হিন্দুত্ববাদী ভারত এবং বাঙালি মুসলিমের বিপন্ন মুসলিমত্ব ও স্বাধীনতা (পর্ব-১)

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 অধিকৃতিটি ভারতের

 বাংলাদেশের রাজনীতির উপর ভারতীয় অধিকৃতি যে প্রকট -সেটি বুঝতে গবেষণা লাগে না। সে অধিকৃতি স্পষ্ট বুঝা যায় শাসক দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির উপর ভারতের গভীর প্রভাব দেখে। ভারত জানে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ একটি প্রবল পক্ষ। এ দলটি ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের উপর দখলদারী প্রতিষ্ঠার কাজটি অতি সহজ হয়ে যায়। ভারত শুরু থেকেই আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে আসছে নিজ অধিকৃতি প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার রূপে। এখন এটি আর গোপন নয়, ভারত তার নিজ এজন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছিল ষাটের দশকেই। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র ফাঁস হওয়ার পর ভারতীয় সে প্রকল্প আর গোপন থাকেনি। ভারত শেখ মুজিবকে রিক্রট করেছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্পে তাকে ব্যবহার করতে। আগরতলা ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলেও ভারতের এজেন্ডা পূরণের রাজনীতি থেকে শেখ মুজিব কখনোই দূরে সরেননি। আগরতলা ষড়যন্ত্র যে লক্ষ্যে করা হয়েছিল -সে লক্ষ্যটি পুরোপুরি সফল হয় একাত্তরের যুদ্ধে।

শেখ মুজিবের বদ্ধমূল ধারণাটি ছিল, বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতী সাহায্য জরুরি। সেটি মুজিব ভারতের সে শক্তিটি নিজ চোখে দেখেছেন ১৯৭১’য়ে। জনগণের ভোট ও মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ তাকে ক্ষমতায় বসায়নি, তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।  মুজিব তখন থেকেই বুঝেছেন ক্ষমতায় থাকতে হলে ভারতের এজেন্ডার সাথে অবশ্যই একাত্ম হতে হবে। এজন্যই মুজিব ভারতকে খুশি করতে তার দলের নীতি ও এজেন্ডা পাল্টিয়েছে। উদাহরণ দেয়া যাক। যে নির্বাচনী মেনিফেস্টোর ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় তাতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিল না। সমাজতন্ত্রের কথাও ছিল না। কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর ১৯৭২ সালে যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয় তাতে ধর্মনিরপেক্ষবাদ ও সমাজতন্ত্র যোগ করা হয়। লক্ষণীয় হলো, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টো প্রণীত হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। তখন দলটির উপর কারো অধিকৃতি ছিল না। ফলে আওয়ামী লীগের নেতারা তখন যা যথার্থ মনে করেছেন স্বাধীন ভাবে সেটিই মেনিফেস্টোতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ১৯৭০’য়ের নির্বাচন হয়েছিল পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য। কিন্তু ১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনা বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর শুধু পাকিস্তানের নয় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ভূ- অবস্থা পাল্টে যায়। তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা শুধু  পূর্ব পাকিস্তানই অধিকৃত হয়নি, অধিকৃত হয়েছে আওয়ামী লীগও। ফলে পাল্টে যায় আওয়ামী লীগের নীতিমালাও।

দাবী করা হয় মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। অথচ ৯ মাস যুদ্ধের প্রথম ৮ মাস কালে তারা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান দূরে থাকে, কোন একটি জেলা, কোন একটি মহকুমা বা একটি থানাকেও স্বাধীন করতে পারিনি। পাকিস্তান আর্মির দ্রুত পরাজয় শুরু হয় নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে সরাসরি হামলা শুরুর পর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তূলনায় ভারতীয় সৈন্যদের সংখ্যা, যুদ্ধ বিমান ও যুদ্ধাস্ত্র ছিল কয়েকগুণ। ভারতের দখল যখন সমগ্র দেশজুড়ে, তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাহারাদারীতে শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তখন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরু হয় ভূমিকম্প। পরিবর্তন দেখা যায় বাংলাদেশের সংবিধান, প্রশাসন, শিক্ষানীতি, ধর্মনীতি, সংস্কৃতি, জাতীয় সঙ্গীত, মিডিয়া অন্যান্য বহু ক্ষেত্রে। সংবিধানে তখন যোগ হয় ধর্মনিরেপক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। শিক্ষা ও রেডিও-টিভিতে বাদ পড়ে কুর’আন-হাদীস। জাতীয় সঙ্গীত রূপে গাওয়া শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিক গান। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে ইসলাম ও মুসলিম ছিল, শুরু হয় সেগুলি থেকে ইসলাম ও মুসলিম সরানোর অভিযান। ভারতে বানারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় দোষের নয়, কিন্তু অসহ্য গণ্য হয় মুসলিম ও ইসলাম সংযুক্ত জাহাঙ্গির নগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও নজরুল ইসলাম কলেজের নাম। নিষিদ্ধ করা হয় সকল ইসলামী দলকে। এবং বিরামহীন যুদ্ধ শুরু হয় ইসলামের বিরুদ্ধে।  অথচ ১৯৭০’য়ের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সেরূপ একটি ইসলাম বিরোধী যুদ্ধের জন্য জনগণ থেকে ম্যান্ডেট নেয়নি   

একটি দেশের স্বাধীনতার অর্থ শুধু সেদেশের একটি পৃথক পতাকা ও মানচিত্র নয়; থাকতে হয় জনগণের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব। সে সার্বভৌমত্বের অর্থ শুধু রাজনৈর্তিক সার্বভৌমত্ব নয়, বরং সেটি হলো আদর্শিক সার্বভৌমত্ব। আদর্শিক সার্বভৌমত্বের অর্থ জনগণ যে ধর্ম ও আদর্শ নিয়ে বাঁচতে চায় সে স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার স্বাধীনতা। এর অর্থ, জনগণ যদি ইসলামের নীতিমালা তথা শরিয়তী বিধানের প্রতিষ্ঠা দিয়ে বাঁচতে চায় -তবে তাদেরকে সে অধিকার অবশ্যই দিতে হয়। মুসলিম দেশের আদালতে কুফুরি আইন চাপিয়ে দেয়া যায়না। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলিমদের সে সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়। সেটি করা হয়েছে ভারতের এজেন্ডা পূরণের প্রয়োজনে। ভারত বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূল নীতির মাঝে ধর্মনিরপেক্ষতার  নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর অর্থ দাঁড়ায়, যারা মহান আল্লাহতায়ালাকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারি মনে করে -তাদের জন্য নির্বাচনে অংশ গ্রহণ সাংবিধানিক ভাবে নিষিদ্ধ। একারণেই নিবন্ধন পাচ্ছে না জামায়াতে ইসলামী। এভাবেই অসম্ভব করা হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের যে কোন উদ্যোগকে। ফলে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে অসম্ভব করা হয়েছে নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নতের প্রতিষ্ঠা। এভাবে মুসলিমকে বাঁচতে বাধ্য করা হচ্ছে শরিয়ত-পালন ছাড়াই। এখানে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে। অথচ মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো, আইন-আদালত ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার ক্ষেত্রে ইসলামের পক্ষে অবস্থান নেয়া।

                         

ভারতের যুদ্ধ ও বাংলাদেশী ফুট-সোলজার

                                                                                                                                                    বাঙালি মুসলিমের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধটি বিরামহীন। এযুদ্ধের শুরুটি যেমন একাত্তরে নয়; তেমনি এ যুদ্ধটি শেষও হয়নি একাত্তরে। এ যুদ্ধের শুরু তখন থেকেই যখন বাঙালি মুসলিমগণ ভারতে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানে যোগ দেয়, পাকিস্তানকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত করে এবং দেশটিকে ভারতের প্রতিদ্বন্দী রাষ্ট্র হিসাবে খাড়া করে। পাকিস্তানের জন্ম থেকেই ভারত সিন্ধান্ত নেয় দেশটিকে খণ্ডিত করার। ফলে ১৯৪৭ থেকেই শুরু হয় ভারতের রণপ্রস্তুতি। ভারত যোগ দেয় সোভিয়েত শিবিরে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধে ভারতের জন্য প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানের ঘরের শত্রুদের পার্টনার রূপে বেছে নেয়া। পাকিস্তানের ঘরের শত্রু ছিল ইসলাম থেকে দূরে-সরা বাঙালি সেক্যুলারিস্ট, কম্যুনিস্ট, নাস্তিক, হিন্দু এবং বাঙালি জাতীয়তবাদীগণ। পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ছিল ইসলাম থেকে দূরে-সরা এই লোকদের রাজনৈতিক মঞ্চ।

একাত্তরের পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে, তবে তাতে ভারতের বিপদ কাটেনি। কারণ, বাঙালি মুসলিমদের চেতনা থেকে ইসলাম নির্মূলের কাজটি শেষ হয়নি। ফলে ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়ত, প্যান-ইসলামিক মুসলিম ঐক্য, জিহাদ -এধরণের ইসলামী মৌল বিশ্বাসগুলি নিয়ে বাস করে বিপুল সংখ্যক বাঙালি মুসলিম। এরাই ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের অখণ্ড ভারত নির্মাণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বাধা। ফলে এদের কুপানোর জন্য ভারতের কাছে আওয়ামী লীগের প্রয়োজন শেষ হয়নি। আজকের আওয়ামী লীগ যদি বিলুপ্তও হয়, ভারত আরেক আওয়ামী লীগকে ময়দানে নামাবে -যেমন বাকশালী মুজিবের হাতে বিলুপ্তপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগকে আবার জীবিত করেছে। কারণ, ভারতসেবী রাজনীতির যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য মুজিবের হাতে প্রতিষ্ঠা পায়, ভারত চায়, মুজিবের সে লিগ্যাসি বাংলাদেশের রাজনীতিতেচিরকাল বেঁচে থাকুক। তাই ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির কথা, বাংলাদেশে তারা আওয়ামী লীগকে দুর্বল হতে দিবে না। মুজিবের মৃত্যুর পর হাসিনাকে বসানো হয়েছে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধকে অব্যাহত ‌ও তীব্রতর করার প্রয়োজনে। 

                                                                                                                                                 প্রতিবেশীকে কখনো পাল্টানো যায় না। ফলে যতই অনিচ্ছা হোক, ভারতকে বাঁচতে হচ্ছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের প্রতিবেশী রূপে। এখানেই ভারতে বিপদ। কারণ, বাংলাদেশের পাশে বাঁচার অর্থই হলো ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্রের বিপদ নিয়ে বাঁচা। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিবেশী হওয়ার কারণেই পারস্য সাম্রাজ্য বিলীন হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে রোমান সাম্রাজ্য। ভারতের জন্যও এটি এক বিশাল ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। ইসরাইলের জন্য স্বাধীন ফিলিস্তিন যেমন বিপদজনক, ভারতের জন্য তেমনি বিপদজনক হলো স্বাধীন ও ইসলামী বাংলাদেশ। এজন্যই বাংলাদেশকে বিলুপ্ত করতে না পারলেও ভারত চায় ইসলাম এবং  ইসলামপন্থীদের বিলুপ্তি।  তাই ভারতের যুদ্ধটি যেমন বাঙালি মুসলিমদের চেতনার ভূমিতে, তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গণে। এ যুদ্ধে শেখ হাসিনা ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের একজন ফুট সোলজার মাত্র। শেখ মুজিবের ভূমিকাও এর চেয়ে ভিন্নতর ছিলনা। হাসিনার বর্তমান সেনাপতি হলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সিন্ধান্ত নেয় ও হুকুম দেয় সেনাপতিরা, ফুট সোলজারদের কাজ শুধু সে হুকুম ও সিদ্ধান্তগুলিকে কার্যকর করা। শেখ মুজিব যখন ভারতের ফুট সোলজার রূপে যুদ্ধ করেছে ইসলাম, গণতন্ত্র ও জনগণের বিরুদ্ধে, তখন তার সেনাপতি ছিলেন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। বাংলাদেশের সংবিধানের মূল নীতি কি হবে, কি হবে জাতীয় সঙ্গীত, স্কুলে কি পড়ানো হবে, কোন দলগুলির রাজনীতির অধিকার থাকবে, কোন দলগুলি নিষিদ্ধ হবে, কাদেরকে কারাবন্দী বা হত্যা করা হবে -সে বিষয়ে হুকুমনামা আসতো খোদ ইন্দিরা গান্ধি থেকে। মুজিবের কাজ ছিল অনুগত ভৃত্যের ন্যায় সেগুলি পালন করা। অপর দিকে ইন্দিরা গান্ধির কাজ ছিল মুজিবর গদির সুরক্ষা দেয়া। ভারতের একই নীতি হাসিনার সাথে।

ইতিহাসের যে বিষয়টি কখনোই ভূলবার নয় তা হলো, ভারত সরকারের যেসব ফুট সোলজারগণ পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য ১৯৪৭ সাল থেকেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, তাদের সাথে সে কাজে একাত্ম হওয়ার জন্য শেখ মুজিব আগরতলা যান। ইতিহাসে সেটিই আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। মুজিবের এ ষড়যন্ত্রের কথা পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দাগণ জেনে ফেলে; ফলে মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। ফুট সোলজারের চেয়ে বেশী কিছু হলে মুজিব কখনোই এতোটা নীচে নামতেন না। সেনাপতির পরিবর্তন হলেও ফুট সোলজারদের দায়িত্ব পাল্টায় না। তাই গণতনন্ত্র, ইসলাম ও বাংলাদেশীদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধটি মুজিবে লড়ে গেছে, সে অভিন্ন যুদ্ধটি লড়ছে শেখ হাসিনাও।

ভারতের যুদ্ধাংদেহী আগ্রাসী চরিত্রটি বুঝা যায় দেশটির যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখে। আর তাতে সংকট বাড়ছে বাংলাদেশের নিরাপত্তায়। বিশ্বের দুই শতাধিক রাষ্ট্রের মাঝে সবচেয়ে বেশী দরিদ্র মানুষের বসবাস ভারতে। অথচ ভারত হলো সমগ্র বিশ্বের মাঝে সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা। গড়ে তুলেছে বিপুল সংখ্যক পারমানবিক বোমা ও মিজাইলের বিশাল ভান্ডার। ভারতের এ অস্ত্র ভান্ডার কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়ার জন্য? সে সামর্থ্য কি ভারতের আছে? বরং উক্ত দেশগুলোর সাথে ভারত তার বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা বাড়াতে ব্যস্ত। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উষ্ণ ভারত সফর, নরেন্দ্র মোদীর চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরের মধ্য দিয়ে তো সেটিই ধরা পড়ে। ভারত তার সীমাবদ্ধতা বুঝে। বিশ্বজয়ের বদলে দেশটি দৃষ্টি দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়া জয়ে। লক্ষ্য, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভূটান ও নেপালের ন্যায় প্রতিবেশী দেশগুলোকে নতজানু রাখা এবং দক্ষিণ এশিয়ার বুকে একমাত্র বৃহৎ শক্তি রূপে নিজের আধিপত্য বহাল রাখা। এজন্যই বাংলাদেশের রাজনীতি ভারতের প্রভাব দিন দিন গভীরতর হচ্ছে।

প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে ভারতের  সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রটি যুদ্ধাস্ত্র নয়। বরং সেটি হলো রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অস্ত্র। সামরিক অস্ত্রে ভারত পাকিস্তানকে ১৯৪৮ এবং ১৯৬৫’য়ে পরাজিত করতে পারিনি। কিন্তু রাজনৈতিক,বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অস্ত্রে পাকিস্তানকে একাত্তরে নতজানু করে ফেলে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৬৫’য়ের যুদ্ধে বিজয় না পাওয়ার পর ভারত শেখ মুজিব ও লেন্দুপ দর্জি (সিকিমের ভারতপন্থী নেতা)’র ন্যায় তাঁবেদার নেতা ও শত শত অনুগত বুদ্ধিজীবী প্রতিপালনে মনযোগী হয়। শুরু করে আগরতলা ষড়যন্ত্রের ন্যায় নানারূপ ষড়যন্ত্র। এমন চানক্য নীতির সফলতাটি বিশাল। ভারতের অর্থক্ষয় এবং রক্তক্ষয়ও এতে কমেছে। এ নীতিতে ভারত যেমন সিকিমকে বিনা রক্তব্যয়ে ভারতভূক্ত করতে পেরেছে, তেমনি বাংলাদেশকে একটি নতজানু আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পেরেছে। তাজুদ্দীনকে দিয়ে ৭ দফা এবং শেখ মুজিবকে দিয়ে ২৫ সালা দাসচুক্তিও স্বাক্ষর করিয়ে নিতে পেরেছিল।

 

বাংলাদেশকেন্দ্রীক ভূ-রাজনীতি এবং ভারতের বাংলাদেশ-ভীতি

বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে ভারত নতুন বিপদ দেখছে। ভারত বুঝতে পেরেছে, বাংলাদেশকে ঘিরে  নির্মিত হচ্ছে এ এলাকার নতুন ভূ-রাজনীতি। ভারত জানে, বাংলাদেশের ১৮ কোটি নাগরিকের সবাই শেখ মুজিব ও তাজুদ্দীন নয়, লেন্দুপ দর্জিও নয়। ভারতের বাংলাদেশ বিরোধী কুকীর্তিগুলি ভারতসেবীগণ আওয়ামী লীগ  নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীগণ যতই লুকানোর চেষ্টা করুক, সেটি বাঙালি মুসলিমদের কাছে আদৌ কোন গোপন বিষয় নয়। সেগুলি তারা প্রতিনিয়ত টিভি’র পর্দায় দেখছে। তারা দেখছে, ভারতীয় মুসলিমদের সাথে তাদের নৃশংস আচরণ। দেখছে, কীভাবে সীমান্তে ভারতীয় BSF ‘য়ের সেনাদের হাতে বাংলাদেশীরা নিহত হচ্ছে। দেখছে, নৃশংস ফ্যাসিবাদী হাসিনার প্রতি ভারতের অন্ধ সমর্থন। এরই ফলে যে প্যান-ইসলামীক চেতনা নিয়ে বাঙালি মুসলিমগণ ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান বানিয়েছিল -ইসলামের সে মৌল চেতনাটি বিলুপ্ত না হয়ে বরং দিন দিন তীব্রতর হয়েছে। সেটি বুঝা যায় বাংলাদেশীদের মাঝে প্রবল ভারত বিরোধীতা দেখে। সে ভারতবিরোধীরা চেতনায় ধারণ করেই বাংলাদেশীরা এখন প্রকৃত স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চায়।  এবং কাঁধ থেকে নামাতে চায় ভারতীয় আধিপত্যের জোয়াল।

ভারতের কাছে স্বাধীন ও ভারতবিরোধী বাংলাদেশের অস্তিত্ব অসহ্য। ভারত চায়, ভারতীয় রাডারের নীচে অধিনত এক গোলাম বাংলাদেশ। সে কথাটি বলেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল শংকরাচার্য। ইসরাইলীদের মনে যেমন তীব্র হামাস ভীতি, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের মনে তেমনি তীব্র হলো বাঙালি মুসলিম ভীতি। বাংলাদেশ হিন্দু নেপাল নয়, বৌদ্ধ  শ্রীলংকাও নয়। ক্ষুদ্র ভূটানও নয়। গাজার জনসংখ্যা ২৩ লাখ, কিন্তু বাংলানদেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটি। তাছাড়া ভারত ইসরাইলের চেয়ে অধিক শক্তিশালী নয়। যে ইসলামী চেতনা হামাসের উত্থান ঘটিয়েছে, সে অভিন্ন ইসলামী চেতনা বাংলাদেশীদেরও। বোমা মেরে গণহত্যা চালানো যায়। হাসপাতাল, স্কুল ও ঘরবাড়ীকেও ধ্বংস করা যায়। কিন্তু ইসলামী চেতনাকে হত্যা করা যায় না। ইসরাইল তাই পারছে না। আফগানিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ, সোভিয়েত রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও পারিনি। স্বাধীন ভাবে বাঁচায় প্যান-ইসলামীক চেতনা নতুন আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিতে পারে পশ্চিম বাংলা, আসাম, আরাকানের মুসলিমদের মাঝেও। তখন স্বাধীনতায় আগ্রহ বাড়াবে ভারতের উত্তর-পূর্ব ৭টি রাজ্যের জনগণের মাঝেও। তাতে ত্বরিৎ পরিবর্তন আসবে এ এলাকার ভূ-রাজনীতিতে। এখানেই ভারতের ভয়। এজন্যই ভারত চায়, বাংলাদেশী মুসলিমদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। চায়, হাসিনার ন্যায় ভারতের অনুগত ফাসিস্ট শাসক। এ অবধি হাসিনা সে কাজটিই করছে। এজন্যই যে কোন মূল্যে ভারত হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে চায় -সেটি ভোটডাকাতি করে হলেও। ভারত চায়, বাংলাদেশীরা বেড়ে উঠুক মুজিব, তাজুদ্দীন ও লেন্দুপদর্জির ন্যায় ভারত-সেবী চেতনা নিয়ে। এবং দূরে সরে আসুক প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনা থেকে -যেমনটি তারা দূরে সরেছিল ১৯৭১’য়ে।

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *