একাত্তরের গণহত্যা (৭)

 

যে কাহিনী শুনতে নেই (১১)

সংগ্রহে কায় কাউস

=============

“… একাত্তর নাকি আমাদের জাতির ‘স্যালভেশনের’ মাইলফলক। আর ১৬ই ডিসেম্বর, সে তো আমাদের ‘মহান বিজয়ের’ সিংহদুয়ার। অতএব এখান থেকেই শুরু করা যাক।

 … রানু (প্রয়াত কমরেড রাশিদা) গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলো শহরে পাঞ্জাবী সেনাদের আগমনের আগেই। ২৫শে মার্চের পর পাঞ্জাবী সেনাদের হাতে জান খোয়ানোর চেয়েও বেশি, ইজ্জত খোয়ানোর ভয়ে শহর থেকে সব মেয়েমানুষ দলে দলে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছিলো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রানুর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো ভিন্নতর। আসলে রানু নিজের আজন্মলালিত শহরটিকে ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলো আর দশটি মেয়েমানুষের মতো যতটা না পাঞ্জাবীদের ভয়ে, তার চেয়েও বেশি অন্য এক বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঐ বিশেষ ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর এ শহরের বাতাস যেনো পাথর হয়ে চেপে বসেছিলো ওর বুকে। 

‘ক্রাকডাউনের’ পর ঢাকা থেকে পাঞ্জাবী সেনাদের আগমনের পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত আমাদের এ মফস্বল শহরটি ছিলো পুরোপুরি মুক্ত এলাকা। বিশেষ করে ২৭-২৮ মার্চে শহরতলী এলাকায় অবস্থিত ইপিআর ক্যাম্পের সব অবাঙালি অফিসার-জওয়ান বউ-বাচ্চা সহকারে খতম হওয়ার পর গোটা শহর তখন পুরোপুরি শত্রুমুক্ত। এক অভাবিত মুক্তির স্বাদে কয়টা দিন শহরের অলিতে গলিতে আর ঘরে ঘরে আপাতমুক্তির আনন্দ-উল্লাসের কী যে জোয়ার বয়েছিল, তা স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা যায় না। রানুর মনেও আনন্দ-উল্লাসের হয়তো কমতি ছিলো না।

কিন্তু এরই মাঝে হঠাৎ এক সকালে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান চেতনা’ হুমড়ি খেয়ে পড়লো শহরের বিহারী কলোনীগুলোর ওপর। হৈ হৈ রৈ রৈ করে রীতিমতো কুরুক্ষেত্র আর লংকাকান্ড চললো পুরো তিন দিন। বিহারী ছেলে, বুড়ো ও নারী-পুরুষের রক্তের স্রোত বয়ে গেলো কলোনীগুলোর ওপর। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র, নিষ্ক্রিয়, অসহায় নারী-পুরুষ-শিশুর ওপর একতরফা হত্যাযজ্ঞ চললো পুরো তিনটে দিন। 

রানু এই চরম লোমহর্ষক বর্বর মুহুর্তেও কাউকে না জানিয়ে একাকী কলোনীতে দৌড়ে গিয়েছিলো। তাহমিনাদের ঘরের আঙীনায় পৌঁছে ওর বাবা-মা’র লাশ দেখে আৎকে উঠলেও সে পিছ-পা হয়নি। প্রিয়তমা বান্ধবীকে উদ্ধারের আশায় অতি দু:সাহসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে তাহমিনাদের ঘরে ঢুকে পড়েছিলো এবং ঢুকেই আর্তচিৎকারে কলোনীর আকাশ প্রকম্পিত করে দিয়েছিলো। রানুর চোখের সামনে এক বীভৎস দৃশ্যের নিস্তব্ধতা। মেঝেতে তাহমিনার লাশ পড়ে আছে চিৎ হয়ে, পরনে ওর একটি সুতোও নেই। রক্তে সারা ঘর ভাসছে।

তার পরদিনই রানু শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। ‘মুক্তিযুদ্ধের’ পুরো ৯টি মাস রানুকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হই। ওর মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় ৭১-এ এই দেশের মাটিতে অসহায় মানুষকে নির্বিচারে হত্যা, অবলা নারীর ওপর বলাৎকার ইত্যকার পাশবিক কার্যকলাপ প্রথম নাকি শুরু করে একশ্রেণীর বাঙালিরাই। রানুকে যদি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার দায়িত্ব দেয়া যেতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিশ্চয়ই শুরু হতো এই কলংকময় অধ্যায় দিয়ে। 

কিন্তু রানু কি সেদিন জানতো, ৭১-এ ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের’ সূচনায় এমন নারকীয় যজ্ঞ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সর্বত্রই চলেছিলো নির্বিচারে। পাঞ্জাবীদের ‘মালাউন’ নিধন এবং বাঙালিদের ‘বিহারী’ নিধন এ দুয়ে মিলে তৈরি হয়েছিলো যে ‘ককটেল’ এবং তারই সাথে দিল্লীর সঞ্জীবনী সুধা পান করে যাত্রা শুরু হয়েছিলো যে ‘মুক্তিযুদ্ধের’, আজকের এই ১৬ই ডিসেম্বরে তো তারই ষোলকলা পূর্ণ হলো॥”— রইসউদ্দিন আরিফ (সাবেক সম্পাদক, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি) / আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন সমগ্র ॥ [পাঠক সমাবেশ – ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ । পৃ: ১১৯ / ১২৪-১২৫

   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *