শেখ মুজিবের অপরাধ এবং বাঙালি মুসলিমের অপরাধ (১ম পর্ব)

ফিরোজ মাহবুব কামাল

ট্রেনে উঠার আগে দেখতে হয়, সে ট্রেনটি কোন দিকে যাচ্ছে? ভূল ট্রেনে উঠে দোয়া-দরুদ পড়ে লাভ হয় না। তাই চোখ-কান খোলা রেখে এবং পুরা হুশ নিয়ে পথে-ঘাটে নামতে হয়। নইলে বিপদ অনিবার্য। তখন ভূল পথে ও ভূল ট্রেনে উঠে ভূল গন্তব্যে পৌঁছা ছাড়া উপায় থাকে না। সেরূপ হুশ ও কান্ডজ্ঞানের প্রয়োজন হয় রাজনীতিতে নেতা ও রাজনৈতিক দল বেছে নেয়ার ক্ষেত্রেও। রাজনীতির অঙ্গণটি চোখ-কান বন্ধ করে এবং অর্ধচেতন হুশ নিয়ে চলাফেরা করার জায়গা নয়। মুসলিমদের জন্য রাজনীতি হলো সর্বোচ্চ ইবাদতের জায়গা। ইবাদতে চাই মহান আল্লাহতায়ালার সাথে সচেতন মনের গভীর সংযোগ। নইলে সেটি ইবাদত হয় না। এ ইবাদতে নির্দেশনা নিতে হয় তাঁর দেয়া পবিত্র কিতাব কুর’আন থেকে। ইবাদতে থাকতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি দায়বদ্ধতার চেতনা।

ইসলামে রাজনীতি হলো পবিত্র জিহাদ। রাজনীতির ইবাদতের মাধ্যমে মুসলিমগণ আল্লাহর এজেন্ডাকে বিজয়ী করে। রাজনীতির মাধ্যমেই বিপ্লব আনে দেশের শাসনতন্ত্র, প্রশাসন, আইন-আদালত ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে। এবং সুনিশ্চিত করে দেশের সুরক্ষাকে। এমন রাজনীতি প্রতিটি ঈমানদারের উপর ফরজ। আগুনের পরিচয় যেমন তার উত্তাপে, ঈমানের পরিচয়ও তেমনি ব্যক্তির রাজনৈতিক জিহাদে। রাজনীতির ফরজ পালনে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। নামাজ-রোজার ক্বাজা আছে, কিন্তু রাজনৈতিক জিহাদের ক্বাজা নাই।

রাজনীতির সাথে জড়িত ইসলামের স্বার্থ, দেশের স্বার্থ, ব্যক্তির নিজের স্বার্থ ও সে সাথে পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থ। রাজনীতির উপর নির্ভর করে রাষ্ট্র কি জনগণকে জান্নাতে নেয়ার বাহনে পরিনত হবে, না জাহান্নামে নেয়ার। রাষ্ট্র জনগণকে জান্নাতে বা জাহান্নামে নেয়ার কাজটি করে শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, মিডিয়া ও প্রচারযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রিত করে। এজন্যই কোন কম্যুনিস্ট, ফ্যাসিস্ট ও হিন্দুত্বাদী রাষ্ট্রে বসবাস করে পূর্ণ ইসলাম পালনের স্বপ্ন দেখা যায় না। এজন্যই নবীজী (সা:)কে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হয়েছে। এটিই ছিল নবীজী (সা:)’র সবচেয়ে ব্যয় বহুল প্রকল্প। সে রাষ্ট্র সেদিন নির্মিত না হলে ইসলাম কখনোই একটি বিশ্বশক্তি ও বিশ্বসভ্যতার জন্ম দিতে পারতো না।

রাজনীতির অঙ্গণে ভূল হলে দেশবাসীর জীবনে ভয়ানক বিপদ অনিবার্য হয়ে উঠে। রাশিয়া ও চীনের বহু কোটি মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে কোন মহামারি, সুনামী বা ভূমিকম্পের কারণে নয়। সেটি কম্যুনিজমের মত প্রাণনাশী বিষাক্ত মতবাদ ও তার নেতাদের পিছনে খাড়া হওয়ার কারণে। সে মতবাদের বিজয়ের ফলে সে দেশের মসজিদ-মাদ্রাসাগুলি ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর শত শত নগর ধ্বংস হয়েছে এবং প্রায় ৮০ লাখ জার্মান নাগরিকের প্রাণ হারাতে হয়েছে। এবং সেটি হিটলারের ন্যায় এক দুর্বৃত্ত ফ্যাসিস্টকে নেতা রূপে বরণ করার কারণে। রাজনৈতিক ভূলগুলি এভাবেই কোভিড মহামারি, সুনামী, ভূমিকম্প এবং প্লাবনের চেয়েও অধিক প্রাননাশী হয়। বাঙালি মুসলিমদের রাজনৈতিক ভূলগুলিও কি কম নাশকতা ঘটিয়েছে? বাঙালির জীবনে একাত্তরের রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ, গুম, খুন, ধর্ষণ, অপহরন, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, অর্থপাচার, সন্ত্রাস ও হিন্দুত্বের যে জোয়ার -এগুলি আসমান থেকে নাযিল হয়নি। এগুলি বাঙালি মুসলিমদের নিজ হাতের অর্জণ। সেটি মুজিবের ন্যায় ফ্যাসিস্ট, ধোকাবাজ, গণতন্ত্রের খুনি, দুর্বৃত্তির প্রতিপালক, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের সেবককে নেতা রূপে বরণ করার কারণে। বাঙালি মুসলিমের হাজার বছরের ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় ভূল।

ভূল যখন সজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় হয়, তখন সেটি আর ভূল নয়। সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত হয়। তখন শাস্তি আসে আসমান থেকে। বাঙালি মুসলিমদের খাতায় সে অপরাধের অংকটি বিশাল। প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো নেতা নির্বাচনের বিষয়টি। সেখানেই ঈমান, ইলম ও প্রজ্ঞার পরীক্ষা হয়। যে ব্যক্তি বহু মানুষের খুনি, গণতন্ত্রের খুনি, দুর্নীতিবাজ, ধোকাবাজ এবং বিদেশী শক্তি সেবাদাস –তাকে যারা নেতা রূপে মেন নেয় তারা কখনোই সভ্য, ভদ্র ও বিজ্ঞ হতে পারেনা। ঈমানদারও হতে পারে না। কোন নেতাকে অনুসরণের আগে দেখতে হয়, কী তাঁর রাজনৈতিক এজেন্ডা। কী তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ? দেখতে হয়, সে কি দেশবাসীকে জান্নাতে দিকে নিবে, না জাহান্নামের দিকে নিবে? সে পৌত্তলিক শিবিরে নিয়ে হাজির করবে, না মু’মিনদের শিবিরে হাজির করবে। দেখতে হয় তাঁর চরিত্র ও বিবেকের মানকে।

যাকে তাকে যেমন গাড়ীর ড্রাইভার, গৃহের পাহারাদার বা মসজিদের ইমাম বানানো যায় না, তেমনি যাকে তাকে রাজনৈতিক নেতাও বানানো যায় না। নেতার যোগ্যতার সাথে জড়িত জাতির ভাগ্য। তাই শুধু ঘর বাঁধা ও ভাত-মাছ খাওয়া শিখলে চলে না। শুধু বিষাক্ত সাপ-বিচ্ছু ও হিংস্র পশুগুলি চিনলে চলে না। আল্লাহতায়ালা যে মহামূল্যবান চোখ, কান ও বুদ্ধি দিয়েছেন, সেগুলিও ব্যবহার করতে হয় নেতা ও দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে। সভ্য মানুষ রূপে বেড়ে উঠা ও সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সেটি অপরিহার্য। সে সামর্থ্যগুলি ব্যবহার না করাটি গুরুতর অপরাধ। এটি আমানতের খেয়ানত। মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে এমন খেয়ানতের শাস্তি রয়েছে।

যারা নিজেদের চোখ, কান ও বুদ্ধিকে ব্যবহার করে না, মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে এতোই ঘৃণা করেন যে, তাদেরকে তিনি মানুষের মর্যাদা দিতে রাজী নন। পবিত্র কুর’আনে তাদেরকে তিনি পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলেছেন। মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া সে সামর্থ্যগুলিকে কাজে লাগাতে হয় নেতা ও দল চেনার কাজে। সে কাজে বাঙালি মুসলিমগণ আদৌ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়নি। নিজের চোখ, কান ও বুদ্ধিকে কাজ লাগালে কি গণতন্ত্রের খুনি, ভোটডাকাত, নৃশংস ফ্যাসিস্ট, ইসলামের দুশমন ও ভারতের এজেন্ট কি কখনো নেতা হওয়ার সুযোগ পেত?

যে ব্যক্তির রাজনীতিতে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার অঙ্গীকার নাই, মুসলিম স্বার্থের প্রতি যার ভ্রুক্ষেপ নাই এবং যে বাঁচে জাতি পূজা, ভাষা পূজা ও বর্ণপূজা নিয়ে–তার মত জাহেল ব্যক্তিকে নেতা বানানো ইসলামে হারাম। এমন হারাম কাজে বিজয়ী হয় ইসলামের শত্রুপক্ষ। এরূপ হারাম রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক হয় দেশী-বিদেশী কাফিরগণ। প্রতিটি ঈমানদারকে শুধু নামাজ-রোজার ফরজ-সূন্নত এবং পানাহারের হালাল-হারাম শিখলে চলে না, শিখতে হয় রাজনীতির হারাম-হালালের বিষয়গুলিও। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি হাছিলের চেয়ে রাজনীতি এই মৌলিক বিষয়গুলি জানা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ মৌলিক জ্ঞানটুকু যার নাই, বুঝতে হবে সে ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হলেও মূলত জাহেল।

ইসলামের গৌরবকালে ভেড়ার রাখালগণও রাজনীতির এই মৌলিক বিষয়গুলি বুঝতেন। কারণ, তাদেরকে এ বিষয়গুলির উপর নবীজী (সা:) জ্ঞানদান করেছিলেন। তাদের সেই রাজনৈতিক সজ্ঞানতার কারণেই হযরত আবু বকর (রা:), হযরত উমর (রা:), হযরত উসমান (রা:) ও হযরত আলী (রা:)’র ন্যায় ব্যক্তিদের খলিফার আসনে বসতে রাজপুত্র হতে হয়নি। মানব ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম গণতন্ত্র চর্চা। আজকের মুসলিমগণ পথ হারিয়েছে এবং বিপর্যের মুখে পড়েছে –ইসলামের এই গৌরবজনক ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়ার কারণে। এবং এই অজ্ঞতার কারণেই মুসলিম দেশগুলিতে ইসলামের চিহ্নিত শত্রুগণও মুসলিমদের নেতা হয়। ফলে মুসলিম দেশগুলি অধিকৃত হয়েছে নব্য ফিরাউনদের হাতে। অনেকেই এসব দুর্বৃত্তকে ভোট দেয় এবং তাদের পক্ষে যুদ্ধ করে ও প্রাণও দেয়। পরিতাপের বিষয় হলো, বিপুল সংখ্যক মানুষ এভাবেই জাহান্নামের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

পবিত্র কুর’আনের সুস্পষ্ট হুকুম হলো, যে মহফিলে বা যে সভায় ইসলামের বিরুদ্ধে বিরূপ কথ বলা হয় -সে আসরে যেন কোন ঈমানদার না বসে। তাদের সঙ্গ দেয়া হারাম। এবং ফরজ হলো, সে স্থান দ্রুত ত্যাগ করা। সে আসরে বসে থাকার অর্থ, তাদের অপরাধের ভাগী হওয়া। এ বিষয়ে পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ: “(হে রাসূল), আপনি যখন দেখতে পান তারা আমার আয়াত সমূহের ব্যাপারে উপহাসমূলক আলোচনায় মগ্ন, আপনি তাদের সঙ্গ ত্যাগ করবেন, যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত হয়।” –(সুরা আনয়াম, আয়াত ৬৮)। একই রূপ নির্দেশ এসেছে সুরা নিসার ১৪০ নম্বর আয়াতে। এ আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ হলো: “(এর আগে) তোমাদের উপর নাযিল হয়েছে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখাত হচ্ছে এবং বিদ্রুপ করা হচ্ছে আয়াতগুলি নিয়ে, যতক্ষণ না তারা অন্য প্রসঙ্গে যায়, তাদের সাথে বসবে না। নইলে তোমরাও তাদের মত গণ্য হবে। মুনিফিক ও কাফির –এদের সকলকেই আল্লাহ জাহান্নামে একত্রিত করবেন।”

প্রশ্ন হলো, ইসলামের চিহ্নিত শত্রুর সাথে একত্রে বসা যেখানে নিষিদ্ধ, সেখানে তাদের সাথে একই দলে শামিল হয়ে একজন ঈমানদার ব্যক্তি রাজনীতি করে কীরূপে? সেক্যুলারিস্টগণ তো তাদের দলীয় সভায় শরিয়তী আইনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য কথা বলে। এ যুগে শরিয়তী আইনকে তারা অচল বলে এবং মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে তিরস্কার করে। ইসলামের প্রতি অঙ্গীকার এবং শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা নিয়ে যারা কাজ করে সেক্যুলারিস্টগণ তাদরকে দলে স্থান দিতে রাজী নয়। কথা হলো, শরিয়তের বিরুদ্ধে যে দলে প্রকাশ্যে অবস্থান, সে দলে কি কোন মুসলিম যোগ দিতে পারে? যোগ দিলে কি তাঁর ঈমান থাকে? নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালনে কি এরূপ গুনাহ কখনো মাফ হয়?

মুসলিম রাজনীতি করবে একমাত্র ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে, কোন মতবাদ, ব্যক্তি বা দলকে বিজয়ী করতে নয়। বাংলাদেশের বুক যারা সেক্যুলারিস্ট, নাস্তিক, জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিস্ট, কম্যুনিস্ট ও হিন্দুত্ববাদী -ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধটি কোন কালেই গোপন বিষয় ছিল না এবং এখনো নয়। রাজনীতির মধ্য দিয়েই মানুষ কোন একটি মতবাদ বা বিশ্বাসের পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। ঈমানদার যেমন আল্লাহতায়ালা, তাঁর রাসূল, কুর’আনী সত্য ও ঈমানদারের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়, তেমনি বেঈমান ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় মিথ্যা এবং মিথ্যাচারী দুর্বৃত্তদের ন্যায় শয়তানের খলিফাদের পক্ষে। ঈমানের পরীক্ষাটি শুরু হয় সাক্ষ্য দেয়ার মধ্য দিয়। কালেমায়ে শাহাদত হলো সেই সাক্ষ্যদানের কালিমা। মুসলিম জীবনের শুরুটি হয় এই কালিমা পাঠের মধ্য দিয়ে। জান্নাতে যেতে হলে প্রথমে সাক্ষ্যদানের এই পরীক্ষায় অবশ্যই পাশ করতে হয়।

কথা হলো চোরডাকাত, ভোটাডাকাত, গুম-খুন-অপহরণ এবং ফ্যাসিবাদের নৃশংস নেতা-নেত্রীকে যে ব্যক্তি শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় বলে কুর্ণিশ করে -তাকে কি জাহান্নামে যাওয়ার জন্য মানুষ খুন বা নারী ধর্ষণের প্রয়োজন পড়ে? অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে খুন, চুরিডাকাতি ও ধর্ষণে অপরাধের কারণে নয়। বরং অপরাধীদের পক্ষে সাক্ষ্যদান ও তাদের পক্ষে লাঠি ধরার জন্য। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো, বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশে ইসলামের শত্রুপক্ষের রাজনীতি বেঁচে আছে এবং সে রাজনীতি বিজয় পেয়েছে মুসলিমদের সমর্থণে। ১০/১০/২০২২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *