নামায কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

নামাযের এতো গুরুত্ব কেন?

যে ইবাদতটি অমুসলিম থেকে মুসলিমকে পৃথক করে -তা হলো নামায। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে নামায কাফের ও মুসলিমের মাঝে দেয়াল রূপে কাজ করে। নামায না থাকলে মুসলিম আর অমুসলিমের মাঝে কোন পার্থক্যই থাকে না, উভয়ে একাকার হয়ে যায়। ব্যক্তির ঈমান দেখা যায় না। রোযাও দেখা যায় না –যদি না সে নিজে থেকে তা প্রকাশ করে। তেমনই কে যাকাত দেয়, সেটিও বুঝা যায় না –যদি না সে ব্যক্তি অন্যদের জানিয়ে দেয়। আর হজ্ব তো সবার জন্য ফরজ নয়; ফলে হজ্ব না করাতে কেউ অমুসলিম হয় না। কিন্তু নামায দেখা যায়। কারণ নামাযে যে শুধু দৃশ্যমান ক্বিয়াম, রুকু, সিজদা ও বৈঠক আছে –তা নয়। নামায পড়তে হয় লোকালয়ের মসজিদে হাজির হয়ে। ঘরে বা দোকানে নামায পড়লেও তা অন্যদের নজরে পড়ে। তাই কে নামাযী আর কে বেনামাযী -সমাজে সেটি গোপন থা্কে না। অপর দিকে নামাযই ব্যক্তির ঈমানের পরিমাপ দেয়; মুসলিম না অমুসলিম -সেটি প্রকাশ করে দেয়। প্রতিদিনের প্রশিক্ষণে যদি কোন সৈনিক হাজির না হয় তবে সৈনিকের খাতায় তার নাম থাকে না। সেনা বাহিনী থেকে সে বহিস্কৃত হয়। তেমনি মসজিদের জামায়াতে যে ব্যক্তি হাজির হয় না -তাকেও কি মুসলিম বলা যায়? মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাযে নিয়মিত হাজির হওয়ার সামর্থ্য মুনাফিকদের থাকে না –বিশেষ করে ফজর ও এশার নামাযে। ফলে কে মুনাফিক –সেটিও প্রকাশ পায় নামাযে অনুপস্থিতির মধ্য দিয়ে। 

কোন বেনামাযী যে জান্নাতে যাবে না -তা নিয়ে বিতর্ক নাই। কারণ, জান্নাত তো একমাত্র ঈমানদারদের জন্য। সেখানে বেঈমানের কোন স্থান নেই। আর ঈমানদার তো সেই যে নামায পড়ে। আগুন জ্বললে, উত্তাপ দিবেই। তেমনি হৃদয়ে ঈমান প্রবেশ করলে, সে ব্যক্তির জীবনে নামায-রোযা আসবেই। আগুন থেকে যেমন তার উত্তাপকে আলাদা করা যায় না, তেমনি ঈমানদার থেকে পৃথক করা যায় না তার নামাযকে। হাদীসে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম যে ইবাদতের হিসাব নিবেন সেটি হলো নামায। সুরা মুলকে বলা হয়েছে, জাহান্নামবাসীদের জিজ্ঞাসা করা হবে তোমরা কীরূপে এখানে পৌঁছলে? সর্বপ্রথম যে কারণটিকে তারা উল্লেখ করবে তা হলো, তারা নামায পড়তো না। নামাযের মূল্য বেনামাযীগণ ইহকালে না বুঝলেও বুঝবে জাহান্নামে প্রবেশের পর। জাহান্নামবাসীদের সে বেদনাদায়ক উপলব্ধিকে মহান আল্লাহতায়ালা কোর’আনে উল্লেখ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। সেটি মূলত যাদের জীবনে এখনো মৃত্যু আসেনি তাদেরকে সাবধান করতে। জাহন্নামে পৌঁছার আগেই তারা যেন বুঝতে পারে নামাযের গুরুত্ব। নইলে জাহান্নামে পৌঁছে শুধু আফসোসই হবে, করার কিছু থাকবে না। কোর’আন মজীদ মানব জীবনের রোডম্যপ। এ রোডম্যপ শুধু জান্নাতের পথই দেখায় না, সামনে অপেক্ষামান জাহান্নামের বিপদের কথাও বলে।     

 

কীরূপে ব্যর্থ হয় নামায?                                                                 

চিনিকলে আঁখ চিনিতে পরিণত হয়। সেরূপ না হলে বুঝতে হবে চিনিকলে ত্রুটি রয়েছে? নামাযের মধ্যেও তেমনি একটি প্রক্রিয়া কাজ করে যা পরিশুদ্ধি আনে ব্যক্তির জীবনে। সে পরিশুদ্ধি না এলে বুঝতে হবে নামাযে ত্রুটি আছে। এবং ত্রুটি কোথায়, সেটি বুঝতে হলে নামাযকে মিলিয়ে দেখতে হয় সাহাবীদের নামাযের সাথে। কারণ, তারাই হলেন নামাযসহ সকল ইবাদত-বন্দেগীর মডেল। নামাযের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ শুধু ক্বিয়াম, রুকু, সিজদা বা বৈঠক নয়। স্রেফ সুরা পাঠ, তাশাহুদ পাঠ, দরুদ ও তাসবিহ পাঠও নয়।  বরং সেটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার সাথে নামাযীর মনের সংযোগ। এবং সে সংযোগটি ঘটে তাঁর রহমত, কুদরত, ফজিলত ও আয়াত সমূহের স্মরণের মধ্য দিয়ে। সুরা বাকারা’য় বলা হয়েছে, “ফাজকুরুনি আজকুরুকুম” অর্থঃ “তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করবো।” এটি বান্দার প্রতি মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া পবিত্র ওয়াদা। আর ওয়াদা পালনে তাঁর চেয়ে আর কে শ্রেষ্ঠ হতে পারে? সুরা যুখরুফে বলা হয়েছে, যখন কারো মন থেকে আল্লাহতায়ালার স্মরণ বিলুপ্ত হয় তখন তার উপর শয়তান নিযুক্ত করে দেয়া হয়। এবং সে শয়তান তাকে জাহান্নামে নেয়। সুরা হাশরে বলা হয়েছে যারা আল্লাহকে ভূলে থাকে তাদের জীবন থেকে ভূলিয়ে দেয়া হয় নিজেদের  কল্যাণের বিষয়গুলি। নামাযের মুল কাজ তো ঈমানদারের মনে মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণকে জাগ্রত করা। সেটি শুরু হয় নামাযের আযান ও ওযু থেকে। নামাযে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণের মাধ্যমে ঈমানদার নিজেও স্থান করে নেয় মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণে। এটিই তো নামাযের শ্রেষ্ঠ দান। কিন্তু নামাযীর মন থেকে সে স্মরণ বিলুপ্ত হলে সে নামাযের কি কোন মূল্য থাকে? সেটি তো মনের এক চেতনাহীন বেহাল অবস্থা। সেরূপ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পবিত্র কোর’আনে বলা হয়েছে,“হে ঈমানদারগণ, তোমরা মাদকাসক্ত অবস্থায় নামাযের নিকটবর্তী হয়োনা -যতক্ষণ না তোমরা যা পড় তা বুঝতে না পার…”। –(সুরা নিসা, আয়াত ৪৩)।

উপরুক্ত আয়াতে রয়েছে ভাবনার এক গুরুতর বিষয়। আয়াতটি যখন নাযিল হয়, মদ তখনও হারাম হয়নি। ফলে নবীজী (সাঃ)’র অনেক সাহাবী মাতাল অবস্থায় মসজিদে হাজির হতেন। মদপানের কুফল হলো, এতে বিলুপ্ত হয় চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা। তখন নামাযীর মন থেকে বিলুপ্ত হয় মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণ। এবং বিলুপ্ত হয় মহান মা’বুদের সাথে বান্দার মনের সংযোগ। ফলে নামাযে পবিত্র কোর’আন থেকে যা কিছু তেলাওয়াত হয় -তাতে মনযোগ দেয়া অসম্ভব হয়। তখন অসম্ভব হয় চেতনায় জাগরন বা পরিশুদ্ধি। আর চেতনায় পরিশুদ্ধি না আসলে চরিত্রে পরিশুদ্ধি আসবে কীরূপে? অথচ কোর’আন নিজেই যিকরের কিতাব। সে যিকরের সাথে নিজেকে জড়িত করতে তো যিকির রত মন চাই। সুরা ক্বাফে বলা হয়েছে, “ইন্না ফি যালিকা লা যিকরা লিমান কানা লাহু ক্বালবুন আও আলকাস সাময়া ওয়া হুয়া শাহীদ” অর্থঃ নিশ্চয়ই এ কিতাব (কোর’আনের) মধ্যে রয়েছে যিকর; (এবং সেটি) তাদের জন্য যাদের রয়েছে ক্বালব এবং কাজে লাগায় শ্রবনশক্তিকে এবং সাক্ষ্য দেয় সত্যের পক্ষে। –(সুরা ক্বাফ, আয়াত ৩৭)। অর্থাৎ কোর’আন থেকে শি্ক্ষা নিতে চাই জাগ্রত ক্বালব, তীক্ষ্ণ শ্রবনশক্তি এবং সত্যকে সত্য রূপে দেখার দৃষ্টিশক্তি। মাদক-সেবন এর সবগুলিই কেড়ে নেয়। ফলে ব্যহত হয় সুস্থ্য বিবেক নিয়ে ও প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। পবিত্র জায়নামাযে নামাযীর এরূপ মাদকাসক্তি ও মনযোগহীনতা মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহাতায়ালার কাছে ভাল লাগেনি।

 

শ্রেষ্ঠ যিকর

মু’মিনের উত্তম যিকর হলো তার নামায। এরূপ পবিত্র যিকির পীরের খানকায়, সুফি হালকায় বা বনে-জঙ্গলে সম্ভব নয়। তাই পবিত্র কোর’আনে সে সব খানকায়, হালকায় ও বনে-জঙ্গলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়নি। বরং নির্দেশ এসেছে নামাযে ছুটে যাওয়ার। সুরা জুম্মুয়াতে বলা হয়েছে, “যখন জুম্মার দিনে নামাযের জন্য ডাকা (আযান দেয়া) হয়, তখন তোমরা আল্লাহর যিকিরে ( অর্থাৎ নামাযে) ছুটে যাও।” নামায ঈমানদারকে প্রতিদিন ৫ বার সে যিকরে হাজির করে। ঈমানদার ব্যক্তি এভাবেই অন্ততঃ দিনে ৫ বার মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণে জায়গা করে নেয়। এভাবেই গড়ে উঠে মা’বুদের সাথে বান্দার গভীর সম্পর্ক।

বস্তুতঃ প্রতিটি ইবাদতই হলো মহান আল্লাহতায়ালার যিকর। রোযার যিকর হয় সমগ্র দিন ব্যাপী; এবং সেটি সমগ্র রমযানের মাস জুড়ে। হজ্বে সে যিকর চলে হজ্বের ইহরাম বাধাকালীন সময়ে। মহান আল্লাহতায়ালার যিকর তখনও হয় যখন বান্দা যাকাত দেয়। এদিক দিয়ে নামায অনন্য; যিকরের আয়োজন হয় কম পক্ষে দিনে ৫ বার এবং চলে আমৃত্যু। যারা তাহাজ্জুদ ও নফল নামায পড়ে -তাদের জীবনে যিকরের মাত্রা আরো অধিক। অপর দিকে একমাত্র নামাযেই যিকরের কিতাব তথা পবিত্র কোর’আন থেকে পাঠ করাটি বাধ্যতামূলক; রোযা, হজ্ব বা যাকাতের ন্যায় অন্য কোন ইবাদতে নয়।

সর্বকালে ও সর্বজনপদে মানবের মনে যিকর তথা ধ্যানমগ্নতাকে প্রতিষ্ঠা দেয়াই হলো মহান আল্লাহতায়ালার নীতি। কারণ এ যিকরই দেয় জান্নাতের পথে চলার আগ্রহ। দেয় সত্য পথের সন্ধান। এবং সে যিকর প্রতিষ্ঠায় প্রতি যুগেই নামায গণ্য হয়েছে শ্রেষ্ঠ মাধ্যম রূপে। তাই হযরত মূসা (সাঃ)’র সাথে প্রথম বাক্যালাপেই তাঁকে নামাযের হুকুম দেয়া হয়। হযরত মূসা (সাঃ)’র সাথে মহান আল্লাহতায়ালার প্রথম বাক্য বিনিময় হয় পবিত্র তুয়া উপত্যাকায়। নিজ পরিবারকে নিয়ে তখন তিনি মিশরে ফিরছিলেন। হযরত মূসা (সাঃ)কে নির্দেশ দেয়া হয়, “নিশ্চয় আমিই আল্লাহ এবং আমি ছাড়া আর কোন ইলাহা নাই। অতএব আমার ইবাদত করো এবং প্রতিষ্ঠা দাও নামাযকে –যাতে আমার যিকর করতে পার।” –(সুরা ত্বাহা, আয়াত ১৪)।

নামাযে যিকরের মূল ভূমি হলো কোর’আনের আয়াত। নামাযীর মনের গভীরে মহান আল্লাহাতায়ালা তাঁর পবিত্র বাণীগুলি গেঁথে দেন পবিত্র কোর’আনের আয়াতগুলির মাধ্যমে। তখন ধ্যানমগ্ন হয় নামাযীর মন। কিন্তু ধ্যানের সে সামর্থ্য মাতাল ব্যক্তির অবচেতন মনের থাকে না। তখন ব্যর্থ হয় নামাযের মূল উদ্দেশ্য। সে ব্যর্থতা থেকে বাঁচাতেই মদ পান করে নামাযে আসা হারাম ঘোষিত হয়। এবং পরবর্তীতে মদ্যপান পুরাপুরি হারাম ঘোষিত হয়। তবে দুর্ভাবনার আরেকটি গুরুতর বিষয় হলো, মানব মনের যে সামর্থ্যটি শুধু মদই কেড়ে নেয়, কেড়ে নেয় কোর’আন বুঝার অক্ষমতাও। তখন নামায ব্যর্থ হয় নামাযীর জীবনে কাঙ্খিত চারিত্রিক বিপ্লব আনতে।

তাই কত কোটি লোক নামায পড়লো সেটিই বড় কথা নয়। কতজন দুর্বৃত্তকে নামায চরিত্রবান করলো এবং কত জনকে ফিরালো পাপকর্ম থেকে -সেটিই মূল কথা। এক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলির কোটি কোটি নামাযীর ব্যর্থতাটি বিশাল। নামায পড়ছে আবার মিথ্যা বলছে, ঘুষ খাচ্ছে এবং দুর্নীতিও করছে। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলি রেকর্ড গড়ছে দুর্বৃত্তিতে। এক্ষেত্রে ব্যর্থতাটি নামাযের নয়, বরং যারা নামায পড়ে তাদের। নামায ব্যর্থ হচ্ছে নামাযীকে ধ্যানমগ্ন করতে। নামাযী ব্যর্থ হচ্ছে নিজ জীবনের হিসাব নিতে। এর কারণ, নামাযীদের কোর’আন বুঝার অক্ষমতা। মদের প্রভাব কয়েক ঘন্টায় শেষ হয়। কিন্তু কোর’আন বুঝার ক্ষেত্রে যে অক্ষমতা, সেটি ব্যক্তিকে অক্ষম রাখে আমৃত্যু। এ অক্ষমতা ডেকে আনে মানব জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক ব্যর্থতা।সেটি জাহান্নামে পৌঁছার। ঈমান পুষ্টি পায় কোর’আনের জ্ঞান থেকে। তাই মানব জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো কোর’আন বুঝার সক্ষমতা অর্জন। এজন্যই নামায-রোযার পূর্বে কোর’আনের জ্ঞান লাভ ফরজ করে হয়েছে। সে ভয়ানক ব্যর্থতা থেকে বাঁচতেই মিশর, ইরাক, সিরিয়া, সূদান, মরক্কো, আলজিরিয়া, লিবিয়া, মালি, তিউনিসিয়ার ন্যায় বহু দেশের জনগণ মাতৃভাষাকে দাফন করে কোর’আনের ভাষাকে আপন করে নেয়। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, ভাষাপ্রেম তাদের জান্নাতে নিবে না। বরং জান্নাতে নিবে কোর’আনের জ্ঞান।

মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান হলো পবিত্র কোর’আন। এ কোর’আনই দেখায় জান্নাতের পথ। দেয় সভ্যতর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের রোডম্যাপ। কোর’আনের কারণেই নামাযের শ্রেষ্ঠত্ব। প্রতিটি নামাযীকে নামাযের প্রতি রাকাতে কোর’আনের কিছু অংশ পাঠ করতে হয়। নইলে নামাযই হয় না। নামাযের গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো ক্বিয়াম অর্থাৎ জায়নামাযে দাঁড়ানো থাকাকালীন সময়। এ সময়টিতে কোর’আন থেকে কিছু পাঠ করা হয়। কোর’আন পাঠের সে কাজটি রুকু, সিজদা বা বসাকালীন সময়ে হয় না। তাই যে নামাযে দীর্ঘ সময় ক্বিয়ামে কাটানো হয় -সে নামাযের ওজন অধিক। নামাযের সাথে কোর’আনের গভীর সম্পর্কের বর্ণনাটি এসেছে সুরা আরাফে। বলা হয়ছে, “এবং যারা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলো কোর’আনকে এবং প্রতিষ্ঠা দিল নামাযকে, নিশ্চয়ই আমরা (এরূপ) সৎকর্মশীলদের প্রতিদানকে নষ্ট করিনা।”–(আয়াত ১৭০)। একই রূপ বর্ণনা এসেছে সুরা আনকাবুতে। বলা হয়েছে, “(হে মুহম্মদ), তোমার উপর ওহী রূপে যা নাযিল করেছি তা পাঠ করো কিতাব থেকে (অর্থাৎ কোরআনকে) এবং প্রতিষ্ঠা দাও নামাযকে। নিশ্চয়ই নামায বাঁচায় ফাহেশা (অশ্লিলতা, জ্বিনা, পাপাচার) ও দুর্বৃত্তি থেকে। এবং নিশ্চয়ই আল্লাহর যিকরই সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম। এবং আল্লাহ জানেন যা কিছু তোমরা করো। –(সুরা আনকাবুত, আয়াত ৪৫)। উপরুক্ত দুটি আয়াতে  পবিত্র কোর’আন এবং নামাযে কোর’আন পাঠের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দিনের অন্য সময়ে কোর’আন পাঠের সুযোগ না মিললেও সেটিকে ৫ বার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে নামাযে সুরা তেলাওয়াতের মাধ্যমে। রোগের ভ্যাকসিন নিলে সে রোগ থেকে বাঁচা যায়। কোর’আনের জ্ঞান ব্যক্তির চেতনা রাজ্যে তেমনি এক ভ্যাকসিনের কাজ করে। ফলে যে ব্যক্তি প্রতিদিনে ৫  ওয়াক্ত নামায আদায় করে সে বাঁচে সকল প্রকার অশ্লিলতা, জ্বিনা, পাপাচার ও দুর্বৃত্তি থেকে।

পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ হয়েছে মিরাজের পর অর্থাৎ হিজরাতের প্রায় এক বা দেড় বছর আগে। প্রশ্ন হলো, এর আগে প্রায় ১১ বছর যাবত নবীজী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণ কি করতেন? সে সময় কি ছিল তাদের ইবাদতের ধরণ? সে সময় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ছিল পবিত্র কোর’আন পাঠ তথা কোর’আনের জ্ঞানার্জন। জ্ঞানই গড়ে চেতনা ও চরিত্র। অজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তির চেতনা-চরিত্র কখনোই একই রূপ হয়না। সাহাবায়ে কেরাম যেরূপ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব গড়ে উঠতে পরেছিলেন তার মূলে ছিল কোর’আনের জ্ঞান। নবুয়ত লাভের পর প্রথম যে কয়েকটি সুরা নাযিল হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো সুরা মুজাম্মিল। এ সুরায় নবীজী (সাঃ)’র উপর নির্দেশ এসেছে যিনি তিনি রাতের অর্ধেক অংশ বা তার চেয়ে কিছু বেশী বা কম অংশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পবিত্র কোর’আন থেকে তেলাওয়াত করেন। সাহাবাগণও সেটিই করতেন। ৫ ওয়াক্ত নামায ফরজ হওয়ার পূর্বে ১১ বছর ধরে সে কাজ অবিরাম ভাবে চলতে থাকে। এভাবেই সাহাবাদের হৃদয়ে গভীর ভাবে স্থান করে নেয় কোর’আনের জ্ঞান। সে জ্ঞানের উপর নির্মিত হয় তাদের বিস্ময়কর চারিত্রিক কাঠামো।

 

যে নামায কল্যাণ আনে

নামায মুসলিম জীবনে কল্যাণ দিবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আজকের মুসলিম জীবনে নামাযের সে কল্যাণ কতটুকু? বাস্তবতা হলো, কোটি কোটি মানুষ নামায পড়লেও সবার নামায একই রূপ হয় না। সকল নামাযীর চেতনায় ও চরিত্রে একই রূপ বিপ্লবও আসে না। বরং অনেক নামাযীর জীবনে আসে মারাত্মক স্খলন। নামাযকে সফল করতে হলে যত্নবান হতে হয় নামাযের প্রতিটি ধাপে। প্রতি ওয়াক্ত নামাযের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট সময়; খেয়াল রাখতে হয় ওয়াক্তের দিকে। যেমন বলা হয়েছে, “নামায নির্দিষ্ট সময়ে আদায়ের জন্য মু’মিনদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।” –(সুরা নিসা, আয়াত ১০৩)। তবে জরুরি শুধু নির্দিষ্ট সময়ই নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো নামাযের জন্য নির্দিষ্ট স্থান মসজিদে গিয়ে নামায আদায়। এজন্যই জরুরি হলো, নামাযের আযান শুনে মসজিদের দিকে ধাবিত হওয়া। তাই মসজিদে নামায পড়া ও সঠিক ওয়াক্তে নামায পড়ার ক্ষেত্রে যারা গাফেল -তাদের রোগটি ঈমানে।

হাদীসে বলা হয়েছে, “যখন কোন মু’মিন ব্যক্তি নামাযের জন্য মসজিদ অভিমুখে রওয়ানা দেয়, তখন থেকেই সে নামাযে দাখিল হয়ে যায়। এবং প্রতি কদমে বৃদ্ধি করা হয় তার মর্যাদা। এবং মসজিদে গিয়ে নামাযের অপেক্ষায় বসে থেকেও সে নামাযের সওয়াব পায়।” মসজিদে নামায আদায়ের সওয়াব ঘরে নামায আদায়ের চেয়ে ২৭ গুণ অধিক। এমন কি অন্ধ ও পঙ্গুদেরও মসজিদে গিয়ে নামায আদায়ের উৎসাহ দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মকতুম (রাঃ) ছিলেন অন্ধ। তিনি নবীজী (সাঃ)কে বল্লেন, “আমি তো চোখে দেখিনা, ফলে মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করা কঠিন। আমি কি অনুমতি পেতে পারি ঘরে নামায পড়ার?” নবীজী (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি ঘর থেকে আযান শুনতে পান?” বল্লেন, “হাঁ, আমি আযান শুনতে পাই।” নবীজী (সাঃ) বল্লেন, “তবে আপনাকে মসজিদে এসেই নামায পড়তে হবে।” –(আবু দাউদ শরীফ)। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণীত হাদীসঃ নবীজী (সাঃ)  বলেন, “আমার ইচ্ছা হয়, জ্বালানী কাঠ সংগ্রহের নির্দেশ দেই্। এরপর আযানের পর কাউকে ইমামতির দায়িত্ব দিয়ে ঐসব লোকদের বাড়ীতে যাই যারা মসজিদে নামাযে আসেনি এবং তাদের ঘরগুলি জ্বালিয়ে দেই।”–(বুখারী ও মুসলিম শরীফ)। আবু দাউদ শরীফের হাদীসঃ “যদি কোন মহল্লায় তিন জন মুসলিমও বাস করে তবে তাদের উচিত জামায়াতবদ্ধ ভাবে নামায আদায় করা।

তাছাড়া মসজিদে নামায আদায়ে মনের যে একাগ্রতা ও ধ্যানমগ্নতা থাকে -তা ঘর, অফিস বা দোকানের নামাযে থাকে না। কারণ, ঘর, অফিস ও দোকানে অন্যদের শোরগোল, কথা-বার্তাসহ দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার মত অনেক কিছুই থাকে। ফলে সেখানে থাকে না যিকিরের পরিবশে। কিন্তু মসজিদ সাঁজানো হয় নামাযের জন্য। তাছাড়া মসজিদে বসে অন্যের নামায দেখে শেখারও অনেক কিছু থাকে। নামাযরত পাশের ব্যক্তির একাগ্রতা, ধ্যানমগ্নতা ও দীর্ঘ রুকু-সেজদা দেখে নিজের মনেও ভাল নামায আদায়ের আকাঙ্খা জাগে। তাছাড়া নেকড়ের পাল যেমন বিশাল মহিষকে একাকী পেলে ঘিরে ধরে, তেমনি ঈমানদারকে একাকী পেলে ঘিরে ধরে শয়তানও।

 

মুসলিমের মিশন ও নামায

ইসলাম শুধু ব্যক্তির জীবনে পরিশুদ্ধি চায় না। পরিশুদ্ধি চায় সমাজ ও রাষ্ট্রের চৌহদ্দিতেও। চায়, দুর্বৃত্তির নির্মূল ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। সে লক্ষ্যে চায়, ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। সেরূপ একটি প্রকল্পকে বিজয়ী করতে প্রতিটি ঈমানদারকে তাই ভিশন ও মিশন নিয়ে বাঁচতে হয়। মুসলিমের মিশন তো তাই যা মহান আল্লাহতায়ালার ভিশনকে বিজয়ী করার জন্য জরুরি। পবিত্র কোর’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার সে ভিশনটি হলো “লি’ইউযহিরাহু আলাদ্দিনি কুল্লিহি” অর্থাৎ সকল দ্বীনের উপর তাঁর দ্বীন তথা ইসলামের বিজয়। ঈমানদারের দায়বদ্ধতা হলো সে ভিশন নিয়ে বাঁচা। ফলে মুসলিমের বাঁচার মিশনে লড়াই তখন অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ, ইসলামের শত্রুপক্ষের দখলে যে ভূমি সেটি তারা বিনা যুদ্ধে ছাড়তে রাজী নয়। ফলে জিহাদ ছাড়া মহান আল্লাহতায়ালার ভিশন নিয়ে সামনে এগুনোর আর কোন রাস্তা থাকে না। এবং যেখানেই যুদ্ধ,  সেখানে দুর্গ, সৈন্য ও সৈন্যের প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। মসজিদ হলো সেই দুর্গ, প্রতিটি নামাযী হলো সেই সৈনিক এবং ৫ ওয়াক্ত নামায হলো সেই প্রশিক্ষণ।

প্রশিক্ষণের অর্থ শুধু সামরিক কলাকৌশল শেখানো নয়, বরং মূল বিষয়টি হলো ইসলামের বিজয়ে জান, মাল, মেধাসহ সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগে নামাযীকে প্রস্তুত করা। এবং লক্ষ্য, নামাযীদের মাঝে সিসাঢালা দেয়ালসম অটুট ঐক্যের প্রতিষ্ঠা দেয়া। অতীতে মুসলিমগণ যখন একের পর বিজয় এনেছে, তখন মসজিদ ছাড়া তাদের কোন দুর্গ বা ক্যান্টনমেন্ট ছিল না। নামায ছাড়া তেমন নিয়মিত কোন প্রশিক্ষণও ছিল না। মসজিদের জায়নামাযে বসে জিহাদের প্রস্তুতি নেয়া হতো। তখন রাজস্বের সিংহভাগ খরচ করে সৈন্য পালতে হয়নি। নামাযী নিজ অর্থ, নিজ খাদ্য, নিজ বাহন ও নিজ অস্ত্র নিয়ে রণাঙ্গণে হাজির হতো। তারা সেটিকে জান্নাতে প্রবেশের বাহন মনে করতো। আজ মুসলিম দেশগুলিতে বিপুল অর্থব্যায়ে ক্যান্টনমেন্টের সংখ্যা বেড়েছে, সৈন্য সংখ্যা ও তাদের প্রশিক্ষণের আয়োজনও বেড়েছে। কিন্তু তাতে বিজয় বাড়েনি বরং বেড়েছে পরাজয়। বরং বহু মুসলিম দেশে এ সৈনিকেরা পরিণত হয়েছে স্বৈরাচারি শাসকচক্রে।

অন্যের ধর্মের অনুসারিগণ ক্লাবে বা মদ্যশালায় বন্ধুত্ব গড়ে ও জোটবদ্ধ হয়। ইসলাম ভাতৃত্বের বন্ধন গড়ে মসজিদের পবিত্র মেঝেতে। জায়নামাযে ভাষা, গোত্র, বর্ণ ও এলাকাভিত্তিক কোন বিভক্তি থাকে না। সব নামাযীকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাতার বাঁধতে হয়। হাদীসে বলা হয়েছে, কাতারে ফাঁক থাকলে সেখানে শয়তান ঢুকে পড়ে। এবং জামাতবদ্ধ হওয়ার এ রীতি শুধু জায়নামাযে সীমিত রাখলে চলে না, সেরূপ একতাকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গণেও প্রতিষ্ঠা দিতে হয়। প্রতিষ্ঠা দিতে হয় রণাঙ্গণে। জামাতবদ্ধ নামাযের সেটিই তো গুরুত্পূর্ণ  শিক্ষা। তখন মুসলিমদের ভূগোলের আয়োতন বাড়লেও ভূগোল খন্ডিত হয় না। কিন্তু আজ মুসলিম উম্মাহর মাঝে যে বিভক্তি, তা দেখে নিশ্চিত বলা যায়, নামায থেকে তারা কোন শিক্ষাই গ্রহণ করেনি।  

             

যে নামায আযাব ডেকে আনে

নামায শুধু ঈমাদারগণই পড়ে না। মুনাফিকগণও পড়ে। মহান আল্লাহতায়ালা খুশি হন মু’মিনদের নামাযে এবং প্রচন্ড অখুশি হন মুনাফিকদের নামাযে। নামায তখন সওয়াবের বদলে আযাব ডেকে আনে। তাই শুধু নামায পড়লেই চলে না, নজর রাখতে হয় নামায যেন মুনাফিকের নামাযে পরিণত না হয়। কি ধরণের নামায মহান আল্লাহতায়ালার অভিসম্পাত ডেকে আনে সে বিষয়টি জানানো হয়েছে সুরা মাউনে। বলা হয়েছে,“ধ্বংস ঐসব নামাযীদের, যারা দেরীতে নামায আদায় করে এবং নামাযে খাড়া হয় লোক দেখানোর জন্য।” –(সুরা মাউন, আয়াত ৫-৬)।

নামায না পড়লে গর্দান থেকে ইসলামের রশি ছিন্ন হয়ে যায়। নবীজী (সাঃ)র জামানায় নামায গণ্য হতো মুসলিমের প্রধান পরিচিতি রূপে। যারা নামায পড়তো না, তারা গণ্য হতো কাফের রূপে। মুসলিম সমাজে কাফের রূপে পরিচিত হওয়ার বিপদ বুঝে মুনাফিকগণ নামাযকে বেছে নিত ঢাল রূপে। তারা শুধু নামাযই পড়তো না, বরং নবীজী (সাঃ)র পিছনে প্রথম কাতারে হাজির হতো। লোক-দেখানো সে নামাযের মধ্য দিয়ে তারা মুসলিমদের ধোকা দিত। এবং ধোকা দিত মহান আল্লাহতায়ালাকেও। নামায নিয়ে মুনাফিকদের সে ষড়যন্ত্রকে ফাঁস করেছে সুরা নিসা। বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই মুনাফিকগণ আল্লাহকে ধোকা দেয়, আসলে তিনিই (আল্লাহ) তাদেরকে ধোকা দেন। এবং যখন তারা নামাযে দাঁড়ায়, দাঁড়ায় আলস্য নিয়ে এবং লোক-দেখানোর উদ্দেশ্য। আল্লাহকে তারা সামান্যই স্মরণ করে।” –(আয়াত ১৪২)।

তাই নামায বা অন্যকোন নেক আমল করলেই মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তা গৃহিত হবে -বিষয়টি তেমন সহজ সরল নয়। নেক আমল কবুলের কিছু শর্ত আছে। সে শর্তের কথা শুনানো হয়েছে সুরা তাওবাতে। বলা হয়েছে, “তাদের দান আল্লাহর কাছে গৃহিত হওয়া থেকে কোন কিছুই বাধা দেয় না -একমাত্র এছাড়া যে তারা অস্বীকার করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে, নামাযে দাঁড়ায় আলস্য নিয়ে এবং দান করে অনিচ্ছা নিয়ে।” –(আয়াত ৫৪)। ইবাদত রূপে গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে নামাযীকে তাই জায়নামাযে দাঁড়াতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি গভীর আত্মনিবেদন ও আত্মসমর্পণ নিয়ে। পবিত্র কোর’আনে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে, “নিশ্চয়ই কামিয়াবী মু’মিনদের জন্য। যারা নামাযে আত্মনিবেদিত।” –(সুরা মু’মিনুন, আয়াত ১-২)। এবং সে আত্মনিবেদন ও আত্মসমর্পণ শুধু নামাযে সীমিত রাখলে চলে না, প্রকাশ ঘটাতে হয় রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালত ও ব্যবসা-বানিজ্যে। নামাযের সাথে বেঈমানদের সে গাদ্দারীটি ধরা পড়ে যখন আদালতে শরিয়তি আইনের বদলে কুফরি আইনকে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়।  এবং খেলাফতের বদলে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয় স্বৈরাচারকে।

 

নামায দেয় দোয়ার পরিবেশ

দোয়া সর্বাবস্থায় করা যায়। চলতে ফিরতে, কর্মস্থলে, এমন কি বিছানায় শুয়েও মহান আল্লাহর দরবারে আরজী পেশ করা যায়। মু’মিনের জন্য মহান আল্লাহতায়ালার দরবার সব সময় খোলা। তবে দোয়ার শ্রেষ্ঠতম সময় যেমন নামাযে, তেমনি নামায শেষে জায়নামাযে। নামায গড়ে আল্লাহতায়ালার সাথে সরাসরি সংযোগ। সে জন্য পীর বা দরবেশের মধ্যস্থতা লাগে না। মহান দয়াময়ের স্মরণের জায়গাতে নামায মু’মিনের জন্য স্থান করে দেয়। ফলে সৃষ্টি করে দোয়া কবুলের যথার্থ পরিবেশ। মহান আল্লাহতায়ালা চান, নামাযের মাধ্যমে তাঁর ঈমানদার বান্দাহ তাঁর দরবারে আবেদনটি পেশ করুক। এটিই হলো বান্দার জন্য নামাযের সবচেয়ে বড় দান। নির্দেশ দেয়া হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা ছবর ও নামাযের সাহায্যে সাহায্য চাও। নিশ্চ্য়ই আল্লাহ ধৈয্যশীলদের সাথে।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ১৫৩)। মহান আল্লাহতায়ালা থেকে মাগফিরাত লাভের এটিই হলো তাঁর নিজের দেখানো পথ। তাই দয়াময় রাব্বুল আ’লামীনের দরবারে দোয়া পেশের জন্য যেমন ছবর চাই, তেমনি চাই নামায। নামায ছেড়ে যারা পীরের মাজারে বা সুফি হালকায় দোয়া কবুলের জন্য ধর্না দেয়, তাদের জন্য এ আয়াতে রয়েছে চরম হুশিয়ারি।

দোয়ার গুরুত্ব কি, দোয়া কি ভাবে করতে হয় এবং কোন দোয়াটি শ্রেষ্ঠ সেটিও শিখিয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালা। সে শিক্ষাটি দেয়া হয়েছে সুরা ফাতেহা’তে -যা পাঠ করতে হয় নামাযের প্রতি রাকাতে। এ সুরা পাঠ না করলে নামাযই হয় না। তাই জরুরি শুধু সুরা ফাতেহা পাঠ নয়, বরং এ সুরার প্রতিটি বাক্যের অর্থ হৃদয়ে গভীর ভাবে ধারণ করা। সুরা ফাতেহা’র মূল বিষয় তিনটি। এক). প্রথমে বর্ণিত হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার মর্যাদা। বলা হয়েছে,“আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন”।  অর্থঃ সকল প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহর। তিনিই “রাহমানির রাহীম”, তিনিই “মালিকি ইওয়ামিদ্দিন।” অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা হলেন সবচেয়ে দয়াময় এবং দয়া করাই তার রীতি। এবং তিনি রোজ হাশরের দিনের সর্বসময় কর্তা। দুই). দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এ সুরায় বর্ণিত হয়েছে তা হলো মুসলিম জীবনের মিশন। সে মিশনটি হলোঃ “ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা না’স্তায়ীন” অর্থাৎ আমরা ইবাদত করি একমাত্র মহান আল্লাহর এবং একমাত্র আল্লাহ থেকেই আমরা সাহায্য ভিক্ষা করি। তিন). তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো দোয়া। এবং সে দোয়াটি হলো “ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম”। অর্থঃ “(হে মহান আল্লাহ), আমাকে সিরাতুল মুস্তাকীম তথা জান্নাতের পথটি দেখান।” এটিই হলো মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দোয়া। যে ব্যক্তি সিরাতুল মুস্তাকীম পেল সেই জান্নাত পেল। এর চেয়ে বড় পাওয়া সমগ্র মানব জীবনে আর কি হতে পারে? ধনসম্পদ, সন্তান, স্বাস্থ্য তো কাফেরও পায়। কিন্তু তা কি জান্নাতে নেয়। যে ব্যক্তি ব্যর্থ হলো সিরাতুল মুস্তাকীম পেতে, সে পৌঁছে জাহান্নামে। এর চেয়ে বড় ক্ষতিই বা কি হতে পারে? নামায তাই সবচেয়ে বড় ক্ষতি থেকে যেমন বাঁচতে শেখায়, তেমনি দেখায় সবচেয়ে বড় কল্যাণের পথ। নামায এভাবেই কাজ করে জান্নাতে চাবি রূপে। ১০/১২/২০২০।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *