শিক্ষার নামে বাঙালি মুসলিম জীবনে দুর্বৃত্তায়ন ও নাশকতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল 

 আল্লাহতায়ালার সিলেবাস এবং শয়তানের সিলেবাস                                             

 শিক্ষাঙ্গণে যেমন মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা ও সিলেবাস রয়েছে, তেমনি রয়েছে শয়তানের এজেন্ডা ও সিলেবাস। আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে বেড়ে উঠবে না শয়তানের খলিফা রূপে বেড়ে উঠবে –মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টি নির্ধারিত হয় শিক্ষাঙ্গণ থেকেই। কে জান্নাতে যাবে এবং কে জাহান্নামে যাবে -সেটিও স্থির করে দেয় এবং সে লক্ষ্যে ব্যক্তিকে প্রস্তুত করে তার শিক্ষা। তাই মানব জীবনের সবচেয়ে চুড়ান্ত ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গণটি হলো শিক্ষাঙ্গণ। এবং সেটি ধরা মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার স্ট্রাটেজীতেও। তাই তিনি  ইসলামের মিশনটি নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ফরজ করে শুরু করেনেনি। বরং শুরু করেছেন জ্ঞানার্জন জ্ঞানদানকে ফরজ করার মধ্য দিয়ে। শিক্ষাঙ্গণে আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা হলো, শিক্ষার মাধ্যমে মানবের ঈমান ও আক্বীদার পরিশুদ্ধি এবং নেক আমলের সামর্থ্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে তাকে জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তোলা। মানব তখন ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর হয়।

 অপর দিকে শিক্ষাঙ্গণে শয়তানের এজেন্ডা হলো, কুশিক্ষার মাধ্যমে মানব সন্তানদের আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করা এবং জাহান্নামের যোগ্য দুর্বৃত্ত রূপে গড়ে তোলা। শিক্ষাঙ্গণ থেকেই শয়তান পায় তার রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণের সৈনিক। মানবের চেতনা, কর্ম ও চরিত্র তো সেটিই -যা সে শিক্ষাঙ্গণ থেকে পায়। ব্যক্তির দৈহিক পরিচয়টি তার পানাহারের গুণে, কিন্তু সে মানবিক ও নৈতিক পরিচয়টি পায় শিক্ষার গুণে। তাই মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিক্ষার এ দুটি বিপরীতমুখী ধারাকে বুঝা এবং সঠিক ধারাটি বেছে নেয়া। এ পৃথিবীতে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বিতীয়টি নাই। এখানে ব্যর্থ হলে বিপর্যয় অনিবার্য। তখন এ জীবনের পুরা বাঁচাটিই ব্যর্থ হয়ে যায়। সেটি ভূল ট্রেনে উঠে ভূল গন্তব্যে পৌঁছার মত। শিক্ষার সে দুটি ধারা সুস্পষ্ট দেখা যায় নবীজী (সা:)’র আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং আজকের বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে নজর দিলে। নবীজী (সা:)’র আমলে শিক্ষাঙ্গণে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা ও সিলেবাস। সে শিক্ষাব্যবস্থায় গড়ে উঠেছিল সর্বকালের সর্বশ্রষ্ঠ মানব। নির্মিত হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। তাতে মুসলিমদের উত্থান ঘটেছিল এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপ ব্যাপী বিস্তৃত প্রধান বিশ্বশক্তি রূপে। অপর দিকে বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের শিক্ষাঙ্গণে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা ও সিলেবাস গুরুত্ব পায়নি। বরং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শয়তানের এজেন্ডা ও সিলেবাস। এ শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্বৃত্তায়ন এতোটাই ফলন দিয়েছে যে, এই শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশে পর পর ৫ বার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বৃত্তকবলিত দেশের শিরোপা পেয়েছে। সমগ্র মানব ইতিহাসে আর কোন দেশ এরূপ রেকর্ড অর্জন করেনি। দেশ পরিণত হয় ভিক্ষার তলাহীন ঝুলিতে। যে মুজিবকে নিয়ে বাঙালির গর্ব, তাঁর শাসনামলেই বহুদলীয় গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকার কবরে স্থান পায়। তথাকথিত জাতির জনক ও বঙ্গবন্ধু পরিণত হয় একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার, বিচার বহির্ভুত হত্যা ও ভারতসেবী রাজনীতির জনকে। বাংলাদেশ জুড়ে আজ যেরূপ গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, চুরিডাকাতি, অর্থপাচার, ভোটডাকাতির প্লাবন -সেটির কারণ দেশের নিরক্ষর গ্রামীন জনগণ নয়। বরং এজন্য দায়ী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত শহুরে দুর্বৃত্তগণ। ২০১৮ সালে দেশজুড়ে যেভাবে ভোটডাকাতি হলো সেটিই প্রমান করে বাংলাদেশের প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আইন আদালত কীরূপ অসভ্য ও দুর্বৃত্তদের দ্বারা অধিকৃত। যে কোন সভ্য দেশে কোন একটি গৃহে ডাকাতি হলেও ডাকাত ধরার চেষ্টা হয় এবং ডাকাতকে শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে দেশজুড়ে ভোটডাকাতি হলেও কোন ভোটডাকাতকে গ্রেফতার করা হয়নি এবং তাকে শাস্তিও দেয়া হয়নি। বরং ডাকাত সর্দারনীকে মাননীয় ও শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী বলা হয়। কোন সভ্যদেশে কি এমনটি ভাবা যায়। একমাত্র দুর্বৃত্ত ও অসভ্যগণই আরেক দুর্বৃত্তকে মাননীয় ও শ্রদ্ধেয় বলে; কোন সভ্য ও ভদ্রজন নয়। যে অসভ্য দুর্বৃত্তগণ ২০১৮ সালে দেশজুড়ে ভোটডাকাতি করলো তারা কোন ডাকাতপাড়ায় ও পতিতাপল্লীতে গড়ে উঠেনি, গড়ে উঠেছে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চরিত্র ধ্বংসে ও দুর্বৃত্তায়নে যে কতটা সফল –এ হলো তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। ইসলামের মৌল কথা, দুর্বৃত্ত হওয়ার অর্থই জাহান্নামের যোগ্য হওয়া। দেশ শয়তানী শক্তির দখলে গেলে শিক্ষাঙ্গণ পরিণত হয় দুর্বৃত্ত উৎপাদনের ফ্যাক্টরিতে। বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামের পরাজয় এবং দুর্বৃত্তদের নিরংকুশ বিজয় দেখে নিশ্চিত বলা যায়, দেশটিতে শয়তানের বিজয় কতটা বিশাল।

 মহান আল্লাহতায়ালার দৃষ্টিতে দুনিয়ার এ জীবনটি হলো প্রতিটি মানুষের জন্য আমৃত্যু পরীক্ষালয় –যেমনটি বলা হয়েছে সুরা মুলকের ২ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “তিনিই সেই মহান সত্ত্বা যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন এজন্য যে, পরীক্ষা করবেন আমলের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠতর।” ফলে প্রতিটি ঘর, প্রতিটি কর্মস্থল এবং রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রতিটি অঙ্গণ হলো পরীক্ষার হল। আল্লাহতায়ালার নজর সবার উপরে। জীবনের সাফল্য পুরাপুরি নির্ভর করে এ পরীক্ষায় পাশের উপর। মৃত্যুহীন পরকালীন জীবনে কে জান্নাতবাসী হবে এবং কে জ্বলবে জাহান্নামের আগুনে -সেটি নির্ধারিত হবে এ পরীক্ষার ফলাফল থেকে। এ জীবনে তো তারাই সফল হয়, যারা এ জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত বাঁচে উপরুক্ত আয়াতটির কথা হৃদয়ে ধারণ করে। নইলে ব্যর্থ হয় এ জীবনের পুরা বাঁচাটিই। পরীক্ষাকালীন পুরা সময়টি তখন রুজী-রোজগার, খেলা-খুলা, নাচ-গান, অর্থহীন গল্প ও আনন্দ-উল্লাসে ব্যয় হয়ে যায়। অবশেষে পরীক্ষার শেষ ঘন্টা বাজার সাথে সাথে কবরে যেতে হয়। অধিকাংশ মানুষের জীবনে তো সেরূপই ঘটে।

 করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালা কখনোই চান না, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ মানবসৃষ্টির কেউ জাহান্নামের আগুনে দগ্ধিভুত হোক। তাদের জন্য তো প্রস্তুত রেখেছেন নিয়ামতভরা অগণিত জান্নাত –যেখানে দুঃখ-যাতনা ও অভাবেরই অভাব। বান্দাহগণ যাতে পরীক্ষায় সহজে পাশ করতে পারে –সে সুযোগও সৃষ্টি করছেন। সে জন্য  যেমন পূর্ব থেকেই সিলেবাস বেঁধে দিয়েছেন, তেমনি তাদের কাছে টেক্সট বুকও পাঠিয়েছেন। সে টেক্সট বুকটি হলো পবিত্র কুর’আন -যা দেয় শতভাগ পাশের নিশ্চয়তা। অতীতে যারাই এ টেক্সটবুক অনুসরণ করেছে তাদের সবাই নিশ্চিত সফল হয়েছে। তাছাড়া কীরূপে এই টেক্সটবুকটি অনুসরণ করতে হয় -সেটিও হাতে-কলমে শেখাতে রাসূল পাঠিয়েছেন। সে সাথে পরীক্ষায় কীরূপে ব্যর্থতা জুটে এবং মানুষ কীরূপে জাহন্নামে পৌঁছে -সেটিও বহুবার জানিয়ে দিয়েছেন। শয়তান চায়, মানুষ এ পরীক্ষায় ফেল করুক এবং জাহান্নামে পৌঁছুক। সে লক্ষ্যসাধনে শয়তানের প্রধান স্ট্রাটেজী হলো, আল্লাহতায়ালাপ্রদত্ত সিলেবাস ও টেক্সটবুক থেকে জনগণকে দূরে রাখা। এজন্যই শয়তানের অনুসারীগণ যখনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পায়, ইসলামবিরোধী শিক্ষাদানের সাথে স্কুল-কলেজ থেকে কুর’আন-হাদীসের পাঠ তখনই বন্ধ করে দেয়। শেখ মুজিব তাই পাকিস্তান আমলে চালু করা দ্বীনিয়াত নামক ইসলামী বইটি স্কুলের পাঠ্যতালিকা থেকে বাদ দেয়। শেখ হাসিনা নিয়ন্ত্রণ করে পবিত্র কুর’আনের তাফসির ও মসজিদে ইমামদের খোতবা। বিখ্যাত তাফসিরকারকদের কারাবন্দী করার সাথে বাজেয়াপ্ত করেছে জিহাদ বিষয়ক বই –যেন জিহাদ ইসলাম-বহির্ভৃত বিষয়। সে সাথে বাধ্যতামূলক করেছে পৌত্তলিক জাতীয় সঙ্গিত, স্কুল চত্বরে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে মুজিবের মুর্তি এবং স্কুলের পাঠ্য বইয়ে ঢুকিয়েছে হিন্দুধর্মের পৌরানিক কাহিনী। শিক্ষাঙ্গণ এভাবেই পরিণত হয়েছে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মূল রণাঙ্গণ।     

 

 কুশিক্ষার ভয়ংকর নাশকতা

 স্রেফ দৈহিক বল নিয়ে বাঁচায় কৃতিত্ব নাই। বিপুল দৈহিক দল পশুরও থাকে। ব্যক্তিকে জান্নাতে নেয় তাঁর ঈমানের বল এবং নেক আমল। দেহের ন্যায় ঈমানও লাগাতর পুষ্টি চায়। ঈমানের পুষ্টি আসে ওহীর জ্ঞান তথা পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান থেকে। নৈতিক সুস্থতা নিয়ে বেড়ে উঠার জন্য সে জ্ঞান অপরিহার্য। তাই পবিত্র কুর’আনী জ্ঞানের শূন্যতা নিয়ে যে শিক্ষা তার নাশকতাটি অতি ভয়ংকর। এতে মৃত্যু ঘটে ঈমানের। বিলুপ্ত হয় সভ্য মানুষ রূপে বেড়ে উঠার সামর্থ্য। মানব শিশু যে কারণে হিংস্র ও ইতর দুর্বৃত্তে পরিণত হয় -সেটি হলো এই কুশিক্ষা। কুশিক্ষা কেড়ে নেয় জান্নাতের যোগ্য হওয়ার সামর্থ্য এবং হাজির করে জাহান্নামের আগুনে। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বড় ক্ষতিগুলো কোন কালেই হিংস্র পশু, রোগজীবাণু, মহামারী, ঘুর্ণিঝড়, ভূমিকম্প বা সুনামীর কারণে হয়নি। কোটি কোটি মানুষের প্রাননাশী যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বিশ্বযুদ্ধের ন্যায় বীভৎস বর্বরতাগুলো ঘটেছে এমন সব দুর্বৃত্তদের হাতে যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পেয়েছে কুশিক্ষা। তাই মানব সমাজে সবচেয়ে বড় নেক কর্মটি অর্থদান, গৃহদান, খাদ্যদান বা চিকিৎসা-দান নয়, বরং সেটি হলো সুশিক্ষা-দান। একটি সভ্য রাষ্ট্রের এটিই হলো সবচেয়ে গণকল্যাণমূলক খাত। একটি জাতি এগুবে না পিছিয়ে যাবে -সেটি নির্ধারিত হয় শিক্ষাখাতের বিনিয়োগ থেকেই।

 যে কোন রাষ্ট্রেই নানারূপ অপরাধ কর্ম ঘটে। কিন্তু সবচেয়ে জঘন্য অপরাধটি চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস ও মানব হত্যা নয় বরং সেটি হলো কুশিক্ষা-দান। অপরাধটি এখানে চেতনা রাজ্যে বিষাক্ত বিষ প্রয়োগের। ফলে অপরাধটি বিবেক হত্যার। সে ঘাতক বিষটি হলো বিষাক্ত মতবাদের। তখন সুবোধ বালকও নৃশংস খুনিতে পরিণত হয়। বুয়েটের এক পাল ছাত্র যেভাবে আবরার ফাহাদ নামক নিরীহ ছাত্রকে নির্মম ভাবে পিটিয়ে হত্যা করলো, সেটিই প্রমাণ করে দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়া শিক্ষাঙ্গণে কতটা প্রবল। ১৯৭৩ সালে এমন খুনিরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে ৭ জন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এরূপ ঘটনার সংখ্য অসংখ্য। একাত্তরের এরাই হাজার হাজার বিহারী নারীকে ধর্ষণ করে এবং ছিনিয়ে নেয়  প্রায় ৬ লাখ বিহারীর ঘরবাড়ী ও দোকানপাট।

মুষ্টিমেয় কিছু লোকের চুরি-ডাকাতি, গুম, খুন ও দুর্বৃত্তির কারণে কোন জাতি অসভ্য ও ব্যর্থ হয় না। সমগ্র দেশ তাতে আযাবের মুখে পড়ে না। কিন্তু জাতি অসভ্য ও ব্যর্থ হয় এবং জনগণ জাহান্নামের খাদ্য রূপে বেড়ে উঠে কুশিক্ষার কারণে। দুর্বৃত্তি তখন কোভিডের ন্যায় মহামারির রূপ ধারণ করে। তাতে মানব সৃষ্টির মূল এজেন্ডাই ব্যর্থ হয়ে যায়। মহান আল্লাহতায়ালা চান, মানুষ এ পৃথিবী পৃষ্টে তাঁর খলিফা হবে। কিন্তু কুশিক্ষিত মানুষটি তখন বিদ্রোহী হয়। এবং মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা হওয়ার বদলে শয়তানের খলিফায় পরিণত হয়। মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা দূরে থাক, এমন দুর্বৃত্তের পক্ষে অসম্ভব হয় ন্যূনতম সভ্য মানুষ রূপে বেড়ে উঠা। কুশিক্ষা এভাবেই মানব জীবনে সবচেয়ে ভয়ংকর নাশকতাটি ঘটায়। নামে মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও এরাই বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে ইসলামের পরাজয় বাড়িয়েছে এবং বিজয় বাড়িয়েছে শয়তানের। সম্পদের প্রাচুর্য্য বাড়িয়ে এদের কল্যাণ করা যায় না। এদের যাত্রা জাহান্নামের দিকে। 

 আল্লাহতায়ালার মহান সূন্নত হলো, যখনই তিনি কারো কল্যাণ চান, তাকে জ্ঞান দান করেন। বাড়িয়ে দেন তাঁর চিন্তা-ভাবনার সামর্থ্য। দেন, ন্যায়-অন্যায় এবং সত্য-মিথ্যার মাঝে তারতম্য করার সামর্থ্য। তখন সে ব্যক্তি পায় জান্নাতের যোগ্য রূপে বেড়ে উঠার সামর্থ্য। অনেক কাফেরকেও আল্লাহতায়ালা দৈহিক শক্তি, সম্পদ ও সন্তান দান করেন; কিন্তু তাদেরকে ওহীর জ্ঞান দেন না। ওহীর জ্ঞানশূণ্যতার কারণে এমন ব্যক্তিগণ পথভ্রষ্ট হয় এবং ছুটে চলে জাহান্নামের দিকে। এ জন্যই মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দানটি হলো পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান। একমাত্র এই ওহীর জ্ঞানই ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায়। এজন্যই কোন দেশ যখন বাংলাদেশের ন্যায় গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি ও ভোটডাকাতির প্লাবনে ভাসতে থাকে, বুঝতে তবে সে জাতির জীবনে ওহীর জ্ঞান জুটেনি। ফলে হিদায়েতও জুটেনি। এমন জাতি যে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বরেকর্ড গড়বে –সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?

 অসভ্য আরবগণ যে কারণে বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয় এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দেয় -তার মূলে তেল-গ্যাস ও সোনা-রূপার খনি এবং আরবের আলো-বাতাস ও জলবায়ু ছিল না। সেটি হলো পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান। এই কুর’আনের জ্ঞানের বলেই সাহাবাগণ ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর হতে পেরেছিলেন। তারা পরিণত হয়েছিলেন মহান আল্লাহতায়ালার একনিষ্ঠ খলিফায় ও আল্লাহর বাহিনীতে। আল্লাহতায়ালা কি কখনো তার নিজ বাহিনীর পরাজয় চান? ফলে তাদের সাহায্যে রণাঙ্গণে ফেরেশতাগণ নেমে এসেছিলেন। একারণেই তাদের জন্য বার বার বিজয়লাভ সহজ হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের মত দেশগুলিতে ঘটছে বিপরীতটি। সুশিক্ষা দানের পবিত্র সূন্নতটি হলো মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর নবী-রাসূলদের। এবং কুশিক্ষা দেয় শয়তান ও তার অনুসারীগণ। বাংলাদেশের মত দেশগুলিতে শয়তানী পক্ষ বিজয়ী হওয়ায় মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র সূন্নতটি বেঁচে নাই। বরং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শয়তানের সূন্নত। ফলে যতই বাড়ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ততই বাড়ছে দুর্বৃত্ত উৎপাদনের আয়োজন। ফলে বেড়ে চলেছে জাহান্নামের পথে যাত্রীর সংখ্যা।

            

 হাতিয়ার দুর্বৃত্তায়নের

 দুর্বৃত্তায়নে প্রতিদেশেই পতিতাপল্লী, মাফিয়া চক্র, ড্রাগব্যবসায়ী, মদ-জুয়ার আখড়া, চোর-ডাকাতদল এবং সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলের নাশকতামূলক ভূমিকা থাকে। তবে দেশজুড়ে দুর্বৃত্তায়নের জোয়ার সৃষ্টিতে এগুলিই দুর্বৃত্ত শক্তির সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি নয়। বরং সেটি হলো কুশিক্ষা দানে নিয়োজিত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সে লক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত লক্ষাধিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। ঘুষখোর অফিসার, স্বৈরাচারী সরকারের সামরিক ও বেসামরিক চাকর-বাকর, বিদেশের চর, ইসলামের শত্রু এবং রাজনৈতিক দলের খুনি ক্যাডারগণ গড়ে উঠে এই শিক্ষাঙ্গণ থেকে। এদের উৎপাদনে ব্যয় হয় দেশবাসীর শত শত হাজার কোটি টাকার রাজস্বের অর্থ। দুর্বৃত্তকবলিত রাষ্ট্রে এটিই হলো সবচেয়ে দুর্বৃত্তায়ন ও নাশকতার খাত। এজন্য দেশে এবং দেশবাসীর চরিত্রে বিপ্লব আনতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সর্বপ্রথম শিক্ষার সংস্কারে হাত দিতে হয়। সেটিই মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র সূন্নত। আরবের বুকে ইসলামের যাত্রা সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের সকল ব্যর্থতার কারণ, দেশটিতে মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহর সে পবিত্র সূন্নত পালন করা হয়নি। বরং প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে শয়তানের স্ট্রাটেজীকে।

কুর’আনী জ্ঞান ব্যক্তিকে যেমন মানব-সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যটি জানায়, তেমনি জানায় মানব-জীবনের মূল মিশনটি। এভাবেই সে জ্ঞান যেমন প্রকৃত মানব রূপে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে, তেমনি পদে পদে জান্নাতের পথও দেখায়। সে জ্ঞানের বরকতেই মানুষ জাহান্নামের পথে ধাবিত হওয়ার মহাবিপদ থেকে বাঁচে। তখন ব্যক্তি পায় মহান আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দা রূপে বেড়ে উঠার সামর্থ্য। এমন ব্যক্তিরাই বেড়ে উঠে মহান আল্লাহতায়ালা দায়িত্ববান খলিফা রূপে। এমন মানুষদের নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের মাঝে গর্ব করেন। অথচ যেখানেই এই কুর’আনী জ্ঞানের অভাব, সেখানেই জীবনের মূল মিশন, ইবাদতের সঠিক বিধান, শরিয়তী আইন, ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা, ইসলামী রাষ্ট্রের গুরুত্ব, জিহাদ এবং জান্নাত-জাহান্নাম –এরূপ বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই অজানা থেকে যায়। তখন জীবন ভরে উঠে অজ্ঞতার অন্ধকারে ও ব্যর্থতায়। এমন ব্যক্তিগণই শয়তানের সৈনিক হয় এবং জাহান্নামের বাসিন্দা হয়।

 

কুশিক্ষা স্বরূপ

 যে শিক্ষায় ওহীর তথা কুর’আন-হাদীসের জ্ঞান নাই, সুশিক্ষিত ও সুসভ্য ব্যক্তি গড়ার উপকরণ নাই, ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা নাই, নবীজী (সা:)’র ন্যায় অনুকরণীয় মডেল চরিত্রের বর্ণনা নাই এবং সিরাতাল মুস্তাকীমের হদীস নাই -সেটিই মূলত কুশিক্ষা। কুশিক্ষা তখন দুর্বৃত্তায়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, স্বৈরাচারী শাসক এবং দেশী-বিদেশী মাফিয়া চক্র তাদের চাকর-বাকরের জোগান পায় এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে।  ব্রিটিশগণ ভারত দখলের পর তাই এমন দুর্বৃত্ত উৎপাদন কল্পে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। মানব জাতির ইতিহাসে সকল নৃশংসতার মূলে হলো এই কুশিক্ষা। পশুর হাতে পারমানবিক বোমা, রাসায়নিক বোমা, ক্লাস্টার বোমা, মিজাইল ও ড্রোন থাকে না। কিন্তু মানবরূপী এ হিংস্র জীবদের হাতে সেগুলি বিপুল সংখ্যায় থাকে। ফলে মানবের হাতে রক্ত ঝরে কোটি কোটি মানুষের। এবং বিধ্বস্ত হয় শত শত নগর-বন্দর। তখন উদ্বাস্তু  হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ। সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, আরাকান, কাশ্মিরসহ পৃথিবীর নানা দেশে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে তো এসব হিংস্র জীবদের হাতেই। মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি তাই কৃষি, শিল্প বা বাণিজ্য খাতে ঘটে না, সেটি ঘটে এই শিক্ষা খাতে। শিক্ষা খাতের এ ব্যর্থতার কারণেই মানব ব্যর্থ হচ্ছে উচ্চতর মানবিক গুণ নিয়ে বেড়ে উঠতে। বরং নামছে ইতর পর্যায়ে। শিক্ষা খাতে অতীতের ব্যর্থতার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, কম্যুনিজম, বর্ণবাদ, বর্ণবাদী নির্মূলীকরণ, বিশ্বযুদ্ধ ও পারমানবিক  অস্ত্রের ন্যায় নানাবিধ ঘাতক মতবাদ ও  জীবনধ্বংসী উপকরণ। অর্থাৎ মানুষ পরিণত হয়েছে নৃশংস দুর্বৃত্ততে।   

 অক্ষরজ্ঞান, লিখনির জ্ঞান বা গণিতের জ্ঞানে নিরক্ষতা দূর হয় বটে, কিন্তু তাতে কুশিক্ষা দূর হয় না। কুশিক্ষার হিংস্র নাশকতা তখন বরং অধিক রক্তাক্ত হয়। দুইটি বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে যারা সাড়ে সাত কোটি মানুষকে হত্যা করলো, ধ্বংস করলো হাজার হাজার নগর-বন্দর এবং ধুলিস্যাৎ করলো বহুকোটি ঘর-বাড়ি ও কল-কারখানা -তাদের কেউই কি নিরক্ষর ছিল? এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিশাল ভু-ভাগকে যেসব ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীগণ জবর-দখল করলো, লুন্ঠন করলো, সেসব দেশের বহু কোটি আদিবাসীকে হত্যা করলো এবং দাসরূপে তাদের কেনাবেচা করলো –তারাও নিরক্ষর ছিল না। যেসব আগ্রাসীদের হাতে ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, কাশ্মির, আরাকান, উইঘুর ও আফগানিস্তানের বহু লক্ষ মানুষ নির্যাতিত ও নিহত হলো এবং হাজার হাজার নারী ধর্ষিতা হলো –তাদেরও কেউ নিরক্ষর ছিল না। হিটলারের মত নৃশংস স্বৈরাচারী বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ন্যায় বর্ণবাদি ও মিথ্যাবাদী দুর্বৃত্তকে যারা নির্বাচনে বিজয়ী করেছে -তারাও কি নিরক্ষর ছিল?

 এমন কি বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম দেশকে দুর্নীতিতে যারা বিশ্বে ৫ বার প্রথম স্থানে পৌঁছে দিল, মৌলিক মানবিক অধিকার হনন করে বাকশালী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা দিল এবং ২০১৮ সালে জনগণের ভোট ডাকাতি করে নিল -তারাও কি দেশটির নিরক্ষর মানুষ? বরং ডাকাতি ও দুর্বৃত্তির নায়কগণ তো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী নেতানেত্রী, পুলিশ অফিসার, আদালতের বিচারক এবং সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারি। নিরক্ষরতা দূর হলেও তাতে যে কুশিক্ষার নাশকতা দূর হয় না -এটি তো তারই প্রমাণ। অশিক্ষা ও কুশিক্ষার কারণে মানুষ শুধু পশু নয়, পশুর চেয়েও ভয়ংকর জীবে পরিণত হয় –সে প্রমাণ তো অসংখ্য। সে ঐতিহাসিক সত্য নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার নিজের ঘোষণাটি হলো: “উলা’য়িকা কা’আল আনয়াম, বাল হুম আদাল।” অর্থ: তারাই হলো পশু, বরং পশুদের চেয়েও নিকৃষ্ট।

 

শত্রুশক্তির অধিকৃতি এবং চাপানো কুশিক্ষা

মানবরূপী হিংস্র জীবদের হাতে অধিকৃত হওয়ার বিপদটি ভয়ংকর। অধিকৃত হওয়ার সাথে সাথে সে দেশে মহান আল্লাহতায়ালার নাযিলকৃত ওহীর জ্ঞানচর্চা নিষিদ্ধ হয় এবং শরিয়তী আইনের বদলে প্রতিষ্ঠা পায় কুফরি আইন। তখন শুধু বর্বর স্বৈরাচার, নৃশংস নির্যাতন, বিনা বিচারে হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দেশের রাজস্ব লুন্ঠন ও মৌলিক অধিকার হননই এজেন্ডায় পরিণত হয় না, বরং সর্বাত্মক চেষ্টা হয় সত্যের বিলুপ্তি ও সমগ্র জনগণকে জাহান্নামের দিকে নেয়ায়। চাপানো হয় বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাসিবাদ। সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলা তখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য হয়। মুজিবের ন্যায় গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট শাসকের প্রশংসা গাওয়া তখন রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়। একাত্তরের ভারতসেবীদের ভয়ানক অপরাধের কথা তাই বাংলাদেশের মাটিতে বলা যায় না। সেগুলি নিয়ে কোথাও কিছু লেখা যায় না। কারণ দেশের উপর দখলদারীটা তাদের। অতীতে এরূপ বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাসিবাদ চাপানো হয়েছিল নমরুদ ও ফিরাউনের ন্যায় স্বৈরাচারী শাসকদের আমলে। সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহকে আল্লাহ বললে প্রাননাশ করা হতো। তখন ফিরাউনের ন্যায় গুরুতর দুর্বৃত্তকে খোদা বলতে হতো। যুগে যুগে এরূপ ফ্যাসিবাদীরাই নবী-রাসূলদের মিশনের প্রবল প্রতিপক্ষ রূপে দাঁড়িয়েছে। এসব নরপশুদের কারণে হযরত ইব্রাহীম (আ:), হযরত মূসা (আ:) ও হযরত মুহাম্মদ (সা:)’র মত মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরও নিজ জন্ম ভূমি ছাড়তে হয়েছে। ইসলামের দুশমনদের হাতে দেশ অধিকৃত হওয়ার ভয়ানক বিপদটি এখানেই। যেখানে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নাই এবং শিক্ষাঙ্গণে কুর’আনী জ্ঞানের চর্চা নাই -বুঝতে হবে সে দেশে দখলদারীটি মূলত শয়তানী শক্তির।

 মহান আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে শয়তানী শক্তির হাতে অধিকৃতির বিপদ থেকে মুক্তি দিতে চান। পৃথিবী পৃষ্ঠে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে সেটিই হলো মূলত প্রথম ধাপ। কারণ, শয়তানের শক্তির অধিকৃতি বাঁচলে সে ভূমিতে কখনোই সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয় যায়না। তবে তিনি শয়তানী শক্তির বিলুপ্তির সে কাজটি চান ঈমানদারদের হাত দিয়ে। বরং সত্য তো এটাই, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে ঈমানদারের যে কাজটি সবচেয়ে অধিক প্রিয় তা হলো শয়তানী শক্তির নির্মূলের লক্ষ্যে জিহাদ। সেটি বর্ণিত হয়েছে সুরা সাফ’য়ের ৪ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় একতাবদ্ধ ভাবে।” সে সাথে প্রতিটি ঈমানদারদের প্রতি মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ হলো, তারা যেন শয়তানী শক্তির নির্মূলের কাজে তাঁর আনসার তথা সাহায্যকারি হয়ে যায়। সে নির্দেশটি এসেছে সুরা সাফ’য়ের ১৪ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে: “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহতায়ালার সাহায্যকারি হও।” সুরা সাফ’য়ের ১০-১১ আয়াতে তাদের জন্য একটি ব্যবসার কথাও উল্লেখ করেছেন -যা মুক্তি দেয় জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে। বলা হয়েছে: “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কি এমন এক ব্যবসার কথা বলবো -যা মুক্তি দিবে কঠিন আযাব থেকে? সেটি হলো, তোমরা ঈমান আনো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করো তোমাদের সম্পদ ও জান দিয়ে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা বুঝতে।” তাই মানব জীবনে শ্রেষ্ঠ নেক কর্মটি সন্যাসীদের ন্যায় ধ্যানে বসা নয়, বরং সেটি হলো জাহান্নামের আগুনে নেয়ার শয়তানী প্রকল্পের নির্মূলে জিহাদে নামা। ইসলামে এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। একমাত্র এ পথেই সুশাসন ও সুশিক্ষার প্রতিষ্ঠা ঘটে। মানুষ তখন জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে উঠে এবং মুক্তি পায় জাহান্নামের পথ থেকে।

 প্রতি যুগেই মানবরূপী হিংস্র দানবগণ শিক্ষাঙ্গণকে ব্যবহার করেছে কুশিক্ষার বিস্তারে। তারা জানে শিক্ষার সামর্থ্য বিস্ময়কর। কুশিক্ষার মাধ্যমে ফিরাউনের ন্যায় দুর্বৃত্তদেরকে যেমন ভগবান রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়া যায়, তেমনি গরুবাছুর, সাপ-শকুন, লিঙ্গ, পাহাড়-পর্বত এবং মাটির মুর্তিকেও পূজনীয় করা যা।  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি অতি ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হতে পারে জনগণকে ইসলাম দিকে দূরে সরানোর কাজে -তথা জাহান্নামের পথে নেয়ায়। তাই প্রতিদেশে শয়তানী শক্তির অভিন্ন এজেন্ডা হলো, কুর’আন-ভিত্তিক সুশিক্ষাকে বিলুপ্ত করা অথবা কঠোর ভাবে সংকুচিত করা। এবং সে দুচীন ও আলবানিয়ার মত কম্যুনিস্ট শাসিত দেশগুলিতে কুর’আন-হাদীসের জ্ঞানদানকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং বহু হাজার মসজিদ-মাদ্রাসাকে ঘোড়ার আস্তাবল বানানো হয়।  কুশিক্ষার দেশে তাই যুদ্ধাস্ত্র, কৃষি, শিল্প ও বিজ্ঞানে উন্নয়ন হলেও সে দেশগুলিতে কঠিন হয়ে পড়ে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত পথে বাঁচা। সমগ্র রাষ্ট্রীয় শক্তি ও তার বিশাল অবকাঠামো তখন ব্যবহৃত হয় মিথ্যার প্রসার বাড়াতে ও সত্যের নির্মূলে। এবং মিথ্যা যখন প্রবল ভাবে বিজয়ী হয়, তখন ফিরাউনের ন্যায় দুর্বৃত্তগণও ভগবান রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। গণহত্যার নায়কদেরও তখন দেশবাসীর নেতা, পিতা ও বন্ধু রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়। পরিকল্পিত শিক্ষা নীতির মাধ্যমে মানুষ তখন পোষমানা জীবে পরিণত করার চেষ্টা হয়। 

দেশ মিথ্যাসেবীদের দখলে গেলে সমগ্র রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো তখন জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার বাহনে পরিণত হয়। সেটি রাষ্ট্র-পরিচালিত রাজনীতি, শিক্ষানীতি, প্রশাসন, মিডিয়া ও সংস্কৃতির মাধ্যমে। মানবের জন্য সে ভয়ংকর নাশকতাটি হিংস্র পশু, মহামারি, সুনামী বা ভূমিকম্পের ন্যায় দুর্যোগগুলির দ্বারা হয় না। এ জন্যই  ইসলামে শ্রেষ্ঠতম কাজটি হিংস্র পশু হত্যা নয়। মশামাছি নির্মূলও নয়। সেটি হলো রাষ্ট্রের বুক থেকে ইসলামের শত্রুশক্তির নির্মূল। নইলে অসম্ভব হয় সভ্য সমাজের নির্মাণ।নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের আমৃত্যু জিহাদ ছিল তাদের নির্মূলে। “আমিরু বিল মারুফ তথা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও নেহী আনিল মুনকার তথা দুর্বৃত্তির নির্মূল” এ জন্যই মুসলিম জীবনের মূল মিশন। সে মিশনটি মুসলিম জীবনে প্রতিষ্ঠা না পেলে কুর’আনী জ্ঞানের শিক্ষালাভ, প্রকৃত ইসলাম নিয়ে বেড়ে উঠা, সিরাতাল মুস্তাকীমে জীবন পরিচালনা এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ অসম্ভব হয়। মুসলিমগণ তখন ব্যর্থ হয় ইসলামী সভ্যতার নির্মাণে –যেমনটি আজ হচ্ছে। শিক্ষার মূল কাজ, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও দুর্বৃত্তির নির্মূলের মিশনকে বিজয়ী করার কাজে সৈনিক গড়ে তোলা। নবীজী (সা:)’র আমলে তো সেটিই হয়েছিল। কিন্তু যে শিক্ষাব্যবস্থা সে কাজটি করে না -সেটিই কুশিক্ষা। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে কুশিক্ষা প্রবল হওয়ার কারণেই সৈনিক মিলছে না দুর্বৃত্ত নির্মূলের মিশনে।

 ইসলামের বিপক্ষ শক্তির নির্মূলের কাজটি না হলে রাষ্ট্র জুড়ে যা বিজয়ী হয় তা হলো শয়তানী শক্তির এজেন্ডা। তাতে বিলুপ্ত হয় মহান আল্লাহর দেয়া শরিয়তী বিধান এবং নিষিদ্ধ হয় পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান বিতরণ। কোন ঈমানদার ব্যক্তি কি শয়তানী শক্তির এমন অধিকৃতির মুখে নীরব বা নিরপক্ষ থাকতে পারে? মানব সভ্যতার অতি গুরুত্বপূর্ণ কর্ম হলো এরূপ অধিকৃতি থেকে মুক্তি লাভের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ যেমন বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে তেমনি সশস্ত্র রণাঙ্গণে। এ জিহাদে নিহত হলে শহীদ রূপে সরাসরি প্রবেশ ঘটে জান্নাতে। কবরের আযাব, পুলসিরাত ও রোজ হাশরের কঠিন দুর্যোগ থেকে এমন শহীদদের জীবন হবে মুক্ত। এরূপ বিশাল পুরস্কার অন্য কোন নেক কর্মে নেই। অপরদিকে ইসলামের বিপক্ষ শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ ও তাদের সাথে সহযোগিতার শাস্তিটিও ভয়ানক। এবং সে শাস্তিটি অনন্ত কালের জন্য। সে আযাবের শুরুটি দুনিয়ার জীবন থেকেই। মুসলিম উম্মাহ বস্তুত আজ সে আযাবেরই গ্রাসে।

 

 বাঙালি মুসলিম জীবনে কুশিক্ষা

 বাঙালি মুসলিমের জীবনে আজ যেরূপ শরিয়তের বিলুপ্তি ও ইসলামের বিপক্ষ শক্তির জয়জয়াকার –সেটিও হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি। এটি হলো ১৭৫৭ সালে কাফির ইংরেজ শক্তির হাতে অধিকৃত ও গোলাম হওয়ারই ধারাবাহিকতা। পাপ এখন এক স্থায়ী আযাবে রূপ নিয়েছে। বাংলার মাটিতে মুসলিমদের বর্তমান দুর্দশা ও ইসলামের পরাজয়ের মূল কারণ, বাঙালি মুসলিমের দায়িত্ব পালনে প্রচণ্ড ব্যর্থতা। তাদের জীবনে চরম গাদ্দারীর অপরাধটি ঘটেছে মহান আল্লাহতায়ালার কুর’আনী নির্দেশের সাথে। মুসলিম জীবনে অনিবার্য দায়ভার হলো, কাফির  শক্তির আগ্রাসনের মুখে নিজ দেশকে প্রতিরক্ষা দেয়া। এ কাজটি প্রতিটি ঈমানদারের উপর ফরজ। এ ফরজটি পালিত না হলে অসম্ভব হয় প্রকৃত ইসলাম-পালন ও প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। দখলদার কাফির শক্তি মুসলিম ভূমিতে নামাজ-রোজা নিষিদ্ধ না করলেও বিলুপ্ত করে কুর’আনের জ্ঞান-চর্চা। বিদ্যাশিক্ষার নামে তারা চালু করে কুশিক্ষা এবং ইসলামী জ্ঞানের শিকড় কাটার প্রকল্প। এভাবে তারা অসম্ভব করে ঈমানে পুষ্টিলাভ ও ইসলাম নিয়ে বেড়ে উঠা। অধিকৃত দেশের পরাধীন মুসলিমগণ তখন কি অন্য মুসলিমের কল্যাণে কোন ভূমিকা রাখতে পারে? তারা ব্যর্থ হয় এমন কি নিজেদের পার্থিব ও পরকালীন কল্যাণে অবদান রাখতে। এজন্যই নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের পাশাপাশি ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ফরজ ইবাদতটি হলো: দুশমনের হামলার মুখে মুসলিম ভূমিকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরক্ষা দেয়া। নবীজী (সা:)’র হাদীস: দেশের সীমান্তে এক মুহুর্তের পাহারাদারীর সওয়াব সারা রাত নফল ইবাদতের চেয়ে অধিক।

 তাই ঈমানদারকে শুধু নামাজী হলে চলে না, আমৃত্যু মুজাহিদও হতে হয়। নইলে মুসলিম দেশের স্বাধীনতা যেমন বাঁচে না, তেমনি বাঁচেনা মুসলিম সন্তানদের ঈমান। পবিত্র কুর’আনের ঘোষণা, “তোমরা সর্বশক্তি দিয়ে প্রস্তুত হও তাদের (দুশমনদের) বিরুদ্ধে। এবং (যুদ্ধের জন্য)  ঘোড়ার লাগামকে শক্তভাবে বাঁধো। এবং ভীত-সন্ত্রস্ত করো তোমাদের এবং আল্লাহর দুশমনদের।”- (সুরা আনফাল, আয়াত ৬০)। তাই দুশমনদের সৃষ্ট সন্ত্রাসে সন্ত্রস্ত হওয়া ঈমানদারের কাজ নয়। বরং ঈমানদার সন্ত্রস্ত রাখে ইসলামের দুশমনদের। এমন এক চেতনার কারণেই নবীজী (সা:)’র এমন কোন  সাহাবী ছিলেন না যার জীবনে জিহাদের প্রস্তুতি ছিল না। দুশমনের পক্ষ থেকে যখনই হামলা হয়েছে, সাথে সাথে তারা রণাঙ্গনে হাজির হয়েছেন। শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবী শহীদও হয়েছেন। কোন ভীরুতা বা কাপুষতা তাদের মাঝে দেখা দেয়নি। অথচ সে সময় মুসলিমদের সংখ্যা বাংলাদেশের একটি জেলার সমানও ছিল না। বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিমদের উত্থানের মূলে ছিল তাদের সে জিহাদী চেতনা ও কুর’বানী। সেদিন ঈমানদারদের জান ও মালের কুর’বানী মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সাহায্য নামিয়ে এনেছিল। তেমনি এক প্রস্তুতি ও কুর’বানীর কারণে সংখ্যায় ক্ষুদ্র হয়েও আফগান মুসলিমগণ ব্রিটিশদের দুই বার পরাজিত করেছে। ব্রিটিশদের তখন ছিল বিশ্বশক্তির মর্যাদা। বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পরাজিত করেছে আরেক বিশ্বশক্তি সোভিয়েত রাশিয়াকে। এবং সম্প্রতি ২০২১ সালের আগস্টে পরাজিত করলো মার্কিনী যুক্তরাষ্ট্রকে। আফগানদের এরূপ বার বার বিজয়ের পিছনে সে দেশের সরকার ও সরকারি সেনাবাহিনী ছিল না, বরং পুরা কৃতিত্বটি সেদেশের মুসলিম জনগণের।

 

 কুশিক্ষা ও অর্জিত আযাব

 শিক্ষাঙ্গণের ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা একত্রে চলে। শিক্ষাঙ্গণে ব্যর্থতা শুরু হলে রাজনৈতিক ব্যর্থতা তখন অনিবার্য হয়ে উঠে। তখন শুরু হয় পরাজয় এবং শুরু হয় দেশী-বিদেশী শত্রুর অধিকৃতি। এরই প্রমাণ বাংলাদেশ। সকল প্রকার অজ্ঞতা তথা জাহিলিয়াতের জন্ম কুশিক্ষা থেকে। এবং জাহিলিয়াত থেকে জন্ম নেয় পথভ্রষ্টতা। পথভ্রষ্টদের উপর প্রতিশ্রুত আযাব শুধু পরকালেই আসে  না; আসে এ পার্থিব জীবনেও। আযাব আসে যেমন ঘুর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, সুনামী, মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও প্লাবনের বেশে, তেমনি আসে দুশমন শক্তির হাতে অধিকৃতি, পরাধীনতা, বোমা বর্ষন, গণহত্যা, ধ্বংস ও নানা রূপ নির্যাতনের বেশে। সেরূপ আযাব অতীতে যেমন বার বার এসেছে, তেমনি এখনো আসছে। সেরূপ আযাব আজকের মুসলিমদের চারি দিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে। আযাবের ন্যায় পথভ্রষ্টতার আলামতগুলিও অদৃশ্য বা বায়বীয় কিছু নয়, খালি চোখেও সেগুলি দেখা যায়। সে পথভ্রষ্টতা হলো মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, শরিয়ত, শুরা, হুদুদ, খেলাফত ও কুর’আনী জ্ঞান ছাড়াই জীবন কাটানো এবং ইসলামী রাষ্ট্র না গড়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করা। বিস্ময়ের বিষয় হলো, এরূপ ভ্রষ্টতা নিয়েও তারা নিজেদের মুসলিম মনে করে!

তবে আযাবকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলাটাই ইসলামী চেতনাশূন্য সেক্যুলারিস্টদের রীতি। এটিও কুশিক্ষার ফসল। তাদের সেক্যুলার দর্শনে আল্লাহর আযাব বলে কিছু নাই। বস্তুত আযাবকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলার অর্থ: মহান আল্লাহতায়ালার অসীম কুদরতকে অস্বীকার করা। মহান আল্লাহতায়ালার অনুমতি ছাড়া গাছের একটা পাতাও যেখানে পড়ে না, সেখানে দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, মহামারি ও ঘুর্ণিঝড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় কি করে? এগুলিকে কি আল্লাহতায়ালার রহমত বলা যায়? প্রকৃতির নিজস্ব কোন সামর্থ্য নাই। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানই তো মহান আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি। এবং একমাত্র তাঁরই আজ্ঞাবহ। ফলে, সেগুলি যা কিছু করে তা করে স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করতে। তাই ব্যক্তির ঈমানদারী শুধু মহান আল্লাহতায়ালার উপর বিশ্বাস নয়, বরং তাঁর প্রতিটি আযাবকে আযাব রূপে দেখাতেও। একমাত্র তখনই একজন ব্যক্তি সে আযাব থেকে শিক্ষা নিতে পারে।

 

 উপেক্ষিত ইতিহাস পাঠ

 প্রতিটি রোগ-ভোগই বিবেকবান অসুস্থ মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। অথচ সে ভাবনাটি মৃত ও মৃতপ্রায় মানুষের থাকে না। তেমনি আযাবের ঘটনাও ভাবিয়ে তোলে প্রতিটি সুস্থ চেতনার মানুষকে। মানুষ সে সুস্থ ভাবনা ও চেতনা পায় সুশিক্ষা থেকে। সে ভাবনাটি না থাকাই বরং চেতনার প্রচণ্ড অসুস্থততা। এ প্রেক্ষাপটে বাঙালি মুসলিমদের নিয়ে ভাবনার বিষয় যেমন অনেক; তেমনি শিক্ষার বিষয়ও অনেক। তাদের মূল ব্যর্থতাটি প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। এবং সে ব্যর্থতা তাদের জীবনে হঠাৎ করে আসেনি। তারও একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। তাই বর্তমানের এ আযাবকে বুঝতে হলে অতীতের সে প্রক্ষাপটকে অবশ্যই বুঝতে হবে। কারণ, অতীতের মাঝেই তো বর্তমানের বীজ। রোগী মারা গেলে কেন মারা গেলে -সেটি বুঝতে পোষ্টমর্টেম করতে হয়। রোগের প্যাথলজি জানতে হয়। নইলে আগামীতে অন্যদের সে রোগ থেকে বাঁচানো অসম্ভব হয়। তেমন জাতি পরাজিত হলে কেন পরাজিত হলো -সেটি জানতে সে ঘটনার পোষ্টমর্টেম করতে হয়। নইলে ভবিষ্যতে সেরূপ পরাজয় মোকাবেলার সামর্থ্য সৃষ্টি হয় না। ইতিহাস হলো সেই পোষ্টমর্টেমের বই। তাই যাদের জীবনে সে ইতিহাসে পাঠ নাই, তারা ব্যর্থ হয় চলমান ব্যর্থতা ও বিপর্যয়ের কারণ বুঝতে। এবং ব্যর্থ হয় আযাব থেকে বেরুনোর পথ খুঁজে পেতে। ইতিহাস পাঠের গুরত্ব ইসলামে এজন্যই এতো অধিক। কিন্তু বাংলাদেশে সেরূপ ইতিহাস পড়ানো হয় না। এমনকি পবিত্র কুর’আনেও অতীত ইতিহাসের বহু শিক্ষনীয় ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছে। নমরুদ-ফিরাউনদের ফ্যাসিবাদী নৃশংসতার ইতিহাস ও তার পরিণতি এবং মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম ও শরিয়তী বিধানের সাথে বনি ইসরাইলীদের গাদ্দারীর ইতিহাস তাই ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়নি।

 মানব জীবনে দুর্যোগ আসে মূলত দুটি কারণে। প্রথম কারণ: এটি আসে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে পরিকল্পিত পরীক্ষার অংশ রূপে। আল্লাহতায়ালা যাদের পুরস্কার দেন, তাদের থেকে পরীক্ষাও নেন। সেরূপ পরীক্ষা নেয়াই তাঁর সূন্নত। পুরস্কার তো তারাই পায় -যারা সে সব পরীক্ষায় পাশ করে। সে পরীক্ষার অংশ রূপেই জীবনের প্রতি মোড়ে শয়তান খাড়া হয় প্রলোভনের ফাঁদ নিয়ে। সে ফাঁদ থেকে বাঁচাও এক পরীক্ষা। জান্নাত প্রাপ্তির জন্য এরূপ পরীক্ষাগুলিতে কৃতকার্য হওয়াটি পূর্ব শর্ত। দ্বিতীয় কারণ: দুর্যোগ আসে আযাব রূপে। সেটি পূর্বের পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার আযাব রূপে। এমন কি নবী-রাসূলদের জীবনেও এমন পরীক্ষা বার বার এসেছে। বাঙালি মুসলিমের জীবনে তেমনি একটি পরীক্ষা এবং সে পরীক্ষায় ভয়ানক ব্যর্থতা এসেছিল ১৭৫৭ সালে। সেদিন কাফির হানদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সে দায়িত্বটি আদৌ পালিত হয়নি। সে সময় সবচেয়ে বড় অপরাধটি ঘটে হানাদার ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরজ জিহাদে বাঙালি মুসলিমদের অংশ না নেয়ায়। সেটি যেমন রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে, তেমন জনগণের স্তর থেকে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বড় ব্যর্থতা হলো, জীবনের লাগাতর পরীক্ষাগুলি নিয়ে যেমন ভাবতে শেখায় না, তেমনি সেসব পরীক্ষায় পাশ করতেও শেখায় না।

 

 শত্রুশক্তির অধিকৃতির আযাব

 ইংরেজদের হামলার বিরুদ্ধে দেশ বাঁচানোর দায়িত্বটি স্রেফ নবাব সিরাজুদ্দৌলার একার ছিল না, সে দায়িত্বটি ছিল বাংলার প্রতিটি নাগরিকের। তাই পলাশীর যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধটি শুধু মীর জাফরের একার নয়। বাংলার জনগণ সেদিন জিহাদ সংগঠিত না করে পরিচয় দিয়েছে প্রচণ্ড ভীরুতা, কাপুরুষতা ও দায়িত্বহীনতার। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে রহমত লাভেরও পূর্ব শর্ত আছে। তাঁর ফেরেশতা বাহিনী ও রহমত একমাত্র তখনই নেমে আসে যখন মুসলিমগণ তার পথে জিহাদে নামে। নইলে আসে আযাব। জিহাদের সাথে গাদ্দারী হলো অথচ মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুত আযাব এলো না –সেটি অস্বাভাবিক। বস্তুত বাংলার বুকে সে আযাবটি এসেছিল প্রচণ্ড ভয়াবহতা নিয়েই। সে আযাব যেমন ১৯০ বছরের নৃশংস গোলামী দিয়েছিল, তেমনি দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ, নির্যাতন এবং প্রাণহানি। মুসলিম জীবনে আযব তো এভাবেই নির্মম ভাবে আসে। এখনো চলছে সে আযাবের ধারাবাহিকতা। অথচ ১৭৫৭ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা আফগানিস্তানের চেয়ে কয়েকগুণ অধিক ছিল। তখন দেশে হাজার হাজার আলেম-উলামাও ছিল। ৪০ হাজারের বেশী মাদ্রাসা ছিল। সেদিনের বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছিল মুসলিমদের আল্লাহর সাহায্যকারী রূপে গড়ে তুলতে। ফলে তারা ইতিহাস গড়েছিল ইসলামের জিহাদী বিধানের সাথে গাদ্দারীতে। এবং আজ সেটিই হচ্ছে।

বাঙালি মুসলিমগণ ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে পবিত্র জিহাদ করা থেকে নিজেদের বাঁচালেও দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচেনি। এক-তৃতীয়াংশ বাঙালি ( প্রায় এক কোটি) মারা গেছে ব্রিটিশদের শোষণে সৃষ্ট ১৭৬৯ সাল থেকে ১৭৭৩ সাল অবধি চলমান দুর্ভিক্ষে। বাংলার সমগ্র ইতিহাসে এতবড় বিশাল আকারের প্রাণনাশ কোনকালেই ঘটেনি। অথচ ব্রিটিশের হাতে অধিকৃত হওয়ার আগে বাংলাই ছিল সমগ্র এশিয়ার মাঝে সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ। খাদ্যে ছিল স্বয়ংসম্পন্ন।  বস্ত্র শিল্প উৎপাদনে ছিল বিশ্বে সেরা। বাংলার বস্ত্র বিশেষ করে মসলিন ও মখমল ছিল বিশ্ব বিখ্যাত। সে বস্ত্র সম্পদ উসমানিয়া খেলাফত, মিশর, ইউরোপ এবং চীনসহ বিশ্বের নানা দেশে যেত। সরকারের ভাণ্ডার ছিল সোনা-রূপায় পরিপূর্ণ। ১৭০০ খৃষ্টাব্দে ভারত বিশ্বের জিডিপির শতকরা ২৫ ভাগ অংশীদার ছিল। এবং তাতে একমাত্র বাংলাই যোগ করতো বিশ্বের জিডিপির ১২ ভাগ। ইতিহাসবিদদের মতে বাংলার উপর বিজয়ের সাথে সাথে সে গচ্ছিত সম্পদ ইংল্যান্ডে নিতে ২০০টির বেশী জাহাজ বাংলার তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে লন্ডন মুখি রওনা দেয়। সে লুন্ঠনের ফলে লর্ড ক্লাইভের মত ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্ণধারগণ রাতারাতি বিশ্বের ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়।

ডাকাতদের লুন্ঠনে দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ আসবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। তবে পার্থক্য হলো ডাকাতগণ মানুষের ঈমানে হাত দেয় না, জ্ঞানচর্চায়ও ব্যাঘাত ঘটায় না। অথচ কাফির শক্তির হাতে দেশ অধিকৃত হলে শুধু দেশের সম্পদই লুন্ঠিত হয় না, সবচেয়ে ভয়ানক ক্ষতিটি হয় জনগণের ঈমানের ভূবনে। ইংরেজ শাসকদের হাতে সে নাশকতাটি অতি নৃশংস ভাবেই ঘটেছে। রাজস্বভাণ্ডার ও জনগণের অর্থভান্ডার শূন্য করার পাশাপাশি প্রচণ্ড নাশকতা ঘটিয়েছে ইসলামী জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে। ৪০ হাজারের বেশী মাদ্রাসার জন্য মুসলিম শাসকদের বরাদ্দকৃত খাজনামুক্ত জমি বাজেয়াপ্ত করে সে মাদ্রাসাগুলির মৃত্যু ঘটায়। ফলে মুসলিম জনগণ দূরে সরতে থাকে কুর’আন-হাদীসের জ্ঞান থেকে। বাংলার মুসলিম জীবনে ইসলাম থেকে আজ যে বিশাল বিচ্যুতি এবং সর্বত্র যে দুর্বৃত্তি তার মূলে হলো ১৯০ বছরের কাফির শক্তির অধিকৃতি। দেশের শাসন ক্ষমতা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সেক্যুলারিস্ট খলিফাদের দখলে থাকায় শিক্ষাঙ্গণে সে নাশকতা আজও অব্যাহত রয়েছে। সে নাশকতার ফলে বাংলার বুকে যে ইসলাম বেঁচে আছে সেটি নবীজী (সা:)’র ইসলাম নয়। বেঁচে থাকা এই ইসলামে যেমন পবিত্র কুর’আনে নির্দেশিত শরিয়ত, হুদুদ, ইসলাম, শুরা, খিলাফত নাই, তেমনি নাই জিহাদের কোন ধারণা। এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে ইসলামে থেকে দূরে সরাতে মুসলিম সন্তানকে মন্দিরে বা গির্জায় নেয়ার প্রয়োজন হয়না।

কুর’আনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রকল্প নিয়েই লর্ড মেকলে ভারতে শিক্ষার নামে কুশিক্ষার নীতি প্রণয়ন করেন। ইসলামের প্রতিপক্ষ রূপে আজ যারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দখল জমিয়েছে -তারা তো সে শিক্ষা ব্যবস্থারই ফসল। ইসলাম থেকে দূরে সরা এসব কুশিক্ষিত বাঙালিদের প্রতারণাটিও জঘন্য। নিজেদের ইসলাম বিরোধী অভিসন্ধি ঢাকতে নিজেদেরকে তারা মুসলিম রূপে পরিচয় দেয়। অথচ রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে তাদের মূল যুদ্ধটি ইসলামের বিরুদ্ধে। ইসলামকে পরাজিত রাখার মাঝেই তাদের আনন্দ। এদের কারণেই ইসলামের বিজয় ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা রুখতে বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে বিদেশী কাফিরদের সশরীরে নামতে হচ্ছে না। বরং সে কাজে তারা নিজেরাই যথেষ্ট পারঙ্গমতার পরিচয় দিচ্ছে। ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে নৃশংস ও আপোষহীন নীতির কারণে তারা সমাদৃত হচ্ছে ইসলামবিরোধী আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনের বিশ্বস্ত পার্টনার রূপে। ১ম সংস্করণ ০৫/০২/২০১৮; ২য় সংস্করণ ২৮/০১/২০২২; ৩য় সংস্করণ ২৪/০৭/২০২২।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *