্পিত ভাবে দূরে সরানো হচ্ছে কুর’আন-হাদিসের জ্ঞান থেকে।

 সাহিত্য যখন শত্রুর হাতিয়ার

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, অমুসলিমের সাথে মুসলিমের পানাহার যেমন একত্রে চলে না, তেমনি সাহিত্যও একত্রে চলে না। কারণ উভয়ের প্রয়োজনটা যেমন ভিন্ন, তেমনি ভিন্ন হলো কোনটি ক্ষতিকর আর কোনটি উপকারি সে ধারণাটিও। মুসলিম ও অমুসলিমের পানাহার ভিন্ন ভিন্ন টেবিলে বা পৃথক কক্ষে হলে হালাল-হারামের বাছবিচারে এতটা মনযোগী না হলেও চলে। কিন্তু যখন সেটি হয় একই টেবিলে, তখন খাদ্য গ্রহণে ঈমানদারকে অত্যন্ত সতর্ক হতে হয়। তখন টেবিলের নানা কোন থেকে হালাল খাদ্যগুলো বেছে বেছে নিতে হয়। একাজে সামান্য অসতর্ক হলে হারাম খাদ্য ভক্ষণও অস্বাভাবিক নয়। তেমনটি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও। সাহিত্যের ক্ষেত্রে বাছবিচারের বিষয়টি সহজতর করতে গিয়েই দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সকল অবাঙালি মুসলিম শিক্ষার ভাষা, ধর্মের ভাষা ও সংস্কৃতির ভাষা রূপে উর্দুকে গ্রহন করেছে। উর্দুর আগে গ্রহণ করেছিল ফার্সিকে। আর হিন্দুরা গ্রহন করেছে হিন্দিকে। পাঞ্জাবের শিখরা তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ভাষা রূপে পাঞ্জাবীকে গ্রহণ করেছে। আর পাঞ্জাবের মুসলিমগণ গ্রহণ করেছে উর্দুকে। এভাবে ভারতীয় মুসলিমগণ গড়ে ভাষার নিরাপত্তা বুহ্য। কিন্তু এক্ষেত্রে ভিন্নতর হলে কেবল বাঙালি মুসলিমগণ। তারা প্রতিবেশী হিন্দুদের সাথে একত্রে বসে একই টেবিল থেকে তাদের নিজ চেতনার খাদ্যগুলো গ্রহণ করছে। এবং কোন রূপ বাছবিচার ছাড়াই। আর বাঙালি মুসলিমের জীবনে ভয়ানক বিপদটি ঘটছে এখানেই। সাহিত্য পাঠের নামে এখানেই ঘটছে বিষপান। এমন কি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতটিও নেয়া হয়েছে একজন পৌত্তলিক হিন্দু থেকে। সাহিত্যের মধ্য দিয়েই একটি চেতনা কথা বলে  তাই পৌত্তলিকের সাহিত্য এজন্যই ঈমানদারের সাহিত্য থেকে ভিন্নতর হয়। ইকবাল, গালিব, শেখ সাদী বা হাফিজের কবিতার মধ্য দিয়ে যেমন তাদের মুসলিম মানস কথা বলে, তেমনি রবীন্দ্র-সাহিত্যে গোপন থাকেনি তাঁর প্রচণ্ড হিন্দুত্ব ও মুসলিম বিদ্বেষ।   

রবীন্দ্রনাথ বাঙালি হলেও তার স্বপ্ন ছিল অখণ্ড ভারতব্যাপী হিন্দু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও হিন্দুত্বের বিজয়। তাঁর চেতনার সে মানচিত্রে মুসলিমের যেমন স্থান ছিল না, তেমনি ছিল না স্বাধীন বাংলাদেশের ধারণাও। গান্ধীর এক প্রশ্নের জবাবে তিনিই হিন্দি ভাষাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক নেতা না হলেও রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন বা অঙ্গীকার যে কতটা গভীর ছিল -সেটির প্রমাণ হল তাঁর সাহিত্য। তাঁর কাছে অনুকরণীয় মডেল রূপে যিনি স্থান পেয়েছিলেন তিনি কোন বাঙালি ছিলেন না। গান্ধিও নন। তিনি হলেন ভারত থেকে মুসলিম-নির্মূলের নায়ক শিবাজী। শিবাজীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাভরে তিনি ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা লেখেন। তাঁর মত কবি-সাহিত্যিক ও রাজনৈতিকদের উৎসাহে মারাঠার ন্যায় বাংলাতেও শিবাজী উৎসব শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের শিবাজী উৎসব কবিতার মধ্য দিয়ে সুস্পষ্ট প্রকাশ পায়, শিবাজীর প্রতি তার নিজের ভক্তি কতটা গভীর এবং তার হিন্দুত্ব কতটা প্রকট।

হিন্দু মারাঠাদের পরিচালিত মুসলিম নির্মূল প্রক্রিয়াটি মুসলিমদের মনে এতটাই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল যে হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভি (রহ:) তৎকালীন আফগান শাসক আহম্মদ শাহ আবদালীকে মারাঠাদের দমনে ভারতে আসতে আহবান জানান। সে সময় ছিল মোগল শাসনের মুমূর্ষ অবস্থা, মারাঠাদের হামলার মুখে মোগলদের অবস্থা তখন অসহায়। ভারতে মুসলিম শাসনের সে দুর্দিনে আহম্মদ শাহ আবদালী সেদিন মারাঠা শক্তি নির্মূল করে আফগানিস্তান ফিরে যান। ভারতের মুসলিম ইতিহাসে এ যুদ্ধটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মারাঠা শক্তি বিনাশের ফলেই ভারতীয় মুসলিমগণ সে যাত্রায় হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম নির্মূল প্রক্রিয়া থেকে বেঁচে যায়। নইলে ভারতীয় বৌদ্ধদের পরিনতি নেমে আসতো মুসলিমদের জীবনেও। কিন্তু উগ্র হিন্দুদের কাছে শিবাজী প্রতিষ্ঠা পায় মুসলিম বিরোধী রাজনীতির বীর পুরুষ রূপে। এবং সেটি রবীন্দ্রনাথের কাছেও। চরম মুসলিম-বিদ্বেষী আরেক মারাঠা শ্রী বাল গঙ্গাধর তিলক ১৮৯৩ সালে পুনা শহরে শিবাজীর জন্মস্থানে শিবাজী উৎসব প্রবর্তন করেন। শিবাজী পরিণত হন সারা ভারতে হিন্দু পুনরুজ্জীবনের প্রতীক রূপে। শিবাজী উৎসব আমদানী হয় কলিকাতা শহরেও। রবীন্দ্রনাথসহ অধিকাংশ হিন্দু বুদ্ধিজীবীগণই তাতে সাগ্রহে অংশগ্রহণ করেন।

 রবীন্দ্রনাথও বিস্মিত হতেন

হিন্দু জাগরণ, মুসলিম নির্মূল এবং অখণ্ড ভারতের বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের কাছে এতটাই বড় হয়ে দাঁড়ায় যে দস্যূ শিবাজীকে তিনি অতি শ্রদ্ধাভরে ‘জয়তু শিবাজী’ বলেছেন। এভাবেই দিনের আলোর ন্যায় সুস্পষ্ট হয় প্রচণ্ড মুসলিম বিদ্বেষী রবীন্দ্র মানস। বিস্ময়ের বিষয় হলো, সে রবীন্দ্রনাথের গানই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত! বাঙালি মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে চিনতেও। রবীন্দ্র মানসের প্রকৃত রূপটি বাঙালি মুসলিমদের জানা থাকলে তার গান কখনোই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রূপে গৃহীত হতো না। কারণ কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন কোন সভ্য মানুষই শত্রুর গানকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেয় না। বাঙালি মুসলিমের আচরণটি এক্ষেত্রে বোধহীন আহাম্মকের ন্যায়।

রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে মুসলিমদের মাঝে নিজের কদর দেখে তিনি নিজেও বিস্মিত হতেন। তাই সংকট শুধু বাংলা সাহিত্যের অঙ্গণে নয়, বরং গুরুতর সংকট বাঙালি মুসলিমের চেতনা রাজ্যে। তবে চেতনা রাজ্যের এই সংকটটির জন্ম সাহিত্যের সংকট থেকেই। এ সাহিত্য যেমন ইসলামের মহান সন্তানদের চিনতে সাহায্য করছে না, তেমনি সাহায্য করছে না পরম শত্রুদের চিনতে। এমন কি সাহায্য করছে না সুস্থ বিবেকবোধ ও চেতনা নিয়ে বেড়ে উঠতে। এমন সাহিত্য দিয়ে কি তাই সভ্যতার রাষ্ট্র ও সভ্যতা নির্মিত হয়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *