বাংলাদেশে শত্রুশক্তির যুদ্ধ 

ইসলাম ও শত্রুপক্ষের রণকৌশল

মুসলমানগণ কোন কালেই শত্রুমূক্ত ছিল না। আজও নয়। যেখানেই মুসলমান আছে সেখানে শয়তান এবং তার দলবল ও রণকৌশলও আছে। ইসলাম থাকবে অথচ শয়তান থাকবে না -সেটি কি হয়? কোন বিজন দ্বীপে ঈমানদার ঘর বাঁধলেও শয়তান সেখানেও তার কুটকৌশল নিয়ে হাজির হয়। তাই ১৬ কোটি মুসলমানের দেশে শয়তান থাকবে না, এবং তার বাহিনী ও রণকৌশলও থাকবে না -সেটি কি ভাবা যায়? মুসলমানের দায়িত্ব হলো শয়তানের সে বাহিনী ও তার কৌশলগুলোকে সনাক্ত করা এবং এবং সে বাহিনীর বিরুদ্ধে লাগাতর লড়াই করা। প্রতিটি মুসলমানের উপর এ এক অর্পিত দায়ভার। সে দায়ভার পালনে নবীজী (সাঃ) ও তাঁর প্রতিটি সাহাবীকে আজীবন লড়াই লড়তে হয়েছে। অধিকাংশ সাহাবীকে শহীদ হতে হয়েছে। যারা সে লড়াইয়ে অংশ নেয়নি তাদেরকে মুনাফিক বলা হয়েছে। ঈমানদার হওয়ার অর্থই হলো শয়তানি শক্তির চিরকালের শত্রুতে পরিণত হওয়া। মু’মিন ব্যক্তির জীবনে এটিই সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এবং সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মু’মিন ব্যক্তিকে বাঁচতে হয় ইসলামের শত্রুর পক্ষ থেকে আরোপিত একটি ভয়ংকর যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ নিয়েই্। সে চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাঁচার পুরস্কার স্বরূপ পরকালে ঈমানদার ব্যক্তি পায় অফুরন্ত নিয়ামত ভরা জান্নাত। পরীক্ষায় পাশ না করলে যেমন প্রমোশন জুটে না, তেমনি এ চ্যালেঞ্জ সঠিক ভাবে মোকাবেলা না করলে জান্নাতও জুটবে না। এ বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালা কোন অস্পষ্টতা রাখেননি। সে সতর্ক বাণীটি পবিত্র কোরআনে বার বার শোনানো হয়েছে। বলা হয়েছে, “আমি অবশ্যই তোমাদর পরীক্ষা করবো ভয় দিয়ে, ক্ষুধা দিয়ে, জান ও মালের ক্ষতি দিয়ে এবং ফসলের লোকসান দিয়ে। সুসংবাদ দিন মু’মিনদের।” –(সুরা বাকারা )।

তাই মুসলিম জীবনের অর্থই লাগাতর লড়াই নিয়ে বাঁচা। ঈমানদারের জীবনে এটি হলো অপরিহার্য পরীক্ষা। এ পরীক্ষার পর্ব থেকে বাদ পড়েননি নবীরাসূল ও তাঁদের অনুসারিগণ।বরং সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা এসেছে তাঁদের জীবনে। নবীজী (সাঃ) র ন্যায় শান্তিপ্রিয় মহান দয়ালু মানুষটিও তাই তাঁর নবুয়তের জীবনের প্রথম দিন থেকেই শত্রুর হামলার শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। আগুনে ফেলা হয়েছিল,দেশ ছাড়তে হয়েছিল এবং নিজ শিশু পুত্রের কোরবানীর হুকুম হয়েছিল হযরত ইব্রাহীম (আঃ)র উপর। হযরত মূসা (আঃ)কে তো তাঁর জন্মের প্রথম দিনেই নদীতে ভাসতে হয়েছে। তাঁকেও ফিরাউনের হামলার মুখে দেশ ছাড়তে হয়েছে। শূলে চড়িয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল হযরত ঈসা (সাঃ)এর বিরুদ্ধে। ঈমানদার যেমন মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন প্রতিষ্ঠার বিশ্বস্থ্য সৈনিক রূপে তাঁর সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়,তেমনি প্রতিরোধ যুদ্ধের ঘোষণা দেয় শয়তান ও তার অনুগতদের হামলার বিরুদ্ধে। মু’মিনের জীবনে এটিই জিহাদ। মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো আমৃত্যু এ লাগাতর জিহাদ নিয়ে বাঁচা। এমন জিহাদ যেমন নবীজী (সাঃ)র জীবনে ছিল,তেমনি সাহাবাদের জীবনেও ছিল। আজও যারা নবীজী (সাঃ)র অনুসারি হতে চায় তাদের জীবনেও যে থাকবে -সেটিই স্বাভাবিক।

ঈমানদারের জীবনে তাই শুধু কোরআন পাঠ, নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাতের ইবাদতগুলি একাকী আসে না, সাথে লাগাতর জিহাদও আসে। শয়তানি শক্তিবর্গ তা জানে। তাই ঈমানদারদের নির্মূলে শয়তানি শক্তির প্রচেষ্ঠাও লাগাতর। বরং শয়তানি শক্তির পক্ষ  থেকে হামলা না হলে সন্দেহ জাগে ঈমানদার হওয়া নিয়ে। বাংলার ভূমিও আজ শয়তান মূক্ত নয়। বরং ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে বাংলাদেশে এক অধিকৃত ভূমি। ফিরাউন, নমরুদ,আবু জেহেল ও আবু লাহাব যেমন তাদের হাতে অধিকৃত ভূমিতে ইসলামের চর্চা ও প্রতিষ্ঠাকে অসম্ভব করে রেখেছিল এবং অসম্ভব করেছিল মহান আল্লাহর শরিয়তি বিধান পালন,শরিয়তের প্রতিষ্ঠা তেমনি অসম্ভব হয়ে আছে বাংলাদেশে।এদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আজ ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে। কোরআনের তাফসির, জিহাদ বিষয়ক বইয়ের প্রকাশনা ও সে গুলো প্রচার করা তাদের কাছে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপর দিকে তারা অতি বেপরোয়া শয়তানের প্রজেক্ট বাস্তবায়নে। সে শয়তানি প্রজেক্টের অংশ রূপে তারা শুধু সূদ, ঘুষ, ব্যাভিচার, নাচগান ও অশ্লিলতার ন্যায় আদিম পাপাচারকেইও আইনসিদ্ধ করেনি, আইনসিদ্ধ করার পাঁয়তারা করছে সমকামিতা বা হোমোসেক্সুয়ালিজমের ন্যায় অতি জঘন্য কবিরা গুনাহকেও। ইসলামের আক্বিদা-বিশ্বাস ও মুসলিম সংস্কৃতির নির্মূলে এ হলো ইসলামের শত্রু পক্ষের হামলার নমুনা। এ হামলাটি যেমন আদর্শিক, তেমনি সাংস্কৃতিক। এ হামলাটি যে শুধু বাংলাদেশের বুকে জন্ম নেয়া ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য সেক্যুলারিস্টদের পক্ষ থেকে আসছে -তা নয়। এ হামলার সাথে জড়িত এক গ্লোবাল কোয়ালিশন। যারা চায় বহুমুখি কবিরা গুনাহর উপর বিশ্বজুড়ে রাজনীতি ও সংস্কৃতির নির্মাণ। পাশ্চাত্য দেশগুলো ভাসছে সে কুফরি রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর। বস্তুতঃ সে দেশগুলাো অধিকৃত শয়তানের সৈনিকদের কাছে। এখন তারা হাত বাড়িয়েছে বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোতেও।

বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম ভূমির উপর হামলায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বন্ধুহীন নয়। ১৭৫৭ সালে বাংলার উপর আগ্রাসী হামলায় ইংরেজ বাহিনী যেমন মিরজাফরকে পেয়েছিল,তেমন মিরজাফরগণ আজকের শত্রুগণও পাচ্ছে। বরং আজকের পরিস্থিতি তাদের আরো অনুকূলে। ইংরেজদের তখন কয়েক হাজার নিজ সৈন্য নিয়ে পলাশীতে নামতে হয়েছিল। অথচ আজ ইসলামের বিরুদ্ধে পুরা যুদ্ধটি লড়ে দিচ্ছে বাংলাদেশে জন্ম নেয়া তাদের নিজেদের মিত্ররা। তাই গত ৬মে ঢাকার রাজপথে শত শত আলেম হত্যায় কোন অমুসলিমকে বন্দুক হাতে ময়দানে নামতে হয়নি। সেটি করে দিয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেয়া তাদের মানসিক গোলামেরা। পলাশীর ময়দানেও ইংরেজ সেপাহীদের হাতে এত মুসলমানের মৃত্যু হয়নি যা হয়েছে বাঙালী সেপাইদের হাতে মতিঝিলে গত ৫ই ও ৬ই মে। ইসলামের এ স্বদেশী শত্রুপক্ষের কাজে এ বিদেশী শত্রুরা এতই খুশি হয়েছিল যে তারা স্বৈরাচারি এ ইসলাম দুষমন সরকারের এ বীভৎস্য কর্মের বিরুদ্ধে কোন নিন্দা বা প্রতিবাদ জানায়নি। বরং প্রশংসা জুটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। পত্রিকায় প্রকাশ র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ব্রিটিশ নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু কি কারণে দিয়েছে সেটি কি এখনও বুঝতে বাঁকি থাকে? ইসলামের পক্ষের শক্তির নির্মূলে যে কাজটি তারা আফগানিস্তান ও ইরাকে স্বহাতে করেছে বা আজও করছে সে একই কাজ আদায় করে নিচ্ছে বাঙালী পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবী সেপাইদের দিয়ে। আজ থেকে শত বছর আগে হাজার হাজার বাঙালী ও হিন্দুস্থানী সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তারা শাতিল আরবে নিয়ে গিয়ে ইরাক অধিকৃত করেছিল। অধিকৃত করেছিল ফিলিস্তিন। অধিকৃত সে মুসলিম ফিলিস্তিনে তারা পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত করেছে ইসরাইল। আজকের বাংলাদেশকেও তারা এভাবে তাদের অনুগত সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক সৈনিকদের দ্বারা অধিকৃত রাখতে চায়।

ইসলামের শত্রুপক্ষের স্ট্রাটেজীর কারণেই বাংলাদেশ এখন এক উত্তপ্ত রণাঙ্গণ। বাংলাদেশ থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে যা কিছু হচ্ছে তা স্রেফ কিছু ব্লগারের কর্মকান্ড নয়। শুধু শাহবাগের মঞ্চই তার সাথে জড়িত নয়। বরং তার পিছনে রয়েছে এক আন্তর্জাতিক মহা কোয়ালিশন। সে কোয়ালিশনের মূল নিয়ন্ত্রনটি পাশ্চাত্যের। সে কোয়ালিশনে যোগ দিয়েছে আরেক আগ্রাসী দেশ ভারত। কোয়ালিশন বাহিনীটি আফগানিস্তান,ইরাক বা ফিলিস্তিনের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যা কিছু করেছে বা আজও করছে, ভারত অবিকল সেটিই করছে বিগত ৬০ বছরের বেশী কাল ধরে করছে অধিকৃত কাশ্মীরের অসহায় মুসলমানদের সাথে। বাংলাদেশের রণাঙ্গনে এ পক্ষটি অতি-উৎসাহী সহযোদ্ধা রূপে পেয়েছে দেশটির বিপুল সংখ্যক সেক্যুলার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংস্কৃতিক ক্যাডার, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, লেখক-সাংবাদিক, আইনজীবী, বিচারপতিসহ বহু সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা।

 

শত্রুপক্ষের ইসলামভীতি

বিশ্ব-রাজনীতির অঙ্গণ থেকে সোভিয়েত রাশিয়ার বিদায়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রগণ ভেবেছিল তাদের পথের কাঁটা এবার দূর হলো। পুঁজিবাদ ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আধিপত্য এবার বিস্তৃত হবে সমগ্র বিশ্বজুড়ে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। আফগানিস্তানে তালেবানদের বিজয় তাদের কাছে চক্ষশূল মনে হচ্ছিল। ইরাকও তাদের কাছে অবাধ্য মনে হয়েছিল। প্রথমে আফগানিস্তান ও পরে ইরাক দখলে নেয়ার পর এ দুইটি  দেশ দখলে রাখতেই তাদের হিমশিম খেতে হচেছ। যুদ্ধের কারণে মার্কিন অর্থভান্ডার থেকে খসে গেছে তিন ট্রিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ন্যায় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ শেষ হতে ৫ বছর লেগেছিল। কিন্তু বিগত ৭ বছর যুদ্ধ লড়েও মার্কিন নেতৃত্বাধীন ৪০টিরও বেশী দেশের কোয়ালিশ বাহিনী আফগানিস্তানে বিজয় আনতে পারিনি। বরং দ্রুত এগিয়ে চলেছে পরাজয়ের দিকে। এখন তারা জান বাঁচিয়ে পালাবার রাস্তা খুঁজছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ন্যায় একটি বিশ্বযুদ্ধের পরও মার্কিন অর্থনীতিতে এতটা মড়ক লাগেনি যা লেগেছে আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের কারণে।

পাশ্চাত্যের কাছে এখন এটি সুস্পষ্ট, আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন, লেবানন, সোমালিয়ার মত ক্ষুদ্র দেশগুলো দখল করা এবং সেগুলোকে কন্ট্রোলে রাখার সামার্থ্য তাদের নেই। যে প্রতিরোধের মুখে তারা হারতে বসেছে সেটির মূল হাতিয়ার অত্যাধিক যুদ্ধাস্ত্র নয়, জনবল বা অর্থবলও নয়। বরং সেটি কোরআনী দর্শন ও ইসলামের সনাতন জিহাদী সংস্কৃতি। এ দর্শন ও সংস্কৃতিই মুসলমানের জন্য আত্মসমর্পণকে অসম্ভব ও অচিন্তনীয় করে তুলেছে। বরং অতি কাম্য গণ্য হচ্ছে আগ্রাসী শত্রুর বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই ও শাহাদত। এমন চেতনা এবং এমন সংস্কৃতির বলেই এক কালের মুসলমানেরা রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় দুটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করেছিল। এ যুগেও তারা বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র ও বিশ্বশক্তি  রাশিয়াকে পরাজিত করেছে। এবং এখন গলা চেপে ধরেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। আফগান মোজাহিদদের জিহাদ তাই পাল্টে দিচ্ছে বিশ্বরাজনীতির সমীকরণ। কামান, বোমা ও যুদ্ধবিমানের বলে গণহত্যা চালানো যায়। নগর-বন্দরও ধ্বংস করা যায়। কিন্তু সে কামানে বা গোলায় কি দর্শন ও সংস্কৃতির বিনাশও সম্ভব? বরং তাদের আগ্রাসন ও গণহত্যায় প্রতিরোধের সে দর্শন ও সংস্কৃতিই দিন দিন আরো বলবান হচ্ছে। কোন মার্কিনীকে রণাঙ্গণে রাখতে মাথাপিছু প্রায় ১০ লাখ ডলার খরচ হয়। অথচ মুসলমানরা হাজির হচ্ছে নিজ খরচে। তারা শুধু স্বেচ্ছাই অর্থই দিচ্ছে না, প্রাণও দিচ্ছে।

 

লক্ষ্য জিহাদী সংস্কৃতির বিনাশ

অবস্থা বেগতিক দেখে পাশ্চাত্য এখন ভিন্ন স্ট্রাটেজী নিয়েছে। সেটি শুধু গণহত্যা নয়। নিছক নগর-বন্দর, ঘরবাড়ী এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বিনাশও  নয়। বরং সেটি ইসলামি দর্শন ও সংস্কৃতি ধ্বংসের। তাই শুরু করেছে প্রকান্ড আকারের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। নতুন এ স্ট্রাটেজীর আলোকে ইরাক ও আফগানিস্তানে তারা শুধু মানুষ হত্যাই করছে না, ঈমান হত্যাতেও তৎপর। এবং সেটি শুধু আফগানিস্তান ও ইরাকে সীমিত নয়। বাংলাদেশের ন্যায় প্রতিটি মুসলিম দেশই এখন একই রূপ সাংস্কৃতিক যুদ্ধের শিকার। হাসিনার সরকারের পক্ষ থেকে কোরআনের তাফসির নিষিদ্ধ করা,প্রখ্যাত আলেমদের গ্রেফতার ও তাদের ফাঁসির ব্যবস্থা, জিহাদ বিষয়ক বই বাজেয়াপ্ত করা, জামায়াত-শিবিরের মিছিল-মিটিং করতে না দেয়া ও হিফাজতে ইসলামের সমাবেশে ৭-৮হাজার সশস্ত্র সৈন্যর হামলার মূল কারণ তো এটাই। বাংলাদেশ তাদের অন্যতম টার্গেট হওয়ার কারণ, দেশটিতে ১৫ কোটি মুসলমানের বসবাস। তেল, গ্যাস বা অন্য কোন খনিজ সম্পদের চেয়ে ১৫ কোটি জনসংখ্যার ফ্যাক্টরটিই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তেল, গ্যাস বোমায় পরিণত হয়না, কিন্তু মানুষ হয়। তাই বাংলাদেশী না চাইলেও তাদের এ আগ্রাসনের টার্গেট হওযা থেকে বাঁচার উপার নাই। শত্রুর লক্ষ্য এখন মুসলমানদের ঈমানকে হত্যা করা। ফলে মহা সংকটে এবার শুধু দুনিয়ার জীবন নয়, আখেরাতের জীবনও। কারণ এ যুদ্ধে ইসলামের এ শত্রুপক্ষ বিজয়ী হলে বাংলাদেশের মুসলমান দেহ নিয়ে বাঁচলেও ঈমান নিয়ে বাঁচবে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের স্ট্রাটেজী তাই  মুসলমানদের জীবন থেকে জিহাদের সংস্কৃতি বিলুপ্ত করা। এবং ভূলিয়ে দেওয়া ইসলামি মৌল শিক্ষাকে। তেমন এক স্ট্রাটেজী নিয়ে ব্রিটিশগণ ভারতে আলিয়া মাদ্রাসা খুলেছিল। ধর্ম-শিক্ষার ছ্দ্দবেশে মুসলমানদের দৃষ্টি থেকে তারা আড়াল করেছে জিহাদের ন্যায় ইসলামের মূল শিক্ষাকে। ফলে নিরাপদ হয়েছিল তাদের ১৯০ বছেরের শাসন। ইসলামে বিরুদ্ধে সে সফল স্ট্রাটেজী নিয়ে তারা আবার ময়দানে নেমেছে বাংলাদেশে। এখন সে কাজে বাংলাদেশে ব্যবহার করতে চায় জনগণের নিজ অর্থে প্রতিষ্ঠিত হাজার হাজার স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সেক্যিউলারিষ্টদের সহায়তায় ইতিমধ্যই এখন এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের হাতে অধিকৃত। অধিকৃত দেশের অধিকাংশ মিডিয়াও। তারা শুরু হয়েছে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক মিথ্যা-প্রপাগান্ডা। বলতে চায়, ইসলাম এ যুগে অচল। যেন ইসলাম শুধু নবীজী (সাঃ)র জামানার লোকদের জন্যই নাযিল হয়েছিল। তারা শরিয়তকে বলছে মানবতা বিরোধী। সে প্রপাগান্ডাকে ব্যাপকতর করতে বহু টিভি চ্যানেল, অসংখ্য পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করেছে হাজার হাজার এনজিও। এদের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা হলো, নবীজী (সাঃ)র আমলের ইসলামকে জনগণের মন থেকে ভূলিয়ে দেওয়া। অথচ ইসলাম থেকে নামায-রোযাকে যেমন আলাদা করা যায় না, তেমনি আলাদা করা যায় না জিহাদকেও। পবিত্র কোরআনে জিহাদে অংশ নেওয়ার নির্দেশ এসেছে বার বার। সে সব জিহাদে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। নবীজী (সাঃ) নিজে রক্তাক্ষয়ী বহুযুদ্ধ লড়েছেন বহুবার। ইসলামের বহু শত্রুকে হত্যা এবং বনু কুরাইজা ও বনু নাযির ন্যায় ইহুদী বস্তিকে নির্মূল করা হয়েছে তাঁরই নির্দেশে। অথচ নবীজী (সাঃ)র সে আপোষহীন নীতি ও ইসলামের সে সংগ্রামী ইতিহাসকে তারা সুপরিকল্পিত ভাবে আড়াল করতে চায়। নামায-রোযা, হজ-যাকাতের বাইরেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও আইন-আদলতের সংস্কারে ঈমানদারের যে গুরুতর দায়ভার রয়েছে সেটিকেও ভূলিয়ে দিতে চায়।

ইসলামের আক্বিদা-বিশ্বাস ও জিহাদী সংস্কৃতি আজ এভাবেই দেশে দেশে শত্রুপক্ষের হামলার শিকার। তাদের লক্ষ্য, মহান আল্লাহর কোরআনী নির্দেশের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে বিদ্রোহী করা। বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য বিপদের কারণ হলো, এরূপ হামলার মুখে দেশটির ভৌগলিক সীমান্তের ন্যায় সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক সীমান্ত আজ অরক্ষিত। অথচ মুসলমানদের দায়িত্ব শুধু দেশের সীমান্ত পাহারা দেওয়া নয়। বরং অতিগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, চেতনার রাজ্য পাহারা দেওয়া। এবং সেটি সুস্থ্য ঈমান-আক্বিদা ও ইসলামি সংস্কৃতি গড়ে তোলার স্বার্থে। সীমান্ত পাহারায় অবহেলা হলে অনিবার্য হয় পরাজয় ও গোলামী। তখন বিপন্ন হয় জানমাল ও ইজ্জত-আবরু। যেমনটি ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে হয়েছিল। সে পরাজয়ের ফলেই মুসলমানদের জীবনে নেমে এসেছিল ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের দাসত্ব। আর সামরিক ও রাজনৈতিক পরাজয় একাকী আসে না। আসে অর্থনৈতিক দুর্গতি,আসে দুর্ভিক্ষ। তাই পলাশীর পরাজয়ের পর এসেছিল ছিয়াত্তরের মনত্ত্বর। সে দুর্ভিক্ষে বাংলার বহু লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল, যার অধিকাংশই ছিল মুসলমান। একই ভাবে নেমে এসিছিল ১৯৭৪য়ের দুর্ভিক্ষ। একই রূপ ভয়ানক পরিণতি নেমে আসে সাংস্কৃতিক যুদ্ধে পরাজিত হলে। তখন অসম্ভব হয় সুস্থ্য ঈমান-আক্বিদা নিয়ে বেড়ে উঠা। আর মুসলমানের কাছে জানমালের চেয়ে ঈমান ও আক্বিদার গুরুত্ব কি কম? ঈমান নিয়ে বাঁচা অসম্ভব হলে পণ্ড হয় সমগ্র জীবনের বাঁচাটাই। তখন অনিবার্য করে জাহান্নামের আযাব।

 

শ্রেষ্ঠ জিহাদ

ভৌগলিক সীমান্তকে সুরক্ষিত করার চেয়েও তাই গুরুত্বপূর্ণ হলো ঈমান-আক্বিদার সীমান্তকে সুরক্ষিত করা। শয়তানী শক্তির সবচেয়ে বিনাশী হামলা হয় চেতনার এ মানচিত্রে। এটি অধিকৃত হলে দেশ দখল অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। প্রতিটি ঈমানদারকে তাই সে হামলার বিরুদ্ধে লাগাতর জিহাদ করতে হয়। সশস্ত্র যুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে অন্ধ-বধির বা পঙ্গু ব্যক্তির নিষ্কৃতি আছে। কিন্তু চেতনার মানচিত্রে শয়তানী শক্তির আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক হামলার বিরুদ্ধে যে লাগাতর জিহাদ তা থেকে সামান্য ক্ষণের নিষ্কৃতি নেই। এ জিহাদকেই ইসলামে ‌জিহাদে আকবর বা শ্রেষ্ঠ জিহাদ বলা হয়েছে। রাজনৈতিক বা সামরিক ক্ষেত্রের লড়াইটি আসে তার পরে। বদর, ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধের আগে তেরটি বছর ধরে এ জিহাদ লাগাতর চলেছে মক্কায়। মুসলমানের চেতনা রাজ্যের ময়দানকে সুরক্ষিত রাখার স্বার্থেই অপরিহার্য হলো মুসলিম ভূমির ভৌগলিক মানিচিত্রকে সুরক্ষিত করা।

শুধু ঘরবাঁধা, চাষাবাদ করা বা কলকারখানা গড়াই একটি জনগোষ্টির বেঁচে থাকার জন্য সবকিছু নয়। শুধু পনাহারে জীবন বাঁচে বটে, তাতে ঈমান বাঁচে না। এমন বাঁচার মধ্য দিয়ে সিরাতুল মোস্তাকিমও জোটে না। তখন যা জুটে তা হলো পথভ্রষ্টতা। সে পথভ্রষ্টতায় বিপদাপন্ন হয় আখেরাতের জীবন। ইহকাল ও পরকাল বাঁচাতে এজন্যই একজন চিন্তাশীল মানুষকে বেড়ে উঠতে হয় জীবন-বিধান, মূল্যবোধ, জীবন ও জগত নিয়ে একটি সঠিক ধারণা নিয়ে। মুসলমানের কাছে সে জীবন-বিধান হলো ইসলাম। আর নিত্য দিনের বাঁচবার সে প্রক্রিয়া হলো ইসলামী সংস্কৃতি। নামায-রোযা, হজ-যাকাত এবং জিহাদ হলো একজন ঈমানদারের ইবাদতের প্রক্রিয়া। আর সংস্কৃতি হলো এ জগতে বাঁচবার বা জীবনধারনের প্রক্রিয়া। ইসলামি পরিভাষায় এ প্রক্রিয়া হলো তাহজিব। আরবী ভাষায় তাহজিবের অর্থ হলো,ব্যক্তির কর্ম,রুচী, আচার-আচারণ, পোষাক-পরিচ্ছদ ও সার্বিক জীবন যাপনের প্রক্রিয়ায় পরিশুদ্ধি করণের প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ রিফাইনড হয় তথা সুন্দরতম হয়। দিন দিন সুন্দরতম হয় তার রুচীবোধ, আচার-আচরণ, কাজকর্ম ও চরিত্র। তাই মুসলমানের ইবাদত ও সংস্কৃতি -এ দুটোকে পৃথক করা যায় না। উভয়ের মধ্যেই প্রকাশ পায় আল্লাহতায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া গভীর প্রেরণা ও প্রচেষ্টা। পাখি যেমন তার দুটো ডানার একটিকে হারালে উড়তে পারে না, ঈমানদারও তেমনি আল্লাহর ইবাদত ও ইসলামী সংস্কৃতিও একটি হারালে মুসলমান রূপে বেড়ে উঠতে পারে না। তাই মুসলমানগণ যেখানে রাষ্ট্র গড়েছে সেখানে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসাই গড়েনি, ইসলামি সংস্কৃতিও গড়েছে। একটির পরিশুদ্ধি ও শক্তি আসে অপরটি থেকে। মোমেনের মূল্যবোধ, রুচী্বোধ, পানাহার, পোষাকপরিচ্ছদ, অপরের প্রতি ভালবাসার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় তার আল্লাহভীরুতা। অন্যের কল্যাণে সচেষ্ট হয় স্বার্থ চেতনায় নয়, বরং আল্লাহর কাছে প্রিয়তর হওয়ার চেতনায়। এ হলো তার সংস্কৃতি। এমন সংস্কৃতি থেকে সে পায় ইবাদতের স্পিরিট। ঈমানদারে চিন্তুা ও কর্মে এভাবেই আসে পবিত্রতা -যা একজন কাফের বা মোনাফিকের জীবনে কল্পনাও করা যায় না। মুসলিম সমাজে এভাবেই আসে শান্তি, শৃঙ্খলা ও শ্লিলতা। অথচ সেক্যুলার সমাজে সেটি আসে না। সেক্যুলার সমাজে যেটি প্রবলতর হয় সেটি পার্থিব স্বার্থ হাসিলের প্রেরণা। মানুষ এখানে জীবনের উপভোগে স্বেচ্ছাচারি হয়। সে স্বেচ্ছারকে তারা ব্যক্তি-স্বাধীনতার লেবাস পড়িয়ে জায়েজ করে নিতে চায়। সেক্যুলার সমাজে পতিতাবৃত্তি, ব্যভিচার, সমকামিতা, অশ্লিলতা, মদ্যপাণের ন্যায় নানাবিধ পাপাচার বৈধ্যতা পায় তো জীবন উপভোগের এমন স্বেচ্ছাচারি প্রেরণা থেকেই। ফলে সেক্যিউলারিজম যেখানে প্রবলতর হয় সেখানে পাপাচারেও প্লাবন আসে।

মুসলমান ইবাদতে প্রেরণাও পায় তার সংস্কৃতি থেকে। ফলে স্কুল-কলেজ বা মাদ্রাসায় না গিয়েও মুসলিম সমাজে বসবাসকারি যুবক তাই মসজিদে যায়,নামায পড়ে,রোযা রাখে এবং মানুষের কল্যাণ সাধ্যমত চেষ্টাও করে। সীমান্তের প্রতিরক্ষায় বা শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় জিহাদের ময়দানেও হাজির হয়। একাজে শুধু শ্রম-সময়-মেধা নয়, জানমালের কোরবানীও দেয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসার ডিগ্রিধারি না হয়েও নিজেকে বাঁচায় বেপর্দা,ব্যাভিচার,অশ্লিলতা,চুরি-ডাকাতি,সন্ত্রাস-কর্ম ও নানা বিধ পাপাচার থেকে। প্রাথমিক কালের মুসলমানগণ যে মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিতে পেরেছিলেন সেটি এজন্য নয় যে সেদিন বড় বড় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসা ছিল। বরং তখন প্রতিটি ঘর পরিণত হয়েছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠান। সমগ্র রাষ্ট্র জুড়ে গড়ে উঠেছিল ইসলামী সংস্কৃতির বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। সে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেদিনের মুসলমানেরা উন্নত মানব রূপে বেড়ে উঠতে পেরেছিলেন।

 

অধিকৃত শিক্ষা ও সংস্কৃতির ভূমি

বাংলাদেশের ন্যায় অধিকাংশ মুসলিম দেশের আজকের বড় সমস্যা এ নয় যে, দেশগুলি অধিকৃত হয়েছে। বরং সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং সে সাথে ভয়ানক বিপদের কারণ হলো,দেশগুলির সাংস্কৃতিক সীমান্ত বিলুপ্ত হয়েছে এবং তা অধিকৃত হয়েছে ইসলামের শত্রুপক্ষের দ্বারা। দেশের সীমান্ত বিলুপ্ত না হলেও মুসলিম দেশগুলির সংস্কৃতির ময়দান শত্রু পক্ষের দখলে গেছে। ফলে এদেশগুলিতেও তাই হচ্ছে যা কাফের কবলিত একটি দেশে হয়ে থাকে। মুসলিম দেশের সংস্কৃতিও পরিনত হয়েছে মানুষকে আল্লাহর অবাধ্য রূপে গড়া তোলার ইন্সটিটিউশনে। এর ফলে বাংলাদেশের হাজার হাজার মুসলিম সন্তান মসজিদে না গিয়ে হিন্দুদের ন্যায় মঙ্গলপ্রদীপ হাতে নিয়ে শোভাযাত্রা করছে। কপালে তীলক পড়ছে,থার্টি ফাষ্ট নাইটে অশ্লিল নাচগানও করছে। এরাই শয়তানের পক্ষে লড়াকু সৈনিক, তাদের  যুদ্ধাংদেহী রূপ শরিয়তের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে।

ব্যক্তির জীবনে প্রতিটি পাপ, প্রতিটি দুর্বৃত্তি, আল্লাহর হুকুমের প্রতিটি অবাধ্যতাই হলো আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা প্রকাশ পায় বেপর্দা, ব্যাভিচার, অশ্লিলতা, নাচগান, মদ্যপান, মাদকাশক্তি,সন্ত্রাস, দূর্নীতি ইত্যাদীর ব্যাপক বৃদ্ধিতে। জাতীয় জীবনে সেটি প্রকাশ পায় দেশে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা, সূদমূক্ত ব্যাংক ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের মত একটি মুসলিম দেশ আল্লাহর বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহে সমগ্র বিশ্বমাঝে একবার নয়, ৫ বার শিরোপে পেয়েছে। তাদের সে মহাবিদ্রোহটি ঘটেছে আল্লাহর নির্দেশিত সুনীতি প্রতিষ্ঠার হুকুমের অবাধ্যতা এবং সর্বস্তরে দূর্নীতি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এরূপ শিরোপা লাভই কি বলে দেয় না দেশটির মানুষের জীবনযাত্রার প্রক্রিয়া তথা সংস্কৃতি কতটা অসুস্থ্য ও বিদ্রোহাত্মক? এবং সাংস্কৃতিক যুদ্ধে ইসলামের পক্ষের শক্তি কতটা পরাজিত?

ব্যক্তির সংস্কৃতির পরিচয় মেলে পোষাক-পরিচ্ছদ বা পানাহার থেকে নয়। বরং কীরূপ দর্শন বা চেতনা নিয়ে সে বাঁচলো তা থেকে। সংস্কৃতির মূল উপাদান হলো এই দর্শন। বস্তুত দর্শনই মানুষকে পশু থেকে পৃথক করে। নাচগান তো পশুপাখিও করে। কিন্তু তাতে কোন দর্শন থাকে না। তাই পশুপাখির নাচে-গানে কোন সমাজই সভ্যতর হয় না,সেখানে সভ্যতাও নির্মিত হয় না। তাই যে সমাজের সংস্কৃতি যতটা দর্শন-শূন্য সমাজ ততটাই মানবতা বর্জিত। সে সমাজ তখন ধাবিত হয় পশুত্বের দিকে। দর্শনই নির্ধারণ করে দেয় কে কীভাবে বাঁচবে, কীভাবে পানাহার করবে, কীভাবে জীবন যাপন করবে বা উৎসব করবে সেটি। চেতনার এ ভিন্নতার কারণেই একজন পতিতা, ঘুষখোর,সন্ত্রাসী এবং দুর্বৃত্তের বাঁচার ধরণ,পোষাক-পরিচ্ছদ, পানাহার ও উৎসবের ধরণ ঈমানদারের মত হয় না। মুসলমানের সংস্কৃতি এজন্যই অবিশ্বাসী বা কাফেরের সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি বিশেষ বিশ্বাস বা দর্শন জন্ম দেয় একটি বিশেষ রুচী ও সে রুচীভিত্তিক অভ্যাস। সে অভ্যাসের কারণেই ব্যক্তি বেড়ে উঠে সে সংস্কৃতির মানুষ রূপে। সংস্কৃতি এভাবেই সমাজে নীরবে কাজ করে। মুসলিম সমাজ থেকে সৎ নামাযী ও রোযাদারের পাশাপাশী আপোষহীন মোজাহিদ বের হয়ে আসে তা তো সংস্কৃতির সে ইন্সটিটিউশন সক্রিয় থাকার কারণেই। যেখানে সেটি নেই, বুঝতে হবে সেখানে সে পূণ্যময় সংস্কৃতিও নাই।

মুসলমানদের শক্তির মূল উৎস তেল-গ্যাস নয়, জনশক্তিও নয়। সে শক্তি হলো কোরআন ভিত্তিক দর্শন ও সে দর্শন-ভিত্তিক সংস্কৃতি। এজন্যই শত্রুপক্ষের আগ্রাসনের শিকার শুধু মুসলিম দেশের ভূগোল নয়, বরং মূল টার্গেট হলো ইসলামি দর্শন ও সংস্কৃতি। তাই পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ বাংলাদেশের মত দেশে বোমা বা যুদ্ধ বিমান নিয়ে হাজির হয়নি। হাজির হয়েছে সাংস্কৃতিক প্রকল্প নিয়ে। বাংলাদেশের হাজার হাজার এনজিওর উপর দায়িত্ব পড়েছে সে প্রকল্পকে কার্যকর করা। দেশের সংস্কৃতিকে তারা এভাবে ইসলামের শিক্ষা ও দর্শন থেকে মূ্ক্ত করতে চাচ্ছে। রাস্তায় মাটি কাটা ও তূত গাছ পাহাড়া দেওয়াকে মহিলার ক্ষমতায়ন বলে এসব এনজিওগুলো তাদেরকে বেপর্দা হতে বাধ্য করছে। অপর দিকে মাইক্রোক্রেডিটের নামে সাধারণ মানুষকে সূদ দিতে ও সূদ খেতেও অভ্যস্থ করছে। অথচ সূদ খাওয়া বা সূদ দেওয়া –উভয়ই হলো আল্লাহতায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ। ডক্টর ইউনুসকে পাশ্চাত্য মহল নোবেল প্রাইজ দিয়েছে। সেটি এজন্য নয় যে, বাংলাদেশ থেকে তিনি দারিদ্র্য নির্মূল করেছেন। বরং দেশে যতই বাড়ছে গ্রামীন ব্যাংক, ব্রাক বা সূদ ভিত্তিক মাইক্রোক্রেডিট এনজিওর শাখা ততই বাড়ছে দারিদ্র্য। ডক্টর ইউনুস নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন এজন্য যে, আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে বিদ্রোহ করতে তিনি অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছেন। এত বড় সাফল্য ইংরেজগণ তাদের ১৯০ বছরের শাসনেও অর্জন করতে পারিনি। ফলে শুধু নোবেল পুরস্কার নয়, এর চেয়ে কোন বড় পুরস্কার থাকলেও তারা তাকে দিত।

 

লক্ষ্য ইসলামি সংস্কৃতির নির্মূল

ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী কোয়ালিশনের মূল এজেন্ডাটি কি সেটি বুঝা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আফগানিস্তান দখল ও সেখানে চলমান কার্যক্রম থেকে। পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ সেখানে মুসলিম সংস্কৃতির বিনাশে হাত দিয়েছে। আফগানিস্তানের অপরাধ, অতীতে দেশটির জনগণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের ন্যায় দুটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করেছে। এবং সেটি কোন জনশক্তি, সামরিক শক্তি বা অর্থনৈতিক শক্তির বলে নয়, বরং ইসলামি দর্শন ও সে দর্শন-নির্ভর আপোষহীন জিহাদী সংস্কৃতির কারণে। সে অভিন্ন দর্শন ও দর্শনভিত্তিক সংস্কৃতির বলেই তারা আজ  মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্রদের পরাজিত করতে চলেছে। ফলে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ সে দর্শন ও সে দর্শন-ভিত্তিক সংস্কৃতির নির্মূলে করতে চায়। এবং সে বিনাশী কর্মের পাশাপাশি বিপুল বিণিয়োগ করছে সেদেশে সেক্যুলার দর্শন ও সেক্যুলার সংস্কৃতির নির্মানে। এটিকে তারা বলছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা অবকাঠামোর নির্মান। পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তুলছে অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। আফগানিস্তানের শিশুরা এখনও নানা রোগভোগে লাখে লাখে মারা যাচ্ছে। কিন্তু তা থেকে বাঁচানোয় আগ্রহ তাদের নেই, অথচ শত শত মিলিয়ন ডলার খরচ করছে তাদের নাচগান শেখাতে।

বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিশরের মত দেশে অতীতে একই রূপ স্ট্রাটেজী নিয়ে কাজ করেছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকেরা। এদেশগুলির উপর তাদের দীর্ঘ শাসনমামলে তেমন কোন শিল্প কলকারখানা বা প্রযুক্তি গড়ে না উঠলেও তারা সে সব দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সেক্যুলার করেছিল। ফলে এনেছে সাংস্কৃতিক জীবনে প্রচন্ড বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি। সেক্যুলারলিজমের অভিধানিক অর্থ হলো ইহজাগতিকতা। সেক্যুলারিজমের অর্থ, ব্যক্তি তার কাজ-কর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে প্রেরণা পাবে ইহজাগতিক আনন্দ-উপভোগের তাগিদ থেকে, ধর্ম থেকে নয়। এ উপভোগ বাড়াতেই সে নাচবে, গাইবে, বেপর্দা হবে, অশ্লিল নাটক ও ছায়াছবি দেখবে। মদ্যপান করবে এবং ব্যাভিচারিতেও লিপ্ত হবে। উপার্জন বাড়াতে সে সূদ খাবে এবং ঘুষও খাবে। এগুলো ছাড়া তাদের এ পার্থিব জীবন আনন্দময় হয় কি করে? তাই সেক্যিউলারিজম বাড়লে এগুলো বাড়বে অনিবার্য কারণেই। অপর দিকে ধর্মপালনকে বলেছে মৌলবাদী পশ্চাদ-পদতা ও গোঁড়ামী।

মুসলিম দেশে এমন চেতনা ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত হলে বিলুপ্ত হয় জনগণের মন থেকে আল্লাহতায়ালার ভয়। মুসলমানগণ তখন ভূলে যায় নিজেদের ঈমানী দায়বদ্ধতা। বরং বাড়ে মহান আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ফলে বাংলাদেশ, মিশর, পাকিস্তান বা তুরস্কের মত দেশে আল্লাহর আইন তথা শরিয়ত প্রতিষ্ঠা রুখতে কোন কাফেরকে অস্ত্র ধরতে হয়নি। সেকাজের জন্য বরং মুসলিম নামধারি সেক্যুলারগণই যথেষ্ঠ করিৎকর্মা প্রমাণিত হয়েছে। ইসলামের জাগরণ ও মুসলিম শক্তির উত্থান রুখার লক্ষ্যে আজও দেশে দেশে পাশ্চত্যের অনুগত দাস গড়ে তোলার এটিই সফল মডেল। মার্কিন দখলদার বাহিনী সেটিরই বাস্তবায়ন করছে আফগানিস্তানে। এ স্ট্রাটেজীক কৌশলটির পারঙ্গমতা নিয়ে ব্রিটিশ শাসকচক্রের মনে কোন রূপ সন্দেহ ছিল না। যেখানে অধিকার জমিয়েছে সেখানেই এরূপ সেক্যুলারদেরকেই সযত্নে গড়ে তুলেছে। তাদের সংখ্যা পর্যাপ্ত সংখ্যায় বাড়াতে যেখানে দেরী হয়েছে সেদেশের স্বাধীনতা দিতেও তারা বিলম্ব করেছে। সে ব্রিটিশ পলিসির পরিচয়টি মেলে মিশরে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিনিধি লর্ড ক্রোমারের লেখা থেকে। তিনি লিথেছেন,“কোন ব্রিটিশ উপনিবেশকে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রশ্নই উঠেনা যতক্ষণ না সে দেশে এমন এক সেক্যুলার শ্রেণী গড়ে না উঠে যারা চিন্তা-চেতনায় হবে ব্রিটিশের অনুরূপ।” ব্রিটিশ পলিসি যে এক্ষেত্রে কতটা ফলপ্রসু হয়েছে তার প্রমাণ মিলে বাংলাদেশের মত সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর প্রশাসন, রাজনীতি, সেনাবাহিনী ও বিচার ব্যবস্থায় সেক্যুলার ব্যক্তিদের প্রবল আধিপত্য দেখে। আজও আইন-আদালতে ব্রিটেশের প্রবর্তিত পেনাল কোড। বাংলাদেশের সেক্যুলার সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাগণ মুসলিম দেশের জনগণের রাজস্বের অর্থে প্রতিপালিত হলে কি হবে, দেশে যারা শরিয়ত বা আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠা চায় তাদেরকে তারা ব্রিটিশদের ন্যায়ই শত্রু মনে করে। আর বিশ্বস্থ্য আপনজন মনে করে ভিন্ দেশী কাফেরদের। এদের কারণেই মুসলিম দেশে হামিদ কারজাইয়ের মত দাস পেতে ইসলারেম শত্রুপক্ষের কোন বেগ পেতে হয় না।

 

বিদ্রোহী করা হচ্ছে সংস্কৃতির নামে

ইসলামি দর্শন থেকে দূরে সরানো এবং মগজে সেক্যুলার চেতনার পরিচর্যাকে তীব্রতর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের মত দেশে সেক্যুলার দিনক্ষণকে ইতিহাস থেকে খুঁজে বের করে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিচ্ছে। এরই উদাহরণ, বাংলাদেশের মত দেশে বসন্তবরণ বা নববর্ষের দিন উদযাপন। নবীজীর হাদীস, মুসলমানের জীবনে বছরে মাত্র দুটি উৎসব। একটি ঈদুল ফিতর, এবং অপরটি ঈদুল আদহা বা কোরবানীর ঈদ। বাংলার মুসলমানগণ এ দুটো দিনই এতদিন ধুমধামে উদযাপন করে আসছে। বাংলার মুসলমানদের জীবনে নববর্ষের উৎসব কোন কালেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

নিজ-জীবন নিয়ে একজন মুসলমানের মূল্যায়ন আসে মহান আল্লাহর মূল্যায়ন থেকে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর নিজস্ব ঘোষণাটি হলো,“তিনিই (মহান আল্লাহতায়ালা) জীবন ও মৃত্যুকে সৃষ্টি করেছেন যেন পরীক্ষা করতে পারেন তোমাদের মধ্যে কে কর্মে উত্তম।” -সুরা মুলুক। অর্থাৎ মানুষের জন্য এ পার্থিব জীবন পরীক্ষা-কেন্দ্র মাত্র। পরীক্ষা দিতে বসে কেউ কি নাচগান করে? উৎসবে যোগ দেয়? নাচগান বা উৎসবের আয়োজন তো পরীক্ষায় মনযোগী হওয়াই অসম্ভব করে তোলে। নবীজীর হাদীস,“পানি যেমন শস্য উৎপাদন করে,গানও তেমনি মুনাফেকি উৎপন্ন করে।” মুনাফেকী তো ইসলামে অঙ্গিকার শূন্যতা,ঈমানের সাথে তার আমলের গড়মিল। তাই প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের হাতে মুসলমানদের শক্তি ও মর্যাদা বাড়লেও নাচগান বাড়েনি। সংস্কৃতির নামে এগুলো শুরু হলে যেটি বাড়ে তা হলো পথভ্রষ্টতা। তখন সিরাতুল মোস্তাকিমে পথচলাই অসম্ভব হয়ে উঠে। তাই এগুলো শয়তানের স্ট্রাটেজী হতে পারে,কোন মুসলমানের নয়।

নতুন বছর, নতুন মাস, নতুন দিন নবীজী(সাঃ)র আমলেও ছিল। কিন্তু তা নিয়ে তিনি নিজে যেমন কোনদিন উৎসব করেননি, সাহাবাগণও করেননি। অথচ তারাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়তে পেরেছিলেন। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবাগান এ ব্যাপারে অতিশয় মনযোগী ছিলেন যেন শিক্ষা ও সংস্কৃতির নামে সমাজ বা রাষ্ট্রে এমন কিছুর চর্চা না হয় যাতে সিরাতুল মোস্তাকিমে চলাই অসম্ভব হয়। এবং মনযোগে ছেদ পড়ে ধর্মের পথে পথচলায়। ড্রাইভিং সিটে বসে নাচগানে মত্ত হলে সঠিক ভাবে গাড়ী চালানো যায়? এতে বিচ্যুতি ও বিপদ তো অনিবার্য। অবিকল সেটি ঘটে জীবন চালোনার ক্ষেত্রেও। নবীজী(সাঃ)র আমলে সংস্কৃতির নামে আনন্দ উপভোগের প্রতি এত আকর্ষণ ছিল না বলেই সিরাতুল মোস্তাকিমে চলা তাদের জন্য সহজতর হয়েছিল। বরং তারা জন্ম দিয়েছিলেন মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সংস্কৃতির। সে সংস্কৃতির প্রভাবে একজন ভৃত্যও খলিফার সাথে পালাক্রমে উঠের পিঠে চড়েছেন। এবং খলিফা ভৃত্যকে উঠের পিঠে বসিয়ে নিজে রশি ধরে টেনেছেন। সমগ্র মানব ইতিহাসে এর কোন তুলনা  নেই। অথচ বাংলাদেশে আজ সংস্কৃতির নামে কি হচ্ছে? ২০১০ সালে এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা নববর্ষের কনসার্টে কী ঘটলো? যৌন ক্ষুধায় অতি উদভ্রান্ত অসংখ্য হায়েনা কি সেদিন নারীদের উপর ঝাপিয়ে পড়িনি? অসংখ্য নারী কি সেদিন লাঞ্ছিত হয়নি? কিছু কাল আগে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে ব্যান্ড সঙ্গীতের আসরে কী ঘটলো? সেদিন ধর্ষিতা হয়েছিল শত শত নারী। এটিই কি বাঙালী সংস্কৃতি? দেশের সেক্যুলার পক্ষ এমন সংস্কৃতির উৎকর্ষতা চায়?

নববর্ষ উদযাপনের নামে নারী-পুরুষদের মুখে উলকি কেটে বা নানান সাজে একত্রে রাস্তায় নামানোর রীতি কোন মুসলিম সংস্কৃতি নয়। বাঙালীর সংস্কৃতিও নয়। এমনকি বাঙালী হিন্দুদেরও নয়। নববর্ষে নামে বাংলায় বড়জোর কিছু হালখাতার অনুষ্ঠান হতো। কিন্তু কোন কালেই এদিনে কনসার্ট গানের আয়োজন বসেনি। জন্তু-জানোয়ারের প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিলও হয়নি। পাশ্চাত্যেও নববর্ষের দিনে এমন উৎসব দিনভর হয় না। বাংলাদেশে এগুলীর এত আগমন ঘটেছে নিছক রাজনৈতিক প্রয়োজনে। যুদ্ধজয়ের লক্ষ্যে অনেক সময় নতুন প্রযুক্তির যুদ্ধাস্ত্র সৈনিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। অনেক সময় তাতে বিজয়ও আসে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ সাংস্কৃতিক যুদ্ধে সংস্কৃতির নামে এসব অভিনব আয়োজন বাড়ানো হয়েছে তেমনি এক ত্বড়িৎ বিজয়ের লক্ষ্যে। তাদের লক্ষ্য নাচ-গান, কনসার্টের নামে জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো। বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ নিয়ে নতুন ঢংযের এসব আয়োজন বাড়ানো হয়েছে তেমনি এক ষড়যন্ত্রমূলক প্রয়োজনে। পাশ্চাত্যের যুবক-যুবতীদের ধর্ম থেকে দূরে টানার প্রয়োজন নেই। জন্ম থেকেই তারা ধর্ম থেকে দূরে। নাচগান, মদ, অশ্লিলতা, উলঙ্গতা ও ব্যভিচারের মধ্য দিয়েই তাদের বেড়ে উঠা। তাই নববর্ষের নামে তাদের মাঝে এ সবে অভ্যস্থ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেটির প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশে। সেটি ধর্ম থেকে ও নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরানোর লক্ষ্যে। এসবের চর্চা বাড়াতে কাজ করছে প্রচুর দেশী-বিদেশী এনজিও। এমন অনুষ্ঠানে বিপুল অর্থ ব্যয়ও হচ্ছে। এবং সে অর্থ আসছে বিদেশীদের ভান্ডার থেকে। এভাবে নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশার পাশপাশি অশ্লিলতারও সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এবং লুপ্ত করা হচেছ ব্যভিচার ও অশ্লিলতাকে ঘৃণা করার অভ্যাস, -যা পাশ্চাত্য থেকে বহু আগেই বিলুপ্ত হয়েছে।

শুধু বাংলাদেশে নয়, অন্যান্য মুসলিম দেশেও এরূপ নববর্ষ পালনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ পাশ্চাত্য দেশ বিপুল অংকের অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। ইরানী-আফগানী-কিরগিজী-কুর্দীদের নওরোজ উৎসবের দিনে প্রেসিডেন্ট ওবামা বিশেষ বানীও দিয়েছে। তবে নববর্ষের নামে বাংলাদেশে ইসলামের শত্রুপক্ষের বিণিয়োগের মাত্রাটি আরো বিচিত্র ও ব্যাপক। এখানে বানী নয়, আসছে বিপুল বিণিয়োগ। কারণ, বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। আফগানিস্তানের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ। জনসংখ্যার ৯০% ভাগ মুসলমান, যাদের আপনজনেররা ছড়িয়ে আছে ব্শ্বিজুড়ে। ফলে এদেশে ইসলামের দর্শন প্রচার পেলে তা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। এ বিশাল জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে সেক্যুলার সংস্কৃতিতে বশ করানো তাদের কাছে তাই অতিগুরুত্বপূর্ণ। তারা চায় এ পৃথিবী একটি মেল্টিং পটে পরিণত হোক। আলু-পটল, পেঁয়াজ-মরিচ যেমন চুলার তাপে কড়াইয়ে একাকার হয়ে যায়, তেমনি বিশ্বের সব সংস্কৃতির মানুষ একক সংস্কৃতির মানুষের পরিণত হোক। এভাবে নির্মিত হোক গ্লোবাল ভিলেজ। আর সে গ্লোবাল ভিলেজের সংস্কৃতি হবে পাশ্চাত্যের সেক্যুলার সংস্কৃতি। এজন্যই বাংলাদেশে নারী-পুরুষকে ভ্যালেন্টাইন ডে, বর্ষপালন,মদ্যপান, অশ্লিল নাচ, পাশ্চাত্য ধাঁচের কনসার্টে অভ্যস্থ করায় এসব এনজিওদের এত আগ্রহ। তারা চায় তাদের সাংস্কৃতিক সীমানা বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশের প্রতি বসতঘরের মধ্যেও বিস্তৃত হোক। তাই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সীমানা আজ বিলুপ্ত।

 

সামনে আরো বিপদ

সামনে আরো বিপদ। কিন্তু আরো বিপদের কারণ,এতবড় গুরুতর বিষয় নিয়েও জনগণের মাঝে এ নিয়ে ভাবনা নেই। কোন পরিবারে কেউ মৃত্যুশর্যায় পড়লে সে পরিবারে দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। আর এখন শয্যাশায়ী হলো সমগ্র বাংলাদেশ ও তার সংস্কৃতি। অথচ ক’জন আলেম, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ,শিক্ষাবিদ ও লেখক এ বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। ক’জন মুখ খুলেছেন বা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন? ১৭৫৭ সাল থেকে বাংলার মুসলমান কি সামান্যতমও সামনে এগিয়েছে? তখন সে যুদ্ধহীন নীরবরতার মাঝে প্রতিষ্ঠিত পেয়েছিল ব্রিটিশের দখলদারি। অস্তমিত হয়েছিল বাংলার মুসলমানদের স্বাধীনতা। কিন্তু সে পরাধীনতা বিরুদ্ধে কোন জনপদে,কোন গ্রাম-গঞ্জে কোন রূপ প্রতিরোধ বা বিদ্রোহের ধ্বনি উঠেছিল -সে প্রমাণ খুব একটা বেশী নেই। শহীদ তিতুমীর ও মজনু শাহদের সংখ্যা অতি সামান্য। বরং যে যার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ততা থেকেছে। দেশের স্বাধীনতা নিয়ে কিছু ভাবা বা কিছু করার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। অথচ শত্রুর হামলার মুখে প্রতিরোধের এ দায়ভার প্রতিটি মুসলমানের। এ কাজ শুধু বেতনভোগী সৈনিকের নয়। প্রতিটি নাগরিকের। ইসলামে এটি জিহাদ। মুসলমানদের গৌরব কালে এজন্য কোন সেনানীবাস ছিল না। প্রতিটি গৃহই ছিল সেনানীবাস। প্রতিটি যুদ্ধে মানুষ স্বেচ্ছায় সেখান থেকে নিজ খরচে যুদ্ধে গিয়ে হাজির হয়েছে। এবং সেখানে অর্থের খরচ, শ্রমের খরচ ও রক্তের পেশ করেছে। অথচ আজ সেনানীবাসের পর সেনানীবাস বেড়েছে অথচ শত্রুর হামলার মুখে কোন প্রতিরোধ নেই। দেশের পর দেশ তাই অধিকৃত। এবং অধিকৃত মুসলিম দেশের সাংস্কৃতিও।

সাংস্কৃতিক সীমানা রক্ষার লড়ায়ে পরাজিত হলে পরাজয় অনিবার্য হয় ঈমান-আক্বীদা রক্ষার লড়ায়েও। কারণ, মুসলমানে ঈমান-আক্বীদা কখন অনৈসলামিক সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠে না। মাছের জন্য যেমন পানি চাই, ঈমান নিয়ে বাঁচার জন্যও তেমনি ইসলামি রাষ্ট্র ও ইসলামি সংস্কৃতি চাই। মুসলমান তাই শুধু কোরআন পাঠ ও নামায-রোযা আদায় করেনি,ইসলামি রাষ্ট্র এবং সে রাষ্ট্রে শরিয়ত ও ইসলামি সংস্কৃতিরও প্রতিষ্ঠা করেছে। মুসলমানদের অর্থ,রক্ত,সময় ও সামর্থের সবচেয়ে বেশী ভাগ ব্যয় হয়েছে তো ইসলামি রাষ্ট্র ও ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির নির্মানে। নামায রোযার পালন তো কাফের দেশেও সম্ভব। কিন্তু ইসলামী শরিয়ত ও ইসলামী সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও পরিচর্যা তথা ইসলামী বিধানের পূর্ণ পালন কি অমুসলিম দেশে সম্ভব? অতীতের ন্যায় আজকের মুসলমানদের উপরও একই দায়ভার। সেটি শুধু কলম-সৈনিকের নয়,প্রতিটি আলেম, প্রতিটি শিক্ষক, প্রতিটি ছাত্র ও প্রতিটি নাগরিকের উপরও। এ লড়ায়ে তাদেরকেও ময়দানে নেমে আসতে হবে। এ লড়াই হতে হবে কোরআনী জ্ঞানের তরবারী দ্বারা। নবীজী (সাঃ)র যুগে সেটিই হয়েছে। ইসলামে জ্ঞানার্জনকে এজন্যই নামায-রোযার আগে ফরয করা হয়েছে। কিন্তু সে ফরয পালনের আয়োজনই বা কোথায়? অনেকেই জ্ঞানার্জন করছেন নিছক রুটিরুজির তালাশে। ফরয আদায়ের লক্ষে নয়। প্রচন্ড শূণ্যতা ও বিচ্যুতি রয়েছে জ্ঞানার্জনের নিয়তেই। ফলে সে জ্ঞানচর্চায় তাদের রুটি-রুজী জুটছে ঠিকই, কিন্তু সে জ্ঞানার্জনে ফরয আদায় হচ্ছে না। এবং জিহাদের ময়দানে বাড়ছে না লোকবল। বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য এটি এক বিপদজনক দিক। আগ্রাসী শত্রুর হামলার মুখে অরক্ষিত শুধু দেশটির রাজনৈতিক সীমান্তুই নয়,বরং প্রচন্ড ভাবে অরক্ষিত দেশের সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক সীমান্তও। দেশ তাই দ্রুত ধেয়ে চলেছে সর্বমুখি পরাজয় ও প্রচন্ড বিপর্যের দিকে। (নতুন সংস্করণঃ ৯/০৬/১৩)

                       

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *