একাত্তরের বিতর্ক
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on December 12, 2019
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
একাত্তর সম্পর্কে শুরু থেকেই বিপরীত মতামত রয়েছে এবং সেটি ভবিষ্যতেও থাকবে। বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী শক্তি শুধু নিজেদের কথাই বলছে এবং তাদের বিরোধী মতের অনুসারিদের মুখ খুলতে দিচ্ছে না। এটি হলো তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাস। অথচ এ নিয়ে খোলাখোলি আলোচনা হওয়া উচিত। যে কোন দেশে নানা বিষয়ে নানা লোকের ভিন্ন ভিন্ন মতামত থাকবে -সেটিই স্বাভাবিক। তবে কোনটি ঠিক এবং কোনটি সঠিক –সে বিচারটি হয় নানারূপ দর্শন ও চেতনার ভিত্তিতে। ফলে বিচারের রায়ও ভিন্ন হয়। যেমন, দুইজনের সম্মতিতে ব্যাভিচার হলে সেটি সেক্যুলার চেতনায় বা সেক্যুলার আইনে কোন অপারধই নয়। বাংলাদেশের সেক্যুলার আইনেও সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য হয়না। সেক্যুলার চেতনায় সে ব্যাভিচার বরং প্রেম রূপে গণ্য হয়। বাংলাদেশের সেক্যুলার আইনে মদজুয়ার ন্যায় ব্যাভিচারের দোকান খোলাও কোন অপরাধ নয়।
তেমনি গোত্রবাদী ও জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার চেতনায় কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গার কাজটিও অপরাধ গণ্য হয় না। সেটি বরং দেশপ্রেম গণ্য হয়। অথচ বিচারের মানদন্ডটি কোরআন-হাদীস হলে ব্যাভিচার ও দেশ ভাঙ্গা উভয়ই হত্যাযোগ্য অপরাধ রূপে গণ্য হয়। শাসক-শক্তি যদি অত্যাচারি, খুনি বা ধর্ষকও হয় তবুও সে জন্য দেশ ভাঙ্গা জায়েজ হয় না। এটিই শরিয়তের বিধান। কারণ শাসক যত জালেমই হোক সে শত শত বছর বাঁচে না। কিন্তু দেশকে দেশবাসীর জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাজার হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখতে হয়। নইলে বিপদ ঘনিয়ে আসে। দেশের এক গজ ভূগোল বাড়াতেও তো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়। সে দেশকে তাই কি খন্ডিত করা যায়? এমন কাজ তো বেওকুপদের।
খন্ডিত করা মানে তো দেশকে দুর্বল করা। সেটি তো হারাম। ঘরে শাপ ঢুকলে সে শাপ তাড়াতে হয়, সেজন্য ঘরে আগুন দেয়াটি গুরুতর অপরাধ। বিষয়টি প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ জানতো বলেই খোলাফায়ে রাশেদা, উমাইয়া ও আব্বাসী আমলে আরব, ইরানী, তুর্কী, কুর্দ, মুর ইত্যাদী নানা ভাষার মুসলিমগণ একত্রে বসবাস করেছে। ভাষার নামে তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ গড়েনি। বিভক্তিকে তারা হারাম গণ্য করেছে। তবে আজ যেমন শহরে শহরে পতিতাপল্লী গড়ে দেহব্যবসা করাটি যেমন স্বীকৃতি পেয়েছে, তেমনি বৈধতা পেয়েছে মুসলিম দেশগুলিকে খন্ডিত করা। তাই আরবগণ ২২ টুকরায় বিভক্ত। আর এরূপ হারাম কাজে লিপ্ত হলে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত কঠোর আযাব আসবে -সেটিই তো স্বাভাবিক।
কোর’আন-হাদীস ভিত্তিক এমন একটি চেতনার কারণেই গুটিকয় ব্যতিক্রম ছাড়া একাত্তরের কোন ইসলামী দল, কোন আলেম, কোন পীর, মাদ্রাসার কোন ছা্ত্র ও শিক্ষক এবং ইসলামী কোন চিন্তাবিদ পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষ নেয়নি। চেতনার দিক দিয়ে তারা সবাই ছিল রাজাকারের চেতনার অধিকারী। পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষ নিয়েছিল মূলতঃ ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য আওয়ামী লীগ, চীনপন্থি ও রুশপন্থি ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টি এবং হিন্দুগণ। এমন কি বিশ্বের কোন মুসলিম দেশও পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থন করেনি। বরং পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে মুসলিম বিশ্বের জনগণ সেদিন শোকাহত হয়েছে। পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থন করেছে ভারত, রাশিয়া ও ইসরাইলের ন্যায় মুসলিমবিরোধী রাষ্ট্রগুলি। এবং আনন্দের বন্যা বয়েছে ভারতীয় কাফেরদের মনে। সে আনন্দ দেয়াতে ভারত আওয়ামী লীগকে তাই সব সময় মাথায় তুলে রেখেছে। অপর দিকে একাত্তরের যারা ভারতীয় প্রকল্পের কাছে মাথা নত করেনি তাদের নির্মূলের পথ বেছে নিয়েছে।
যারা কাফেরদের মনে আনন্দ বাড়ায়, মুসলিমদের শক্তিহানী করে এবং মুসলিমদের শোকাহত করে তাদেরকে কি ঈমানদার বলা যায়? নামায-রোযা, হজ্ব-উমরা মুনাফিকগণও পালন করে থাকে। কিন্তু বিশ্বমাঝে মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বশক্তি রূপে দেখার স্বপ্নটি হৃদয়ে নিয়ে বাঁচার সামর্থ্য তাদের থাকে না। বস্তুতঃ এরাই একাত্তরে ভারতের কোলে গিয়ে উঠেছিল।ভারতের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদেরকে বিজয়ী করতে যুদ্ধ করেছিল।এবং আজও বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রটি ভেঙ্গে যাওয়াকে তারা উৎসবের বিষয় রূপে গণ্য করে।
ব্যক্তির ঈমান দাড়ি-টুপিতে ধরা পড়ে না। এমনকি নামায-রোযাতেও নয়। নবীজীর পিছনে কয়েক শত মুনাফিকও নামায পড়েছে। রোযাও রেখেছে। তাদের মুনাফিকী ধরা পড়েছে রণাঙ্গনে এবং রাজনীতিতে। জিহাদের ময়দানে কোন মুনাফিককে নবীজী (সাঃ)র পাশে দেখা যায়নি। বরং তাদের কামনা ছিল, রণাঙ্গণে কাফেরগণ বিজয়ী হোক। বাঙালী কাপালিকদেরও অনেকে মুসলিম রূপে দাবী করে। কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধে তাদের দেখা গেছে পৌত্তলিক কাফের শক্তির পাশে। এবং মনেপ্রাণে চেয়েছে কাফেরগণই বিজয়ী হোক। এদের কে কি ঈমানদার বলা যায়?
নবীজী (সাঃ)র সাহাবাদের মধ্য থেকে শতকরা ৭০ ভাগের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। তারা কি মসজিদ-মাদ্রাসা গড়তে বা নামায-রোযা আদায়ে শহীদ হয়েছেন? তারা তো শহীদ হয়েছেন মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়ার প্রয়োজনে। আর শক্তিশালী হতে হলে তো দেশের ভূগোল বাড়াতে হয়। শুধু অর্থনৈতীক উন্নয়ন দিয়ে বিশ্বশক্তি হওয়া যায় না। তেমন একটি প্রয়োজনেই বাঙালী মুসলিমগণ ১৯৪৭ সালে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ পাকিস্তান বানিয়েছিল। কিন্তু সেটি ইসলামের দুষমনদের ভাল লাগেনি। সে দেশটি ভাঙ্গতেই তারা দেশের ভীতরে ভারতীয় কাফের বাহিনীকে ডেকে আনে।
রাষ্ট্র শক্তিশালী না হওয়ার বিপদটি তো ভয়ানক। তখন আগ্রাসী শক্তির গোলাম হতে হয়। যেমন আজকের বাংলাদেশ। কিন্তু তা নিয়ে বাঙালী কাপালিকদের কি কোন ক্ষোভ আছে? বরং ভারতের দাস হওয়া নিয়েই তাদের বিপুল আনন্দ। বরং তাদের ক্ষোভ এ নিয়ে, বাঙালী মুসলিম খাজা নাজিমুদ্দীন, মুহাম্মদ আলী (বগুড়ার) ও সহরোওয়ার্দীর কেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলো? সে অপরাধে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই তাদের বাদ দিয়েছে। যেন বাঙালী মুসলিমের ইতিহাসের শুরু মুজিব থেকে। ১৯৭১’য়ে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক বিলুপ্ত হওয়াতে এখন তা নিয়ে সারা বছর বাংলাদেশে উৎসব হয়।
ব্যাঙ ক্ষুদ্র গর্তের সন্ধান করে। মুজিব এবং তার অনুসারিগণও তেমনি ক্ষুদ্র বাংলাদেশের ভূগোল চেয়েছিল। আর ক্ষুদ্রতা যে অন্যের গোলামী আনবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। আর গোলামের জীবনে তো স্বাধীনতা থাকে না। স্বাধীনতা বিলুপ্ত হওয়ার সাথে বাঙালীর ভোটের অধীকারও তাই বিদায় নিয়েছে।
মুজিব জানতো বাংলার ধর্মভীরু সাধারণ মানুষ কখনোই পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থন করবে না। ফলে ১৯৭০য়ের নির্বাচনে কোনদিনও পাকিস্তান ভাঙ্গার কথা বলেনি। পাকিস্তান ভেঙ্গে পৃথক বাংলাদেশ সৃষ্টি নিয়ে রেফারেন্ডামের দাবীও করেনি। মুজিব ভোট নিয়েছে পাকিস্তানকে অখন্ড রেখে ৬ দফা দাবী আদায়ের কথা বলে। নির্বাচনে ভোট নেয়ার পর মুজিব আওয়াজ তোলে “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। দাবী তুলে, অখন্ড পাকিস্তানের নয়, স্রেফ পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে দিতে হবে। এবং সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে মুজিব তার সঙ্গিদের ভারতে যাওয়ার নসিহত করে।
ভাষা ও অঞ্চলের নামে দেশ স্বাধীন করায় মাঝে কল্যাণ থাকলে ভারত ভেঙ্গে ১২০ কোটি হিন্দুগণ বাংলাদেশের ন্যায় ২০টি স্বাধীন দেশ বানাতে পারতো। তাছাড়া দেশ ভাঙ্গা ইসলামে হারাম হলেও হিন্দু ধর্মে তো হারাম নয়। কিন্তু দেশ ভাঙ্গা যে আত্মঘাতি -সেটি ভারতীয় হিন্দুগণ ভাল করে বুঝে। তাই তারা সে পথে যায়নি। কিন্তু সে হুশ বাঙালী কাপালিকদের নাই। তাই তারা ক্ষুদ্র ভূগোল গড়া নিয়ে উৎসব করে।
তবে একাত্তরের সে জোয়ারের মাঝেও সব বাঙালীই যে বিবেক হারায়নি –সে প্রমাণও অনেক। তাই ১৯৭১য়ে মে মাসের মাঝামাঝিতে দৈনিক ইত্তেফাক পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধীতা করে সম্পাদকীয় লিখেছিল, “দেশ ভাঙ্গাতে বাহাদুরি নাই” এ শিরোনামে। ঢাকা ও চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষক সেদিন পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিল। সে আমলের পত্রিকাগুলোর দিকে তাকালে তাদের সে বক্তব্যগুলো নজরে পড়বে। তাদের কথার পিছনেও যুক্তি ছিল। অথচ আজ সে সত্য কথাগুলো লুকানো হচ্ছে। এবং সেটি ফ্যাসিবাদী শক্তি প্রয়োগ করে।
একাত্তর নিয়ে বাঙালী কাপালিকগণ যে আকাশ চুম্বি মিথ্যাচার রটিয়েছে সেটি বিলুপ্ত করতে না পারলে কি বাঙালী মুসলিমদের কি উন্নততর মানুষ রূপে বেড়ে উঠার সম্ভাবনা আছে? এবং সেটি করতে হলে তো একাত্তর নিয়ে সত্য কথাগুলো প্রবল ভাবে বলতেই হবে। নইলে গুম-খুন-ধর্ষণ-চুরি-ডাকাতি-সন্ত্রাসের প্লাবনে দেশ আজ যে ভাবে ভাসছে তা যে আরো তীব্রতর হবে তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে?
তাছাড়া সবচেয়ে বড় ইবাদত এবং সবচেয়ে বড় জিহাদ তো জালেমের সামনে সত্য কথা বলা। তাছাড়া কারো ভয়ে সত্য লুকানোটি শুধু কবিরা গুনাহই নয়, বরং শিরক। কারণ যে ব্যক্তি ঈমানদার -সে তো ভয় করবে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালাকে এবং অন্য কাউকে নয়। কিন্তু যে মানুষটি ভয়ে সত্য লুকায়, লুকানোর সে অপরাধটি করে অন্য কোন জালেম ব্যক্তি বা শক্তির ভয়ে। তাই সেটি শিরক। এবং যারা শিরক করে তাদের জন্য নিষিদ্ধ হলো জান্নাত –যা পবিত্র কোরআন ও হাদীসে বার বার বলা হয়েছে। ১০/১২/২০১৯
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- হিযবুল্লাহ ও হিযবুশ শায়তান
- উপেক্ষিত সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এবং বাঙালী মুসলিমের বিপর্যয়
- গণতন্ত্র যেখানে গণহত্যা এবং জবরদখল যেখানে লেবারেশন
- দুর্বল থাকার আযাব ও শক্তিবৃদ্ধির ফরজ দায়ভার
- বিবিধ ভাবনা (১৫)
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
MOST READ ARTICLES
- বিবিধ প্রসঙ্গ-৫
- Political, religious & demographic dynamics in South Asia & threatened co-existence of people with pluralities
- My COVID Experience
- The Hindutva Fascists & the Road towards Disintegration of India
- দিল্লিতে সরকারি উদ্যোগে মুসলিম গণহত্যা