রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিক চেতনা এবং বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত

ফিরোজ মাহবুব কামাল

সংক্রামক রবীন্দ্র-চেতনা

মানুষ শুধু তার দেহ নিয়ে বাঁচে না। বাঁচে তার চেতনা নিয়েও। সে চেতনাটি নিয়ে এ জীবন ও জগতের সর্বত্র তার বিচরণ। সেটি যেমন ধর্ম-কর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও পোষাক-পরিচ্ছদে, তেমনি তার গদ্য, পদ্য, কথা ও গানে। কোন ব্যক্তিকে তার রুহ থেকে যেমন আলাদা করা যায় না,তেমনি আলাদা করা যায় না তার চেতনা থেকেও। মানুষ বেড়ে উঠে এবং তার মূল্যায়ন হয় সে চেতনার গুণে। ইসলামের পরিভাষায় সেটিই হলো তার ঈমান ও আক্বীদা। নামায-রোযা ও হজ-যাকাতের আগে রোজ হাশরে আল্লাহর কাছে প্রথমে হিসাব হবে ঈমান ও আক্বীদার। এখানে অকৃতকার্য হলে পাশের আর কোন সম্ভবনাই নাই। শত বছরের ইবাদত দিয়েও সেটি পূরণ হওয়ার নয়। মানুষের ধর্ম, কর্ম, সংস্কৃতি ও আচরনে বিপ্লব আসে তো ঈমান ও আক্বীদের গুণে। এখানে ভেজাল থাকলে ব্যক্তির ইবাদতে বা চরিত্রেও পরিশুদ্ধি আসে না। শিরক তো সে মহাবিপদই ঘটায়। রবীন্দ্রনাথের একটি বিশ্বাস ও চেতনা ছিল। এবং সেটি পৌত্তলিকতার।সে চেতনাটি প্রবল ভাবে ছড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানে। তাঁর রচিত নাটক,ছোটগল্প ও গানে। আলোচ্য নিবন্ধে তাঁর “আমার সোনার বাংলা গান” থেকেই তার কিছু উদাহরণ দেয়া হবে।

যক্ষা,কলেরা ও এ্যাইডসের ন্যায় শারীরীক রোগই শুধু সংক্রামক নয়, বরং অতি সংক্রামক হলো চেতনার রোগ। বাংলাদেশের ভয়ানক বিপদটি মূলতঃ এখানেই। বাংলাদেশ ৫ বার বিশ্বের সবচেয়ে দূর্বৃত্ত কবলিত দেশের যে শিরোপা পেল বা সম্প্রতি বিশ্ববাংক থেকে দূর্নীতির যে অপমানকর সার্টিফিকেট পেল এবং সেসাথে পদ্মা সেতু ঋণ থেকে বঞ্চিত হলো -সেটি যক্ষা, কলেরা ও এ্যাইডসের ন্যায় দৈহীক ব্যাধির কারণে নয়। বরং ব্যাধিগ্রস্ত চেতনা ও চরিত্রের কারণে। চেতনা রোগাগ্রস্ত হয় ভ্রান্ত ধর্ম ও দর্শনে। মানব জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোন বিষয় নাই। বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে একজন মুসলমানকে প্রতি নামাজের প্রতি রাকাতে সে ভ্রান্ত ধর্ম ও দর্শন থেকে বাঁচার জন্য দোয়া পাঠ করতে হয়। মহান আল্লাহর কাছে চাইতে হয় সিরাতুল মোস্তাকীম। সেটি সুরা ফাতেহা পাঠের মধ্য দিয়ে। অথচ এর বিপরীতে ছাত্র-শিক্ষক, নারী-পুরুষ সবার মধ্য রোগ ছড়ানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় খরচে। পৌত্তলিক চেতনায় বিশ্বের কোথাও উন্নত চরিত্র গড়ে উঠেছে বা উচ্চতর সভ্যতা নির্মিত হয় তার প্রমাণ নাই। সেটি তো আদিম জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতার পথ। ১৪০০ শত বছর আগেই নবীজী ও তার সাহাবাগণ আরবের বুকে এমন একটি চেতনার কবর রচনা করেছিলেন। অথচ তেমন একটি পৌত্তলিক চেতনাকে বাংলাদেশের বাঙালী জাতীয় সঙ্গিত রূপে মাথায় তুলেছে। রবীন্দ্রনাথের সংক্রামক পৌত্তলিক চেতনাটি ছড়ানো হচ্ছে তাঁর গানকে যেমন জাতীয় সঙ্গিত করে,তেমনি তাঁর রচিত গান,নাটক ও সাহিত্যকে জনগণের রাজস্বের অর্থে বিপুল ভাবে প্রচার করে। কোটি কোটি কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গিত গেয়ে এবং স্কুল-কলেজে তাঁর সাহিত্য পড়িয়ে যে কোন চারিত্রিক বা নৈতিক বিপ্লব আসে না এবং বাংলাদেশে যে বিগত ৪০ বছরেও আসেনি সেটি কি এখনও প্রমাণিত হয়নি?

মুসলমান হওয়ার প্রকৃত অর্থটি হলো প্রবল এক ঈমানী দায়বদ্ধতা নিয়ে বাঁচা। সে দায়বদ্ধতাটি প্রতি মুহুর্তের। বেঈমান থেকে ঈমানদারের মূল পার্থক্যটি এখানেই। বেঈমান ব্যক্তি মনের খুশিতে যা ইচ্ছা যেমন খেতে বা পান করতে পারে,তেমনি গাইতে, বলতে বা লিখতেও পারে। তার জীবনে কোন নিয়ন্ত্রন নাই।মহান আল্লাহর কাছে তার কোন দায়বদ্ধতার চেতনাও নাই। অথচ মু’মিনের জীবনে নিয়ন্ত্রন সর্বক্ষেত্রে। ঈমানের প্রথম আলামতটি শুরু হয় জিহ্ববার উপর নিয়ন্ত্রন থেকে। সে নিয়ন্ত্রনটি শুধু কালেমায়ে শাহাদত পাঠে সীমিত নয়। বরং সেটি তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যের উপর। তাই কোন ব্যক্তির কাফের হওয়ার জন্য মন্দিরে গিয়ে মুর্তিকে পুজা দেয়া প্রয়োজন পড়ে না। জ্বিনা,উলঙ্গতা,মদ্যপান বা সূদ-ঘুষে লিপ্ত হওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না,বরং জিহ্ববা দিয়ে আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কিছু বলা বা পৌত্তলিক চেতনাপূর্ণ কিছু উচ্চারণ করাই সে জন্য যথেষ্ট। তাই মু’মিন ব্যক্তিকে শুধু পানাহার,পোষাকপরিচ্ছদে বা ইবাদতে সতর্ক হলে চলে না,নিজের রচিত প্রতিটি গানে,কবিতায়,কথা বলায় বা লেখনিতেও লাগাতর সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়। কাফের ব্যক্তি নোবেল প্রাইজ পেলেও তার জীবনে সে ঈমানী নিয়ন্ত্রন থাকে না। কারণ বড় কবি হওয়া বা নোবেল প্রাইজ পাওয়ার জন্য সেটি কোন শর্তও নয়। ইমরুল কায়েসে মত এক কাফেরও আরবের অতি বিখ্যাত কবি ছিল। কিন্তু সে ইমরুল কায়েস মুসলমানদের কাছে গুরুর মর্যাদা পায়নি। তাই কাফের বক্তি যত প্রতিভাবানই হোক তাঁর গানকে মুসলিম দেশের জাতীয় সঙ্গিত বানানো যায় না। কারণ তাতে সংক্রামিত হয় তার কুফরি চেতনা। অথচ বাংলাদেশে তো সে বিপদটি প্রকট ভাবে ঘটেছে।

জাতীয় সঙ্গিতের অর্থ শুধু ভাব,ভাষা, ছন্দ এবং আবেগের প্রকাশ নয়। বরং এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় জাতির সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের আক্বিদা-বিশ্বাস,আশা-আকাঙ্খা,দর্শন,ভিশন ও মিশন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন “আমার সোনার বাংলা” গানটি লিখেছিলেন তখন বাংলাদেশ বলে কোন স্বাধীন দেশ ছিল না,বরং বাংলা ছিল ভারতের একটি প্রদেশ। সে প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও তাদের সংখ্যা আজকের ন্যায় শতকরা ৯০ ভাগ ছিল না। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ নিজেও সে গানটিতে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগ,দর্শন,চেতনা বা স্বপ্নের প্রকাশ ঘটাতে লেখেনি। সেটি যেমন তার লক্ষ্য ছিল না,সে লক্ষ্যে তাঁর প্রস্তুতিও ছিল না। বরং লিখেছেন একান্ত তাঁর নিজের ভাব ও আবেগের প্রকাশ ঘটাতে। ফলে সে গানে যা প্রকাশ পেয়েছে সেটি রবীন্দ্রনাথের একান্ত নিজের।বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নয়।রবীন্দ্রনাথ মুসলমান ছিলেন না। ফলে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিশ্বাস,দর্শন,স্বপ্ন,ভিশন ও মিশনের প্রতিনিধিত্ব করা বা সেগুলির প্রকাশ ঘটানোর সামর্থও তার ছিল না।

 

পৌত্তলিক রবীন্দ্র-চেতনা

পারিবারিক সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হলেও কার্যতঃ ছিলেন পৌত্তলিক মুশরিক। আর এ জগতটাকে একজন মুসলমান যেভাবে দেখে, একজন পৌত্তলিক সেভাবে দেখে না। উভয়ের বিশ্বাস যেমন ভিন্ন, তেমনি চেতনার জগতটাও ভিন্ন। আর কবিতা ও গানে তো সে বিশ্বাসেরই প্রকাশ ঘটে।একজন মুসলমানের কাছে এ পৃথিবীর ভূমি,আলোবাতাস,মাঠঘাট,গাছপালা,ফুল-ফল,নদী-সমুদ্র এবং সেগুলির অপরূপ রূপ –এ সবকিছুই মহান আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শন। এসব নিদর্শন দেখে সে মহান আল্লাহর কুদরত যে কত বিশাল সে ছবকটি পায়। ফলে স্রষ্টার এ অপরূপ সৃষ্টিকূল দেখে মু’মিন ব্যক্তি সেগুলিকে ভগবান বা মা বলে বন্দনা করে না,বরং হামদ ও নাত গায় সেগুলির সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর “আমার সোনার বাংলা” গানটিতে লিখেছেন:

আমার সোনার বাংলা,

আমি তোমায় ভালবাসি।

চিরদিন তোমার আকাশ,

তোমার বাতাস

আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।

ও মা,

ফাগুনে তোর আমের বনে

ঘ্রানে পাগল করে–

মরি হায়, হায় রে

ও মা,

অঘ্রানে তোর ভরা খেতে,

আমি কি দেখেছি মধুর হাসি।।

কি শোভা কি ছায়া গো,

কি স্নেহ কি মায়া গো–

কি আঁচল বিছায়েছ

বটের মূলে,

নদীর কূলে কূলে।

মা, তোর মুখের বাণী

আমার কানে লাগে

সুধার মতো–

মরি হায়, হায় রে

মা, তোর বদনখানি মলিন হলে

আমি নয়ন জলে ভাসি।।

রবীন্দ্রনাথের এ গানে ভাব আছে, ভাষা আছে, ছন্দও আছে। কিন্তু এর বাইরেও এমন কিছু আছে যা একজন মুসলমানের ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক। এ গানে তিনি বন্দনা গেয়েছেন বাংলার ভূমির,এবং সে ভূমির আলো-বাতাস,নদীর কূল,ধানের ক্ষেত,আমবাগান ও বটমূলের। কিন্তু যে মহান আল্লাহতায়ালা সেগুলির স্রষ্টা,সমগ্র গানে একটি বারের জন্যও তাঁর বন্দনা দূরে থাক তাঁর নামের উল্লেখ পর্যন্ত নাই।একজন পৌত্তলিকের জন্য এটিই স্বভাবজাত। পৌত্তলিকের এখানেই মূল সমস্যা। এখানে পৌত্তলিকের ভয়ানক অপরাধটি হলো নানা দেবদেবী ও নানা সৃষ্টির নানা রূপ বন্দনার মাঝে মহান আল্লাহকে ভূলিয়ে দেয়ার। এটিই তার শিরক। এবং এজন্যই সে মুশরিক। মহান আল্লাহর বান্দার বহু বড় বড় গোনাহ মাফ করে দিবেন কিন্তু শিরকের গুনাহ কখনই মাফ করবেন না। নবীজী (সাঃ) সে হুশিয়ারিটি বহুবার শুনিয়েছেন। পৌত্তলিক ব্যক্তিটি তার মনের গহীন অন্ধকারের কারণে এ পৃথিবীপৃষ্ঠে অসংখ্য সৃষ্টি দেখতে পেলেও সে সৃষ্টিকূলের মহান স্রষ্টাকে খুঁজে পায় না। রবীন্দ্রনাথও সে সীমাবদ্ধতার উর্দ্ধে উঠতে পারেননি। তাছাড়া গদ্য,পদ্য কবিতা ও গানের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির মুখ বা জিহবা কথা বলে না বরং কথা বলে তার চেতনা বা বিশ্বাস। ফলে সে কবিতা ও গানে ব্যক্তির আক্বিদা বা ধর্মীয় বিশ্বাস ধরা পড়ে। তাই “আমার সোনার বাংলা” গানে যে চেতনাটির প্রকাশ ঘটেছে সেটি পৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথের। কোন মুসলমানের নয়। গানে ইসলামী চেতনার প্রকাশের সামর্থ থাকলে তো রবীন্দ্রনাথ মুসলমান হয়ে যেতেন। পৌত্তলিক চেতনা নিয়েই একজন পৌত্তলিক কবি কবিতা ও গান লিখবেন বা সাহিত্যচর্চা করবেন সেটিই তো স্বাভাবিক। এমন একটি চেতনার কারণেই পৌত্তলিক ব্যক্তি শাপ-শকুন,গরু, বানর-হনুমান,নদ-নদী,বৃক্ষ,পাহাড়-পর্বতকে উপাস্য রূপে মেনে নেয় এবং তার বন্দনাও গায়।এ গানের ছত্রে ছত্রে তেমন একটি পৌত্তলিক চেতনারই প্রবল প্রকাশ ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের কলমে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে তাঁর নিজ চেতনার সাথে আদৌ গাদ্দারি করেননি। কিন্তু ইসলামি চেতনার সাথে একজন মুসলমানের গাদ্দারি তখনই শুরু হয় যখন পৌত্তলিক চেতনার এ গানকে মনের মাধুরি মিশিয়ে সে গাওয়া শুরু করে।

 

“আমার সোনার বাংলা” গানের প্রেক্ষাপট

“আমার সোনার বাংলা” গানটি রচনার একটি ঐতিহাসিক পেক্ষাপট আছে। গানটি রচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালের পর। বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয় ১৯০৫ সালে। পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় অর্থনীতি ও শিক্ষাদীক্ষায় অতি পশ্চাদপদ ছিল পূর্ব বঙ্গ। পূর্ববঙ্গের সম্পদে দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি ঘটছিল কোলকাতার। শুধু প্রশাসনই নয়,শিক্ষা ও শিল্প গড়ে উঠছিল শুধু কোলকাতাকে কেন্দ্র করে। মুসলমানদের দাবী ছিল বাংলাকে বিভক্ত করা হোক এবং পূর্ববঙ্গের রাজধানি করা হোক ঢাকাকে। সে দাবীর ভিত্তিতে ভারতের তৎকালীন ভাইস রয় লর্ড কার্জন পূর্ব বঙ্গ ও আসামকে নিযে একটি আলাদা প্রদেশ গঠিত করেন। এ নতুন প্রদেশের রাজধানী রূপে গৃহীত হয় ঢাকা নগরী। শহরটি রাতারাতি জেলা শহর থেকে রাজধানী শহরে পরিণত হয়। তখন ঢাকায় কার্জন হলসহ বেশ কিছু নতুন প্রশাসনিক ইমারত এবং হাই কোর্ট ভবন নির্মিত হয়। নির্মিত হয় কিছু প্রশস্ত রাজপথ। প্রদেশটি ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলার এবং সে সাথে আসামের মুসলমানদের মাঝে আসে নতুন রাজনৈতিক প্রত্যয়। ১৯০৬ সালে গঠিত হয় মুসলিম লীগ যা শুধু বাংলার মুসলমানদের জন্যই নয়, সমগ্র ভারতীয় মুসলমানদের মাঝে সৃষ্টি করে নতুন আত্মবিশ্বাস ও রাজনৈতিক চেতনা। মুসলমানদের এ রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং কোলকাতাকে ছেড়ে ঢাকার এ মর্যাদা-বৃদ্ধি কোলকাতার বাঙালী বাবুদের ভাল লাগেনি।কবি রবীন্দ্রনাথেরও ভাল লাগেনি। পূর্ব বাংলা পশ্চাদপদ মুসলমানদের প্রতি অগ্রসর বাঙালী হিন্দুদের কোন দরদ না থাকলেও খণ্ডিত বাংলার প্রতি তখন তাদের দরদ উপচিয়ে পড়ে। বাংলার মাঠঘাট,আলোবাতাস,জলবায়ু,বৃক্ষরাজী ও ফলমূলের প্রতি আবেগ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন এ গান। তাই এ গানের একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। সেটি বাংলার বিভক্তির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা। বাঙালী হিন্দুরা তখন অখণ্ড বঙ্গের দাবী নিয়ে রাজপথে নামে। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জ ভারত ভ্রমনে আসেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভারত উপলক্ষে “জনগণ মনোঅধিনায়ক ভারত ভাগ্যবিধাতা” নামে কবিতা লেখেন। ভারতের সেটিই আজ জাতীয় সঙ্গিত।

রবীন্দ্রনাথ ও  বাঙালী হিন্দুদের সে দাবী রাজা পঞ্চম জর্জ মেনে নেন এবং আবার বাংলা একীভূত হয়। প্রচণ্ড ক্ষোভ ও হতাশা নেমে আসে পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের মাঝে। বিক্ষুদ্ধ এ মুসলমানদের শান্ত করতে ভারতের ব্রিটিশ সরকার তখন ঢাকাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেয়।কিন্তু সেটিও কোলকাতার বাঙালী বাবুদের ভাল লাগেনি। তার মধ্যেও তারা কোলকাতার শ্রীহানীর কারণ খুঁজে পায়। ফলে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধেও বাঙালী বাবুগণ তখন রাজপথে নামেন। খোদ রবীন্দ্রনাথে মিছিলে নেমেছিলেন কোলকাতার সড়কে। এই হলো রবীন্দ্র মানস। সে সাথে বাঙালী হিন্দুর মানস। আর সে মানসকে নিয়ে রচিত সঙ্গিত এখন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত।

আজকের শতকরা ৯১ ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথের আমলের অবিভক্ত বাংলা যেমন নয়,তেমনি দেশটি ভারতভূক্তও নয়। রবীন্দ্রনাথের অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা ৫৫ ভাগের বেশী ছিল না। সে আমলের বাংলা ঢাকাকেন্দ্রীকও ছিল না। এখন এটি এক ভিন্ন চরিত্রের বাংলাদেশ -যে দেশে রবীন্দ্রনাথ একদিনের জন্যও বাস করেননি। কোনদিনও তিনি এদেশের নাগরিক ছিলেন না। এদেশের স্বাধীনতার কথা তিনি যেমন শোনেননি,তেমনি এ দেশের শতকরা ৯১ ভাগ মুসলমানদের নিয়ে তিনি কোন স্বপ্নও দেখেননি। ফলে বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়া,স্বাধীনতা বা স্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব করা কি তাঁর পক্ষে সম্ভব? তাছাড়া এ সঙ্গিতটি সে উদ্দেশ্যে লেখাও হয়নি। জাতীয় সঙ্গিত নির্বাচনের বিষয়টি দোকান থেকে ‘রেডিমেড’ সার্ট কেনার ন্যায় নয়। এটিকে বরং বিশেষ রুচী,বিশেষ আকাঙ্খা,বিশেষ প্রয়োজন মেটাতে অতি বিশেষ গুণের ‘tailor made’ হতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত নির্বাচনের ক্ষেত্রে সে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি। বরং এখানে গুরুত্ব পেয়েছে রবীন্দ্রভক্তি ও রবীন্দ্রপুঁজার মানসিকতা।

 

বড় ব্যর্থতা ও বড় বিদ্রোহ

বাংলাদেশের মুসলমানদের বড় ব্যর্থতা এবং সে সাথে মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহটি শুধু এ নয় যে,তারা রাষ্ট্রের বুকে সূদী ব্যাংক,পতিতাপল্লি,মদের দোকান,অশ্লিল ছায়াছবি এবং দেশের আদালতে কুফরি আইনকে আইনগত বৈধতা দিয়েছে এবং মেনে নিয়েছে। আরেক বড় ব্যর্থতা এবং মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে আরেক বড় বিদ্রোহ হলো জাতীয় সঙ্গিত রূপে গেয়ে চলেছে রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিক চেতনাপুষ্ট এ গানটিকে। যারা বেঈমান ও বিদ্রোহী হয় তাদের সে বেঈমানী ও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রেই। সেটি যেমন দেশের আইন-আদালতে কুফরি আইন অনুসরণে এবং রাষ্ট্রে পতিতাপল্লি ও সূদী ব্যংক বহাল রাখার মধ্যে,তেমনি মনের আবেগ ও মাধুারি মিশিয়ে জাতীয় সঙ্গিত রূপে পৌত্তলিক চেতনা সমৃদ্ধ গান গাওয়াতেও। মহান আল্লাহর সাথে তাদের সে বেঈমান-সুলভ গাদ্দারিটা তখন শুধু রাজনীতিতে সীমিত থাকে না,বরং সর্বক্ষেত্রেই সেটি ধরা পড়ে। মুসলিম সংহতির বুকে কুড়াল মারা এবং মুসলিম রাষ্ট্রের বিনাশের ন্যায় হারাম কাজটিও তখন এমন বিদ্রোহীদের কাছে উৎসবে পরিণত হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত রূপে এ গানটিকে যে শেখ মুজিব ও তাঁর দলবল নির্বাচন করেছিলেন ইসলামে সাথে তাদের গাদ্দারি কি কম পরিচিত? বাংলাদেশে ইসলামের নামে দলবদ্ধ হওয়া এবং ইসলামের শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে মুজিব সাংবিধানিক ভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামে কোরআনের আয়াত এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলাম ও মুসলিম শব্দগুলি তাঁর কাছে বরদাশত হয় হয়নি। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে যেমন কোরআনের আয়াতকে সরিয়েছেন,তেমনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে ইসলাম ও মুসলিম শব্দগুলিও সরিয়েছেন। তাই তাঁর হাতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল হয়ে যায় সলিমুল্লাহ হল। জাহিঙ্গরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যায় জাহ্ঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং নজরুল ইসলাম কলেজ হয় নজরুল কলেজ। মুজিবের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ পেয়েছিল ভারতকে খুশি করা,আল্লাহকে খুশি করা নয়।

ইসলামের বিরুদ্ধে মুজিবের শুরু করা সে যুদ্ধটি এখন চালিয়ে যাচ্ছে তার কন্যা শেখ হাসিনা ও দলীয় কর্মীরা। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ বা ভারতের হিন্দু কাফেরদের থেকেও তারা বেশী ইসলাম বিদ্বেষী। ব্রিটিশ ও হিন্দু ভারতে মুসলমানদের উপর ইসলামের নামে দল গড়ায় নিষেদ্ধাজ্ঞা কোন কালেই ছিল না এবং আজও  নাই। মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, জামায়াতে ইসলামীসহ বহু মুসলিম প্রতিষ্ঠান ভারতে আজও বেঁচে আছে মুসলিম নাম নিয়ে।অথচ মুজিব বেঁচে থাকতে সে অধিকার বাংলাদেশের মুসলমানদের তিনি দেননি। মুজিব ও তাঁর অনুসারিদের চেতনা যে সিক্ত ছিল রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিক চেতনায় -সেটি কি এ গানের নির্বাচন থেকেই সুস্পষ্ট নয়?

 

গুরুত্ব পায়নি মহান আল্লাহর নির্দেশ ও নবীজী (সাঃ)র সূন্নত

নবীজীর আমলেও আরব দেশে বিস্তৃত ভূমি,চন্দ্র-সূর্য্য ও আকাশ-বাতাস ছিল। সে ভূমিতেও মাঠ-ঘাট,ফুল-ফল ও বৃক্ষরাজিও ছিল। কিন্তু মহান নবীজী (সাঃ) কোন সময়ও কি সেগুলিকে মা বলে সম্বোধন করেছেন? বরং আজীবন হামদ-নাত ও প্রশংসা গীত গেয়েছেন সে সৃষ্টিকূলের মহান স্রষ্টার। আল্লাহর অনুগত বান্দাহ রূপে মুসলমানের বড় দায়িত্ব হলো আল্লাহর নামকে সর্বত্র প্রবল ভাবে প্রকাশ করা বা বড় করা। হেদায়াতপ্রাপ্তির চেয়ে ব্যক্তির জীবনে মহান আল্লাহর বড় নেয়ামত নেই। পথভ্রষ্ট হওয়ার চেয়ে এ জীবনে বড় ব্যর্থতাও নেই। হেদায়াত প্রাপ্তির শুকরিয়া জানাতে ঈমানদার ব্যক্তি আমৃত্যু তাই আল্লাহর মহিমা প্রকাশ করে। এ জন্য সর্বত্র আল্লাহু আকবর বলে। পবিত্র কোরআনে সেটির নির্দেশও রয়েছে। বলা হয়েছে,“তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন তোমরা আল্লাহর নামে তাকবির বল (অর্থাৎ আল্লাহ যে মহিমাময় সর্বশ্রেষ্ঠ সেটি মুখ দিয়ে প্রকাশ কর), যাতে তোমরা এভাবে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।” –সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৫। তাই মুসলমান “আল্লাহু আকবর” বলে শুধু জায়নামাজে তাকবির ধ্বণি দেয় না,রাজপথের মিছিলে বা জনসভাতেও দেয়। রাজনীতি,অর্থনীতি সংস্কৃতি,শিক্ষাদীক্ষা,কবিতা ও গানেও বলে। এটি শুধু তাঁর রাজনৈতিক শ্লোগান নয়, বরং ইবাদত। মুসলমান তাই কোথাও সমবেত হলে “জয় বাংলা” বা “জয় হিন্দ” বলে না বরং সর্বশক্তিতে গগন কাঁপিয়ে “নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার” বলে। একজন মুসলমান তো এভাবেই একজন কাফের বা মুনাফিক থেকে ভিন্ন পরিচয় নিয়ে ধর্মকর্ম,রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চা করে।কিন্তু বাংলাদেশের সেক্যুলার পক্ষের বড় সাফল্য হলো ইসলামের সে বিশুদ্ধ চেতনাকে বহুলাংশে তারা বিলুপ্ত করতে সমর্থ হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি,শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে প্রতিনিয়ত যে জয়ধ্বণিটি ঘোষিত হয় সেটি মহান আল্লাহর নয়,বরং শয়তানি বিধানের।

ব্যক্তির নাম থেকেই তার ধর্ম, চেতনা ও বিশ্বাসের পরিচয় জানা যায়। এ পরিচয়টুকু জানার জন্য তখন আর বাড়তি প্রশ্নের প্রয়োজন পড়ে না। সে নামটি আজীবন তার ধর্ম বা বিশ্বাসের পক্ষে সাইনবোর্ড রূপে কাজ করে। তেমনি জাতির জীবনে হলো জাতীয় সঙ্গিত। জাতীয় সঙ্গিত থেকেই পরিচয় মেলে জাতির ধর্মীয় বিশ্বাস ও চেতনার। তাই নাস্তিকের ও আস্তিকের ধর্মীয়,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন যেমন এক হয় না,তেমনি এক হয় না জাতীয় সঙ্গিতও। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিতটি নির্বাচনের একটি ইতিহাস আছে। সেটি গৃহীত হয়েছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর। যারা এ সঙ্গিতটিকে গ্রহণ করেছিল তারা ছিল বাঙালী জাতিয়তাবাদী সেক্যুলার। তাদের চেতনায় ও রাজনীতিতে ইসলামের কোন প্রভাব ছিল না। বরং তারা ইতিহাসে পরিচিতি পেয়েছে ভারতপ্রীতি,রবীন্দ্রপ্রীতি,এবং ইসলামি চেতনার নির্মূলে আপোষহীনতার কারণে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিও শেখ মুজিবের কোন শ্রদ্ধাবোধ ছিল না।তিনি যে শুধু রাজনীতিতে স্বৈরাচারি ছিলেন তা নয়।বরং প্রচণ্ড স্বৈরাচারি ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও। তাই দেশের উপর তিনি শুধু একদলীয় বাকশালই চাপিয়ে দেননি,বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসকে উপেক্ষা করে চাপিয়ে দিয়েছেন পৌত্তলিক সংস্কৃতির আগ্রাসনও। রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা” গানটিকে জাতীয় সঙ্গিত রূপে চাপানো হয়েছে তেমন এক স্বৈরাচারি মানসিকতা থেকে।

 

গুরুত্ব পায়নি বাঙালী মুসলমানের স্বপ্ন

প্রতিটি দেশের শুধু একটি রাজনৈতিক,ভৌগলিক ও ভাষাগত পরিচয়ই থাকে না,সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়ও থাকে।জনগণের চেতনায় যেমন সুনির্দ্দিষ্ট দর্শন থাকে,তেমনি সে দর্শনের আলোকে রাজনৈতিক স্বপ্নও থাকে।সভ্যতা নির্মানের সে দেশের জনগণের একটি গুরুতর দায়বদ্ধতাও থাকে। সে বিচারে প্রতিটি দেশই অনন্য।সে অনন্য বৈশিষ্ঠের কারণেই আজকের বাংলাদেশ পশ্চিম বাংলা থেকে ভিন্ন। এবং সে ভিন্নতার ফলেই পশ্চিম বাংলার ন্যায় বাংলাদেশ ভারতের অংশ নয়।পশ্চিম বাংলার সাথে বাংলাদেশের পার্থক্যটি এখানে ভূমি,জলবায়ু বা আলোবাতাসের নয়,বরং দর্শন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ভিশন ও মিশনের। পার্থক্যটি ভিন্ন স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার। সে ভিন্ন স্বপ্নের কারণেই ১৯৪৭য়ে পশ্চিম বাংলার হিন্দুগণ যখন ভারতে যোগ দেয় তখন পূর্ব বাংলার মুসলমানগণ অতি সচেতন ভাবেই বাঙালী হিন্দুদের সাথে প্রতিবেশী ভারতে যায়নি। গিয়েছে পাকিস্তানে। সাতচল্লিশের সে ভাবনার সাথে দেশের ৯০% ভাগ মুসলমানের সমর্থণ ছিল। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক শেখ মুজিবও সেদিন সে ভাবনার সাথে একাত্ম হয়েছিলেন। প্রতিবেশী বাঙালী হিন্দুদের সাথে না গিয়ে তারা তখন ১২০০ মাইল দূরের অবাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে গেছে।সেটি এক অনস্বীকার্য ইতিহাস।

বাঙালী মুসলমানদের যে প্রতিবেশী হিন্দুদের থেকে যে ভিন্নতর পরিচয় ও স্বপ্ন ছিল সেটি তাই ইতিহাসের গোপন বিষয় নয়। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত রচিত হতে হবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সে বিশিষ্ঠ পরিচয় ও স্বপ্নগুলো তুলে ধরতে এবং প্রবলতর করতে। এমন সঙ্গিতের প্রতিটি শব্দ ও প্রতিটি উচ্চারণ থেকে প্রতিটি নাগরিক তখন পাবে নতুন প্রত্যয় ও নতুন প্রেরণা। পাবে স্বপ্নের সে পথটিতে অবিরাম টিকে থাকার মানসিক বল। কিন্তু জাতীয় সঙ্গিতের নির্বাচনে বাংলাদেশের মুসলমানদের সে ভিন্নতর পরিচয়কে মেনে নেয়া হয়নি। এ সঙ্গিতে যে সুর,যে দর্শন,যে বর্ণনা এবং যে আকুতি ধ্বণিত হয়েছে সেটি কোন মুসলমানের নয়,সেটি নিতান্তই একজন পৌত্তলিকের। এমন সঙ্গিত থেকে মুসলমান অনুপ্রেরণা না পেয়ে পায় চরম পথভ্রষ্টতা। পায় শিরকের ছবক। যে ভ্রষ্টতার কারণে পৌত্তলিক মানুষটি বিষধর সাপকে দেবতা রূপে গ্রহণ করার অনুপ্রেরণা পায়,তেমনি এ সঙ্গিত পাঠকারি বাংলাদেশীও উৎসাহ পায় ভারতের ন্যায় একটি শত্রুদেশকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করায়।

 

ভারতীয় স্ট্রাটেজী ও অধিকৃতি

ভারত থেকে আলাদা মানচিত্র নিয়ে বাংলাদেশ বেড়ে উঠুক ভারত সেটি ১৯৪৭য়ে যেমন চায়নি,আজও  চায় না। ভারতের এ আগ্রাসী নীতি শুধু অধিকৃত কাশ্মির, হায়দারাবাদ,গোয়া,মানভাদড় বা সিকিমের ক্ষেত্রে নয়,বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। কাশ্মিরে ভারত যে ৭ লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী মোতায়েন করেছে সেটি সেখানে গণতন্ত্র বা অর্থনীতি বাড়াতে নয়। বরং ভারতের অধিকৃতি নিশ্চিত করতে। ভারত একাত্তরে যে বিশাল সামরিক বাহিনী নিয়োজিত করেছিল এবং যেরূপ আজ মোতায়েন করে রেখেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ময়দানে লক্ষ লক্ষ অনুগত এজেন্ট সেটিও বাংলাদেশে স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র বাড়াতে নয়। কাশ্মিরে ভারতের বিপদটি হলো সেখানে তারা কাশ্মিরীদের মধ্য থেকে এতটা সেবাদাস এজেন্ট পায়নি যতটা পেয়েছে বাংলাদেশে। ফলে এক কোটি মানুষের কাশ্মির দখলে রাখতে হাজার হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে পাঞ্জাব,রাজস্থান,বিহার,গুজরাত,মহারাষ্ট্র,উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশসহ ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে ৭ লাখ সৈন্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। সে সাত লাখ সৈন্যের পানাহার, চলাচল ও লজিস্টিকের পিছনে প্রতি বছর বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে বহু হাজার কোটি রুপি। অথচ সাড়ে সাত কোটি মানুষের পূর্ব পাকিস্তানে একাত্তরে এক লাখ পাকিস্তানী সৈন্যও ছিল না। কাশ্মিরে এক লাখ ভারতীয় সৈন্য পালতে যত অর্থ ব্যয় হয় তা দিয়ে বাংলাদেশে অন্ততঃ দশ লাখ দালাল পালা সম্ভব। এজন্যই বাংলাদেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি,মিডিয়া,প্রশাসন,সেনাবাহিনী,পুলিশ বাহিনী,শিক্ষাঙ্গণ,সংস্কৃতি ও আদালত প্রাঙ্গণে এত ভারতীয় দালালের ছড়াছড়ি।বাংলাদেশের মাটি এক্ষেত্রে অতি উর্বর। সে উর্বরতা বাড়িয়েছে বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেকুলারিস্টগণ। বাংলাদেশে আওয়ামী-বাকশালী দাসদের কারণে ভারত অতি অল্প খরচে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশকে অধিকৃত রাখতে পেরেছে। ফলে বাংলাদেশের বুক চিরে করিডোর নিতে বা দেশের সমূদ্রবন্দর ও নদীবন্দরের উপর দখল নিতে ভারতকে একটি তীরও ছুড়তে হয়নি।

 

জাতীয় সঙ্গিতের রাজনৈতীক এজেন্ডা


গলিত আবর্জনার স্তুপে যেমন অসংখ্য মশামাছি রাতারাতি বেড়ে উঠে তেমনি সেক্যুলারিজমের মাঝে বিপুল ভাবে বেড়ে উঠে ইসলামের দুষমনেরা। তখন সর্বত্র জুড়ে কিলবিল করে ভারতসেবী, মার্কিনসেবী, ইসরাইলসেবী দাস চরিত্রের ঘৃণীত জীব। তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাড়ে ইসলামের শত্রুপক্ষের সাথে রাজনৈতিক মিত্রতা। তাই ১৯৭১য়ে আওয়ামী বাকশালীরা মুসলিম দেশে কোন বন্ধু খুঁজে না পেলে কি হবে,মুসলিম নিধনকারি ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ায় তারা প্রচুর মিত্র খুঁজে পেয়েছে।অথচ দালালের আবাদ বাড়াতে কাশ্মিরে ভারত সে উর্বরতা পায়নি। কারণ, সেখানে রয়েছে প্রবল ইসলামী চেতনা। গড়ে উঠেছে  ভারত বিরোধী প্রচণ্ড বিদ্রোহ। ফলে বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারত যত সহজে নিরাপদ করিডোর এবং সমুদ্রবন্দর ও নৌবন্দর ব্যবহারের সুযোগ নিয়েছে,কাশ্মিরে ৭ লাখ সৈন্য মোতায়েন করেও যানবাহন চলাচলে সে নিরাপত্তা পায়নি। সে নিরাপত্তা পাচ্ছে না কোন শহরে বা গ্রামে। অথচ বাংলাদেশে তারা বাংলাদেশীদের চেয়েও পাচ্ছে অধিক নিরাপত্তা। ভারতীয় সীমান্তরক্ষির হাতে বাংলাদেশীরা অহরহ লাশ হলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয়দের সে বিপদ নাই। বিপুল সংখ্যক সেক্যুলারিস্টদের চেতনা-রাজ্য ইতিমধ্যেই ভারতের হাতে অধিকৃত। অখন্ড ভারতের বাইরে বাংলাদেশের আলাদা মানচিত্রকে যে গান্ধি, নেহেরু বা রবীন্দ্রনাথ শুরু থেকেই বিরোধীতা করেছিল তারা বরং এ ভারতভক্তদের কাছে পুঁজনীয়।

রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে বাংলার বিভক্তিকে মেনে নেননি। মেনে নেননি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকেও। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতায় তিনি রাজপথে নেমেছেন। কারণে তাতে মুসলমানদের কল্যাণের সম্ভাবনা ছিল।বাংলার অখণ্ড ভূগোল ১৯০৫ সালে তাঁর কাছে তখন পুঁজনীয় ছিল। “আমার সোনার বাংলা” গানটি লেখা হয়েছে তেমনি এক চেতনা নিয়ে। কিন্তু সে অখণ্ড ভূগোলকে রবীন্দ্রভক্ত বাঙালী হিন্দুগণই ১৯৪৭য়ে বিভক্ত করে। ১৯০৫য়ে বাংলাকে অখণ্ড রাখা এবং ১৯৪৭য়ে আবার খণ্ডিত করার মধ্যে তাদের রাজনীতি ছিল। সে রাজনীতির মূল লক্ষ্য হলো বাংলার এ ভূখণ্ডে বাঙালী হিন্দুর স্বার্থ সংরক্ষণ।তেমনি একটি আগ্রাসী রাজনীতি আছে রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা” গানটির পৌত্তলিক চেতনাকে বাংলাদেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়ায়।সে রাজনৈতিক লক্ষটি হলো,যে অখণ্ড বাংলার চেতনা নিয়ে ১৯০৫ সালে গানটি লেখা হয়েছিল সে দিকে ফিরিয়ে নেয়ার।

 

পৌত্তলিকতার আগ্রাসন ও সংকট

বাঙালী মুসলমানের চেতনা রাজ্যে ভারতের পক্ষে প্রবল অধিকৃতি জমানোর কাজটি করেছে সেক্যুলার বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা। ইমারত একবার নির্মিত হলে সেটিকে খাড়া রাখার খরচ অনেক কমে যায়। এমন চেতনা নির্মাণের কাজে ভারতের বিনিয়োগ ১৯৪৭ থেকেই। সেক্যুলার বাংলাদেশ নির্মাণের পর এখন ভারতের সে খরচ বিপুল ভাবে কমেছে। এখন সে কাজে ব্যয় হচ্ছে বাংলাদেশের মুসলমানদের নিজেদের রাজস্বের পুঁজি। ভারতের লক্ষ্য,নিজেদের সে প্রতিষ্ঠিত অধিকৃতিকে লাগাতর বজায় রাখা। বাংলাদেশের উপর ভারতের দখলদারিটি শুধু সামরিক, রাজনৈতিক বা অর্থনতিক নয়,বরং সাংস্কৃতিক।সে অধিকৃতিরই প্রতীক হলো জাতীয় সঙ্গিত রূপে চাপিয়ে দেয়া পৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথের গান। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অখণ্ড ভারতের ধ্বজাধারি। সে অখণ্ড ভারতের চেতনা থেকেই ভারত থেকে মুসলিম নির্মূলের প্রবক্তা মারাঠী শিবাজীকে তিনি জাতীয় বীরের মর্যাদা দিয়েছেন। শিবাজীকে বন্দনা করে তিনি কবিতাও লিখেছেন। গান্ধীকে পরামর্শ দিয়েছেন হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্র ভাষা করতে। এখন সে রবীন্দ্রনাথকে ভারত ব্যবহার করছে বাংলাদেশের উপর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের যোগসূত্র রূপে। এজন্যই বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা ও রবীন্দ্রঅর্চনা বাড়াতে ভারত সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকারের এত বিনিয়োগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের রাজস্বের অর্থে বাংলা এ্যাকাডেমীর কাজ হয়েছে প্রতিবছর পৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথের উপর শত শত বই প্রকাশ করা। অথচ ইসলামের মহান নবীজী(সাঃ)এবং মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানুষটির উপর কি এর দশ ভাগের এক ভাগ বই ছাপানোরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে?

বাংলাদেশের শিশু-সন্তান ও নাগরিকের বিরুদ্ধে বড় জুলুমটি নিছক রাজনৈতিক,প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক নয়। বরং সেটি আদর্শিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক। সে জুলুমের অংশ রূপেই একজন পৌত্তলিকের রচিত সঙ্গিতকে বাংলাদেশের মুসলমান নারীপুরুষ ও শিশুদের দিনের পর দিন জাতীয় সঙ্গিত রূপে গাইতে হচেছ,এবং ফলে তারা ব্যর্থ হচ্ছে জীবনের সে স্মরণীয় মুহুর্তগুলোতে মহান আল্লাহকে স্মরণ করতে। শয়তান তো এভাবেই মানুষের মনের ভূবনে অধিকৃতি জমায়। এবং পথভ্রষ্টতা বাড়ায় মহান আল্লাহর প্রদর্শিত সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে। জাতীয় সঙ্গিত পাঠের নামে এভাবেই পরিকল্পিত ভাবে ইসলামের মূল আক্বিদা ও শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে ছাত্র-ছাত্রী,শিক্ষক-সেনা এবং সাধারণ মানুষকে দূরে হটানো হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিই শুধু নয়,সাধারণ মানুষের চেতনার মানচিত্রও যে অভিন্ন ভাষা ও অভিন্ন সাহিত্যের নামে পৌত্তলিক হিন্দুদের হাতে অধিকৃত এ হল তার নমুনা। বাঙালী মুসলমানের চেতনায় ইসলাম তার সনাতন রূপ নিয়ে বেঁচে থাকলে পৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথের এ গান কি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত রূপে গ্রহণযোগ্যতা পেত?

বস্তুত সাহিত্য এবং সে সাথে জাতীয় সঙ্গিত পরিনত হয়েছে ঈমান ধ্বংসের এক নীরব হাতিয়ারে। ফলে পথভ্রষ্টতা বাড়ছে শুধু ধর্মপালনে নয়,বরং দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, আইন-আদালত ও প্রশাসনে।বাঙালী মুসলমানের জীবনে এভাবেই বাড়ছে মহাসংকট। দিন দিন বাড়ছে নবীজী (সাঃ)র আমলের সনাতন ইসলামের সাথে সাধারণ মানুষের দুরুত্ব। সে সাথে প্রবলতর হচ্ছে রাজনীতি,সংস্কৃতি ও প্রশাসনসহ দেশের সর্বত্র ইসলামের শত্রু পক্ষের অধিকৃতি।ফলে দেশ গড়ছে দূর্নীতিতে বিশ্ব রেকর্ড।বাড়ছে দুনিয়াব্যাপী দুর্নাম ও অপমান। ইসলামি রাষ্ট্র,আল্লাহর সার্বভৌমত্ব,শরিয়তি আইন, মুসলিম উম্মাহর একতা,প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভ্রাতৃত্ব এবং জিহাদ –ইসলামের এসব মৌলিক বিষয়গুলো চিত্রিত হচ্ছে সন্ত্রাসী চেতনা রূপে। প্রতিবেশী রোহিঙ্গা মুসলমানেরা হত্যা,ধর্ষণ,নির্যাতন থেকে প্রাণ বাঁচাতে এসেও বাংলাদেশে আশ্রয় পাচ্ছে না। একটি মুসলিম দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠির এর চেয়ে বড় অধঃপতন ও বিপর্যয় আর কি  হতে পারে? মহান আল্লাহর দরবারে মূক্তিই বা মিলবে কীরূপে? ১৫/০৭/২০১২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *