জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ

কেন এত মিথ্যাচার?

আল্লাহর আর কোন হুকুম বা বিধানের বিরুদ্ধে এত মিথ্যাচার,এত কুৎসা ও এত হামলা হয়নি,যতটা হয়েছে জিহাদের বিরুদ্ধে। আস্তিক-নাস্তিক,সেক্যুলারিস্ট-সোসালিস্ট, জাতিয়তাবাদী-স্বৈরাচারি -ইসলামের সকল বিপক্ষ শক্তি এ হামলায় একতাবদ্ধ। গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন। সে মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই ব্রিটিশ সরকার কোলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা খুলেছিল। ধর্ম শিক্ষার নামে তখন ষড়যন্ত্র হয়েছিল ইসলামের মূল শিক্ষা লুকানোর। ফলে সে মাদ্রাসা থেকে বহু হাজার আলেম বেরুলেও তাদের দ্বারা ইসলামের প্রতিষ্ঠা বাড়েনি। বরং বিভ্রান্তি বেড়েছে জিহাদ নিয়ে। নবীজী(সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণ যেভাবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিজয় এনেছিলেন তা থেকে এ আলেমগণ অনেক দূরে। জিহাদের বিরুদ্ধে আজ  লেখা হচ্ছে অসংখ্য বই, দেশী-বিদেশী অর্থে গড়ে তোলা হয়েছে এবং ময়দানে নামা হয়েছে অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

ধর্মের তাবলিগ বা প্রচার হলেই তা প্রতিষ্ঠা পায় না। বিশ্বজুড়া বিজয়ও আসে না। সে জন্য লাগাতর লড়াই চাই। কোরআনী বিধান প্রতিষ্ঠার সে লড়াই বা প্রচেষ্ঠাকেই বলা হয় জিহাদ। মুসলমানের প্রতিটি কর্ম যেমন ইবাদত, তেমনি প্রতিটি যুদ্ধই জিহাদ। জিহাদ ছাড়া মুসলমানের জীবনে যেমন যুদ্ধ নাই তেমনি কোন কোরবানীও নাই্। শুধু জান-মাল নয়, ব্যক্তির প্রতিটি সামর্থ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে মহামূল্যবান নেয়ামত। মু’মিনের দায়বব্ধতা হলো, সে এ আমানতের বিণিয়োগ করবে একমাত্র মহান আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে। অন্যথায় সেটি ভয়ানক খেয়ানত হবে। সেক্যুলারিস্ট, সোসালিস্ট, স্বৈরাচারি বা জাতিয়তাবাদীর পক্ষে প্রাণ দূরে থাক, কোন রূপ অর্থ, শ্রম ও সময় দেয়াকে একজন প্রকৃত ঈমানদার আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা মনে করে। এ বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা শুধু পরকালে নয়, এ জীবনেও ভয়ানক আযাব ডেকে আনে। মু’মিনের সকল বিণিয়োগ হতে হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে, এবং সে বিণিয়োগটাই হলো জিহাদ। আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে এটিই মূল হাতিয়ার। জিহাদের মধ্য দিয়েই মুসলিম সমাজে পরাজয় ঘটে শয়তানি শক্তির, এবং সে সাথে বিলুপ্ত হয় মানুষকে পথভ্রষ্ট করার সকল শয়তানি প্রজেক্ট। আল্লাহর বিরুদ্ধ পক্ষ তাই জিহাদকে ভয় পায়। জিহাদের বিরুদ্ধে তাদের সকল শত্রুতা ও মিথ্যাচারের মূল হেতু এখানেই। কারণ, যেসব পথভ্রষ্টরা নিজ জীবনে কোরআনী বিধানকে মানতে রাজী নয়, তারা রাজী নয় রাষ্ট্রে বা সমাজে তার প্রতিষ্ঠাতেও। ফলে তাদের শত্রুতা শুধু ইসলামের বিরুদ্ধে নয়,গভীর শত্রুতা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল হাতিয়ারটির বিরুদ্ধেও। সে লক্ষ্যেই তারা জিহাদকে মুসলমানদের থেকে কেড়ে নিতে চায়,এবং বিলুপ্ত করতে চায় জিহাদের ধারণাকে। সে লক্ষ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল পাশ্চাত্য দেশের সরকার মুসলিম দেশে মসজিদের খোতবা,পত্রপত্রিকা ও স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচীর উপর লাগাতর নজরদারি রাখছে -যাতে মুসলমানদের মাঝে জিহাদী চেতনা গড়ে না উঠে। প্রতিদেশে তাদের সাথে জোট বেধেছে মুসলিম নামধারি ভণ্ডরাও।

এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশে জিহাদের বিরুদ্ধে জোরে শোরে কথা বলতো কাদিয়ানী ভ্রষ্টতার জনক ব্রিটিশ মদদপুষ্ট গোলাম আহম্মদ কাদিয়ানী। অনেকেরই ধারণা,কাদিয়ানী ফেরকার জন্মই হয়েছিল জিহাদকে অধর্ম ঘোষণা দিতে। কারণ জিহাদী চেতনার কারণে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন কখোনই উপমহাদেশের মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বরং সে শাসনকে সব সময়ই বিপদের মুখে রেখেছিল। তবে এখন শুধু কাদিয়ানীরাই জিহাদের বিরুদ্ধে নয়,বহু আলেম এবং মুসলিম নামধারী বহু নেতা-কর্মী ও বুদ্ধিজীবীরাও এখন ময়দানে নেমেছে। তাদের সে মিথ্যা প্রচারনা যে বিপুল সফলতাও দিয়েছে। তাদের সে লাগাতর প্রচারণার ফলেই নামায-রোযা,হজ-যাকাত বেঁচে থাকলেও জিহাদ বেঁচে নাই। আর জিহাদ না বাঁচলে কি বিশুদ্ধ ইসলাম বাঁচে? বাড়ে কি মুসলমানের গৌরব? আজ  যে ইসলাম বেঁচে আছে সেটি কি নবীজীর ইসলাম? নবীজী (সাঃ)র ইসলামে ইসলামি রাষ্ট্র ছিল,সে রাষ্ট্রে শরিয়তের প্রতিষ্ঠাও ছিল। সে ইসলামে লাগাতর জিহাদ ছিল,এবং হাজার হাজার সাহাবীর জানমালের কোরবানীও ছিল। সে কোরবানীর বরকতে মুসলমানদের সেদিন বিশ্বজুড়া ইজ্জত ছিল। সমাজে ছিল সুবিচার এবং শান্তি। তখন রাষ্ট্রের কর্ণধার ছিলেন স্বয়ং নবীজী (সাঃ) এবং নবীজী (সাঃ)র ওফাতের পর তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহাবাগণ। মুসলিম রাষ্ট্রের আদালতে আল্লাহর আইন অনুসারে বিচার হবে না -সেটি কি সেদিন অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু আজ  সে ইসলাম নেই। সে ইসলামী রাষ্ট্র ও শরিয়তি বিধানও নেই। ইসলামী রাষ্ট্র বিলুপ্ত হওয়ার পর লুপ্ত হয়েছে মুসলমানদের ইজ্জত, জেঁকে বসেছে পরাজয় ও অপমান। ইসলামি রাষ্ট্রের স্থান দখলে নিয়েছে জাতীয় রাষ্ট্র বা নেশন স্টেট। শাসকের যে আসনে মহান নবীজী (সাঃ) বসতেন, সে আসনে আজ  বসেছে অতি দুর্বত্ত অপরাধীরা। তাদের অঙ্গিকার আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রতি নয়, বরং নিজেকে এবং নিজের বিদেশী প্রভূকে খুশি করা। জিহাদের স্থলে স্থান পেয়েছে ব্যক্তি-স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ, গোত্রীয় বা জাতীয় স্বার্থের লড়াই। জিহাদ বিলুপ্ত হলে ইসলামি রাষ্ট্র ও তাঁর শরিয়তি বিধানের বেঁচে থাকাও যে অসম্ভব –আজকের মুসলিম ইতিহাসে সেটিই এক প্রতিষ্ঠিত সত্য।

 

জিহাদ ছাড়া কি ইসলাম-পালন সম্ভব?

কোন ধর্ম এবং সে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র শূন্যে প্রতিষ্ঠা পায়না। সেখানে পূর্ব থেকেই একটি ধর্ম ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা থাকে। ইসলামের প্রতিষ্ঠা ঘটে সে ধর্মের ও সে ধর্মের অনুসারিদের পরাজিত করার মধ্য দিয়ে। কোন একটি গাছ লাগাতে হলেও কিছু মাটি এবং তার আশেপাশের আগাছা ছাফ করে স্থান করে দিতে হয়। তবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা আর গাছ লাগোনা –এক জিনিষ নয়। আগাছা প্রতিবাদ করে না, কিন্তু মানুষ লড়াই শুরু করে। তাই যে কোন সমাজ বা রাষ্ট্রে অন্য একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসকে সরানোর কাজ শুরু হলেই সাথে সাথে জিহাদও শুরু হয়। ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় একমাত্র বিপক্ষ শক্তির পরাজিত করার মধ্যদিয়েই। নবীজী(সাঃ)র ন্যায় নরম হৃদয়ের মানুষের পক্ষেও সেটি এড়ানো সম্ভব হয়নি। কোন যুগেও সেটি সম্ভব নয়। ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে সংঘাত অনিবার্য। সে সংঘাত শুধু অর্থ, শ্রম ও মেধা চায় না, রক্তও চায়। আরো কোন ইবাদতই এত বড় কোরবানী চায় না। জিহাদ এজন্যই শ্রেষ্ঠ ইবাদত। সারা জীবন নামায-কালামের মধ্যদিয়েও কোন মু’মিন বিনা বিচারে জান্নাত পায়না, কিন্তু সেটি জিহাদে প্রাণদানকারি শহিদ পায়। মৃত্যুর পরও সে আল্লাহর পক্ষ থেকে রেজেক পায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর পক্ষ থেকে সে প্রতিশ্রুতি বহু বার এসেছে। অথচ ইসলামের বিপক্ষ শক্তি ইসলামের এ শ্রেষ্ঠ ধর্মকর্মটি চিহ্নিত করছে সন্ত্রাস বা জঙ্গি মতবাদ রূপে। তাদের সে লাগাতর মিথ্যাচারের কারণেই মুসলিম নাগরিকগণ চরম ভাবে ব্যর্থ হচ্ছে জিহাদের সঠিক ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠতে। অথচ জিহাদের দর্শন বুঝতে ব্যর্থ হলে সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়ে কোরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্যটি অনুধাবন করা। তখন অসম্ভব হয় এ বিশ্বজগত এবং মানব সৃষ্টি নিয়ে মহান আল্লাহর মূল ভিশনটি উপলব্ধি করা। অসম্ভব হয় নবী জীবনের মূল শিক্ষা থেকে সবক নেয়া। বস্তুত ইসলামের মূল শিক্ষাই তার কাছে অজানা থেকে যায়। তখন পদে পদে যেটি প্রকট রূপে দেখা দেয় সেটি পথভ্রষ্টতা।আজকের মুসলিম সমাজে তো মূলত সেটিই ঘটছে।

প্রশ্ন হলো, মানব-সৃষ্টি,রাসূলপ্রেরণ এবং কোরআন নাযিলের মাঝে মহান আল্লাহর মূল অভিপ্রায়টি কি? মহান আল্লাহতায়ালার লক্ষ্য কি সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর দখলদারি তার অবাধ্য শক্তির হাতে ছেড়ে দেয়া এবং তাঁর অনুসারিদের পরাজয় মেনে নেয়া? পবিত্র কোরআনের শিক্ষাকে কি শুধু কিতাবে ও মসজিদের চার দেয়ালের মাঝে সীমিত রাখা? এটি তো তাঁর দ্বীনের জন্য পরাজয়ের পথ! মহান আল্লাহতায়ালার অভিপ্রায়টি কি সেটি তিনি অস্পষ্ট রাখেননি। পবিত্র কোরআনের নানা স্থানে সেটি সুস্পষ্ট ভাবে বর্নীত হয়েছে। যেমন সুরা হাদীদে বলেছেন,“আমি রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি,যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ উপকার। এটি এজন্য যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে (আল্লাহকে)না দেখে তাঁকে ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিধর ও পরাক্রমশালী।” সুরা হাদীদ, আয়াত ২৫। উপরুক্ত আয়াতে মহান আল্লাহপাকের যে উদ্দেশ্যটি প্রবল ভাবে ব্যক্ত হয়েছে তা হল,সমাজে ন্যায়নীতি ও ইনসাফের প্রতিষ্ঠা। সে ন্যায়নীতির উৎস কোন রাজনৈতিক নেতা বা দার্শনিকের বানী নয়,কোন বিচারকের খেয়ালখুশি ভিত্তিক রায়ও নয়,এবং কোন সংসদের তৈরী আইনও নয়। বরং সেটি তাঁর নাযিলকৃত মহাজ্ঞানময় কোরআন। তবে সে কোরআনী ন্যায়নীতি ও ইনসাফের প্রতিষ্ঠা শুধু রাসূল প্রেরণ ও কোরআন প্রেরণের কারণে ঘটে না। সে জন্য অপরিহার্য হলো শক্তির প্রয়োগও। সে বাস্তবতার নিরিখে তিনি শুধু কিতাবই নাযিল করেননি,লৌহও প্রেরণ করেছেন। লৌহ থেকে নির্মিত হতে পারে ঢাল-তলোয়ার,বর্শা এবং কামান যা ব্যবহৃত হতে পারে শত্রুর বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে। ইসলাম ও অনৈসলামের সে দ্বন্দে মহান আল্লাহতায়ালা মু’মিনদের জন্য নীরব বা সরব দর্শক হওয়ার কোন সুযোগ রাখেননি। স্রেফ নামায-রোযা ও হজ-যাকাতের আড়ালে ধার্মিক সাজার পথও খোলা রাখেননি। বরং তিনি সর্বদা এ নজরও রাখছেন কারা ইসলামের বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবেলায় তাঁকে ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। তাই তাঁর দ্বীনে প্রকৃত ঈমানদারের জন্য জিহাদ থেকে পালানোর রাস্তা নেই। জান্নাতে যেতে হলে একমাত্র এ রাস্তা দিয়েই তাকে এগুতে হবে। স্বয়ং নবীজী (সাঃ) এবং তাঁর মহান সাহাবাগণ একমাত্র এ পথ দিয়েই এগিয়েছিলেন। তাদের সামনেও এছাড়া অন্য কোন রাস্তাই খোলা ছিল না। প্রশ্ন হলো,ইসলামের এ প্রাথমিক জ্ঞানটুকু ছাড়া নবীজী (সাঃ)র বার বার জিহাদে যাওয়া এবং সে জিহাদে নিজে আহত হওয়া, শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবীর শহিদ হওয়ার মত মুসলিম ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে শিক্ষা নেয়া কি আদৌ সম্ভব? সম্ভব কি কোরআন নাযিলের উদ্দেশ্য বুঝা? মুসলমানগণ যে সে শিক্ষালাভে আজ চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে তা কি তাদের আজকের পরাজয়ই প্রমাণ করে না? তবে প্রকৃত অবস্থা আরো গুরুতর! আঁধারের চামচিকা যেমন আলোকে ঘৃনা করে, তেমনি মুসলিম নামধারি পথভ্রষ্টরা ঘৃনা করে কোরআনের আলোময় জ্ঞানকে। এবং চরম ঘৃণা করে সে কোরআনের অনুসারিদেরও। ফলে কোরআনের সে আলোকে রুখতে তারা পাচ্য-পাশ্চাত্যের কাফের শক্তির সাথে কোয়ালিশন গড়েছে।এবং যুদ্ধ শুরু করেছে কোরআনের অনুসারিদের বিরুদ্ধে।

 

সেকালের এবং একালের ইসলাম

ইসলামের দুটি রূপ। একটি একালের এবং অপরটি সেকালের -তথা শুরুর সময়ের। একটি উপর্যপরি বিজয় ও গৌরবের, অপরটি লাগাতর পরাজয় ও অপমানের।  আজকের মুসলমানদের মাঝে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা বিষয়ে প্রচণ্ড বিতণ্ডা থাকলেও অন্ততঃ একটি বিষয়ে বিতর্ক নেই। তা হলো নিজেদের আজকের পরাজিত, অপমানিত ও শক্তিহীন অবস্থা নিয়ে। সংখ্যায় প্রায় ১৫০ কোটি হলে কি হবে বিশ্ব-রাজনীতিতে তাদের মতামতের কোন গুরুত্বই নাই। আমলে নেয়া দূরে থাকে,তাদের মতামত কেউ জানতেও চায় না। যে ক্ষমতা ও ইজ্জত নিয়ে ছয় কোটি ব্রিটিশ বা সাড়ে ছয় কোটি ফরাসী জাতিসংঘে বা বিশ্বের কোন মঞ্চে কথা বলে,সে ক্ষমতা ও ইজ্জত ১৫০ কোটি মুসলমানের নাই। মুসলিম দেশের সংখ্যা ৫৫টিরও বেশী,কিন্তু এর মধ্যে অধিকাংশ দেশই শত্রুশক্তি দ্বারা অধিকৃত। সেটি যেমন সামরিক ভাবে,তেমনি সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে। ইরাক,আফগানিস্তান,ফিলিস্তিন, কাশ্মির,বসনিয়া,চেচনিয়ার ন্যায় বহু মুসলিম ভূমি পরিনিত হয়েছে বদ্ধভূমিতে।সভ্যতার নির্মানে যখন মুসলমানদের যাত্রা শুরু হয় তখন সংখ্যায় তারা বিশাল ছিল না। তাদের হাতে এত সম্পদও ছিল না। কিন্তু তখন উপর্যপরি বিজয় এসেছিল। আর আজ  সংখ্যা বেড়েছে,সম্পদও বেড়েছে। কিন্তু তাতে বিজয় না বেড়ে মুসলিম ভূমি অধিকৃত হচ্ছে। তখন কোরআনের শরিয়ত আইন প্রতিটি মুসলিম জনপদে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এবং প্রশংসিত হয়েছিল সবচেয়ে সভ্য ও মানবিক আইন রূপে। সে শরিয়তি আইন এশিয়া ও আফ্রিকার বাইরেও মুসলিম শাসিত ইউরোপের স্পেন, গ্রীস, বুলগারিয়া, সার্বিয়া, আলবানিয়া, মেসেডোনিয়া, বসনিয়া, সাইপ্রাস, ক্রিমিয়ার ন্যায় বহু দেশে বহু শত বছর যাবত চালু ছিল। আর আজ  সে শরিয়তি আইন মুসলমানদের নিজ দেশেই আস্তাকুঁড়ে গিয়ে পড়েছে।

এ পরাজয়টি নিছক মুসলমানদের নয়,বরং মহান আল্লাহর দ্বীনের। এখানে পালিত হয়নি মুসলমানদের মূল দায়ভার। আল্লাহর সাথে মুসলমানদের এটিই সব চেয়ে বড় গাদ্দারী তথা বিশ্বাসঘাতকতা। আল্লাহর দ্বীনের পরাজয় নিশ্চিত করা ছাড়া আর কোন কল্যাণই তারা করেনি। তারা রাষ্ট্র গড়েছে, রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনী গড়েছে এবং বিপুল অর্থব্যয়ে বিশাল বিশাল অস্ত্রভাণ্ডারও গড়েছে। কিন্তু সেগুলি আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে নয়, সেগুলির লক্ষ্য বরং নিজ দেশ,নিজ দল বা নিজ গোত্রকে বিজয়ী করা। এসব দেশের ভিত্তি ইসলাম বা ইসলামি ভাতৃত্বও নয়। বরং রাষ্ট্র গড়েছে পৃথক পৃথক ভাষা,ভূগোল ও গোত্রের নামে। এবং এগুলোর নামে তারা আন্দোলন করে, যুদ্ধ করে এবং রক্তও দেয়। বিগত বহু শতাব্দী জুড়ে বহু লক্ষ মুসলমানদের রক্ত ঝরেছে মূলত এসব ন্যাশন বা ট্রাইবাল স্টেটের নামে। অথচ মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার দায়বদ্ধতা কাঁধে নেয়া। এ কাজে সে অর্থ দিবে, শ্রম দিবে,মেধা দিবে এবং প্রয়োজনে প্রাণও দিবে –এটাই হলো মুসলমান হওয়ার সে মূল দায়বদ্ধতা। তাদের সে কোরবানীর প্রতিদান রূপে মহান আল্লাহপাক তাদেরকে জান্নাত দিবেন। মহান আল্লাহর সাথে ঈমানদারের এটিই পবিত্র চুক্তি। পবিত্র কোরআনে সে চুক্তির কথাটি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়েছে এভাবেঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের নিক থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন,এর বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা (আল্লাহর সাথে কৃত এ চুক্তি অনুসারে) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং (আল্লাহর দ্বীনের শত্রুকে) নিধন করে এবং নিজে নিহত হয়।” –(সুরা তাওবা, আয়াত ১১১)। প্রশ্ন হলো, যার মধ্যে সামান্যতম ঈমান আছে সে কি মহান আল্লাহর সাথে সম্পাদিত এ চুক্তির সাথে গাদ্দারী করতে পারে? সেটি করলে সে কি মুসলমান থাকে? মুসলমান হওয়ার অর্থই তো হলো আল্লাহর প্রতিটি হুকুমের প্রতি অনুগত হওয়া। অপর দিকে কুফরি হলো সে হুকুমের বিরুদ্ধে যে কোন অবাধ্যতা বা বিদ্রোহ।

সেকালে মুসলমানদের কাছে যে পবিত্র কোরআন ছিল,আজও  তাদের কাছে একই কোরআন রয়েছে অবিকল ও অবিকৃত অবস্থায়। নবীজী (সাঃ) এবং তাঁর মহান সাহাবীগণ যেভাবে ইসলাম পালন করতেন, এবং কাফের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যেভাবে তাঁরা ইসলামের বিজয় এনেছেন সে ইতিহাসও আজ  অজানা নয়। নবীজী(সাঃ)র সূন্নতসমূহ অতিশয় খুঁটিনাটিসহ বিদ্যমান রয়েছে পবিত্র হাদীস গ্রন্থগুলিতে। সাহাবাদের ইসলাম পালন ও জান-মালের কোরবানীর বিবরণ রয়েছে তাদের জীবনচরিতে। সেই একই কোরআন ও একই নবীর (সাঃ)র অনুসারি বলে দাবী করে আজকের মুসলমানগণ। দাবী করে সাহাবায়ে কেরামের অনুসারি রূপেও। কিন্তু তাদের অর্জিত বিজয় ও গৌরব আজ জুটছে না,বরং জুটছে পরাজয় ও অপমান? কিন্তু এ নিয়ে ভাবনা আজকের মুসলমানদের ক’জনের? একই পথে শত শত বছর চলার পরও যখন সফলতা জুটছে না তখন কি চলার পথটি নিয়ে সন্দেহ জাগে না? ধর্ম পালনের নির্ভূলতা নিয়েও কি প্রশ্ন জাগে না? আজকের ধর্মপালন এবং সেকালের ধর্ম পালন একই রূপ হলে ফলাফলটিও কি একই রূপ হওয়া উচিত ছিল না? ধর্মপালনে ভূল হলে আখেরাতেও কি তা কল্যাণ দিবে? সেটিও কি গুরুতর ভাবনার বিষয় নয়? কিন্তু আজকের মুসলমানদের জীবনে সে ভাবনা কই? আজকের মুসলমানদের জীবনে কালেমা পাঠ ও তসবিহ-তাহলিলও আছে। নামায-রোযা এবং হজ-যাকাতও আছে। প্যারিস বা লন্ডনের মত কাফের অধ্যুষিত শহরে আজ যত নামাযী ও রোযাদার আছে নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের সময় ততজন নামাযী ও রোযাদার সমগ্র মুসলিম ভূমিতে ছিল না। কিন্তু তাতে কি কোন গৌরব বাড়ছে? মুসলমানের অর্থ শুধু কালেমা পাঠ বা নামায-রোযা,হজ-যাকাত আদায় নয়। ইসলাম মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া একটি পরিপূর্ণ প্যাকেজ। ইসলামকে গ্রহণ করতে হলে তার পুরা প্যাকেজটি গ্রহণ করতে হবে। প্রেসক্রিপশনের সবগুলো ঔষধ সেবন না করলে অসুখ সারে? তেমনি আল্লাহর দেয়া প্রেসক্রিপশনের ব্যাপারেও। মুসলমানের অর্থ পরিপূর্ণ মুসলমান। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে কোন রূপ অসম্পূর্ণতা চলে না,বিশ্বাসের অর্থ পরিপূর্ণ বিশ্বাস। ইসলামের হুকুমগুলি তাই ইচ্ছামত গ্রহণ বা বর্জনের নয়। কোরআনে বলা হয়েছে “উদখুল্ ফিস সিলমে কা’ফফা” অর্থাৎ “প্রবেশ করো ইসলামে পুরাপুরি ভাবে”। তাই ইসলাম কবুলের অর্থ শুধু স্রেফ নামায-রোযা,হজ-যাকাত আদায় নয়। ইসলাম শুধু নামায-রোযা,হজ-যাকাত নিয়ে আসেনি,এসেছে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনের বিধিবিধান নিয়েও। সে বিধানে শান্তির কথা যেমন আছে,তেমনি শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদের কথাও আছে। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের ইসলাম পালনে এসব কিছুই ছিল। কিন্তু আজকের মুসলমানদের ক্ষেত্রে এখানেই ঘটেছে বিশাল বিচ্যুতি ও বিভ্রাট। সীমাহীন ব্যর্থতা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে জানমালের কোরবানী পেশে। মহান নবীজী (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবাগণের ধর্মপালনে নামায-রোযা,হজ-যাকাতের সাথে লাগাতর জিহাদও ছিল। সে জিহাদই ঈমানদারদের লাগাতর বিজয় এনেছিল, এবং প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছিল শরিয়তের। মদিনার সামান্য একটি পল্লি থেকে যতজন ঈমানদার আল্লাহর রাস্তায় প্রাণ দিয়েছেন,প্রাণের সে কোরবানী ১৬ কোটি মুসলমানের বাংলাদেশ দেয়নি। ফলে সেদিন কাফের অধ্যুষিত আরবে ইসলামের বিজয় আসলেও মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে সে বিজয় আসেনি। দেশটিতে আল্লাহর আইন তথা শরিয়তের বিজয়ও আসেনি। কারণ বিজয় তো জায়নামাজে আসে না, মসজিদ-মাদ্রাসার মেঝেতেও আসেনা। বিজয় নেমে আসে জিহাদের ময়দানে,-নবীজীর আমলে যেমন বদর,খন্দক, হুনায়ুনের ন্যায় রণাঙ্গনে এসেছিল। মসজিদ-মাদ্রাসা ও জায়নামাজে ইবাদতের কাজ হলো সে জিহাদের ঈমানদারে অঙ্গিকার বাড়ানো। যে ইবাদতে সে অঙ্গিকার বাড়ে না, বুঝতে হবে সে ইবাদতে ঈমানদারি নেই,ফাঁকিবাজি রয়েছে। জিহাদের লক্ষ্য শুধু মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষা দেয়া নয়,পৃথিবী জুড়ে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় সাধনও। ইসলাম শুধু তাবলিগ বা প্রচারের জন্য আসেনি, ব্শ্বিব্যাপী প্রতিষ্ঠার জন্যও এসেছে। বিশ্বজুড়া ইসলামের প্রতিষ্ঠা বা বিজয়ই হলো মূলতঃ মহান আল্লাহর ভিশন। পবিত্র কোরআনে বর্নিত আল্লাহতায়ালার সে ভিশনটি হলো, “লিইয়ুযহিরাহু আলা দ্বীনি কুল্লিহি” অর্থাৎ সকল ধর্ম বা দ্বীনের উপর আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী রূপে দেখা। এবং সে বিজয়টি অর্জিত হতে হবে মানুষের দ্বারা,ফেরেশতাদের দ্বারা নয়। ঈমানদারের দায়িত্ব হলো,মহান আল্লাহর সে ভিশনের সাথে একাত্ম হওয়া,আল্লাহতায়ালার সে লক্ষ্যপূরণকে নিজ জীবনের মিশন বানিয়ে নেয়া। “জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ” তথা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ তখন মু’মিনের জীবনে অনিবার্য ভাবেই এসে যায়।সেটি না আসার মধ্যেই বরং ভ্রষ্টতা।তখন ভয়ানক বিচ্যুতি আসে সিরাতুল মোস্তাকিম থেকে।

 

 

পরীক্ষা এবং মর্যাদা জিহাদে

মু’মিনের জীবনে সর্বোচ্চ পরীক্ষাটি হয় জিহাদে। জান ও মালের এমন পরীক্ষা আর কোন ভাবেই হয়না। কালেমা পাঠে শ্রম ব্যয়,অর্থব্যয় ও প্রাণের ক্ষতি হয় না। ফলে ঈমানের দাবীতে কে সাচ্চা আর কে ভণ্ড -সে পরীক্ষা কালেমা পাঠে হয় না। তেমনি অর্থ ও প্রাণের ক্ষতি নামায-রোযা পালনেও হয় না। কিন্তু আরাম-আয়াশের সাথে প্রাণে বাঁচাটি বিপদে পড়ে জিহাদে নামলে। তাই মহান আল্লাহর কাছে এটিই শ্রেষ্ঠ পরীক্ষা। এ জগতে কোন প্রমোশন বা পদোন্নতিই পরীক্ষা ছাড়া হয়নি। প্রমোশন বা মর্যাদা তো বাড়ে পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার পর। যার জীবনে পরীক্ষা নেই,তার জীবনে প্রমোশন বা মর্যাদাও নেই। আর জিহাদ তো ঈমানদারের জীবনে সে পরীক্ষা নিয়ে হাজির হয়। সে পরীক্ষার কথাটি পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে এভাবেঃ “মানুষ কি মনে করে যে তারা এ কথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে ‘আমরা বিশ্বাস করি’ এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চ্য়ই জেনে নিবেন মিথ্যুকদেরকে। -(সুরা আনকাবুত,আয়াত ২-৩)। ফলে যখন কোন দেশে মানুষের মাঝে বিজয় ও ইজ্জত লাভের আগ্রহ বাড়ে তখন সে জিহাদের পরীক্ষাও ঘন ঘন আসে। নবীজী(সাঃ) তো সেটিই হয়েছিল। আল্লাহতায়ালা ইচ্ছে করলে যে কোন দেশে যে কোন বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করতে পারেন। সে বিজয় ঠেকাতে কেউ কি মহাশক্তিমান আল্লাহর বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে? তাঁর নির্দেশে মুহুর্তের মধ্যে যেমন প্রলংকরি সুনামি আসতে পারে, তেমনি তাঁর দ্বীনের বিজয়ও আসতে পারে। কিন্তু সেটি হলে ঈমানদারদের পরীক্ষা হয় না,তাদের প্রমোশন লাভের সুযোগও জুটে না। ফলে সেটি মহান আল্লাহর হিকমতও নয়। বরং যুগে যুগে যে হিকমতটির প্রয়োগ ঘটেছে তা হলো, জিহাদের মধ্য দিয়ে মু’মিনদের পরীক্ষা করা এবং সে পরীক্ষায় কৃতকার্যদের পুরস্কৃত করা। আল্লাহতায়ালা তাঁর নিজের সে হিকমাত বা পরিকল্পনার কথাটি ঘোষণা করেছেন এভাবে,“তোমরা (শত্রুর বিরুদ্ধে) জিহাদ চালাবে যতক্ষণ না যুদ্ধ তার অস্ত্র নামিয়ে ফেলে। এটিই বিধান। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি চান, তোমাদের একজনকে অপরের দ্বারা পরীক্ষা করতে। যার আল্লাহর রাস্তে নিহত হয় তিনি কখনও তাদের কর্ম বিনষ্ট হতে দেন না।” –(সুরা মুহাম্মদ, আয়াত ৪)।

মুনাফিকদের থেকে ঈমানদারদের পৃথক করতে জিহাদ ছাঁকুনির কাজ করে। আগুনের তাপে আবর্জনা যেমন খাদ রূপে পানির উপরে ভেসে উঠে, জিহাদও তেমনি ভাসিয়ে তোলে মুনাফিকদের। রাব্বুল আলামিন থেকে মুনাফেকি লুকানোর রাস্তা নেই। ব্যক্তির মনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সবই তিনি জানেন। তাই ব্যক্তির ঈমানের অবস্থা জানার জন্য তার ইবাদত দেখার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু মহান আল্লাহ চান, মৃত্যুর আগেই ব্যক্তি তার নিজের ঈমানের আসল  অবস্থাটি জেনে যাক। ঈমানের প্রকৃত অবস্থাটি প্রকট ভাবে তুলে ধরে মূলতঃ জিহাদ, সেটি জিহাদে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। ব্যক্তির নিজের সামনে যেমন,তেমনি অন্যদের সামনেও। মুসলমানেরাও একমাত্র জিহাদের ময়দানেই সঠিক ভাবে জানতে পারে কে তাদের নিজেদের লোক,আর কে নয়। জানমালের কোরবানীর সে পরীক্ষাটি মসজিদের জায়নামাযে হয় না,রোযা বা হজ্জের জমায়েতেও হয় না। তাই যে সমাজে জিহাদ নেই সে সমাজে ঈমানের দাবী নিয়ে ভণ্ডরাও মুসলমানদের সাথে লুকিয়ে থাকে। উঁই পোকা ভিতর থেকে যেমন খেয়ে ফেলে,এরাও তেমনি মুসলিম উম্মাহকে ভিতরে থেকে ধ্বসিয়ে দেয়। মহান আল্লাহর বিধান হলো, প্রকৃত ঈমানদার থেকে ভণ্ডদের পৃথক করা। তাই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,“তোমাদের কি ধারণা,তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে,অথচ আল্লাহ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কার জিহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্যশীল?” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৪২)। আরো বলছেন, “তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে তোমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে এমনি, যতক্ষণ না আল্লাহ জেনে নিবেন তোমাদের মধ্যে কে (আল্লাহর রাস্তায়) যুদ্ধ করেছে এবং কে আল্লাহ ও মুসলমানদের ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গহণ করা থেকে বিরত রযেছে। আর তোমরা যা কর সে বিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত। -(সুরা তাওবাহ আয়াত ১৬)। অন্যত্র বলা হয়েছে “তোমরা কি ধারণা করে নিয়েছো যে, তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ সে অবস্থার মুখোমুখি তোমরা এখনও হওনি যা তোমাদের পূর্ববর্তীদের ক্ষেত্রে হয়েছে। তাদের উপর এসেছে বিপদ ও ভয়ানক কষ্ট। তারা এমনিভাবে শিহরিত হয়েছে যে যাতে নবী এবং যারা তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছে তারা একথা পর্যন্ত বলেছে যে কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য। তোমরা শোনে নাও আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটবর্তী।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ২১৪)। মুসলমান হওয়ার অর্থঃ এ পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় সজ্ঞানে প্রবেশ করা এবং নিজের ঈমানদারির প্রমাণ রাখা।

মানুষ মাত্রই মর্যাদা খোঁজে। মর্যাদা খোঁজে দেশের রাজা-বাদশাহর সাহায্যকারি হওয়ার মধ্যে। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালা ঈমানদার বান্দাহকে মর্যাদা দেন তাঁর নিজের সাহায্যকারি বানিয়ে। মু’মিনের জীবনে জিহাদ দেয় মওকা। মু’মিনদের প্রতি মহান আল্লাহতায়ালা আহবান রেখেছেন এভাবে, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারি হয়ে যাও” –(সুরা সাফ আয়াত ১৪)। আর আল্লাহর সাহায্যকারি হওয়ার মধ্য দিয়ে সে পায় মহান আল্লাহর সাহায্য –এ জীবনে এবং পরকালীন জীবনে। সে প্রতিশ্রুতিটি শুনিয়েছেন এভাবে। “হে মু’মিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের অবস্থান দৃঢ় করবেন।” – (সুরা মুহাম্মদ আয়াত ৭)। মহান আল্লাহ তাঁর ঈমানদার বান্দাহকে তো দিতে চান বিশাল পদোন্নতি। সে পদোন্নতিতে বড় কোন পদ বা কোটি কোটির বেতন জুটে না,বরং জুটে জান্নাত। যা অনন্তকালের জন্য -যার এক ইঞ্চি ভূমিও দুনিয়ার তাবত সোনা-রূপার চেয়েও মূল্যবান।

 

আলেমদের অপরাধ

আলেমদের অপরাধ অনেক। তবে বড় অপরাধ,মুসলমানদের থেকে কোরআনের শিক্ষাকেই তারা আড়াল করেছেন। মেঘ যেমন সূর্যকে আড়াল করে তারাও তেমনি ইসলামকে আড়াল করেছেন। তারা শুধু নিজেরাই জিহাদের এ কথা ভূলিনি,বরং সাধারণ মুসলমানদের মন থেকেও আল্লাহর পরিকল্পিত চুড়ান্ত পরীক্ষার কথাটিই ভূলিয়ে দিয়েছেন। জিহাদের বদলে কোরআন পাঠ,তাসবিহ পাঠ,নফল ইবাদত ও ছোট ছোট সূন্নত পালনের মাঝে জান্নাত প্রাপ্তির খোশখবর শুনিয়েছেন। তাদের কারণেই জিহাদ নিয়ে বেড়েছে সীমাহীন ভ্রষ্টতা। আর এ ভ্রষ্টতার কারণে পরাজয় শুধু মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে আসেনি, পরাজয় এসেছে মহান আল্লাহর দ্বীনের। এবং সেটি খোদ মুসলিম দেশগুলিতে।ইসলামে জ্ঞানার্জন ফরজ হলে কি হবে, এসব আলেমগণ পছ্ন্দ করে নিয়েছে অজ্ঞতার প্রসারে। সে জন্যই পবিত্র কোরআনকে বুঝার বদলে সেটিকে না বুঝে তেলাওয়াতের রেওয়াজ বাড়িয়েছে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলছেন,“তারা কি কোরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা-ভাবনা করে না? না,তাদের অন্তর কি তালাবদ্ধ? –(সুরা মুহাম্মদ, আয়াত ২৪)। এ আয়াতে যা অতি সুস্পষ্ট তা হলো, আল্লাহতায়ালা অতিশয় অসন্তুষ্ট হন যদি তাঁর কোরআনী আয়াত নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা না হয়। অথচ আলেমগণ সে চিন্তাভিাবনাই অসম্ভব করেছেন। ফলে মুসিলম সমাজে তেলাওয়াতকারির সংখ্যা বাড়ছে,ক্বারি ও হাফেজদের সংখ্যাও বাড়ছে কিন্তু বাড়েনি চিন্তাশীল মু’মিনের সংখ্যা। এমন চিন্তাশূণ্যতার কারণেই বেড়েছে ইসলাম নিয়ে প্রচণ্ড বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা। মুসলিম দেশগুলিতে মসজিদ-মাদ্রাসা,ইসলামী বই-পুস্তক ও ইসলামী দলের সংখ্যা বিপুল সংখ্যায় বেড়েছে,বেড়েছে নামাজীর সংখ্যাও। কিন্তু বাড়েনি জিহাদ নিয়ে সঠিক ধারণা। বাড়েনি মুসলমানদের জিহাদে সংশ্লিষ্টতা। ফলে মুসলিম দেশগুলিতে বেড়েছে ইসলামের পরাজয়।

শিক্ষা-সংস্কৃতি,রাজনীতি,অর্থনীতি,সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্র থেকে ইসলামের কোরআনের বিধান তার দখলদারি হারিয়ে মসজিদের জায়নামাজে স্থান নিয়েছে। অথচ ইসলামের শরিয়তের বিধান দখলদারি হারালে মুসলমান কখনো বিজয়ী হয় না, গৌরবও পায় না। আল্লাহর বিধান কোন দেশের আইন-আদালত থেকে অপসারিত হলো আর মুসলমানরা সে দেশে বিজয় ও ইজ্জত পেল –এমন ইতিহাস কি আছে? মুসলমানের গৌরব তো আসে আল্লাহর সাহায্য আসার মধ্যদিয়ে। আর সে সাহায্য তো একমাত্র তখনই আসে যখন মুসলমানগণ আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। তাঁর  কোরআনী বিধানকে বিজয়ী করতে শত্রুর সামনের জানমালের কোরবানীতে খাড়া হয়। মহান আল্লাহতায়ালা তখন তাঁর বান্দাহর বিশাল বিনিয়োগ দেখে হাজার হাজার ফেরেশতা পাঠান তাদের সাহায্যার্থে। যেমনটি বন্দর,খন্দক,হুনায়ুনের ন্যায় বহু যুদ্ধে ঘটেছিল। যেমনটি বদরের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,“স্মরণ কর,তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে; তখন তিনি তোমাদেরকে জবাব দিয়েছিলেন, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করবো এক সহস্র ফিরিশতা দ্বারা,যারা সারিবদ্ধ ভাবে আসবে।” –(সুরা আনফাল আয়াত ৯)। আর সাহায্য তো আসে একমাত্র আল্লাহ থেকেই। -(সুরা আনফাল আয়াত ১০)। আর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন সাহায্য আসে তখন কোন পরাক্রমশালী শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়েও কি কোন বাধা থাকে?

 

শুধু খুঁটিতে নিরাপত্তা নেই

ঈমান,নামায-রোযা,হজ-যাকাত –এ হলো ইসলামের পাঁচটি খুঁটি। তবে ঘর নির্মানে শুধু খুটি নয়,আরো বহু কিছু জরুরি। ইসলামের সে ঘর নির্মানে সে অপরিহার্য বিষয়গুলো হলো জিহাদ, শরিয়তের প্রতিষ্ঠা,প্রশাসনের ইসলামিকরণ,সামাজিক ইনসাফ, ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি ইত্যাদী। এগুলো ছাড়া ইসলামের খুঁটিই শুধু দাঁড়িয়ে থাকে,ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ঘর তাতে নির্মিত হয় না। তখন সভ্যতাও গড়ে উঠে না। ঘরে যে নিরাবিল শান্তি ও নিরাপত্তা জুটে সেটি কি খুঁটির ছায়াতে জুটে? আজকের মুসলমানদের জীবনে সেটিই ঘটেছে। মুসলিম সমাজে শুধু ৫ খানি খুঁটিই দাঁড়িয়ে আছে।কোথাও ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ঘর নির্মিত হয়নি। ফলে মুসলমানদের জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তাও জুটেনি। মুসলমানগণ আজ  নিজ দেশে হত্যা,ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের শিকার হচ্ছে। অধিকৃত হচ্ছে তাদের নিজ দেশ ও সম্পদ। পদদলিত হচ্ছে তাদের স্বাধীনতা। নবীজীর যুগে শুধু খুঁটি ছিল না, সে খুটির উপর ভর করে বিশাল ইসলামি রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। আল্লাহতায়ালার উপর ঈমান এবং নামায-রোযা,হজ-যাকাতের সাথে ঈমানদারের জীবনে জিহাদও ছিল। প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল ইসলামি শরিয়তের। এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ইসলামের অর্থনীতি,শিক্ষা ও সংস্কৃতি। শত্রুর প্রতিটি হামলার বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষ থেকে গড়ে উঠেছিল প্রবল প্রতিরোধ। জিহাদ তখন প্রতিটি মু’মিনের জীবনে অলংকারে পরিণত হয়েছিল। সে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর গড়ে উঠেছিল মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।

জিহাদের জন্য মু’মিনকে মনেপ্রাণে লাগাতর প্রস্তুত করে তার নামায-রোযা,হজ-যাকাত ও অন্যান্য ইবাদত। কোরআনী জ্ঞান তার চেতনায় জোগায় শক্তি। তখন আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে শুধু অঙ্গিকারই বাড়ে না, তার মাঝে আত্মবিনিয়োগ ও অর্থবিনিয়োগের সামর্থ্যও বাড়ে। তখন মুসলিম দেশে শত্রুর প্রতিরোধের তাড়না শুধু বেতনভোগী সৈনিকদের মাঝে সীমিত থাকে না। সমগ্র দেশ তখন ক্যান্টমেন্টে পরিণত হয় এবং প্রতিটি নাগরিক তখন পরিণত হয় সৈনিকে। এমন জিহাদ না থাকলে শয়তানি শক্তির বিশাল কোয়ালিশনের বিরদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় অনিবার্য। মুসলিম দেশে আজ ক্যান্টমেন্ট বেড়েছে, সৈনিকের সংখ্যাও বেড়েছে। বেড়েছে যুদ্ধাস্ত্রও। কিন্তু জিহাদের ধারণা বিলুপ্ত হওয়ায় শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদে জনগণের দায়বদ্ধতা ও কোরবানী বাড়েনি। ফলে শত্রুর বিরুদ্ধে ইসলামের কি বিজয় আসবে, দেশ অধিকৃত হয়ে গেছে ইসলামের আভ্যন্তরীণ শত্রুর হাতে।

প্রতিটি মতবাদ বা আদর্শই প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য অনুসারিদের অঙ্গিকার চায়, সে সাথে কোরবানীও চায়। ইসলামের প্রতিষ্ঠায় দখল জমিয়ে রাখা আদর্শ ও তার অনুসারিদের হটাতে হয়; হটানোর সে কাজে শ্রমব্যয়,অর্থব্যয় ও রক্তব্যয় ঘটে। অথচ মুসলিম আলেমদের মাঝে আজ  সে কোরবানী পেশের আগ্রহ কোথায়? বরং জিহাদ যে প্রতিটি মুসলমানের উপর বাধ্যতামূলক, ইসলামের সে অতি বুনিয়াদি শিক্ষাটিকে তারা অতি সফলতার সাথে আড়াল করতে সমর্থ হয়েছে। অপর দিকে ইসলামের শরিয়তের বিধানের এমন পরাজয়ের মাঝেও তাদের মাঝে এ নিয়ে কোন মাতম বা আহাজারি নাই। সে হত গৌরব ফিরিযে আনার জন্য জিহাদ এবং সে জিহাদে কোরবানী পেশেরও কোন আগ্রহ নেই। অথচ শয়তানের অনুচরদের কোরবানীটা কত বিশাল। মার্কিনীরা জানমালের বিশাল কোরবানী পেশ করছে নিজ দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের নানা জনপদে। তেমনি প্রাণ দিচ্ছে নানা মতের অনুসারিরা। বাংলাদেশে একমাত্র মুজিব আমলেই প্রায় ৩০ হাজারের বামপন্থি নেতাকর্মি প্রাণ দিয়েছে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায়। অথচ কতজন আলেম প্রাণ দিয়েছেন ইসলামের বিজয় আনতে?

 

ঈমান দৃশ্যমান হয় জিহাদে

মুসলমানের ঈমান কথা বলে তাঁর কর্ম,সংস্কৃতি,আচরণ ও রাজনীতির মধ্য দিয়ে। তাঁর সে ঈমান তাঁকে সমাজের অন্যদের থেকে পৃথক করে,এবং এক ভিন্ন পরিচয়ে খাড়া করে। সে ভিন্নতা স্রেফ নাম,পোষাক-পরিচ্ছদ,খাদ্য-পানীয় ও ইবাদত-বন্দেগীতে নয়,বরং সেটি সৃষ্টিকর্তা, জীবন ও জগত, জীবনের এজেণ্ডা ও মিশন, মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী জীবন,ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদি নানা বিষয়ে স্পষ্টতর এক বিশেষ ধ্যান-ধ্যারণার ভিত্তিতে। ইসলামি পরিভাষায় সে ধ্যান-ধারনাই হলো আক্বিদা। আক্বীদা এবং ঈমান অদৃশ্য,কিন্তু কোন ব্যক্তির মধ্যে তা প্রবেশ করলে সেটির প্রবল প্রকাশ ঘটে তার কর্ম ও আচরনের মধ্যদিয়ে। তখন তার কর্ম, সংস্কৃতি,আচরন ও রাজনীতিও পাল্টে যায়। এক সার্বিক বিপ্লব আসে তার জীবনে। জিহাদ তখন তার জীবনে অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গে পরিনত হয়, যেমনটি হয়েছিল সাহাবায়ে কেরামের জীবনে। কিন্তু যখন সে বিপ্লব আসে না এবং তার জীবনে জিহাদ শুরু হয় না তখন বুঝতে হবে বিশাল শূণ্যতা বা ভ্রষ্টতা রয়েছে তার ঈমান ও আক্বীদায়। তাই কোন ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠির জীবনে পরিবর্তন আনতে হলে পরিবর্তন আনতে হয় তাদের আক্বীদায় তথা ধ্যাণধারণায়। নবুয়ত পাপ্তির পর নবীজী(সাঃ) আমৃত্যু এ কাজটিই করেছেন। সে ঈমান ও আক্বীদার সে বিপ্লবের কারণেই প্রতিটি মুসলিম সেদিন মোজাহিদে পরিনত হয়েছিলেন।

 

দায়িত্ব জিহাদের সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করা

মুসলমানের আক্বীদা বা ধ্যানধারণার ভিত্তি স্রেফ মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস নয়, বরং সমগ্র জগত এবং সে জগতে বসবাসরত মানবসৃষ্টি নিয়ে আল্লাহর নিজের পরিকল্পানা তথা রোডম্যাপের উপর বিশ্বাসও। ইসলামে সে রোডম্যাপটি হলো কোরআনে বর্নিত সিরাতুল মোস্তাকিম। আর সে বিশ্বাসের সাথে প্রতিটি ঈমানদারের উপর দায়িত্বও এসে যায়। সে দায়িত্বটি হলো,মহান আল্লাহর সে রোডম্যাপের পুরাপুরি অনুসরণ। এবং সমাজে তখন পথভ্রষ্টরা পথ খুঁজে পায়। মহান আল্লাহর সে রোডম্যাপের বিরুদ্ধে যে কোন বিদ্রোহ ও অবাধ্যতাই কুফরি। তখন বিপর্যয় ও বিফলতা আসে ব্যক্তির জীবনে। এবং মৃত্যুর পর গিয়ে পৌঁছে জাহান্নামের আগুণে। জিহাদ হলো রাষ্ট্রের বুকে সিরাতুল মোস্তাকিমের অনুসরণকে জারি রাখার প্রচেষ্ঠা। যার মধ্যে সে জিহাদ নাই, বুঝতে হবে তার মধ্যে ঈমানও নাই। মুসলিম রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো জনগণের মাঝে জিহাদের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা। যে রাষ্ট্রে লাগাতর জিহাদ নাই, বুঝতে হবে সে রাষ্ট্রে সিরাতুল মোস্তাকিমও নাই। তখন পথভ্রষ্টতা বাড়ে সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে। সে সমাজ ও রাষ্ট্রে তখন সুদী ব্যাংক,পতিতাপল্লি, নাচের আসর, মদের আসর ও ব্যাভিচারি আঁনাচে কাঁনাচে প্রতিষ্ঠা পায়। তখন সাধারণ মানুষ আত্মসমর্পণ করে এমন পথভ্রষ্টদের কাছে যারা আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহী। তখন দেশ রেকর্ড গড়ে দুর্বৃত্তিতে। আর দুর্বৃত্তির প্রতিটি ঘটনাই তো পথভ্রষ্টতা। আইন-আদালত,শিক্ষা-সংস্কৃতি,অর্থনীতি ও পোষাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে অনুসৃত হয় কাফের তথা পথভ্রষ্টদের নীতি। আর একটি সমাজে দুর্বৃত্তির বিশ্বজুড়া রেকর্ড দেখেই বলা যায় সে দেশে জিহাদ প্রতিষ্ঠা পায়নি। জিহাদ না হলে রাষ্ট্রে ইসলামের প্রতিষ্ঠা অসম্ভব, তখন অসম্ভব হয় দুর্বৃত্তির অবসান। অসম্ভব হয় অজ্ঞাতার অন্ধকার থেকে বাঁচা। বহু দেশের মাঝে আজকের বাংলাদেশও তো বস্তুত তেমনই এক দেশ। এমন দেশে নামাযী ও রোযাদারের সংখ্যা যতই থাক,“জিহাদ ফি সাবিল্লাহ” তথা আল্লাহর পথে লড়াই যে ভয়ানক ভাবে উপেক্ষিত সেটি বুঝার জন্য কি গবেষণার প্রয়োজন পড়ে? আর মহান আল্লাহর প্রদর্শিত পথের প্রতি এমন উপেক্ষা নিয়ে কি জনগণ কল্যাণ পায়? যারা মানুষের সত্যিকার কল্যাণ চায় –এ দুনিয়ায় ও আখেরাতে,তাদের অন্ততঃ এ নিয়ে গভীর ভাবে ভাবা উচিত। ২১/০১/১২

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *