তালেবান-মার্কিন আলোচনাঃ প্রস্তুতি কি নতুন যুদ্ধের?
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on April 13, 2019
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, মুসলিম জাহান
- No Comments.
আসন্ন মার্কিনী পরাজয় এবং নতুন স্ট্রাটেজী
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কখনোই যুদ্ধ ছাড়া বাঁচে না। তাদের যুদ্ধ তাই শেষ হয় না; স্ট্রাটেজী পাল্টায় মাত্র। এবং প্রস্তুতি নেয় নতুন যুদ্ধের। আফগানিস্তানেও সেটি হতে যাচ্ছে। সেটিরই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তালেবান-মার্কিন সাম্প্রতিক আলোচনার মাঝে। মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন যুদ্ধটি ১৮ বছর ধরে চলছে আফগানিস্তানে। বিজয় লাভে মার্কিনীদের অস্ত্র, সৈন্য ও অর্থের বিনিয়োগ এ যুদ্ধে কম হয়নি। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি; বরং ধাবিত হচ্ছে অনিবার্য পরাজয়ের দিকে। মার্কিনী বাহিনী তাই দেশে ফেরার রাস্তা খুঁজছে। তবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় এখন যুদ্ধের বদলে তালেবানদের সাথে আলোচনার গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রণীত হচ্ছে নতুন স্ট্রাটেজী। উনবিংশ শতাব্দীতে আফগান ভূমিতে দু্ইবার পরাস্তু হয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনী। আশির দশকে পরাজিত হয়েছে সোভিয়েত রাশিয়া। এবং এখন পরাজয়ের দিন গুনছে আমেরিকা। লক্ষ্যণীয় হলো, প্রতিবারই এ বিজয় এসেছে জনগণের মধ্য থেকে উত্থিত মুজাহিদদের হাতে, রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর হাতে নয়। সমগ্র ইতিহাসে আফগান জনগণের এ এক বিরল কৃতিত্ব। বিশ্বের কোন দেশের জনগণই এভাবে তিনটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করেনি। দেশটি পরিণত করেছে বিদেশী শক্তির কবরস্থানে।
আফগান ভূমিতে মার্কিন হামলার মূল কারণ ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টম্বরের হামলা। ঐদিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূমিতে বিশেষ করে নিউওর্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং ওয়াশিংটনের পেন্টাগণে বিমান নিয়ে আঘাত হানায় প্রায় তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তবে সবচেয়ে বেশী আহত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আত্মসম্মান ও অহংবোধ। মার্কিনীদের ইতিহাস তো অন্য দেশে হামলা, ধ্বংস এবং গণহত্যা ঘটানো। অন্যরা এভাবে ভিতরে ঢুকে মার্কিনীদের হত্যা কররে – সেটি চিন্তার বাইরে। বদলা নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ পাগল হয়ে উঠে এবং যুদ্ধ শুরু করে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে –যদিও কোন আফগান সে হামলায় জড়িত ছিল না। তালেবানদের অপরাধ, তারা আশ্রয় দিয়েছিল আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে। তালেবান সরকারের দ্রুত পতন ঘটাতে পারলেও বিগত ১৮ বছর পরও যুদ্ধটি শেষ হওয়ার নাম নিচ্ছে না। ইতিমধ্যে বহুশত মার্কিনী সৈনিককে লাশ হতে হয়েছে, এবং মার্কিন কোষাগার থেকে গচ্চা গেছে বিপুল অর্থ। মার্কিন সরকার দ্রুত যুদ্ধজয়ে ৪০টির বেশী দেশ থেকে সৈনিক জোগার করেছিল, কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। শহরগুলি দখলে নিলেও আফগানিস্তানের শতকরা ৭০ ভাগ ভূমি থেকেছে তাদের কন্ট্রোলের বাইরে। এখনো ১৪ হাজার মার্কিন ও ন্যাটো সৈনিকের অবস্থান রয়েছে আফগানিস্তানে; কিন্তু ফলাফল শূন্যের কোঠায়।
কিন্তু পরিস্থিতি এখন নতুন মোড় নিচ্ছে। যে তালেবানদের নির্মূলের লক্ষ্যে যুদ্ধ শুরু করেছিল -এখন নির্মূলের সে চিন্তা বাদ দিয়ে তাদের সাথে আলোচনায় বসছে। আলোচনা সফল করার লক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে যালমায় খলিলযাদকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। খলিলযাদ নিজেও একজন আফগান বংশোদ্ভুদ মার্কিন নাগরিক; জর্জ বুশের আমলে সে ছিল জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি। আলোচনার কেন্দ্রস্থল রূপে বেছে নেয়া হয়েছে কাতারের রাজধানী দোহাকে। মার্কিনীদের নির্দেশেই কাতার সরকার তালেবানদের অনুমতি দিয়েছে দোহাতে দফতর খোলার। অপরদিকে তারা পাকিস্তানকে বাধ্য করা হয়েছে তালেবান নেতা মোল্লা আব্দুল গনি বারাদারকে জেল থেকে মুক্তি দিতে। গতি ফেব্রেয়ারিতে দোহা’তে মোল্লা বারাদারের সাথে যালমায় খলিলযাদের প্রথম বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে উভয়েই আলোচনার অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা আফগানিস্তান থেকে শীঘ্রই সৈন্য অপসারণ করবে। মার্কিনীদের মূল দাবী, কোন মার্কিন বিরোধী শক্তির জন্য আফগানিস্তান ভূমিকে ব্যবহার করতে দেয়া যাবে না। অপরদিকে তালেবানদের দাবী, আফগান ভূমিতে কোন মার্কিন বা ন্যাটো বাহিনীর ঘাঁটি ও সৈন্য থাকতে পারবে না।
তবে এ দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় প্রচণ্ড অখুশি হলো আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও তার নেতৃত্বাধীন সরকারের শরীক দলগুলি। তাদের ভয়, অস্তিত্ব বিলুপ্তির। সে ভয়ের পিছনে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। ১৯৮৮ সালে আফগান মুজাহিদদের সাথে চুক্তি ছাড়াই সোভিয়েত রাশিয়ার সৈন্য অপসারণে বাধ্য হয়। তার পরিণতিতে ১৯৯২ সালে সোভিয়েত রাশিয়া সমর্থিত সরকারের পতন ঘটেছিল এবং প্রেসিডেন্ট নজিবুল্লাহকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কাবুলের রাস্তায় হত্যা করা হয়েছিল। সে রকম পরিণতি যে বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিদেরও হতে পারে –সেটিই মূল আশংকা। তাছাড়া প্রশ্ন হলো, তালেবানদের পরাজিত করার সামর্থ্য যেখানে মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্যদেরই নাই, সে সামর্থ্য আফগান সরকার পায় কি করে? নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই আলোচনার বৈঠকে তারা উপস্থিত থাকতে চায়। কিন্তু তালেবান নেতৃবৃন্দ আলোচনায় আফগান সরকারকে অংশীদার করতে রাজী নয়। তাদের যুক্তি, চাকর-বাকরদের সাথে আলাপ করে কী লাভ? আলোচনা তো হবে মূল কর্তা-ব্যক্তির সাথে। আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের মূল কর্তা হলো দখলদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
কেন এ আলোচনা?
প্রশ্ন হলো, তালেবানদের নির্মূলের উদ্দেশ্য নিয়ে যে যুদ্ধের শুরু ১৮ বছর আগে, হঠাৎ করে তাদের সাথে আলোচনায় আগ্রহ কেন? বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সেটি বুঝতে হলে আফগানিস্তানে বর্তমান পরিস্থিতিকে বুঝতে হবে। কয়েক বছর হলো আফগানিস্তানের রণাঙ্গণে হাজির হয়েছে আইএস তথা ইসলামী স্টেট, তাতেই আমূল পাল্টে গেছে আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ২০১৫ সালের জানুয়ারীতে আফগানিস্তানকে ইসলামী স্টেটের খোরাসান প্রদেশে অংশ রূপে ঘোষণা দেয়া হয়। এতেই শুধু মার্কিন শিবিরে নয়, তালেবান শিবিরেও নতুন কম্পন শুরু হয়। তালেবানগণ জিহাদের কথা বল্লেও তাদের সে লড়াই আফগানিস্তানের ভৌগলিক সীমানা দ্বারা সীমিত। যে চেতনা নিয়ে তারা যুদ্ধ লড়ছে সেটি নির্ভেজাল ইসলামী নয়, তাতে রয়েছে গোত্রগত, ভাষাগত ও ভৌগলিক চেতনার মিশ্রন। তাদের অধিকাংশ যোদ্ধাই হলো পশতু ভাষী আফগানী। তাদের লক্ষ্য আফগানিস্তানে তাদের নিজেদের শাসনকে প্রতিষ্ঠা দেয়া। কিন্তু ইসলামী স্টেটের রাজনৈতিক দর্শনে ও লড়াইয়ে ভৌগলিক বা ভাষাগত সীমানা বলে কিছু নাই। তারা প্যান-ইসলামিক। ফলে তাদের বাহিনীতে যেমন আছে পশতু, তাজিক, উযবেক ইত্যাদি নানা ভাষার আফগানী, তেমনি আছে বিশ্বের নানা দেশ থেকে আগত মোজাহিদ। ফলে ইসলামী স্টেটের সৈনিকদের মাঝে আছে আফগানদের পাশাপাশি পাকিস্তানী, আরব, উযবেক, তাজিক, রাশিয়ান চেচেন, চীনা উইঘুর, ইত্যাদি নানা ভাষার মুসলিম। তাছাড়া শুধু আফগানিস্তানে নয়, ইসলামী স্টেট যুদ্ধ লড়ছে ইরাক, সিরিয়াসহ এশিয়া ও আফ্রিকার নানা দেশে। প্রতি দেশেই তাদের শত্রুপক্ষে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের সমর্থিত পক্ষ।
বিষয়টি আদৌ গোপন নয় যে, মার্কিনীদের কাছে স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী বন্ধু বলে কেউ নাই। তাদের নীতি প্রণোয়নে যে স্থায়ী বিষয়টি গুরুত্ব পায় তা হলো স্রেফ নিজেদের স্বার্থকে সুরক্ষা দেয়া। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাষায় সেটি হলো “আমেরিকা ফার্স্ট” তথা “প্রথম আমেরিকা” নীতি। এ নীতিটি বারাক ওবামাসহ অন্যান্য মার্কিন প্রেসিডেন্টদেরও ছিল, কিন্তু তারা সেটি প্রকাশ্যে বলতো না। আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ার উপর মার্কিনী হামলা এবং দেশ তিনটিকে তছনছ করে দেয়ার মূল লক্ষ্যটি সেখান থেকে তেল বা গ্যাস লাভ ছিল না। সেটি ছিল, বিশ্ববাসীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করা ও মার্কিন কর্তৃত্বকে বিনা প্রতিবাদে মেন নিতে বাধ্য করা। এটি প্রমাণ করা শক্তি ও কর্তৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিশ্বাসীকে দেখিয়ে দেয়া, যে কোন রাষ্ট্রকে তারা যেমন ইচ্ছামত দখলে নিতে পারে, শহরের পর শহর ধ্বংসও করতে পারে, গণহত্যা চালাতে পারে এবং গোয়ান্তোনামো বে’র জেলে নিয়ে বিনা বিচারে বছরের পর অত্যাচারও করতে পারে। সে জন্য কারো কাছে জবাবদেহীতার জন্য তারা দায়বদ্ধ নয়। জাতিসংঘের নীতিমালা বা আন্তর্জাতিক আইন মানতেও তারা বাধ্য নয়। সন্ত্রাসের আভিধানিক অর্থ হলো ত্রাস সৃষ্টিতে অস্ত্রের প্রয়োগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বিশ্বব্যাপী সেটিই করছে। অপর দিকে মার্কিনীরা যাদেরকে সন্ত্রাসী বলে তাদের ত্রাস সৃষ্টির সামর্থ্য তো সীমিত। বড় জোর কিছু ব্যক্তিকে হত্যা বা কিছু দফতর ও স্থাপনাকে বিধ্বস্ত করে। অথচ বহু দেশ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে মার্কিনী সন্ত্রাসে। সে সন্ত্রাস থেকে ইরাক ও সিরিয়ার মোসল, রামাদী, ফালুজা, রাক্কা, কোবানি, দেরাজোরের খুব কম গৃহই অক্ষত থেকেছে। সন্ত্রাসে সে ভয়ানক সামর্থ্য দেখাতেই জাপানের উপর তারা পারমানবিক বোমা ফেলেছিল। পাশ্চাত্য মিডিয়ার বড় সফলতাটি হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দেশ দখল, দেশ ধ্বংস এবং লক্ষ লক্ষ নরনারী হত্যার সন্ত্রাসকে বহুলাংশেই লুকাতে পেরেছে এবং সন্ত্রাস রূপে চিত্রিত করতে পেরেছে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনীদের নিজ ভিটায় ফেরার দাবী নিয়ে ইসরাইলী সীমান্তে জমায়েত ও পাথর নিক্ষেপকে।
মার্কিনীদের কাছে বড় শত্রু এখন আর তালেবান নয়, সে স্থানটি নিয়ে নিয়েছে ইসলামী স্টেট বা আইএস। মার্কিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তালেবানগণ কখনোই আফগানিস্তানের বাইরে নেয়নি। কিন্তু মার্কিন বিরোধী ইসলামী স্টেটের যুদ্ধ চলছে এশিয়া-আফ্রিকার বহুদেশ জুড়ে। দিন দিন সে যুদ্ধ আরো ছড়িয়ে পড়ছে এবং তীব্রতর হচ্ছে। ইসলামী স্টেটের যুদ্ধের সামর্থ্য যে তালেবানদের চেয়ে অধীক সেটি এমন কি মার্কিন কতৃপক্ষও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ইরাক ও সিরিয়ায়। রাজধানী কাবুল থেকে তালেবানদের হটাতে মার্কিন বাহিনীর এক সপ্তাহও লাগেনি। অথচ ৬ মাসের বেশী সময় লেগেছে ইসলামী স্টেটের হাত থেকে একমাত্র মোসল শহর নিতে। শহরটি দখলে নিতে সমগ্র শহরকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করতে হয়েছে। ছোট একটি শহর কোবানী দখলে নিতে লেগেছে মাসাধিক কাল। অবশেষে সে ক্ষুদ্র শহরটিকেও মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়েছে। একই চিত্র রাক্কা, দেরাজুর, ফালুজা, রামাদিসহ অন্যান্য শহরের ক্ষেত্রে। অথচ তালেবানদের পরাজিত করতে সেটি করতে হয়নি।
মার্কিনীদের একার পক্ষে ইসলামী স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় যে অসম্ভব –সেটি ইতিমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে যুদ্ধ ইসলামী স্টেটের বিরুদ্ধে, সেখানেই তাদের পার্টনার চাই। ইরাক এবং সিরিয়ায় এজন্যই ইরাকী এবং ইরানী শিয়াদের পাশাপাশি, কুর্দি এবং সেক্যুলার আরব গোত্রপতিদের সাথে নিতে হয়েছে। নিজেদের যুদ্ধবিমান, মিজাইল, ড্রোন, বোমায় কুলাচ্ছে না, সাথে নিতে হয়েছে রুশ, ব্রিটিশ ও ফরাসী বিমান বাহিনীকেও। একই চিত্র ঘটতে যাচ্ছে আফগানিস্তানেও। পুরাপুরি মার্কিন-নির্ভর প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সরকারকে সাথে নিয়ে ইসলামী স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় অসম্ভব। মার্কিনীরা এখন ছোট শত্রুর সাথে কোয়ালিশন গড়ে বড় শত্রুকে পরাজিত করতে চায়। একই কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার কম্যুনিস্টদের সাথে পুঁজিবাদী পশ্চিমা শক্তির আঁতাত গড়াটি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তেমনি ঘটেছে সিরিয়াতেও। ইসলামী স্টেটকে পরাস্ত করতে তারা কোয়ালিশন গড়ে কুর্দি মার্কসিস্টদের সাথে। একই কারণে মার্কিনীদের কাছে আজ জরুরী হয়ে পড়েছে তালেবানদের সাথে শুধু আপোষ করা নয়, বরং কোয়ালিশন গড়া।
“ইসলামী স্টেট” ভীতি
তাছাড়া আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের তো শেষ নাই; দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। কারণ ইসলামী স্টেট প্রতিনিধিত্ব করে একটি আদর্শের। ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামী স্টেট পরাজিত হলেও সে আদর্শের মৃত্যুর ঘটেনি। সে আদর্শের মূল কথা, সাড়ে চৌদ্দশত বছরের সনাতন ইসলামে ফিরে যাওয়া -যেখানে ভাষা, গোত্র, বা অঞ্চল ভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্রের নামে বিভক্তির দেয়াল গড়ার কোন বৈধতা নেই। বরং তা গণ্য হয় হারাম রূপে। এবং গুরুত্ব পায় প্যান-ইসলামী রাষ্ট্র গড়া -যাতে গুরুত্ব পায় শরিয়ত, হুদুদ, জিহাদ, শুরা এবং খেলাফতের ন্যায় ইসলামের মৌল বিধানগুলির প্রতিষ্টা। ইসলামের এ সনাতন আদর্শই এক কালে নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা অঞ্চলের মানুষের মনের রাজ্যে অভুতপূর্ব বিপ্লব এনেছিল এবং তাদেকে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণে নিজেদের অর্থ, রক্ত, শ্রম ও মেধার কোরবানীতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এবং তা পতন ঘটিয়েছিল তৎকালীন বিশ্বের দুই বিশ্বশক্তির। বাস্তবতা হলো, সে আদর্শ প্রবল ও অক্ষত রূপে বেঁচে পবিত্র কোরআন, হাদীস ও ইসলামের ইতিহাসের মাঝে। এবং আজও তা অসংখ্য মানুষকে কাছে টানছে। ফলে সনাতন ইসলাম নিয়ে বাঁচার সে যুদ্ধটি না থেমে বরং চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে পোলারাইজেশন হচ্ছে মুসলিম বিশ্বজুড়ে। এমন একটি সিভিলাইজেশনাল পোলারাইজেশন ও সর্বব্যাপী যুদ্ধের পূর্বভাস দিয়েছেন মার্কিন প্রফেসর হান্টিংটন তার বই “ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন” বইতে।
মার্কিনীদের জন্য বিপদের আরো কারণ, গোলাবারুদ ও মিজাইল দিয়ে মানুষ হত্যা করা যায়; শত শত শহরকেও ধ্বংস্তুপে পরিণত করা যায়। কিন্তু তাতে আদর্শ বা চিন্তাধারা বিলুপ্ত না হয়ে বরং ধারালো হয়। ফলে যুদ্ধ বেঁচে থাকে এবং সে যুদ্ধ লাগাতর সৈনিক পায়। সে যুদ্ধ একাকী লড়ার সামর্থ্য যুদ্ধ-ক্লান্ত মার্কিনীদের নাই। ফলে প্রতিদেশেই তারা পার্টনার চায়। তাছাড়া আফগানিস্তানে ইসলামী স্টেটকে পরাজিত করাটি হবে আরো কঠিন। কারণ, গেরিলা যুদ্ধের জন্য অতি উপযোগী ক্ষেত্রটি হলো পাহাড়-পর্বতে ঘিরা আফগানিস্তানের ভূ-পৃকৃতি, মরুধুসর ও গাছপালাহীন ইরাক বা সিরিয়া নয়। ট্যাংক, মিজাইল বা বিমান নিয়ে এখানে যুদ্ধজয় সম্ভব নয়। তাই মোসল, রাক্কা বা রামাদি ধ্বংসে মার্কিনীদের ৯, ৮০০ কেজি ওজনের “মাদার অব অল বোম্ব” ফেলতে হয়নি। সে কাজে দূর থেকে নিক্ষিপ্ত মিজাইলই যথেষ্ট ছিল। অথচ ১৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের “মাদার অব অল বোম্ব” ফেলেও মার্কিন বাহিনীর তেমন লাভ হয়নি। বড়জোর আফগানিস্তানের পাহাড়ে কিছু গর্ত সৃষ্টি করেছে, কিন্তু তা দিয়ে ইসলামী স্টেটের কোন ঘাটি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।
অপর দিকে আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতীক গুরুত্ব অপরিসীম। দেশটির সীমান্ত ঘিরে চীন, ইরান, পাকিস্তান,উযবেকিস্তান, তাজাকিস্তানের ন্যায় ৫টি দেশের অবস্থান। অতি নিকটেই রাশিয়ার সীমান্ত। পাশেই যুদ্ধময় কাশ্মীর। ইসলামী স্টেট আফগানিস্তানে পা জমাতে পারলে তার প্রভাব প্রতিবেশী বিশাল এলাকার উপর গিয়ে পড়বে –তা নিয়ে মার্কিন মহল চিন্তিত। তাদের ভয় এখান থেকেই অপ্রতিরোধ্য ইসলামীক সিভিলাইজেশনাল স্টেটের উদ্ভব হতে পারে। তা নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তিত শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং রাশিয়া, চীন, ইরান এবং ভারতও। সমস্যা দেখা দিয়েছে, ইসলামী স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়দায়িত্ব কে নিবে? ইসলামী স্টেটের বিরুদ্ধে নামতে হলে নামতে হয় এক অন্তহীন যুদ্ধে প্রাণদানের অঙ্গিকার নিয়ে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তো যুদ্ধ লড়তে চায় নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে। আফ্রিকার মালি থেকে ইসলামী যোদ্ধাদের হটাতে বিশ্বের আরেক প্রান্ত থেকে এসেছিল কেনাডিয়ান সৈন্য; কিন্তু নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে যুদ্ধ অসমাপ্ত রেখেই ঘরে ফিরেছে। ঘরে ফিরছে ফ্রান্সের সৈন্যরাও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কোথাও তাদের নিজেদের পদাতিক সৈন্যকে নামাতে রাজি নয়। তারা চায় অন্যরা তাদের পক্ষে লড়ে দিক। সিরিয়ায় সেটি করেছে মার্কসিস্ট কুর্দিরা। সে কাজে আফগানিস্তানে তারা তালেবানদের নামাতে চায়। এক্ষেত্রে মার্কিনীদের বড় আশাবাদটি হলো, ইসলামী স্টেটকে শুধু আমেরিকাই শত্রু মনে করে না, শত্রু মনে করে তালেবানগণও। ইসলামী স্টেটের আগমনকে তালেবানগণ দেখছে নিজেদের অস্তিত্ব বিলুপ্তির চ্যালেঞ্জ রূপে। মার্কিন-তালবান আজ যে তাড়াহুড়া -তার মূল কারণ তো উভয়ের মনে গভীর “ইসলামী স্টেট” ভীতি।
লক্ষ্যঃ বিশ্বশক্তি রূপে ইসলামের উত্থানরোধ
নিজেদের অর্থ ও রক্তের খরচ কমিয়ে স্বার্থ উদ্ধারে মার্কিনীরা চায় কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে। তাই যে সাদ্দাম হোসেনকে তারা এক সময় ইরানে বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করেছে এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে অবশেষে তারাই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং ফাঁসিতেও লটকিয়ে হত্যাও করেছে। তেমনি সিরিয়ার যে কুর্দিরা মার্কিনীদের কাছে সন্ত্রাসী রূপে গণ্য হতো, তাদেরকে কাজে লাগিয়েছে ইসলামী স্টেটের বিরুদ্ধে । ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিনীদের অভিযোগের শেষ নেই। অথচ সে ইরানকে মার্কিনীগণ ব্যবহার করেছে ২০০১ সালে আফগানিস্তান ও ২০০৩ সালে ইরাক দখলে। এবং সম্প্রতি ব্যবহার করলো সিরিয়া ও ইরাকের রণাঙ্গণে ইসলামী স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। অপরদিকে ১৯৯৬ সালে তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠার পর ইরানের শাসক মহল আফগানিস্তানকে নিজেদের জন্য বিপদ মনে করেছে। তালেবান সরকারের নির্মূলে ইরান সরকার তাই উযবেক নেতা রশিদ দোস্তামকে এবং তাজিক নেতা আহম্মদ শাহ মাসূদকে সমর্থণ দিয়েছে। এবং ২০০১ সালে মার্কিন বাহিনী যখন তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে, সে যুদ্ধে ইরান মার্কিনীদের নানা ভাবে সমর্থণ দিয়েছে। কিন্তু এখন সে ইরানই তালেবানদের সাথে কোয়ালিশ গড়তে আগ্রহী। আফগানিস্তানে ইসলামী স্টেটের আগমনের সাথে সাথে ইরানের বড় শত্রু এখন আর তালেবানগণ নয়, বরং সেটি হলো ইসলামী স্টেট। ইসলামী স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরান তাই সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিনীদের পাশে হাজির হয়েছে। ফলে আফগানিস্তানেও একই কাতারে দেখা যাবে মার্কনীদের সাথে শুধু তালেবান ও ইরানীদেরও।
তালেবানগণও জানে, আইএসের বিরুদ্ধে তাদের নিজেদের লড়াইটি এতটা সহজ হবে না। কারণ, আইএসের অধিকাংশ যোদ্ধা আফগানি। তারা তালেবানদের ঘরের খবর জানে। তাছাড়া তালেবানদের জন্য দুশ্চিন্তার বড় কারণ, অনেক তালেবান যোদ্ধা দল ছেড়ে ইতিমধ্যেই আইএসে যোগ দিয়েছে। তালেবানগণও তাই এ যুদ্ধে পার্টনার পেতে আগ্রহী। ইরান এক্ষেত্রে তাদের টার্গেট। কাতারে অবস্থিত তালেবান দফতর থেকে তাই একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি ইরানী কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করতে তেহরান যায়। অপরদিকে দুশ্চিন্তা বেড়েছে রাশিয়ারও। কারণ শত শত রাশিয়ান চেচেন ও দাগিস্তানী যুদ্ধ লড়ছে আইএসে শামিল হয়ে। রাশিয়ার ভয়, আইএস আফগানিস্তানে বিজয়ী হলে তাতে চেচেন ও দাগেস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতর হবে। সে ভয় নিয়েই রাশিয়ানরাও কোয়ালিশন গড়ছে তালেবানদের সাথে। বরং মার্কিনীদের অভিযোগ, রাশিয়া তালেবানদের অস্ত্র জোগাচ্ছে। ফলে যতই দিন যাচ্ছে আফগানিস্তানে লড়াইয়ে মেরুকরণ আরো তীব্রতর হচ্ছে। তালেবান ও মার্কিনীদের মধ্যে চলমান আলোচনায় যুদ্ধ শেষ হবে -সে সম্ভাবনা তাই কম। বরং তীব্রতর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।
কোন দেশ থেকে সৈন্য অপসারণ করলেই মার্কিনীদের যুদ্ধ শেষ হয় না। ইরাক থেকে সৈন্য অপসারণ করলেও যুদ্ধ সেখানে তাই শেষ হয়নি। যুদ্ধ করছে ইরাকীদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে। আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাই সৈন্য নামাতে হয়নি। তারা যুদ্ধ করেছে আকাশ থেকে; ব্যবহৃত হয় মিজাইল, বোমা ও ড্রোন। সে নীতিতে ইরাক ও সিরিয়ার শত শত শহর ধ্বংস ও লক্ষ লক্ষ নরনারী নিহত ও উদ্বাস্তুতে পরিণত হলেও মার্কিনীদের প্রাণ হারাতে হয়নি। সে স্ট্রাটেজী কার্যকর হতে যাচ্ছে আফগানিস্তানে। তবে সমস্যা হলো, আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়ার জন্য তো ভূমিতে বিপুল সংখ্যক লড়াকু সৈন্য চাই। সে দায়িত্ব তালেবানগণ নিলে মার্কিনীরা যে আফগানিস্তান ছাড়তে পুরাপুরি রাজী -সেটিই মার্কিনী দূত যালমাই খলিলযাদ তালেবানদের বুঝাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, তালেবানদের সে সামর্থ্য নিয়েও মার্কিনীদের প্রচুর সন্দেহ আছে। সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে আরবভূমিতে বিশ্বশক্তি রূপে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার অন্যতম কারণ, রোমান ও পারসিক –এ দু’টি বিশ্বশক্তি শাসন থেকে এ এলাকাটি ছিল মূক্ত। আফগানিস্তানকে সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক শক্তির প্রভাব বলয়ের বাইরে থাকতে দিতে রাজী নয়। ইসলাম দমনের সে দায়িত্ব পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর ঘাড়ে চাপানোর জন্য এমন কি এ প্রস্তাবও রেখেছে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে সীমান্ত বিলুপ্ত করে এক অখণ্ড রাষ্ট্র নির্মাণের। কারণ, পাকিস্তানে রয়েছে মার্সেনারী চরিত্রের নিরেট সেক্যুলার আর্মি -যারা ইসলামের প্রতিষ্ঠা রুখতে আপোষহীন। ইসলামাবাদের লাল মসজিদে বোমা বর্ষন, হাফসা মাদ্রাসা ধ্বংস এবং উজিরীস্তানে ইসলামপন্থিদের নির্মূলের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান আর্মি সে সামর্থ্য প্রমাণও করেছে। মার্কিনীদের লক্ষ্য আফগানিস্তান থেকে তেল বা গ্যাস লাভ নয়, বরং যে কোন মূল্যে রুখতে চায় ইসলামিক সিভিলাইলাইজেশনাল স্টেটের প্রতিষ্ঠা। কারণ, তেমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেলে মুসলিমগণ পরিণত হবে এক অপরাজেয় বিশ্বশক্তিতে। তাদের কথা, সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে তৎকালীন দুটি বিশ্বশক্তি -রোমান ও পারসিক সাম্রাজ্য, যেভাবে ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা রুখতে ব্যর্থ হয়েছিল সেটি তারা হতে দিবে না। কারণ, সেটি হলে বিলুপ্ত হবে তাদের নিজেদের প্রতিপত্তি। ১৩/০৪/২০১৯
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- ভারতীয় আগ্রাসনের হুমকি: বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুরক্ষা কীরূপে?
- ভারতীয় ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
- সম্প্রতি বাংলাদেশে যা দেখলাম
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018