মুসলিম জীবনে জিহাদবিলুপ্তি ও পরাজয়

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 আক্রোশ কেন জিহাদের প্রতি?

দুর্বৃত্ত শাসনের বড় নাশকতাটি হলো, জিহাদের ন্যায় মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্মটিও তখন নিষিদ্ধ হয়। গুরুত্ব পায় দুর্বৃত্তির প্রতিষ্ঠা। এবং দুর্বৃত্তি নির্মূলের জিহাদী প্রচেষ্ঠাগুলো গণ্য হয় দন্ডনীয় অপরাধ রূপে। অথচ ইসলামে জিহাদ হলো, দুর্বৃত্তির নির্মূল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মহান আল্লাহতায়ার নির্দেশিত একমাত্র হাতিয়ার। এখানে বিনিয়োগ ঘটে ব্যক্তির মেধা, অর্থ, শ্রম, সময় ও রক্তের। রাষ্ট্র দুর্বৃত্তমুক্ত হয়, প্রতিষ্ঠা পায় শরিয়তী বিধান এবং মানব সভ্যতর হয় বস্তুত জিহাদের গুণে। নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিলে সেটি হয় না। লক্ষ লক্ষ মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়েও সেটি হয় না। পীরদের শত শত আস্তানা বা সুফি খানকা গড়েও সেটি হয় না। জিহাদ না থাকলে সমাজে দুর্বৃত্তির জোয়ার আসে। এবং তার উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। তাই সমাজের সকল দুর্বৃত্ত শক্তির আক্রোশ জিহাদের বিরুদ্ধে; নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিলের বিরুদ্ধে নয়। পীরদের আস্তানা বা সুফি খানকার বিরুদ্ধেও নয়।

জিহাদের বিরুদ্ধে সে প্রবল আক্রোশটি দেখা যায় বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সেক্যুলারিস্ট শিবিরে। তাদের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে সবচেয়ে বড় দুর্বৃ্ত্তিটি হলো, শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা। তাদের কাছে জিহাদের ন্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতটি গণ্য হয় ফৌজদারি অপরাধ রূপে। ফলে ঘরে স্রেফ জিহাদ বিষয়ক বই রাখাকে অপরাধ চিহ্নিত করে শত শত ছাত্রছাত্রীদের জেলে তোলা হচ্ছে। আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় গাদ্দারি এবং এর চেয়ে বড় বিদ্রোহ আর কি হতে পারে? বিস্ময়ের বিষয়, এমন একটি ইসলামবিরোধী সরকারও বেঁচে আছে দেশের মুসলিম জনগণের রাজস্বের অর্থে! বহুকোটি মানুষ তাদের ভোট দেয়। এবং তাদের সভা-সমাবেশেও হাজির হয়। ফলে ইসলামের বিরুদ্ধে গাদ্দারীটা শুধু সরকারের নয়, বিপুল সংখ্যক জনগণেরও। কথা হলো, এমন গাদ্দারী কি মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে পুরস্কার আনে? আনে কি নিয়ামত? বরং যা আনে তা হলো আযাব। আনে পরাজয় ও অপমান। তবে দুর্বৃত্ত শাসনের বড় আযাবটি হলো, ইসলামশূণ্যতা ও ঈমানশূণ্যতার জোয়ার। সে ইসলামশূণ্যতা ও ঈমানশূণ্যতার সুস্পষ্ট আলামতটি হলো শরিয়তী শাসনের বিলুপ্তি।

মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামতটি ধনসম্পদ নয়। ধনসম্পদ তিনি কাফেরদেরও দেন। সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামতটি হলো জান্নাতের পথে চলার হিদায়েত। সে হিদায়েত কখনোই জালেম, ফাসেক, অপরাধী এবং আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহী তারা পায় না। হিদায়েত প্রাপ্তির সবচেয়ে বড় আলামতটি হলো প্রতি মুহুর্তে শরিয়ত পালন নিয়ে বাঁচা এবং রাষ্ট্রে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দেয়া। যাদের জীবনে শরিয়তের পালন নাই এবং তা নিয়ে আগ্রহ নাই –বুঝতে হবে তারা হিদায়াত পায়নি। তাদের জীবনে নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত থাকতে পারে, কিন্তু তাদের চলার পথটি জান্নাতের পথে নয়। সেটি জাহান্নামের পথ। শরিয়তী শাসন হলো মহান আল্লাহতায়ালার জমিনে তাঁর সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এতে প্রকাশ পায় দেশবাসীর ঈমান ও মহাপ্রভুর কাছে তাদের আত্মসমর্পণ। শরিয়তের প্রতিষ্ঠা না থাকলে বুঝতে হবে, দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শয়তানের কর্তৃত্ব। এবং দেশবাসী ভুগছে প্রকট ঈমানশূণ্যতায়।

একমাত্র শরিয়তী শাসনই দেশে দুর্বৃত্তির বিলুপ্তি ঘটায়। পবিত্রতা আনে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে। এমন শরিয়তী শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল নবীজী(সাঃ) ও তাঁর সাহাবাদের শাসনামলে। ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্র পরিচালনের এটিই হলো সমগ্র মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মডেল। শরিয়ত শব্দের অর্থ হলো পথ। একমাত্র এ পথটিই হলো কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ এবং সে সাথে জান্নাতে পৌঁছার পথ। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোর’আনে এ পথকেই সিরাতুল মুস্তাকীম তথা সরল পথ বলেছেন। ফলে যে মুসলিম রাষ্ট্রে শরিয়ত নাই –বুঝতে হবে জনগণ সেখানে পথ চলছে সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত হয়ে শয়তানের পথে। এবং এ পথটি জাহান্নামে নেয়।

 

দুর্বৃত্ত শাসনের মূল নাশকতা

মানব জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়াটি হলো সিরাতুল মুস্তাকীম তথা জান্নাতের পথ পাওয়া। যে জান্নাত পেল, সেই এ জীবনে সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি পেল। আর মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সে পথ চাওয়ার দোয়াটি (ইহদিনাস সিরাতুল মোস্তাকীম) হলো মানব জীবনের সবচেয়ে বড় দোয়া –যা আল্লাহপাক পবিত্র কোর’আনে শিখিয়েছেন এবং নামাযের প্রতি রাকাতে সেটি পড়াকে বাধ্যতামূলক করেছেন। এবং মানব জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টি হলো, সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুতি তথা পথভ্রষ্টতা। সে বিচ্যুতি তথা পথভ্রষ্টতা বাড়ায় দুর্বৃত্তদের দুঃশাসন। এভাবে অনিবার্য করে জাহান্নাম। তাই মানবজীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টি সুনামী, ভূমিকমম্প, ঘূর্ণিঝড় ও মহামারি নয়, সেটি হলো দুর্বৃত্ত শাসন। সুনামী, ভূমিকমম্প, ঘূর্ণিঝড় ও মহামারির ন্যায় বিপর্যয়গুলো মৃত্যু ও যাতনা দেয়; কিন্তু জনগণকে সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে পথভ্রষ্ট করে না। জাহান্নামেও নেয় না। কিন্তু জাহান্নামে নেয় দুর্বৃত্তদের শাসন। তারা জাহান্নামে নেয় রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, প্রশাসন, মিডিয়া ও আইন-আদালতের মাধ্যমে সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে সরিয়ে। দুর্বৃত্তদের হাতে রাষ্ট্র পরিণত হয় জাহান্নামে নেয়ার বাহনে। এভাবে জীবনের সমগ্র বাঁচাটাই ক্ষতির কারণে পরিণত হয়। অনৈসলামিক শাসনের সবচেয়ে বড় বিপদ তাই স্রেফ দুর্নীতি, দুর্বৃত্তি, খুনখারাবী ও সন্ত্রাস নয়, বরং সেটি হলো এ দুনিয়ায় জাহান্নামের পথে চলা এবং পরকালে জাহান্নামে পৌঁছা। ব্যক্তি জীবনে হিদায়াত ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শরিয়তের শাসন -মহান আল্লাহতায়ালার এ দুটি শ্রেষ্ঠ নিয়ামত কখনোই তাঁর অবাধ্য ও বিদ্রোহীদের জুটে না। সেটি অর্জন করতে হয় আল্লাহর উপর অটল ঈমান ও তাঁর পথে অবিরাম জান ও মালের কোরবানী পেশ করে। মু’মিন সে কোরবানীটি পেশ করে জিহাদের ময়দানে। তাই জিহাদ থেকে দূরে থাকার অর্থ জান্নাতের পথ থেকে দূরে থাকা এবং জাহান্নামের যাত্রী হয়ে যাওয়া।  

দেশ যখন দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হয় তখন অপরাধ কর্ম শুধু চোর-ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের হাতে সীমিত থাকেনা। সমগ্র সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন তখন সকল রকম অপরাধ কর্মের হাতিয়ারে পরিণত হয়। চুরি-ডাকাতি, গুম, খুন ও সন্ত্রাসের পাশাপাশি তখন রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও প্রচারযন্ত্রের এজেন্ডা হয় জনগণকে পথভ্রষ্ট করা ও জাহান্নামে নেয়া। মানুষকে জাহান্নামের টানার শয়তানি এজেন্ডার সাথে রাষ্ট্রের এজেন্ডাও তখন একাকার হয়ে যায়। সে পথভ্রষ্টতাকে বাধাহীন করার স্বার্থেই দুর্বৃত্ত শাসক শ্রেণী কোর’আনের জ্ঞানদান ও ইসলামের প্রচারকে নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করে। নির্মূল করে ইসলামপন্থিদেরও। এটি শুধু অতীতের ফিরাউন, নমরুদ বা আবু জেহল ও আবু লাহাবদের নীতি নয়। সে নীতি আজকের ইসলাম বিরোধীদেরও। বাংলাদেশের বুকে তাদের সৃষ্ট সে পথভ্রষ্টতাটি তো বিশাল। রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তি জুড়ে চরম পথভ্রষ্টতার কারণেই নবীজী (সাঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদার শরিয়তি শাসনের বদলে শেখ মুজিবের স্বৈরাচারি শাসন তাদের কাছে পবিত্র গণ্য হয়। সাহাবায়ে কেরামের জিহাদের স্থলে বেশী ধর্মীয় মনে হয় মাজার পূজা, সুফিদের তরকিত, লালনের গান ও গ্রাম্য ফকিরদের মরমী সঙ্গিত। আর নানারূপ এ পথভ্রষ্টতাকে কন্টকহীন ও প্রতিরোধহীন করার স্বার্থেই তারা রাজনীতিতে ইসলাম নিষিদ্ধ করতে চায়।

 

ব্যর্থতা সুস্থ্য সংস্কৃতির নির্মাণে

বাংলাদেশের মুসলিমদের বড় ব্যর্থতাটি সংস্কৃতির নির্মাণে। সাংস্কৃতিক ব্যর্থতার কারণে চরম ব্যর্থতা আসে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ায়। মুসলিম সংস্কৃতির উপাদান কোন কালেই গান-বাজনা, নৃত্য, সংঙ্গীত ও ভাস্কর্য ছিল না। এগুলো তো মানুষকে আল্লাহবিমুখ করার ও পরকাল ভূলানোর সংস্কৃতি। এমন সংস্কৃতিতে সিরাতুল মোস্তাকীমে চলা গুরুত্ব পায় না। বরং গুরুত্ব পায় জীবনের আকন্ঠ উপভোগ। আর এ উপভোগটাই হলো সেক্যুলারিজমের মূল কথা। শরিয়তী বিধান এমন উপভোগে বাধা দেয় বলেই সেক্যুলারিস্টগণ শরিয়তের বিরোধ। বাংলাদেশে এমন সেক্যুলার সংস্কৃতির প্রসারে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগটি বিশাল। শয়তান মানুষকে মন্দিরে নিতে না পারলেও এরূপ সংস্কৃতির পথে টেনে কোটি কোটি মানুষকে সিরাতুল মোস্তাকীমে চলা থেকে রুখেছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গণগুলো এভাবেই শয়তানের মাদ্রাসা রূপে কাজ করে। এরূপ প্রজেক্ট বাংলাদেশে বিপুল ভাবে বিজয়ী। অথচ ইসলামের সংস্কৃতি হলো জিহাদের সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি যেমন দুনিয়ার বুকে জান্নাতের রাস্তা গড়ার সংস্কৃতি; তেমনি উন্নত মানব গড়ারও। অথচ বাঙালী মুসলিমের জীবনে সে সংস্কৃতি স্থান পায়নি। বরং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্তদের সংস্কৃতি। আল্লাহপাক এমন পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্তদেরকে সুরা ফাতেহা’তে (দোয়াল্লিন) পথভ্রষ্ট ও মাগদুব (অভিশপ্ত) বলেছেন। জান্নাত পাওয়ার জন্য সিরাতুল মোস্তাকীম পাওয়াটি যেমন জরুরি; তেমনি জরুরি হলো পথভ্রষ্টদের পথ থেকে বাঁচাটিও। তাই নামাযের প্রতি রাকাতে সিরাতুল মোস্তাকীম পাওয়ার দোয়া পাঠ যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনি বাধ্যতামূলক হলো পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্তদের পথ থেকে বাঁচার দোয়াটিও।

কিন্তু এক্ষেত্রে বাঙালী মুসলিমদের ব্যর্থতাটি বিশাল। তাদের জীবনে সিরাতুল মোস্তাকীমে চলার কাজটি যেমন সঠিক ভাবে হয়নি, তেমনি হয়নি পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্তদের পথ থেকে বাঁচাটিও। ফলে বাঙালী মুসলিমদের হাতে নির্মিত হয়েছে ১৪ শত বছরের মুসলিম ইতিহাসে সবচেয়ে কদর্য ইতিহাস। তারা যেমন দুর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়ে রেকর্ড গড়েছে, তেমনি রেকর্ড গড়েছে ঔপনিবেশিক কাফেরদের হাতে ১৯০ বছরের জন্য গোলাম হয়ে। আযাব তো এভাবেই আল্লাহতায়ালার অবাধ্যদের ঘিরে ধরে। আফগানদের সংখ্যা বাঙালী মুসলিমদের সিকি ভাগও নয়। কিন্তু তারা এক দিনের জন্যও কি কোন কাফের শক্তির শাসন মেনে নিয়েছে? অথচ সে দেশে কাফেরদের হামলা যে হয়নি -তা নয়। কিন্তু কাফের আগ্রাসন শুরুর সাথে সাথেই শুরু হযেছে প্রচন্ড প্রতিরোধ। সেটি হয়েছে আম জনতার পক্ষ থেকে। তারা যেমন বীরদর্পে ব্রিটিশ হামলার মোকাবেলা করেছে, তেমনি যুদ্ধ লড়েছে রুশ ও মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। প্রানদানে তারা পিছুপা হয়নি। অথচ বাংলাদেশে নির্মিত হয়েছে সম্পর্ণ বিপরীত সংস্কৃতি। সেটি হয়েছে নিজ দেশে কাফেরদের সামরিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দখলদারি প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। সেটিই প্রকট ভাবে হয়েছে ১৯৭১ সালে ভারতীয় কাফেরদের বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে। এবং সেটিকে জায়েজ করা হচ্ছে কাফেরদের বিজয়কে নিজেদের বিজয় রূপে জাহির করে।

 

সবচেয়ে বড় নেক কর্মটি

মুসলিম জীবনে সবচেয়ে বড় নেককর্মটি শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতিরক্ষা দেয়া। নবীজী (সা:)’র হাদীস: একাজে সামান্যতম মুহুর্ত ব্যয় করাও সারা রাতের নফল নামাযের চেয়ে উত্তম। এবং সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ার আযাবটি অতি হৃদয়বিদারক। তখন শত্রুর হাতে শুধু গণহত্যা ও ধর্ষণের শিকারই হতে হয় না, হারাতে হয় ঈমান-আমলও। সে ব্যর্থতার কারণে বিপদ চেপে বসেছিল স্পেন, রাশিয়া, চীন ও ভারতের বহু কোটি মুসলিমের জীবনে। শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ার দায়ভারটি শুধু বেতনভোগী সৈনিকদের নয়, বরং প্রতিটি ঈমানদারের। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের মোকাবেলার দায়ভারটি শুধু নবাব সিরাজদ্দৌলা ও তাঁর সেনাবাহিনীর ছিল না, ছিল প্রতিটি মুসলিমের। মুসলিমগণ যখন রোমান বা পারসিক সাম্রাজ্যের ন্যায় বিশাল বিশাল দেশের সামরিক বাহিনীর মোকাবেলা করেছে তখন মুসলিম বাহিনীতে কোন বেতনভোগী সৈনিকই ছিল না। তাদের সবাই ছিলেন যেমন নামাযী, তেমনি সবাই ছিলেন যোদ্ধা। কিন্তু বাঙলার মুসলিমদের আচরণ ছিল এর বিপরীত। শহিদ তিতুমীরের প্রতিরোধ ও ফকির বিদ্রোহের মত কিছু বিচ্ছিন্ন জিহাদ ছাড়া তারা যে শুধু দেশব্যাপী প্রতিরোধ জিহাদ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, বরং হাজার হাজার মুসলিম যুবক শত্রু সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছে। সেটি শুধু বাংলা বা ভারতের উপর ব্রিটিশ দখলদারিকে স্থায়িত্ব দিতে নয়, বরং ইরাক, সিরিয়া ও ফিলিস্তিনসহ এশিয়া-আফ্রিকার বহু মুসলিম দেশে সাম্রাজ্যবাদীদের দখলদারি বাড়াতে। অথচ এরূপ আত্মবিক্রীতদের অনেককেই বাঙালী মুসলিমদের জাতীয় গৌরবের প্রতীক গণ্য করা হয়। নিজ ধর্মের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা কতটা গভীর হলে সেটি হতে পারে -তা কি এরপরও বুঝতে বাঁকি থাকে?

 

শেষ হয়নি শত্রুর দখলদারী

মুসলিমদের দায়ভার শুধু ভৌগলিক মানচিত্রের উপর ইসলামের বিজয়কে সুনিশ্চিত করা নয়, বরং জনগণের চেতনার মানচিত্রেও সে বিজয়কে সুসংহত করা। প্রতিটি বিজয়ী সেনাবাহিনীই সেটি করে। ইংরেজগণ তাই শুধু বাংলার ভৌগলিক মানচিত্রের উপরই দখল জমায়নি, দখল জমিয়েছে বাঙালীর চেতনার মানচিত্রেও। ব্রিটিশের সামরিক দখলদারীটা ১৯৪৭ সালে শেষে হয়েছে। কিন্তু চেতনা রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত  সে দখলদারীটা এখনো প্রবল ভাবে বেঁচে আছে। শত্রুর সে বুদ্ধিবৃত্তিক দখলদারী হটিয়ে রাজনীতি, প্রশাসন, আইন-আদালত, অর্থনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির কোন একটি অঙ্গণেও ইসলাম বিজয়ী হতে পারিনি। ব্রিটিশের এ অব্যাহত দখলদারী বাঁচিয়ে রেখেছে বাঙালী সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী, বিচারক, আইনবিদ, রাজনীতিবিদ এবং সামরিক ও বেসামরিক সরকারি কর্মচারিগণ। সে লক্ষ্যে কাজ করছে বহু হাজার এনজিও নেতাকর্মীগণ। বাংলাদেশে ইংরেজগণ তাদের ১৯০ বছরের শাসনেও ঘরে ঘরে সূদ খাওয়া ও সূদ দেয়ার ন্যায় হারাম কাজের আাবাদ বাড়াতে পারিনি। কিন্তু এনজিওগুলোর কারণে সেটি সহজেই সম্ভব হয়েছে। অথচ সূদ খাওয়া ও সূদ দেয়া সামান্য পাপ নয়, নবীজী (সাঃ) সূদকে মায়ের সাথে জ্বিনার ন্যায় পাপ বলেছেন।–(হাদীস)। তাই কোন মুসলিম যেমন ব্যাভিচারি হতে পারে না, তেমনি সূদখোরও হতে পারে না। এটিই তো মুসলিমের ঈমান। কিন্তু মুসলিমের সে ঈমান এবং ইসলামের সে ভিত্তিমূলটি গুড়িয়ে দেয়ার কারণেই ইসলামের চিহ্নিত শত্রুরা ডক্টর ইউনূসকে নবেল প্রাইজ দিয়েছ, আর ব্রাকের ফজলে হোসেন আবেদকে দিয়েছে স্যার উপাধী। এরা যে শত্রুপক্ষের নিবেদিত প্রাণ যোদ্ধা -সেটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদেরকে পুরস্কার দিয়ে প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশের বুকে এরাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বেসামরিক সৈনিক। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সরকার থেকে এদের পকেটে শুধু বিপুল অর্থলাভই ঘটে না, লাগাতর উৎসাহ ও অনুপ্রেরনাও জুটে। এসব এনজিও সৈনিকেরা দেশে ও বিদেশের মাটিতে লাগাতর প্রশিক্ষণও পায়। এরাই দেশের সিভিল সোসাইটি নামে পরিচিত। এরা যেমন সেক্যুলারিস্ট তেমনি ইসলামবিরোধী। ক্ষমতাসীন সেক্যুলারিস্টদের পাশে এদের দৃঢ় অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের আদালতে এখনো পূর্ণ দখলদারী ব্রিটিশদের প্রবর্তিত কুফরি আইন ও তাদের রসম-রেওয়াজের। সে আইনে পতিতাবৃত্তি যেমন হালাল, তেমনি হালাল হলো সূদ, মদ ও জুয়া। মহান আল্লাহতায়ালার আইনের কোন দখলদারী সেখানে চলে না।

মহান আল্লাহতায়ালার আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চেয়ে তাঁর বড় অসম্মান আর কি হতে পারে? সাহাবায়ে কেরামের যুগে এমনটি কি কল্পনা করা যেত? শরিয়তের প্রতিষ্ঠা রুখাই যে তাদের মূল এজেন্ডা –সেটিও এ সেক্যুলারিস্টগণ লুকিয়ে বলে না। বরং গলা বাড়িয়েই বলে। শাসনতন্ত্রে আল্লাহর আইন দূরে থাক, মহান রাব্বুল আলামীনের নামটিও তাদের কাছে অসহ্য। ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদকে তারা ফাঁসির যোগ্য ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করে। অথচ মানবাধিকার রূপে গণ্য হচ্ছে পতিতাবৃত্তি, সমকামিতা, মদ্যপান, জুয়া ও সূদের ন্যায় পাপাচার। আল্লাহর দেয়া আলো-বাতাসে বাস করেও কাফেরগণ যেমন শয়তানের গোলামী করে, এরাও তেমনি মুসলিম ভূমিতে বাস করে গোলাম করে অমুসলিম সংস্কৃতি ও ধ্যান-ধারণার। মিশরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কর্তাব্যক্তি লর্ড ক্রমার এ শ্রেণীর মানসিক ও সাংস্কৃতিক গোলামদের নিয়ে বড় আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। ইসলামে অঙ্গিকারহীন এরূপ গোলাম শ্রেণী তৈরী না হওয়া অবধি কোন অধিকৃত মুসলিম ভূমিকে ব্রিটিশ সরকার যে স্বাধীনতা দিবে না -সে ঘোষণাও তিনি দিয়েছিলেন।

দেহের স্বাস্থ্য বাঁচাতে হলে শুধু ভয়ানক রোগজীবাণূগুলি চিনলে চলে না। সেগুলির নির্মূলে চিকিৎসাও জরুরী। তেমনি মুসলিম উম্মাহর স্বাস্থ্য বাঁচাতে হলে শুধু বিদেশী শত্রুদের চিনলে চলে না; ঘরের শত্রুদেরও চিনতে হয়। নবীজী (সাঃ)র আমলে শুধু চেনার কাজই হয়নি। নির্মূলের কাজও হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটিও কি যথার্থ ভাবে হয়েছে? হয়নি বলেই ঈমানবিনাশী ও দেশবিনাশী এসব ভয়ংকর জীবাণূগণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুধু ভোটই পায় না, হৃদয়েও স্থান পায়। জাতির নেতা, জাতির পিতা ও দেশের বন্ধু রূপেও গৃহিত হয়।    

 

জিহাদের বিধান  

মুসলিম দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আইন আদালত যখন ইসলামের শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃত হয়, জিহাদ তখন নামায-রোযার ন্যায় ফরজে-আয়ীন হয়ে যায়। হযরত আবু বকর (রাঃ)’র শাসনামলে কিছু লোক রাষ্ট্রীয় ভান্ডারে যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিলেন। আর তাতেই তাদের বিরুদ্ধে তিনি জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশের মুসলিমদের জিহাদ কোন প্রতিবেশী কাফের দেশ দখল করার নয়। বরং সেটি নিজ দেশকে ইসলামের শত্রুশক্তির দখলদারি থেকে মুক্ত করার। জিহাদ এখানে আল্লাহর পরাজিত বিধানকে পুণঃপ্রতিষ্ঠিত করার।এ জিহাদে যোদ্ধা হওয়া তাই প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ। অথচ সে পবিত্র জিহাদে যোদ্ধা হওয়াকেই সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ বলা হচ্ছে। জিহাদ নিয়ে এ ব্যাখাটি নিতান্তই শয়তানি শক্তির নিজস্ব। ইসলামের শত্রুপক্ষটি এরূপ প্রচার চালাচ্ছে একটি বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে। সেটি শুধু তাদের স্বৈরাচারি শাসনকে দীর্ঘায়ীত করার লক্ষ্যে নয়, বরং বাংলাদেশের বুকে বিদেশী কাফের শক্তির আগামী আগ্রাসনকে প্রতিরোধহীন করার লক্ষ্যে।

জিহাদই দেয় মুসলিম বাহিনীতে বিপুল লড়াকু জনবল। তখন সাধারণ প্রজারা নিজেদের অর্জিত অর্থ, খাদ্য এবং অস্ত্র সাথে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ছুটে। সেটিকে তারা জান্নাতে প্রবেশের দরোজা গণ্য করে। জিহাদ এভাবে জনগণের ব্যাপক ক্ষমতায়ন ঘটায়। প্রতিটি নাগরিক তখন যোদ্ধায় পরিণত হয় –যেমনটি নবীজী (সা:)’র আমলে হয়েছিল। সে ইতিহাস জানে বলেই ইসলামের শত্রুপক্ষের মনে এতো ইসলামভীতি ও জিহাদভীতি। জিহাদের চেতনা বিলুপ্তিতে এজন্যই তাদের এতো আয়োজন। বিলুপ্ত করতে চায় আলোচনায় জিহাদ শব্দের ব্যবহার। এমন কি আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ করতে চায় জিহাদকে। কারণ, জিহাদ নিষিদ্ধ হলে এ পবিত্র ইবাদতটি তখন আদালতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ রূপে গণ্য হবে। ভারতে যখন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের শাসন, তারাও নিষিদ্ধ করেছিল জিহাদকে। একই উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিন যক্তরাষ্ট্র মুসলিম দেশের স্কুল ও মাদ্রাসায় সিলেবাস বদলানোতে হাত দিয়েছে। 

বাঙালী সেক্যুলারিস্টদেরর চেতনার ভূগোলটি বহু আগেই ভারতীয় বা বিদেশী কাফেরদের চেতনার সাথে মিশে গেছে। এখন শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূগোল একাকার করার কাজটি বাঁকি। ভারতীয় বা পাশ্চাত্যের কাফেরদের ধ্যানধারণা ও সংস্কৃতির চেয়ে ইসলাম ও ইসলামের সংস্কৃতিই তাদের কাছে বেশী বিদেশী মনে হয়। অথচ আগ্রাসী ভারতীয়দের হাতে বাংলাদেশ একাত্তরের ন্যায় আবার অধিকৃত হলে বাঙালী মুসলমানদের জীবনে যে ভয়ানক আযাব ও অপমান নেমে আসবে তাতেও কি কোন সন্দেহ আছে? একাত্তরে অধিকৃত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী খেতাব জুটেছিল ভিক্ষুকের তলাহীন ঝুলির। এতবড় অপমান কোন কালেই কোন মুসলিম দেশের জুটেনি। সেটিই পরিমাপ দেয় আগ্রাসী ভারতীয়দের দস্যুবৃত্তি একাত্তরে কতটা নির্মম ছিল। কিন্তু পুণঃরায় অধিকৃত হলে আবার নেমে আসবে সে আযাব।

মুসলিম রাষ্ট্রের অতিক্ষুদ্র অঙ্গণকেও কাফেরদের হাতে অধিকৃত থাকতে দেয়ার বিধান ইসলামে নেই। না সামরিক ভাবে, না সাংস্কৃতিক বা আদর্শিক ভাবে। বাংলার নবাব যখন কয়েকটি গ্রামের মালিকানা ইংরেজদের হাতে তুলে দেয় তখন থেকেই শুরু হয় খাল কেটে কুমির আনার কাজ। তখন ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করে বাংলার উপর ইংরেজদের দখলদারি। একই ভাবে ধীরে ধীরে সমগ্র ফিলিস্তিন অধিকৃত হয়েছে ইহুদীদের হাতে। ধর্মীয়, আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগলিক ময়দানের কোন একটি ক্ষেত্রও যদি শত্রুশক্তির দখলদারিতে যায় তখন সেটি যে কতবড় ভয়ানক বিপর্যয় ঘটায় -এ হলো তার নমুনা। মুসলিমদেরকে তাই মুসলিম ভূমির প্রতি ইঞ্চি ভূমিকেই সুরক্ষা দিতে হয়। শুধু দেশের ভূগোল পাল্টালে চলে না, মনের ভূগোলও পাল্টাতে হয়। নিরংকুশ বিজয় আনতে হয় দেশবাসীর চিন্তা-চেতনা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গণেও। অথচ বাংলাদেশে সে বিজয় কোন কালেই অর্জিত হয়নি। বাঙালী মুসলিমের এখানেই বড় ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার কারণে, অনৈসলামিক চেতনা বেঁচে আছে বিপুল সংখ্যক মানুষের মনের মানচিত্রে।

ইসলামের জিহাদ শুধু সামরিক নয়, বুদ্ধিবৃত্তিকও। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে বাঙালী মুসলিম সৈনিকদের সংখ্যাটি অতি নগন্য। ফলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থিদের সবচেয়ে বড় পরাজয় এবং শত্রুশক্তির সবচেয়ে বড় দখলদারিটি ঘটেছে জনগণের চেতনার ভূবনে। চেতনার মানচিত্রটি এভাবে শত্রুশক্তির দখলে গেলে রাজনৈতিক মানচিত্রের উপরও কি দখলদারি থাকে? তখন পুরা দেশ পরিণত হয় শত্রুশক্তির অধিকৃত ভূমিতে।  রাষ্ট্রের উপর ইসলামের নিরংকুশ বিজয় নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার নিজের ঘোষণাটি হলোঃ “তিনিই সেই সত্ত্বা যিনি হিদায়েত ও সত্যদ্বীনসহ তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছেন। এবং সেটি এজন্য যে সেটি বিজয়ী হবে সকল দ্বীন তথা ধর্মের উপর।..”।–(সুরা সাফ, আয়াত ৯)। তাই বিজয় শুধু ভৌগলিক হলে চলে না, আদর্শিক ও ধর্মীয়ও হতে হয়। মুসলিম ভূমিতে তাই কোন রাজা, কোন স্বৈরাচারি শাসক বা কোন জনগোষ্ঠির সার্বভৌমত্ব যেমন প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না, তেমনি বৈধতা পেতে পারে না ইসলাম ভিন্ন অন্যকোন ধর্মমত বা মতাদর্শের বিজয়। বিজয়ী হওয়ার বৈধ অধিকার রাখে একমাত্র মহান আল্লাহর দ্বীন।

 

জিহাদবিলুপ্তি ও বিজয় হারাম রাজনীতির

আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার দায়ভার ফেরেশতাদের নয়, সে দায়ভারটি ঈমানদারদের। কারণ, এ পৃথিবী ফেরেশতাদের পরীক্ষাস্থল নয়; এখানে পরীক্ষা হয় তাদের যারা নিজেদের ঈমানদার রূপে দাবী করে। এবং  পরীক্ষাটি হয় অর্পিত দায়ভার পালনের মধ্য দিয়ে। এ কারণেই প্রতিটি ঈমাদার শুধু নামাযী ও রোযদাদর হলে চলে না, মুজাহিদও হতে হয়। মু’মিনের বাঁচার ভিশনটি কি, সে সাথে তাঁর রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির মিশনই বা কি –সেটি উপরুক্ত আয়াতটিতে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এরূপ একটি মিশনকে মু’মিনের জীবনে ফরজ করার জন্য পবিত্র কোরআনের উপরুক্ত ঘোষণাটি মাত্র একবার ঘোষিত হওয়াই যথেষ্ট ছিল। অথচ মহান আল্লাহতায়লা সেটি ঘোষণা শুনিয়েছেন তিন বার। অভিন্ন শব্দমালায় সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা তাওবা’র আয়াত ৩৩, সুরা ফাতাহ’র আয়াত ২৮ ও সুরা সাফ’র ৯ নম্বর আয়াতে। ইসলামকে বিজয়ী করার কাজে দেশে দেশে ও যুগে যুগে মু’মিনদের জীবনে যে লাগাতর লড়াই –সেটির ধর্মীয়, নৈতিক ও দার্শনিক যৌক্তিকতা তো মহান আল্লাহতায়ালার এ ঘোষণা।

ইসলাম-অনৈসলামের দ্বন্দে ঈমানদারের জন্য নিরব ও নিষ্ক্রীয় থাকাটি যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো নিরেপক্ষ থাকা। কারণ, তাতে ইসলামের বিজয় আসে না। এজন্য ফরজ হলো লড়াইয়ের প্রতি অঙ্গণে ইসলামের পক্ষ নেয়া। ইসলাম কবুলের সাথে সাথে ঈমানদারের জীবনে তাই নামায-রোযা ও হজ-যাকাতের সাথে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদও এসে যায়। সে সাথে কিতাল বা সশস্ত্র যুদ্ধও আসে। সেগুলি যেমন নবীজী (সাঃ)র জীবনে এসেছিল, তেমনি এসেছিল প্রতিটি সাহাবীর জীবনেও। মুসলিম নামধারী হয়েও যারা রাজনীতিতে ইসলামকে নিষিদ্ধ করতে চায়, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছে, নবীজী (সাঃ) বেঁচে থাকতে কার হাতে ছিল মুসলিম উম্মাহর রাজনীতি? কে ছিলেন ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান? কে পরিচালনা করতেন জিহাদ? তখন তো নিষিদ্ধ হয়েছিল তাদের রাজনীতি -যাদের লক্ষ্য জনগণকে জাহান্নামে নেয়া। এটি তো ভয়ানক অপরাধের রাজনীতি। তাদের এ অপরাধ তো চোরডাকাতদের অপরাধের চেয়েও ভয়ানক। চোরডাকাতগণ মানুষের অর্থে হাত দিলেও কাউকে জাহান্নামে নেয় না। এ কাজটি তো তাদের -যারা শরিয়তের প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে। নবীজী(সাঃ) ও সাহাবাযে কেরামের শাসনামলে মুসলিম ভূমিতে তাই এরূপ অপরাধীদের রাজনীতিকে কখনো অনুমতি দেয়া হয়নি। ইসলামের রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে বাংলাদেশের সেক্যেুলারিস্টগণ যা করতে চায় -তা হলো নবী-আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। শরিয়ত বিরোধীতার এ রাজনীতি শত ভাগ হারাম –যেমন হারাম হলো পতিতাবৃত্তি, মদপান, জুয়া ও সূদ। কোন মুসলিম দেশে এ রাজনীতি বৈধতা পেতে পারে না। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোতে এ হারাম রাজনীতিই বিজয়ী। আর এ হারাম রাজনীতির বিজয়ের মূল কারণ, মুসলিম জীবনে জিহাদশূণ্যতা। এবং একমাত্র জিহাদের মাধ্যমেই বিজয়কে আবার ফিরিয়ে আনতে পারে।

 

পরাজয় যে পথে অনিবার্য হয়

রাষ্ট্রের অঙ্গনে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হবে, না অন্য ধর্ম বা বিধান প্রতিষ্ঠা পাবে -সে ফয়সালাটি কখনোই মসজিদ-মাদ্রাসার মেঝেতে হয় না। পীরের খানকাহ, তাবলিগের ইজতেমা বা সূফির আস্তানাতেও হয় না। সেটি নির্ধারিত হয় জিহাদের ময়দানে। তাই ইসলামের বিজয় নিয়ে যাদের সামান্যতম ভাবনা আছে তারা কি কখনো নিজেদের ইবাদত-বন্দেগী মসজিদ-মাদ্রাসা, পীরের খানকাহ, সুফির আস্তানা বা তাবলিগী ইজতেমায় বন্দী রাখতে পারে? তারা তো সকল সামর্থ্য নিয়ে হাজির হবে জিহাদের ময়দানে। নবীজীকেও তাই বদর,ওহুদ¸খন্দক খায়বর ও হুনায়ুনের যুদ্ধের ন্যায় বহু যুদ্ধে নামতে হয়েছে। নামতে হয়েছে লাগাতর বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়েও।

ব্যক্তির যুদ্ধ, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি থেকেই ধরা পড়ে সে মূলত কোন পক্ষের। তাছাড়া কোন দল ও কোন মতাদর্শের প্রতিষ্ঠায় সে রায় দেয়, অর্থ দেয় বা শ্রম ও রক্ত দেয় –সেটিও কি গোপন থাকার বিষয়? মু’মিনের ঈমানদারি এবং কাফেরদের বেঈমানী তো এভাবেই প্রকাশ পায়। মদিনার মুনাফিকগণ নবীজী (সাঃ)’র পিছনে নিয়মিত নামায পড়েছে। কিন্তু তাদের মুনাফেকি ধরা পড়েছে রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধের ময়দানে। ইতিহাসের বড় শিক্ষা হলো, জনগণের জীবন থেকে যখনই জিহাদ বিলুপ্তি হয়, তখনই ইসলাম বিলুপ্ত হয় দেশের রাজনীতি,আইন-আদালত, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রশাসন থেকেও। দেশ এভাবেই অধিকৃত হয়ে যায় ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে। ইসলাম ও মুসলিমের পরাজয় তো এভাবে অনিবার্য হয়। এবং আজকের বাংলাদেশ তো তারই উদাহরণ। ১ম সংস্করণ ২২/০৩/২০১৪; ২য় সংস্করণ ০৪/০২/২০২১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *