যাকাতের বিধান ও ব্যর্থ মুসলিম

ফিরোজ মাহবুব কামাল

সভ্য সমাজের নির্মাণ ও যাকাত                                                                 

মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব-সৃষ্টিকে যেমন নিয়ামত ভরা জান্নাতের যোগ্য করে গড়ে তুলতে চান না, তেমনি চান পৃথিবী পৃষ্ঠেও নির্মিত হোক সমৃদ্ধ, দারিদ্র্যমুক্ত ও শান্তিময় সভ্য সভ্যতা। মহান আল্লাহতায়ালা তাই শুধু পরিশুদ্ধ চেতনার তাকওয়াসমৃদ্ধ মানব গড়ার বিধানই দেননি, দিয়েছেন শান্তিময় সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের সংবিধানও। সে সংবিধানটি হলো পবিত্র কুর’আন। মানব জাতির জন্যই এটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। ইসলামের গৌরবকালে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মিত হয়েছিল সে সংবিধানের উপর ভিত্তি করেই। এরূপ পরিশুদ্ধ মানব ও সভ্য সভ্যতা এর পূর্বে কোন কালেই নির্মিত হয়নি। যে ৫টি খুঁটির উপর ইসলাম তার কাঙ্খিত ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চায় তা হলো ঈমান, নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত। নামাযের বিধান আসে হিযরতের এক বছর পূর্বে মিরাজের পরই। রোযা, হজ্জ ও যাকাতের বিধান আসে মদিনায় হিজরতের কিছুকাল পরই। আসে জান ও মাল নিয়ে জিহাদের নির্দেশও। লক্ষণীয় হলো, যাকাতের বিধানটি যখন আসে তখন মুসলিমদের হাতে ছিল মদিনাভিত্তিক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্রে তখন রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে আসীন ছিলেন খোদ মহান নবীজী (সা:)। ফলে পরিশুদ্ধ মানব গড়া ও যাকাতের বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিমগণ সহায়ক শক্তি রূপে পায় একটি রাষ্ট্র ও বিশাল একটি রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। প্রশ্ন হলো, ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত না হলে কি আদৌ সেটি সম্ভব হতো? ইসলামী রাষ্ট্রের সে অবকাঠামোর উপরই পরবর্তীতে নির্মিত হয় মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। মুসলিমগণ বেড়ে উঠে সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তি রূপে। এ থেকেই প্রমাণিত হয় ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের গুরুত্ব কত অধিক।  

কোন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের মূল কারিগর হলো মানব। ভাল ইট না হলে যেমন ভাল ইমারত গড়া যায়না, তেমনি ভাল মানুষ না হলে ভাল সমাজ ও রাষ্ট্র গড়া যায় না। সভ্য মানবেরাই সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। অসভ্য ও দুর্বৃত্ত মানুষেরা গড়ে তোলে অসভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র। তাই ইসলামে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো পরিশুদ্ধ মানব গড়া। সে লক্ষ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো চেতনার ভূমিতে কুর’আনী জ্ঞানের আবাদ। কারণ জ্ঞানই বিপ্লব আনে ব্যক্তির আমলে, চরিত্রে ও আচরণে। মক্কার ১৩ বছর ধরে চলে জ্ঞানবান মানব গড়ার কাজ। তবে সে কাজটি স্রেফ জ্ঞানার্জনে সমাধা হয় না। সে পরিশুদ্ধি করণের কাজটি সফল ভাবে করার জন্যই মহান আল্লাহতায়ালার বিধান হলো নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জ। ওযু-গোছল পবিত্র করে ব্যক্তির দেহকে, নামায-রোযা-হজ্জ পবিত্র করে আত্মাকে এবং যাকাত পবিত্রতা আনে ব্যক্তির ধন-সম্পদে ও বাঁচবার আয়োজনে। এরূপ পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধির ফলে মানুষ বেড়ে উঠে মহান আল্লাহতায়ালার মাগফিরাত লাভের যোগ্য রূপে। এমন পরিশুদ্ধ মানব দিয়েই নির্মিত হয় সভ্য সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতা।    

মানব ইতিহাসে ধর্মের সংখ্যা অনেক। সেসব ধর্মে উপাসনার লক্ষ্যে গুরুত্ব পেয়েছে মু্র্তিগড়া, মন্দির গড়া ও নানারূপ পূজাপার্বন। একমাত্র ইসলাম ছাড়া সেসব ধর্মে দুস্থ্য ও দরিদ্র মানুষের দুঃখ লাঘবের বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। হিন্দু ধর্মে তো দরিদ্রদের আমৃত্যু দরিদ্র ও বঞ্চিত রাখার স্বার্থে তাদেরকে অস্পৃশ্য রাখাই ধর্মীয় রীতি। সেটিকে ধর্মীয় ভাবে বৈধ ও পাকাপোক্ত করা হয়েছে বর্ণভেদের মাধ্যমে। এ দলিতদের দুঃখ লাঘবে হিন্দু ধর্মে কোন অর্থনৈতিক বা সামাজিক বিধান নাই্। ফলে নিজেদের সম্পদের অংশ থেকে দরিদ্রদের কিছু দিতে হিন্দুগণ ধর্মীয় ভাবে বাধ্য নয়। তেমনি একটি অবস্থা খৃষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের মাঝেও। ফলে এসব অমুসলিম সমাজে দেখা দিয়েছে ধনি ও দরিদ্রের গভীর বিভাজন। সেসব দেশে এক দিকে যেমন গড়ে উঠেছে সম্পদশালী অভিজাত শ্রেণী, অপরদিকে গড়ে উঠেছে সম্পদহীন, অধিকারহীন ও মর্যাদাহীন দরিদ্র শ্রেণী। এসব সমাজে ও ধর্মে গরীব মানুষের দারিদ্র্য মোচনের কোন বিধানই ছিলনা। ফলে দরিদ্র পরিবারে যাদের জন্ম হতো তাদেরকে আমৃত্যু দরিদ্রই থাকতে হতো; এবং তারা পরিণত হতো মর্যাদাহীন, সম্পদহীন ও অধিকারহীন দাসে। বহু দেশে গবাদী পশুর ন্যায় কেনাবেচার জন্য পণ্য রূপে এদেরকে হাটে তোলা হতো। ইসলাম তাদেরকে এ দুর্দশা থেকে মুক্তি দেয়।

প্রতিটি সমাজেই অতি স্বাভাবিক যে, জন্মের পরই কিছু শিশু পিতা-মাতাকে হারায়। কত মানুষই তো জন্ম নেয় মানসিক বা শারীরিক পঙ্গুত্ব নিয়ে। কেউবা নানা রোগভোগে কাজকর্মের সামার্থ্য হারায়। কত মহিলাই তো বিবাহের পরই তার স্বামীকে হারায়। কত ঘরবাড়িই তো আগুনে পুড়ে যায়। কত পরিবারই তো প্লাবন, ঘুর্ণিঝড়, ভূমিকম্প ও নদিভাঙ্গণের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়। কে বহন করবে তাদের ঘর বাঁধার ও বেঁচে থাকার খরচ? যে কোন রাষ্ট্র ও সমাজেই এটি এক গুরুতর সমস্যা। সাম্প্রতিক কালে পাশ্চাত্য দেশে আইন করে দরিদ্র পরিবারের ভরণপোষণের দায়ভার রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। কিন্তু ইসলাম এ সমস্যার সমাধান করেছে ১৪ শত আগেই। সেটি যাকাত-সাদকা-ফিতরার মধ্য দিয়ে। কারণ, সমাজের এ গুরুতর সমস্যার বিষয়টি মহা দয়াময় মহান আল্লাহতায়ালার দৃষ্টির অগোচরে নয়। তিনি চান, তাঁর দুস্থ্য, বিকলাঙ্গ ও দরিদ্র বান্দারা বাঁচার তাগিদে যেন রাস্তায় ভিক্ষায় না নামে। তিনি চান, তাদের যেন সইতে না হয় অপমানিত জীবনের গ্লানি। দরিদ্র মানুষেরা ধনির দোয়ারে এসে ভিক্ষা চাইবে -মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর এ গরিব বান্দাদের অপমান দেখতে চান না।

ইসলাম যে সত্যই মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত ধর্ম -সেটি সুস্পষ্ট বুঝা যায় যাকাতের বিধানটি দেখে। ধনির সম্পদের উপর তিনি দরিদ্র মানুষের বৈধ অধিকার বরাদ্দ করে দিয়েছেন। ধনির উপর বাধ্যতামূলক করেছেন সে যেন তার আত্মীয়স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীর মাঝে কারা দরিদ্র তাদেরকে নিজ গরজে খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের ঘরে যাকাত-সাদাকার অর্থ পৌঁছে দেয়। ঈমানদারের নামাযের সাথে যাকাতকেও একসাথে বেঁধে দিয়েছেন। যার মাঝে নামায আছে অথচ যাকাত নাই –বুঝতে হবে তার ঈমানই নাই্। সে বস্তুত জাহান্নামের যাত্রী।

এ পার্থিব জীবনে মহান আল্লাহতায়ালা কাউকে দরিদ্র করে পরীক্ষা করেন। অনেককে পরীক্ষা করেন সম্পদ দিয়ে। কাউকে সুস্থ্যতা দেন। কাউকে দেন পঙ্গত্ব বা মানসিক বিকলাঙ্গতা। এরূপ দুস্থ্য, পঙ্গু ও অক্ষম মানবগণ আসে সমাজের ধনি ও সুস্থ্যদের ঈমানের পরীক্ষা নিতে। অক্ষম ব্যক্তিকে পরীক্ষায় পাশ করতে হয় সে দুস্থ্য অবস্থায় ছবর ধারণ করে। এবং ধনি ব্যক্তিদেরকে সে পরীক্ষায় পাশ করতে তাঁর সম্পদ থেকে দরিদ্র, অক্ষম ও অসুস্থ্য ব্যক্তির প্রাপ্য অংশকে নিজ উদ্যোগে তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে। এ পরীক্ষায় পাশ না করলে সে আর মুসলিমই থাকে না। 

 

যাকাতের প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র

মহান আল্লাহতায়ালা নবীজী (সা:)কে শুধু নামায-রোযা-হজ্জের ন্যায় ইবাদতের হুকুমই দেয়া হয়নি, বরং হুকুম দেয়া হয়েছে যাকাত-সাদকারও। বলা হয়েছে, “(হে নবী) আপনি (যারা সামর্থ্যবান) তাদের ধনসম্পদ থেকে সাদাকা (যাকাত) গ্রহণ করুন। আপনি তা দিয়ে তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন (তাদের চরিত্র ও সম্পদ)কে।–(সুরা তাওবা, আয়াত ১০৩)। নবীজী (সা:) তখন ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁর উপর হুকুমটি এসেছে যাকাতের বিধানকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা দেয়ার তাগিদ দিয়ে। তাই মুসলিমগণ রাষ্ট্র গড়বে শুধু রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ও কল-কারখানা গড়ার জন্য নয়। বরং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি হলো যাকাতের নিযামকে পূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া। রাষ্ট্রের আরো দায়িত্ব হলো, প্রতিটি দুস্থ্য মানুষের খবর নেয়া এবং তাদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে যাকাতের অর্থ পৌঁছে দেয়া। দুস্থ্য মানুষদের ভিখারীর বেশে পথে নামানোর অর্থ তাদেরকে অপমানিত করা। এ অপমান সমগ্র দেশবাসীর। এতে সন্মানহানী হয় ইসলামেরও।  দুস্থ্য ও দরিদ্র মানুষের জীবন রক্ষায় এবং সে সাথে তাদের ইজ্জত-আবরু রক্ষায় প্রতিটি মুসলিম শাসকই হলো মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা। একজন মানব সন্তানও যদি দারিদ্র্যের কারণে কষ্ট পায় বা প্রাণ হারায় -তবে সেটি এক নির্মম হত্যাকান্ড। সে অপরাধ মূলত সরকারের। এবং অপরাধটি এখানে গরীবের হক তার ঘরে পৌঁছিয়ে না দেয়ার।

সরকার শুধু দেশের জমিজমা, স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, বনজ সম্পদ ও খনিজ সম্পদের পরিসংখ্যানই রাখবে না, বরং নিখুঁত পরিসংখ্যান রাখবে তাদেরও যারা যাকাত প্রদানে সক্ষম। এবং অবশ্যই সঠিক পরিসংখ্যান রাখবে তাদেরও যারা যাকাতের হকদার। যাকাতের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা যাকাত দেয় না, সরকারের দায়িত্ব হলো তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। যেমনটি করেছিলেন হযরত আবু বকর (রা:) তার খেলাফত কালে। এরূপ যুদ্ধ না করলে অধিকার বঞ্চিত হয় দেশের গরীব জনগণ। জনগণের অভিভাবক রূপে সরকারের দায়িত্ব হলো ধনিদের থেকে যাকাত সংগ্রহ করে প্রতি বছর হকদার মানুষের ঘরে পৌঁছে দেয়া। তাছাড়া যাকাত একটি ফরয বিধান; এ বিধান অমান্য করায় সে ব্যক্তি আর মুসলিম থাকে না, মুরতাদে পরিণত হয়। শরিয়তী আইনে মুরতাদের শাস্ত্রি প্রাণদন্ড। সরকারের দায়িত্ব হলো সে মুরতাদদের শাস্তি দেয়া। খলিফা হযরত আবু বকর (রা:) তাঁর খেলাফত কালে সে শাস্তি তিনি কঠোর ভাবে প্রয়োগ করেছেন। শরীরে বর্জ পদার্থের পেটে জমে থাকাটি (intestinal obstruction) একটি গুরুতর রোগ। দ্রুত আরোগ্য না ঘটালে রোগীর মৃত্যু ঘটে। তেমনি মুসলিম উম্মহর পরাজয় ও পতন অনিবার্য হয় যদি উম্মাহর দেহে মুরতাদ তথা কাফের শত্রুদের ঘাঁটি গড়তে দেয়া হয়। মুসলিম উম্মাহর দেহে সেটি শুরু হয় নবীজী (সা:)’র ইন্তেকালের পর পরই। তাদের নির্মূলেই হযরত আবু বকর (রা:) জিহাদ শুরু করতে হয়। এ শত্রুদের আবির্ভাব ঘটেছিল ভন্ড নবী ও যাকাত অস্বীকারকারীদের বেশে।      

 

যাকাত এবং পবিত্রতা, পরিশুদ্ধি ও তাকওয়া

“লিসানুল আরাবী” অভিধানে যাকাতের অর্থ বলা হয়েছে পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ও প্রশংসা। ফলে যে যাকাত দেয় তার সম্পদে কমতি হয় না বরং তাতে বৃদ্ধি ঘটে। সেটিই পবিত্র কুর’আনে প্রদত্ত মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুতি। যাকাত দেয় সম্পদে দেয় পরিশুদ্ধি ও পবিত্রতা। সুরা শামসের ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “ক্বাদ আফলাহা মান যাক্কা হা।” অর্থ: “সেই সফল হলো যে পরিশুদ্ধ করলো তার নিজেকে।” “যাক্কা” শব্দটি এখানে পরিশুদ্ধি বা পবিত্রতা বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। “যাক্কা” শব্দটি থেকে যাকাত শব্দের উৎপত্তি। একই রূপ ব্যাখা দিয়েছেন ইমাম তাইমিয়া (রহ:)। তিনি বলেছেন, “যাকাত ও সাদকা দানে দানকারীর মন ও আত্মা পবিত্র হয়। এবং বৃদ্ধি পায় তার সম্পদ। ধন-সম্পদ থেকে যে অংশকে বের করে দেয়া হয় সেটিই হলো যাকাত। এবং যে সম্পদ থেকে যায় তা পায় পবিত্রতা।”

মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে মানবের মূল্যমান ও মর্যাদা নির্ধারণ করে তাঁর তাকওয়া ও নেক আমল। পরকালে এর ভিত্তিতেই সে পুরস্কার পাবে। তাই যে ব্যক্তি তাঁর নেক আমল ও তাঁর তা্কওয়াকে বৃদ্ধি করে সেই সফল হয়। তবে প্রশ্ন হলো কি সে নেক আমল এবং কি সে তাকওয়া? নেক আমল ও তাকওয়ার সুবিন্যস্ত সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। সেটি সুরা বাকারার ১৭৭ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “নেক আমল শুধু এ নয় যে, (কিবলা রূপে) পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ করবে; বরং প্রকৃত নেক কর্ম হলো এই যে, ব্যক্তি ঈমান আনবে আল্লাহর উপর, কিয়ামত দিবসের উপর, ফিরেশতাদের উপর এবং সকল নবী-রাসূলদের উপর; এবং সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই প্রতি মহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। এবং সে সাথে যারা প্রতিষ্ঠা করে নামায, দান করে যাকাত, পালন করে কৃত ওয়াদা এবং ধৈর্য্যধারণ করে রোগে-শোকে ও যুদ্ধে। এরাই হলো সত্যাশ্রয়ী এবং এরাই হলো তাকওয়ার অধিকারী।”    

যাকাত পবিত্রতা ও সমৃদ্ধি আনে সমাজেও। কারণ, দরিদ্রতা সমাজের আর্থিক, নৈতিক ও ঈমানী অসুস্থ্যতার সিম্পটম বা প্রতীক। যাকাত সে অসুস্থ্যতা থেকে সমাজকে মুক্তি দেয়। দরিদ্র মানুষের ঘরে অর্থ প্রাপ্তি ঘটলে সে ঘরের বাসিন্দাদের বাঁচাটিই শুধু সহজ হয় না, বৃদ্ধি পায় সে অর্থে বিনিয়োগ ও উপার্জনের সামর্থ্য। পরিবারের শিশুরা পায় পুষ্টি ও শিক্ষার সুযোগ। তাছাড়া দারিদ্র্য ব্যক্তিকে পাপের পথে টানে। যাকাতের অর্থে দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা পায়, উন্নয়নের মই বেয়ে উপরে উঠার সুযোগ। এই ভাবেই অর্থনৈতিক উন্নয়নে ও সামাজিক শান্তি বৃদ্ধিতে যাকাত বিপ্লবী ভূমিকার রাখে। বাংলাদেশের মত একটি দেশে শত শত কোটি টাকা প্রতি বছর যাকাত-ফিতরা-সাদকার নামে ধনিদের পকেট থেকে দরিদ্রদের পকেটে পৌঁছে যায়। ভারতের ন্যায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে দরিদ্রের ঘরে এরূপ অর্থায়ন ঘটে না। বাংলাদেশে গরীবদের আর্থিক অবস্থা ভারতীয় দুস্থ্যদের চেয়ে যে অনেকাংশেই ভাল -তার কারণ এই যাকাত-ফিতরা-সাদকা। ভারতীয় হিন্দুগণ প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে বহু লক্ষ পূজামন্ডপে মুর্তির রূপ ও জৌলুস বাড়াতে। কয়েকদিন পর সেগুলি নদীতে ভাসিয়ে নদীর পানিও দুষিত করে। ভারতে বহু শত কোটি টাকা ব্যয় হয় দেয়ালী উৎসবের আতসবাজীতে এবং হোলীতে রং ছিটাতে। সে বিপুল অর্থব্যয়ে কারোই কোন অর্থনৈতিক কল্যাণ হয়না। ভারতে হাজার হাজার কোটিপতি; কিন্তু গরীবের ঘরে অর্থদানে হিন্দু ধর্মে কোন ধর্মীয় বাধ্য-বাধকতা নাই। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে অধিক দরিদ্র মানুষের বসবাস ভারতে।          

 

পবিত্র কুর’আনে যাকাত বিষয়ক আয়াত

যাকাত বিষয়ক আয়াতগুলো এসেছে মূলত মদিনায় নাযিলকৃত সুরাগুলোতে। তবে মক্কায় নাযিলকৃত সুরাগুলোতেও যাকাতের উল্লেখ আছে। তবে তাতে নিসাব ও কি হারে সম্পদের উপর যাকাত নির্ধারিত হবে -সে বিষয়টি মক্কী সুরায় বলা হয়নি। যেমন সুরা আনয়ামে বলা হয়েছে, “ফসল কাটার দিনই তার (দরিদ্রের) হক দিয়ে দাও।” এই আয়াতটি মক্কী। ঈমানদার হওয়ার শর্ত হলো, তাঁকে মেনে নিতে হয়, ধন-সম্পদের ন্যায় প্রতিটি নিয়ামতই মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত দান। এবং সে নিয়ামতটি যিনি দান করেন সে মহাপ্রভুর পক্ষ থেকে ঘোষণাটি হলো, সে সম্পদে রয়েছে দরিদ্র, বঞ্চিত ও ভিখারীদের হিস্যা। তাই ঈমান নিয়ে বাঁচার তাগিদে সে সম্পদ থেকে পাওনাদারের হক দেয়াটি বাধ্যতামূলক। পবিত্র কুর’আনে সেটিই ধ্বনিত হয়েছে এভাবে, “এবং তাদের সম্পদে অধিকার রয়েছে ভিখারীদের ও বঞ্চিতদের।” –(সুরা যারিয়া, আয়াত ১৯)। সমাজের বুকে বঞ্চিত তো তারাই যারা সম্পদহীন, সামর্থ্যহীন ও কর্মহীন। সুরা বনি ইসরাইলের ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “দিয়ে দাও নিকটাত্মীয়দের (তোমার সম্পদের উপর) তাদের অধিকারকে এবং দাও মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকদের। এবং অপচয়কারী হয়োনা।” তাই যারা সত্যিকার ঈমানদার তারা মেনে নেয় নিজেদের সম্পদের উপর দরিদ্রদের অধিকারও। এবং হারাম হলো, দরিদ্রদের সে প্রাপ্য অংশ নিজে ভোগ করা। তাই প্রকৃত ঈমানদারগণ কখনোই যাকাত দিতে ইতঃস্তত করেনা বরং স্বপ্রনোদিত হয়। মু’মিনের সে বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি বর্ণিত হয়েছে সুরা মু’মিনুনের ৪ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “এবং (মু’মিনগণ হলো) তারা যারা যাকাত দানে সক্রিয়।” সুরা মায়ারেজের ২০ আয়াতে বলা হয়েছে, “এবং তারাই সংকীর্ণমনা থেকে মুক্ত যারা নামাযে দৃঢ় এবং যারা নিজেদের মালের নির্দিষ্ট অংশ দেয় ভিক্ষুক ও বঞ্চিতদের।”

মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে শত্রুমুক্ত তথা মুশরিকমুক্ত করার সুস্পষ্ট ঘোষণাটটি আসে সুরা তাওবার ৫ নম্বর আয়াতে। ইসলামের সেটি ছিল শৈশব কাল। চার দিক দিয়ে সে নতুন রাষ্ট্রটি ছিল শত্রু পরিবেষ্টিত। রাষ্ট্রের ভিতরেও শত্রুর বসবাস হবে –সেটি মহান আল্লাহতায়ালার কামনা ছিল না। তাই তিনি দেন নির্মূলের হুকুম। সে সময় মুসলিমদের মূল শত্রু ছিল পৌত্তলিক মুশরিকগণ। তাদের জন্য মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ৪টি হারাম মাসের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। নির্মূল হওয়া থেকে বাঁচতে মুশরিকদের সামনে তিনটি শর্ত পেশ করা হয়। শর্ত না মানলে এবং ইসলামী রাষ্ট্র পরিত্যাগ না করার শাস্তি ছিল হত্যা। পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত সে তিনটি শর্ত হলো: ১). পৌত্তলিকতা ও সর্বপ্রকার শিরক থেকে তাওবা। সে তাওবার বিষয়টি প্রকাশ্যে জানাতে হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এই কালেমা পাঠের মধ্য দিয়ে। ২). প্রতিদিন নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামায পড়তে হবে। ৩). যাকাত দিবে হবে ধন-সম্পদ থেকে। লক্ষণীয় হলো, কালেমা পাঠ ও নামাযের সাথে যাকাতকেও শর্ত রূপে রাখা হয়। এখানেই বুঝা যায় যাকাতের গুরুত্ব কত অধিক। তবে মুশরিকদের জন্য একটি সুখবরও শোনানো হয়। উপরুক্ত তিনটি শর্ত মেনে নিলে তারা গণ্য হবে মুসলিমদের দ্বীনী ভাই রূপে। ফলে তারা সন্মান ও নিরাপত্তা পাবে অন্য মুসলিমদের ন্যায়। তাদের জন্য সে সুখবরটি এসেছে সুরা তাওবার ১১ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “অতঃপর তারা (মুশরিকগণ) যদি তাওবা করে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই।”      

মু’মিনের জীবনে যাকাত প্রদানের বিষয়টি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটির বর্ণনা এসেছে সুরা আরাফের ১৫৭ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “আমার রহমত সর্বব্যপ্ত। আমি লিপিবদ্ধ করবো যারা মুত্তাকী (তাদের নেক আমল), যারা যাকাত দেয়, যারা আমার বর্ণিত আয়াত সমূহের উপর ঈমান আনে এবং আমার উম্মি রাসূলকে অনুসরণ করে।” কারা এ জীবনে সফলকাল হবে এবং কারা আখেরাতে মহান আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্য পৌঁছবে -সেটির বর্ণনা দিতে বলা হয়েছে, “এবং তারা নিকটাত্মীয়ের হক আদায় করে এবং দান করে মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকদের। এরূপ কর্ম তাদের জন্য উত্তম যারা মহান আল্লাহতায়ালার দর্শনপ্রার্থী। এবং এরাই হলো সফলকাল। -(সুরা রুম, আয়াত ৩৮)।

যারা বেঈমান এবং যারা যাবে জাহান্নামের আগুনে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠগুলোও পবিত্র কুর’আন বার বার তুলে ধরেছে এবং সুস্পষ্ট করেছে সে পথের আলামতগুলো -যাতে মানুষ সেগুলো চিনতে পারে ও পরিহার করতে পারে। সুরা মুদাচ্ছিরের ৪৪ নম্বর আয়াতে যারা জাহান্নামের বাসিন্দা হবে তাদের সাক্ষাতকারের একটি বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। তাদের যখন জিজ্ঞাসা করা হবে তোমরা কীরূপে পৌছলে জাহান্নামের এ আগুনে, তখন তারা বলবে, আমরা নামায পড়তাম না। এটিই হলো প্রথম কারণ। তারপর দ্বিতীয় যে কারণটি তারা বলবে তা হলো, “আমরা খানা খাওয়াতাম না মিসকীনদের।” সুরা ফুস্সিলাতে বলা হয়েছে, “ধ্বংস সেই সব মুশরিকদের জন্য যারা যাকাত দেয়না এবং আখেরাতকে অস্বীকার করে।” বেঈমানের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ বর্ণনা দিতে গিয়ে সুরা মাউনে বলা হয়েছে, “তারা মিসকীনদের খাওয়াতে উৎসাহ দেয়না। সুরা ফজ্বরের ১৭-১৮ আয়াতে এ বিষয়টির উপর অধিক জোর দিয়ে বলা হয়েছে, “না, তোমরা এতিমদের উপর রহম করোনা, এবং মিসকীনদের খাওয়াতে পরস্পরে উৎসাহিত করো না।”    

 

যাকাতের উৎস ও ব্যয়ের খাত

যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত ফরজ হয় তাকে ফিকাহর ভাষায় নিসাব বলা হয়। কারো কাছে যদি এক চন্দ্র বছরের অধিক কাল ৮৮ গ্রাম ওজনের স্বর্ণ বা স্বর্ণের অলংকার অথবা ৬১২  গ্রাম ওজনের রূপা বা রূপার অলংকার থাকে তবে সেটিই তার জন্য নিসাব। অর্থাৎ তাকে যাকাত দিতে হবে। (সূত্র: বেহেশতে জেওয়ার, মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ: )। যদি স্বর্ণ বা রূপার বদলে সমপরিমান অর্থ এক চন্দ্র বছরের অধিক কাল গচ্ছিত থাকে তবে তার উপর যাকাত দিতে হবে। যাকাতের হার সম্পদের শতকরা ২.৫ ভাগ। যাকাত দিতে উঠ, গরু, ছাগল, ভেড়া ও ক্ষেতের ফসলের উপরও। উঠের নিসাব হলো ৫টি উঠ এবং ছাগলের নিসাব হলো ৪০টি ছাগল। এর কম হলে যাকাত নাই। সুরা আনয়ামের ১৪১ আয়াতে বলা হয়েছে, “…খাও (নিজ ক্ষেতের) ফসল থেকে যখন তা উৎপাদিত হয়, এবং আল্লাহর হক দিয়ে দাও যখন ফসল তুলবে। আর সীমালংঘন করো না। আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না। ইমাম আবু হানিফার মতে ক্ষেতে উৎপাদিত ফসল যে পরিমাণই হোক তার উপর ১০ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। একে ওশরও বলা হয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) ও উমর ইবনুল আযীয (রহ:)’র মতে শাক সবজির ১০টি আটি থেকে একটি আটি যাকাত দিতে হবে। তবে অন্য ফিকাহবিদদের মতে ফসলের পরিমান ৫ অসাক তথা ১৮.৫ মনের কম হলে তার উপর যাকাত নাই। (সূত্র: শেখ ইউসুফ আল কারযাভী)।

যাকাতের দাতা যেমন মুসলিম, তেমনি যাকাতের প্রাপককেও মুসলিম হতে হয়। নামায-রোযা যেমন মুসলিমদের নিজস্ব বিষয়, তেমনি নিজস্ব বিষয় হলো যাকাত। ইসলামের এ বিধান থেকে কোন মুনাফিক, ফাসিক, কাফির ও ইসলামের কোন শত্রু যেন লাভবান না হয় -সেদিকে নজর রাখতে হয়। যাকাত প্রদানের ৮টি খাত। সেগুলি হলো: ১). মুসলিম ফকির তথা ভিখারী ২).মুসলিম মিসকীন তথা দরিদ্র ব্যক্তি, ৩). যাকাত আদায়কারী কর্মচারী, ৪). মোয়াল্লাফাতেল ক্বুলুব তথা ইসলামের পক্ষে মনজয়, ৫). মুসলিম ক্রীত দাসের মুক্তি, ৬). মুসলিম দরিদ্র ব্যক্তির ঋণমুক্তি, ৭). ফি সাবিলিল্লাহ তথা আল্লাহর পথে জিহাদ, ৮). নিঃস্ব মুসলিম মুসাফির। নবীজী (সা:)’র আমলে যাকাত প্রদানের গুরুত্পূর্ণ খাত ছিল দাসমুক্তি। কারণ তখন ছিল আরব জুড়ে ক্রীতদাস প্রথা। তাদের অনেকেই ইসলাম কবুল করছিল; কিন্তু কাফেরদের ক্রীতদাস হওয়ার কারণে তারা ইসলাম পালনে বাধাগ্রস্ত হতো। অনেক অত্যাচারী কাফের মনিব ইসলাম কবুলের কারণে দাসদের উপর নিদারুন নির্যাতন করতো, এমন কি নির্মম ভাবে হত্যাও করতো। ইসলাম কবুলের কারণে হযরত ইয়াসির (রা:) এবং তাঁর স্ত্রী হযরত সুমাইয়া (রা:)কে তাদের মনিবের হাতে নিমর্ম ভাবে শহীদ হতে হয়। তারাই হলো ইসলামের প্রথম শহীদ। তাই অতি নেক আমল হলো যাকাতের অর্থ দিয়ে এরূপ দাসদের মুক্ত করা। হযরত আবু বকর (রা:) মুক্ত করেছিলেন হযরত বেলাল (রা:)কে। সে সময় যাকাত প্রদানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত ছিল মুসাফিরদের সাহায্য করা। কারণ, সে সময় পথেঘাটে কোন নিরাপত্তা ছিলনা। যাত্রা পথে ডাকাত দলের খপ্পড়ে পরে অনেকেই নিঃস্ব হতো। বহু পথ পাড়ি দিয়ে ঘরে ফিরার সম্বল তাদের থাকতো না। ফলে সওয়াবের কাজ ছিল অর্থ দিয়ে তাদের ঘরে ফিরতে সাহায্য করা। এটি ছিল যাকাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত।

সামাজিক অবস্থা ও নিরাপত্তায় উন্নয়নের সাথে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন ঘটে। তবে সব সময়েই যাকাতের অর্থব্যয়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি খাত হলো, ফকির-মিসকীনদের অর্থদান এবং মহান আল্লাহতায়ালার পথে খরচ। যে কোন সমাজে সবসময়েই কিছু দুস্থ্য-অসুস্থ্য-দরিদ্র-অক্ষম ব্যক্তি থাকে, তেমনি থাকে মহান আল্লাহতায়ালার পথে তথা ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজে অর্থের প্রয়োজন। মোয়াল্লাফাতেল ক্বুলুব বলতে বলা হয়, ইসলামের প্রতি মানুষের মনকে আকৃষ্ট করার কাজ। এখানে লক্ষ্য, ইসলাম কবুলকারী নতুন মুসলিমদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে রাখা। সে সাথে মুসলিম সমাজের প্রতি তাদের মনে মহব্বত সৃষ্টি করা। কারণ, ইসলাম কবুলের সাথে সাথে তারা পরিতাজ্য হয় তাদের নিজ পরিবার ও সমাজ থেকে। নিজ পায়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সামর্থ্য তাদের থাকে না। ফলে তাদের পুনর্বাসনে দায়িত্বটি মুসলিমদের নিতে হয়। সেখাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় হতে পারে। আল্লাহর পথের খাতটি বিশাল এবং অতি গুরুত্পূর্ণ। এটি দ্বীনের প্রচার এবং দ্বীনকে ও ইসলামী রাষ্ট্রকে শত্রুর হামলার মুখে বিজয়ী করার কাজ। এটিই হলো জিহাদের কাজ। সৈনিকদের প্রশিক্ষণে, তাদের জন্য অস্ত্র ক্রয়, হাসপাতাল ও আবাসিক স্থান নির্মাণের কাজেও যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়। তবে জিহাদ যে শুধু রণাঙ্গণে অস্ত্র দিয়ে হয় তা নয়, সেটি বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণেও হয়। জিহাদ হয় কথা দিয়ে ও লেখনী দিয়ে। রণাঙ্গণের জিহাদটি মাঝে মধ্যে হয়, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটি সব সময় হয়। এ লড়াইয়ে ইসলামের পক্ষে বই, পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ার প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় বুদ্ধিবৃত্তিক সৈনিক তথা  গবেষকের। এ কাজে যারা দিবারাত্র ব্যস্ত তাদের উপার্জনে নামার সুযোগ থাকে না। উপার্জনে নামলে এ বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে সময় দেয়ার ফুরসত থাকে না। কাজে প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন শেখ ইউসুফ আল-কারযাভীর মতে আধুনিক কালে জিহাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। এ জিহাদ কোটি কোটি মানুষের চেতনার ভূমিতে ইসলামকে প্রতিরক্ষা দেয় ও বিজয়ী করে। এ ক্ষেত্রে তাই যাকাতের অর্থ দান করা যায়। যাকাতের অর্থ ব্যয় হতে পারে মুসলিম জনশক্তিকে শিক্ষিত করার কাজেও। পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলোতে যাকাত প্রদানের অতি উপেক্ষিত খাতটি হলো বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের খাত। ফলে ইসলামকে পরাজিত করার কাজে ইসলামের চিহ্নিত শত্রুদেরকে সশস্ত্র যুদ্ধে নামতে হচ্ছে না। বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণেই তারা মুসলিম সন্তানদের পরাজিত করছে এবং নিজেদের দলে টানছে। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলির শাসনক্ষমতায় জাতীয়তাবাদী, সমাজবাদী, সেক্যুলারিস্টদের ন্যায় ইসলামের শত্রুদের বিজয়ী হওয়ার মূল কারণ তো তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয়। এক্ষেত্রে তারা যুদ্ধজয় করেছে কোন রূপ যুদ্ধ না লড়েই।       

 

যাকাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

কোন গৃহকে বাঁচতে হলে তার সবগুলো খুঁটিকে বাঁচাতে হয়। নইলে সে গৃহ সহজেই বিধ্বস্ত হয়। বিষয়টি অবিকল ইসলামের বেলাতেও। ইসলামের ৫টি খুঁটির মধ্য তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ খুঁটিটি হলো যাকাত। ইসলাম শুধু ইবাদতের বিধানই দেয় না। দেয় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রশাসন ও আদালতের বিধি-বিধানও। ইসলামের এ বিধানগুলো না বাঁচলে ইসলামও বাঁচে না। তখন নির্মিত হয় না সেরূপ সমাজ ও রাষ্ট্র -যা ইসলাম নির্মাণ করতে চায়। তখন ব্যর্থ হয় মানবকে ঘিরে মহান আল্লাহতায়ালার কুর’আনী প্রকল্প। ইসলামী রাষ্ট্র, সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের কাজে যাকাত দেয় অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য একটি বিপ্লবী সোসাল পলিসি। এবং শরিয়তভিত্তিক আদালত নিশ্চিত করে ইনসাফ তথা সুবিচার। এ বিধানগুলো বাঁচানো ইসলামে অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিষয়। এগুলো স্রেফ ওয়াজ-নসিহতে বাঁচে না। কারণ, ইসলামের শত্রুগণ কখনোই ওয়াজ-নসিহতের ভাষা বুঝে না, তারা বুঝে শুধু অস্ত্রের ভাষা। এদের দমনে সশস্ত্র জিহাদের বিধান এজন্যই এতো অপরিহার্য। ঈমানদারের জিহাদ তাই শুধু শত্রুর হামলার মুখে মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দেয়ার প্রয়োজনে নয়, বরং সেটি অপরিহার্য ইসলামের বিধানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনেও। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামকে এজন্যই আমৃত্যু জিহাদ করতে হয়েছে। এ জিহাদ না বাঁচলে ইসলাম তার পূর্ণাঙ্গ বিধান নিয়ে বাঁচে না। মুসলিম জীবন থেকে সে জিহাদ বিলুপ্ত হয়েছে বলেই ৫৭টি মুসলিম দেশের কোথাও নবীজী (সা:)’র ইসলাম তার সামগ্রিক পরিচয় নিয়ে বেঁচে নাই। তবে সবেমাত্র আফগানিস্তান ব্যতিক্রম হতে যাচ্ছে।

যাকাতের মধ্যেই রয়েছে রাষ্ট্রের দরিদ্র-দুস্থ্য জনগণকে সন্মানে বাঁচিয়ে রাখার প্রকল্প। যাকাতের এ কুর’আনী বিধান বিলুপ্ত হলে দেশের বিপুল সংখ্যক অভাবী জনগণ সম্পদশালীদের সম্পদের উপর আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত প্রাপ্য অধিকারটি হারায়। সে অধিকার আদায় করার ক্ষমতা দুস্থ্য জনগণের থাকে না। কারণ, সে কাজে ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রকাণ্ড যুদ্ধে নামতে হয়। গরীবের অভিভাবক রূপে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সে অধিকার আদায়ে প্রয়োজনে যুদ্ধ করা। খলিফা হযরত আবু বকর (রা:) তাঁর শাসনামলে তেমনি একটি জিহাদ সংঘটিত করেছিলেন যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে। অন্যরা যুদ্ধ করে ভাষা, ভূগোল, রাজা, গোত্র বা বর্ণের নামে। কিন্তু মুসলিমগণ জিহাদ করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিতে; এবং সে সাথে সে রাষ্ট্র ও ইসলামের বিধানগুলো বাঁচাতে। একমাত্র এরূপ জিহাদের মাধ্যেই মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব বাঁচে। এ বিশাল কাজ নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাতে হয় না। মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়িয়েও হয় না। ইসলামে জিহাদ এ জন্যই সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। যারা এ ইবাদতে নিহত হয়, তারাই পায় মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার। সেটি হলো, নিহত হওয়ার সাথে সাথে বিনা বিচারে জান্নাতপ্রাপ্তি। এমন শহীদদের মৃত বলাও তিনি হারাম করেছেন।

নবীজী (সা:)’র জীবনের আমৃত্যু মিশন ছিল এই জিহাদ। নবীজী (সা:) জিহাদে সে তাগিদটি পেয়েছেন পবিত্র কুর’আনের অসংখ্য আয়াত থেকে। ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী সভ্যতা গড়ে উঠেছে তো সে জিহাদের পথ ধরেই। হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা:) থেকে  বর্ণিত  একটি হাদীসে নবীজী (সা:) বলেছেন: “লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমি হুকুমপ্রাপ্ত হয়েছি, যতক্ষণ না তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র সাক্ষ্য দেবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। তারা যদি তা করে তবে তাদের রক্ত আমার কাছ থেকে নিরাপত্তা পেয়ে গেল।” –(সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম)। হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীস: নবীজী (সা:) বলেছেন, “আমাকে আদেশ করা হয়েছে লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে, যতক্ষণ না তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য দেবে, আমার ও আমি যে দ্বীন নিয়ে এসেছি তার প্রতি ঈমান আনবে। তবে তারা তা করলে তাদের রক্ত ও ধন-মাল আমার কাছে নিরাপত্তা লাভ করবে।” – (বুখারী, মুসলিম এবং নাসায়ী)। পরিতাপের বিষয় হলো আজকের মুসলিম জীবনে নামায-রোযা এবং হজ্জ-যাকাত আছে, তাসবিহ-তাহলিলও আছে। কিন্তু জিহাদ নাই। ফলে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত সে ইসলামও নাই।    

 

যাকাত পালনে মুসলিমদের ব্যর্থতা

আইন শুধু কিতাবে থাকলে চলে না, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও থাকতে হয়। নইলে সে আইন কিতাবেই থেকে যায়। বিষয়টি অবিকল সত্য যাকাতের বেলায়ও। যাকাতের বিধান অতি কল্যাণকর হলে কি হবে, সমস্যা হলো, সে বিধানকে প্রয়োগ করার কাজে কোন প্রতিষ্ঠান নাই। এ কাজে মুল দায়িত্বটি ইসলামী রাষ্ট্রের। এ পবিত্র কাজটি কখনোই কোন সেক্যুলার রাষ্ট্র দিয়ে হয় না। বোধগম্য কারণেই সেক্যুলার রাজনীতিকদের রাজনীতিতে এটি কোন এজেন্ডাও নয়। তাদের এজেন্ডা তো যাকাতের নির্মূল। কারণ যাকাতের বিধান বিলুপ্ত করলে আরো শক্তিহানী হয় মুসলিম দুস্থ্যগণ। যাকাতের বিধান মুসলিম সমাজে ব্যর্থ হওয়ার কারণ, মুসলিম বিশ্বে ইসলামী রাষ্ট্রই নাই। ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া যেমন শরিয়তের প্রতিষ্ঠা পায় না, তেমনি প্রতিষ্ঠা পায় না যাকাতও। যাকাতের প্রতিষ্ঠা দিতে হযরত আবু বকর (রা:) যেরূপ রক্তাত্ব যুদ্ধ লড়েছিলেন সেটি বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশেগুলোর রাজনীতি ও প্রশাসনে কোন এজেন্ডাই নয়। এ থেকেই বুঝা যায়, ইসলাম থেকে বিচ্যুতিটি কত গভীর। ঈমান কখনোই গোপন থাকার বিষয় নয়, প্রকাশ  পায় আমলের মধ্য দিয়ে। সেটি প্রকাশ পায়, যাকাত দানে আগ্রহের মধ্যে। ফলে যাকাত পালিত না হলে সন্দেহ সৃষ্টি হয় ঈমান নিয়ে।  

একটি দেশের পথে ঘাটে বিনা চিকিৎসায় মানুষের মৃত্যু দেখে বুঝা যায়, সে দেশে চিকিৎসা খাত কতটা ব্যর্থ। এবং বুঝা যায়, সরকার কতটা দায়শূণ্য ও মানবতাশূণ্য। তেমনি একটি মুসলিম দেশের রাস্তা ঘাটে ভিক্ষুক, অক্ষম ও পঙ্গু মানুষের আহাজারী-কাতরানী দেখেই বুঝা যায়, সে দেশে রাষ্ট্র ও ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা কতটা ব্যর্থ। বুঝা যায়, মানুষের ঈমানের অঙ্গণে সংকট কতটা গভীর। তখন প্রকাশ পায়, দেশবাসীর চেতনায় পরকালের ভয় কতটা মৃত। কোটি কোটি মুসলিমদের দেশে দুস্থ্য মানুষেরা ভিক্ষায় নামবে –সেটি কি ভাবা যায়? এক্ষেত্রে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা যেমন জনগণের, তেমনি সরকারেরও। সরকারের এজেন্ডায় জনসেবার যে কোন স্থান নাই -সেটি দরিদ্র মানুষের আর্তনাদই প্রকাশ করে দেয়। অথচ শাসকদের চেতনায় সামান্য ঈমান ও দায়িত্ব জ্ঞান থাকলে দুস্থ্য মানুষদের রাস্তায় নামার আগেই তাদের ঘরে তারা অর্থ ও খাদ্য পৌঁছে দিত। বরং এ অপরাধী শাসনচক্রই শোষণের হাতিয়ার রূপে প্রতিষ্ঠা দয়ে সূদভিত্তিক অর্থনীতিকে।  

বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশের শাসকগণ নিজেদেরকে মুসলিম রূপে দাবী করে। কথা হলো, মুসলিম রূপে দাবী করলেই কেউ মুসলিম হয় না। সে জন্য কাঙ্খিত মাত্রায় ঈমান ও আমল থাকতে হয়। মুসলিম শাসক কাকে বলে এবং কী তার চরিত্র -তার একটি সুস্পষ্ট বর্ণনা পেশ করেছেন মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনে। মুসলিম শাসকদের উচিত নিজেদের চরিত্র ও কর্মকে মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া কুর’আনী বর্ণনার সাথে মিলিয়ে দেখা। তখন তারা জানতে পারবে তারা কতটা মুসলিম। সে বর্ণনাটি হলো: “তারা (মুসলিমগণ) হলো সে সব ব্যক্তি যখন কোন দেশে তাদেরকে আমরা প্রতিষ্ঠা দেই, তারা প্রতিষ্ঠা দেয় নামাযের, প্রতিষ্ঠিত করে যাকাত, হুকুম দেয় ন্যায়ের, নির্মূল করে দুর্বৃত্তির; এবং সর্ব বিষয়ের মালিক আল্লাহ।” –(সুরা হাজ্জ, আয়াত ৪১)। এখানে মহান আল্লাহতায়ালা সুস্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, কী হবে একটি মুসলিম দেশের শাসকের মূল এজেন্ডা।

 

ইসলামী রাষ্ট্র কেন অপরিহার্য?

কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের সরকারী এজেন্ডায় কতটুকু স্থান পেয়েছে পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত সে এজেন্ডা? শাসক গোষ্ঠি ব্যস্ত নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডার বাস্তবায়ন নিয়ে। সেখানে নামায ও যাকাতের প্রতিষ্ঠার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কোন স্থান নাই। স্থান নাই ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলের। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা যদি শাসকের কাছে গুরুত্ব না পায় তবে কি সে শাসকের কি একটি মুসলিম দেশে শাসন ক্ষমতায় থাকার কি নৈতিক অধিকার থাকে? ডাক্তারী পেশায় নামতে হলে ডাক্তার হতে হয়। তেমনি মুসলিম দেশের শাসক হতে হলে অবশ্যই তাকে মুসলিম হতে হয়। তখন পবিত্র কুর’আনে দেয়া মুসলিমের সংজ্ঞার সাথে তার নিজের চরিত্রকে মিলিয়ে দেখতে হয়। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা ছাড়া অন্য যে কোন এজেন্ডাই শয়তানের এজেন্ডা। শয়তানের এজেন্ডা নিয়ে রাজনীতির অর্থ হলো, ইসলামের এজেন্ডাকে পরাজিত করা। কোন ঈমানদার কি ইসলামের পরাজয় মেনে নিতে পারে? মেনে নিলে কি তার ঈমান থাকে? ঈমানদারকে তো প্রতি মুহুর্তে বাঁচতে হয় ইসলামের বিজয়ী করার জিহাদ নিয়ে। এটিই তো হলো ঈমানদার হওয়ার দায়বদ্ধতা। কিন্তু মুসলিমদের মাঝে সে দায়বদ্ধতার চেতনাই বা ক’জনের? যাকাতের বিধান কাঙ্খিত ফল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে তো এই দায়িত্বহীনতার কারণেই। এরই ফলে মুসলিম দেশগুলির দরিদ্র, দুস্থ্য ও অক্ষম মানুষেরা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে। এবং রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে ভয়ানক অপরাধীদের হাতে শোষণ, শাসন ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ারে।

যাকাত প্রদানে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে হযরত আবু বকর (রা:)’য়ের ঘোষিত জিহাদের কারণ, তিনি নিজেকে দরিদ্র জনগণের অভিভাবক ভাবতেন। ফলে ধনির মাল থেকে গরীবের অধিকার আদায় করে তাদের হাতে পৌঁছিয়ে দেয়াকে তিনি নিজের দায়িত্ব মনে করতেন। তাছাড়া তিনি ছিলেন রাসূলে পাক (সা:)’য়ের খলিফা। ফলে তাঁর দায়িত্ব ছিল নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিধানের প্রতিরক্ষা দেয়া। অথচ সে চেতনা ও দায়িত্ববোধ কাজ করছে না মুসলিম দেশগুলোর আজকের শাসকদের মাঝে। যারা আল্লাহতায়ালার খলিফা হতে ব্যর্থ হয়, তারা স্বভাবতই পরিণত হয় শয়তানের খলিফায়। এ ছাড়া মানবের তৃতীয় পরিচয় নাই। তখন এরা বাঁচে শয়তানী বিধানের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে। এজন্যই ইসলামের বিধানের প্রতি তারা এতটা অঙ্গিকারহীন। তারা কাজ করে সম্পদশালী অভিজাতদের অভিভাবক তথা রক্ষক রূপে। ফলে যাকাত-বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জিহাদ শুরু হলে সে জিহাদটি হতো শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে এবং তাদের বন্ধুবান্ধব ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে। সেটি হতো তাদের জন্য আত্মঘাতী। তাই তাদের হাত দিয়ে যাকাতের বিধান প্রতিষ্ঠা পাবে -সেটি কি কখনো আশা করা যায়? ঘোড়ার আগে যেমন গাড়ী জোড়া যায় না, তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র না গড়ে যাকাতের বিধানও চালু করা যায় না। লন্ডন, ০৩/১০/২০২১।        

Post Tagged with ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *