বাঙালি মুসলিমের ভাষা আন্দোলন ও নাশকতার রাজনীতি

ফিরোজ মাহবুব কামাল

কি ছিল ভাষা আন্দোলনের মূল গোলপোষ্ট?

বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস বুঝতে হলে বুঝতে হবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। কারণ ভাষা আন্দোলন থেকেই যে বাংলাদেশের সৃষ্টি –তা নিয়ে দেশের সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক পক্ষগুলির মাঝে কোন বিরোধ নাই। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বুঝতে হলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস যেমন বুঝতে হবে, তেমনি বুঝতে হবে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও স্ট্রাটেজী। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার বুকে এরাই হলো প্রধান রাজনৈতিক শক্তি এবং বাংলাদেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতি নিয়ে বিশ্বের অন্য যে কোন জনগণের চেয়ে তাদের আগ্রহটাই হলো সর্বাধিক। বাংলাদেশে ভূ-রাজনীতিকে তারা যে নিজে দেশের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং তার উপর নজরদারী রাখে -সেটিও কোন গোপন বিষয় নয়। তাছাড়া ১৯৫২’য়ের ভাষা-আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে ভারতের হিন্দুত্ববাদী পক্ষটি পুরোপুরি একাত্ম ছিল। সেটি বুঝা যায় সে সময়ের ভারতীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ ও নিবন্ধের দিকে নজর দিলে।

ভাষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্যটি শুধু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি লাভ ছিল না। বরং মূল গোলপোষ্টটি ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা। সে লক্ষ্যে এ আন্দোলনের মূল স্ট্রাটেজী ছিল ভাষা আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের বাংলাভাষী নাগরিকদের মাঝে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ার সৃষ্টি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্বের উপর ভিত্তি করে। এ চেতনা ১৯৪৭ সালে বাঙালি, পাঞ্জাবী, বিহারী, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ, আসামী ইত্যাদি নানা ভাষী মুসলিমদের একতাবদ্ধ করেছিল। এবং এ চেতনা কখনোই জাতীয়তাবাদের জোয়ারে বাঁচে না। ফলে প্যান-ইসলামী চেতনার বিলুপ্তির অর্থই ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের বিনাশ। ইতিহাসের এ সহজ-সরল বিষয়টি পাকিস্তানের শত্রুদের অজানা ছিল না। তাই পাকিস্তানের শত্রুদের লক্ষ্য ছিল, ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগানো। সে সাথে উপমহাদেশের উদীয়মান মুসলিম শক্তির কোমর ভাঙ্গা। এবং ভারতকে উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়া। পাকিস্তানের শত্রুগণ যেমন দেশটির ভিতরে ছিল, তেমনি ভারতের ন্যায় দেশেও ছিল। ১৯৭১ সালে সে লক্ষ্যটিই পুরোপুরি অর্জিত হয়েছে।

ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশকে আর কখনোই ভারতের রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না। এর অর্থ: বাংলাদেশকে বাঁচতে হবে ভারতের নজরদারী ও অধীনতা মেনে নিয়ে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে আর কখনোই স্বাধীন পাকিস্তানের মত আরেক স্বাধীন দেশ হতে দেয়া হবে না। উক্ত ঘোষণাটি জেনারেল চৌধুরীর একার নয়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে এটিই হলো সকল ভারত সরকারের নীতি। সে নীতি গৃহীত হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধ শুরুর বহু আগেই, কিন্তু সে সময় এ মুসলিম ভূমি পাকিস্তানের অংশ থাকায় ভারত তার লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়নি। ভারতের সে আগ্রাসী অভিলাষ পূরণে সহযোগী হয় শেখ মুজিব ও তাঁর সহচরগণ। ভারতের সে অভিলাষ মেনে নিয়েই তাজুদ্দীন ৭ দফা ও মুজিব ২৫ সালা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। প্রতিদানে তারা ভারত থেকে চায় তাদের নিজেদের গদীর নিরাপত্তা। সম্প্রতি (আগষ্ট, ২০২২) বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেন দিল্লি সফরে গিয়ে ভারত সরকারের কাছে সে আবেদনটিই রেখেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি ভারত সরকারকে বলেছি, যে করেই হোক শেখ হাসিনাকে শাসনক্ষমতায় রাখতেই হবে। এর মধ্যেই ভারতের কল্যাণ।” বুঝতে হবে, বাংলাদেশ আজ এ পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বস্তুত ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টে মুজিব-শাসনের বিলুপ্তির পর স্বল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশ ভারতীয় রাডারের তথা নিয়ন্ত্রনের বাইরে গিয়েছিল। কিন্তু ভারত তাতে খুশি হয়নি। জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরীর কথা থেকে বুঝা যায়, ভবিষ্যতে ভারত আর কখনোই সেরূপ হতে দিবে না।

ভারতের ন্যায় আগ্রাসী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের খপ্পড় থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভাবে বাঁচার খরচটি বিশাল। সে খরচ জোগানোর সে সামর্থ্য ছিল না বলেই হায়দারাবাদ, জুনাগড়, মানভাদরের ন্যায় মুসলিম শাসিত দেশগুলিকে ভারতের পেটে বিলীন হতে হয়েছে। এবং কাশ্মীর আজও অধিকৃত। স্বাধীনতা বাড়াতে হলে দেশের ভূগোল বাড়াতে হয়। ভূগোল ক্ষুদ্রতর হলে বিলুপ্ত হয় স্বাধীনতা। স্বাধীনতার সে সামর্থ্য বাড়াতেই ১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীন ভাবে বাঁচার সামর্থ্য বাড়াতে পাকিস্তানকে পারমানবিক বোমা, দূরপাল্লার মিজাইল, উন্নত ট্যাংক ও যুদ্ধ বিমান নিজ দেশে বানাতে হয়েছে। মুসলিম বিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন এ বাংলাদেশকে ভারতের অধীনতা থেকে বাঁচাতে আর কোন অবাঙালিই যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসবে না। একাত্তর-পরবরর্তী বাংলাদেশের এটিই হলো সবচেয়ে করুণ বাস্তবতা। তবে যারা ভারতীয় স্বার্থের সেবাদাস, তারা স্বাধীনতা নিয়ে ভাবে না। তারা ভাবে প্রভুকে কীরূপে আরো খুশি রাখা যায়, খুশি করে ক্ষমতায় থাকা যায় -তা নিয়ে। পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেনর মুখ থেকেই সেটিই উচ্চারিত হয়েছে। তাই ভারতে বিজিপি নেতা-নেত্রীদের পক্ষ থেকে নবীজী (সা:) বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা হলে সারা মুসলিম বিশ্বের সরকারগণ সেটির কড়া প্রতিবাদ করলেও, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীরব থাকে এবং খুনী নরেন্দ্র মোদীকে সর্বোৎকৃষ্ট আমের ভেট পাঠায়। কারণ, মনিবের নিন্দা করার সাহস অনুগত দাসদের থাকে না। 

 

ষড়যন্ত্রটি মুসলিমের শক্তি বিনাশে

ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই যে পাকিস্তান খন্ডিত হয়েছে –সে কথাটি এখন বাঙালি সেক্যুলারিস্টগণ, হিন্দুত্ববাদী শক্তি ও কম্যুনিস্টগণ অতি গর্বের সাথেই বলে। ভাষা আন্দোলনের মধ্যই ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার বীজ এবং বিষ ঢালা শুরু হয় প্যান-ইনসালিম চেতনার বিনাশে –সে চিত্রটি দেখা যায় ভাষা আন্দোলনের গবেষক বদরুদ্দীন উমরের বইতে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শুরু থেকেই পাকিস্তানের সংহতিকে বিপন্ন করার এজেন্ডা নেয় কম্যুনিষ্ট পার্টি এবং ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের ন্যায় ভারতী কংগ্রেসের সে সব হিন্দু সদস্যগণ যারা ১৯৪৭’য়ে ভারতে না গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যায়। বদরুদ্দীন উমর নিজে কম্যুনিষ্ট পার্টির সদস্য ছিলন। তিনি তাঁর বইতে লিখেছেন কম্যুনিষ্ট পার্টির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক আবুল কাশেম তমদ্দুন মজলিস নামক একটি সংগঠন গড়ে তোলেন ভাষা আন্দোলনের এজেন্ডাকে সামনে এগিয়ে নিতে। অথচ এক্ষেত্রে উল্লেখ্য হলো, উর্দু যে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে -সে সিদ্ধান্তটি কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর একার ছিল না। সে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভায় পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই। কারণ, উর্দুই হলো একমাত্র ভাষা যা পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশের শিক্ষিত মুসলিমদের মাঝে গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছিল। বাংলা ভাষার সে মর্যাদা ছিল না। উর্দু ছাড়া উপমহাদেশের সবগুলি ভাষাই হলো প্রাদেশিক। আজও ভারতীয় হিন্দুদের মাঝে হিন্দিসহ কোন ভাষারই সে সর্বভারতীয় মর্যাদা নাই।  

বাংলাদেশ আজ যেরূপ ভারতের রাডারের নীচে অধীনত গোলাম রাষ্ট্র –সে লক্ষ্যে পৌঁছার পরিকল্পনাটি নেয়া হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে। কারণ, সে আন্দোলনের ময়দান থেকেই ভারত তার পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র নিয়ে এগুনোর পার্টনার পেয়ে যায়। ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য শুধু রাষ্ট্র ভাষা রূপে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি লাভ হলে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে সে স্বীকৃতি দানের পর প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রেয়ারীতে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে বাংলা ভাষা ও বাঙালির শত্রু রূপে চিত্রিত করার চেষ্টা থেমে যেত। কিন্তু সে চেষ্টা থামেনি বরং দিন দিন প্রবলতর করা হয়েছে এবং আজও সে একই কথা বলা হয়। ভারত কখনোই ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে মনেপ্রাণে মেনে নেয়নি। এবং কখনোই চায়নি পাকিস্তান বেঁচে থাকুক। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ভারতে  চলছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার গোপন ষড়যন্ত্র। ভাষা আন্দোলন তাদের সে ষড়যন্ত্রকে আরো বলবান করে এবং সামনে নিয়ে আসে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও কম্যুনিস্ট পার্টির সেসব নেতাকর্মীগণ পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যায়, রাজনীতিতে তারা একদিনের জন্যও নীরব ও নিষ্ক্রিয় ছিল না। ১৯৫২ সালে রাজনীতিতে তারা নতুন এজেন্ডা পেয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে তারা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে রুখেতে পারিনি। কিন্তু তারা সফল হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার রাজনীতি। সে এজেন্ডা পূরণে মোক্ষম হাতিয়ার রূপে কাজ দেয় বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন।

যে কোন ভাষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি রাখে সেদেশের শিক্ষিত সুধিজন, এক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং প্রশাসনের ভূমিকা অতি সামান্য। ভাষার উন্নয়ন নির্ভর করে সে ভাষাতে বুদ্ধিবৃত্তি, লেখালেখি ও সাহিত্য চর্চার কাজ কতটুকু হলো তার উপর। রাষ্ট্রের কাজ তো সাহিত্যচর্চা বা বুদ্ধিবৃত্তি নয়। রাষ্ট্র ভাষাকে ব্যবহার করে নিছক কথাবার্তা, হুকুমনামা, দলিল ও নথিপত্র লেখার কাজে। ভারতের বুকে কোন কালেই বাংলা ভাষা কোন দেশ বা প্রদেশের রাষ্ট্রভাষা ছিল না, এখনো নয়। তাতে কি বাংলা ভাষার উন্নয়ন থেমে গেছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের বুকে যে ভাষাটির সমগ্র ভারত ব্যাপী সবচেয়ে দ্রুত প্রসার ও উন্নয়ন ঘটেছে সেটি হলো উর্দু। পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম এবং কাশ্মীর থেকে মাদ্রাজ পর্যন্ত ভারতের সকল শিক্ষিত মুসলিমই এ ভাষাটি বুঝতো। এমন কি অনেক হিন্দুও উর্দু ভাষায় সাহিত্য চর্চা করতেন। উর্দুর তূলনায় হিন্দি ভাষার তেমন উন্নয়ন ঘটেনি। হিন্দি ভাষাটি সীমিত রয়েছে উত্তর ভারতের গরু-বলয়ে অর্থাৎ উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, হরিয়ানা ও উত্তরখন্ডে। উর্দু ভাষার এরূপ উন্নয়নে দেখে হিন্দুত্ববাদীগণ আফসোস করতো তারা মুসলিমদের মত এমন একটি সর্ব-ভারতীয় সমৃদ্ধ ভাষার জন্ম দিতে পারিনি। উর্দু ভাষার এতো দ্রুত উন্নয়নের পিছনে কাজ করেছিল মুসলিমদের মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি। হিন্দুদের  কাছে মুর্খ বা অজ্ঞ থাকা কোন পাপ নয়, কিন্তু মুসলিমদের কাছে অজ্ঞ থাকা কবিরা গুনাহ। জ্ঞানার্জন প্রতিটি নর-নারীর উপর নামাজ-রোজার ন্যায় ফরজ তথা বাধ্যতামূলক। হিন্দু ধর্মে সেরূপ বিধান নাই। মুসলিমদের ভাষায় এজন্যই দ্রুত উন্নয়ন ঘটে। আরবীতে কুর’আনের আগে কোন গ্রন্থ ছিল না। ইসলাম কবুলের সাথে সাথে আরবগণ আরবী ভাষাকে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত করে। তেমনি ঘটেছে উর্দুর সাথে। পরবর্তীতে কুর’আন, হাদীস ও নবীজী (সা:)’র যেরূপ গবেষণা উর্দুতে হয়েছে তা আরবী, ফারসী, তুর্কী বা বিশ্বের অন্য কোন ভাষায় হয়নি।      

উর্দু ভাষার দ্রুত উন্নয়নের পিছনে কোন রাষ্ট্রীয় শক্তি ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে এটি কখনোই রাষ্ট্র ভাষা ছিল না। উর্দুর এ উন্নয়নের পিছনে ছিল ভারতের নানা প্রদেশের নানা ভাষী মুসলিম চিন্তাবিদ, কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীগণ। উর্দু ভাষার বড় বড় লেখক ও সাহিত্যিকগণ এসেছেন উত্তর প্রদেশ, বিহার, হায়দারাবাদ, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, বাংলা, আসাম –তথা সমগ্র ভারত থেকে। অবিভক্তি ভারতে সবচেয়ে উন্নত ও অধিক উর্দু পত্রিকা বের হতো বাংলার রাজধানী কলকাতা থেকে। উর্দু ভাষায় সবচেয়ে শক্তিশালী গদ্য লেখক ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। তিনি তাঁর বিখ্যাত উর্দু পত্রিকা আল হিলাল বের করতে কলকাতা থেকে। এ পত্রিকার গ্রাহক ছিল সারা ভারত জুড়ে।

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মুসলিম কবি-সাহিত্যিক ও লেখকগণ উর্দুকে মুসলিমদের লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা রূপে গড়ে তোলে। ফলে মুসলিমগণ ভারতের যেখানেই বেড়াতে যায়, ভাবের আদান-প্রদানে তাদের কোন অসুবিধা হয়না। অথচ সে সুবিধা হিন্দুদের ছিল না। তাদের ইংরাজী ভাষার আশ্রয় নিয়ে হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব থেকেই সর্বভারতীয় মুসলিম নেতাদের মাঝে এব্যাপার সহমত ছিল যে একমাত্রই উর্দুই হতে পারে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। তারা জানতো যে, অন্য কোন প্রাদেশিক ভাষার সে সামর্থ্য নাই। কায়েদে আযম মহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ও কার্জন হলের সমাবেশে সে প্রতিষ্ঠিত সহমতেরই ঘোষণা দিয়েছিলেন মাত্র। কিন্তু সেটি বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের ভাল লাগেনি। কারণ তাদের ছিল ভাষাপ্রেমের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল পাকিস্তান ধ্বংসের বিষয়টি। প্রয়োজন ছিল বাঙালি জাতয়তাবাদী চেতনার জোয়ার। সে জোয়ার সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনকে তারা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে। সেদিন সে অভিপ্রায় গোপন থাকলেও পরে গোপন থাকেনি। বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষা রূপে স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলা ভাষার কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে -সেটি গবেষণার বিষয়।  কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ফলে মুসলিম উম্মাহর যে ক্ষতি হয়ে গেল -সেটি আর পূরণ হওয়ার নয়। তাই এতে বিপুল বিজয় ও আনন্দ বেড়েছে ইসলাম ও মুসলিমদের শত্রুশিবিরে। সেটি বুঝা যায় ভাষা আন্দোলন নিয়ে কলকাতার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধগুলি পড়লে। সম্প্রতি এক টিভি সাক্ষাতকারে বাম শিবিরের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মাজহার বলেন, “পাকিস্তান বেঁচে থাকলেই হয়তো বাঙালি মুসলিম ও উপমহাদেশের মুসলিমের শক্তি বাড়তো।” কথা হলো, শক্তি বাড়লে তো স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তাও বাড়তো।  ঘাড়ের উপর যতই ভারতীয় আধিপত্যের জোয়াল ভারী হচ্ছে ফরহাদ মাজহারের ন্যায় বহু দেশপ্রমিকও ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও ইতিহাসের ভূলগুলি বুঝতে পারছে। দেশের চলমান রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাসিবাদের বিলুপ্তি ঘটলে অনেকের মুখ থেকেই এরূপ সত্য কথা শোনা যেত। 

যে কোন ঈমানদার মুসলিমের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কোন ভাষার বা কোন গোত্রের প্রতিষ্ঠা দেয়া ও গৌরব-বৃদ্ধি নয়। একাজে কোন সওয়াব নাই। বরং পবিত্র ইবাদত হলো শত্রুর হামলার মূখে মুসলিমের জান-মাল ও ইজ্জতের প্রতিরক্ষা দেয়া। এবং সে সাথে বিজয়ী করা ইসলামকে। এটি জিহাদ। সে জিহাদকে বলবান করার জন্য জরুরি হলো মুসলিমদের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিবৃদ্ধি। সে কাজটি কোন একক ভাষা ও কোন একক অঞ্চলের মুসলিমদের একার কাজ নয়। সে লক্ষ্য অর্জনে অন্য অঞ্চলের ও অন্যভাষী মুসলিমদের সাথে একতা গড়তে হয়। সে লক্ষ্য পূরণে ভাষা ও বর্ণের উর্দ্ধে উঠতে হয়। ইসলামের গৌরব যুগে তাই আরব, ইরানী, তুর্ক, কুর্দ ও অন্য বহু ভাষার মুসলিমগণ একতাবদ্ধ হয়েছিল। পরস্পরে এরূপ একাত্ম হওয়াটি ইসলামে  ফরজ। এবং বিভক্তি গড়া হারাম। এটি ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জিহাদটিও লড়তে হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের নানা ভাষী মুসলিমদের একতাবদ্ধ ভাবে।  ভাষা, বর্ণ বা অঞ্চলের নামে ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি করা হলে মুসলিম জীবনে বিভক্তি, পরাজয় ও বিপর্যয় আসে। ঐক্যই শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সামর্থ্য দেয়; এবং সে সামর্থ্য বিলুপ্ত হয় বিভক্তিতে। প্রতিরোধের সামর্থ্য বাড়াতেই প্রতিষ্ঠা দিতে হয় বৃহৎ রাষ্ট্রের। মুসলিমগণ তাই অতীতে রাষ্ট্রকে না ভেঙ্গে তার ভূগোল বাড়িয়েছে। সেজন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল নানাভাষী মুসলিমদের নিয়ে গড়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখা। কিন্তু বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের কাছে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও মুসলিমের প্রতিরক্ষার বিষয়টি আদৌ গুরুত্ব পায়নি।  তারা রাজী নয় ভাষাভিত্তিক বাঙালি পরিচয়ের উপরে উঠতে। তারা মুসলিমের শক্তিবৃদ্ধি ও ইসলামের এজেন্ডা নিয়ে ভাবে না। তাই তাদের রাজনীতিতে নাশকতা শুরু হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। এবং সেটি হিন্দুত্ববাদী কাফির শক্তির সাথে কোয়ালিশন গড়ে।  আখেরাতে জবাবদেহীতার ভয় থাকলে তারা কি কখনো সে পথে যেত?

 

এজেন্ডা-পূরণের কাজ এখনো বাকি

১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্পটি সফল হলেও হিন্দুত্ববাদী ভারত ও তার মিত্রদের ইসলামী চেতনা বিনাশের কাজটি এখনো শেষ হয়নি। কারণ কোমর ভাঙ্গার কাজটি হলেও ইসলামের পক্ষের শক্তি নির্মূলের কাজটি এখনো পুরোপুরি হয়নি। শেষ হয়নি ভাষা আন্দোলনের নামে বাঙালি মুসলিমের চেতনা জগতে সেক্যুলার ধারার সংস্কৃতি নির্মাণ ও আদর্শিক বিপ্লবের কাজ। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের প্রবল একটি আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক এজেন্ডা যেমন পূর্বে ছিল, তেমনি এখনো আছে। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল বাঙালি মুসলিমদের সাংস্কৃতিক কনভার্শন তথা ইসলাম থেকে দূরে সরানো। সে কাজের শুরু হয় গান গেয়ে গেয়ে নগ্ন পায়ে ভোর সকালে ফুল হাতে একুশের স্মৃতি স্তম্ভে হাজির হওয়া। বাঙালি মুসলিম জীবনে এটি নিরেট সাংস্কৃতিক বিদ’য়াত। চাপানো হয় হিন্দুত্বের পৌত্তলিক রেওয়াজ। পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্র ভাষা রূপে বাংলা স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু তাতে ২১ ফেব্রেয়ারী পালনের আয়োজন কমেনি; বরং বেড়েছে। সে সাথে বেগবান করা হয়েছে বাঙালি মুসলিম সন্তানদের মাঝে মুর্তিপূজার অনুকরণে স্তম্ভপূজার রীতি। একুশে ফেব্রেয়ারী পরিণত হয় ইসলামের বিরুদ্ধে সেক্যুলারিস্ট ও বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক যুদ্ধের তীর্থভূমিতে।

হিন্দুদের অনেকেই তাদের ধর্মকে ধর্ম না বলে আবহমান ভারতীয় সংস্কৃতি বলে। ফলে তাদের কাছে গুরত্ব পায় অন্য ধর্মের মানুষকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিতে দীক্ষা দেয়া। সে দীক্ষা যারাই গ্রহণ করে, তাদেরকে তারা হিন্দু বলে।  মুসলিমদের জন্য যেমন মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া ফরজ তথা বাধ্যতামূলক, হিন্দুদের জন্য মন্দিরে যাওয়াটি তেমন বাধ্যতামূলক নয়। এমন কি নিম্মবর্ণের হিন্দুদের জন্য মন্দিরে প্রবেশই নিষেধ। হিন্দুরা চায় ভারতীয় মুসলিমদের হিন্দুত্বয়ানী সংস্কৃতিতে ফিরে আসুক। সে চেষ্টাটি অতি পুরনো। ব্রিটিশ আমলে “শুদ্ধি” নামে শুরু হয়েছিল মুসলিমদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেয়ার আন্দলোন। একই লক্ষ্যে বিজিপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলি শুরু করেছে “ঘর ওয়াপসি” তথা ঘরে ফেরানোর আন্দোলন। এ আন্দোলনের লক্ষ্য, মুসলিমদের হিন্দু ধর্মের ঘরে ফিরিয়ে নেয়া।

বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদীদের স্ট্রাটেজী দ্বি-মুখী।  শুরুটি “ডি-ইসলামাইজেশন” তথা ইসলাম থেকে দূরে সরানোর মধ্য দিয়ে। এবং শেষটি হলো “কালচারাল কনভার্শন” তথা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিতে দীক্ষা। সে স্ট্রাটেজীর বাস্তবায়নে তারা বাঙালি মুসলিমদের হাজির করে ২১ ফেব্রেয়ারী, বর্ষবরণ, বসন্তবরণ, ভ্যালেন্টাইন ডে ইত্যাদি নামের নানা রূপ আনুষ্ঠানে। এগুলো সাংস্কৃতিক কনভার্শনের ইন্ডাস্ট্রি। সাংস্কৃতিক কনভার্শনের ক্ষেত্রে হিন্দুদের বিজয়টি বিশাল। হিন্দু সংস্কৃতির প্রাকটিস করতে  মুসলিমদের মন্দিরে যেতে হয়না, বরং মন্দির নামিয়ে এনেছে মুসলিমদের শিক্ষাঙ্গণে ও নানা প্রতিষ্ঠানে। হিন্দুগণ মন্দিরে গিয়ে যা করে –অবিকল সেটিই করা হয় ২১ ফেব্রেয়ারীতে স্তম্ভের পাদদেশে ফুল ও ভক্তি দিয়ে। তাই ভাষা আন্দোলনের নাশকতা শুধু পাকিস্তান ধ্বংসে শেষ হয়নি। এটিকে পরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে মুসলিমদের ঈমান ধ্বংসের কাজে।  

ভাষা আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের দাবী, ভাষা আন্দোলন না হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ কখনোই এতোটা প্রচণ্ডতা পেত না এবং স্বাধীন বাংলাদেশও সৃষ্টি হতো না। তাদের দাবী আদৌ মিথ্যা নয়। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে প্যান-ইসলামিজম তথা ইসলামের বিশ্ব মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনা বাঁচে না। তখন ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞাও পাল্টে যায়। প্যান-ইসলামিজমের চেতনায় একজন মুসলিমের কাছে অন্য ভাষী একজন মুসলিম তাঁর দ্বীনি ভাই রূপে গণ্য হয়। অথচ জাতীয়তাবাদী চেতনায় শত্রু হওয়ার জন্য তার ভিন্ন ভাষা বা ভিন্ন অঞ্চলের হওয়াই যথেষ্ট। তাই পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী ৬ লাখের অধিক যে বিহারীর ঘর-বাড়ী ও ব্যবসায়-বাণিজ্য কেড়ে নিয়ে বস্তিতে পাঠানো হয়, তাদের অধিকাংশই ছিল নারী, শিশু, বৃদ্ধ। তাদের অপরাধ এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না যে তারা ও তাদের পিতামাতাগণ এসেছিল বাংলাদেশের বাইরে থেকে। তারা হিন্দুদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি ভারতীয় প্রদেশ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল। যদিও তাদের অনেকের জন্ম পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে বাংলার মাটিতে হয়েছিল। মানব ইতিহাসের অতি অমানবিক মতবাদ হলো জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, গোত্রবাদ ও ফ্যাসিবাদ। এ মতবাদগুলি অতি সহজেই মানুষকে অতি নৃশংস খুনি, ধর্ষক ও সন্ত্রাসীতে পরিণত করে। বাংলার মাটিতে সেটি দেখা গেছে ১৯৭১ সালে। এ চেতনায় আচ্ছন্ন বাঙালিদের দ্বারা একাত্তরে ধর্ষিতা হয়েছে হাজার হাজার অবাঙালি মহিলা। খুন হয়েছে এক লাখেরও বেশী। অনেককে জীবিত অবস্থায় পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। অনেক অবাঙালি মহিলার স্তন কর্তন করা হয়েছে। তাদের লাশগুলিকে কবরও দেয়া হয়নি। এরূপ নৃশংসতার লোমহর্ষক বিবরণ বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলার মাটিত এতবড় নৃশংস বর্বরতা আর কোন কালেই ঘটেনি। এবং সেটি ঘটেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা। আজ বাংলাদেশের বুকে গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি ও সন্ত্রাসের জোয়ার তার বীজ তো একাত্তরেই রোপন করা হয়েছিল। এখন সেটিরই ফল ভোগ করতে হচ্ছে। জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী ও গোত্রবাদী চেতনাকে ইসলামে বলা হয় আসাবিয়াত। ইসলামে এগুলি হারাম। এরূপ বর্বর মতবাদের অনুসারী অপরাধীদের উদ্দেশ্যই নবীজী (সা:) বলেছেন, এরা আমার উম্মত নয়।    

১৯৪৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের কল্যাণচিন্তা, ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিরূপে মুসলিমদের পুনরুত্থান -এরূপ নানা স্বপ্ন মাথায় নিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। সেরূপ ভিশন ও মিশনের রাজনীতিতে বাঙালি মুসলিমগণ ছিল অগ্রভাগে। বরং মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের সৃষ্টিতে বাঙালি মুসলিমদের অবদান ছিল ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিমদের চেয়ে অধিক। ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সে স্বপ্নেরই মৃত্যু হয়। বাঙালি মুসলিম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পাকিস্তান প্রজেক্ট থেকে। পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ রূপে চিত্রিত করতে থাকে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্যকে দলিল রূপে পেশ করা। অথচ বলা হয়নি, যে বৈষম্য নিয়ে ১৯৪৭’য়ের পাকিস্তানের সৃষ্টি তা নিয়ে। এ বৈষম্যের কারণ পাকিস্তান নয়, বরং সে জন্য দায়ী বাঙালির উপর ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন। ব্রিটিশ শাসনের ফলেই বাঙালি মুসলিমগণ শিক্ষা ও শিল্প হারিয়ে হিন্দু জমিদারের ভূমিহীন প্রজায় পরিণত হয়। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিমদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। বাঙালি মুসলিমের ঘাড়ে ছিল গোলামীর দুটি জোয়াল। একটি ছিল ব্রিটিশের, অপরটি হিন্দু জমিদারের। বাঙালি মুসলিমগণ ভূমির মালিক হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। এবং সেটি মুসলিম লীগ সরকারের হাতে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর। পশ্চিম পাকিস্তানের উপর ব্রিটিশের গোলামী ছিল মাত্র ৯০ বছরের –সেটি ১৮৫৭ সালে মোগল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির পর। অথচ বাঙালি মুসলিম জীবনে সে গোলামী শুরু হয় ১০০ বছর আগে ১৭৫৭ সালে পলাশীতে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পর। ব্রিটিশের শোষন এতোই নৃশংস ছিল যে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ জনগণের মৃত্যু হয় ব্রিটিশ-সৃষ্ট ১৭৬৯-৭০ সালের দুর্ভিক্ষে। যাকে ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলা হয়। ১৯০ বছরের শাসন-শোষণে বাঙালি মুসলিমগণ এতোটাই পিছিয়ে পড়ে যে, ১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলিমদের মাঝে একজনও ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আই. সি.এস)’য়ের অফিসার ছিল না। বাঙালী মুসলিম জেনারেল পদে দূরে থাক, ব্রিগেডিয়ার বা কর্নেল পদেও ছিল না। অথচ অবাঙালি মুসলিমদের মাঝে একাধিক জেনারেল এবং বহু ব্রিগেডিয়ার ও কর্নেল ছিল। বাঙালি মুসলিমদের মাঝে একজন শিল্পপতিও ছিল না। অথচ আদমজী, বাওয়ানী, ইস্পাহানী, দাউদ, হাবিব, সায়গল, রেঙ্গুলওয়ালা এরূপ বহু অবাঙালি শিল্পপতি ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই। ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের যে বৈষম্য ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুর দিন থেকেই বিরাজ করছিল তার জন্য পাকিস্তানের ২৩ বছরকে কি করে দায়ী করা যায়?  

১৯৭১’য়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধজয় ছিল দক্ষিণ এশিয়ার বুকে ইসলাম বিরোধী শক্তির এক বিশাল বিজয়। এতে ভারত পরিণত হয়েছ দক্ষিণ এশিয়ার বুকে অপ্রতিদ্বন্দী শক্তিতে। ১৯৭১’য়ের আগে ভারতে সে মর্যাদা ছিল না। এতে বিপদ বেড়েছে ২২ কোটি ভারতীয় মুসলিমের। বিপদ বেড়েছে কাশ্মীরী মুসলিমদের। এবং বিপদ বেড়েছে বাঙালি মুসলিমদেরও। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধটি সর্বত্রই তীব্রতর হয়েছে। এবং বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ভারতের আশ্রীত একটি শক্তিহীন ও প্রতিবাদহীন রাষ্ট্রে।  এভাবে সংকুচিত হয়েছে বাংলাদেশী মুসলিমদের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, আইন-আদালত ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ইসলামপন্থীগণ যেরূপ পরাজিত শক্তি এবং বিজয়ী রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ইসলামের বিপক্ষ শক্তি -তার মূল কারণ হলো এই ভাষা-আন্দোলন। ভাষা-আন্দোলন বাঙালির শত্রু ও মিত্রের একটি সংজ্ঞা বেঁধে দেয়। যারা ইসলামপন্থী এবং একাত্তরে পাকিস্তানপন্থী ছিল এবং যারা ভারতবিরোধী -তারা চিত্রিত হয় বাঙালির শত্রু রূপে। বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের রাজনৈতিক প্রভু ভারত তাদেরকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোন স্থান দিতে রাজি নয়। ভারতের ইচ্ছা পূরণে আজও বিচারের নামে তাদের ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি এক বিশাল গুণগত পরিবর্তন। উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতিতে বহু ঘটনা ঘটেছে, তবে যে ঘটনাটি ভারতের আধিপত্যবাদী হিন্দুদের প্রচুর আনন্দ জুগিয়েছে এবং সে সাথে তাদেরকে প্রচণ্ড লাভবানও করেছে -তা হলো এই ভাষা আন্দোলন। এদের অনেকে ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়েও খুশি হয়েছিল। সিরাজদ্দৌলার পরাজয়কে ইংরেজদের সাথে হিন্দুগণও উৎসবযোগ্য রূপে গণ্য করেছে। কারণ, তাতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার উপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। সিরাজুদ্দৌলার চরিত্রে কালীমা লেপন করে বহু হিন্দু কবি-সাহিত্যিক বহু কবিতা, বহু উপন্যাস ও বহু নাটক লিখেছেন। অথচ সে তূলনায় মীর জাফর ও ক্লাইভের কুৎসিত রূপটি তুলে ধরা হয়েছে সামান্যই। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাপ-দাদাগণই যে শুধু ইংরেজদের প্রশংসায় গদগদ ছিলেন তা নয়, রবীন্দ্রনাথ নিজেও ইংরেজ রাজা পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন উপলক্ষ্যে তাকে “জনগনমন –অধিনায়ক  ভারতভাগ্যবিধাতা” রূপে কবিতা লিখে প্রশংসা গেয়েছেন। “জয় হো, জয় হো” – এরূপ স্তুতি গেয়ে জয়ধ্বণিও দিয়েছেন।

তবে বাঙালি মুসলিমগণ ১৭৫৭ সালের সে পরাজয়ের গ্লানি থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসে গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারই ফল দাঁড়িয়েছিল, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে যখন থেকে ভারতে নির্বাচন দেওয়া শুরু হয়, তখন থেকে বাংলার প্রাদেশিক সরকারের শাসন ক্ষমতায় কোন হিন্দুকে বসতে দেয়নি। অবিভিক্ত বাংলায় তিন জন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের তিন জনই ছিলেন মুসলিম। অথচ তখন মুসলিমদের সংখ্যা হিন্দুদের তুলনায় খুব একটি বেশী ছিল না। জনসংখ্যার শতকরা ৫৫ ভাগ হলেও অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকুরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মুসলিমদের পশ্চাদপদতা ছিল হিন্দুদের তুলনায় বিশাল। তারপরও শতকরা ৭৫ ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত কলকাতায় বসে ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল অবধি এই ১১ বছর যাবত মুসলিম প্রধানমন্ত্রী বাংলাকে শাসন করেছে। অবশেষে ১৯৪৭ সালে হিন্দু ও ইংরেজ উভয়ের প্রবল বিরোধীতা সত্ত্বেও লড়াই করে তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল। মুসলিমদের জন্য এ ছিল বিশাল বিজয়। কিন্তু উত্থানমুখী মুসলিমদের কোমর ভেঙ্গে দেয় ভাষা আন্দোলন। মুসলিমদের মধ্যে ভাষা ও অঞ্চল-ভিত্তিক বিভক্তি, ভাতৃঘাতি লড়াই, পাকিস্তানের ধ্বংস এবং ইসলামী চেতনা বিনাশের বীজ বপন করা হয়েছিল এ আন্দোলনে। যে প্যান-ইসলামিক চেতনার ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল -সেটির মৃত্যু ঘটে পূর্ব পাকিস্তানে। ভারতীয় আগ্রাসনবাদীগণ তো সেটিই চেয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১’য়ে বিভক্ত হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ ধরা পড়েছে ভারতের ফাঁদে। ভারতের বিশাল বিজয় ও গর্ব এ কারণে যে, দু’টি পাখিকে তারা একই ঢিলে মারতে পেরেছে। একদিকে যেমন শত্রুদেশ পাকিস্তানকে খণ্ডিত ও দুর্বল করতে পেরেছে, অপরদিকে প্রতিরক্ষাহীন বাংলাদেশকে পেয়েছে ভারতের রাডারের নীচে একটি অধীনত গোলাম রাষ্ট্র রূপে।

 

শত্রু শিবিরে উৎসব এবং ইতিহাসের প্রকৃত সত্য

অনেকেই নিজের ক্ষতি টের  পায় না। সে ক্ষতিটি সহজে বুঝা যায় শত্রুর উৎসব দেখে। কারণ চৌকশ শত্রু শক্তি কখনোই তার নিজের লাভটি বুঝতে ভূল করে না। তাছাড়া মুসলিমদের কোন বিষয়ে কল্যাণ হলো এবং হিন্দুত্ববাদীগণ তাতে খুশি হলো -তা কি কখনো ভাবা যায়?  আধিপত্যবাদী বর্ণ হিন্দুদের কুটিল ও হিংসাত্মক চরিত্রের সাথে যাদের পরিচয়টি গভীর -তাদের অভিজ্ঞতাটি আদৌও সুখের নয়। মুসলিমদেরকে তারা অনুগত দাস রূপে গ্রহণ করতে রাজী, সম-সম্মানের প্রতিবেশী ও বন্ধু হিসাবে নয়। কায়েদে আজম মহম্মদ তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন হিন্দু ও মুসলিমের মিলনের দূত রূপে। সে লক্ষ্য নিয়ে যোগ দেন কংগ্রসে।  প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সরোজিনী নাইডু তাঁকে হিন্দু-মুসলিম মিলনের দূত বলে অভিহিত করতেন। কিন্তু অচিরেই তাঁর সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ভগ্ন হৃদয় নিয়ে হিন্দুদের সম্পর্কে বলতেন, তারা “incorrigle” তথা চিকিৎসা বা সংশোধনের অযোগ্য। হিন্দুদের নিয়ে কাজ করেছেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব শেরেবাংলা ফজলুল হক। হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীকে তিনি তার মন্ত্রী সভায় স্থান দেন। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতাও প্রীতিকর ছিলনা। তিনি বলতেন, “কলকাতার হিন্দু পত্রিকাগুলো যখন আমার কোন সিদ্ধান্তের সমর্থণে লেখালেখি শুরু করে, তখনই বুঝতে হবে সেটির দ্বারা মুসলিমদের বড় রকমের ক্ষতি আশংকা রয়েছে।”

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিয়ে কলকাতার পত্রিকাগুলো শুধু পক্ষেই লেখেনি, এখনো বছর ঘুরে প্রতি বছর ২১ ফেব্রেয়ারীতে কলকাতাতে উৎসব শুরু হয়। তাই ইতিহাসের প্রকৃত সত্য এবং মুসলিমদের ক্ষতির মাত্রা বোঝার জন্য কি কোন গবেষণার প্রয়োজন আছে? সেটি বুঝা যায় হিন্দুত্ববাদীদের উল্লাসের মাত্রা দেখে। পরিতাপের বিষয় হলো, বাঙালি মুসলিমগণ নিজেদের কল্যাণের চেয়ে অধিক বাড়িয়েছে হিন্দুদের বিজয়। বরং নিজেরা বঞ্চিত হয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে। এবং সেটি মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রহত্যাকারি এক ফ্যাসিস্টের হাতে। যে শেখ মুজিব জনগণের ভোট ও স্বাধীন মতামত প্রকাশের ন্যায় গণতান্ত্রিক অধিকারের ইজ্জত দেয়নি, সে কি স্বাধীনতা দিতে পারে? বাংলাদেশীদের কল্যাণ নিয়ে ভারতের সামান্যতম আগ্রহ থাকলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর ভারতীয় সেনা বাহিনীকে কি লুন্ঠনে নামতো? লুটে নিয়ে যেত কি পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া সকল অস্ত্র। সীমাহীন লুন্ঠনের মধ্য দিয়ে কি দুর্ভিক্ষ উপহার দিত? কোন ভদ্র ও সভ্য মানুষ কি তার বন্ধুর ঘরে চুরি-ডাকাতিতে নামে?

 

ভাষা আন্দোলন ও মিথ্যাচার

বাংলাদেশের ইতিহাসে অতি মিথ্যাচার হয়েছে বাংলা ভাষা ও ভাষা-আন্দোলনকে ঘিরে। ভাষা-আন্দোলন নিয়ে সবচেয়ে বড় মিথ্যাটি হলো, বাঙালির মুখের ভাষা নাকি পাকিস্তান সরকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। এ প্রসঙ্গে যে সত্যটিকে তারা বুঝতে রাজী নয় তা হলো, দেশের অনেকগুলি ভাষার মধ্য থেকে একটিকে রাষ্ট্র বানানোর অর্থ অন্য ভাষাগুলোকে কবরে পাঠানো নয়। বর্তমান পাকিস্তানে রয়েছে পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পশতু, বেলুচ – এ চারটি প্রধান প্রাদেশশিক ভাষা। উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা বানানোর সে ভাষাগুলির কোনটিরই মৃত্যু হয়নি। বরং সেগুলোও সমৃদ্ধ হয়েছে। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ঢাকার সন্তান খাজা নাযিম উদ্দীন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন আরেক বাংলাভাষী জনাব নুরুল আমীন। পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রনায়কগণ মধ্য খানে ১২ শত মাইলের ভারতীয় ভূমি দিয়ে বিভক্ত পাকিস্তানের অখণ্ডতা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন। দেশের অখণ্ডতা বজায়ে ভাষার বন্ধন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই বিশ্বের অধিকাংশ দেশই ভৌগলিক অখণ্ডতা বাঁচাতে একটি লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা তথা যোগাযোগের ভাষা গড়ে  তুলে। গ্রেট ব্রিটেনে ইংরেজী ভাষার বাইরে স্কটিশ, আইরিশ ও ওয়েলশ ভাষা রয়েছে। কিন্তু সকল ভাষাভাষী জনগণই ইংরাজীকে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা রূপে গ্রহণ করেছে। তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহিত হয়েছে ইংরাজী। ভারতে প্রসার ও প্রতিষ্ঠা দেয়া হচ্ছে হিন্দিকে। আজকের অবশিষ্ট পাকিস্তানে উর্দু কোন প্রাদেশিক ভাষা নয়। কিন্তু সেখানকার ৪টি প্রদেশের জনগণই উর্দুকে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা রূপে গ্রহণ করেছে। তাতে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট পাকিস্তানের সংহতি মজবুত হয়েছে। পাকিস্তানের জন্মের পূর্ব  থেকেই দেশটির ভিতরে ও বাইরে প্রচুর শত্রু ছিল। তারা কখনোই চাইতো না, পাকিস্তান সৃষ্টি হোক ও বেঁচে থাকুক। ফলে তারা কখনোই চাইতো না উর্দুকে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা করার মধ্য দিয়ে দেশটির সংহতি শক্তিশালী হোক। এরাই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সংহতিতে মজবুত করার চেষ্টা বানচাল করে দেয়।

বাংলাভাষা কোন কালেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়নি। পাকিস্তান সরকারই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এবং সেটি ১৯৫৪ সালে। বাংলা ভাষার উন্নয়নে বাংলা এ্যাকাডেমী ও বাংলা-উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা এবং বিদেশী ভাষার বিপুল সংখ্যক বইয়ের বাংলায় তরজমার কাজ তখনই শুরু করা হয়। বলা যায়, বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার কাজে সরকারি ভাবে পাকিস্তানের ২৩ বছরে যে কাজ করা হয় তা অতীতে কোন কালেই হয়নি। বাংলা ভাষার উন্নয়নে ভারতের পশ্চিম বাংলাতেও এতো সরকারি বিনিয়োগ হয়নি। অথচ সেই পাকিস্তানকে ইতিহাসে চিত্রিত করা হয়েছে বাংলা ভাষার শত্রু রূপে।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে আরেক মিথ্যাচার হলো, দুনিয়ার আর কোথাও নাকি ভাষার নামে এতো রক্তদান হয়নি -যা হয়েছে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রেয়ারীতে। অথচ হিন্দি ভাষাকে যখন দক্ষিণ ভারতের তামিলদের উপর চাপিয়ে দেয়া চেষ্টা হয়, বহুগুণ বেশী মানুষ প্রাণ দেয় সে চেষ্টা রুখতে। একই ঘটনা ঘটে আসামের কাছাড় ও করিম গঞ্জে। বহু মানুষ সেখানেও প্রাণ দেয় যখন বাংলা ভাষার উপর অসমিয় ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়। তবে সেসব ভাষা কেন্দ্রিক আন্দোলনকে কখনোই দেশ ভাঙ্গার আন্দোলেন পরিণত হয়নি -যা হয়েছে বাংলাদেশে।

 

সংস্কৃতি স্তম্ভপূজার  

বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিলেও ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন বেগবান করা হয়েছে দুটি কারণে। একটি রাজনৈতিক, অপরটি সাংস্কৃতিক। রাজনৈতিক প্রয়োজনটি ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির কাজে এ আন্দোলনকে ব্যবহার করা। সাংস্কৃতিক প্রয়োজনটি হলো, বাংলার মুসলিমদের মন ও মনন থেকে প্যান-ইসলামী চেতনার বিনাশ এবং সে সাথে সেক্যুলারিজমের আবাদ বাড়াতে সেটিকে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বটে, কিন্তু সেকুলারাইজেশনের কাজ শেষ হয়নি। ফলে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে অনুষ্ঠানের প্রয়োজনও শেষ হয়নি। থেমে যায়নি প্রভাতফেরীর নামে হাজার হাজার নারীপুরুষকে একত্রে রাতের আঁধারে রাস্তায় নামানোর আয়োজন। বরং ইসলামী চেতনার দ্রুত বিকাশ এবং ইসলামী রাষ্ট্র বিপ্লবের আন্দোলন দেশে দেশে প্রবলতর হওয়ায় গুরুত্ব বেড়ে গেছে একুশে ফেব্রুয়ারির। এবং সেটি বুঝা যায় একুশে ফেব্রুয়ারি উৎযাপনের বর্তমান মাত্রা দেখে। একুশের বই মেলা পরিণত হয়েছে সেক্যুলার চেতনা-ভিত্তিক সাহিত্যের প্লাবন সৃষ্টির কাজে। পাকিস্তান আমলে ২১’শে ফেব্রুয়ারি পালিত হতো বছরের মাত্র একটি দিনে, এবং সেটিও মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য। এখন শুরু হয়েছে সারা দেশব্যাপী স্তম্ভপূজা। সে আমলে সেক্যুলার এবং বামপন্থী ছাত্র-ছাত্রীরাই শুধু ২১শে ফেব্রুয়ারিতে নগ্ন পদে স্মৃতি স্তম্ভে গিয়ে ফুল দিত। এসব ছাত্র-ছাত্রীরা ছিল মূলত আওয়ামী লীগ ও রুশপন্থী ও চীনপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ও সমর্থক। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা এ থেকে সচেতনতার সাথে দূরে থাকতো। যাদের মধ্যে ইসলামের সামান্য জ্ঞান ছিল এবং ইসলামের অনুশাসন পালনে সামান্য অঙ্গীকার ছিল, তারা স্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে এমন সম্মান প্রদর্শনকে নির্ভেজাল শিরক মনে করতো।

শহীদ শব্দের অপব্যবহার ও সাংস্কৃতিক কনভার্শন

আদর্শের জন্য প্রাণদান ইসলামে নতুন কিছু নয়। নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের অর্ধেকের বেশী শহীদ হয়েছেন। “শহীদ” শব্দটিও এসেছে ইসলাম থেকে। শহীদদের রক্তের বরকতেই আল্লাহর রহমত প্রাপ্তি ঘটেছিল এবং নির্মিত হয়েছিল মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে যা কিছু গর্বের তার বেশীর ভাগের নির্মাতা হলেন এই শহীদগণ। বিশ্বের সকল মুসলিমদের কাছে তাই তারা সর্বকালের পরম সম্মানের পাত্র। কিন্তু ইসলামে সম্মান প্রদর্শনেরও নিজস্ব রীতি আছে। সেটি স্তম্ভ গড়ে নয়। স্তম্ভের গোড়ায় ফুল দিয়ে স্তম্ভ পূজাও নয়। রাতে বা প্রভাতে নারী-পুরুষকে রাস্তায় নামিয়েও নয়। শহিদদের স্মৃতিতে স্তম্ভ গড়া সিদ্ধ রীতি হলে শুধু মক্কা-মদীনাতে নয়, মুসলিম বিশ্বের অসংখ্য শহরে হাজার হাজার স্তম্ভ গড়া হতো। সেসব স্তম্ভে বছরের একটি দিনে শুধু নয়, প্রতিদিন ফুল দেওয়া হতো। কিন্তু সেটি হয়নি। কারণ সেটি মুসলিম সংস্কৃতি নয়। ইসলামসিদ্ধও নয়। অথচ বাংলাদেশের নগরে বন্দরের প্রতিটি স্কুল-কলেজে বহুলক্ষ স্তম্ভ গড়ে সেটিকে আজ বাঙালির সংস্কৃতি রূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এভাবে মুসলিম জীবনে শুরু হয় চরম সাংস্কৃতিক পথভ্রষ্টতা। সে সাথে চরম বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রষ্টতাও। তাই বাঙালি মুসলিম জীবনে শতভাগ হারাম রীতি চালু করা হয় ভাষা আন্দোলনের নামে। এতে নাশকতা ঘটে বাঙালি মুসলিমের ঈমানের ভূবনে। এভাবে খুলে দেয়া হয় জাহান্নামে পথ। বাংলাদেশীদের এরূপ সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রষ্টতা সুস্পষ্ট করে দেশের ইসলামপন্থীদের চরম বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা। ব্যর্থতা এখানে আলেমদের। দেশে মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা বিপুল হারে বেড়েছে, বেড়েছে আলেমদের সংখ্যাও। কিন্তু আলেমগণ ব্যর্থ হয়েছে দেশের জনগণকে ভয়াবহ শিরকের স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচাতে।

এরূপ সাংস্কৃতিক ভ্রষ্টতা এসেছে আদর্শিক ভ্রষ্টতা থেকে। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে দেহব্যবসার মত ব্যভিচার যেমন আইনগত বৈধতা পেয়েছে, তেমনি বৈধতা পেয়েছে আরেক হারাম কর্ম স্তম্ভপূজা। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের হাজির করা হচ্ছে শেখ মুজিবের মুর্তি বা ছবির সামনে। এমন সাংস্কৃতিক ভ্রষ্টতার পিছনে ভ্রষ্ট দর্শনটি হলো সেক্যুলারিজম –যার মূলকথা পরকালের ভাবনা বিলুপ্ত করে মানুষকে দুনিয়ামুখী করা। মানুষের ঢল মসজিদমুখী না করে স্তম্ভমুখী ও মুর্তিমুখী করা। বাঙালি মুসলিমদের জীবনে এভাবেই নেমে এসেছে এক ব্যাপক সাংস্কৃতিক কনভার্শন। সংস্কৃতির পথ ধরে এভাবেই চরম দুষণ ঘটেছে বাঙালি মুসলিমদের চেতনালোকে। ইসলামের শত্রুদের আজকের স্ট্রাটেজী মুসলিমদেরকে হিন্দু বানানো নয়। বরং সেটি হলো, সংস্কৃতির লেবাসে এমন সব বিশ্বাস ও রীতিনীতিতে অভ্যস্ত করা -যা ইসলামের মূল শিক্ষা থেকেই দূরে সরিয়ে নেয়। এভাবেই মুসলিমদের সরানো হচ্ছে ইসলাম থেকে। এর অনিবার্য পরিণতি হলো, শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশে হলো ইসলামের লাগাতর পরাজয়। সেটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক অঙ্গণে।

সেক্যুলারিজমের প্রচার ও প্রভাব বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এতোটাই গভীরতর হয়েছে যে, বহু ইসলামপন্থী নেতাকর্মীও সে স্রোতে ভেসে গেছে। ফলে এখন আর শুধু আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কম্যিউনিষ্ট পার্টির নেতা-কর্মীগণই নগ্ন পদে ফুলের মালা নিয়ে স্তম্ভপূজায় হাজির হচ্ছে না, হাজির হচ্ছে তথাকথিত বহু ইসলামী দলের অনেক নেতাকর্মীও। রাজনৈতিক বিজয়ের পাশে বাংলাদেশের সেকুলারিষ্টদের জন্য এটি হলো এক আদর্শিক বিজয়। হযরত ঈসা (আ:) ও হযরত মূসা (আ:)’র  অনুসারীদের সমস্যা এ নয় যে, তারা মূর্তি পূজায় ফিরে গেছে। বরং তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক অঙ্গণে। এবং সে পথভ্রষ্টতার কারণেই তারা বিদ্রোহী হয়েছে আল্লাহর ফরমানের বিরুদ্ধে। ফলে সমগ্র খৃষ্টান ও ইহুদী জগতে আল্লাহর বিধান আজ পরাজিত। পুরাতন টেস্টামেন্ট বা তাওরাতের বিধানগুলো তাই শুধু কেতাবেই রয়ে গেছে। তারা নেমেছে উলঙ্গতা, মদপান, বিবাহ বহির্ভৃত যৌন সম্পর্ক, সমকামীতা, পর্ণফিল্ম ইত্যাদি পাপকর্মে। একই ভাবে গভীর ভ্রষ্টতা নেমে এসেছে বাঙালি মুসলিম জীবনে। মহান আল্লাহর শরিয়তী বিধান তাই আদালতের বদলে শুধু কিতাবে রয়ে গেছে। মহান আল্লাহতায়ালার কুর’আনী আইনের বিরুদ্ধে এরূপ গাদ্দারী নিয়ে কোন মানব সন্তান কি আদৌ মুসলিম হওয়ার দাবী করতে পারে?

কবিরা গুনাহ’র কোরাস

মিথ্যা হলো সকল গুনাহর মা –এটি নবীজী (সা:)’র হাদীস। মিথ্যা রটানো করা তাই কবিরা গুনাহ। কোন ঈমানদার তাই মিথ্যা বলতে পারে না। অন্যের বলা মিথ্যাগুলি নিজে রটাতে পারে না। মিথ্যা বলা মানেই সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। মিথ্যা থেকে দূরে থাকার মধ্যেই সত্যিকারের ঈমানদারী। মুসলিম জীবনে ইবাদতের শুরুটি হয় সত্যের পক্ষে সাক্ষ্যদান তথা কালেমায়ে শাহাদত উচ্চারণের মধ্য দিয়ে। এরূপ কালেমায়ে শাহাদত পাঠ হলো ইসলামের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। শয়তানেরও কালেমা আছে। বেঈমানের জীবনে শয়তানের ইবাদত শুরু হয় মিথ্যার পক্ষে শাহাদত দান তথা সাক্ষ্য দানের মধ্য দিয়ে। অথচ মিথ্যাচারি আব্দুল গাফফার চৌধুরী তার একুশে ফেব্রেয়ারি নিয়ে রচিত কবিতায় শয়তানের কালেমা পাঠকেই সেক্যুলার বাঙালির সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে। নামাজে সুরা পাঠ না করলে যেমন নামাজ হয় না, তেমনি আব্দুল গাফফার চৌধুরীর রচিত মিথ্যাপূর্ণ কবিতাটি সমবেত ভাবে পাঠ না পারলে সেক্যুলারিস্ট বাঙালির একুশে ফেব্রেয়ারিও উদযাপিত হয়না। তার সে কবিতাটি মিথ্যাপূর্ণ কিছু লাইন নীচে তুলে ধরা হলো:

 

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারী

আমি কি ভুলিতে পারি।

জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা

শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,

ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে

ওরা এদেশের নয়,

ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।

আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী।”

 

উক্ত কবিতা বা গানটি বহু মিথ্যায় ভরা। সেগুলির মাঝে বড় মিথ্যাটি হলো, দাবী করা হয়েছে শত মা’য়ের সন্তান হারানোর। অথচ একুশে ফেব্রেয়ারীতে নিহত হয় ৫ জন, শত জন নয়। অথচ শেখ হাসিনা বহু শত মায়ের সন্তান কেড়ে নিয়েছে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের গণহত্যায়। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মধ্যে মানবতা থাকলে এবং সন্তানহারা মায়েদের প্রতি দরদ থাকলে কবিতা লেখা উচিত ছিল শাপলা চত্বরের গণহত্যা নিয়ে। শেখ মুজিব কেড়ে নিয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জীবন। কেড়ে নিয়েছিল কথা বলা ও ভোটদানের স্বাধীনতা। গণতন্ত্রকে পাঠিয়েছে কবরস্থানে। কেড়ে নিয়েছে শেখ হাসিনাও। হৃদয়ে মানবতা থাকলে সে নৃশংস ভোটডাকাতি নিয়েও কবিতা লেখা যেত।

 

আব্দুল গাফফার চৌধুরীর একুশের কবিতা রচনায় রাজনীতি কাজ করেছে, মানবতা নয়। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়া হিফাজতে ইসলামের নিরস্ত্র মুসল্লীগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করে সংসদ ভবনের দিকে ধাওয়া করেনি –যা হয়েছিল ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রেয়ারীতে। ঐদিন জগন্নাথ হলে প্রাদেশিক পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চলছিল। সংসদের উপর হামলা হবে -এই আশংকাতেই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। পুলিশ সেদিন গুলি চালিয়েছে যখন ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল সংসদের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করে। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর গানে অভিযোগ আনা হয়েছে শিশু হত্যার। এটিও নিরেট মিথ্যাচার। ঐদিন যে ৫ জন নিহত হয়েছিল, তাদের কেউই শিশু ছিল না। যারা একুশে ফেব্রেয়ারিতে গুলি চালিয়েছিল তাদেরকে বিদেশী বলে কটুক্তি করা হয়েছে। অথচ তাদের কেউ বিদেশী ছিল না। তারাও বাঙালি ছিল এবং ছিল পাকিস্তানের নাগরিক। কবিতায় অভিযোগ আনা হয়েছে, মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি কেড়ে নেয়ার। সেটি ছিল ১৯৫২ সাল। সেদিন ১৯৭৪ সালের ন্যায় দেশবাসীর উপর কোন দুর্ভিক্ষ চাপানো হয়নি। অনাহারে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া হয়নি। কাপড়ের অভাবে সেদিন জালপড়া বাসন্তিও সৃষ্টি হয়নি। উক্ত গানে বলা হয়েছে: “জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী।” অথচ সেদিন পাকিস্তানের জেলে কোন নারী ছিল না। সেদিন জেলের মধ্যে মুজিব এবং  হাসিনার আমলের ন্যায় কেউ মারাও যাচ্ছিল না। বছর ঘুরে প্রতি বছর একুশে ফেব্রেয়ারি এলেই এরূপ মিথ্যাপূর্ণ গানের কোরাস পাঠ করানো হয় বাঙালিদের মুখ দিয়ে। এটি তো কবিরা গুনাহ’র মহড়া। নিরেট মিথ্যার এরূপ দলবদ্ধ বন্দনায় একমাত্র শয়তানই খুশি হতে পারে।

                                                                                                            

 

ইন্সটিটিউশন পূজাপালনের

জনগণের মাঝে আদর্শিক বা সাংস্কৃতিক ভ্রষ্টতা সার্বজনীন করার স্বার্থেও ইন্সটিটিউশন চাই। মুর্তিপূজার ন্যায় সনাতন অজ্ঞতা, পথভ্রষ্টতা ও মিথ্যাচার বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে মুর্তি গড়া ও এসব মূর্তির পদতলে ফুল দেওয়া হলো হিন্দুদের ধর্মীয় ইন্সটিটিউশন। সে আচার বাঁচিয়ে রাখতে বাংলার হিন্দু সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বারো মাসে তের পার্বন। গড়া হয়েছে লক্ষাধিক মন্দির ও পূজামন্ডপ। একই আদলে বাংলাদেশের সেকুলারিষ্টগণও ভাষা আন্দোলনের নামে বাংলাদেশের নগর-বন্দরেই শুধু নয়, গ্রাম-গঞ্জেও স্মৃতিস্তম্ভের নামে বিপুল সংখ্যায় ইন্সটিটিউশন গড়ে তুলেছে। চালু করেছে স্তম্ভপূজা। বস্তুত বাংলার সেকুলারিষ্টদের এটিই হলো সবচেয়ে শক্তিশালী ইনস্টিটিউশন। একুশের নামে প্রতিবছর যে অনুষ্ঠান হয় সেগুলির মূল লক্ষ্য ভাষায় সমৃদ্ধি আনা নয়, বরং তা হলো সেক্যুলার ধারণাকে আরো প্রবলতর করা এবং সে সাথে সেগুলি দীর্ঘজীবী করা। এমনকি ২১ ফেব্রেয়ারীর বদলে বাংলা সনের ৮ ফাল্গুনও চালু করতে পারিনি। এই হলো বাংলা প্রীতির নমুনা। ভাষায় সমৃদ্ধি আনা লক্ষ্য হলে, সে জন্য কি নগ্নপদে মিছিল করা ও স্তম্ভের বেদীমূলে নত শিরে ফুলদানের প্রয়োজন পড়ে? রাষ্ট্রভাষা রূপেও কি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন পড়ে? উর্দু ভাষা ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র ভাষা ছিল না। অথচ উর্দু  বিশ্বের বুকে একটি সমৃদ্ধ ভাষা। কিন্তু সে ভাষার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। উর্দু ভাষায় পবিত্র কুর’আনের বহু অনুবাদ ও বহু তফসির লেখা হয়েছে। বহু তরজমা ও বহু ব্যাখা লেখা হয়েছে হাদীস গ্রন্থগুলিরও। অসংখ্য গ্রন্থ্ লেখা হয়েছে ফিকাহ শাস্ত্র, নবী-জীবনী, সাহাবা-জীবনী, দর্শন ও ইতিহাসের উপর। সমৃদ্ধি এসেছে উর্দু প্রবন্ধ, কবিতা ও গজলে। কিন্তু বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম রাষ্ট্রে রাষ্ট্র-ভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরও বাংলা ভাষায় উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে? বাংলা ভাষার যা কিছু উন্নয়ন হয়েছে তা হয়েছে বাঙালি হিন্দুদের দ্বারা। এবং সে উন্নয়ন হয়েছে তখন যখন বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষা ছিল না। বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের নামে যা কিছু হয়েছে তা মূলত হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। এমন একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এখনো অপূর্ণ থাকায় একুশে ফেব্রুয়ারী পালনে সেকুলারিষ্টদের উদ্যোগে কমতি আসছে না, বরং দিন দিন সেটিকে আরো তীব্রতর করা হচ্ছে। অথচ মনযোগ নাই বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করায়।

 

ভাষার দায়িত্ব ও বাংলা ভাষার ব্যর্থতা

মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর মাধ্যম নেই। কিন্তু শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান মানুষ রূপে বেড়ে উঠার স্বার্থে মনের ভাব প্রকাশ করাটাই একমাত্র কাজ নয়। অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো জ্ঞানলাভ করাটাও। নইলে মনের ভাবেরও সভ্যতর প্রকাশ ঘটে না। তাই ভাষাকে শুধু মুখের ভাষা হলে চলে না, সেটিকে শিক্ষার ভাষা, জ্ঞানের ভাষা, বুদ্ধিবৃত্তির ভাষা এবং সংস্কৃতির ভাষাও হতে হয়। এ বিচারে মুসলিমদের ক্ষেত্রে ভাষার দায়িত্বটা আরো বেড়ে যায়। ভাষাকে তখন সিরাতাল মুস্তাকীম তথা জান্নাতের পথ দেখানোর দায়িত্বটা পালন করতে হয়। বান্দাহর উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর মহান রাসূল (সা:)’র কথাগুলোও তাই ভাষাকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হয়। কোন একটি ভাষার এটিই হলো সবচেয়ে বড় দায়বদ্ধতা -যেমন খাদ্যের সবচেয়ে বড় দায়বদ্ধতা হলো দেহে পুষ্টি জোগানো। পুষ্টি জোগানোর কাজটি না হলে খাদ্য অখাদ্য গণ্য হয়। খাদ্য তাই নিছক মুখরোচক হলেই চলে না। নিজ দেশে বা নিজ ঘরে খাদ্য না থাকলে এজন্যই বাঁচার তাগিদে পুষ্টিকর খাদ্যের সন্ধানে নামতে হয়। নইলে অনিবার্য হয় মৃত্যূ। তেমনি চেতনার মৃত্যূ ও ঈমানের মৃত্যু ঠেকাতে মুসলিমকে এমন ভাষা শিখতে হয় যে ভাষায় ঈমানের খাদ্য মেলে। এমন এক দায়বদ্ধতার কারণেই লক্ষ লক্ষ বাংলাভাষী আজও আরবী শেখে। অনেকে উর্দুও শেখে। এভাবে অন্য কোন সমৃদ্ধ ভাষা শেখার মধ্যে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে শত্রুতা কোথায়? ষড়যন্ত্রই বা কোথায়? নিজের ঘরে চাল না থাকলে অন্যের দোকান থেকে চাল কেনায় অপরাধ কোথায়? নিজ ঘরের চালের প্রতি ঘৃণাই বা কোথায়? ইসলামের জ্ঞান না থাকলে কোন মুসলিমের পক্ষে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাই অসম্ভব। ইসলামে জ্ঞানার্জন ফরজ তো মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার তাগিদেই। মাতৃভাষা ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ না হলে তখন অন্য ভাষার সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। জ্ঞানের সে ক্ষুধা মেটাতেই বাংলার মুসলিমদের শত শত বছর ধরে প্রথমে ফার্সি ভাষা এবং পরে উর্দু ভাষার সাহায্য নিতে হয়েছে। কিন্তু ভাষা আন্দোলন বাঙালির মননে যে চেতনার জন্ম দেয় তাতে শুধু উর্দু ও আরবী নয়, এমন কি ইংরেজী ভাষাচর্চাও অপরাধে পরিণত হয়। গণ্য হয় বাংলা ভাষার সাথে গাদ্দারী। শেখ মুজিবের আমলে পরিত্যক্ত হয় স্কুল-কলেজে ইরাজী ভাষা শেখানোর গুরুত্ব। এরই পরিনাম হলো, আন্তর্জাতিক ব্যবসা পরিচালনার প্রয়োজনে আজ ভারত ও শ্রীলংকা থেকে ইংরাজী জানা লোক আমদানী করতে হচ্ছে।

বাংলা সাহিত্যের শতকরা ৮৫ ভাগ বইয়ের লেখক হিন্দু বাঙালি। হিন্দুদের সাথে মুসলিমদের পার্থক্য শুধু খাদ্য-পানীয়তেই নয়। দেহের খাদ্যের ন্যায় বিশাল পার্থক্য রয়েছে উভয়ের মনের খাদ্যতেও। মুসলিম নিছক সাহিত্য রস উপভোগের স্বার্থে সাহিত্য পাঠ করে না। তাকে সে পাঠের মাধ্যমে ঈমানকেও বাঁচাতে হয়। ফলে বাঙালি হিন্দুদের রচিত বাংলা সাহিত্যে মুসলিমদের জ্ঞানগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োজন পুরণ হওয়ার নয়। বরং তাতে ভয়ানক ক্ষতির সম্ভাবনা। কারণ হিন্দুগণ বই লিখেছেন তাদের নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক পুষ্টির প্রয়োজনে। মুসলিমদের প্রয়োজন তারা পুরণ করবে সেটি কি আশা করা যায়? বিষয়টি এমন কি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বুঝেছিলেন। তিনি তার এক বন্ধুকে লেখা পত্রে লিখেছিলেন, “আজকের বাঙালা ভাষা যদি বাঙালি মুসলিমদের ভাব সুস্পষ্টভাবে ও সহজ ভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম হয়, তবে তারা বাঙালা পরিত্যাগ করে উর্দু গ্রহণ করতে পারেন।” –(প্রবাসী, ১৩৪১: বৈশাখী সংখ্যা)।   

বিশ্বে ভাষার সংখ্যা বহু হাজার। কিন্তু সব ভাষার কি বুদ্ধিবৃত্তিক পুষ্টি জোগানোর প্রয়োজনীয় সামর্থ্য আছে? বাংলা, পাঞ্জাবী, গুজরাতী, সিন্ধি, কাশ্মীরী, পশতু, অসমীয়, তেলেগুসহ অনেক ভাষা রয়েছে দক্ষিণ এশিয়াতেও। কিন্তু এসব ভাষায় ইসলামী জ্ঞানের বিশাল ভূবন দূরে থাক, মাত্র শত বা দেড় শত বছর আগে কুর’আন ও হাদীসের কোন অনুবাদও ছিল না। সমস্যা হলো, কোন ভাষায় সেটি রাতারাতি গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। এ কাজে শত শত বছর লাগে। লাগে বিপুল সংখ্যক মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বল। দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমগণ পূর্বে সে অভাব পুরণ করতো ফার্সি ও আরবী ভাষা শিখে। ইংরেজরা ফার্সিকে বিলুপ্ত করে দেয়। তখন উপমহাদেশের মুসলিমগণ মনযোগী হয় সম্মিলিত ভাবে উর্দু ভাষা চর্চা ও সেটিকে সমৃদ্ধ করার কাজে। তাই উর্দু ভাষার আজ যে সমৃদ্ধি তার পিছনে ভারতে বিশেষ কোন একটি প্রদেশের বা এলাকার মুসলিমদের অবদান বললে ভূল হবে। এতে অবদান রয়েছে উত্তর ভারতের মুসলিমদের সাথে দক্ষিণ ভারতের মুসলিমদেরও। অবদান রয়েছে পশ্চিম ভারতের মুসলিমদের সাথে পূর্ব ভারতের মুসলিমদেরও। এদিক দিয়ে মুসলিমগণ হিন্দুদের চেয়েও অগ্রসর ছিল। হিন্দুদের তখনও সর্বভারতীয় কোন ভাষা দূরে থাক, বর্ণমালাই ছিল না। হিন্দিতে দেবনাগরীর প্রচলন আসে অনেক পরে। তাদেরকে শব্দভান্ডার গড়ে তুলতে সাহায্য নিতে হয় সংস্কৃত ভাষার ন্যায় একটি মৃত ভাষা থেকে। অথচ মুসলিমগণ উর্দুকে সমৃদ্ধ করেছে আরবী ও ফার্সির ন্যায় দুটি জীবন্ত ভাষা থেকে। ফলে উর্দু পরিণত হয় একটি প্রাণবন্ত ভাষায়। পরিণত হয় একটি প্যান-ইসলামিক ও প্যান-ভারতীয় ভাষা। উর্দু ভাষা শিখলে সহজ হয়ে যায় আরবী ভাষা শেখা। কারণ উর্দুর অধিকাংশ শব্দই আরবী ভাষা থেকে নেয়া। এককালে বাংলার মাদ্রাসাগুলোতে কুর’আন-হাদীসের পাঠ দেয়া হতো উর্দুর মাধ্যমে।

 

উর্দুর সামর্থ্য ও বাংলার দৈন্যতা

ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে উর্দুই ছিল একমাত্র ভাষা যা বাংলা, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, হায়দারাবাদ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, কাশ্মীর, গুজরাট, মাদ্রাজসহ সর্বভারতের শিক্ষিত মুসলিমদের প্রায় সবাই বুঝতো। কিন্তু সে মর্যাদা বাংলা ভাষার ছিল না। সিন্ধি, পাঞ্জাবী, গুজরাতী বা পশতু ভাষারও ছিল না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষার করার দাবী উঠে বস্তুত সে প্রেক্ষাপটেই। তাই এটিকে বাংলার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র বলা যায়? অথচ বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের পক্ষ থেকে সে মিথ্যাটিই লাগাতর বলা হয়ে থাকে। বাংলার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে দাবী উঠে সেটি নিছক পাকিস্তানে বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার কারণে। কিন্তু পূর্ব বাংলার পাশাপাশি পাকিস্তানে যে আরো ৪টি প্রদেশ আছে সে বিষয়টিকে ভাষা আন্দোলনের নেতারা বিবেচনায় আনেনি। সে প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি ও ইসলামদরদী মানসিকতাও তাদের ছিল না। ছিল না পাকিস্তানকে শক্তিশালী করায় আগ্রহ। প্যান-ইসলামিক হওয়ার বদলে তারা ছিল অন্ধ জাতীয়তাবাদী। বাংলা ও বাংলা ভাষার নামে পাকিস্তানের বিনাশও তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই তারা দাবী তুলেছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হলেও বাংলা ভাষা ছিল নিছক একটি প্রাদেশিক ভাষা, বাংলার বাইরে এর কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এমন একটি ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করলে কি পাকিস্তান লাভবান হতো? অথচ উর্দু পাকিস্তানের কোন একটি প্রদেশের ভাষা না হলেও সব প্রদেশের শিক্ষিত মানুষেরা সে ভাষাকে বুঝতো। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থ হাছিলের লক্ষ্যে ভাষা আন্দোলনের নেতারা সে সত্যটা সেদিন বুঝতে রাজী হয়নি। সেটি বুঝার সৎ ইচ্ছাও তাদের ছিল না।

পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন কায়েদে আযম মহম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি ছিলেন গুজরাতী। উর্দু তাঁর মাতৃভাষা ছিল না। বাংলা ভাষা বা অন্য কোন প্রাদেশিক ভাষার সাথে তার কোন শত্রুতা ছিল না। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক। সমগ্র রাষ্ট্রের কিসে কল্যাণ সেটিই ছিল তার প্রায়োরিটি। তাঁর বস্তুনিষ্ঠ বিচারে উর্দুর কোন বিকল্প ছিল না। কারণ একমাত্র উর্দুই ছিল সমগ্র পাকিস্তানের কাছে গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানী নেতারা তখন পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে একটি মাত্র ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতি ছিলেন। একাধিক ভাষা রাষ্ট্রভাষা হলে তাতে সংহতি না বেড়ে বিভক্তি বাড়বে, সে আশংকা তাদের ছিল। সে বিষয়টি ভাষা আন্দোলনের নেতাগণও পুরোপুরি বুঝতেন। সেজন্যই পাকিস্তান ভাঙ্গা যাদের লক্ষ্য ছিল, ভাষা আন্দোলন তাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এটিকে তারা রাজনীতির মূল হাতিয়ারে পরিণত করে। পাকিস্তানের তৎকালীন নেতারা যা আশংকা করেছিলেন ১৯৭১’য়ে সেটিই সত্য প্রমাণতি হয়েছে। সে সময়ের পাকিস্তানী নেতাদের ভূল-ত্রুটি যাই থাক, সে সত্যকে বুঝতে তারা আদৌ ভূল করেননি। অথচ ভাষা আন্দোলনের নেতাগণ তাদের পাকিস্তানবিনাশী চেতনাকে সেদিন কপট ভাবে গোপন করে রেখেছিল।  

তবে দেশের এ দুর্যোগ মুহুর্তে আলেমদের ব্যর্থতাও কি কম? তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দু। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষায় তখনো কোন তাফসির লেখা হয়নি। অনুদিত হয়নি কোন হাদিস গ্রন্থ । বাংলায় ইসলামী গ্রন্থ  বলতে বুঝাতে মাকছুদুল মু’মিনুন নামে নামাজ শিক্ষার বই, নিয়ামূল কুর’আন নামক দোয়া-ওজিফার বই এবং বেহশতি জেওয়ার নামক একটি মসলা মাসায়েলের বই। এবং ছিল আনোয়ার উপন্যাস ও বিষাদ সিন্ধু। সে সাথে কিছু পুথি সাহিত্য।  এ সামান্য কয়েক খানি বই দিয়ে কি বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠির চেতনায় পুষ্টি জোগানোর কাজ চলে? তাই বাংলাদেশে যারা  ইসলামকে বুঝতে চান এবং জনগণের মাঝে ইসলামের জ্ঞানের বিস্তার চান তাদের সামনে কুর’আন-হাদীস থেকে জ্ঞান লাভের একমাত্র মাধ্যম ছিল উর্দু ভাষা। তাই উর্দু ভাষা চর্চা নিষিদ্ধ করার অর্থ ইসলামের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। সেটি ছিল গৃহে পানির সাপ্লাই লাইন ছিন্ন করার ন্যায় ভয়ানক নাশকতা। পানির সাপ্লাই ছিন্ন করার অর্থ গৃহবাসীর মৃত্যু। তেমনি বুদ্ধিবৃত্তির ভাষার সাথে সংযোগ ছিন্ন করার অর্থ ইসলামী চেতনার মৃত্যু। তাছাড়া উর্দুর ন্যায় একটি সমৃদ্ধ ভাষার সাথে সংযোগ বাড়লে বাংলা ভাষা দুর্বল না হয়ে বরং তার শব্দ ভাণ্ডার আরো সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু সেক্যুলারিস্টদের সে সংযোগ ভাল লাগেনি। তাদের এই ষড়যন্ত্রটি শুধু উর্দুর বিরুদ্ধে ছিল না, সেটি ছিল ইসলামের বিরুদ্ধেও। লক্ষ্য ছিল, ঈমানের পরিপুষ্টির উপাদান থেকে মুসলিমদের বঞ্চিত করা।

কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো, বাঙালি মুসলিমদের ইসলামী জ্ঞানে জ্ঞানশূণ্য করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশের আলেমদের পক্ষ থেকে সেদিন কোন আন্দোলন গড়ে তোলা হয়নি। পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমদের সে ভয়ানক দুর্দিনে তারা নীরব ও নিষ্ক্রিয় থেকেছে। তারা বুঝতেই পারিনি ইসলাম ও মুসলিমদের কত বড় ক্ষতি হতে যাচ্ছে। ১৯৫২ সালের সে মুহুর্তটি ছিল বাঙালি মুসলিম জীবনের সবচেয়ে ক্রান্তিলগ্ন। সে মুহুর্তে নির্ণীত হতে যাচ্ছিল বাঙালি মুসলিমের ভবিষ্যৎ। বাংলার মাটিতে তখন অতি সক্রিয় ছিল ভারতপন্থী, রুশপন্থী, চীনপন্থী, মার্কিনপন্থী ইত্যাদি পরিচয়ে ইসলামের শত্রুপক্ষ। দেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে তখন সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, সোসালিস্ট ও নাস্তিকদের প্রচণ্ড তাণ্ডব। অথচ সেদিন নিষ্ক্রিয় ও বিভক্ত থেকেছে ইসলামপন্থীগণ। এরূপ বিভক্তি ও নিষ্ক্রিয়তায় একমাত্র শয়তানই খুশি হতে পারে। কারণ সেরূপ বিভক্তি হলো শয়তান ও তার অনুসারীদের বিজয়ী করার পথ। আজকের বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের যে শোচনীয় পরাজয় এবং বিপুল বিজয় ভারতপন্থী ইসলামের শত্রুপক্ষের –সে চুড়ান্ত ফয়সালাটি ভাষা আন্দোলনের ময়দানেই স্থির হয়ে যায়।

সে দুর্যোগ মুহুর্তে আলেমদের নিষ্ক্রিয় ও নীরব থাকার কারণ,  মাদ্রাসায় শিক্ষিত আলেমদের ছিল না রাষ্ট্র বিজ্ঞান, ইতিহাস বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় জ্ঞান। অতি সাধারণ বিষয়ও তারা বুঝতে ব্যর্থ হয় যে, ইসলামকে বিজয়ী করার যে রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি সেটি আদৌ কোন পেশাদারীত্ব নয়। এটিই হলো মুসলিম জীবনের পবিত্র জিহাদ। রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির জিহাদে না থাকার অর্থ ইসলাম ও তার শরিয়তী বিধানকে বিজয়ী করার লড়াই থেকে দূরে থাকা বা নিষ্ক্রিয় থাকা। এমন নিষ্ক্রিয়তা ইসলামে হারাম। একাজ ঈমানদারের হতে পারেনা। সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি না বুঝার কারণে দেশের  রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে বাঙালি মুসলিম আলেমদের ভূমিক অতি নগণ্য। আলেমদের মাঝে সে আগ্রহ না থাকার কারণ, মাদ্রাসাগুলিতে রাষ্ট্র বিজ্ঞান, ইতিহাস বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞানের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি পড়ানোই হয় না। ফলে এ বিষয়গুলির গুরত্ব তারা বুঝবেন কীরূপে? তাদের পাঠ্যসূচী স্রেফ কুর’আন-হাদীসে সীমিত।

অথচ আলেম শব্দের অর্থ জ্ঞানী। আল্লামা অর্থ: মহাজ্ঞানী। প্রশ্ন জাগে এসব গুরুত্ব বিষয়ে অজ্ঞতা নিয়ে কেউ কি আলেম বা আল্লামা রূপে জাহির করতে পারে? আল রাযী, আত তাবারী, ইবনে কাছির, আল কুরতুবী, ইবনে খলদুনের ন্যায় বিখ্যাত আলেমগণ নিজেদের নামের আগে কখনোই আলেম বা আল্লামা খেতাব লাগাতেন না। কিন্তু তাদের জ্ঞান শুধু কুর’আন-হাদীসে সীমিত ছিল না। সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস বিজ্ঞান, ভূগোল, দর্শন ও রাজনীতির ন্যায় নানা বিষয়ে তারা ছিলেন নিজ নিজ আমলের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। ইবনে খলদুনকে বলা হয় সমাজ বিজ্ঞানের জনক। আত তাবারী ছিলেন শুধু মুফাচ্ছিরে কুর’আনই ছিলেন না, ছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাস বিজ্ঞানী। কিন্তু বাংলাদেশে নামের আগে আলেম বা আল্লামা লাগানোয় যেরূপ আগ্রহ, সেরূপ আগ্রহ নেই জ্ঞানের জগতে বিচরণ নিয়ে। বুদ্ধিবৃত্তিক অসামর্থ্যতার কারণেই তারা চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে। এমন কি সাধারণ জনগণও একাজে তাদেরকে যোগ্যবান ভাবেন না। শুধু তাই নয়, সমাজ বিজ্ঞানের এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অজ্ঞতার কারণেই তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হন ইসলামের শত্রুদের পক্ষ থেকে পরিচালিত সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তকি যুদ্ধের ভয়ানক পরিণতিটি বুঝতে। আজ বাংলাদেশের বুকে ইসলামপন্থীদের যে বিপর্যয়, সেটি তাদের নিজ হাতের কামাই। তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে ময়দান বহু আগেই দখলে গেছে ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে।   

 

ভাষাপূজা বনাম ঈমানের সুরক্ষা

ইমানদারকে শুধু দেহ বাঁচালে চলে না, ঈমানও বাঁচাতে হয়। নইলে জাহান্নামে যেতে হয়। ঈমান বাঁচাতে যে ভাষায় কুর’আনের জ্ঞান পাওয়া যায় মুসলিমকে সে ভাষা থেকেই জ্ঞান আহরণ করতে হয়। এটি ফরজ। ভাষা পূজায় সে কাজ উপেক্ষিত হলে ঈমানের মৃত্যু ঘটে। মিশর, সূদান, আলজেরিয়া, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, ইরাক, সিরিয়া, লেবাননের ন্যায় বহু দেশের মানুষ সে ফরজ পালনের তাগিদে নিজেদের মাতৃভাষাকে দাফন করে আরবী ভাষাকে নিজেদের ভাষা এবং সে সাথে রাষ্ট্রের ভাষা রূপে গ্রহন করেছিল। কারণ তারা বুঝেছিল, মায়ের ভাষায় পূজা দিয়ে জ্ঞানার্জনের ফরজ পালন হবে না। তাতে আত্মা পুষ্টি পাবে না, ঈমানও বাঁচবে না। একমাত্র ইসলামী জ্ঞানই সন্ধান দেয় সিরাতাল মুস্তাকীমের। তখন মুক্তি আসে এ দুনিয়ায় ও আখেরাতে। নইলে ব্যর্থ হয় সমগ্র বাঁচাটাই। এরূপ ঈমানী উপলব্ধিটি বাংলার অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মনে ১৯৪৭’য়ের পূর্বে যেমন ছিল, তেমনি ১৯৪৭’য়ের পরও ছিল। এমন একটি আত্মীক ক্ষুধা বাংলার ন্যায় পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের ন্যায় অ-উর্দুভাষী প্রদেশেও ছিল। ঈমানের এমন দাবীতে অনেক বাঙালি মুসলিম আরবী হরফে বাংলা লেখার চিন্তাভাবনাও করেছিলেন। তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল মুসলিম রূপে বাঁচা ও বেড়ে উঠা, স্রেফ বাঙালি রূপে নয়। তাদের যুক্তিটি ছিল, হিন্দুদের রচিত বাংলা সাহিত্য মুসলিম মানসে দুষিত চিন্তার জীবাণু ছড়াবে। পাইপ যোগে ঘরে দূষিত পানি পৌঁছতে থাকলে তাতে দেহ বাঁচে না। তেমনি সাহিত্যের মাধ্যমে চেতনায় মিথ্যা ও দূষিত দর্শনের জীবাণু পৌঁছতে দিলে ঈমান বাঁচে না। ভাষা এক্ষেত্র শয়তানের হাতিয়ার রূপে কাজ করে। ভাষা যখন দুষ্টচিন্তার ও মিথ্যার বাহন হয় তখন ঈমান বাঁচাতে সে ভাষার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়। প্রাচিন সভ্যতার দেশ রূপে পরিচিত মিশর, ইরাক ও ইরানের জনগণ তেমন একটি প্রয়োজনেই তাদের হাজার বছরের পুরনো ভাষাকে কবরে পাঠিয়ে দেয় এবং আরবীকে গ্রহণ করে। এবং একাত্ম হয় মুসলিম উম্মাহতে।  ঈমানদারের কাছে ঈমান বাঁচানো জরুরি, ভাষা বাঁচানো নয়। ভাষা মানুষের জন্য, মানুষ ভাষার জন্য নয়।

বাঙালি হিন্দুগণ মুসলিমদের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব করতে না পারলেও সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব করছে তো এই ভাষার সংযোগের কারণে। ফলে রবীন্দ্রনাথের মত মুসলিম বিদ্বেষী এবং হিন্দু আধিপত্যবাদের কবি পরিণত হয়েছে বাঙালি সেকুলারিষ্টদের আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক গুরুতে। অথচ এই সেই রবীন্দ্রনাথ যিনি তার সাহিত্যে মুসলিমদের যবন বলে গালি দিয়েছেন, মুসলিমের নির্মূলকে ধর্ম ভেবেছেন এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কলকাতার রাজপথে প্রতিবাদে নেমেছিলেন। তিনি জানতেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ করার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া। মুসলিম-প্রধান পূর্ববাংলার জন্য এ ছিল ব্রিটিশ সরকারের ওয়াদা। কিন্তু মুসলিমদের সে কল্যাণ সাম্প্রদায়িক রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগেনি। ভাল লাগেনি কলকাতার হিন্দু পত্রিকাগুলোরও। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তখন মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় বলে ব্যাঙ্গ করতো। জমিদার রূপে রবীন্দ্রনাথ নিজে রাজস্ব তুলতেন পূর্ব বাংলা থেকে। অথচ তিনি তাঁর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দু-অধ্যুষিত বোলপুরে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, যে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলার মুসলিমদের শিক্ষিত হওয়াকে পছন্দ করেননি, তাঁর গান পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে। যারা তার এ গানকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দিয়েছে তাদের লক্ষ্য বাঙালি মুসলিমের কল্যাণ নয়, বরং রবীন্দ্রপূজা এবং ভারতীয় মনিবদের তুষ্ট করা। দাসগণ কি এর চেয়ে বেশী কিছু ভাবতে পারে?

হিন্দুদের রচিত মুসলিম বিদ্বেষী বাংলা সাহিত্যের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে যারা আরবী হরফে বাংলা লেখার পরামর্শ রেখেছিলেন তাদের যুক্তি ছিল, এতে বাঁচবে বাংলার মুসলিম মানস। এবং সংযোগ বাড়বে আরবী ও উর্দুর সাথে। এতে সমৃদ্ধি আসবে বাংলা ভাষায়। একই কারণ ভারতের মুসলিমগণ হিন্দি ভাষা থেকে ভিন্নতর বর্ণমালায় উর্দু লেখা শুরু করে। হিন্দু সাহিত্য ও মুসলিম সাহিত্য এক নয়। যেমন এক নয় উভয়ের ধর্ম, জীবনবোধ ও দর্শন। উর্দু ও হিন্দির জন্ম মূলত একই ভৌগলিক এলাকায়। কিন্তু দু’টি ভাষার মাঝে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল দেওয়াল এবং সেটি শুধু বর্ণমালার নয়, শব্দ, উপমা ও দর্শনের। একই ভূমিতে জন্ম নেওয়া সত্ত্বেও উর্দু ছুটেছে আরবী-ফারসীর দিকে। আর হিন্দি ছুটেছে সংস্কৃত ভাষার দিকে। ঈমান বাঁচানোর সে তাগিদে বাংলার মুসলিমদেরও অনেকে তাই আরবী হরেফে বাংলা লেখার কথা ভাবতেন। কিন্তু সে জন্য কি পাকিস্তানকে দায়ী করা যায়? এমন এক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল –সেক্যুলারিস্টদের সে বয়ানটি অসত্য। সেটি ছিল ধর্মপ্রাণ ও ইসলামী জ্ঞান-পিপাসু মানুষের মনের দাবী। সে দাবী ছিল ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলিমদেরও। বরং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই এ বিষয়টি নানা ভাষাভাষী ভারতীয় মুসলিমদের মাঝে চিন্তাভাবনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। একই রূপ প্রয়োজনের তাগিদে ফার্সি ভাষা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পেয়েছে আফগানিস্তানে। 

তবে খাদ্যের ক্ষুধার ন্যায় জ্ঞানের ক্ষুধাও সবার থাকে না। খাদ্যের ক্ষুধা তো স্বাস্থ্যের লক্ষণ। জ্ঞানের ক্ষুধা তেমনি সুস্থ ঈমানের লক্ষণ। স্বাস্থ্য-পতনে যেমন ক্ষুধা লোপ পায়, তেমনি ঈমানের দুর্বলতায় লোপ পায় জ্ঞানের ক্ষুধা। বিশেষ করে ইসলামী জ্ঞানের। তখন ক্ষুধা বাড়ে অখাদ্যে। তাই একজন ব্যক্তি কতটা ইসলামী বই পড়ে -তা দেখেই তার ঈমানের পরিমাপ দেয়া যায়। বাঙালি মুসলিমের ঈমানের ভূমিতে পচনের শুরুটি জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ও সেকুলারিজমের ন্যায় বাতিল মতবাদে দীক্ষা ও ইসলামে অঙ্গীকারহীনতা থেকে। সেটি আরো প্রকট রূপে প্রকাশ পায় দুর্বৃত্তিতে বার বার শিরোপা পাওয়ার মধ্য দিয়ে। ঈমানের এমন প্রকট রোগে যারা আক্রান্ত তাদের মাঝে কুর’আন শিক্ষায় আগ্রহ থাকবে -সেটি কি আশা করা যায়? ইসলামী জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে আরবী, উর্দু বা অন্য কোন ভাষা শেখা এজন্যই তাদের কাছে অনর্থক মনে হয়।

সেক্যুলার বা বামপন্থী বাঙালিদের কাছে ভাষার গুরুত্ব বিবেচিত হয় সে ভাষায় কথা বলা, গান করা, সাহিত্য রচনা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অফিস আদালত চালানোর মধ্যে। একারণেই ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মনের আকুতিটি তারা বুঝতেই পারেনি। বরং তারা মনেপ্রাণে ভয় করতো উর্দুকে। কারণ উর্দু নিছক ভাষা ছিল না, ছিল প্যান-ইসলামিক চেতনার প্রতীক। এ ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছিল এমন শত শত প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিক, আলেম ও গ্রন্থকার, যাদের মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। উর্দু ভাষায় সবচেয়ে শক্তিশালী কবি এসেছেন পাঞ্জাব থেকে; তিনি হলেন আল্লামা মহম্মদ ইকবাল। এবং সবচেয়ে শক্তিশালী গদ্য লেখক এসেছেন বাংলা থেকে; তিনি হলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। অনেকে প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক এসেছে দক্ষিণ ভারতের হায়দারাবাদ থেকে। ভারতের অন্য কোন ভাষার এরূপ ভারতব্যাপী চর্চা নাই। এ কারণে যেখানেই উর্দু ভাষার চর্চা বেড়েছে সেখানেই জোরদার হয়েছে প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্ব। এমন কি পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে সমগ্র ভারত জুড়ে যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরী হয় তার পিছনেও উর্দু ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তানের বুকে এজন্যই সিন্ধুর জিএম সৈয়দের জাতীয়তাবাদী “জিয়ে সিন্ধ” আন্দোলন এবং সীমান্ত প্রদেশের খান আব্দুল গাফ্ফার খানের পখতুনিস্তান আন্দোলনও মারা পড়েছে। অথচ পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে প্রথম আন্দোলন শুরু করেছিল তারাই। বাংলার সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের কাছে সে ইতিহাস অজানা ছিল না।

বাঙালি সেক্যুলারিস্টগণ শুধু রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি নিয়েই খুশি থাকেনি। পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ভাষার চর্চাকেও তারা রুদ্ধ করে দেয়। ফলে ভাষা আন্দোলনের নামে বাংলা ভাষার উন্নয়ন যা হয়েছে তার চেয়ে সেটি বেশী হয়েছে পাকিস্তানের অবকাঠামোর মধ্যে বাঙালি মুসলিমের একাত্ম হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ। ফলে প্যান-ইসলামিক চেতনার বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের চেতনা পরিণত হয়েছে এক লৌহ দেয়ালে। রাষ্ট্রভাষা রূপে কোন ভাষাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অর্থ যে সে ভাষাকে জনগণের মুখ থেকে কেড়ে নেওয়া নয় -সে সত্যটুকুও বাঙালি জাতীয়তাবাদীগণ মেনে নিতে রাজী ছিল না। প্রায় ৫ শত বছর ধরে বাংলাদেশে রাষ্ট্র ভাষা ছিল ফার্সি এবং তার পর এসেছে ইংরেজী, তখন কি বাংলাকে বাঙালির মুখ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল? রাষ্ট্রভাষা না হওয়াতে পাঞ্জাবী, সিন্ধি,পশতু বা বেলুচ ভাষাও কি পাকিস্তান থেকে বিলুপ্ত হয়েছে? অথচ এ নিয়ে কত মিথ্যাচারই না হয়েছে এবং আজও হচ্ছে।

 

প্রকল্প অশিক্ষিত করার

১৭৫৭ সালে ব্রিটিশের হাতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হওয়ায় মুসলিমদের জীবনে যে শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল তা নয়, প্রচণ্ড বিপর্যয় এসেছিল মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রেও। ব্রিটিশগণ বাংলার অর্থনীতি, বিশেষ করে বিশ্ববিখ্যাত মসলিন শিল্পকে বিনষ্ট করার লক্ষ্যে মসলিন শিল্পিদের আঙুল কেটেছিল। অর্থনীতি ধ্বংসের সাথে ব্রিটিশেরা প্রকল্প নেয় মুসলিমদের অশিক্ষিত করায়। সে প্রকল্পের অংশ রূপে তারা ফার্সি ভাষা চর্চা বন্ধ করে। সেটি করে বাংলার ৪০ হাজারের বেশী মাদ্রাসার জায়গাজমি কেড়ে নিয়ে। সেগুলি ছিল পূর্বেকার মুসলিম শাসকদের দেয়া খাজনামুক্ত জমি। ব্রিটিশ সরকার মাদ্রাসার সে জমি কেড়ে নিয়ে হিন্দু জমিদারদের দেয়। ব্রিটিশ সরকার এভাবেই অসম্ভব করে তুলেছিল মুসলিমদের মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। কারণ, অজ্ঞতা, অশিক্ষা ও কুশিক্ষায় আর যাই হোক সত্যিকার মুসলিম হওয়া যায় না। এজন্যই মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম নামাজ-রোজা ফরজ না করে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেন। কিন্তু শয়তান কখনোই মহান আল্লাহতায়ালা সে এজেন্ডা কার্যকর হতে দেয় না। কাফের ব্রিটিশগণও দেয়নি। তাদের হামলাটি এ জন্যই শুধু মুসলিম অর্থনীতির উপর ছিল না, কঠোর হামলাটি ছিল তাদের শিক্ষাব্যবস্থার উপরও।  

ব্রিটিশদের হাতে অধিকৃত হওয়ার আগে বাংলার রাষ্ট্রভাষা এবং সে সাথে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ভাষা ছিল ফার্সি। ইংরেজ শাসকেরা ইংরাজী চালু করে এবং ফার্সি ভাষায় জ্ঞানলাভ অসম্ভব করে। ইংরেজদের হাতে এটিই ছিল মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি। এভাবেই ইংরেজগণ বাংলার মুসলিমদের দ্রুত মূর্খ এবং সে সাথে দরিদ্র বানায়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পে মুসলিমগণ ব্রিটিশদের প্রতিদ্বন্দী হোক- সেটি তাদের কাম্য ছিল না। তাছাড়া শিক্ষা আত্মসচেনত করে; আগ্রাসনের মুখে প্রতিবাদী ও প্রতিরোধীও করে। সৃষ্টি করে জিহাদের জজবা। জ্ঞানচর্চা থেকে দূরে সরলে, দূরে সরতে হয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতা থেকেও। তখন ভাটা শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তিতেও। মানুষ তখন পথ হারায়। এমন একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখেই অশিক্ষা ও অর্থনৈতিক দুর্গতি একত্র নামানো বাংলার মুসলিম জীবনে। এমন কি সেটি ধরা পড়ে ব্রিটিশ শাসনামলের ইংরেজ আমলা ও লেখক ডব্লিও. ডব্লিও. হান্টারের চোখে। তিনি লিখেছেন, “যেসব মুসলিমদের পক্ষে একসময় দরিদ্র হওয়াই অসম্ভব ছিল এখন (ব্রিটিশ সরকারের নীতির কারণে) তাদের পক্ষে স্বচ্ছল থাকাই অসম্ভব হয়েছে।”

 

বাঙালি হিন্দুর রেনাসাাঁ ও বাংলা সাহিত্যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা

বাংলায় ইংরেজ শাসনের ফলে আয়, আনন্দ ও প্রতিপত্তি বেড়েছিল হিন্দুদের। সেটি মুসলিমদের বিস্তর ক্ষতির বিনিময়ে। দখলদার ইংরেজগণ শুরুতেই বুঝেছিল, মুসলিমদের মনে কখনোই তাদের ন্যায় কাফের শাসকের প্রতি বন্ধু হওয়ায় আগ্রহ নাই। মুসলিমগণ তাদেরকে মনেপ্রাণে শত্রু মনে করে। ফলে ইংরেজ শাসনকে দীর্ঘায়ীত করার লক্ষ্যে স্ট্রাটেজী হয় হিন্দুদের সাথে পার্টনারশিপ গড়ে তোলা । মুসলিমদের দাবীয়ে রাখার পাশাপাশি পলিসি হয় হিন্দুদের উপরে তোলা। এবং সেটি শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে। সবচেয়ে বেশী সুবিধা পায় বাঙালি হিন্দুগণ। ভারত জুড়ে সর্বত্রই তখন গোরা বাবুদের পাশে দেখা যেত বাঙালি হিন্দু বাবুদের। ইংরেজগণ তখন মুসলিম শাসনামলের ভূমি আইন পরিবর্তন করে চালু করে চিরস্থায়ী প্রথা -যার ফলে সৃষ্টি হয় অর্থশালী হিন্দু জমিদার শ্রেণী। পোষা কুকুরের ন্যায় এ জমিদার শ্রেণী পরিণত হয় ব্রিটিশ শাসনের সার্বক্ষণিক পাহারাদারে। হিন্দুদের জমিদারী অবকাঠামো পরিণত হয় মুসলিমদের উপর গোয়েন্দাগিরি ও নির্যাতনের হাতিয়ারে। 

হিন্দুগণ তখন ইংরেজী ভাষা শেখার পাশাপাশি বাংলাভাষা গড়ে তোলাতেও মনযোগী হয়। বাংলাভাষার উন্নতি কল্পে ইংরেজ মিশনারীগণ গড়ে তোলে ছাপাখানা। বাংলাভাষায় সাহিত্য সৃষ্টিতে এগিয়ে আসে বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের ন্যায় বিশাল এক ঝাঁক সাহিত্যিক। তাদের সাহিত্যের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলার হিন্দুদের মাঝে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জাগরণ আনা। প্রতিবেশী মুসলিমদের জন্য তাদের সাহিত্যে কোন স্থান ছেড়ে দেয়নি। তাদের নিয়ে তাদের কোন ভাবনাও ছিলনা। অঙ্গীকারও ছিল না। তাদের সাহিত্য পড়লে মনেই হয় না, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম। হিন্দু সাহিত্যিকদের সাহিত্যে শব্দ, ভাবনা, উপমা ও দর্শন সংগৃহীত হতো সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেদ, রামায়ন, গীতা, মহাভারত থেকে। বাংলা মুসলিমদের মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুদের রচিত এ সাহিত্যে মুসলিমদের মনের খোরাক ছিল না। মিটতো না তাদের শিক্ষা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন। ফলে হিন্দুদের রচিত এ সাহিত্যে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাঙালি হিন্দুদের মাঝে রেনেসাঁ শুরু হলেও মুসলমিদের উপর তার কোন প্রভাবই পড়েনি।

 

বাঙালি মুসলিমের রেনেসাঁ ও বাংলায় উর্দু চর্চা

অশিক্ষা ও বিপর্যয় থেকে বাঁচবার জন্য মুসলিমদেরও নিজস্ব সাহিত্য চর্চায় হাত দিতে হয়। মুসলিমদের তখন ধাবিত হতে হয় অধিকতর সমৃদ্ধ উর্দু ভাষার দিকে। কারণ, বাংলায় ফার্সি ভাষা নিষিদ্ধ হলেও উর্দু ও ফার্সির চর্চা জোরে শোরে চলছিল দিল্লীসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে। নিছক চাকুরী ও শিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে আজ কোটি কোটি বাঙালি ইংরেজী শিখছে। সে বিদেশী ভাষা শিক্ষায় শত শত ঘন্টা ব্যয়ও করছে। কিন্তু তখন বাংলার মুসলিমদের উর্দু ভাষা শিক্ষার আবশ্যকতা ছিল আরো বেশী। সেটি চাকুরীর প্রয়োজনে ছিল না, ছিল মুসলিম রূপে বাঁচা ও বেড়ে উঠার প্রয়োজনে। সেটির প্রয়োজন ছিল অনন্তু-অসীম জীবনের আখেরাত বাঁচাতে। সে প্রয়োজনেই বাংলার বুকে গড়ে তোলা হয় নতুন মডেলের মাদ্রাসা। শুরু হয় উর্দু চর্চা। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির কোয়ালিশন সরকার। বাংলার প্রধানমন্ত্রী তখন শেরে বাংলা ফজলুল হক। সে সরকারের উদ্যোগে জোরদার করা হয় উর্দু শিক্ষার উদ্যোগ। ১৯৩৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক দ্বিধাহীন ভাবে ঘোষণা দেন, “আমি দৃঢ় ভাবে এ মত পোষন করি, যাদের মাতৃভাষা বাংলা, সেসব মুসলিম ছাত্রদের সবার জন্য উর্দুভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।” -(Star of India, 9 April, 1936).

এর পূর্বে ১৯৩৮ সালের ৩’রা এপ্রিল মুসলিম লীগের আসানসোল সম্মেলনে বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক মুসলিমদের সাংস্কৃতিক সংহতির স্বার্থে উর্দুকে মুসলিম ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলক করার উপর জোর দেন। -(Star of India, 9 April, 1938. p6)। বাংলার মুসলিমদের সৌভাগ্য হলো, হিন্দুদের মাঝে রেনেসাঁ মুসলিমদের তুলনায় অনেক আগে শুরু হলেও তারা অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক শাসন ক্ষমতা হাতে নিতে পারেনি। শাসন ক্ষমতা যায় মুসলিম প্রধানমন্ত্রীদের হাতে এবং ১১ বছর স্থায়ী হয়। প্রধানমন্ত্রী হন জনাব ফজলুল হক, জনাব সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিন। এবং সে সরকারের শিক্ষানীতির ফল হলো, সে সময় বাংলার বুকে শিক্ষিত এমন কোন বাঙালি মুসলিম পাওয়াই কঠিন ছিল যে উর্দু ভাষা জানতো না। অনেকে ফার্সিও জানতো। শেরে বাংলা ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দীন, সহরোওয়ার্দী, মাওলানা ভাষানী, ও শেখ মুজিবের ন্যায় নেতারা উর্দুতে অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। শুধু ফজলুল হক নন, উর্দুর পক্ষে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেন হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দী। তিনি বলেছিলেন, “উর্দু এবং উর্দু ও ফার্সির বর্ণমালা হলো আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষার দুইটি লৌহ দেওয়াল।”-(Star of India, 28th April, 193)। সৈয়দ আমির আলী বলেন, “আরবী এবং উর্দু সমগ্র ইসলামী বিশ্ব জুড়ে মুসলিমদের আবেগ ও অনুভূতির একতা গড়ে তোলে। একতা ছাড়া আর কোথায় অধিকশক্তির সন্ধান পাওয়া যাবে?”-(The Spirit of Islam, London, 1955)।

বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন এমনকি কিছু ইংরেজ পন্ডিত ব্যক্তিও। তখন বাংলার ডি.পি. আই. ছিলেন W.W. Hornwell । তিনি লিখেন, “The question of Urdu is the question of life and death of Mohammadan education in Bengal.”–(The Mussalman, 22 June 1917, p2-3). তার বক্তব্য ছিল, মোঘল শাসনের অবসানের পর ফার্সি চর্চাকে বাংলায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। এবং বাংলার মুসলিমদের বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। অথচ বাংলা ভাষা হলো হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক ধারণা, ঐতিহ্য এবং দর্শনের ভাষা -যা মুসলিমদের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। তার অভিমত ছিল, বাংলার মুসলিমদের বাংলা শিখতে হবে -কারণ এটি তাদের মাতৃভাষা। তবে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় হলো, সংস্কৃতির ভাষা উর্দু ও ফার্সি। তিনি এ কথাও উল্লেখ করেন, “এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুভব করেই বাংলার উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মুসলিগণ উর্দু ভাষা শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।” এমন একটি উপলব্ধি নিয়েই তিনি পরামর্শ রাখেন, বাংলার সকল মুসলিমদের জন্য উর্দু ভাষা শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হোক। এছাড়া তিনি উর্দু প্রশিক্ষণ স্কুল এবং উপযোগী উর্দু পাঠ্যবই প্রস্তুতেরও পরামর্শ রাখেন। -(The Mussalman, 22 June 1917, p 2-3)।

বাংলা সাহিত্য নিয়ে হিন্দুদের অভিমত কি ছিল -সেটিও দেখা যাক। শনিবারের চিঠিতে লেখক পরিমল গোস্বামী জোরের সাথে লেখেন, “বাংলা সাহিত্য হলো মূলত বাঙালি হিন্দুদের অবদান। সেহেতু বাংলার সাথে হিন্দুর আধ্যাত্মীক সংযোগ। এবং মুসলিমগণ বাংলার উন্নয়নে কোন কাজই করেনি। সুতরাং তাদের এর প্রতি কোন দরদও নেই।”-( শনিবারের চিঠি, ১০ম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, কার্তীক ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ১৩)। এ প্রসঙ্গে জয়া চ্যাটার্জীর লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি দেয়া যাক:  “বাংলার হিন্দু জাগরণের কথা লিখতে গিয়ে যদুনাথ সরকার আধুনিক বাঙলার ইতিহাসে মুসলিমদের অবস্থানকেও অস্বীকার করেন। তার কথা, আধুনিক বাঙলা হলো হিন্দু ভদ্রলোকদের সৃষ্টি। ব্রিটিশদের কাছ থেকে আহৃত দীপ্তির সাহায্যে তারা বাঙলাকে পুনরায় ভারতীয় সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে। অধিকার বলেই বাংলা তাই তাদেরই। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নব জাগরণই হলো শুধু ভদ্রলোকের সংস্কৃতির প্রতীক নয়, সেই সঙ্গে একটি হিন্দু বাঙলার, যেখানে মুসলিমের ঠাই নেই। –(জয়া চ্যাটার্জী, বাঙলা ভাগ হলো; ২০০২)

উর্দু শিক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে তখন বাংলায় গড়ে উঠে বহু সংগঠন। অনুষ্ঠিত হয় নানা শহরে সম্মেলন। ১৯১৭ সালে এমনই একটি সম্মেলন হয়ছিল বরিশালে। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বরিশাল কনফারেন্সে যে প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছিল তা হলো:
• আরবী ও ফার্সি ভাষার শিক্ষাদান ৭ম শ্রেণী থেকে নয়, ৫ম শ্রেণী থেকে শুরু করতে হবে
• যাদের মাতৃভাষা উর্দু নয় তাদের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পরীক্ষায় উর্দুকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃত দিতে হবে।
• কলকাতা মাদ্রাসা ও অন্যান্য মাদ্রাসার নিম্নশ্রেণীতে বাংলা ও উর্দুকে একে অপরের বিকল্প ভাষা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। -( The Mussalman, 11 May 1917 p3)।

১৯০৮ সালের ১৮ই এপ্রিলে পূর্ণিয়াতে অনুষ্ঠিত হয় মোহমেডান এডুকেশন কনফারেন্স। সে কনফারেন্সে সৈয়দ আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী বাঙলার মুসলিমদের উর্দু শেখার প্রতি আহবান জানান। -(The Mussalman, 24 April 1908 p5.)। ১৯৩৩ সালে ২রা জুলাই কিদিরপুরে অনুষ্ঠিত হয় বেঙ্গল প্রাদেশিক উর্দু কনফারেন্স। সে অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে জনাব এস.ওয়াজেদ আলী মুসলিমদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র ও ঐক্যের উপর জোর দেন। তিনি বলেন, সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা ও জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার স্বার্থে উর্দু জরুরি ।-(The Mussalman, 4 July 1933 p.9)। 

বাঙালি কেন উর্দু কনফারেন্স করবে? কেনই বা উর্দুর পক্ষে কথা বলবে সেটি আজকের মত সেদিনেও অনেকের মনে উদয় হয়েছিল। সে প্রশ্নের উত্র দিতে গিয়ে উর্দু সম্মেলনের জনৈক সেক্রেটারি বলেন,“উর্দু সম্মেলন বিশুদ্ধভাবে মুসলিমদের নিজস্ব ব্যাপার। তাই এটি ভিতরের আহ্বান।” -(The Mussalman, 5th July, 1933, p2)। অর্থাৎ উর্দুর প্রতি তাদের এ আগ্রহের পিছনে কোন সরকারের বা গোষ্ঠীর চাপ ছিল না। বরং তারা সেটি করেছেন নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে। পুষ্টিকর খাদ্যের সন্ধানে স্বাস্থ্য-সচেতন ব্যক্তি মাত্রই নিজ গরজে রাস্তায় নামে, কারো চাপের প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাতেও উর্দুর প্রতি এমন এক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি এক প্রয়োজনের তাগিদে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বহু বাংলাভাষী নেতা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী করেছিল তেমনি এক প্রেরণা থেকে। এমন একটি প্রেরণাকে কি পশ্চিম পাকিস্তানীদের চাপিয়ে দেওয়া ষড়যন্ত্র বলা যায়? উর্দুতো পশ্চিম পাকিস্তানের কোন এলাকার ভাষা ছিল না। বাঙালি বুদ্ধিজীবীগণ ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গে সে বিষয়টি আদৌ সততার সাথে বিবেচনা করেনি। 

 

উপমহাদেশে উর্দু ভাষা ও প্যান-ইসলামীজম

ইসলামী জ্ঞানের বিশাল ভান্ডারের পাশাপাশি উর্দু ভাষার মাধ্যমে বাংলার মুসলিমদের আরেকটি রাজনৈতিক সুবিধাও হাছিল হয়। সেটি হলো, আত্মীক সম্পর্ক গড়ে উঠে ভারতের বিভিন্ন কোণের মুসলিমদের সাথে। তখন বাংলার রাজধানী কলকাতা পরিণত হয় উর্দু চর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে। এ শহর থেকেই তখন প্রকাশিত হতো তৎকালীন ভারতের জাগরণ সৃষ্টিকারি আল-হেলালের ন্যায় উর্দু পত্রিকা। আল-হেলালের সম্পাদক ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। তখন তিনি খেলাফত আন্দোলনে পক্ষে জনমত গড়ে তুলছিলেন। এই পত্রিকাটির কারণেই বাংলার মুসলিমদের মাঝেই শুধু নয়, জাগরণ আসে এবং প্যান-ইসলামী চেতনা গড়ে উঠে সমগ্র ভারত জুড়ে। ফলে মহম্মদ আলী জওহর, শওকত আলী, আবুল কালাম আজাদ পরিচালিত খেলাফত আন্দোলনে দ্রুত একাত্ম হয় বাংলার মুসলিমগণ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল অনুপ্রেরণা তো এসেছিল এই প্যান-ইসলামী চেতনা থেকেই। তাই ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো তখন রাষ্ট্র ভাষা রূপে উর্দুই প্রাধান্য পাবে -সেটিই কি স্বাভাবিক ছিল না? বরং সে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই। অথচ ইর্ষাকাতর বাঙালি সেকুলারিষ্টগণ উর্দুর প্রতি আগ্রহকে দেখেছে বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রূপে।

মুসলিম মানসে বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের নায়কদের বড় সফলতা হলো, বাঙালি মুসলিমদের হাতে এ আন্দোলনটি একটি প্রায়োরিটির তালিকা ধরিয়ে দিয়েছে। সেটি হলো, তারা প্রথমে বাঙালি। তারপর বাংলাদেশী। এবং তারপর মুসলিম। ভাষা আন্দোলন কতটা গভীরভাবে বাংলাদেশের মুসলিমদের ডি-ইসলামাইজড করেছে এই হলো তার উদাহরণ। এটিই হলো সেকুলারাইজেশনের এক চুড়ান্ত বিজয়। অথচ মুসলিমদের কাছে তার মুসলিম পরিচিতিটিই মূল। আল্লাহর কাছে বিচার দিনে একমাত্র তাঁর মুসলিম পরিচিতিটাই গুরুত্ব পাবে, বাঙালি বা বাংলাদেশী পরিচয় নয়। প্রশ্ন উঠবে,তার মুসলিম পরিচিতিটি কতটা পূর্ণাঙ্গ, কতটা জিহাদপূর্ণ ও কতটা আপোষহীন। কে কতটা বাঙালি রূপে বাঁচলো -সে প্রশ্ন সেদিন উঠবেই না। প্রশ্ন হলো, যে পরিচয় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে গুরুত্ব রাখে না -সে পরিচয় মুসলিমের কাছে এতো গুরুত্ব পায় কীরূপে? এটি কি ঈমানের স্খলন নয়? অথচ সে স্খলনটিই বাঙালি মুসলিম জীবনে প্রকট।

 

প্যান-ইসলামিক চেতনার বিনাশ এবং বিভক্তির পথে বাঙালি মুসলিম

নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের ন্যায় মুসলিম জীবনের অন্যতম ফরজ বিধানটি হলো মুসলিমদের একতা গড়া। স্বাধীনতা, ইজ্জত ও শক্তি নিয়ে বাঁচতে হলে একতার বিকল্প নাই। যা কিছু মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভক্তি গড়ে -সেটাই হারাম।  সকল বিজয়ই একতার পথ ধরে আসে। বিভক্তির পথ মানেই পরাজয়, বিপর্যয় ও গোলামীর পথ। যে কোন দেশে জনগণের মাঝে বিভক্তি গড়া হয় ভাষা, বর্ণ, গ্রোত্র ও অঞ্চলের নামে। সেরূপ বিভক্তির প্রবল চেষ্টা হয়েছে এমন কি নবীজী (সা:)’র আমলেও।  মুনাফিকদের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা হয়েছে আনসার ও মোহাজিরদের মধ্য সংঘাত সৃষ্টির। সে প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহতায়ালার বিধানও এসেছে। নবীজী (সা:)’র আমলেই বিভক্তি গড়ার এরূপ সকল প্রচেষ্টাকে হারাম এবং ফৌজদারী অপরাধ ঘোষিত হয়েছে। বিভক্তি গড়া হতো গোত্রের নামে। নবীজী (সা:)’র হাদীস: “সে আমাদের কেউ নয় যে গোত্রের জন্য যুদ্ধ করে। সে আমাদের কেউ নয় যে গোত্রের জন্য মারা যায়।” এখন বিভক্তি গড়া হয় ভাষা, বর্ণ, জাতি ও অঞ্চলের নামে। যে কোন বিভক্তিই ইসলামে হারাম।  মুসলিমকে তাই শুধু নামাজী ও রোজাদার হলে চলে না, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে প্যান-ইসলামিক হতে হয়। এটি বাধ্যতামূলক; এখানে আপোষ চলে না। মুসলিম জীবনে এ চেতনাটি মজবুত হলেই মুসলিম উম্মাহর শক্তি বাড়ে। নইলে বিভক্ত আসে; এবং তাতে উম্মাহ শক্তিহীন ও দুর্বল হয়। তখন অনিবার্য হয় শত্রুর হাতে পরাজয় ও অধিকৃতি। মুসলিমদের আজ জনশক্তি বেড়েছে, সম্পদও বেড়েছে। কিন্তু তাদের পরাজয়ের মূল কারণ হলো ভাষা ও ভূগোলের নামে বিভক্তি।

প্যান-ইসলামিক চেতনার মাঝেই মু’মিনের ঈমান দেখা যায়। নামাজ-রোজা অনেকেই পালন করে, কিন্তু তাদের অনেকেই ব্যর্থ হয় ভাষা, গোত্র, অঞ্চল ও বর্ণের বন্ধন থেকে উপরে উঠতে। প্যান-ইসলামিক চেতনা নিয়ে বেড়ে উঠায় যে ব্যর্থতা, সেটি মূলত পূর্ণ ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠায় ব্যর্থতা। অর্থাৎ পূর্ণ মুসলিম হওয়ায় ব্যর্থতা। ভাষা, বর্ণ ও ভূগোলের নামে যখন অন্যভাষী মুসলিমদের সাথে প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্ব নিয়ে বেড়ে উঠাকে বাধাগ্রস্ত করা হয় -তখন বুঝতে হবে সেটি মহান আল্লাহতায়ালার বিধানের সাথে গাদ্দারী। এটি কখনোই কোন ঈমানদারের কাজ হতে পারে না। মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার পথটি হলো একতার পথ। শয়তানকে খুশি করার পথটি হলো বিভক্তির পথ। অথচ কি বিস্ময়, বিভক্তির মধ্য দিয়ে মুসলিমগণ শয়তানকে খুশি করার পথটিই বেছে নিয়েছে। বাঙালি মুসলিমগণ তা থেকে ব্যতিক্রম নয়।

প্রশ্ন হলো, যে ব্যক্তির জীবনে প্রথম প্রায়োরিটি হয় বাঙালি হওয়া, তার কাছে কি অন্যভাষী মুসলিমের সাথে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে একাত্ম হওয়াটি গুরুত্ব পায়? তখন বরং ভাষাগত পরিচয়টিই রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরই মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে যায়। ভাষা তখন ফেতনা রূপে খাড়া হয়। ভাষা আন্দোলনের সময় সেরূপ বহু ফেতনা দেখা গেছে। মিনারের নামে স্তম্ভ নির্মাণ, সে স্তম্ভের সামনে দল বেঁধে, নগ্ন পদে ও গান গেয়ে গেয়ে হাজির হওয়া, স্তম্ভের পদতলে শ্রদ্ধাভরে ফুল দেয়া –এমনটি আদৌ মুসলিম সংস্কৃতি নয়। এটি নিরেট হিন্দু সংস্কৃতি। সে সংস্কৃতির আবাদ বেড়েছে ২১ শে ফেব্রেয়ারির অনুষ্ঠানকে ঘিরে।

 

পাল্টে দেয় চেতনার ভূমি

ভাষা আন্দোলন পাল্টে দেয় বাঙালি মুসলিমের চেতনার ভূমি। পাল্টে দেয় বন্ধু ও শত্রুর সংজ্ঞা। নিজ দেশের নাগরিকও শত্রু গণ্য হয় -যদি সে বাংলাভাষাী  না হয়। যেমনটি পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বিহারীগণ গণ্য হয়েছে। অপর দিকে বাঙালি মাত্র বন্ধু গণ্য হয় –হোক সে হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, নাস্তিক বা অন্য দেশের নাগরিক। তখন গুরুত্ব হারায় অন্য ভাষী মুসলিম ভাইয়ের সাথে একতা গড়ার ফরজ বিধানটি। মুসলিমগণ এভাবেই বিভক্ত হয় এবং আনন্দ বাড়ায় শয়তানের। সেটিই ঘটেছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। ভাষাভিত্তিক বাঙালি পরিচয়টি তখন বাঙালি মুসলিমের প্যান-ইসলামিক পাকিস্তানী পরিচয়ের স্থানটি দখল করে নেয়। পাকিস্তান চিত্রিত হয় বাংলা ভাষা ও বাঙালির শত্রু রূপে। ফলে ভাষা আন্দোলনকারী বহু বাঙালির কাছে গুরুত্ব হারায় পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখার বিষয়টি। বরং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় ভারতের পশ্চিম বাংলার সাথে সম্পর্ককে ঘনিষ্টতর করা। প্যান-ইসলামিক চেতনা ঈমানের সহজাত গুণ; মুসলিমদের মাঝে একতা গড়তে এটি সিমেন্টের কাজ করে। ভাষা আন্দোলন সে সিমেন্ট খুলে ফেলে। এবং সেখান থেকেই শুরু হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার আন্দোলন। 

ভাষাভিত্তিক বাঙালি পরিচয়ের ভিত্তিতেই বাঙালি মুসলিমগণ মানসিক ভাবে শুধু পাকিস্তান ও উপমহাদেশের মুসলিমদের থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়নি, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মুসলিম জাহান থেকেও। সে বিচ্ছিন্নতাটির কারণেই দ্রুত গড়ে উঠে ভারতের সাথে একাত্ম হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চেতনাগত প্রস্তুতিটি। সে কারণেই কাশ্মীর, ভারত ও আরাকানের মজলুম মুসলিমদের মুক্তির বিষয় নিয়ে বাঙালি সেক্যুলারিস্টগণ মাথা ঘামায় না। সেগুলিকে মনে করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে বিষয়গুলির বদলে প্রতিবেশী ভারত বা মায়ানমারের সাথে সুসম্পর্ক বহাল রাখাই অধিক গুরুত্ব পায়। এখানে বাঙলি সেক্যুলারিস্টদের মাঝে কাজ করে পার্থিব স্বার্থ চেতনা এবং গুরুত্ব হারায় মুসলিম ভাতৃত্বের ঈমানী দায়ভার। একই কারণে নির্যাতিত ফিলিস্তিনীদের জন্যও বাংলাদেশ থেকে তেমন কোন সাহায্যই যায় না। মুসলিম উম্মাহর বেদনাদায়ক বিষয়গুলো বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের রাজনীতিতে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গই নয়। ফলে ইরাকে যুদ্ধ থামাতে ২০০৩ সালে লন্ডন ও রোমে ২০ লাখ মানুষের মিছিল হলেও, ঢাকার রাস্তায় ২০ হাজার মানুষও নামেনি।   

যখন কোন মুসলিম ব্যক্তি অন্য মুসলিমের ভাষা শিখে তখন তার সাথে শুধু মুখের যোগযোগই বাড়ে না, বাড়ে আত্মার সংযোগও। তখন গড়ে উঠে আত্মীক সম্পর্কও। ভাষার মূল কাজ তো এরূপ সংযোগ গড়া। এক কালে বাঙালি মুসলিম তাই ফার্সি, উর্দু ও আরবী শিখতো। বাংলা ভাষা চর্চার পাশাপাশি উর্দু শেখার কারণে বাংলার মানুষের যে লাভটি হয়েছিল তা হলো, উপমহাদেশের অন্য মুসলিমদের সাথে তাদের মনের সংযোগটি বেড়েছিল। সে সাথে বেড়েছিল জ্ঞানের ঐশ্বর্যও। বেড়েছিল ঔদার্যতাও। এরই ফলে বাঙালি মুসলিমগণ সামর্থ্য পায় উপমহাদেশের অন্য মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগে।

কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ফল দাঁড়ালো, অন্য ভাষার অবাঙালি ভাইয়েরা চিত্রিত হলো “ছাতুখোর” বা “মাওরা” দুশমন রূপে। অবাঙালিদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশে পাকিস্তান আমলে এ গালিটি বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের মুখে সচারচরই শোনা যেত। অথচ এক মুসলিম যে অন্য মুসলিমের ভাই – সে খেতাবটি মহান আল্লাহতায়ালার দেওয়া। তাই মুসলিমগণ একে অপরের ভাই বলবে -সেটি এক অলংঘনীয় ঈমানী দায়বদ্ধতা। নইলে গাদ্দারী হয় মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশের সাথে। ভাইয়ের ভাষা ভিন্ন হওয়ায় তাকে গালি দেয়া কুফরি। অথচ ভাষা আন্দোলন বাঙালি মুসলিমের মাঝে সে গাদ্দারী এবং কুফরিই প্রবলভাবে বাড়িয়েছে। এভাবেই ছিন্ন করা হয় পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মাঝে প্যান-ইসলামী বন্ধন। অথচ মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতা শুধু রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক অপরাধই নয়, ইসলামের দৃষ্টিতে হারামও। এমন বিচ্ছিন্নতাই যে কোন মুসলিম জনপদে আল্লাহর আযাব অনিবার্য করার জন্য যথেষ্ট। এরূপ আযাব নামিয়ে আনার জন্য পুতুল পূজার প্রয়োজন নেই। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে পবিত্র কুর’আনে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে, “এবং তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা সুস্পষ্ট ঘোষণা আসার পরও পরস্পরে মতভেদ ও বিভক্তি গড়লো। তারাই হলো সেই সব ব্যক্তি যাদের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব। -(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১০৫)।

জন্ম দেয় নৃশংস বাঙালি ফ্যাসিবাদের

সত্যিকার ঈমানদার ব্যক্তি শুধু নামাজ-রোজা এবং হজ্জ-যাকাতেই মনযোগী হয় না, একনিষ্ঠ হয় মুসলিমদের মাঝে একতা গড়াতে। কারণ, একতা গড়া ফরজ এবং বিভক্তি গড়া হারাম। এমন এক চেতনার কারণেই ১৯৪৭’য়ে বাঙালি মুসলিমগণ অন্যভাষী মুসলিমদের সাথে একত্রিত হয়ে পাকিস্তান গড়েছিল। ভাষা আন্দোলন সে বন্ধনের দ্রুত বিলুপ্তি ঘটায়। ফল হলো, বাঙালি মুসলিমের মাঝে শত বছর আগে যে চারিত্রিক, নৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুণ ছিল –তার দ্রুত মৃত্যু ঘটে। শত বছর আগে অন্ততঃ অন্য ভাষা, অন্য বর্ণ ও অন্য ভূগোলের মুসলিমদের ভাই বলার ঈমানী সামর্থ্য ছিল। তাদের সাথে একত্রে রাজনীতি করা এবং কাফির  শত্রুর বিরুদ্ধে একত্রে যুদ্ধ করারও আগ্রহ ছিল। এ বিষয়ে উল্লেখ্য যে, ১৯১২-১৩ সালের বলকান যুদ্ধে খলিফার বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য বাঙালি মুসলিমগণ ঘরে ঘরে মুষ্ঠির চালের হাড়ি বসিয়েছিল। সে চালের অর্থ খলিফাকে পাঠানো হতো। অনেকে খলিফার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে বলকানের রণাঙ্গণে  গিয়েছিল।

কিন্তু ভাষা আন্দোলন বাঙালি মুসলিমের মগজ থেকে প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনাকেই বিলুপ্ত করে দেয়। এবং জন্ম দেয় উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদের। এটিই হলো ভাষা আন্দোলনের বিষাক্ত নাশকতা। সে ফ্যাসিবাদী নৃশংসতা দেখা গেছে একাত্তরে –সেটি যেমন পাকিস্তানপন্থী বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে তেমনি অবাঙালিদের বিরুদ্ধে। তখন বাঙালি মুসলিমগণ উৎসবভরে অবাঙালি মুসলিমদের হত্যা করেছে এবং তাদের ঘর-বাড়ি, চাকুরি-বাকুরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য কেড়ে নিয়েছে। হাজার অবাঙালি মুসলিম নারীদের ধর্ষণও করেছে। কোন বাঙালি মুসলিমই সেদনি এমন নৃশংস বর্বরতার বিরুদ্ধে বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি। কোন বাঙালি রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী এ বর্বরতাকে নিন্দা করে কোন বিবৃতিও দেয়নি। সকল বিহারী পুরুষ, নারী ও শিশু চিহ্নিত হয়েছে বাঙালির শত্রু রূপে। যে সকল বিহারী নারী-পুরুষ- শিশুই বাঙালি হত্যার আসামী। ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে বহু লক্ষ বিহারী আজও বস্তিতে বাস করছে। তাদের সামনে কোন ভবিষ্যৎ নাই।  কোন মুসলিম দেশে লাখ লাখ মুসলিম শুধু মুখের ভাষা ভিন্ন হওয়ার কারণে এভাবে যুগ যুগ নিগৃহীত ও অবহেলিত হবে -সেটি কি ভাবা যায়? এটি তো মানবতাবিরোধী গুরুতর অপরাধ। অথচ সে অপরাধটি সংঘটিত হচ্ছে কোটি কোটি মানুষের চোখের সামনে বাংলাদেশে। ১৯৭১’য়ের পর বাংলাদেশে বহু সরকারই ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু তাদের ভাগ্য উন্নয়ন কোন সরকারেরই এজেন্ডা ছিল না। তাদের আশাহত অবস্থা কোন সরকারেরই মনে রেখাপাত করেনি। এমনকি বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীদের বিবেকেও সাড়া জাগায়নি। এভাবেই এই হতভাগা বিহারী মুসলিমগণ বিশ্ববাসীর সামনে নীরবে সাক্ষী দিয়ে যাচ্ছে বাঙালি মুসলিমদের বিবেকহীনতার।  অথচ এই বাংলাদেশীরা নানা দেশে পাড়ি জমায় এবং সেখানে তারা নানারূপ মানবিক অধিকার দাবী করে ও ভোগ করে। কিন্তু তারা নিজ দেশেই প্রায় ৬ লাখ বিহারীর মৌলিক মানবিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে।

তাই ১৯৫২’য়ের ভাষা আন্দোলন বাঙালি মুসলিমের জীবনে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি গড়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ইন্সটিটিউশন রূপে। এটি বাঙালি মুসলিম জীবনে এনেছে অভুতপূর্ব সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব। এতে শুধু রাজনৈতিক ভূগোলই পাল্টে যায়নি, পাল্টে গেছে বাঙালি মুসলিমের বিবেক, নীতিবোধ, মূল্যবোধ ও মনের ভূগোল। বিপুল বিজয় এনেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ফ্যাসিবাদের। মারা পড়েছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। এভাবেই বঙ্গীয় এ ব-দ্বীপে বাঙালি মুসলিমদের হাতে সংঘটিত হয়েছে ভয়ংকর আত্মঘাতী নাশকতা। এ নাশকতা অসম্ভব করেছে প্যান-ইসলামিক চেতনাধারি পূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাই শুধু নয়, বরং অসম্ভব করেছে স্বাভাবিক মানবিক গুণ নিয়ে বেড়ে উঠাও। এমন দেশে চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, অপহরণ, বিচার বহির্ভূত হত্যা, শাপলা চত্বরের গণহত্যা, ধর্ষণ, ধর্ষণে সেঞ্চুরি এবং দুর্নীতিতে ৫ বার বিশ্বে প্রথম হওয়ার ইতিহাস নির্মিত হবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? ১ম সংস্করণ ২১/১২/২০১৭; ২য় সংস্করণ ২৩/০২/২০২১; ৩য় সংস্করণ ২৪/০৮/২০২২।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *