বাঙালী মুসলিমের ভয়ংকর সাহিত্য-সংকট
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on August 4, 2019
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি
- No Comments.
গভীর সংকটটি সাহিত্যে
কোন ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠি কীরূপ শারীরীক বল বা সুস্থ্যতা পাবে -সেটি নির্ভর করে কি খায় বা পান করে তার উপর। কিন্তু কীরূপ চরিত্র পাবে তা নির্ভর করে কি সে পাঠ করে তার উপর। অনাহারে যেমন দেহ বাঁচে না, তেমনি জ্ঞানের অভাবে বিবেক বাঁচে না। অথচ মৃত বা অসুস্থ্য বিবেক নিয়ে মুসলিম হওয়া দূরে থাক মানবিক পরিচয় বেড়ে উঠা্ও অসম্ভব হয়। পবিত্র কোর’আনে এদেরকেই পশুর চেয়ওও নিকৃষ্ট বলা হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা তাই পানাহার ফরজ করতে কোর’আন বা কোন ওহী নাযিল করেনি। প্রাণী মাত্রই পানাহারের গুরুত্বটি বুঝে। কিন্তু লক্ষাধিক নবী পাঠিয়েছেন এবং ওহী নাযিল করেছেন যেমন জ্ঞানার্জনকে ফরজ করতে, তেমনি সে বিশুদ্ধ জ্ঞানের একটি বিশাল ভান্ডারকে সুনিশ্চিত করতে। কিন্তু যখনই কোন জনগোষ্ঠি সে জ্ঞানের ভান্ডার থেকে দূরে সরে তখনই তাদের যাত্রা শুরু হয় নীচে নামার দিকে। তখন তারা রেকর্ড গড়ে শুধু দুর্বৃত্তিতেই নয়, বরং নৃশংস স্বৈরাচার, সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, গুম-খুনের অসভ্যতা। বাংলাদেশের আজকের যাত্রা তো সে পথেই।
বাঙালী মুসলিমের আজকের সংকটটি যেমন খাদ্য বা সম্পদে নয়; তেমনি ভূমি বা জলবায়ূতেও নয়। বরং সেটি দেশের সাহিত্যে। সাহিত্যে দূষন দেখা দিলে চরম দূষন দেখা দেয় দেশবাসীর বিবেক, আচার-আচরণ, দর্শন, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মূল্যবোধ। তখন সাহিত্য পাঠের নামে গণহারে বিষ পান হয়। তখন নৈতীক মড়ক আসে শুধু নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর মাঝেই নয়, বরং অত্যাধীক বিষ পানের ফলে বিবেক ও মূল্যবোধে মহামারি আসে বেশী বেশী ডিগ্রিধারি, সাহিত্যসেবী ও অর্থশালীদের মাঝে। দেশের কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, আদালতের বিচারপতি, দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী এবং সংসদ-সদস্যগণও তখন প্রচণ্ড দুর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসী হয়। তখন সমগ্র জাতি অসুস্থ্য হয় নীতি ও নৈতিকতায়। দেহের রোগ যেমন জ্বর, দুর্বলতা, ক্ষুধা-হ্রাস ও ওজন-হ্রাসের ন্যায় নানারূপ লক্ষণ নিয়ে হাজির হয়, তেমনি নানারূপ লক্ষণ দেখা দেয় চেতনার রোগেও। দেশ তখন দূর্নীতিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ে। প্রচণ্ডতা পায় পাপাচার। রাজনীতিতে বাড়ে স্বৈরাচার ও সন্ত্রাস।
বাংলাদেশে ব্যাপক দূর্নীতি, সন্ত্রাস, স্বৈরাচার ও নানাবিধ অপরাধের বিস্তার দেখে এটুকু সঠিক ভাবেই বলা যায়, বিপুল সংখ্যক মানুষের চেতনা,নৈতিকতা এবং বিবেক আদৌ সুস্থ্য নয়।এবং এটি কোন মামূলী বিষয়ও নয়। বাঙালী মুসলমানের সকল রাজনৈতিক, সমাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার জন্ম গুরুতর এই নৈতিক অসুস্থ্যতা থেকেই।এর ফলে বিশ্বমাঝে মাথা তুলে দাঁড়ানো দূরে থাক,ইজ্জত নিয়ে বাঁচাই দিন দিন কঠিনতর হচ্ছে। ইতিমধ্যে দূর্নীতিতে ৫ বার বিশ্বে প্রথম হওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বাবাসীর পরিস্কার হয়ে গেছে নৈতিক সে রোগটি বাংলাদেশে কতটা প্রবল। বিপদের আরো ভয়াবহতা হল, বাঙালী মুসলিমদের মাঝে এ বিশাল সংকট নিয়ে চিন্তা-ভাবনা যেমন নেই, তেমনি ভাবনা নেই এ বিপদ থেকে কীরূপে উদ্ধার মিলবে তা নিয়েও। শয্যাগত মুমূর্ষরোগীর নিজের চিকিৎস্যা নিয়ে ভাবনা থাকে না। বোধও থাকে না। কোথায় এবং কীরূপে চিকিৎসা সম্ভব সে হুশটি লোপ পায় অনেক আগেই। লোপ পায় তার নিজের কল্যাণ চিন্তাও। এমন কি পানাহারের জন্যও তাকে নির্ভর করতে হয় অন্যের উপর। অনুরূপ অবস্থা হয় অধঃপতিত জাতিরও। দূর্নীতিতে ডুবা এমন অসুস্থ্য জাতির জীবনে দূর্নীতি মুক্তি নিয়ে কোন তাড়না থাকে না।
ব্যক্তি, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে সাহিত্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে ভাবনাই বা ক’জনের? অথচ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বাঙালী মুসলমানের প্রচণ্ড গর্ব। জাতীয় জীবনে দিন দিন বিপর্যয় বাড়লে কি হবে,রাষ্ট্র-ভাষা রূপে বাংলার প্রতিষ্ঠাতেই অনেকের আনন্দ। ভাষার প্রয়োজনীতাটি কি নিছক সে ভাষায় কথাবলা? সরকারি নথি, চিঠিপত্র ও দলিল-দস্তাবেজ লেখা? কথোপকথোন, দোকান-পাঠ-অফিস বা ব্যাবসা-বাণিজ্যের কাজ চালনা ছাড়াও ভাষাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। ক্ষেতখামারের কাজ যেমন দেশবাসীর পেটে খাদ্য জোগানো, ভাষার কাজ তেমনি চেতনায় পুষ্টি জোগানো। নইলে চরিত্র ও চেতনায় অসুস্থ্যতা অনিবার্য। ইতিহাসের বড় ছবক হলো, দেশের ভূমি যত উর্বর ও সুজলা-সুফলাই হোক, ভাষা ও সাহিত্যে সমৃদ্ধি না এলে সে দেশে যেমন চেতনাসমৃদ্ধ মানুষ যেমন গড়ে উঠে না, তেমনি উচ্চতর সভ্যতাও গড়ে উঠে না। তাই ইসলামী সভ্যতার নির্মাণ ও বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিমদের উত্থান জনবিরল আরব মরুর বুকে সম্ভব হলেও বাংলাদেশের ন্যায় মাঝে উর্বর ও শস্য-শ্যামল বিশাল মুসলিম জনসংখ্যার দেশে সম্ভব হয়নি। বস্তুতঃ ভাষা ও ভাষালব্ধ দর্শন ও সাহিত্যের বিচারে সেকালের আরব এবং বাংলাদেশের মাঝে বিরাজমান বিশাল পার্থক্যের প্রতিফলন ঘটেছে সভ্যতার নির্মানে বাঙালী মুসলিমদের বিফলতায়। আরবী ভাষা যখন শ্রেষ্ঠতায় বিশ্বে অনন্য, বাংলা ভাষার তখনও জন্মই হয়নি।
আরবী ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের কারণ, সে ভাষায় লেখা নিছক মানব রচিত সাহিত্য নয়। বরং মূল কারণটি হলো, এ ভাষাতেই অবতীর্ন হয়েছে মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ দান এবং মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল-কোরআন। বিশাল এক সোনার খনি একটি দেশের অর্থনৈতিক ভাগ্য পাল্টে দিতে পারে। কিন্তু জ্ঞানের ভূবনে বিপ্লব এলে, বিপ্লব আসে জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, চরিত্র ও সভ্যতায়। তবে জ্ঞানের সে সূত্রটি মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত আল-কোরআন হয় তবে বিপ্লবটি ঘটে আরো ব্যাপক ভাবে। তখন খোদ মানুষ পরিনত হয় খাঁটি সোনার চেয়েও দামী।
তবে সাহিত্যের অঙ্গণে বাংলা ভাষার দারিদ্র্যতা অতি প্রকট। বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম উপকরণ কোরআন নয়। হাদিসও নয়। হাফিজ শিরাজী, রুমী, সাদী, গালিব বা ইকবালের ন্যায় কবিদের উচ্চতর দর্শন-নির্ভর সাহিত্যও নয়। বরং সেটি হল শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, মনসা-মঙ্গল, চণ্ডি-মঙ্গল, বৈষ্ণব পদাবলী, খনার বচন,পুঁথি-সাহিত্য,বঙ্কিম-সাহিত্য,রবীন্দ্র-সাহিত্য, ইত্যাদী। এ সাহিত্যে কি উন্নত চেতনা,দর্শন,মূল্যবোধ ও সভ্যতা গড়ে উঠার সামগ্রী কতটুকু? পাইপ লাইনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে বিশুদ্ধ পানি যেমন পৌঁছতে পারে, তেমনি পৌঁছতে পারে দূষিত পানিও। তেমনি সাহিত্যের মাধ্যমে ঘরে ঘরে যেমন ব্যক্তির উন্নত দর্শন, মূল্যবোধ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানকে পৌছাতে পারে, মিথ্যা মতবাদ, ভ্রান্ত দর্শন, কুসংস্কার এবং মানব মনের অশ্লিল ও কুৎসিত বার্তাগুলোও পৌছাতে পারে। সাহিত্য এভাবে আলোর বদলে আঁধারের দিকেও যেমন টানতে পারে। মানব মনে ভয়ানক আবর্জনাও পৌঁছাতে পারে। ফলে দুষিত সাহিত্য সভ্যতার নির্মানে সহায়ক না হয়ে বরং দুর্গতি ও অবক্ষয়েরও কারণ হতে পারে। কিন্তু সে চিন্তা ক’জনের? যখন বাংলা ভাষার ন্যায় বহু আধুনিক ভাষার জন্মই হয়নি, তখনও শত শত রাষ্ট্র, সমাজ ও গোত্র গড়ে উঠেছে। বহু হাজার বছর ধরে সে সব রাষ্ট্র, সমাজ ও গোত্রের কার্যাবলী যেমন সমাধা হয়েছে তেমনি জনগণের মনের যোগযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কথোপকথনও হয়েছে। কিন্তু সব ভাষায় ও সব রাষ্ট্রে সভ্যতা গড়ে উঠেনি। উন্নত সভ্যতা তখনই নির্মিত হয়েছে যখনই কোন ভাষা উন্নত দর্শন ও সাহিত্যের বাহন হয়েছে এবং জনগণের চেতনা, কর্ম, আচরণ, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিতে আমূল বিপ্লব এনেছে।
সমগ্র সৃষ্টির মাঝে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব দেহের গুণে নয়; সেটি চিন্তা-ভাবনা বা দর্শনের গুণে। এই গুণটিই মানুষকে পশু থেকে পৃথক করে। উন্নত সভ্যতার নাগরিকগণ এ গুণের বলেই অনুন্নত বা বর্বরদের থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায়। চিন্তা-ভাবনার সে বিস্ময়কর সামর্থ্য থেকেই জন্ম নেয় জ্ঞান-বিজ্ঞান। গড়ে তোলে সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি। নির্মিত হয় উচ্চতর সভ্যতা। গাছ যেমন প্রতিদিন বাড়ে, তেমনি প্রতিদিন বেড়ে উঠতে হয় ব্যক্তিকেও। সেটি শুধু দেহের গুণে নয়, নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক গুণেও। বেড়ে উঠার সামর্থ্য বাড়াতে প্রতি মুহুর্তে তাকে নতুন কিছু যেমন শিখতে হয়, তেমনি ভাবনা ও কর্মের মধ্য দিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টিও করতে হয়। বেড়ে উঠার বিষয়টি ইসলামে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ইসলামের নবী (সাঃ)বলেছেন, “যার জীবনে পর পর দুটি দিন অতিবাহিত হল অথচ তার জ্ঞানের রাজ্যে কোন বৃদ্ধি এলো না তার জন্য বড়ই বিপদ।” সম্পদের উপর প্রতিদিনের সংযোজিত সমৃদ্ধিকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় এ্যাডেড ভ্যালু বা সংযোজিত মূল্য। জাতির জিডিপ (গ্রস ডমিস্টিক প্রোডাক্ট) হল সে সংযোজিত মূল্যের যোগফল। তবে উচ্চতর সভ্যতার নির্মানে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ঘটে অন্যত্র। মূল্য সংযোজনের সে মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ঘটে প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে। সুস্থ্য ব্যক্তির জীবনে এমন সৃষ্টিশীলতা চলে আজীবন। সেটি যেমন তার জ্ঞানের রাজ্যে,তেমনি কৃষি,শিল্প,সংস্কৃতি,রাজনীতি ও অর্থনীতিতে।শিক্ষা ও সাহিত্যের কাজ হল, সে সৃষ্টিশীলতা বা মূল্য সংযোজনের কাজে জনগণের সামর্থ্য বাড়ানো। সেটি যেমন বিদ্যালয়ে ও তেমনি বিদ্যালয়ের বাইরেও। বিদ্যালয়ের বাইরের সে কাজটি বেগবান করে সাহিত্য।
সৃষ্টিশীলতার বিপরীত যেটি সেটি হল স্থবিরতা। স্থবিরতা প্রাণহীন জড় বস্তু বা মৃত ব্যক্তির গুণ,জীবিতের নয়।জাতীয় জীবনে এমন স্থবিরতা ব্যাপকতর হলে অনিবার্য হয় সে পতন। অপরদিকে অতিক্ষুদ্র পরমাণুর উপর যখন সৃষ্টিশীলতা বা এ্যাডেড ভ্যালু যোগ হয়,তা থেকে জন্ম নেয় বিস্ময়কর পারমাণবিক শক্তি। সে এ্যাডেড ভ্যালু যখন কোন ব্যক্তির জীবনে যোগ হয়, সে মানুষটি ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর হয়।এমন লাগাতর সৃষ্টিশীলতার ফলেই সৃষ্টিশীল বিপ্লব আসে ব্যক্তি,সমাজ ও রাষ্ট্রে। সমৃদ্ধি আসে অর্থনীতি,সংস্কৃতি ও সাহিত্যে। একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিমাপ হয় সে দেশের সম্পদের উপর বছরে সর্বসাকুল্যে কতটা মূল্য সংযোজিত হল বা নতুন সম্পদ সৃষ্টি হল তা থেকে। আর জাতির মানবিক উন্নয়নের পরিচয়টি মেলে মানবিক গুণে জনগণের জীবনে সর্বসাকুল্যে কতটা সমৃদ্ধি আসলো এবং চারিত্রিক ও নৈতিকতার উপর কতটা উন্নয়ন ঘটল তা থেকে।সেটি ব্যাপক ভাবে বাড়লে তখন বিপ্লব আসে দেশের সংস্কৃতি,সমাজনীতি,অর্থনীতি ও রাজনীতিতে।তখন গড়ে উঠে উচ্চতর সাহিত্য।আর সাহিত্য তো তাই যা গড়ে উঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবনা,কল্পনা ও আবেগের সাথে ব্যক্তির সৃষ্টিশীল প্রতিভার সংযোজনের ফলে।হাফিজ শিরাজী,জালালুদ্দীন রুমী,গালিব বা ইকবাল তাদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য গড়ে তুলেছেন তো এ পথেই।এমন সাহিত্য নিজেই যেমন এক অমূল্য সৃষ্টিশীলতা,এবং তা থেকে অনুপ্রেরণা পায় বিপুল সংখ্যক সৃষ্টিশীল মানুষও।
অপর দিকে মুসলিম হওয়ার অর্থই হল সৃষ্টিশীল হওয়া। এটিই হলো তার ফিতরাত। তবে সৃষ্টিশীলতার জন্য চিন্তাশীলতাও জরুরী। চিন্তাশীলতার অভাবে মানুষ পরিণত হয় ইতর জীবে। যার মধ্যে চিন্তাশীলতা নেই, পবিত্র কোরআন থাকে তাকে পশুর চেয়েও অধম বলেছে। চিন্তাশীলতার মধ্য দিয়ে যা বাড়ে তা হল ঈমান ও তাকওয়া। ঈমানের বলেই মোমেন পায় লাগাতর নেক আমলের প্রেরণা তথা সৃষ্টিশীলতা। মোমেনের প্রতিটি নেক আমল মূলতঃ সে সৃষ্টিশীলতারই ফসল। প্রতিটি দিন এবং প্রতিটি মুহুর্তই ব্যক্তির জীবনে হাজির হয় নেক আমল তথা সৃষ্টিশীলতার বিশাল সুযোগ নিয়ে। একটি দিন অতিবাহিত হলো, অথচ সে কিছু শিখলো না, কাওকে কিছু শেখালোও না, কিছু করলোও না -এতে অপচয় ঘটে তাঁর জীবনের মূল্যবান একটি দিনের। অর্থের অপচয়ের চেয়েও এ অপচয়টি কি কম ক্ষতিকর? মহান আল্লাহর কাছে অতি অপছন্দের হলো এ অপচয়। নবীজী এমন অপচয়কারিদের শয়তানের ভাই বলেছেন।
ঈমানদার তার প্রতিটি সৃষ্টশীল কর্মে প্রেরণা পায়, নির্দেশনা পায় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানটি পায়টি পবিত্র কোর’আনের জ্ঞান থেকে। কোর’আনী জ্ঞানের মূল কথাটি হল, এ জীবন মানুষের জন্য পরীক্ষাস্থল। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সে কথাটি বলেছেন এভাবে, “আল্লাযী খালাকাল মাওতা ওয়াল হায়াতা লি ইয়াবলুয়াকুম আইয়োকুম আহসানা আমালা।” -(সুরা মুলক,আয়াত ১)। অর্থঃ তিনিই সেই (মহান আল্লাহ) যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমাদের মধ্যে কে কর্মের দিক দিয়ে উত্তম -সেটির পরীক্ষা হয়। ফলে এ পার্থিব জীবনে প্রতিটি ব্যক্তিই একজন পরীক্ষার্থী। আর পরীক্ষায় বসে পরীক্ষার্থীর লক্ষ্য হয়,প্রতি মুহুর্তে পরীক্ষার খাতায় নাম্বার বা স্কোর বাড়ানো। একই ভাবে ঈমানদার ব্যক্তি প্রতি মুহুর্তে স্কোর বাড়ায় তার আমলনামায়। সেটি নেক আমলের মাধ্যমে। যেমন সৎ কর্মে, তেমনি জ্ঞানের রাজ্যে। দুইটিই অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। লক্ষ্য,পরকালে জান্নাত লাভ। তাই যে দেশে ঈমানদারের সংখ্যা বাড়ে সেদেশে নেক আমল ও জ্ঞানের রাজ্যেও সমৃদ্ধি আসে। ইসলামের বিজয়ের আরবে তো সেটাই ঘটেছিল। তাই কোন দেশে মুসলমানের সংখ্যা বাড়লো অথচ সেদেশে সম্পদে ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধি আসলো না সেটি অভাবনীয়। এমনটি হলে বুঝতে হবে, সমস্যা রয়েছে জনগণের ইসলাম পালনে।
মুসলিম হওয়ার অর্থ তাই শুধু নামায-রোযা ও তাসবিহ পাঠে মনযোগী হওয়া নয়। বরং সেটি হলো নেক আমল বৃদ্ধির কাজে আমৃত্যু এবং প্রতি মুহুর্ত লেগে যাওয়া। সৃষ্টিশীল এমন মিশনে লেগে থাকার কারণেই ব্যক্তির জীবনে লাগাতর উৎকর্ষ আসে; যেমন তার কর্মে, তেমনি তার ভাবনায়। আরবের মানুষগুলো ঈমান ও আমলে অতি দ্রুত উপরে উঠেছিল তো এ পথেই। তাঁরা পরিণত হয়েছিলেন মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানবে। যারা এক কালে নিজেদের কন্যাকে জীবন্ত কবর দিত, তাঁরাই হাজার হাজার মাইল দূরের মানুষদের জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচাতে ছুটে গিয়েছিলেন। দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছেন বড় বড় পাহাড়-পর্বত, নদীনালা ও মরুপ্রান্তর অতিক্রম করে। বাংলাদেশের চেয়ে ৫০ গুণ বৃহৎ রাষ্ট্রের খলিফা তার ভৃত্যুকে উঠের চড়িয়ে নিজে উঠের রশি ধরে টেনেছেন। খলিফা নিজে আটার বস্তা কাঁধে নিয়ে ক্ষুদার্ত মানুষে জনগণের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। এ ছিল তাঁদের সভ্যতার মান। সে সময় যে দেশেই ইসলামের প্রবেশ ঘটেছিল সে দেশেই এসেছিল এরূপ মানবিক গুণের বিপ্লব।এসেছিল প্রচণ্ড সৃষ্টিশীলতা ও চিন্তাশীলতা। আরবী ভাষায় পবিত্র কোরআনের পূর্বে কোন গ্রন্থ ছিল না। কিন্তু আরবদের ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে সে দেশে শুধু নামায-রোযা ও হজ-যাকাত আসেনি, বিপুল সমৃদ্ধি এসেছে তাদের ভাষা ও সাহিত্যে। ফলে আরবী ভাষায় অতি অল্প সময়ে গড়ে উঠে এক বিশাল জ্ঞান-ভান্ডার। আর এ ফলে গড়ে উঠে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। অথচ কোর’আনের পূর্বে আরবী ভাষায় কোন গ্রন্থ ছিল না। ইসলামের প্রবেশের ফলে সাহিত্য ও বিজ্ঞানে দ্রুত বিপ্লব এসেছিল ইরান দেশেও। ইরানের ইতিহাস বহু হাজার বছরের। কিন্তু সে দেশের মানুষের যা কিছু মহান সৃষ্টি তা গড়ে উঠেছে ইসলাম আগমনের পর। ইসলাম মহান বিপ্লব এনেছিল তুর্কীদের মাঝেও। তারা গড়ে তুলেছিল ওসমানিয়া খেলাফত যা ছিল বহুশত বছর ধরে সমগ্র বিশ্বের প্রধানতম বিশ্বশক্তি। ইসলাম কবুলের পর বিপ্লব এসেছিল আফগানদের জীবনেও। সুলতান মাহমুদের সময় তার রাজ্যে যত বিজ্ঞানীর বসবাস ছিল, তা সমগ্র বাঁকি বিশ্বে ছিল না।
কোন জাতির সংস্কৃতি,মূল্যবোধ ও মানবিক উন্নয়নের মান যাচায়ে সে জাতির লোকসংখ্যা,রাস্তাঘাট, মাঠঘাট বা কলকারখানার খতিয়ান নেয়াটি জরুরী নয়। বরং সে পরিচয় মেলে সে জাতির ভাষা ও সাহিত্য থেকে। গাড়ীর আগে যেমন ঘোড়া দৌড়ায়,তেমনি জাতির বিজয় বা উন্নয়নের আগে সে জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যের ঘোড়াটি দৌড়ায়। ভাষার মধ্যেই ধরে পড়ে জাতির ধর্ম-কর্ম, চরিত্র, বুদ্ধিবৃত্তি ও মূল্যবোধ। পরবর্তী বংশধরদের জন্য সাহিত্যের মধ্যে থাকে াভাস সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার। তবে সে উত্তরাধিকার যেমন কল্যাণকর হতে পারে,তেমনি অকল্যাণকরও হতে পারে। সন্তানের দেহে পিতামাতা যেমন সংক্রামক ব্যাধীর বীজ ছড়িয়ে মারা যেতে পারে, তেমনি শিশুর চেতনায় সংক্রামক অজ্ঞতা,পথভ্রষ্টতা বা কুসংস্কার রেখেও মারা যেতে পারে। শত শত বছর ধরে মানব সমাজে নানারূপ অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতা যে বেঁচে থাকে তা তো এমন পারিবারীক বিশ্বাস ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায়।পাপুয়া নিউগিনির মানুষ আজও যেরূপ উলঙ্গ ভাবে বনে জঙ্গলে জীবন কাটায় সেটি তো একারণেই। পূর্বপুরুষ অগ্নিপুঁজা,পুতুলপুঁজা,সর্পপুঁজা,গরুপুঁজার বা নাস্তিকতার ঐতিহ্য পরিবারে রেখে মারা গেলে পরবর্তী বংশধরগণও গর্বভরে সেটাই অনুসরণ করে। সেটি বেঁচে থাকে দেশের আবহমান ধর্ম, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মাধ্যমে। মুসলিমদের কাজ শুধু ইসলাম প্রচার নয়,বরং সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নামে যে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার মানুষকে পথভ্রষ্ট করে সেগুলির বিলুপ্তি ঘটানো। সে কাজটি যথার্থ ভাবে না হলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মানের কাজটি। পানাহারের নামে বিষপানের ন্যায় সাহিত্য ও সংস্কৃতির নামে পথভ্রষ্টতাও তখন প্রবলতর হয়। এমন এক অপরিহার্য তাগিদেই মিশর, ইরান, আফগানিস্তানের মানুষ ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে তাদের বহু শত বছরের পুরনো ভাষা, সাহিত্য ও ঐতিহ্যের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল। ইসলামের প্রবেশের আগে মিশরীদের নিজস্ব ভাষা ছিল,সে ভাষায় শত শত বছর ধরে ফিরাউনদের রাষ্ট্রও পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু মিশরীয়রা সে মাতৃভাষাকে ত্যাগ করে তারা আরবীকে গ্রহণ করেছিল। নিজস্ব ভাষা ছিল ইরানীদেরও,সেটি ছিল ‘দারী’ ভাষা।সে ভাষায় সে আমলের বিশ্বশক্তি সাসানীদের রাজকার্য,ধর্ম-কর্ম ও শিক্ষার কাজ চলতো। কিন্তু ইরানীরা ইসলাম কবুলের সাথে সাথে ‘দারী’ বর্জন করে কোরআনের শব্দ, উপমা ও দর্শন নিয়ে নতুন ভাষা ফার্সীর জন্ম দেয়। ফার্সী ভাষার শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশী শব্দ আরবী। ভারতে মুসলিমদের যখন আগমন ঘটে তখন এদেশে যে ভাষা বা সাহিত্য ছিল না তা নয়। তখন সংস্কৃত ভাষা ছিল, সে ভাষায় সাহিত্যও ছিল। তবে সংস্কৃত ভাষা ও সে ভাষায় রচিত রামায়ন, মহাভারত, বেদ,উপনিষদের কেচ্ছাকাহিনীপূর্ণ সাহিত্য দিয়ে চেতনা পূর্ণ করলে মুসলিমদের পক্ষে ঈমান বাঁচানোই অসম্ভব হত। ঈমান বাঁচাতে গিয়ে ভারতীয় মুসলিমগণ তাই নতুন ভাষা উর্দুর জন্ম দিয়েছে এবং সে ভাষায় বিশাল সাহিত্য-ভান্ডারও গড়ে তুলেছে। উর্দুর পাশাপাশি সাহায্য নিয়েছে আরবী ও ফার্সীর। মুসলিমরা এভাবে যেখানেই গেছে সেখান শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা ও রাষ্ট্র নির্মান করেনি,নতুন নতুন ভাষা এবং সে ভাষায় সমৃদ্ধ সাহিত্যেরও জন্ম দিয়েছে।
বাঙালী মুসলিমদের বিপদ
কিন্তু মিশর, ইরান, আফগানিস্তান বা তুরস্কে যা ঘটেছে,বাংলাদেশে সেটি ঘটেনি।বাঙালী মুসলিমদের মূল বিপদটি এখানেই।আধুনিক বাংলা ভাষাটি গড়ে উঠেছে মূলত বাঙালী হিন্দুদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে। সেটির প্রমাণ মেলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে। বাংলা সাহিত্যের জন্ম বৌদ্ধদের দ্বারা। এবং সেটি চর্যাপদের মাধ্যমে। ১৯০৭ সালে হর প্রাসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয় পাঠাগারে ২৩ জন কবীর ৪৭টি চর্যাপদের সন্ধান পেয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের সেটাই প্রাচীন কাল এবং এ চর্যাপদগুলিই সে আমলের সাহিত্য-ভান্ডারের একমাত্র সঞ্চয়। বলা হয়ে থাকে,এগুলো রচিত হয়েছিল দশম শতাব্দীতে। কিন্তু এরপর বাংলা সাহিত্যে বৌদ্ধদের অবদান আর নজরে পড়ে না। সম্ভবতঃ এ কারণে যে,হিন্দুদের দ্বারা ব্যাপক বৌদ্ধনির্মূল শুরু হলে তাদের দ্বারা সাহিত্য সৃষ্টি দূরে থাক,প্রাণে বাঁচাই কঠিন হয়ে পড়ে। তখন বাংলায় বৌদ্ধ পাল রাজাদের শাসনই শুধু বিলুপ্ত হয়নি,প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মও। জীবন বাঁচাতে বৌদ্ধরা তখন নেপাল, ভূটান, শ্রীলংকা, বার্মা ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেয়। শরণার্থী বৌদ্ধদের সাথে চর্যাপদগুলি নেপালে পৌঁছানোর ফলে সেগুলি বেঁচে যায়। এরপর শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগ। মধ্যযুগীয় সে সাহিত্যের প্রায় সবটুকুই বাঙালী হিন্দুদের সাহিত্য। সেটি বুঝা যায় সে সাহিত্যের উপকরণগুলির দিকে তাকালে। সেগুলি হলঃ এক)বৈষ্ণব সাহিত্য, দুই) শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন,তিন) বিদ্যাপতির পদাবলী, চার)চন্ডিদাশ পদাবলী, পাঁচ) মঙ্গল কাব্য, ছয়) সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অনুবাদ, সাত) মহাভারতের অনুবাদ, এবং আট) বাউল গান। সে সাহিত্যে স্থান পেয়েছিল শ্রীকৃষ্ণ, রাম,শর্প, মনসা, রামায়ন ও মহাভারতের কথা। বাঙালী মুসলিমদের পক্ষে সে সাহিত্য থেকে চেতনায় পুষ্টি লাভ দূরে থাক,সে গুলির ভাষা, উপমা ও চরিত্র থেকে অর্থ-উদ্ধারই দূরুহ। শুধু একালে নয়, সেকালেও সেগুলি দূর্বোধ্য ছিল। বাংলায় মুসলিমদের বিজয় ত্রয়দশ শতাব্দীতে হলেও মুসলিম কবিদের সাহিত্যচর্চার শুরু হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। প্রশ্ন হল, ত্রয়দশ থেকে পঞ্চদশ এ দুইশত বছর ধরে বাঙলার মুসলিমদের চেতনায় পুষ্টি জোগানো হল কি ভাবে? পঞ্চদশ শতাব্দীতে যে সাহিত্য রচনা শুরু হল সে সাহিত্যই বা কতটা সমৃদ্ধ ছিল? পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম সারীর কবি হলেন শাহ মুহম্মদ ছগির।তিনি রচনা করেন ইউসুফ জুলেখা। পবিত্র কোরআনে ইউসুফ জুলেখার বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু শাহ মুহম্মদ ছগির তার “ইউসুফ জুলেখা”য় যা লেখেন তা তাঁর নিজস্ব কল্পনাপ্রসূত। এ আমলের অন্যরা হলেন দৌলত উজির বাহরাম খান,শাহ বারিদ খান,মুহম্মদ কবীর প্রমুখ। দৌলত উজির বাহরাম খান রচনা করেন লায়লী মজনু, শাহ বারিদ খান লেখেন বিদ্যাসুন্দর এবং হানিফা-কয়রপরী কাব্য। মুহম্মদ কবীর রচনা করেন মধু মালতী। দুই শতাব্দী ধরে মাত্র ৫ জন কবির হাতে রচিত হয় মাত্র ছয়খানি আখ্যানকাব্য। (সুত্রঃ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খণ্ড,২০০৮;বাংলা একাডেমী প্রকাশিত)।মধ্য যুগে অন্যান্য মুসলিম কবিগণ হলেন আলাওল, সৈয়দ সুলতান, মুজাম্মিল, ফয়জুল্লাহ প্রমুখ। এ আমলে মুসলিমদের রচিত সাহিত্যের কলেবর যেমন নগন্য,তার চেয়েও নগন্য হল জনগণের উপর তার প্রভাব।
এর পর শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ। প্রাচীন ও মধ্য যুগের ন্যায় আধুনিক যুগের সাহিত্যকর্মের শুরুও অমুসলিমদের হাতে। শুরুর কাজটি এবারও ঘটে ধর্মীয় প্রয়োজনে। তবে সেটি খৃষ্টানদের হাতে এবং খৃষ্টান ধর্মের প্রচারের স্বার্থে। শুরু হয় শ্রীরামপুর মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে। খৃষ্টানগণই সর্বপ্রথম এদেশে ছাপা খানা গড়ে তোলে এবং পত্রিকার প্রকাশও শুরু করে। খৃষ্টানদের মাঝে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন উইলিয়াম কেরী। তাদের দ্বারাই সর্ব প্রথম গদ্য সাহিত্যের জন্ম। এ আমলের সাহিত্য জগতের উল্লেখযোগ্য তারকা হলেন রাম মহন রায়, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজ নারায়ন বসু,অক্ষয় কুমার দ্ত্ত, পেয়ারী চাঁদ মিত্র, কালী প্রসন্ন সিংহ, মাইকেল মধুসূদন, ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত,বঙ্কিমচন্দ্র চ্যাটার্জী,হেমচন্দ্র,নবীনচন্দ্র,বিহারীলাল চক্রবর্তী,দীনবন্ধু মিত্র,গিরিশচন্দ্র ঘোষ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,মোশাররফ হোসেন,শরৎচন্দ্র,সত্যন্দ্রনাথ দত্ত,মোহিতলাল মজুমদার,দ্বিজেন্দ্রলাল রায়,নজরুল ইসলাম,বিভূতি ভূষন বন্দোপাধ্যয়,তারাশংকর বন্দোপাধ্যয়, মানিক বন্দোপাধ্যয় এবং আরো অনেকে।
সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দু সাহিত্যিকদের রচিত গল্প, উপন্যাস, নাটক, কাব্য ও মহাকাব্যের মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোকে শক্তিশালী করা এবং তাদের কল্যাণচিন্তাকে বলবান করা। সে সাহিত্যের প্রভাবেই বাংলার হিন্দুদের মাঝে দেখা দেয় রেনাসাঁ।সেটি যেমন শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে,তেমনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও। মুসলমানের মনে পুষ্টি জোগানো দূরে থাক,সে সাহিত্যে মুসলিমদের উল্লেখটিও ছিল অতি সামান্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে উল্লেখগুলি ছিল মুসলিমদের চরিত্রহননের লক্ষ্যে। বরং বাস্তবতা হল, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ যে মুসলিম সেটি হিন্দুদের রচিত মধ্য যুগীয় ও আধুনিক কালের বাংলা সাহিত্যে পড়লে বোঝাই যায় না। বাংলার মাঠঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, নগর-বন্দর ও অফিস-আদালতসহ সর্বত্র জুড়ে যেন শুধু হিন্দুই,মুসলমানের খোঁজ সে সাহিত্যে তেমন মেলে না। তাই মুসলিমদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় প্রয়োজন মেটোনোর সামর্থ্য এ সাহিত্যের ছিল না। বরং বিস্তর সামর্থ্য ছিল মুসলিমদের মনবল ভেঙ্গে দেয়ার।মীর মোশাররফ হোসেনের মত ব্যক্তিদের রচিত সাহিত্যও মুসলিমদের কল্যাণে কাজের কাজ কিছুই করেনি। ইসলামের ইতিহাসের অতি বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটেছিল কারবালায়। কারবালার সে ঘটনাকে তিনি রংচঙ চড়িয়ে ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচনা করলেও সে গ্রন্থে কারবালার মূল শিক্ষাকে তিনি আড়াল করেছেন। কারবালার সে অতি করুণ ঘটনাকে তিনি প্রেমের কেচ্ছা বানিয়েছেন।সাহিত্যকে তিনি বিনোদনের বাহন বানিয়েছেন, জনগণের চেতনা ও দর্শনে সুস্থ্যতা বাড়ানোর কাজে তার অবদান তাই নগণ্য।
সাহিত্যের অবদানঃ চেতনায় প্রতিরোধ
মুসলমানের প্রতি কাজেই থাকে ইবাদতের প্রেরণা। পরীক্ষার খাতায় প্রতি শব্দ লেখার মধ্যে যেমন থাকে পাশের চিন্তা, তেমনি ঈমানদারের প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি উচ্চারণ ও প্রতিটি ভাবনার মধ্যেও থাকে আখেরাতে মুক্তির ভাবনা। তাই যারা ঈমানদার কবি-সাহিত্যিক তারা শুধু সাহিত্যিকই নন, সাধক, দার্শনিক এবং মোজাহিদও। কবি ইকবাল তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সাহিত্যের মূল কাজ শুধু ঈমানে পুষ্টি জোগানো নয়,বরং অসুস্থ্য ভাবনা,মিথ্যা দর্শন,সামাজিক কুসংস্কার এবং অসত্য ও অধর্মের বিরুদ্ধে মানব মনে প্রতিরোধ বাড়ানো। ইসলামী সাহিত্য এভাবেই মানব মনে ভ্যাকসিনেশনের কাজ করে। সে ভ্যাকসিন ইম্যুনিটি বা প্রতিরক্ষা দেয় মিথ্যা, পাপাচার ও অধর্মের বিরুদ্ধে। পাপাচার কবলিত সমাজে সুস্থ্যতা নিয়ে বাঁচার জন্য এমন ইম্যুনিটি জরুরী। মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সম্পদ তেল গ্যাস নয়,জন-সম্পদও নয়।সেটি হলো পবিত্র কোরআন-হাদীস,এবং সে কোরআন-হাদীসের ভিত্তিতে রচিত ইসলামী সাহিত্য। এ সাহিত্য থেকে সে পায় ঈমানের বল। তেল-গ্যাসের অর্থে এমন ইম্যুনিটি আসে না। বরং বিপদ হল,সাহিত্যের বদলে দেশে অপ-সাহিত্য গড়ে উঠলে সেটি অসুস্থ দর্শন,মিথ্যা মতবাদ,দুষিত সংস্কৃতি এবং পাপের বাহনও হতে পারে। বইয়ের পাতা বয়ে কোটি কোটি মানুষের চেতনায় তখন পৌঁছে বিষাক্ত বিষ। এমন বিষ প্রচণ্ডতা নেশাগ্রস্ততাও আনে। সে নেশাগ্রস্ততা হিরোইনের চেয়ে কম নয়। হিরোইনসেবীরা যেমন পুষ্টিকর খাদ্যে রুচী হারায়, তেমনি অপসাহিত্যের নেশাগ্রস্ত পাঠকগণ রুচী হারায় কল্যাণকর সাহিত্যে। জাতীয় জীবনে তখন বিপর্যয় নেমে আসে ভয়ানক ভাবে। কবি, নাট্যকার ও উপন্যাসিকের ছদ্দবেশে বাংলাদেশে এমন বিষ-ব্যাবসায়ী বা হিরোইন-ব্যবসায়ীর সংখ্যা কি কম? দূষিত খাদ্য-পানীয়ের ন্যায় দুষিত সাহিত্যও পরিহার এজন্যই জরুরী। আরবের মুসলিমগণ তাই ইমরুল কায়সদের মত কবিদের সৃষ্ট অসুস্থ্য ও অশ্লিল সাহিত্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। অথচ অসুস্থ্য ও অশ্লিল সাহিত্য জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বাংলাদেশে। সাহিত্য পরিণত হয়েছে নিছক বিনোদনের মাধম্যে। কোন কোন ক্ষেত্রে সেটি অশ্লিলতার আশ্রয়ে।ফলে এ সাহিত্য জনমনে ইম্যুনিটি না বাড়িয়ে বরং সেটির ব্যাপক বিনাশ ঘটাচ্ছে। এইডস ভয়ানক রোগ,কারণ এ রোগটি দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বিলুপ্ত করে। সুস্থ্য মানুষ দীর্ঘ কাল বাঁচে কোন ঔষধের গুণে নয়।বরং সেটি আল্লাহপ্রদত্ত প্রতিরোধ ক্ষমতার গুণে। সুস্থ্য দেহের নানা স্থানে লক্ষ লক্ষ জীবানূর বাস, কিন্তু সেগুলি দেহের প্রতিরক্ষা বুহ্য ভেদ করতে পারে না। ফলে সে জীবনূগুলো শরীরের অভ্যন্তরে বছরের পর বছর বাস করলেও তা থেকে রোগ সৃষ্টি হয় না। কিন্তু এইডস রোগীর জীবনে এ দুর্বল জীবানূগুলিই ত্বরিৎ মৃত্যু ডেকে আনে। চেতনা রাজ্যে তেমনি এইডস সৃষ্টি করে অপ-সাহিত্য। বাংলাদেশে সে বিনাশী কর্ম যে কতটা ভয়ানক ভাবে হচ্ছে সেটি বুঝা যায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দুরাবস্থা ও দুর্নীতির ব্যাপক প্রচার দেখে। নৈতিক ইম্যুনিটি বিনষ্ট হওয়ার ফলেই বাংলাদেশ দূর্নীতে বিশ্ব-রেকর্ড গড়ছে। নবীজী (সাঃ)র আমলে মুসলিমগণ প্রথম ১৩টি বছর কাটিয়েছেন মক্কায়। সেখানে যেমন মদ-জুয়া ছিল,তেমনি উলঙ্গতা,অশ্লিলতা, দুর্বৃত্তি এবং ধর্মের নামে অধর্মও ছিল। সে সমাজ ছিল নৈতিক ব্যাধীতে পরিপূর্ণ। কিন্তু সেগুলি ঈমানদারদের স্পর্শ করতে পারেনি। ব্যর্থ হয়েছে তাদের মাঝে নৈতিক রোগ সৃষ্টি করতে। সেটি সম্ভব হয়েছিল তাদের চেতনায় প্রবল ইম্যুনিটির কারণে। আর সে ইম্যুনিটি প্রবল ভাবে বেড়েছিল আল-কোরআনের জ্ঞানে। অতীতে ভারতে আগত শক,হুন,জৈন,আর্য-অনার্য -নানা ধর্মের মানুষ ভারতীয় হিন্দুদের মাঝে হারিয়ে গেছে। কিন্তু হারিয়ে যায়নি মুসলিমগণ। হারিয়ে যাওয়া থেকে মুসলিমগণ বেঁচে গেছে কোরআনী জ্ঞানলব্ধ ইম্যুনিটির কারণে।কিন্তু সে ইম্যুনিটি বিনাশের লক্ষ্যে প্রচণ্ড আগ্রাসন শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। আর সে লক্ষ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে সাহিত্য। এবং সে সাথে জনগণকে পরিকল্পিত ভাবে দূরে সরানো হচ্ছে কোরআন-হাদিসের জ্ঞান থেকে।
অধিকৃত চেতনাঃ সাহিত্য যেখানে হাতিয়ার
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, অমুসলমানের সাথে মুসলমানের পানাহার যেমন একত্রে চলে না, তেমনি সাহিত্যও চলে না। কারণ উভয়ের প্রয়োজনটা যেমন ভিন্ন, তেমনি ভিন্ন হল কোনটি ক্ষতিকর আর কোনটি উপকারি সে ধারণাটিও। মুসলিম ও অমুসলমানের পানাহার ভিন্ন ভিন্ন টেবিলে বা পৃথক কক্ষে হলে হালাল-হারামের বাছবিচারে এতটা মনযোগী না হলেও চলে। কিন্তু যখন সেটি হয় একই টেবিলে, তখন খাদ্য গ্রহনে ঈমানদারকে অত্যন্ত সতর্ক হতে হয়। তখন টেবিলের নানা কোন থেকে হালাল খাদ্যগুলো বেছে বেছে নিতে হয়। একাজে সামান্য অসতর্ক হলে হারাম খাদ্য ভক্ষণও অস্বাভাবিক নয়। তেমনটি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও। সাহিত্যের ক্ষেত্রে বাছবিচারের বিষয়টি সহজতর করতে গিয়েই দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সকল অবাঙালী মুসলমানেরা শিক্ষার ভাষা, ধর্মের ভাষা ও সংস্কৃতির ভাষা রূপে উর্দুকে গ্রহন করেছে। উর্দুর আগে গ্রহণ করেছিল ফার্সীকে। আর হিন্দুরা গ্রহন করেছে হিন্দিকে। পাঞ্জাবের শিখরা তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ভাষা রূপে পাঞ্জাবীকে গ্রহণ করেছে। আর পাঞ্জাবের মুসলমানেরা গ্রহণ করেছে উর্দুকে। কিন্তু এক্ষেত্রে ভিন্নতর হল বাঙালী মুসলিমগণ। তারা প্রতিবেশী হিন্দুদের সাথে একত্রে বসে একই টেবিল থেকে তাদের নিজ চেতনার খাদ্যগুলো গ্রহণ করছে। এবং কোন রূপ বাছবিচার ছাড়াই। আর বাঙালী মুসলমানের জীবনে ভয়ানক বিপদটি ঘটছে এখানেই। সাহিত্য পাঠের নামে এখানেই ঘটছে বিষপান।এমন কি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিতটিও নেয়া হয়েছে একজন পৌত্তলিক হিন্দু থেকে। সাহিত্যের মধ্য দিয়েই একটি চেতনা কথা বলে। তাই পৌত্তলিকের সাহিত্য এজন্যই ঈমানদারের সাহিত্য থেকে ভিন্নতর হয়। ইকবাল, গালিব বা হাফিজের কবিতার মধ্য দিয়ে যেমন তাদের মুসলিম মানস কথা বলে, তেমনি রবীন্দ্র-সাহিত্যে গোপন থাকেনি তাঁর প্রচণ্ড হিন্দুত্ব ।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালী হলেও তার স্বপ্ন ছিল অখণ্ড ভারতব্যাপী হিন্দু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও হিন্দুত্বের বিজয়।তাঁর চেতনার সে মানচিত্রে মুসলমানের যেমন স্থান ছিল না,তেমনি ছিল না স্বাধীন বাংলাদেশের ধারণাও। গান্ধীর এক প্রশ্নের জবাবে তিনিই হিন্দি ভাষাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।রাজনৈতিক নেতা না হলেও রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন বা অঙ্গিকার যে কতটা গভীর ছিল সেটির প্রমাণ হল তাঁর সাহিত্য। তাঁর কাছে অনুকরণীয় মডেল রূপে যিনি স্থান পেয়েছিলেন তিনি কোন বাঙালী ছিলেন না। গান্ধিও নন। তিনি হলেন ভারত থেকে মুসলিম-নির্মূলের নায়ক শিবাজী। শিবাজীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাভরে তিনি ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা লেখেন। তাঁর মত কবি-সাহিত্যিক ও রাজনৈতিকদের উৎসাহে মারাঠার ন্যায় বাংলাতেও শিবাজী উৎসব শুরু হয়।রবীন্দ্রনাথের শিবাজী উৎসব কবিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়, শিবাজীর প্রতি তার নিজের ভক্তিটা কত গভীর এবং তার হিন্দুত্ব কতটা বিশাল। তিনি লেখেন:
“আমি কবি এ পূর্ব ভারতে
কী অপূর্ব হেরি,
বঙ্গের অঙ্গন দ্বারে কেমনে ধ্বনিল কোথা হতে
তব জয় ভেরি।
…
শুধু তব নাম আজি পিতৃলোক হতে এল নামি
করিল আহবান-
মুহুর্তে হৃদয়াসনে তোমারেই বরিল হে স্বামী,
বাঙালীর প্রাণ।
…
তোমারে চিনেছি আজি চিনেছি হে রাজন
তুমি মহারাজ।
তব রাজ করলয়ে আট কোটি বঙ্গের নন্দন
দাঁড়াইবে আজ ।
…
মারাঠির সাথে আজি হে বাঙালি, এক কন্ঠে বলো
‘জয়তু শিবাজী’
মারাঠির সাথে আজি হে বাঙালি, এক সঙ্গে চলো
মহোৎসবে আজি।”
অথচ এ মাত্র ৫ বছর পূর্বে ‘পণরক্ষা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ মারাঠাদের দস্যু রূপে চিত্রিত করে লিখেছেন:
“মারাঠা দস্যু আসিছিরে ঐ
করো করো সবে সাজ।”
মারাঠাদের দস্যু চরিত্র রবীন্দ্রনাথের অজানা ছিল না। সে সাথে এটিও তাঁর অজানা ছিল না যে, মারাঠা নেতা শিবাজী মুসলিম নির্মূলের নায়ক। এবং তিনি হিন্দু পুনর্জাগরনের নেতা। লক্ষণীয় হল,শিবাজী উৎসব কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ৮ কোটি বাঙালীকে এক সঙ্গে ‘জয়তু শিবাজী’ ধ্বণি দিতে বলেছেন। এখানে অর্থ দাড়ালো কি? রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় বাঙালী হিন্দুর সংখ্যা ৮ কোটি ছিল না।এবং এখনও তারা ৮ কোটি নয়। তবে কি তিনি ‘জয়তু শিবাজী’ ধ্বনি দিতে মুসলিমদেরকেও আহবান করছেন? তবে কি তিনি চান,অখন্ড ভারত জুড়ে হিন্দু-রাজ্য নির্মানে শিবাজীর ন্যায় মুসলিম নির্মূলের নায়কের অনুসারি হয়ে বাঙালী মুসলমানেরাও শামিল হোক? মুসলিমদের সাথে এর চেয়ে নির্মম মস্করা আর কি হতে পারে? এটি তো মুসলিমদের নিজ কবর নিজ হাতে খনন করতে বলা। ভারতীয় শিব সেনা, বিজেপী, বজরং দল, বিশ্বহিন্দু পরিষত তো সেটিই চায়।কথা হল,এমন উগ্রহিন্দু চেতনাধারির রচিত গান বাঙালী মুসলমানের জাতীয় সঙ্গীত হয় কি করে?
হিন্দু মারাঠাদের পরিচালিত মুসলিম নির্মূল প্রক্রিয়াটি মুসলিমদের মনে এতটাই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল যে হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভি (রহঃ) তৎকালীন আফগান শাসক আহম্মদ শাহ আবদালীকে মারাঠাদের দমনে ভারতে আসতে আহবান জানান।সে সময় ছিল মোগল শাসনের মুমূর্ষ অবস্থা, মারাঠাদের হামলার মুখে মোগলদের অবস্থা তখন অসহায়। ভারতে মুসলিম শাসনের সে দূর্দীনে আহম্মদ শাহ আবদালী সেদিন মারাঠা শক্তি নির্মূল করে আফগানিস্তান ফিরে যান। ভারতের মুসলিম ইতিহাসে এ যুদ্ধটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ,মারাঠা শক্তি বিনাশের ফলেই ভারতীয় মুসলিমগণ সে যাত্রায় নির্মূল প্রক্রিয়া থেকে বেঁচে যায়। নইলে ভারতীয় বৌদ্ধদের পরিনতি নেমে আসতো মুসলিমদের জীবনেও। কিন্তু উগ্র হিন্দুদের কাছে শিবাজী প্রতিষ্ঠা পায় মুসলিম বিরোধী রাজনীতির বীর পুরুষ রূপে। এবং সেটি রবীন্দ্রনাথের কাছেও। চরম মুসলিম-বিদ্বেষী আরেক মারাঠা শ্রী বাল গঙ্গাধর তিলক ১৮৯৩ সালে পুনা শহরে শিবাজীর জন্মস্থানে শিবাজী উৎসব প্রবর্তন করেন। শিবাজী পরিনত হন সারা ভারতে হিন্দু পুনরুজ্জীবনের প্রতীক রূপে। শিবাজী উৎসব আমদানী হয় কলিকাতা শহরেও। রবীন্দ্রনাথসহ অধিকাংশ হিন্দু বুদ্ধিজীবীগণই তাতে সাগ্রহে অংশগ্রহণ করেন।হিন্দু জাগরণ,মুসলিম নির্মূল এবং অখন্ড ভারতের বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের কাছে এতটাই বড় হয়ে দাঁড়ায় যে দস্যূ শিবাজীকে তিনি অতি শ্রদ্ধাভরে ‘জয়তু শিবাজী’ বলেছেন। এভাবে সেদিন দিনের আলোর ন্যায় সুস্পষ্ট হয় রবীন্দ্র মানস। বিস্ময়ের বিষয় হল,সে রবীন্দ্রনাথের গানই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত! কোন মুসলিম নেতা বা বুদ্ধিজীবী এমন একটি গানকে কি মুসলিমদের জাতীয় সঙ্গিত রূপে গ্রহণ করতে পারে?
জাতীয় সঙ্গিতের সুর,ছন্দ বা কবিত্বই বড় কথা নয়। বরং গুরুত্বপূর্ণ হল, সে সঙ্গিতের মধ্য দিয়ে জাতির ভিশন,মিশন,ধর্ম,জীবন-দর্শন ও আশা-আকাঙ্খার কতটা প্রকাশ ঘটল সেটি। জাতীয় সঙ্গিতের মাঝে প্রতিফলিত হয় দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের চেতনা। জাতীয় সঙ্গিতের লেখককে এজন্য নবেল-প্রাইজ বিজয়ী হওয়াটি জরুরী নয়। বিশ্বের দুই শত বেশী রাষ্ট্রের মধ্যে কয়টির দেশের জাতীয় সঙ্গিতের লেখক নবেল প্রাইজ বিজয়ী? এক্ষেত্রে জরুরী হল দেশবাসীর চেতনা ও বিশ্বাসের প্রতিনিধি হওয়ার সামর্থ্য থাকা। কিন্তু সে সামর্থ্য কি রবীন্দ্রনাথের ছিল? রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম বিশাল। হাজার হাজার পৃষ্ঠা তিনি লিখেছেন। যখন তিনি লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত তখন তার চোখের সামনেই এদেশের উপর চলছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জুলুমটি। সেটি সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসন। সে শাসন সাথে এনেছিল অর্থনৈতিক শোষন। এনেছিল নীল চাষ। এনেছিল দেশীয় শিল্প, কৃষি ও শিক্ষার ধ্বংসের অভিনব কৌশল। বাংলার মসলিন শিল্পের ধ্বংসে তারা তাঁতীদের হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত কেটেছে। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শোষন, শাসন ও জুলুমের বিরুদ্ধে নিন্দাজ্ঞাপনের জন্য বেশী মানবতা লাগেনা। বিবেকের সে সামর্থ্য বাংলার বহু সাধারণের ছিল। সে জুলুম, শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে বাংলার ফকিরগণ বিদ্রোহ করেছে। সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছে। সিপাহীরাও বিদ্রোহ করেছে। হাজার হাজার ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু সে জুলুম ও শোষন রবীন্দ্রনাথের বিবেককে স্পর্ষ করেনি। সাম্রাজ্যবাদী জুলুমের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামা দূরে থাক একটি কবিতা, গান বা প্রবন্ধও লেখেননি। বরং ১৯১১ সালে যখন ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লি আসেন তখন যে গানটি গেয়ে সে সাম্রাজ্যবাদী শাসককে অভিনন্দন জানানো হয়েছিল সে জ্ঞানটির লেখক ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এই হল রবীন্দ্রনাথের চেতনা ও বিবেকের মান।
শুধু তাই নয়। দেশে শিক্ষার বিস্তার কে না চায়? দেশের যে কোন প্রান্তে একটি স্কুল বা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা পেলে এমন কি পথের মানুষও আনন্দে আত্মহারা হয়। কিন্তু সে চেতনাটি কি রবীন্দ্রনাথের ছিল? ১৯১২ সালে পূর্ব বাংলার বিক্ষুব্ধ মুসলিমদের শান্ত করার জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোলকাতার রাস্তায় নেমেছিলেন। এবং তারও একটি প্রেক্ষাপট আছে। ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে এসে ১৯০৫ সালে কৃত বঙ্গভঙ্গকে রদ করে দেয়। এতে বিক্ষুব্ধ হয় পূর্ব বাংলার মুসলিম। ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ হওয়াতে ঢাকা কেন্দ্রীক উন্নয়ন শুরু হয়েছিল। সেটি বহাল থাকলে বাংলার সম্পদ শুধু কোলকাতায় কেন্দ্রীভূত না হয়ে ঢাকায়ও কিছু জমা হত। এতে ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার মানুষ ঢাকা এবং সে সাথে পূর্ব বাংলাকে অনেকটা ভিন্ন ভাবে পেত। ঢাকায় এবং সে সাথে পূর্ব বাংলায় শিক্ষা, শিল্প, যোগাযোগ ও প্রশাসনিক অবকাঠামা গড়ে উঠত, যেমনটি যে কোন রাজধানীতে গড়ে উঠে। সাতচল্লিশের ঢাকা কোন রাজধানী নগরী ছিল না। ছিল একটি জেলা শহর মাত্র।কিন্তু ঢাকা ও পূর্ব বাংলার উন্নয়ন কোলকাতা কেন্দ্রীক হিন্দুদের পছন্দ হয়নি। পছন্দ হয়নি রবীন্দ্রনাথেরও। তাই রবীন্দ্রনাথও বঙ্গভঙ্গ রদের দাবীতে রাস্তায় নেমেছিলেন। এরপর যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ওয়াদা দেয়া হয়, সেটির বিরোধীতাতে তিনি কোলকাতার রাজপথে মিছিল করেছেন। এসবই হল ইতিহাস। এবং এই হল রবীন্দ্র মানস ও রবীন্দ্র বিবেক। এ রবীন্দ্র মানস ও বিবেককে আলাদা করে কি তাঁর রচিত জাতীয় সঙ্গিত গাওয়া যায়? হিটলারের বক্তৃতা থেকে যেমন তার চরিত্র ও চেতনাকে আলাদা করা যায় না তেমনি পৃথক করা যায় না রবীন্দ্রনাথের রচিত গান থেকে তাঁর চরিত্র ও চেতনাকে।
আরো কথা হল,আজকের শতকরা ৯১ ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথের অবিভক্ত বাংলা যেমন নয়, তেমনি দেশটি ভারতও নয়। রবীন্দ্রনাথের অবিভক্ত বাংলায় মুসলিমদের সংখ্যা ৫৫% ভাগের বেশী ছিল না। সে বাংলা ঢাকাকেন্দ্রীকও ছিল না। এখন এটি এক ভিন্ন চরিত্রের বাংলাদেশ,-যে দেশে রবীন্দ্রনাথ একদিনের জন্যও বাস করেননি। কোনদিনও তিনি এদেশের নাগরিক ছিলেন না। এদেশের স্বাধীনতার কথা তিনি যেমন শোনেননি,তেমনি এ দেশের ৯১% ভাগ মুসলিমদের নিয়ে তিনি কোন স্বপ্নও দেখেননি। ফলে তাঁর পক্ষে বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়া, স্বাধীনতা, আকাঙ্খা বা স্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব করা কি সম্ভব? তাছাড়া এ সঙ্গিতটি সে উদ্দেশ্যে লেখাও হয়নি। জাতীয় সঙ্গিত নির্বাচনের বিষয়টি দোকান থেকে ‘রেডিমেড’ সার্ট কেনার ন্যায় নয়। এটিকে বরং বিশেষ রুচী, বিশেষ আকাঙ্খা,বিশেষ প্রয়োজন মেটাতে অতি বিশেষ গুণের ‘tailor made’ হতে হয়। প্রতিটি দেশেরই একটি রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় থাকে। বিশেষ কিছু স্বপ্নও থাকে। সে বিচারে প্রতিটি দেশই অনন্য। সে অনন্য বৈশিষ্ঠের কারণেই পশ্চিম বাংলার ন্যায় বাংলাদেশে ভারতের অংশ নয়। জাতীয় সঙ্গিত রচিত হয় সে বিশিষ্ঠ পরিচয় ও স্বপ্নগুলো তুলে ধরতে। এমন সঙ্গিতের প্রতিটি শব্দ ও প্রতিটি উচ্চারণ থেকে প্রতিটি নাগরিক পায় নতুন প্রত্যয়, পায় নতুন প্রেরণা। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিতের যে সুর,যে দর্শন,যে বর্ণনা এবং যে আকুতি সেটি নিতান্তই একজন পৌত্তলিক হিন্দুর,কোন মুসলমানের নয়। দেশের ভূমি,নদ-নদী,আলো-বাতাস,জলবায়ু –সব কিছুই মহান স্রষ্টার একক সৃষ্টি।এসব একমাত্র তাঁরই নেয়ামত। সর্বশ্রেষ্ঠ সে মহান স্রষ্টার সুপরিচিত নামও রয়েছে। সে নামটি ‘আল্লাহ’। মুসলিম তাঁর প্রতিকর্মে সে আল্লাহকেই স্মরণ করে এবং তাঁরই ইবাদত করে। সকল নেয়ামতের জন্য তারই শুকরিয়া আদায় করে। এবং সে স্মরণ এবং সে শুকরিয়া নিজ দেশের যে কোন কল্যাণ কর্মেও। এটিই ইসলামের সংস্কৃতি। সে সংস্কৃতিরই প্রকাশ ঘটে মুসলিম দেশের জাতীয় সঙ্গিতে। অথচ সে মহান আল্লাহ একজন হিন্দুর কাছে অপরিচিত। এবং অপরিচিত হল তাঁর স্মরণ ও তাঁর প্রতি শুকরিয়া জানানোর পদ্ধতিও। এ রবীন্দ্রগানটিতে বরং পুঁজনীয় হয়ে উঠেছে মহান আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক নৈসগ্য। আরধ্য হয়ে উঠেছে ভূমি,ফুল ও ফল,আলো-বাতাস এবং নদ-নদী। এখানেই হিন্দু রবীন্দ্রনাথের সাথে একজন মুসলিম বাংলাদেশীর পার্থক্য। এমন প্রকৃতি পুঁজা ইসলামে হারাম। অথচ রবীন্দ্রনাথের কাছে শুধু দেশ ও দেশের মাটির নয়, শাপ-শকুন-গরুও দেবতাতূল্য। বাংলাদেশের শিশু-সন্তান ও নাগরিকের বিরুদ্ধে বড় জুলুমটি হল, একজন পৌত্তলিকের রচিত জাতীয় সঙ্গিতটি তাদেরকে দিনের পর দিন গাইতে হচেছ,এবং তারা ব্যর্থ হচ্ছে সে স্মরণীয় মুহুর্তে মহান আল্লাহকে স্মরণ করতে। অথচ মানব জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মহান আল্লাহর স্মরণ তথা যিকর। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতসহ সকল ইবাদতের মূলটি লক্ষ্য হলো সে যিকরকে লাগাতর করা ও তীব্রতর করা। যিকর হলো পবিত্র কোর’আন পাঠ। যিকরের অর্থ ভাবনা শূণ্য মন নিয়ে স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালার নাম জপা নয়। বরং সেটি হলো তাঁর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়বদ্ধতা নিয়ে বাঁচার ধ্যানমগ্নতা। অথচ বাংলাদেশের সাহিত্য-সঙ্গিত, শিক্ষা-সংস্কৃতির কাজ হয়েছে সে যিকর বা ধ্যানমগ্নতা বিলুপ্ত করা। এমন কি বিলুপ্তির সে কাজটি হয় এক পৌত্তলিক কবির রচিত জাতীয় সঙ্গিত গাওয়ার নামেও। দেশের জাতীয় সঙ্গিতে দেশের মাটি, গাছ-পালা, ফলমূল ও আলো-বাতাসের বন্দনা থাকলেও যিকর নাই সেই মহান করুণাময় স্রষ্টার যিনি সেগুলি সৃষ্টি করেছেন। এভাবেই মহান আল্লাহতায়ালার যিকর ও ইসলামের মূল আক্বিদা থেকে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-সেনা এবং সাধারণ মানুষকে দূরে হটানো হচ্ছে। সে সাথে জন্ম দেয়া হচ্ছে শিরক তথা পৌত্তলিকতার। অথচ তা নিয়ে মোল্লা-মৌলভী, আলেম,পীর, মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার ছাত্র, ইসলামী দলগুলির নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মুসল্লীদের মাঝে সামান্যতম প্রতিবাদ নাই। রাজনীতি ও অর্থনীতিতেই শুধু নয়, সাধারণ মানুষের চেতনার মানচিত্রও হিন্দু আগ্রাসীদের হাতে কতটা অধিকৃত এ হল তার নমুনা। সাহিত্য পরিনত হয়েছে এখানে ঈমান ধ্বংসের নীরব হাতিয়ারে। বাঙালী মুসলমানের সাহিত্য সংকট এভাবেই এক ভয়ংকর জাতীয়-সংকট সৃষ্টি করছে। ১৯/০২/১১; দ্বিতীয় সংস্করণ ৪/৮/২০১৯
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- Why not the Muslims Should Suffer from Slavery & Subjugation?
- বাঙালি মুসলিম জীবনে মতবাদী রাজনীতির নাশকতা
- বাংলাদেশের বিপদ ও সম্ভাবনা
- সংগঠিত হতে হবে সংগঠন ছাড়াই
- পতিত হাসিনার দুর্বৃত্তায়ন ও হিন্দুত্বায়ন প্রকল্প এবং বাঙালি মুসলিম জীবনে নাশকতা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018