বাংলাদেশে স্বৈরাচারি অসভ্যতা ও মৃত গণতন্ত্র

মৃত গণতন্ত্র ও অসভ্যতা

বাঁচার অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার এবং দেশের ভাগ্য নির্ধারণে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকে কবরে পাঠিয়ে যে বাঁচা -তাতে সভ্য ভাবে বাঁচার কাজটি হয় না। সেটি নিরেট বর্বর যুগের অসভ্যতা। সে অসভ্যতা তাদের হাতেই প্রচণ্ড রূপ লাভ করে যাদের যুদ্ধের মূল লক্ষ্য জনগণের অধিকার হনন। বাংলাদেশের মাটিতে জনগণের অধিকার নির্মূলের যুদ্ধটি প্রথম শুরু করেন শেখ মুজিব। সে যুদ্ধে তিনি বিজয় লাভ করেন একদলীয় বাকশালের প্রতিষ্ঠা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানোর মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্র বলতে আওয়ামী লীগ যা বুঝে তা হলো ১৯৭৩, ২০১৪ এবং ২০১৮’য়ের ভোট ডাকাতির নির্বাচন। এসব নির্বাচনে জনগণের স্বাধীন রায় দেয়ার অধিকার যেমন দেয়া হয়নি, তেমনি বিরোধীদের জন্য সংসদে কোন স্থানও রাখা হয়নি। শেখ মুজিবের মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের যুদ্ধ থামেনি। বরং সে যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় বাকশালী চেতনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ শুধু জীবিতই নয়, এক বিজয়ী আদর্শে পরিণত হয়েছে। চলমান এ যুদ্ধে তাদের প্রতিপক্ষ হলো জনগণ। তাদের লক্ষ্য স্রেফ দেশকে অধিকৃত রাখা নয়, জনগণকে পরাজিত এবং নিরস্ত্র রাখাও। আরো লক্ষ্য হলো, তাদের বিদেশী  প্রভু ভারতকে খুশি রাখা। স্বৈরশাসকগণ জানে, জনগণের মোক্ষম  অস্ত্রটি ঢাল-তলোয়ার বা গোলাবারুদ নয়, সেটি হলো ভোট। সে ভোট দিয়েই জনগণ তাদের ইচ্ছামত কাউকে ক্ষমতায় বসায়, কাউকে নামায় এবং কাউকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে। গণতন্ত্রে জনগণের শক্তি তাই বিশাল। এ শক্তিবলে বড় বড় স্বৈরশাসককে জনগণ অতীতে আস্তাকুঁড়ে ফেলেছে। এজন্যই প্রতিটি স্বৈরশাসক গণতন্ত্রকে ভয় পায়। তারা জনগণের ভোটে ক্ষমতাচ্যুৎ হওয়া থেকে বাঁচতে চায়। তাদের লক্ষ্য তাই জনগণের হাত থেকে ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া। ফলে  স্বৈরশাসক মাত্রই গণতন্ত্রের চিরশত্রু। স্বৈরতন্ত্র ও গণতন্ত্র –এ দুটি কখনোই একই ভূমিতে একত্রে বাঁচে না; একটির বাঁচা মানেই অপরটির মৃত্যু। জনগণের ভোটের অধিকার, মিছিল-মিটিং করার অধিকার ও মৌলিক মানবিক অধীকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও নৃশংস সহিংসতা ছাড়া স্বৈরশাসনের মৃত্যু তাই অনিবার্য়। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়ামী বাকশালীদের লাগাতর ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধের মূল কারণ তো এটিই।

বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে তিনবার কবরে পাঠিয়েছে। প্রথমে কবরে পাঠানোর কাজটি করেন শেখ মুজিব নিজে; সেটি সকল বিরোধী দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। লক্ষ্যণীয় হলো, মুজিবের হাতে গণতন্ত্র হত্যার সে গণবিরোধী গর্হিত কর্মটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে কোনদিনই নিন্দনীয় গণ্য হয়নি। বরং তাদের কাছে গণতন্ত্র হত্যার সে স্বৈরাচারি নায়ক গণ্য হয় শ্রেষ্ঠ আদর্শ রূপে, এমনকি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে! ফলে এতে প্রমান মেলে,গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থানটি স্রেফ মুজিবের একার ছিল না, সেটিই ছিল আওয়ামী লীগের দলগণ অবস্থান। দলটি দ্বিতীয়বার গণতন্ত্র হত্যার কাজটি করে ১৯৮২ সালে; সেটি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের বিরুদ্ধে জেনারেল এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানকে সমর্থণের মধ্য দিয়ে। লক্ষ্যণীয় হলো, সামরিক অভ্যুত্থানকে নিন্দা করাই বিশ্বের তাবত গণতান্ত্রিক শক্তির রীতি। কারণ, সামরিক অভ্যুত্থানে কোন দেশেই গণতন্ত্র বাঁচেনি, বরং সামরিক অভ্যুত্থানই হলো দেশে দেশে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার মূল হাতিয়ার। ফলে সামরিক জান্তাদের হাতে গণতন্ত্র হত্যার সে বর্বর কাজটিকে নিন্দার সামর্থ্য না থাকলে তাকে গণতন্ত্রী বলাটি মূলতঃ গণতন্ত্রের সাথে দুশমনি। গণতান্ত্রিক চেতনার মূল্যায়নে এটি হলো লিটমাস টেস্ট। কিন্তু সে টেস্টে আওয়ামী লীগ ফেল করেছে। কারণ, স্বৈরাচারি এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানকে আওয়ামী লীগ নিন্দা না করে বরং সমর্থন করেছে। এবং আজও গণতন্ত্র-হত্যাকারি স্বৈরাচারি এরশাদই হলো শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট রাজনৈতিক মিত্র। এ হলো আওয়ামী লীগের স্বৈরাচার প্রীতির নমুনা। গণতন্ত্রকে তৃতীয়বার এবং সবচেয়ে বেশী কালের জন্য কবরে পাঠিয়েছেন দলটির বর্তমান নেত্রী শেখ হাসিনা। সেটি ২০১৪ সালে ভোট-ডাকাতি ও ভোটাবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে। জনগণের ভোটের ভাণ্ডারে শেখ হাসিনা পুণরায় ডাকাতি করে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে। ডাকাতগণ কখনোই নিজেদের নৃশংস ডাকাতি নিয়ে লজ্জাবোধ করে না। বরং প্রচণ্ড গর্ববোধ করে সফল ডাকাতির। এজন্যই হাসিনার মুখে সব সময়ই খুশি খুশি তৃপ্তির হাঁসি। রায় দানের অধিকার ছিনতাইয়ের পর জনগণের কাজ এখন হাসিনার ফেরেশতা সুলভ কথা এবং হাসির মহড়া দেখা। এটিই তো স্বৈরাচারের রীতি। বাংলাদেশে নবী-রাসূলকে নিন্দা করলে শাস্তি হয় না। কিন্তু হাসিনার নিন্দা করলে জেলে যেতে হয়।

সামরিক অভ্যুত্থানে যেমন গণতন্ত্র বাঁচে না, তেমনি ভোট-ডাকাতিতেও গণতন্ত্র বাঁচে না। ফলে কেয়ার টেকার গভর্নমেন্টের হাত ধরে যে গণতন্ত্র কবর থেকে ফিরে এসেছিল -সেটি আবার হাসিনার হাতে নিহত ও কবরে শায়ীত। তবে ভোট ডাকাতি ও গণতন্ত্র হত্যাই শেখ হাসিনার একমাত্র অপরাধ নয়। তিনি তাঁর পিতার বাকশালকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এক নতুন আঙ্গিকে। শেখ মুজিব সকল বিরোধী দলকে বিলুপ্ত করেছিলেন এবং নিষিদ্ধ করেছিলেন সকল বিরোধী দলীয় পত্রপত্রিকা। শেখ হাসিনা বিরোধী দলগুলিকে বিলুপ্ত না করে বিলুপ্ত করেছেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মৌলিক মানবিক অধিকার। কেড়ে নিয়েছেন সভাসমিতি, মিছিল, জনসংযোগের অধিকার। নিষিদ্ধ করেছেন আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলাম টিভি। ফলে বিরোধীদলগুলো নামে বাঁচলেও বিলুপ্ত হয়েছে সংসদ, রাজপথ ও মিডিয়া থেকে। গণতন্ত্র নির্মূলে শেখ হাসিনা তাঁর পিতা থেকেও বহু ধাপ এগিয়ে গেছেন। বিরোধী দলের মিটিংয়ে গুলি চালাতে ও বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যায় শেখ মুজিব কখনো সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেননি। সে কাজে তাঁর ছিল একটি মাত্র বাহিনী, সেটির নাম ছিল রক্ষিবাহিনী। কিন্তু শেখ হাসিনা রক্ষি বাহিনী না গড়ে সেনাবাহিনী, বিজিবী, পুলিশ ও RAB (রাপিড আকশন ব্যাটিলন)কে রক্ষিবাহিনীতে পরিণত করেছেন। ২০১৩ সালের ৫ই শাপলা চত্ত্বরে হিফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে গণহত্যায় গোলাবারুদ ও ভারী মেশিন গান নিয়ে সাত হাজারের বেশী সশস্ত্র সেপাই যোগ দিয়েছিল। তারা এসেছিল উপরুক্ত চারটি বাহিনী থেকে।

জনগণের ভোটাধীকারের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ঘৃণা কতটা তীব্র সেটি বুঝা যায় ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে সংসদের ১৫৩টি সিটে তিনি ভোটকেন্দ্র খোলার প্রয়োজন বোধ করেননি। অপর দিকে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র খোলা হলেও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের কাজটি পূর্বের রাতেই সমাধা করা হয়। ফলে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট না দিয়েই ভোটারদের ফিরে আসতে। মানব ইতিহাসে গণতন্ত্র হত্যার এ এক নয়া রেকর্ড। ঘৃনা সব সময়ই ঘৃনার জন্ম দেয়। গণতন্ত্রের প্রতি শেখ হাসিনার মনে যে ঘৃণা তা জনগণের মনে প্রচণ্ড ভাবে জন্ম দিয়েছে তাঁর স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা। সে ঘৃণার তীব্র প্রকাশ ঘটেছিল তার আয়োজিত ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করার মধ্য দিয়ে। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে শতকরা ৫ ভাগ ভোটারও ভোট দেয়নি।

নির্বাচনের লক্ষ্য তো জনগণের রায় নেয়া। সেটি অর্জিত না হলে কি তাকে নির্বাচন বলা যায়? বিশ্বের আর কোন দেশে কোন কালেই কি এরূপ ভোটারহীন নির্বাচন এবং ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের নির্বাচন হয়েছে? অথচ শেখ হাসিনা তো তাতেই খুশি। শেখ হাসিনার লক্ষ্য ছিল তাঁর দলের বিজয়, নির্বাচন কতটা সুষ্ঠ বা নিরপেক্ষ হলো এবং জনগণ তাতে কতটা অংশ নিল –তা নিয়ে তাঁর সামান্যতম আগ্রহ ছিল না। এ হলো তাঁর গণতন্ত্রের নমুনা। গণতন্ত্র হত্যায় আওয়ামী লীগ এভাবে স্বৈরাচারি এরশাদের চেয়েও বহুধাপ নিচে নেমেছে। ভোটারগণ তো তখনই ভোটকেন্দ্রে আসে যখন নির্বাচনে বিরোধীদল অংশ নেয়, নির্বাচনে প্রতিযোগিতা হয় এবং তারা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর বিজয়ে সম্ভাবনা দেখে। কিন্তু যে নির্বাচনের পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য হলো, স্রেফ সরকারি দলকে যে কোন রূপে বিজয়ী করা –সে নির্বাচনে জনগণ ভোটকেন্দ্রে আসবে কেন? এজন্যই স্বৈরশাসকের আয়োজিত নির্বাচনগুলি নিতান্তই প্রহসন ও গণতন্ত্রের সাথে মশকরা ভিন্ন অন্য কিছু নয়।

 

স্বৈরাচারঃ অসভ্যতার প্রতীক

সভ্যতার ন্যায় অসভ্যতার নিজস্ব আলামত আছে। সেটি শুধু জন্তু-জানোয়ারের ন্যায় বনেজঙ্গলে বা গুহায় বসবাস নয়। বরং সে নিরেট অসভ্যতার প্রকাশটি বাড়ি-গাড়ি, রাস্তাঘাট ও অফিস-আদালতে পরিপূর্ণ আধুনিক শহরেও হতে পারে। বন-জঙ্গলের ন্যায় এসব শহরেও তখন বিলুপ্ত হয় ন্যায়-নীতি, আইন-আদালত ও ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধ। অসভ্যতার সে আয়োজনে কাজ করে সন্ত্রাসের শক্তি। যার শক্তি আছে সে যাকে ইচ্ছা তাকে ধরতে পারে, গুম করতে পারে, খুন করতে এবং ধর্ষণও করতে পারে। রিমান্ডে নিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতনও করতে পারে। সে অসভ্যতায় এমন কি ৭-৮ বছরের বালিকাকে ধর্ষিতা হতে পারে। এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গণে ধুমধামে শত নারী ধর্ষণের উৎসবও করতে পারে –যেমনটি শেখ হাসিনার প্রথমবার ক্ষমতায় আসাতে জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতা করেছে। পত্রিকায় সে খবর ফলাও করে প্রকাশও পেয়েছে। এ অসভ্যতার আরো আলামত হলো, জঙ্গলে কেউ গুম, খুন বা ধর্ষিতা হলে যেমন বিচার বসে না, তেমনি আধুনিক অসভ্যতাতেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন বিচার বসে না। তাই বাংলাদেশের রেকর্ড শুধু দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্বচাম্পিয়ান হওয়ায় নয়, বরং দুর্বৃত্তদের বিচার না করারও।  জঙ্গলের অসভ্যতায় ভাল-ভালুকের সামনে ছাগল-ভেড়ার জীবনে নিরাপত্তা থাকে না। তেমনি স্বৈরাচারের অসভ্যতায় নিরাপত্তা থাকে না নিরীহ সাধারণ মানুষের -বিশেষ করে সরকারবিরোধীদের। আদিম অসভ্যতার ন্যায় এখানেও হুকুম চলে একমাত্র দলীয় প্রধান বা স্বৈরশাসকের। অন্যরা পরিণত হয় চাকর-বাকরে। রাষ্ট্রের অর্থ, অস্ত্র এবং সকল সামরিক ও প্রশাসনিক শক্তি পরিণত হয় স্রেফ স্বৈরশাসকের ত্রাস সৃষ্টির হাতিয়ারে।

তবে বন-জঙ্গলের অসভ্যতা ও স্বৈরাচারের অসভ্যতার মাঝে মৌলিক কিছু পার্থক্যও আছে। হিংস্র জন্তুর সহিংসতায় থাকে নিছক প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ। পেট পূর্ণ হলে তারা শিকার ধরে না। শিকার হত্যায় পশুদের মাঝে একটি নিয়ন্ত্রন দেখা যায়। ফলে বনে জঙ্গলে কখনো লাশ পড়ে থাকে না। ফলে গণনির্মূলের ন্যায় জঙ্গলে কখনো পশুনির্মূল হয় না। তাই পশুদের নৃশংসতায় স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণ থাকে। অথচ সেরূপ নিয়ন্ত্রণ থাকে না স্বৈরাচারের অসভ্যতায়। এজন্যই কোন দেশের বনজঙ্গলে বিপুল সংখ্যক হিংস্র পশুর বসবাস হলেও তাতে দেশ অসভ্যতায় ইতিহাস গড়ে না। কিন্তু সেটি হয় দেশের লোকালয়ে স্বৈরাচারি নেতাকর্মীদের সংখ্যা বাড়লে। স্বৈরাচারি নেতাকর্মীগণ নৃশংসতায় নামে স্রেফ প্রাণ বাঁচাতে নয়, বরং নিজেদের জুলুমবাজীর সংস্কৃতি বাঁচাতেও। কারণ জুলুমবাজী না বাঁচলে তাদের স্বৈর শাসন বাঁচে না। ফলে গুম, খুন, গণগ্রেফতার, গণহত্যা, গণনির্মূল –এসবই স্বৈরাচারি অসভ্যতার সহজাত সংস্কৃতি।  এবং থাকে সে নৃশংস অসভ্যতাকে একটি সভ্য রূপ দেওয়ার আয়োজন। সে অসভ্যতা বাঁচাতে যেমন নিত্য নতুন আইন তৈরী করা হয়, তেমনি আদালত বসিয়ে বিচারের নামে প্রহসনও হয়। এসব কিছুই হয় বিরোধীদের নির্মূলের কাজকে বৈধতা দিতে। যেমন রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নৃশংস গণহত্যা ও উচ্ছেদের ন্যায় নিরেট অসভ্যতাকে আইনসিদ্ধ করতে মায়ানমারে আইন তৈরী করা হয়েছে। অনুরূপ রাষ্ট্রীয় অসভ্যতার কারণেই জার্মানীতে বহু লাখ ইহুদীকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করাকেও আইনের শাসন বলা হয়েছে। তেমনি বাংলাদেশেও আইনের শাসন রূপে গণ্য হয়েছে ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে হিফাজতে ইসলামের শত শত কর্মীকে নিহত ও আহত এবং হত্যা শেষে তাদের লাশ গুম করার ন্যায় অসভ্যতা। একই রূপ আইনের শাসনের নাম করে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। আইনের শাসনের দোহাই দিয়ে বিরোধী দলীয় নেতা-নেত্রীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা খাড়া করা হচ্ছে। এভাবে আইন-আদালত ও প্রশাসন পরিণত হয়েছে স্বৈরাচারি অসভ্যতাকে দীর্ঘজীবী করার হাতিয়ারে।

 

কোয়ালিশন স্বৈরাচারি শক্তির

গণতন্ত্রের প্রাণ হলো, কে দেশের শাসক হবে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায় নেয়া। সেটি না হলে মৃত্যু ঘটে গণতন্ত্রের। অথচ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জনগণ সে রায় দেয়নি। এমন নির্বাচন বার বার হলেও তাতে গণতন্ত্র বাঁচে না। ফলে যারা ক্ষমতায় বসেছে তারা গণতন্ত্রের নিজস্ব সংজ্ঞায় পুরাপুরি অবৈধ। জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে এবং সামান্যতম আত্মসম্মান থাকলে এমন প্রহসনের নির্বাচনকে ভিত্তি করে কেউ কি ক্ষমতায় বসতে পারে? আত্মসম্মান ও জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকাতেই ডাকাতগণ অন্যের গৃহে ঢুকে এবং তাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়। একই রোগ তো স্বৈর শাসকের। একই রোগ সামরিক জান্তাদেরও। তারাও জনগণের অনুমতি না নিয়েই রাষ্ট্রের ঘরে ঢুকে। জনগণের শাসক রূপে নিজেদের ঘোষনা দেয়। ফলে যাদের মধ্যে সততা, মানবতা ও সামান্যতম বিবেকবোধ আছে এবং জনগণের মৌলিক অধিকারকে যারা সমর্থন করে -তারা কখনোই স্বৈরাচারের পক্ষ নেয় না। পক্ষ নেয় না সামরিক স্বৈরশাসকেরও। অথচ বাংলাদেশ গণতন্ত্র মারা পড়েছে যেমন স্বৈরশাসকের অধীনে অনুষ্ঠিত ভূয়া নির্বাচনে, তেমনি সামরিক অভ্যুর্থানে। আরো লক্ষ্যণীয় হলো, বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যার সবগুলি অপরাধের সাথেই আওয়ামী লীগ জড়িত। এমন কি পাকিস্তানী আমলেও দলটির ভূমিকা আদৌ কম কদর্যপূর্ণ ছিল না। আওয়ামী লীগের নেতারা ঢাকার প্রাদেশিক আইন পরিষদের ডেপুটি স্পীকার জনাব শাহেদ আলিকে সহিংস ভাবে হত্যা করেছিল। এবং সে হত্যাকাণ্ডের তারা বিচার করেনি। লক্ষণীয় হলো, পাকিস্তানের অন্য কোন প্রদেশের আইন পরিষদের অভ্যন্তরে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড কখনোই ঘটেনি; কারণ সেসব প্রদেশের সংসদে আওয়ামী লীগ ছিল না।

আওয়ামী বাকশালীদের বর্তমান যুদ্ধটি মূলতঃ সে সব বিরোধী দলের বিরুদ্ধে যারা গণতন্ত্রকে কবর থেকে আবার ফিরিয়ে আনতে চায়। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ চালিয়ে নিতে শেখ হাসিনা কোয়ালিশন গড়েছেন এরশাদের ন্যায় এক সাবেক স্বৈরশাসকের সাথে। সাথে নিয়েছেন গণতন্ত্র বিরোধী ও গণবিচ্ছিন্ন বামপন্থিদের। আওয়ামী বাকশালীদের এরূপ গণবিরোধী ভূমিকার কারণে গণতন্ত্র চর্চায় তুরস্কো, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, তিউনিসিয়া, লেবানন, নাইজিরিয়ার মত মুসলিম দেশগুলি বহুদূর এগিয়ে গেছে। এগিয়ে গেছে শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটানের ন্যায় দেশগুলিও। অথচ বাংলাদেশ রয়ে গেছে ৪৬ বছর পূর্বের মুজিব-প্রবর্তিত স্বৈরাচারি বাকশালী জামানায়। বাংলাদেশীদের আজকের পিছিয়ে পড়া নিয়ে বহুশত বছর পরও নতুন প্রজন্মের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠবে এবং সে সাথে ধিক্কারও উঠবে, “আমাদের পূর্বপুরুষগণ কি এতই অসাধু ছিল যে, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ন্যায় সভ্য কাজের সামান্য সামর্থ্যও তাদের ছিল না? অভিযোগ উঠবে, জনগণ কি এতই অযোগ্য ছিল যে, ব্যর্থ হয়েছে গণতন্ত্রের শত্রু নির্মূলে?”

প্রশ্ন হলো, আগামী প্রজন্মের দরবারে সে ইজ্জতের ভাবনা কি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আছে? সে ভাবনা যে নাই –সেটিই প্রকাশ পাচ্ছে নানা ভাবে। সে ভাবনা থাকলে তো আজকের বিশ্ববাসীর সামনেও তারা নিজেদের ইজ্জত নিয়ে ভাবতো। আত্মসম্মানের সে ভাবনায় অসম্ভব হতো দূর্নীতিতে বাংলাদেশের ৫ বার বিশ্বে প্রথম হওয়া। অসম্ভব হতো ভোটডাকাতি করা। তবে তেমন একটি সুস্থ্য ভাবনা না থাকার যথেষ্ঠ কারণও আছে। সেটি হলো, সভ্যতা, সম্মান  ও অগ্রগতি নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অদ্ভুত বিপরীতমুখী ভাবনা ও মূল্যবোধ। সে ভ্রষ্ট ভাবনার কারণে বাকশালী স্বৈরাচারকে তারা যেমন গণতন্ত্র বলে, তেমনি ১৫৩ সিটে নির্বাচন না করাকেও সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে। এবং দেশের পিছিয়ে পড়াকেও অগ্রগতি বলে। গলা উঁচিয়ে আরো বলে, দেশ দ্রুত উন্নত দেশগুলির কাতারে শামিল হচ্ছে। এমন মানসিক বিকলাঙ্গগণ কি মানবতা বা গণতন্ত্রের বন্ধু হতে পারে? অথচ বাংলাদেশে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে যারা নিরেপক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছিল – তারা বিদেশী ছিল না। তারা এদেশেরই সন্তান ছিল। কিন্তু সেরূপ নির্বাচন এজন্যই সম্ভব হয়েছিল যে সেগুলি আওয়ামী বাকশালীদের দখলদারিতে অনুষ্ঠিত হয়নি, হয়েছিল নির্দলীয় কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে। তেমন একটি সভ্য নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ না থাকাতে এটিই প্রমাণিত হয়, দেশ আজ কতটা অশুভ ও অসভ্য শক্তির হাতে অধিকৃত।

 

চেতনায় রাজতন্ত্র

অসভ্যতার যেমন সুস্পষ্ট প্রকাশ আছে, তেমনি আছে সভ্যতারও। স্বৈরাচার যেমন অসভ্যতার প্রতীক, তেমনি সভ্যতার প্রতীক হলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মৌলিক মানবিক অধিকার নিয়ে বাঁচা। দেশ কতটা উন্নত বা পশ্চাদপদ, সভ্য বা অসভ্য –সে বিচারটি নির্ভূল ভাবে হয় মতপ্রকাশ, ধর্মপালন, রাজনীতি ও ভোট দানের স্বাধীনতা থেকে। চলাফেরা, ঘর বাঁধা, খাওয়া-পড়া, চাষাবাদের স্বাধীনতা এমন কি ঔপনিবেশিক বিদেশী শত্রুশক্তিও অতীতে কেড়ে নেয়নি। এরূপ স্বাধীনতা যেমন দেশের পশুপাখি পায়, তেমনি পায় জনগণও। কিন্তু দখলদার শত্রুশক্তি কেড়ে নেয় স্বাধীন মতপ্রকাশ, সভাসমিতি ও রাজনীতির ন্যায় সভ্য মানুষ রূপে বাঁচার মৌলিক অধিকার। তাই স্বৈরশাসকদের  আমলে ঘরবাড়ী, দোকানপাঠ, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা ও স্কুল-কলেজ নির্মিত হলেও তাতে নাগরিক অধিকার নিয়ে বাঁচাটি নিশ্চিত হয় না। তেমনি স্বৈরশাসকদের আমলে বার বার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হলেই তাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হয় না; সেজন্য জরুরী হলো মত প্রকাশ, দল গঠন ও নির্বাচনে  অংশ নেয়ার অবাধ স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার অধিকার। সেটি আসে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই প্রতিষ্ঠা পায় এক দল, এক মত ও এক নেতার বদলে নানা নেতা, নানা মত ও নানা দলের মূক্ত রাজনীতি। কিন্তু সে স্বাধীনতা আওয়ামী বাকশালীগণ মুজিব আমলে যেমন দেয়নি, হাসিনার আমলেও দিচ্ছে না।

গণতন্ত্রের মূল কথা, রাষ্ট্রের ভাগ্য নির্ধারণে সবারই সমান অধিকার। কারো কোন বাড়তি অধিকার থাকে না। যে সম-অধিকার যেমন একজন ধনীর, তেমনি একজন গরীবেরও। ফলে নির্বাচনে কেউ যেমন দু’টি ভোটের অধিকারী নয়; তেমনি কেউ স্পেশালও নয়। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এখানেই শেখ হাসিনার প্রচণ্ড ক্ষোভ। কারণ, গণতান্ত্রিক চেনতায় বিলুপ্ত হয় তাঁর নিজের বিশেষ অধিকার। তিনি তো সাধারণ মানুষ নন। তাঁর পিতা তো জাতির পিতা। সেরূপ এক পিতার সন্তান রূপে তাঁর অধিকার তো সবার উপরে। দেশ-শাসনের অধিকার তো একমাত্র তাঁরই। রাজার সন্তানেরাই তো রাজা হয় –চেতনায় রাজতন্ত্র থাকায় শেখ হাসিনা নিজের ও নিজ পরিবারের সদস্যদের জন্য রাষ্ট্রের তহবিল থেকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার খরচ ও প্রহরার ব্যবস্থা আদায় করেছেন। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেরূপ বাড়তি অধিকার কারো থাকে না, নিরাপত্তার অধিকারটি এখানে সবার সমান। অথচ বাংলাদেশে জনগণের জীবনে সে নিপরাপত্তার অধিকার আজ সমাহিত। ফলে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার নিরাপত্তা পেলেও হাজার হাজার বাংলাদেশী লাশ হচ্ছে, গুম  হচ্ছে, ধর্ষিতা হচ্ছে এবং পুলিশের হাতে  নির্যাতিত হচ্ছে। জনগণকে সমান ভোটাধিকার দিলে তো হরণ হয় শেখ মুজিবে কণ্যা সূত্রে তাঁর নিজের অগ্রাধিকার। তাই রাজা-বাদশাহদের ন্যায় শেখ হাসিনাও জনগণকে ভোটাধিকার দিতে রাজী নন। তাঁর ভয়, জনগণকে সে অধিকার দিলে অতীতের ন্যায় সে অস্ত্র আবারো ব্যবহৃত হবে তাঁর অপসারণের কাজে। এমন একটি ভীতি নিয়েই তিনি জনগণের হাত থেকে ভোটের অস্ত্রটি ছিনিয়ে নিয়েছেন। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এরূপ নাশকতায় তিনি স্রেফ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকেই ধ্বংস করেননি, জনগণের মৌলিক নাগরিক অধিকারগুলিকেও আবর্জনার স্তুপে ফেলেছেন। তেমন একটি গণবিরোধী ধারণার কারণেই ২০১৪ সালে ১৫৩ আসনে নির্বাচন না করাটি তার কাছে আদৌ অপরাধ গণ্য হয়নি। অপরাধ গণ্য হয়নি ২০১৮ সালের ভোট ডাকাতি।

 

যে মহাবিপদ স্বৈরশাসনের

শাসক মাত্রই তার গদি বাঁচাতে শুধু প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে পরিবর্তন আনে না, পরিবর্তন আনে দেশবাসীর বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতে। পরিবর্তন আনে কোনটি ঘৃণীত হবে এবং কোনটি গৃহিত হবে -সে বাছ-বিচারের মানদণ্ড। সংস্কৃতির নির্মাণে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাবটি বিশাল। চোর-ডাকাতগণ সমাজে ঘৃণিত হয় এ কারণে যে, তাদের হাতে রাজনৈতিক দল থাকে না, থাকে না পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী,পত্র-পত্রিতা এবং আদালত। ফলে তাদের পক্ষে কথা বলা ও তাদের বাঁচাতে লাঠি ধরার কেউ থাকে না। কিন্তু ভোট-ডাকাতদের থাকে। তাদের হাতে থাকে জনগণের মতামত ও চেতনাকে প্রভাবিত করার বিপুল ক্ষমতা। ফলে তাদের হাতে কলুষিত হয় জনগণের বিশ্বাস, রুচি এবং সংস্কৃতি। তখন ফিরাউনের ন্যায় নৃশংস স্বৈরাচারি শাসকও জনগণের কাছে খোদা রূপে স্বীকৃতি পায়। একই কারণ ভোট-ডাকাতগণও জনগণের কাছে শাসক রূপে গৃহিত হয়। স্বৈরশাসনের এটিই সবচেয়ে বড় বিপদ। বিলেতে কোন এমপি বা মন্ত্রী মিথ্যা বলেছে বা চুরি করেছে -সেটি প্রমাণিত হলে তাকে নিজ পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়। অথচ বাংলাদেশে ভোট-ডাকাতি করেও এমপি, মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায়। এর কারণ, বিলেত থেকে বাংলাদেশের সংস্কৃতির ভিন্নতা। বিলেতের বুকে ভিন্নতর রীতি ও সংস্কৃতির কারণ, সেখানে কোন স্বৈরাচারি শাসন নেই। তাই কোন মিথ্যুক বা চোর-ডাকাত এমপি বা মন্ত্রী হবে -সেটি জনগণ ভাবতেও পারে না।

দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে শুধু প্রশাসনকে নয়, দেশবাসীর চেতনা ও সংস্কৃতিকে কলুষিত করার পূর্ণ সুযোগ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। সমগ্র সরকারি প্রশাসনকে তারা পরিণত  করেছে সরকারি দলের চাকর-বাকরে। সরকারি প্রশাসনের প্রতিটি বিভাগ পরিণত হয়েছে স্বৈরশাসকের ডাকাত বাহিনীতে। ফলে ভোট-ডাকাতির কাজটি এখন আর দলীয় নেতাকর্মীদের নিজ হাতে করতে হয় না, সেটি পুলিশ ও প্রশাসনের লোকেরা নিজ হাতে করে দেয়। সরকারি ডাকাত বাহিনীর অতি নৃশংসতাটি নগ্ন ভাবে দেখা গেছে ২০১৩ সালের ৫ই মে শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতে ইসলামের কয়েক শত কর্মীকে হত্যা ও হত্যার পর লাশ গুমের কাজে। এখনো দেখা যায়, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের উপর জুলুমবাজীর ক্ষেত্রে। এরূপ ডাকাতবাহিনীর হাতে নির্বাচন যে নিছক প্রহসনে পরিণত হবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসককে উৎখাত করা এজন্যই অসম্ভব। স্বৈরাচারি এরশাদকেও তাই ভোটের মাধ্যমে উৎখাত করা যায়নি। অপসারণ করা যায়নি মিশরে হোসনী মোবারক ও তিউনিসার বিন আলীকেও। কারণ, নির্বাচনি কমিশন, প্রেজাইডিং অফিসার, ভোট কেন্দ্রের পাহারাদার –এদের সবাই নিজেদেরকে স্বৈর-সরকারের বেতনভোগী চাকর-বাকর ছাড়া বড় কিছু ভাবেনা। তারা জানে, ভোটকেন্দ্রে তাদের মূল দায়িত্বটি হলো, সরকারি দলের প্রার্থীকে যে কোন ভাবে বিজয়ী করা। তারা এটাও জানে, সরকারি  দলকে বিজয়ী করার মধ্যেই তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার।

স্বৈরশাসনের আরেক বড় অসভ্যতা হলো, এতে বিলুপ্ত হয় ন্যায় বিচার। এবং যখন বিচারে শাস্তির ভয় থাকে না তখন দেশ পরিণত হয় অপরাধীদের অভয় অরণ্যে। তখন অপরাধীগণ অপরাধ ঘটায় অতি নৃশংস ভাবে। এবং সেটি দিন-দুপুরে অন্যদের চোখের সামনে। এমন কি তখন অপরাধের আলামত গোপন করাও অপরাধীদের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। বরং নিজেদের কৃত অপরাধকে বেশী বেশী জনসম্মুখে প্রকাশ করে এবং তা নিয়ে বাহাদুরি জাহির করে। তখন জনসম্মুখে রাস্তায় মানুষ খুন করা, বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্র হাতে ছাত্রদের লাশ করা ও ধর্ষণ নিয়ে উৎসব করা, ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরে দলবল নিয়ে স্বদর্পে আড্ডা দেয়া এবং প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারাও অতি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে অপরাধীদের জন্য এক অভয় অরণ্যে। কোন সভ্য দেশে কি ভাবা যায়, দিনদুপুরে ডাকাতি হবে এবং ডাকাতদের শাস্তি হবে না? এটি তো অসভ্যতার আলামত। অথচ বাংলাদেশে এরূপ অসভ্যতাকে প্রবলতর করাই হলো শেখ হাসিনা এবং তার দলের প্রধানতম অবদান। চোর-ডাকাতগণ স্বভাবতঃই চুরি-ডাকাতি করে। খুনিরাও মানুষ খুন করে। সেটি সব যুগেই হয়। কিন্তু স্বৈরাচারি সরকার যেরূপ রাষ্টের বুকে অসভ্যতার জন্ম দেয়, সেরূপ অপরাধ মহল্লার চোর-ডাকাতগণ করে না।

শেখ হাসিনাও এক দিন মারা যাবেন, কিন্তু তার সৃষ্ট অসভ্যতার ইতিহাস শত শত বছর বেঁচে থাকবে। তখন কবরে শুয়ে তার লাগাতর অর্জনটি হবে কোটি কোটি মানুষের ঘৃণা ও অভিশাপ। এবং সেটি শত শত বছর ধরে। তবে স্বৈরাচারিদের স্বভাব হলো, তারা জনগণের ঘৃণা বা অভিশাপ নিয়ে ভাবে না। সে ভাবনা থাকলে তো তারা ভোট-ডাকাতি, খুন ও গুমের রাজনীতিতে নামতো না।  তারা ভাবে নিজেদের শাসনকে কী করে আরো দীর্ঘায়ীত করা যায় -তা নিয়ে। ফলে ভাবে বেশী বেশী গুম, খুন ও ভোট-ডাকাতির পরিকল্পনা নিয়ে। এটি হলো পাপের প্রতি তারা অসভ্য নেশাগ্রস্ততা। এমন নেশাগ্রস্ততা নিয়ে শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক অধিকার হনন করে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। সেরূপ নেশাগ্রস্ততা নিয়ে ফিরাউনও হযরত মূসা (আঃ)র ন্যায় মানব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিটি স্বৈর-শাসকদের এটিই হলো স্বভাব। শেখ হাসিনা হাতে বাংলাদেশে সে অসভ্যতাই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তবে পার্থক্য হলো, ফিরাউন তার ফিরামিড নিয়ে গর্ব করতো। এবং হাসিনার গর্ব হলো মানব রপ্তানি, পোষাক রপ্তানি ও চিংড়ি রপ্তানি নিয়ে। ১৮/০৩/২০১৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *