কোর’আন না বুঝে পড়ার বিপদ
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on April 4, 2019
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, ইসলাম
- No Comments.
কোর’আনের জ্ঞান কেন অপরিহার্য?
পশুর ন্যায় দেহ নিয়ে বাঁচার জন্য আলো-বাতাস এবং খাদ্য-পানীয় হলেই চলে। কিন্তু মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার জন্য বাড়তি প্রয়োজনটি হলো, পবিত্র কোর’আনের জ্ঞান। মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাটি নিশ্চিত করতে মহান আল্লাহতায়ালা তাই কোর’আনের জ্ঞানার্জন শুধু মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, মসজিদের ইমাম বা মোল্লা-মৌলভীদের উপর ফরজ করেননি, ফরজ করেছেন প্রতিটি নরনারীর উপর। কারণ, একের পানাহারে কি অন্য জন বাঁচে না; দেহ বাঁচাতে সবাইকেই নিয়মিত পানাহার করতে হয়। তেমনি ঈমান বাঁচাতে সবাইকে নিয়মিত কোর’আনের জ্ঞানার্জন করতে হয়। মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার জন্য জ্ঞানী হওয়াটি কতটা জরুরী -সে বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালার নিজের ঘোষণাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো, “ইন্নামা ইয়াখশাল্লাহা মিন ইবাদিহি ওলামা”। অর্থঃ “বান্দাহদের মাঝে একমাত্র (কোরআনের জ্ঞানে) জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। জ্ঞানদানকে নিশ্চিত করতেই মহান আল্লাহতায়ালা যেমন নবীজী (সাঃ)কে রাসূল রূপে নিয়োগ দিয়েছেন, তেমনি তাঁর উপর পবিত্র কোর’আনও নাযিল করেছেন। মুসলিম হওয়ার জন্য তাই অপরিহার্য হলো, জ্ঞানদানের যে প্রক্রিয়া কোর’আন নাযিলের মাধ্যেম শুরু হয়েছিল তার সাথে সম্পৃক্ত হওয়া।
তাছাড়া চেতনা ও চরিত্রের অঙ্গণে বিপ্লবটি আসে জ্ঞানের গুণে; খাদ্য-পানীয়, বংশ, সম্পদ বা দেহের গুণে নয়। সে জ্ঞানের গুণেই জাহেলী যুগের অসভ্য আরবগণ মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবে পরিণত হয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনই হলো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য সর্বশ্রষ্ঠ দান। এ পৃথিবীতে মহান আল্লাহতায়ালার সৃষ্টির সংখ্যা বহু বিলিয়ন। কিন্তু কোন সৃষ্টিই মহান আল্লাহতায়ালার পরিচয়টি পেশ করে না; তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টিও মানবকে জানায় না। মানব থেকে মহান স্রষ্টার প্রত্যাশা কি –অতি গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টিও বলে না। অথচ সে বিষযগুলো নির্ভূল ভাবে তুলে ধরে একমা্ত্র পবিত্র কোরআন, এবং সেটি মহান আল্লাহতায়ালার নিজের ভাষায়। ফলে মানবসৃষ্টির জন্য এর চেয়ে অধীক গুরুত্বপূর্ণ দান আর কি হতে পারে? এ জ্ঞানের অনুপস্থিতির পরিনাম তো ভয়াবহ; মানব তখন গরু, শাপ, পাহাড়-পর্বত, চন্দ্রসূর্যকেও ভগবান রূপে গ্রহণ করে। তখন অনিবার্য হয় অনন্ত-অসীম কালের জন্য জাহান্নামের আগুণ। ফলে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে যারা সম্পর্ক মজবুত করতে চায়, চায় জান্নাতে পৌঁছার সিরাতুল মুস্তাকীম -তাদের সামনে তাঁর পবিত্র ইচ্ছা সাথে পুরাপুরি সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়া বিকল্প পথ আছে কি? সে লক্ষ্যে অনিবার্য হলো, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে কি বলা হয়েছে সেটি তাঁর নিজের কিতাব থেকেই সরাসরি জানা। ফলে মানব জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় কোন কাজ আছে কি?
ভয়ংকর ক্ষতি কেন না বুঝে তেলাওয়াতে?
প্রতিটি ব্যক্তিকেই আমৃত্যু পথ চলতে হয়। সেটি যেমন আক্বিদা-বিশ্বাস, ধর্মকর্ম ও ইবাদতের ক্ষেত্রে, তেমনি রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালত, অর্থনীতি, যুদ্ধ-বিগ্রহসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে। সে পথচলাটি সঠিক পথে হওয়ার জন্য চাই প্রতি পদে সঠিক পথনির্দেশনা। নইলে অনিবার্য হয়, জাহান্নামে পৌঁছা। সে সঠিক পথনির্দেশনাটি দেয় পবিত্র কোর’আন। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা সুরা বাকারার দ্বিতীয় আয়াতেই পবিত্র কোরাআনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন “হুদাল লিন্নাস” তথা মানবের জন্য পথনির্দেশনা রূপে। না বুঝে কোর’আন তেলাওয়াতে কিছু সুর ও কিছু আওয়াজ সৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু তাতে জ্ঞানলাভ যেমন ঘটে না, তেমনি পথনির্দেশনাও জুটে না। সিলেবাসের বই না বুঝে পড়লে কি পরীক্ষায় পাশ জুটে? অথচ মানব জীবনে পরীক্ষাটি তো প্রতি পদে। জান্নাতে পৌছতে হলে অপরিহার্য হলো এসব পরীক্ষায় পাশ করা। এবং পাশের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ ঘটে একমাত্র পবিত্র কোর’আন থেকে। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এটিই হলো তাঁর সিলেবাসভূক্ত একমাত্র গ্রন্থ। না বুঝে কোর’আন তেলাওয়াতে যেমন জ্ঞানলাভ হয় না, তেমনি হিদায়েত লাভও হয় না। ফলে ব্যক্তির জীবনে তা ভয়ানক বিপদ ঘটায়। সে অজ্ঞতা যেমন ভ্রষ্টতা দেয়, তেমনি জাহান্নামেও নেয়।
কোরআনের জ্ঞানার্জন কতটা গুরুত্বপূর্ণ -সেটি বুঝা যায় এ বিষয়টিকে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশাবলীর তালিকায় সর্বোচ্চ শিখরে দেখে। নবীজী (সাঃ)’র প্রতি তাঁর প্রথম হুকুমটি নামায-রোযা, হজ-যাকাতের ছিল না। মদ্যপান, জুয়ার ন্যায় নানারূপ পাপাচারের বিরুদ্ধেও ছিল না। মসজিদ গড়ারও ছিল না। সে হুকুমটি হলো “ইকরা” অথা পড়ার। পড়তে বলার অর্থ এখানে জ্ঞান লাভ করতে বলা। এখানে মহান আল্লাহতায়ালার উদ্দেশ্যটি যেমন নিজের পবিত্র ইচ্ছা, ভিশন ও মিশনটি নিজের ভাষায় বর্ণনা করা, তেমনি তার সাথে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে একাত্ম করা। এ বিষয়টি কোন মামূলী বিষয় নয়; বরং প্রতিটি মানব সন্তানের জন্য এটিই হলো তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, মহাপ্রভু মহান স্রষ্টার সাথে তার সৃষ্টির সংযোগ ঘটে তো এ বিষয়টি বুঝার মধ্য দিয়ে। বুঝতে ব্যর্থ হলে যা বৃদ্ধি পায় তা হলো মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা, ভিশন ও মিশনের সাথে বিচ্ছিন্নতা। সে বিচ্ছিন্নতা ব্যক্তিকে শয়তানের দলে হাজির করে এবং জাহান্নামে নিয়ে পৌঁছায়। একমাত্র পবিত্র কোর’আনের মধ্যেই মহান আল্লাহতায়ালা স্বয়ং হাজির হয়েছেন তাঁর নিজের ইচ্ছা, ভিশন ও মিশনের সুস্পষ্ট ঘোষণা নিয়ে। এ বিষয়ে সম্যক জ্ঞান-লাভ ঘটে তো অর্থ বুঝে পবিত্র কোর’আন পাঠের মধ্য দিয়ে। যে ব্যক্তি কোর’আন না বুঝে শুধু তেলাওয়াত করলো -সে তার রবের ইচ্ছা, ভিশন ও মিশনকে জানবে কেমনে? তাঁর সাথে একাত্মই বা হবে কি করে? কোর’আনকে বলা হয় “হাবলিল্লাহ” অর্থাৎ আল্লাহর রশি। এ রশির এক প্রান্তে মহান আল্লাহতায়ালা এবং অপর প্রান্তটি পৃথিবীপৃষ্ঠে পবিত্র কোর’আনের মাঝে। ফলে যারাই আঁকড়ে ধরলো মহান আল্লাহতায়ালার এ রশিকে, তারাই আঁকড়ে ধরলো তাঁর দ্বীনকে। এবং এ রশি বেয়েই তারা পৌঁছে জান্নাতে।
কোর’আনের জ্ঞান হলো মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত পবিত্র আলো যা আলোয় ঝলমল করে ঈমানদার ব্যক্তির মনের ভূবনকে। একমাত্র এ আলোতেই দেখা যায় সিরাতুল মুস্তাকীম। যার মধ্যে সে আলো নাই -তার জীবন ঘন অন্ধকারময়। মনের সে অন্ধকারে অসম্ভব হয় সিরাতুল মুস্তাকীম খুঁজে পাওয়া। জ্ঞানের সে আলোকিত রাজ্যে ব্যক্তির প্রবেশ ঘটে একমাত্র বুঝে কোর’আন পাঠের মধ্য দিয়ে। কোর’আন না বুঝে পড়া বা কোর’আনে চুমু খাওয়াতে জ্ঞানের সে আলোকিত ভূবনে প্রবেশ ঘটে না। ফলে তাতে মনের অন্ধকারও দূর হয় না। এমন ব্যক্তি তখন পথ খোঁজে পীরের মাজারে, ভণ্ড পীরের দরবারে, স্বৈরাচারীর দফতরে, সেক্যুলার দর্শন ও রাজনীতে। না বুঝে কোর’আন পাঠের ফলে ব্যক্তি এভাবেই বঞ্চিত হয় মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় নিয়ামত থেকে। ফলে এর চেয়ে বড় ক্ষতি ব্যক্তির জীবনে আর কি হতে পারে? না বুঝে কোর’আন পাঠের ফলে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হওয়ার রোগটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও মহামারি রূপে দেখা দেয়। তখন দেশে বাজার পায় চোর-ডাকাত, ভোট-ডাকাত, ধর্মচ্যুৎ রাজনীতিবিদ, ভণ্ডপীর এবং ফেরকাবাজ মোল্লা-মৌলভীগণ –যেমনটি বাংলাদেশে ঘটেছে। বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হওয়ার কারণে এমন কি দেশের আলেম বা আল্লামা নামধারীগণও ইসলামের ঘোরতর শত্রুদেরকে নেতা রূপে কবুল করে।
অথচ কোর’আনের জ্ঞান বিপ্লব আনে জীবন ও জগত নিয়ে ব্যক্তির দর্শনে। এমন ব্যক্তি তখন সিরাতুল মুস্তাকীম পায়। প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ প্রমাণ করেছেন, মুসলিমদের বিজয় ও ইজ্জতের সঠিক পথটি হলো পবিত্র কোরআনের জ্ঞান নিয়ে বেড়ে উঠাতে। এবং সে জ্ঞান থেকে দূরে সরাতে বাড়ে পরাজয় ও অপমান। শুধু এ দুনিয়ায় নয়, আখেরাতেও। ফলে শয়তানের মূল এজেন্ডাটি মুসলিমদের নামায-রোযা ও হজ-যাকাত থেকে দূরে সরানো নয়। মসজিদ-মাদ্রাসা ভাঙ্গাও নয়। বরং সেটি হলো কোরআনের জ্ঞান থেকে দূরে সরানো। শয়তান সে কাজটি করে না বুঝে কোর’আন তেলাওয়াতের ছবক দিয়ে। শয়তান এ কাজে সমাজের বুকে নিজের আসল চেহারা নিয়ে নামে না, নামে ধর্মের লেবাস পড়ে। নামে শয়তানের সে এজেন্ডা মুসলিম দেশগুলিতে যে কতটা সফলতা পেয়েছে তা বুঝা যায়, না বুঝে পবিত্র কোরআন পাঠের বিশাল আয়োজন দেখে। বুঝা যায় নবীজী (সাঃ)র ইসলাম -যাতে ছিল শরিয়ত, হুদুদ, খেলাফত, জিহাদ ও ইসলামী রাষ্ট্র, তার বিলুপ্তি দেখে। বুঝা যায়, ফেরকা, মজহাব ও তরিকার নামে মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি দেখে। ফলে দেশে দেশে শয়তানের শিবিরে আজ বিজয় উৎসব। শয়তানের বিজয়ের বড় আলামতটি হলো, সমগ্র পৃথিবীতে পবিত্র কোরআনই হলো একমাত্র কিতাব যা না বুঝে পড়া হয় এবং সেরূপ পড়াকে সওয়াবের কাজ মনে করা হয়। মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ এ নিয়ামতের সাথে এর চেয়ে বড় অবমাননা আর কি হতে পারে?
তেলাওয়াতের অর্থঃ বুঝা ও অনুসরণ করা
কেম্ব্রিজের শিক্ষক, আরবী ভাষার পন্ডিত ও প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ডক্টর আকরাম নদভির মত হলো, “কোর’আন না বুঝে তেলাওয়াতে কোন ছওয়াব নাই।” উনার কথা, যারা বলে কোরআন না বুঝে পড়লেও সওয়ার আছে তারা আসলে ‘পড়া’ শব্দটির অর্থই জানে না। পড়ার অর্থ শুধু কোন বাক্য জিহ্বা ও ঠোঠ দিয়ে বিড়বিড় করে উচ্চারন করা নয়। বরং পড়ার সাথে সেটির অর্থ বুঝা। আকরাম নদভির উক্ত অভিমতটির ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। শেখ নদভির আরো যুক্তি হলো, হাদীসে আছে মসজিদে আসার পথে প্রতি কদমে ছওয়াব আছে। তবে সে সওয়াবে জন্য মসজিদে আসতে হবে নামাযের জন্য। স্রেফ মসজিদে আসার জন্য কোন ছওয়াব নাই। দিনে হাজার বার মসজিদের দিকে দৌড়ালেও কোন ছওয়াব নাই। তেমনি কোর’আন পড়ার ক্ষেত্রে ছওয়াব তখনই মিলবে যখন মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র কালাম বুঝাব জন্য ও তার উপর আমলের জন্য পড়া হয়। অতীতে সাহাবগণ তো সেটিই করেছেন। এমন পড়ার মধ্য দিয়েই তো ইলম সৃষ্টি হয় এবং বান্দা আলেমে পরিণত হয়। না বুঝে হাজার হাজার বার পড়লেই বা কি লাভ? এতে মনের জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা যেমন দূর হয় না, তেমনি হিদায়েত লাভও হয় না। ফলে এমন কোর’আন পাঠে ছওয়াব জুটবে কেমনে? এতে যেমন সময় নষ্ট হয়, তেমনি বাঁচা হয় অজ্ঞতা নিয়ে। বাংলাদেশে তো সেটিই হচ্ছে।
কোন শিক্ষক যদি তার ছাত্রকে কোন একটি বই পড়ে আসতে বলে তার অর্থ হলো সেটি বুঝে আসতে বলা। সর্বযুগে এবং সর্বদেশে এটিই পড়ার সর্বজন গৃহীত অর্থ। সব দেশের শিক্ষকগণই শুধুই নয়, ছাত্রগণও সেটিই বুঝে। তবে বাংলাদেশের অসংখ্য মোল্লা-মৌলভী পড়ার সে অর্থটি মানতে রাজী নন। তারা নবীজী (সাঃ)র একটি হাদীটির উদ্ধৃতি দেন যাতে বলা হয়েছে, কোর’আন তেলাওয়াতে প্রতি হরফে ১০টি নেকী আছে। অথচ নবীজী (সাঃ) এ হাদীসটিতে এমন কথাটি বলেননি যে না বুঝে তেলাওয়াতেও ছওয়াব আছে। নবীজী (সাঃ) নিশ্চয়ই জানতেন, এ দুনিয়ায় কেউই কোন বই না বুঝে পড়ে না। এমন কি শিশুও যে বই বুঝে না, সে বই কখনো পড়ে না। অতএব পবিত্র কোর’আনের ক্ষেত্রে পড়ার অর্থ না বুঝে পড়া শামিল হবে কেন? তাছাড়া আরবী ভাষাতে তেলাওয়াতে দু’টি অর্থ। এক). কোন কিছু পাঠ করা। দুই). কোন কিছু অনুসরণ করা। (সূত্রঃ Arabic English Dictionary for Advanced Learners; J.G. Hava)। পবিত্র কোর’আনে তেলাওয়াত শব্দটি এ দু’টি অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। তেলাওয়াত শব্দটির অর্থ যে অনুসরণ সেটির প্রয়োগ হয়েছে সুরা আশ শামসের দ্বিতীয় আয়াতে। বলা হয়েছে, “ওয়াল কামারি এযা তালাহা।” অর্থ: “এবং চন্দ্র, যখন অনুসরণ করে সেটিকে (সূর্যকে)”।
প্রকৃত কল্যাণ বুঝা ও অনুসরণে
কোরআন না বুঝে পড়লে অজ্ঞতা তথা জাহিলিয়াত দূর হয় না। অজ্ঞতার কুফল তো ভয়ানক। তাতে সিরাতুল মুস্তাকীম চেনা যায় না; ফলে তা প্রতি পদে পথভ্রষ্টতা দেয়। খাওয়ার অর্থ কোন কিছু মুখে ভরা ও হজম করা। তেমনি কিছু পড়ার অর্থ বা কোন কিছু শোনার লক্ষ্য জ্ঞান লাভ করা। অজ্ঞ বা জাহেল থাকা কবিরা গুনাহ। কারণ অজ্ঞতা সিরাতুল মুস্তাকীমে চলা অসম্ভব করে। না বুঝে কোরআন পড়লে জাহিলিয়াত দূর হয় না এবং তাতে জ্ঞানার্জনের ফরজ আদায় হয় না। প্রশ্ন হলো, যে কোরআন পাঠে অজ্ঞতা দূর হয় না, সিরাতুল মুস্তাকীমও জুটে না -তাতে সওয়াব হয় কি করে?’ কোর’আন বুঝা যে অতি গুরুত্বপূর্ণ সেটি পবিত্র কোরঅআনে বার বার বলা হয়েছে। যেমন সুরা যুমারের বলা হয়েছে, “আমি এই কোর’আনে মানুষের জন্য সব দৃষ্টান্তই বর্ণনা করেছি যাতে তারা বুঝতে পারে।” তাছাড়া পবিত্র কোরআনের কোথায় কি বলা হয়েছে যে তোমরা ছওয়াবের জন্য কোরআন পড়? ছওয়াব গুরুত্বপূর্ণ না হিদায়েত গুরুত্বপূর্ণ? হিদায়েত পাওয়ার অর্থ সিরাতুল মুস্তাকীম পাওয়া। হিদায়েত না পেলে জাহান্নাম অনিবার্য। অপর দিকে তেলাওয়াতের সওয়াব না পেলে গুনাহ হয় না। তাছাডা কোরআন দোয়ার বই নয়। আল্লাহ তায়ালা কোরআনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন হিদায়েতের কিতাব বলে। হিদায়েত পেতে হলে হিদায়েতের সে বানিকে বুঝে পড়তে হয়। না বুঝে হাজার বার তেলাওয়াত করেও কি হিদায়েত জুটে?
সুরা কা’ফে নবীজী (সা:)কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, “ফাযাক্কির বিল কোর’আন”। অর্থঃ কোরআনের সাহায্যে মানুষকে সাবধান করো। নির্দেশ এখানে কোরআনের জ্ঞান দিয়ে সাবধান করা। তরবারির শক্তি যেমন তার ধারে, কিতাবের শক্তি হলো জ্ঞানে। যা পড়া হলো বা শোনানো হলো তা না বুঝে ব্যক্তি সাবধান হবে কীরূপে? বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কোরআনের ভাষা বুঝে না। তবে সে জন্য কি কোরআন না বুঝা জায়েজ হয়ে যাবে?” সুরা হাদিদের ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা: “আমি নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আমার আয়াতকে সুস্পস্ট ভাবে প্রকাশ করেছি যাতে তোমরা তোমাদের আকলকে কাজে লাগাতে পার (অর্থাৎ বুঝতে পার)।” মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম এখানে কোরআনের আয়াতকে বুঝার। সে কাজে নির্দেশ হলো আকল তথা বুদ্ধিকে কাজে লাগানোর। না বুঝে কোর’আন পাঠে তাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের অবাধ্যতা হয়। কথা হলো, প্রতিটি অবাধ্যতাই কবিরা গুনাহ, তাতে সওয়াব হয় কি করে? নিজের স্বার্থ উদ্ধারে মানুষ তার আকলকে দিবারাত্র কাজে লাগাতে ব্যস্ত। সে কাজে বিদেশী ভাষাও শেখে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় বছরের বছর কাটিয়ে দেয়। বিদেশেও পাড়ি জমায়। ১৫ থেকে ২০ বছর ব্যয় করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করতে। এভাবে সামর্থ্য বাড়ায় বিদেশী ভাষা শিখতে। অথচ কোর’আন বুঝার প্রশ্ন উঠলেই অভাব দেখা দেয় সময় ও সামর্থ্যে। অথচ মানুষ তো পুরস্কার পায় কোর’আন বুঝার কাজে সামর্থ্য বাড়ানোর কাজে। কোর’আন বুঝে পড়ার কাজে প্রতি হরফে এজন্যই তো ১০টি নেকী।
পবিত্র কোর’আন বুঝাটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সুরা ক্বামারে এ বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিয়ে ৪টি আয়াত নাযিল করা হয়েছে। সে আয়াতগুলিতে নাযিল হয়েছে অতি হৃদয়স্পর্শি ভাষায়। সরাসরি পাঠকের কাছে মহান আল্লাহতায়ালা প্রশ্ন রেখেছেন, “আমি কোর’আনকে বুঝার জন্য সহজ করে নাযিল করেছি। (তোমাদের মাঝে) আছে কি কেউ, যে বুঝতে চায় (এ কোর’আনকে)?” –(সুরা ক্বামার, আয়াত ১৭, ২২, ৩২, ৪০)। বার বার ঘোষিত এ আয়াতে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপর মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা জোর দিয়েছেন তা হলো, কোর’আনকে তিনি সহজ করে নাযিল করেছেন এজন্য যে পাঠক তা বুঝবে। অতএব মানুষের দায়িত্ব হলো, তারা যেন কোর’আনকে বুঝে পড়ে এবং তা থেকে শিক্ষা নেয়। সে সাথে এ ঘোষণাও দিয়েছেন, তিনি দেখতে চান কারা তার কিতাব বুঝতে আগ্রহী। অতএর যারা মনে করে কোর’আন না বুঝে পড়লেও মহান আল্লাহতায়ালা খুশি হন এবং তাতে ছওয়াব দেন -তাদের ধারণা যে কতটা ভ্রান্ত এ আয়াত হলো তারই প্রমাণ।
পবিত্র কোর’আন নাযিলের লক্ষ্য কি? সেটি তো পথ দেখানো। বার বার বিভিন্ন সুরায় সেটি বলা হয়েছে। সুরা হাদিদের ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তিনি সেই মহান সত্ত্বা যিনি তার বান্দার উপর স্পষ্ট ভাবে বর্ণিত আয়াত নাযিল করেছেন যাতে তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসতে পারেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্য দয়াময় এবং রহমতপূর্ণ।” মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ইস্যুটি পানাহারে বাঁচা নয়; বরং সেটি হলো সঠিক পথে তথা সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে বাঁচা। নইলে ব্যক্তির দীর্ঘায়ু অধীক ইন্ধন সংগ্রহ করে জাহান্নামের জন্য। এজন্যই প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দোয়াটি হলো “ইহদিনাস সিরাতুল মুস্তাকীম” অর্থাৎ সিরাতুল মুস্তাকীম চাওয়ার দোয়া। এবং জান্নাতে পৌঁছার সে সিরাতুল মুস্তাকীমটি হলো পবিত্র কোরআন। সিরাতুল মুস্তাকীম পেতে হলে তাই বার বার পড়তে হবে পবিত্র কোরআন এবং সেটি অর্থ বুঝে।
ষড়যন্ত্র আল্লাহতায়ালার মিশনকে ব্যর্থ করার
যখনই কোর’আন শুনতে বা পড়তে বলা হয়েছে -তার অর্থ হলো তা থেকে হিদায়েত নেয়া। যে ব্যক্তি হিদায়েতের বদলে শুধু ছওয়াব খুঁজলো -সে তো কোরআনের মূল লক্ষ্যের সাথে খেয়ানত করলো। এতে ব্যর্থ হয় মহান আল্লাহতায়ালার মিশন; এবং বিজয়ী হয় শয়তানের মিশন। অথচ বাংলাদেশে সেটিই হচ্ছে। শয়তান ও তার অনুসারিগণ চায়, মানুষ কোর’আন বুঝা ও তা থেকে শিক্ষা নেয়া থেকে দূরে থাক। এটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র মিশনকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্র। ঈমানদারের জন্য পবিত্র কোরআনের প্রতিটি বাক্যে ম্যাসেজ বা পথের নির্দেশনা আছে। না বুঝে পড়লে সে সুর পায়, কিন্তু পথ পায় না। না বুঝে কোরআন পড়লে জাহালত তথা অজ্ঞতা দূর হয় না। ফলে সে জাহেলের পক্ষে ঈমানদার হওয়া অসম্ভব হয়। ফলে সে পথভ্রষ্ট হয় এবং দোজখমুখি হয়। এ মহা বিপদ থেকে বাঁচাতেই কুর’আনের বুঝা প্রতিটি নরনারীর উপর ফরজ করেছেন। এ ফরজ পালিত না হলে কোন কাফ্ফারা আদায়ের পথও নাই। কাফফারা দিতে হয় জাহান্নামের আগুণে পৌঁছার মধ্য দিয়ে।
তাছাড়া ঈমানের খাদ্য হলো কোর’আনের জ্ঞান। এখানে অপুষ্টি দেখা দিলে ঈমানরে মৃত্যু ঘটে। সুরা আনফালের দ্বিতীয় আয়াতে সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে এভাবে, “মু’মিন তো একমাত্র তারাই যাদের অবস্থা এমন, যখন তাদের সামনে আল্লাহর নামের স্মরণ হয় তখন তাদের মন ভয়ে কেঁপে উঠে। এবং যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতকে তেলাওয়াত করে শোনানো হয় তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায়। এবং তাঁরা তাদের রবের উপর ভরসা করে।” প্রশ্ন হলো, কোন বাক্যের অর্থ না বুঝলে তাতে কি মনের উপর তার কোন আছড় হয়? আছড় তো হয় বুঝার কারণে। ফলে না বুঝে পড়ায় ব্যক্তির রুহ ব্যর্থ হয় তার পুষ্টি পেতে। কোর’আনী জ্ঞানের পুষ্টিতে ঈমানকে বলবান করার তাগিদে মিশর, সিরিয়া, ইরাক, সূদান, মরক্কো, আলজিরিয়া, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মালি, মৌরতানিয়া এরূপ প্রায় ২০টি দেশের জনগণ মুসলিম হওয়ার সাথে সাথে তাদের মাতৃভাষাকে কবরে পাঠিয়ে কোর’আনের ভাষাকে নিজেদের ভাষা রূপে গ্রহণ করে। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় দেশগুলিতে চলছে কোর’আন বুঝা থেকে দূরে রাখার শয়তানি চক্রান্ত। না বুঝে পড়াকেও ছওয়াবের কাজ বলা হচ্ছে।
পথভ্রষ্টতা যে কারণে অনিবার্য হয়
অজানা পথে পথচলায় সঠিক ম্যাপ চাই। নইলে অসম্ভব হয়, সঠিক পথে পথ চলা। তখন অনিবার্য হয় পথভ্রষ্টতা। তবে এখানে পথচলাটি এক শহর থেকে অন্য শহরে গমনের নয়। বরং সেটি দুনিয়ার এ জীবন থেকে জান্নাতে পৌঁছার। ফলে যাত্রাপথটি নির্ভূল হওয়ার গুরুত্বটি অপরিসীম। তার উপর নির্ভর করে মানব জীবনের বাঁচার প্রকৃত সফলতা। নইলে পথভ্রষ্ট মানুষটি জাহান্নামে গিয়ে পৌঁছে। তখন জীবনের সমগ্র বাঁচাটিই অনন্ত-অসীম কালের জন্য দুঃখের কামাইয়ে পরিণত হয়। মানব জাতির মূল ব্যর্থতা কৃষি, শিল্প বা বিজ্ঞানে নয়। বরং সেটি হলো সঠিক পথে জীবন চালানোর। মহান আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের বিস্ময়কর সামর্থ্য দিয়েছেন। কিন্তু সিরাতুল মুস্তাকীম পথ আবিস্কারের ক্ষমতাটি দেননি। এ বিষয়টি তিনি নিজ হাতে রেখেছনে। তাই সুরা লাইলে ঘোষণা দিয়েছেন, “ইন্না আলায়নাল হুদা” অর্থঃ “নিশ্চয়ই (মানুষকে) পথ দেখানোর দায়িত্বটি আমার।”
সে দায়িত্ব পালনের তাগিদেই তিনি লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন এবং নাযিল করেছেন আসমানি কিতাব। পবিত্র কোর’আন হলো এ সিলসিলার সর্বশেষ কিতাব এবং নবীজী (সাঃ) হলেন সর্বশেষ রাসূল। এবং সিরাতুল মুস্তাকীমে চলার স্যাটেলাইট নেভিগেশন ম্যাপ হলো পবিত্র কোরআন। তবে সে ম্যাপটি শুধু কাছে থাকলেই চলে না। সেটিকে বুঝতে হয়, এবং পদে পদে অনুসরণও করতে হয়। যে ব্যক্তি জান্নাতে পৌঁছতে চায় তার সর্বক্ষণের ফিকর হয়, কি করে পবিত্র কোরআন থেকে প্রতি পদে দিক-নির্দেশনা নেয়া যায়। এবং কি করে বাঁচা যায় পথভ্রষ্টতা থেকে। ঈমানদারের এরূপ সার্বক্ষণিক ফিকরই হলো তাকওয়া। সে গভীর তাকওয়ার তাগিদে সে তখন কোর’আনের ভাষা শেখে। এবং পবিত্র কোর’আনের প্রতিটি আয়াত বুঝবারও চেষ্টা করে। মুসলিমদের গৌরব কালে মুসলিমদের মাঝে তো সে তাড়নাটাই প্রবল রূপে দেখা গেছে। কিন্তু যে ব্যক্তি না বুঝে তেলাওয়াত করে, সে ব্যক্তি ব্যর্থ হয় সে পথে চলতে। তখন ব্যর্থ হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা। এবং বিজয়ী হয় শয়তানের এজেন্ডা। তাই শয়তান ও তার অনুসারিরা চায়, মানুষ হাজার বার কোর’আন পড়ুক, কিন্তু তা যেন না বুঝে পড়ে। এতে সফল হয় মানব সন্তানদের দিয়ে জাহান্নাম পূরণ করার শয়তানী প্রকল্প। ৪/৪/২০১৯
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- Why not the Muslims Should Suffer from Slavery & Subjugation?
- বাঙালি মুসলিম জীবনে মতবাদী রাজনীতির নাশকতা
- বাংলাদেশের বিপদ ও সম্ভাবনা
- সংগঠিত হতে হবে সংগঠন ছাড়াই
- পতিত হাসিনার দুর্বৃত্তায়ন ও হিন্দুত্বায়ন প্রকল্প এবং বাঙালি মুসলিম জীবনে নাশকতা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018