গণতন্ত্র যেখানে গণহত্যা এবং জবরদখল যেখানে লেবারেশন
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on January 19, 2021
- Bangla Articles, মুসলিম জাহান
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
আগ্রাসন যেখানে লিবারেশন
ইরাকী জনগণকে স্বৈরাচার থেকে মুক্তি দিবে এবং গণতন্ত্র উপহার দিবে বলে যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেন। কিন্তু তারা স্বৈরাচার থেকে আর কি মুক্তি দিবে, বরং মুক্তি দিচ্ছে অগণিত নারীপুরুষ ও শিশুকে তাদের প্রাণে বেঁচে থাকা থেকেই। গণহত্যা ও ধ্বংসকে তারা রীতিমত স্পোর্টসে পরিণত করেছে। তাদের আরেক যুক্তি ছিল, ইরাকের হাতে weapons of mass destruction তথা ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের কারখানা রয়েছে। যুদ্ধ করে সে অস্ত্র নির্মান বন্ধ করবে। সেটিও যে বিশাল মিথ্যা তাও প্রমাণিত হয়েছে। ইরাকের দক্ষিণ থেকে উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত শত শত মাইল তারা দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এ বিশাল ইরাকী ভূমির কোথাও weapons of mass destruction এর কারখানা পায়নি। আর যদি থেকেও থাকে তবে সমগ্র ইরাকজুড়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর এবং খোদ বাগদাদে মার্কিন সেনা প্রবেশের পর ইরাক যে এখনও সেটির প্রয়োগ করেনি -সেটিই কি প্রমাণ করে না যে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও প্রধান মন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের চেয়ে এমন অস্ত্র সাদ্দামের কাছে থাকাই বেশী নিরাপদ?
ইরাকের ভূমিতে মার্কিন ও বৃটিশ সৈনিকের উপর রাসায়নিক বোমা হামলা হলে পারমানবিক বোমা ব্যাবহার করা হবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বুশ ও বৃটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেফরি হুন। অথচ সশস্ত্র হানাদার ঘরে ঢুকলে তার উপর হামলার অধিকার প্রতিটি গৃহকর্তারই থাকে। অবৈধ ও অন্যায় হামলার শিকার হয়েছে ইরাক। ফেলা হয়েছে হাজার হাজার টন বোমা। এমন বোমা ওয়াশিংটন বা লন্ডনে ফেলা হলে তারা কি করতো? পারমানবিক বোমাসহ কোন বিধ্বংসী মারনাস্ত্রই কি তারা গুদামে ফেলে রাখতো? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূ-খন্ডে জাপানীরা বোমা ফেলেনি, ওয়াশিংটন বা নিউয়র্কও আক্রান্ত হয়নি। অথচ জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমা –এ দু’টি বৃহৎ শহরকে পারমানবিক বোমায় নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। ফলে বিশ্বে কারা সবচেয়ে দায়িত্বহীন এবং কাদের হাতে বিশ্বশান্তি সবচেয়ে বেশী হুমকীর সম্মুখীণ সেটি কি বুঝতে বাঁকি থাকে? অতএব বিশ্বকে অশান্তি ও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে যে দেশটিকে প্রথমে অস্ত্রমূক্ত করা দরকার সেটি কি ইরাক না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র?
ইঙ্গোমার্কিন সামাজ্যবাদ ইরাকের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যাকে যেমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বলছে তেমনি এ বিধ্বংসী সামরিক আগ্রাসনকে বলছে লিবারেশন। অপরদিকে ইরাকীদের প্রতিরোধকে বলছে সন্ত্রাস। এভাবে ডিকশোনারিই পাল্টিয়ে দিচ্ছে। অন্যায়কে বলছে ন্যায়, চরম বর্বরতাকে বলছে সভ্যতা। আর এরাই সভ্যতা ও গণতন্ত্র শেখাতে চায় বিশ্ববাসীকে! তাদের প্রত্যাশা, ইরাকী জনগণ অস্ত্র ফেলে কুর্ণিশ করবে। তাদের মাথায় ফুল ও আতর ছিটাবে। দুনিয়ার তাবত দুর্বৃত্ত দস্যুদের একই রুচি। যে কোন দুর্বৃত্তের কাছেই অতি অনাকাঙ্খিত হলো প্রতিরোধ, সে তো চায় আত্মসমর্পণ। ইরাকী জনগণ তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করছে না সেটিই ইঙ্গোমার্কিন জোটের কাছে বড় অপরাধ। সে অপরাধের শাস্তি দিতে তারা বিধস্ত করছে বাগদাদ, বসরা, কারবালা, নজফ, কিরকুক, মসোলের ন্যায় শহরগুলোকেই শুধু নয়, সমগ্র ইরাককে। সভ্যতা কি ভাবে জন্মেছিল, কি ভাবে হাঁটি-হাঁটি, পায়ে-পায়ে সামনে এগিয়েছিল – সমগ্র ইরাক হলো তারই নিদর্শন। এজন্যই দেশটিকে বলা হয় ক্রাডল অব সিভিলাইজেশন। ইঙ্গোমার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভান্ডারের সর্বাধিক বিধ্বংসী অস্ত্র নিয়ে নেমেছে সেটির বিনাশে। হাজার হাজার ঐতিহাসিক নিদর্শন ইতিমধ্যে ট্যাংকের তলায় বা বোমার আঘাতে বিনষ্ট হয়েছে। মানব সভ্যতার জন্মভূমি এভাবেই আজ ধুলিস্যাৎ হচ্ছে। ফলে ইঙ্গোমার্কিনীদের অপরাধ শুধু ইরাকের বিরুদ্ধে নয়, সমগ্র মানব জাতির বিরুদ্ধে। অথচ বিশ্ববাসী সেটিই নীরবে দেখছে। সে নীরব-দর্শনকে টিভি, ইন্টারনেট, পত্র-পত্রিকা আরো সহজতর করে দিয়েছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ও আই সি, আরব লীগসহ সকল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে আজ একই মৃত্যুবৎ নীরবতা।
ষড়যন্ত্র গণতন্ত্র নির্মূলে
আর স্বৈরাচার-মুক্তির কথা? বোমায় কি কখন স্বৈরাচার নির্মূল হয়? ইরানের শাহ, চিলির পিনোশে, ফিলিপাইনের মার্কোস বা ইন্দোনেশিয়ার সোহার্ত কি বোমায় নির্মূল হয়েছে? বোমায় যারা নির্মূল বা পঙ্গু হয় তারা নিরীহ মানুষ, স্বৈরাচার নয়। বরং এতে নয়া স্বৈরাচারের রাস্তা প্রস্তুত করা হয়। আফগানিস্তানে সেটিই হয়েছে। তাছাড়া এ বিশ্বে স্বৈরাচারের সংখ্যা কি কম? মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি দেশেই তো স্বৈরাচার। এবং তাদের নির্মূলের পথে সবচেয়ে বড় বাধা তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরব, কুয়েত, জর্দানসহ সর্বত্র কি তাদের পাহাদারির ব্যবস্থা করতে মার্কিন বা বৃটিশ সৈন্য মোতায়ান করা হয়নি? অপর দিকে স্বৈরাচার নির্মূল ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কারণেই কি ইরানের উপর বিপদ নেমে আসছে না? প্রেসিডেন্ট কার্টারের সময় একবার হামলাও করা হয়েছিল। এ দেশটির প্রতি মার্কিনীদের এখনও আক্রোশ এ কারণে যে কেন মার্কিন যুক্তরাষ্টের তাঁবেদার মহম্মদ রেজা শাহকে উৎখান করা হলো। একই অপরাধে ১৯৫৬ সালে ইরানে সামরিক অভ্যুর্থাণে উস্কানি দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তখন তারা দেশটির নির্বাচিত প্রধান মন্ত্রী মোসাদ্দেককে হটিয়ে বিতাড়িত শাহকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবে শাহ পুণরায় বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
মার্কিনীদের আগ্রহ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নয়, বরং গণতন্ত্রের নির্মূলে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মার্কিনীদের এত আগ্রহ থাকলে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওম্মান, জর্দান ও বাইরাইনের ন্যায় দেশগুলীতে তা হচেছ না কেন? এ সব রাষ্ট্রে গণতন্ত্রচর্চা দূরে থাক, রাস্তায় সভা, মিছিল বা মত প্রকাশের অধিকারও নেই। অথচ এসব দেশের সরকার মার্কিনীদের অতি পছন্দের। জনগণ যেহেতু মার্কিন হামলার বিরোধী, ফলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে এ দেশগুলির ঘনিষ্টতা বাড়তো ইরাকের সাথে। মার্কিনীদের ঘাঁটি নির্মান তখন কি সম্ভব হতো? তখন তেলের উপর প্রতিষ্ঠিত হতো জনগণের মালিকানা। অতএব বাধাপ্রাপ্ত হতো তেলের লুন্ঠন। এটিই কি তাদের গণতন্ত্রের সাথে শত্রুতার মূল কারণ নয়?
মার্কিনীদের এসব ধোকাবাজী জনগণ যে বুঝে না তা নয়। জনগণ কি এতই বোকা যে হীংস্র পশুর নখরে ভাইবোন ও নিজ শিশুদের ছিন্ন ভিন্ন হতে দেখেও সে পশুটিকে আলিঙ্গণ করবে? ভেবেছিল, ইরাকের ধ্বংসে হাজার হাজার টন বোমা ফেললে কি হবে তাদের সৈন্যদেরকে আহলান সাহলান বলা হবে। সম্ভার্ধনা জানাতে প্রতি জনপদে মিছিল হবে। কিন্তু কোথাও সেটি হয়নি। ইরাকে কেন, সমগ্র আরব বিশ্বে হয়নি। যেটি হয়েছে সেটি শাসক মহলে। কারণ তারাই মার্কিনীদের আসল প্রজা। এ আগ্রাসী শক্তিকে তারাই সর্বপ্রকার সহায়তা দিচ্ছে। পবিত্র হজ্ব বা উমরাহ পালনে ভিসা পেতে একজন মুসলিমকে কতো ঝামেলাই না পোহাতে হয়, অথচ মার্কিনীদেরকে অবাধ অনুমতি দিয়েছে এ পবিত্র ভূমিতে অস্ত্র নিয়ে ঢুকার। অধিকার দিয়েছে ঘাঁটি নির্মানের। মার্কিনীরা অবাধ সুযোগ পেলেও জনগণ সুযোগ পাচ্ছে না ইরাকী মুসলমানদের ধ্বংস ও মৃত্যু দেখে প্রতিবাদে রাস্তায় নামার। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশও তারা নিষিদ্ধ করেছে। এ ভয়ে না জানি অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাদের অভ্যাসে পরিণত না হয়। কারণ, নিজেদের বর্বর শাসনই তখন অসম্ভব হবে। নিজেদের অন্যায় হামলাকে জায়েজ করতে বুশ ও ব্লেয়ার বহু বার বলেছেন, সাদ্দাম হোসেন প্রতিবেশীদের জন্য হুমকি। ইরাকের প্রতিবেশী ইরান ও সিরিয়া, ফলে তাদের কথা মতো সাদ্দামের পতনে এ দেশ দুটি সর্বাধিক খুশী হবে সেটি ছিল স্বাভাবিক। অথচ মার্কন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রামসফিল্ড ও সেক্রেটারী অব স্টেটস কলিন পাওয়েল ইরান ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে হুশিয়ারি দিয়েছে যে তারা ইরাককে সহায়তা দিচ্ছে। অতএব ইরাক প্রতিবেশী দেশগুলির প্রতি হুমকি – এ অভিযোগের সত্যতা কোথায়? ফলে ইরাকের উপর আগ্রাসনের সমগ্র ভিত্তিটাই যে মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত তা নিয়ে সন্দেহ থাকে কি?
সংঘাত সভ্যতার
ইরাকে আজ যে বর্বরতা চলছে সেটি কি শুধু জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারের? এ যুদ্ধ সমগ্র পুঁজিবাদী সভ্যতার্। এবং এটি ইসলামের বিরুদ্ধে। সামরিক আগ্রাসন, অর্থনৈতিক শোষণ ও গণহত্যা – এগুলি পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতার সার্বজনীন সংস্কৃতি। শোষণ-নির্ভর এ সভ্যতার এ গুলোই হলো মূল উপকরণ। এজন্যই আগ্রাসন ও গণহত্যা চালাতে নিজ দেশে সমর্থণ পেতে এদের সামান্যতম বেগ পেতে হয় না। প্রতিটি সফল ডাকাতি ডাকাত পরিবারে আনন্দের হিল্লোল বয়ে আনে। কারণ, এতে রাতারাতি বৃদ্ধি ঘটে বিত্ত-বৈভবে। যে সমৃদ্ধি বাড়াতে অন্যদের যে ভাবে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হয় -তাদের সেটির প্রয়োজন পড়ে না। তাই ইরাকের পতন অত্যাসন্য দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের প্রায় প্রতি মহলে আনন্দের হিড়িক। এ স্বার্থচেতনা থেকে এদের সবচেয়ে বিবেকবান ব্যক্তিরাও মূক্ত নয়। ফলে ডেইলি গার্ডিয়ান ও মিররের মত পত্রিকাও চায় এ আগ্রাসী য্দ্ধুটি বৃটিশ সৈন্যরা নিরাপদে সমাধা করুক। ব্রিটেনের লেবারেল ডিমোক্রাটিক পার্টির মত দল যারা প্রথমে যুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল তারাও চায় তাদের সৈন্যদের বিজয়। এমন কি মি. রবিন কুক যিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করছেন তিনি ইরাকের ত্বরিৎ পরাজয় চান। একই অবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সাথে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের যত বিরোধই থাক, মার্কিন আগ্রাসন যাতে সফল হয় সেটিই তাদের অভিন্ন এজেন্ডা।
এমন এক অভিন্ন চেতনার কারণেই পরদেশে আগ্রাসন ও গণহত্যায় পুঁজিবিণিয়োগে তাদের পুঁজির অভাব হয় না। বৃটেনে এখন অর্থনৈতিক মন্দা। স্বল্প মজুরীর কারণে কর্মচারিরা বিক্ষুব্ধ, অনেকে ধর্মঘটেও নেমেছে। কিন্তু তাদের বেতন বাড়ানোর পয়সা না থাকলে কি হবে, সরকার তিন বিলিয়ন পাউন্ড অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়েছে যুদ্ধ খাতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪ কোটিরও বেশী মানুষের স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত, কিন্তু সে দেশের সরকার যুদ্ধ খাতে ৭৫ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়েছে। একই কারণে অতীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নিজেদের নিম্ন মানের কাপড়ের বাজার বাড়াতে যখন বাঙলার মসলিন শিল্পীদের হাতের আঙ্গুল কাটছিল তখনও সে জঘন্য কাজে অর্থের জোগানদার পেতে তাদের বেগ পেতে হয়নি। পুঁজি বিনিয়োগে তখনও কমতি পড়েনি যখন নিগ্রোদের গলায় রশি বেঁধে হাটে বাজারে বিক্রি করাকে বাণিজ্যে পরিণত করেছিল বা রেড ইন্ডিয়ানদের নির্মূলকে রাজনীতি ভাবতো। ইঙ্গো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এটিই হলো ঐতিহ্য। ইরাকের বিরুদ্ধে একটি অন্যায় যুদ্ধ বিপুল ভোট পার্লামেন্টে কেন গৃহীত হয় -সেটি বুঝতে কি এর পরও কিছু বাঁকি থাকে?
উলঙ্গ হলো সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র
অবর্ণনীয় দুঃখের পাশে ইরাকে আগ্রাসন ও গণহত্যা বিশ্ববাসীকে এক অপূর্ব সুযোগও দিয়েছে। সেটি হলো, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ যে কতটা বর্বর সেটি। এ বিষয়টি কোটি কোটি ঘন্টা বক্তৃতা দিয়ে বা হাজার হাজার বই লিখে বুঝানো সম্ভব হতো না। সাম্রাজ্যবাদ এখন স্বমূর্তিতে হাজির। দূর্বৃত্তের বন্ধু হওয়ার মধ্যে প্রচন্ড অসম্মান আছে। সমাজের দুর্বৃত্তরা এজন্য অর্থশালী হলেও বন্ধুহীন হয়। ইঙ্গো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা তেমনি এক অবস্থার মুখোমুখী বিশ্বজুড়ে। ফলে যে ফ্রান্স, জার্মান ও বেলজিয়াম সেদিনও যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের সাথে গলায় গলায় ভাব রেখেছে তাদের কাছে ভিড়তেও আজ তারা ভয় পায়। এ ভয়ে যে, তাদের গায়ের গলিত দূর্গন্ধ না জানি নিজেদের গায়ে জড়িয়ে না যায়। একই ভয়ে মধ্যপ্রাচ্যের জালেম স্বৈরাচারিরা গোপনে সহযোগীতা করলে প্রকাশ্যে মার্কিনীদের প্রশংসা করা বাদ দিয়েছে।
ইঙ্গো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অধিকৃত জনগণের প্রতিরোধকে সাম্রাজ্যবাদী মগল যতই সন্ত্রাস বলে চিত্রিত করুক না কেন -এ যুদ্ধ জিহাদ রুপে গণ্য হচ্ছে সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে। শিয়া-সূন্নী, হানাফী-শাফেয়ী, আরব-অনারব -কারো মধ্যেই এ নিয়ে আজ মতবিরোধ নেই। এটি যে শতভাগ ধর্ম যুদ্ধ সে ফতোয়া আসছে শিয়া ও সূন্নী উভয় পক্ষ থেকেই। মুসলিম বিশ্বকে আর কোন বিষয়ই এতটা একতা বদ্ধ করতে পারিনি -যা এ আগ্রাসন পেরেছে। এটি এক বিরাট অর্জন। প্রতিটি বিবেকমান মানুষের দায়িত্ব, এ বিরল অর্জনকে ধরে রাখা। মানব সভ্যতার স্থায়ী মূল্যবোধ নির্মাণ করতে হবে এ অন্যায় ও অসভ্যতার বিরুদ্ধে ঘৃনাবোধকে চির-জাগ্রত রাখার মধ্য দিয়ে। এ ঘৃনাবোধ বাঁচলে বিবেকবান মানুষ মাত্রই তাদের তাঁবেদার হতে ঘৃণা করবে।
ষড়যন্ত্র মানবিক মূল্যবোধ নির্মূলে
সবাই জানে দুর্বৃত্তিতে অর্থপ্রাপ্তি ঘটে। কিন্তু এরপরও বিবেকবান মানুষ মাত্রই সে পথে যে পা বাড়ায় না -সেটি দূষ্ট কর্মের প্রতি তীব্র ঘৃনাবোধ থেকেই। কিন্তু জালিমগণ সেটিই মুছে ফেলতে চায়। দুর্বৃত্ত শাসকের ক্ষমতা লাভে জাতীয় জীবনে যে মহাবিপর্যয়টি ঘটে -সেটি এই মূল্যবোধের ক্ষেত্রে। বিপর্যস্ত এ মূলবোধের কারণে এজিদের ন্যায় দূর্বৃত্তের সৈনিক হওয়ার মধ্যেও পাপবোধ থাকে না। এ পাপবোধকে নির্মূল করতেই মুসলিম বিশ্বের জালেম শাসকেরা সবসময়ই স্বচেষ্ট হয়েছে যে মানুষের স্মৃতি থেকে এজিদদের কুকর্ম মুছে যাক। ভুলে যাক কারবালার অতি বিয়োগান্ত ঘটনা। ভুলে যাক ইমাম হোসেনের শাহাদতের শিক্ষা। উমাইয়াদের থেকে শুরু করে সর্বযুগের স্বৈরাচারি এজিদদেরা এজন্য বিস্তর অর্থ ব্যয় করেছে আলেমদের পিছনে। আশুরা আসে, আশুরা চলেও যায়। আশুরা নিয়ে বহুবিধ আলোচনাও হয়। লম্বা আলোচনা হয় নফল রোজার ফজিলত নিয়ে। কিন্ত যে ফরজকে সমূন্নত রাখতে মুসলিমদের সার্বজনীন ইমাম ও জান্নাতের যুব-সর্দার ইমাম হোসেন শহিদ হলেন তা নিয়ে অধিকাংশ মসজিদে আজ আর অলোচনাই হয় না। এটিই হলো আজকের আলেমদের বড় বিচ্যুতি। যেন ইমাম হোসেন শিয়া এবং তিনি শিয়াদের! বিভ্রান্ত আলেমদের কারণে এ পৃথিবীতে মহান আল্লাহতায়লার একমাত্র প্রতিষ্ঠান মসজিদগুলো প্রাণহীন হয়েছে। মুসলিম বিশ্বজুড়ে আজ যে এজিদদের সংখ্যাবৃদ্ধি, শরিয়তের অনুপস্থিতি এবং ইমাম হোসেন (রাঃ) অনুসারিদের কমতি -সেটি তো ইমাম হোসেনের (রাঃ) সে শিক্ষাকে ধরে না রাখার কারণেই। এবং সেটি প্রতিরোধহীন করেছে এমন কি কাফের শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। মুসলিম বিশ্বে আজ যে দুর্গতি তার মূল কারণতো এই বিচ্যুতি।
একই কৌশলে সাম্রাজ্যবাদীরাও চায় তাদের র্বরতার বিরুদ্ধে যে ঘৃনাবোধ সৃষ্টি হয়েছে সেটি মুসলিম মানস থেকে মুছে ফেলতে। এমন ঘৃণাবোধ তখনও সৃষ্টি হয়েছিল যখন তারা লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনীদের ভিটাছাড়া করে ইসরাইল প্রতিষ্টা করেছিল। আগুণ ধরিয়ে দিয়েছিল বাইতুল মোকাদ্দসে। কিন্ত ইঙ্গো-মার্কিন সাম্রজ্যবাদের বিরুদ্ধে সে ঘৃণাবোধ স্থায়ী হয়নি। দুর্বত্ত মাত্রই জানে, অর্থে শুধু শাক-শবজিই কেনা যায় না, বিস্তর মানুষও কেনা যায়। বিশ্ব জুড়ে সিআইএ ও বৃটিশ গুপ্তচর সংস্থা মানব-ক্রয়ের সে কাজটিই করেছে। যে মিশর ছিল ইসরাইলের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে সবচেয়ে যুদ্ধাংদেহী সে মিশরকে কিনতে তারা কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এ অর্থব্যয় যে শুধু আনোয়ার সা’দাতের মত সেক্যুলারিষ্টদের উপর হয়েছে তা নয়, এ অর্থ এমন প্রতিটি ক্ষেত্রে পৌছেছে যেখানে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মোজাহিদ সৃষ্টির সম্ভ্বানা রয়েছে। ইঙ্গো-মার্কিন সাম্রজ্যবাদ এ লক্ষে কোয়ালিশন গড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচারি রাজা-বাদশাহ ও শেখদের সাথে। এ কোয়ালিশন যে কতটা গভীর সেটি কি ইঙ্গো-মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে এসব রাজাবাদশাহ ও শেখদের নীরবতাই কি প্রমাণ করে না?
বনের পাখি ধরতে শিকারী যেমন খাঁচার পাখিকে ব্যবহার করে, তেমনি মুসলিম বিশ্বের বহু নেতা, সংগঠন, লেখক ও বুদ্ধিজীবী ক্রয়ে সিআইএ এসব জোব্বাধারী রাজাবাদশাহ ও শেখদের ব্যবহার করেছে। ফলে অধিকৃত হয়েছে মুসলিম দেশগুলিই শুধু নয়, বরং হাজার হাজার মসজিদ, মাদ্রাসা, ইসলামী সংগঠন ও আন্দোলন। মুসলিম বিশ্বের বিপদ এখানেই। ফলে পবিত্র মক্কায় শত শত হাজী-হত্যকে মুসলিম বিশ্ব যেভাবে ভুলে গেছে বা ইসরাইলের অস্তিত্বকে যেভাবে নীরবে মেনে নিচ্ছে তেমনি হয়তো ভূলে যাবে ইরাকের উপর ইঙ্গো-মার্কিন বর্বরতাকেও। তখন গণহত্যা স্বীকৃতি পাবে মানবাধিকার রূপে এবং জবরদখলও চিত্রিত হবে ইরাকের লেবারেশন রূপে। কিন্তু কথা হলো, মুসলিম বিশ্বের বিবেকমান মানুষ গুলোও কি এসব মেনে নিবে? তাদের কি এ নিয়ে কিছুই করার নেই? ০৭/০৪/২০০৩
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বিবিধ ভাবনা (২৯)
- ভাষা-আন্দোলন: বাঙালী সেক্যুলরিস্টদের ষড়যন্ত্র ও নাশকতা
- শত্রুশক্তির যুদ্ধ ও ইসলাম বিনাশী নাশকতা
- গণতন্ত্রের কবর ও সন্ত্রাসে আওয়ামী মনোপলি
- বাঙালী মুসলিম জীবনে বিচ্যুতি ও বিপর্যয়
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
MOST READ ARTICLES
- বিবিধ প্রসঙ্গ-৫
- My COVID Experience
- The Hindutva Fascists & the Road towards Disintegration of India
- দিল্লিতে সরকারি উদ্যোগে মুসলিম গণহত্যা
- একাত্তরের প্রসঙ্গ ও কিছু আলেমের কান্ড
RECENT COMMENTS
- Dr. Md. Kamruzzaman on বিবিধ ভাবনা (২৯)
- Md. Anisul Kabir Jasir on আত্মঘাতের পথে বাংলাদেশ: অভাব যেখানে শিক্ষা ও দর্শনের
- রেজা on শেখ মুজিবের সাথে কিছুক্ষণের স্মৃতি
- Mohammec on শেখ মুজিবের সাথে কিছুক্ষণের স্মৃতি
- ফিরোজ মাহবুব কামাল on শেখ মুজিবের সাথে কিছুক্ষণের স্মৃতি