অধ্যায় তিন: নিহত তিরিশ লাখের কাহিনী

অপরাধ সত্য লুকানোর

প্রতি যুদ্ধেই রক্তপাত ঘটে; রক্তপাত একাত্তরেও ঘটেছিল। নিহত ও আহত হয়েছিল হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। কিন্তু সে যুদ্ধে কতজন নিহত হয়েছিল সে সংখ্যা এখনও সঠিক ভাবে নির্ণীত হয়নি। ১৭ কোটি বাংলাদেশীর এটি এক বড় ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতা নিয়ে আজ থেকে বহুশত বছর পরও প্রশ্ন উঠবে। পশুপাখীরা নিজেদের মৃত সাথীদের লাশ গণনার সামর্থ্য রাখে না। এটি তাদের অসামর্থ্যতা। একই রূপ অসামর্থ্যতা ধরা পড়ে বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রেও। উন্নত দেশের সরকারগুলি দুর্যোগে গরু-ছাগল মারা গেলও তার সঠিক হিসাব রাখে। দেশে কতটা পশু সম্পদের ক্ষতি হলো এভাবে তার খতিয়ান নেয়। আজ থেকে শত শত বছর পর তখনকার প্রজন্ম বাংলাদেশীদের সে অসামর্থ্যতা দেখে কি বিস্মিত হবে না? বলা হয়, একাত্তরে নিহতদের সংখ্যা তিরিশ লাখ। অথচ তার কোন তথ্য-প্রমাণ নাই। কারণ, গ্রাম-গঞ্জে নেমে কেউই নিহতদের তালিকা তৈরি করেনি। সাহিত্য, পত্র-পত্রিকা, ফিল্ম ও ইতিহাসের বইয়ে তিরিশ লাখ নিহতের যে তথ্যটি দেয়া হয় সেটি মাঠ পর্যায়ে কোন রূপ জরিপ বা তথ্য সংগ্রহ না করেই। বলা হয় নিতান্তই লাগামহীন অনুমানের ভিত্তিতে। ফলে কোন বিবেকমান মানুষের কাছে কি সে তথ্য বিশ্বাসযোগ্য হয়? একাত্তরের যুদ্ধে কতজন নিহত হলো সেটি গণনা করার সামর্থ্য যে সরকারের ছিল না –বিষয়টি আদৌ তা নয়। তবে না করার কারণটি অন্যত্র। নিহতদের সংখ্যা নির্ণয়ের সে কাজটি তারা করেনি নিজেদের রটানো বিশাল মিথ্যাকে লুকানোর স্বার্থে। অথচ সত্য আবিস্কার করা প্রতিটি বিবেকমান মানুষের অতি মৌলিক দায়িত্ব। একমাত্র মিথ্যাচারীরাই সত্য আবিস্কারে উদাসীন হতে পারে। গুরুতর অপরাধটি এখানে সত্য লুকানোর –ইসলামে যা মহাপাপ।

তিরিশ লাখ নয়, এমন কি এক একজনের মৃত্যুও বেদনাদায়ক এবং অনাকাঙ্খিত। কিন্তু সে গভীর বেদনাটি মিথ্যা বলার ন্যায় পাপের অনুমতি দেয় না। কোন বেদনাদায়ক ঘটনার সাথে মিথ্যার মিশ্রন ঘটলে সেটি বরং কদর্যকর এবং নিন্দনীয় হয়। ঘটনা যত নৃশংস ও বেদনাদায়কই হোক, নিহতের সংখ্যা বাড়িয়ে বললে তাতে সম্মান বাড়ে না। বরং মিথ্যাবাদী রূপে দেশে-বিদেশে হেয় হতে হয়। মিথ্যার মিশ্রনে তখন কলংকিত হয় দেশের ইতিহাস। স্বাধীনতার মর্যাদা বাড়াতে সেটি জরুরীও নয়। তাছাড়া জনগণ ও নতুন প্রজন্মের উপর এমন মিথ্যাচারের কুফলটিও কি কম? এতে প্রতিষ্ঠা পায় মিথ্যা বলার সংস্কৃতি; এবং জন-জীবনে গড়ে উঠে প্রতি পদে মিথ্যা বলার অভ্যাস। তবে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে মিথ্যা বলার বিশাল রাজনৈতিক উপযোগীতা আছে;সেটি ভারতের স্বার্থসেবী বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের কাছে। তাদের কাছে বিশাল আকারের মিথ্যার প্রয়োজনটি ছিল মূলত একাত্তরের যুদ্ধকালে বাঙালী মুসলিমদের মাঝে যে ভাতৃঘাতি বিভক্তি, যুদ্ধ ও ঘৃনা সৃষ্টি হয়েছিল সেটিকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে। তাতে সহজ হয় বাংলাদেশীদের দীর্ঘকাল বিভক্ত ও পঙ্গু রাখা। শক্তিশালী বাংলাদেশের নির্মাণ রোধে ও ইসলামের উত্থান প্রতিরোধে এমন মিথ্যাচারই হলো তাদের প্রধান অস্ত্র। ভারত এবং ভারত-সেবী নেতাকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা এজন্যই সে মিথ্যাকে বাঁচিয়ে রাখতে এতো সচেষ্ট। ফলে চায় না, নিহতদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয়ে কোন জরিপ হোক।

 

কেন এ বিশাল মিথ্যা?

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত এবং ভারতপন্থী আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের সবচেয়ে বড় মিথ্যাটি হলো,একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক এ্যাকশনের মূল লক্ষ্যটি ছিল বাঙালী নির্মূল। বলা হয়, তারা নাকি শুধু বাংলার মাটি চাইতো,মানুষ নয়! নিহত তিরিশ লাখের কিসসা মূলত সে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। যাদের বিরুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী নির্মূলের অভিযোগ, তাদের হাতে ৩০ লাখের কম নিহত হলে কি সে অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য বানানো যায়? হিটলার ৬০ লাখ ইহুদী হত্যা করেছিল। হিটলার যে ইহুদীদের নির্মুল চাইতো -সেটি অনেকেই তাই বিশ্বাস করে নিয়েছিল। ফলে নয় মাসে কমপক্ষে ৩০ লাখ বাঙালী নিহত না হলে পাকিস্তান সরকারর বিরুদ্ধে বাঙালী নির্মূলের অভিযোগটি দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য বানানো যায় কেমনে? তিরিশ লাখের তথ্যটি আবিস্কৃত হয়েছে তাই রাজনৈতিক প্রয়োজনে। মাঠে ময়দানে গণনাকারি নামিয়ে কত জন মারা গেল সে হিসাব নিলে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে মুজিবের অভিযোগটি ডাহা মিথ্যা প্রমাণিত হতো,সেটি খোদ মুজিবও জানতেন। তাই একাত্তরের নিহতদের সঠিক সংখ্যা সংগ্রহকে তিনি নিজের রাজনীতির জন্য অতিশয় ক্ষতিকর ভেবেছেন। মিথ্যাচারীরা একই কারণে প্রতি যুগে সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। একই চেতনা কাজ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝেও। নইলে আজও কি সঠিক পরিসংখ্যান বের করা এতো কঠিন? নিহত আপনজনদের কথা কোন পরিবার কি শতবছরেও ভূলে? ফলে একাত্তরের নিহতদের স্মৃতি মাত্র ৪০ বা ৫০ বছরেই তারা ভূলে বসবে -সেটিও কি বিশ্বাস করা যায়?

অনেকের বিশ্বাস, তিরিশ লাখের সংখ্যাটি আবিস্কার করেছে ভারত। ভারতের এজেন্ডা শুধু পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি করাই ছিল না, পাকিস্তানীদেরকে বিশ্বের দরবারে হিংস্র, বর্বর ও কুৎসিত রূপে চিত্রিত করাটিও। সে সাথে নিজেকে মানবতার অবতার রূপে জাহির করা। অথচ ভারতে সংখ্যালঘু নির্মূলে বিগত ৬০ বছরে যতগুলি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে তা বিশ্বের তাবত দেশেও হয়নি। নিজের স্বার্থে ভারত চায়, উপমহাদেশের মুসলিমদের বাঙালী-অবাঙ্গলী, পাকিস্তানপন্থী ও পাকিস্তান-বিরোধী এরূপ নানা পরিচয়ে বিভক্ত রাখা। পাকিস্তান থেকে ফেরার পথে শেখ মুজিব যখন লন্ডন আসেন তখন ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে নিহত তিরিশ লাখের তথ্যটি তাঁর কানে প্রথমে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ভারতই যে এ সংখ্যার জনক সে অভিমতটি প্রখ্যাত মার্কিন গবেষক Professor Richard Sisson এবং Professor Leo Rose এর। ভারত-প্রদত্ত এ তথ্য নিয়ে সন্দেহ করার সাহস শেখ মুজিবের ছিল না। এবং ছিল না ভারতকে মিথ্যুক রূপে প্রমানিত করায় তাঁর সামান্যতম আগ্রহ। বরং মুজিব ও তার সহচরগণ তখন কৃতজ্ঞতায় ভারত বন্দনায় মগ্ন। তাছাড়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃনাকে বাঁচিয়ে রাখায় মধ্যে ভারতের ন্যায় তিনিও নিজের রাজনৈতিক লাভ দেখেছিলেন। তাই মুজিব সরকারের পক্ষ থেকে নিহত তিরিশ লাখের সংখ্যাটি প্রচার করা হয় এবং ইতিহাসের গ্রন্থাবলিতে তুলে ধরা হয় কোনরূপ জরিপ না করেই।

 

তিরিশ লাখ ও ইমেজ সংকট

নিহত তিরিশ লাখের তথ্যটি বিদেশী সাংবাদিকগণও প্রথম দিকে কোনরূপ বিচার-বিশ্লেষণ না করেই প্রচার করতে থাকে। বিভিন্ন দেশের পত্রিকায় নিহতদের সংখ্যা সে সময় তিরিশ লাখ বলেই ছাপা হয়। তবে তারা উল্লেখ করতো,পরিসংখ্যানটি বাংলাদেশ সরকারের দেয়া। সাংবাদিকগণ গবেষক,বিশেষজ্ঞ বা বিচারক নন। তাদের কাজ মাঠে নেমে জরিপ করা নয়। তাদের পেশা,দেশের ক্ষমতাসীন সরকার বা অন্য পক্ষ কি বলে সেটিই হুবহু প্রচার করা। মজার ব্যাপার হলো, আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীগণ বিদেশী সাংবাদিকদের সেসব রিপোর্টগুলিকে আবার নিজেদের পরিসংখ্যানের পক্ষে দলিল রূপে পেশ করে। এবং সেগুলিকে আদালতে সাক্ষ্য রূপে পেশ করছে একাত্তরের পাকিস্তানপন্থীদের ফাঁসীতে ঝুলানোর লক্ষ্যে। কিন্তু বিদেশীদের কাছে এ সংখ্যাটি সহসাই অতি অবিশ্বাস্য বড় রকমের মিথ্যা রূপে গণ্য হয়। এতে সংকটে পড়ে বাংলাদেশের ইমেজ। প্লাবনে বা ভূমিকম্পে যে পরিবারের নিহতের সংখ্যা এক বা দুইজন, সে পরিবারটি যদি বাড়িয়ে চার জন বলে প্রচার করে -তবে কি সে পরিবারের সম্মান থাকে? আন্তর্জাতিক সমাজে বাংলাদেশের ইজ্জতের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গ্লানিকর কটাক্ষ শুরু হয় মূলত নিহতের সংখ্যা তিরিশ লাখ রটনা করার পর থেকে। তার কিছু উদাহরন দেয়া যাক। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন। তাঁর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। তিরিশ লক্ষটি মার্কিন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে কতটা উদ্ভট ও অবিশ্বাস্য লেগেছিল সেটি ফুটে উঠেছে সে সময়ের মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট (পররাষ্ট মন্ত্রী) মি. উইলিয়াম রজার্সের সাথে হেনরি কিসিঞ্জারের আলাপে। কিসিঞ্জার রজার্সকে বলেছিলেন: “Do you remember when they said there were 1000 bodies and they had the graves and they couldn’t find 20?” অনুবাদঃ আপনার কি মনে আছে যখন তারা (বাংলাদেশীরা) বলেছিল যে এক হাজার মৃতদেহ আছে এবং তাদের কবরও আছে। অথচ তারা খুঁজে বিশ জনও পায়নি। হেনরি কিসিঞ্জারের এই একটি বাক্যের মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছে নিহত তিরিশ লাখের তথ্যটি তাদের কাছে কতটা বড় রকমের অবিশ্বাস্য মিথ্যা মনে হয়েছে।

নিহতদের সংখ্যা ও গণকবর নিয়ে কঠাক্ষটি শুধু হেনরি কিসিঞ্জারের একার নয়। একই রূপ কঠাক্ষ করেছেন লন্ডনের দৈনিক গার্ডিয়ানি পত্রিকার William Drummond। তিনি ১৯৭২ য়ের জুনে এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, “Of course, there are ‘mass graves’ all over Bangladesh. But nobody, not even the most rabid Pakistani-hater, has yet asserted that all these mass graves account for more than about 1,000 victims. Furthermore, because a body is found in a mass grave does not necessarily mean that the victim was killed by the Pakistani Army”. অনুবাদঃ “অবশ্যই বাংলাদেশ জুড়ে গণ-কবর রয়েছে। কিন্তু কেউই –এমনকি যারা চরম ভাবে পাকিস্তান বিদ্বেষী তারাও এতোটা প্রত্যয়ের সাথে বলতে পারিনি যে, সে সব গণকবরে সব মিলিয়ে এক হাজারের বেশী লাশ আছে। উপরুন্ত, গণকবরে লাশ পাওয়া গেলেই সেটি প্রমাণিত হয় না যে,সে ব্যক্তি পাকিস্তানে আর্মির হাতে নিহত হয়েছিল।”

তিনি আরো লিখেন, “Killing fields and mass graves were claimed to be everywhere, but none was forensically exhumed and examined in a transparent manner, not even the one in Dhaka University. Moreover, the finding of someone’s remain cannot clarify, unless scientifically demonstrated, whether the person was Bengali and non-Bengali, combatant or non-combatant, whether death took palce in the 1971 war, or whether it was caused by the Pakistan Army”. অনুবাদঃ “বলা হয়, বধ্যভূমি ও গণকবর ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। কিন্তু কোথাও এ অবধি লাশকে কবর থেকে বের করে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ময়নাতদন্তের আয়োজন করা হয়নি। এমন কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও নয়। তাছাড়া কারো মরদেহের পেলেই সে কি বাঙালী না অবাঙালী ছিল, যোদ্ধা না অযোদ্ধা ছিল বা উনিশ শ’ একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল -সেটি প্রমাণিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা-নিরীক্ষার।” অথচ বাংলাদেশে সেরূপ কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষার আয়োজন হয়নি। কারা মারা গেল, কতজন মারা গেল এবং কাদের হাতে মারা গেল, সেটি নির্ধারিত হয়েছে নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এবং গুজবের ভিত্তিতে। সে গুজবের পিছনে কাজ করেছিল রাজনৈতিক মতলব। তাই ইতিহাস থেকে ইচ্ছাকৃত ভাবেই বাদ দেয়া হয়েছে নিহত হাজার হাজার অবাঙালী ও পাকিস্তানপন্থীদের সংখ্যা।

William Drummond লেখেন, “The field investigation by the Home Ministry of Bangladesh in 1972 had turned up about 2,000 complaints of deaths at the hands of the Pakistan Army”. অনুবাদঃ “১৯৭২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে, সে তদন্তে পাকিস্তান আর্মির হাতে প্রায় দুই হাজার নিহত হওয়ার অভিযোগ আসে।” তিনি আরো লেখেন “The Pakistan Army did kill, but the Bangladeshi claims were blown out of proportion undermining their credibility”. অনুবাদঃ “পাকিস্তান আর্মি মানুষ হত্যা করেছে, কিন্তু বাংলাদেশীরা নিহতদের সংখ্যা এতোটাই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে পেশে করেছে যে তাতে সে দাবীর বিশ্বাস-যোগ্যতাই বিনষ্ট হয়েছে।”

১৯৭২ সালের ৬ জুন William Drummond লন্ডনের “The Guardian” পত্রিকায় “The Missing Millions” শিরোনামায় লিখেছিলেন, “This figure of three million deaths, which the Sheikh has repeated several times since he returned to Bangladesh in early January, has been carried uncritically in sections of world press. Through repeatation such a claim gains a validity of its own and gradually evolves from assertion to fact needing no attribution. My judgment, based on numerous trips around Bangladesh and extensive discussions with many people at the village level as well as in the government, is that the three million death figure is an exaggeration so gross as to be absurd.” অনুবাদঃ “নিহত তিরিশ লাখের তথ্যটি যা শেখ মুজিব বাংলাদেশের ফেরার পর জানুয়ারির প্রথম দিকে কয়েকবার বলেছেন তা বিশ্বের কোন কোন পত্র-পত্রিকা কোনরূপ বিচার-বিবেচনা না করেই প্রচার করেছে। বার বার প্রচারের ফলে এ দাবীটি গ্রহণযোগ্যতা পায়, এবং ধীরে ধীরে সেটি নিছক অনুমান থেকে সত্য ঘটনায় পরিণত হয়। অন্যরা এর নিয়ে অভিমত ব্যক্ত করার প্রয়োজনও বোধ করেনি। কিন্তু বাংলাদেশে অসংখ্যবার ভ্রমন এবং সেখানে গ্রাম পর্যায়ে ও সরকারি মহলে বহু লোকের সাথে বিষদ আলোপ আলোচনার প্রেক্ষিতে আমার ধারণা জন্মেছে, তিরিশ লাখ নিহত হওয়ার তথ্যটি অবিশ্বাস্য রকমের অতিরঞ্জিত।”

কারো কারো অভিমত, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে যাওয়ার পথে লন্ডনে এসে তিনি যুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। তখন তাঁর সাথে ছিল বিবিসির তৎকালীন সাংবাদিক জনাব সিরাজুর রহমান। তিনি তাঁকে আনুমানিক তিন লাখের কথা বলেছিলেন। সম্প্রতি লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি চিঠিতে জনাব সিরাজুর রহমান সে কথাটি উল্লেখও করেছেন। তবে জনাব সিরাজুর রহমান যে তিন লাখের তথ্যটি দিয়েছেন সেটিও ছিল সম্পূর্ণ অনুমানের উপর। যুদ্ধকালীন ৯ মাসে তিনি একবারের জন্যও বাংলাদেশে যাননি, ফলে মাঠ পর্যায়ের কোন ধারণা তাঁরও ছিল না। তিন লাখের তথ্যটি তিনিও আবিস্কার করেছেন লন্ডন বসে,এবং সেটি যুদ্ধকালীন প্রচারিত গুজবের উপর ভিত্তি করে। অপরদিকে ঢাকায় নেমে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিরাজুর রহমানের বলা সে তিন লাখকেই তিন মিলিয়ন তথা তিরিশ লাখ বলেছেন। শেখ মুজিবের মুখে তিরিশ লাখের কথা শুনে ঢাকা থেকে সে সংখ্যা নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন লন্ডনের “দি টাইম” পত্রিকার রিপোর্টার পিটার হ্যাযেলহার্স্ট, এবং তা ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। সেদিন যে রিপোর্টটি ছাপা হয়েছিল তা হলঃ In his first public rally in independent Bangladesh Mujib reported to have said, “I have discovered that they have killed three million of my people”. অনুবাদঃ “স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর প্রথম জনসভায় শেখ মুজিব বলেন, আমি জানতে পেরেছি তারা আমার তিরিশ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে।” তাঁর সে রিপোর্টের পর সে সংখ্যাটি বিশ্বময় প্রচার পায়। শেখ মুজিব ভূলে তিন লাখকে তিন মিলিয়ন বলেছিলেন, না ইচ্ছা করেই তিরিশ লাখ বলেছিলেন সেটি একমাত্র তিনিই বলতে পারেন। তবে তিরিশ লাখের পিছনে যে কোন প্রামান্য দলিল নেই -সেটি নিয়ে এ বিশ্বের কারোই কোন দ্বিমত নেই। তাই শুরু থেকেই এ সংখ্যাটি ভূয়া এবং অবিশ্বাস্যই রয়ে গেছে। এখানে লক্ষনীয় হল, মুজিব শুধু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে নিহত বাঙালীর সংখ্যা তিন মিলিয়ন বলেছেন। যে বিপুল সংখ্যক অবাঙালীরা বাঙালীর হাতে নিহত হয়েছে সে তিন মিলিয়নের মাঝে তাদের উল্লেখ নাই। সম্ভবত অবাঙালীদের নিহত হওয়ার বিষয়টি তার দৃষ্টিতে কোন বেদনাদায়ক সহিংস ঘটনা মনে হয়নি।

 

২৫ মার্চের মিলিটারি এ্যাকশন এবং মিথ্যাচার

মিথ্যাচার যে শুধু একাত্তরের যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে হয়েছে তা নয়, প্রকাণ্ড মিথ্যাচার হয়েছে ২৫ মার্চের ঢাকায় রাতের হত্যাকাণ্ড নিয়ে। বলা হয়, পাক-বাহিনী ২৫শে মার্চের এক রাতেই ঢাকা শহরে ৬০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। বলা হচ্ছে, এ ৬০ হাজারের মধ্যে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক, এবং ঢাকায় বসবাসরত হিন্দুরা। কাদের সিদ্দিকীর দাবী, ২৫শে মার্চের মাত্র এক রাতে সারা দেশে তিন থেকে পাঁচ লাখ বাঙালীকে হত্যা করা হয়। ( কাদের সিদ্দিকী, ১৯৯৭)  হিটলার বহু লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল। তার হাতে অনেক গুলো গ্যাস চেম্বার ছিল। কিন্তু সে হত্যাকাণ্ডে হিটলারের কয়েকটি বছর লেগেছিল। আর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫শে মার্চের মাঝ রাতে হামলা শুরু করে সকাল হওয়ার আগেই ৬০ হাজার মানুষকে শুধু হত্যাই করেনি, তাদের লাশও নাকি গায়েব করেছিল! এবং এমন ভাবে গায়েব করেছিল যে আওয়ামী লীগের সরকার তাদের শাসনামলে সে ৬০ হাজার মানুষের কবর বা হাড্ডির সন্ধান করতে পারলো না! কোন সুস্থ বিবেক বুদ্ধির মানুষ কি এমন কাহিনী বিশ্বাস করতে পারে? অথচ ভারত-ভক্ত বাঙালীরা সেটি শুধু বিশ্বাসই করে না, তা নিয়ে সাহিত্য রচনা করে,ইতিহাস লেখে, নাটক করে এবং ফিল্মও বানায়। বাংলাদেশের ইতিহাস এরূপ কাহিনীতে ভরপুর। এটি সত্য, পাক বাহিনী একাত্তরে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল। কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ কি এ অনুমতি দেয়, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলতে হবে? আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের আরো দাবী, একাত্তরের ৯ মাসে ধর্ষিতা বা শ্লীলতাহানীর শিকার হয়েছিল আড়াই লক্ষ বাঙালী মহিলা।-(Shahriar Kabir, 2010)। ধর্ষিতাদের সংখ্যা বাড়িয়ে কেউ ৪ লাখ, কেউ বা ৫ লাখও বলছে। সংখ্যা নিয়ে কে কতটা হাঁক দিবে সেটা যেন খেয়াল খুশির ব্যাপার। প্রমাণ বা পরিসংখ্যান পেশের যেহেতু বাধ্যবাধকতা নেই, ফলে বাতিক বেড়েছে সংখ্যা বাড়িয়ে চমক সৃষ্টি করা! যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশে একদিনের জন্য না থাকলে কি হবে, শেখ মুজিবও তেমনি হাঁক দিয়েছিলেন ৩০ লাখের। এভাবে কি কোন দেশের ইতিহাস লেখা হয়? অথচ বাংলাদেশে সেটিই হয়েছে।

বলা হয়, একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতে ঢাকার রাস্তায় নামে পাকিস্তান আর্মীর ট্যাংকের বহর। নেমেছিল হাজার হাজার সৈনিক। ট্যাংকের গোলায় ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। তাতে মারা পড়েছিল ৬০ হাজার মানুষ। যার মধ্যে বিপুল সংখ্যায় ছিল ছাত্র-ছাত্রি। কিন্তু সে রাতে কতগুলি ট্যাংক রাস্তায় নেমেছিল, কোন কোন রাস্তা দিয়ে সে ট্যাংকগুলো গিয়েছিল এবং সে ট্যাংকের গোলায় কতগুলো ঘরবাড়ী, দালানকোঠা ধ্বংস হয়েছিল সে হিসাব বাংলাদেশের ইতিহাসে মেলে না। নিহত মানুষের নাম-ঠিকানাও মেলেনা। কতজন সৈন্য রাস্তায় নেমেছিল সে ইতিহাসও নেই। পঁচিশে মার্চ রাতের ইতিহাস সংগ্রহ করেছেন গবেষক শর্মিলা বোস। সে কাজে তিনি পাকিস্তান গিয়েছিলেন। ২৫ মার্চের রাতে সেনাবাহিনীর যে অফিসারের অপারেশনের উপর দায়িত্ব ছিল তাঁর নাম লে. কর্নেল (পরে ব্রিগেডয়ার) তাজ। অপারেশন চালিয়েছিল ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। তাঁর রিপোর্ট অনুযায়ী সে অপারেশনে ইকবাল হলে মারা যায় ১২ জন, জগন্নাথ হলে ৩২ জন এবং রোকেয়া হলে ৭ জন। রোকেয়া হলে মৃতদের সবাই ছিল সে হলের পুরুষ কর্মচারি। কোন ছাত্রী বা নারী সেখানে মারা যায়নি। সর্বমোট মারা যায় ৩০০ জন। সামরিক অফিসারদের ওয়ারলেস আলোচনার রেকর্ড থেকেও জানা যায় মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০ জন।–(শর্মিলা বোস, ২০১১)। ২৫ মার্চের রাতে নিহত প্রফেসর জোতির্ময় গুহাথাকুরতার কন্যা প্রফেসর মেঘনা গুহাথাকুরতাও বলেন সে রাতে মারা গিয়েছিল ৩০০ জন।–(মেঘনা গুহাথাকুরতা)। ২৫ মার্চ রাতে ট্যাংক বাহিনীর সাথে যিনি ছিলেন তার সাথে শর্মিলা বোস নিজে কথা বলেছেন। উক্ত অফিসারের নাম, লে. মুহাম্মদ আলী শাহ। তিনি ছিলেন ১৮ পাঞ্জাবের। তাঁর কথা, “ঐ রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে নামানো হয় মাত্র তিনটি ট্যাংক। এ ট্যাংকগুলোর মূল কাজ ছিল শক্তির প্রদর্শনী”। তিনি আরো বলেন, “সে রাতে ঐ ট্যাংকগুলোর মুল কামানটি একটি বারের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি। তবে আওয়াজ সৃষ্টির জন্য পাশের দুটো ছোট কামান থেকে মাঝে মাঝে গোলা ছোড়া হয়েছিল”। তিনি আরো বলেন, “তাঁর লোকেরা ট্যাংক তিনটি নিয়ে শুধু প্রধান প্রধান রাস্তা দিয়েই চলেছিল, কোন আবাসিক এলাকাতে ঢুকেনি। নিউ মার্কেট বা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেও নয়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীদের উপর পাকিস্তানী সৈন্যদের বলাৎকার এবং বলৎকার শেষে হত্যার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বহুল আলোচিত বিষয়। সে অভিযোগ কতটুকু সত্য সেটি গুরুতর গবেষণা ও বিবেচনার বিষয়। সে সময় রোকেয়া হলের প্রোভোষ্ট ছিলেন বেগম আখতার ইমাম। তিনি বলেন, রোকেয়া হলে সর্বমোট ৮০০ জন ছাত্রীর জন্য স্থান ছিল। ২৫ মার্চের আগেই প্রায় সকল ছাত্রী হোস্টেল ত্যাগ করে। মাত্র ৭ জন ছাত্রী থেকে যায়। তাদেরকে সাহেরা খাতুন নামে একজন হাউস টিউটরের বাসায় পৌঁছে দেয়া হয়। তাদের সবাই নিরাপদ ছিল এবং ২৭ মার্চ তারা তাদের অভিভাবকদের সাথে হোস্টেল থেকে চলে যায়। একই রূপ বিবরণ দিয়েছেন,তৎকালে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর জনাব ড. সাজ্জাদ হোসেন তাঁর “একাত্তরের স্মৃতি” বইতে।

 

প্রতি ২৫ জনে একজনের মৃত্যু!

তিরিশ লাখের অর্থ তিন মিলিয়ন। একাত্তরে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি অর্থাৎ ৭৫ মিলিয়ন। যে কোন স্কুল ছাত্রও হিসাব করে বের করতে পারে, সাড়ে ৭ কোটির (৭৫ মিলিয়ন) মাঝে তিরিশ লাখ (তিন মিলিয়ন) মানুষের মৃত্যু হলে প্রতি ২৫ জনে একজনকে মারা যেতে হয়। যে গ্রামে ১ হাজার মানুষের বাস সে গ্রামে মারা যেতে হয় ৪০ জনকে। ঘটনাক্রমে সে গ্রামে কেউ মারা না গেলে পরবর্তী গ্রামটি যদি হয় ১ হাজার মানুষের বসবাস তবে সেখান থেকে মারা যেতে হবে কমপক্ষে ৮০ জনকে। যে থানায় ১ লাখ মানুষের বাস সেখানে মারা যেতে হবে ৪ হাজার মানুষকে। প্রতি থানায় ও প্রতি গ্রামে মৃত্যুর সংখ্যা এ হারে না হলে ৩০ লাখের সংখ্যা পূরণ হবে না। তাছাড়া ৯ মাসে তিরিশ লাখ মানুষকে হত্যা করতে হলে প্রতিদিন গড়ে ১১, ১১১ জনকে হত্যা করতে হয়। ১৯৭১’য়ে বাংলাদেশ ছিল একটি গ্রামীন জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি দেশ যার প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ জনগণই বাস করতো গ্রামে। সেনাবাহিনীর পক্ষে যেহেতু প্রায় ৭০ হাজার গ্রামের মাঝে ১০% গ্রামে পৌঁছাতে হলে নদীনালা, দ্বীপ, বিল, হাওর ও চরে পরিপূর্ণ ৭ হাজার গ্রামে পৌঁছতে হয়। সেটি কি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে ৯ মাসে পৌঁছা সম্ভব ছিল? ফলে সহজেই ধারণা করা যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী শতকরা ৯৫ ভাগ গ্রামেও পৌঁছতে পারিনি। ফলে তিরিশ লাখের বিপুল হত্যাকান্ডটি ঘটাতে হতো জেলা, মহকুমা বা উপজেলা শহরে। তখন পাড়ায় পাড়ায় অসংখ্য নারীকে ধর্ষিতা হতে হতো। এটি কি তাই বিশ্বাসযোগ্য? সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাক-বাহিনীর প্রকৃত সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৫ হাজার। -(জেনারেল নিয়াজী, ২০০১)। যুদ্ধবন্ধি রূপে যেসব পাকিস্তানীদের ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের মধ্যে অনেকে ছিল বেসামরিক ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্য। ৪৫ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের পক্ষে কি সম্ভব ছিল বিল-হাওর,নদী-নালা,দ্বীপ ও চরাভূমিতে পরিপূর্ণ একটি দেশের প্রায় ৭০ হাজার গ্রামে পৌছানো? প্রতিটি গ্রাম দূরে থাক প্রতিটি ইউনিয়নেও কি তারা যেতে পেরেছিল? প্রকৃত সত্য হল, যুদ্ধকালীন ৯ মাসে অধিকাংশ গ্রাম দূরে থাক, অধিকাংশ ইউনিয়নেও পাক বাহিনী পৌঁছতে পারিনি। প্রতিটি গ্রামে ও ইউনিয়নে গেলে সীমান্তে যুদ্ধ করলো কারা? কারা পাহারা দিল দেশের বিমান বন্দর, নদীবন্দর, সবগুলো জেলা-শহর ও রাজধানী? ৩০ লাখ মানুষের নিহত হওয়ার এ তথ্য বিশ্বের দরবারে গ্রহণযোগ্য হওয়া দূরে থাক, বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনি বহু ভারতীয় সামিরিক অফিসারের কাছেও। ভারতীয় রাজনীতিবিদগণ তিরিশ লাখের পক্ষে যতই বলুক, যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কোন কোন ভারতীয় জেনারেলদের কাছে এটি হাস্যকর মিথ্যা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাদের সে অভিমত একবার নয়, বহুবার প্রকাশ পেয়েছে।

 

পাকিস্তান সরকারের রিপোর্ট

একাত্তরের নিহতদের নিয়ে বাংলাদেশে সরকার কোন হিসাব নিকাশের ব্যবস্থা না করলেও পাকিস্তান সরকার সেটির অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। সে কমিশনের প্রধান ছিলেন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হামদূর রহমান। ইনি নিজে একজন বাঙালী। উক্ত কমিশন একাত্তরে তিরিশ লাখের সংখ্যাটিকে “altogather fantastic and fanciful” বলেছেন। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় “সম্পূর্ণ উদ্ভট এবং কল্পনাপ্রসূত”। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল হেডকোয়ার্টারের হিসাব মতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ২৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই সংখ্যাটি পাওয়া যায় তৎকালীন আর্মির পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের পক্ষ থেকে হেড কোয়ার্টারকে দেয়া প্রতিদিনের সিচুয়েশন রিপোর্ট থেকে। তবে বিচারপতি হামদূর রহমান মনে করেন এ সংখ্যাটিও অতিরঞ্জিত। কারণ তখন আর্মির লোকেরা বিভিন্ন অপরাশেনে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের অপারেশনকে গুরুত্বপূর্ণ ও সফল দেখাতে গিয়ে নিহত শত্রুর সংখ্যা বেশী বেশী করে দেখাতে পারে। তবে এ ২৬ হাজারের মাঝে বাঙালীদের হাতে নিহত বিহারী বা অবাঙালীদের কোন পরিসংখ্যান নাই। নিহত অবাঙালীদের সংখ্যা অনিবার্য কারণেই এর চেয়ে অনেক বেশী হবে। কারণ, খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিল, শান্তাহার, চট্টগ্রাম, যশোর, পাকশি, সৈয়দপুর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়ার ন্যায় প্রতিটি স্থানে অবাঙালীদের থেকে বেছে বেছে শুধু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের হত্যা করা হয়নি, বরং গণহত্যার শিকার হয়েছিল অবাঙালী নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধরা। শর্মিলা বোস মনে করেন,একাত্তরে নিহতদের সর্বমোট সংখ্যা ৫০ হাজার থেকে এক লাখ হতে পারে। এর মধ্যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যরাও রয়েছে। ভারতীয় জেনারেল জ্যাকবের হিসাব মতে ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্য মারা গেছে ৬,৭৬১ জন। -(Jacob, 2001)। আহত হয়েছে ৮ হাজার। আর জেনারেল নিয়াজীর হিসাব মতে তেসরা ডিসেম্বর অবধি প্রায় ৪ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের মৃত্যু ঘটে, আহত হয় আরো ৪ হাজার।-(Niazi, 1998)।

 

পরিকল্পিত মিথ্যাচার

একাত্তরের হতাহতদের নিয়ে মিথ্যাচারটি যেমন বাঙালীদের দ্বারা হয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হয়েছে মতলববাজ অমুসলিম সাংবাদিকদের দ্বারা। মুসলিমদের গায়ে কালিমা লেপনেই তাদের আনন্দ। একাত্তরে সে সুযোগ পেয়ে তারা নামে পরিকল্পিত মিথ্যাচারে। এমন একজন সাংবাদিক ছিলেন লন্ডনের “দি টাইম” পত্রিকার এন্থনী ম্যাসক্যারেনহাস। তিনি ছিলেন করাচীতে বসবাসরত একজন পাকিস্তানী নাগরিক। ধর্মে ছিলেন খৃষ্টান। তিনি রিপোর্ট করেন, পাকিস্তানী আর্মি ২৬ মার্চের রাতে ঢাকার শাখারি পাড়ায় ৮ হাজার মানুষকে হত্যা করে। ভদ্রলোক এ রিপোর্টটি করেছেন সেখানে সরেজমিনে না গিয়েই। অর্থাৎ তিনি সাক্ষি সেজেছেন ঘটনাস্থলে কোন হত্যাকাণ্ড নিজ চোখে না দেখে। আরো দুঃখজনক হল, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আজও এ ঘটনার উপর কোনরূপ তদন্ত হয়নি। ফলে শাখারী পাড়ায় সে রাতে কারা মারা গেল, এবং কি তাদের নামঠিকানা -সে বিষয়ে আজও কোন খোঁজ-খবর নেয়া হয়নি। এ জরুরী কাজটি না করে সরকার যেটি করেছে সেটি হল ভিত্তিহীন মিথ্যার প্রচার। অথচ শাখারী পাড়ার হত্যাকাণ্ডের উপর একমাত্র গবেষণা-মূলক কাজটি করেছেন শর্মিলা বোস। তিনি সরেজমিনে শাখারি পট্টিতে গেছেন। যারা সেদিন আর্মি এ্যাকশন নিজ চোখে দেখেছেন সেখানে গিয়ে সেসব হিন্দুদের সাথে তিনি সরাসরি কথা বলেছেন। শাখারি পাড়ার হত্যাকাণ্ড নিয়ে এন্থনী ম্যাসক্যারেনহাসের রিপোর্টটি মিথ্যাপূর্ন ছিল, সেটি বেরিয়ে এসেছে তাঁর রিসার্চে। পাকিস্তানী হয়েও আন্তর্জাতিক বিশ্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী কালিমা লেপন করেছিলেন তিনিই। এ কালিমা লেপনের পর ত্বরিৎ তিনি পাকিস্তান ছেড়েছিলেন। শর্মিলা বোস শাখারি পাড়ার হিন্দুদের থেকে জানতে পারেন যে, সে রাতে পাকিস্তানী আর্মির হাতে মৃতের সংখ্যা ৮ হাজার নয়, বরং ১৪ বা ১৫ জন পুরুষ। মৃতদের মধ্যে একজন শিশুও ছিল। -(শর্মিলা বোস, ২০১১)। প্রতি যুদ্ধেই সত্য মারা পড়ে,এবং প্রচার পায় মিথ্যা। তবে প্রকৃত সত্যের মৃত্যু একাত্তরে কতটা ব্যাপক ভাবে হয়েছিল -এ হল তার নমুনা। ইতিহাসবিদদের কাজটি মিথ্যা ভাষ্যকে ইতিহাসের বইয়ে লিপিবদ্ধ করা নয়, বরং সত্যকে অন্বেষণ করা। অথচ সে কাজটিই বাংলাদেশে হয়নি।

 

চুকনগরের হত্যাকাণ্ড  

একাত্তরের নয় মাসে পাকিস্তান আর্মির হাতে সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে খুলনা-যশোর এলাকার চুকনগরে ২০শে মে তারিখে। হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন সেনা সদস্যের হাতে। সেখানে সেদিন তারা নির্মম হত্যা করেছিল ভারত অভিমুখে যাওয়া হিন্দু শরণার্থীদের। শর্মিলা বোস সেখানে গিয়ে সেদিন বেঁচে যাওয়া হিন্দুদের সাথে কথা বলেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী কেউ কেউ বলেন, এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সামরিক পোষাকধারি বিহারীরা। হতে পারে মার্চ-এপ্রিলে খুলনা-যশোরে ঘটে যাওয়া বিহারী গণহত্যার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এটি ছিল প্রতিশোধ হামলা। তবে শর্মিলা বোসের কথা, এ হ্ত্যাকাণ্ড নিয়েও অতি বড় রকমের অতিরঞ্জন ঘটেছে। কোন কোন বাংলাদেশী লেখকের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেখানে ১০ হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল। অথচ শর্মিলার বোসের কাছে বেঁচে যাওয়া হিন্দুরা বলেন, সেখানে সেদিন সর্বমোট ৮ থেকে ১০ হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ শরণার্থী ছিল। হত্যাকারিরা শুধু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের হত্যা করেছিল। কোন নারী ও শিশুকে নয়। হত্যাকারিরা কোন মহিলাকে স্পর্শ করিনি। অথচ ৮-১০ হাজার শরণার্থীর মধ্যে নারী ও শিশুদের সংখ্যাই ছিল অধিক। নিহতদের লাশগুলো সেদিন পাশের নদীতে ফেলেছিল ওয়াজেদ আলী এবং শের আলী নামক দুই ভাই। তারা ছিল চুকনগরের বাসিন্দা। তাদেরকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এ লাশগুলো নদীতে ফেলার জন্য ৪ হাজার টাকার ওয়াদা দিয়েছিল। অবশেষে দিয়েছিল ২ হাজার টাকা। শর্মিলা বোস এ হত্যাকাণ্ডের বিবরণ শুনেছেন ওয়াজিদ আলীর নিকট থেকে। শর্মিলা বোসের অভিমত, এ দুই ভাইয়ের পক্ষে ১০ হাজার লোকের লাশ একদিনে নদীতে ফেলা অসম্ভব। তাই অতিশয় অতিরঞ্জন ঘটেছে এখানেও। তাঁর মতে নিহতদের সংখ্যা কয়েক শত হতে পারে,৮ বা ১০ হাজার নয়। -(শর্মিলা বোস, ২০১১)।

তবে চুকনগরের হত্যাকাণ্ডের মটিভ কি ছিল সেটি অজানাই রয়ে গেছে। ঐদিন বেঁচে যাওয়ার কোন কোন হিন্দুর মতে, নিছক ডাকাতির স্বার্থে স্থানীয় মুসলিম খবর দিয়ে আর্মিকে ডেকে আনে। এব্যাপারে সবাই একমত যে, আর্মি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ত্বরিৎ চলে যায়। এরপর উদ্বাস্তুদের সহায় সম্বল লুণ্ঠনে নামে স্থানীয় বাঙালী মুসলমানেরা। এমন কি তারা আহত অথচ বেঁচে আছে এমন মানুষের পকেট ও ব্যাগ হাতড়িয়ে টাকা পয়সা লুণ্ঠন করেছিল। তখন ভারতের পথে যাত্রারত হিন্দু উদ্বাস্তুদের লুণ্ঠন করা সমাজের দুর্বৃত্ত প্রৃকৃতির লোকদের পেশায় পরিণত হয়। এমন ঘটনা দেশের নানা স্থানে ঘটতে থাকে। সাক্ষাতদাতাদের একজন শর্মিলা বোসকে বলে, সেদিন মৃত উদ্বাস্তুদের পকেট ও বাক্স থেকে সে ৮ লাখ টাকা ও ৪ কিলো স্বর্ণ পেয়েছিল। তবে সে অর্থ তার নিজের কাছে থাকেনি, অন্যরা নিয়ে নেয়। এ শরণার্থীদের অনেকেই ভারতে যাচ্ছিল বরিশালের মঠবাড়িয়া ও অন্যান্য এলাকা থেকে। তারা সাথে নিজেদের নৌকা এনেছিল। সে নৌকাগুলো স্থানীয় মুসলমানরা নিয়ে নেয়। সে সময় পাকিস্তান আর্মির স্থানীয় ব্রিগেড কমাণ্ডার ছিলেন ব্রিডেডিয়ার মুহাম্মদ হায়াত। ছিলেন মেজর (পরে কর্নেল) সামিন জান বাবর এবং  লে. (পরে লে. জেনারেল) গোলাম মোস্তাফা। তারা শর্মিলা বোসের কাছে বলেন, চুকনগরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তারা পূর্বে কখনো শুনেননি।-(শর্মিলা বোস, ২০১১)।

 

ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধ

প্রচণ্ড মিথ্যাচার হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধে ভারতের যুদ্ধাপরাধ গুলো আড়াল করার ক্ষেত্রেও। তারও কিছু উদাহরন দেয়া যাক। ঢাকা শহরের কেন্দ্রে ছিল একটি বিশাল ইসলামী ইয়াতিম খানা। সে ইয়াতিম খানার উপর ৯ই ডিসেম্বর ভারতীয় যুদ্ধবিমান ৫০০ কিলোগ্রাম থেকে ১০০০ কিলোগ্রাম ওজনের একটি বোমা ফেলে। এতে মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হয় ৩০০ জন ইয়াতিম বালক ও বালিকা। লন্ডনের দি অবজার্ভার পত্রিকায় ১২ ডিসেম্বর সে হামলার খবরটি ছাপা হয়েছিল এভাবেঃ “The worst of it till now is the horror of the Islamic orphanage, hit by Indian bombs at 4 o’clock this morning. Three hundred boys and girls are dead. I saw the place soon after dawn. Bombs had ploughed everyone into a vast and hideous mud-cake, most of them dead… Bombing at night is a deadly thing, and unnecessary here. These bombs were aimed at the airport runway, but the Indians had been attacking it for five days by daylight. Only at midday today did finally put a bomb right on it. But up to then, we had all agreed with an Australian correspondent here who muttered on the first day: “The Indians couldn’t hit a bull in the bum with a banjo”. অনুবাদঃ “এ যাবত কালের সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনাটি হল ইসলামী ইয়াতিম খানার। ভারতীয় বোমা সেখানে সকাল ভোর ৪ টায় আঘাত হানে। নিহত হয় তিন শত বালক-বালিকা। আমি স্থানটি সকালে সূর্যোদয়ের পরই দেখতে যাই। বোমার আঘাতে বিশাল এলাকার মাটি উলোট পালোট হয়ে গেছে। অতি ভয়ানক হল রাতে বোমার আঘাত। এ বোমটি পড়ার কথা বিমানবন্দরের রানওয়ের উপর, যার উপর গত ৫দিন ধরে ভারত দিনের আলোতে আঘাত হানছিল। অবশেষে কেবল আজই দুপুর বেলা সেখানে তারা একটি বোমা ফেলতে সফল হল। এবং সে সময় পর্যন্ত আমরা সবাই সেই অস্ট্রালিয়ান সাংবাদিকের সাথে একমত ছিলাম যে প্রথম দিনই বিড় বিড় করে বলছিল, “ভারতীয়রা একটি ষাড়ের পিছন দিকেও বেহালা দিয়ে আঘাত করতে না।”

ইয়াতিম খানার ন্যায় বেসামরিক এলাকার উপর এরূপ বোমাবর্ষণ আন্তর্জাতিক আইনে গুরুতর যুদ্ধাপরাধ। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের বইগুলোতে ৯ ডিসেম্বরের এ যুদ্ধাপরাধের উল্লেখ নেই। পাকিস্তান আর্মির হাতে ৭১’য়ের ১৯ মার্চে জয়দেবপুরে মারা পড়েছিল দুই জন, অথচ শেখ মুজিব সেটিকে ১০ গুণ বাড়িয়ে বলেছিলেন ২০ জন। অথচ ইয়াতিম খানার ৩০০ জন ইয়াতিম বালক-বালিকার সে তথ্যকে তিনি হিসাব থেকেই বাদ দিয়েছেন। কোথাও সেটির উল্লেখ থাকলেও সেটি চোখে পড়ার মত নয়। বরং উল্টো আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ এ জঘন্য যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছে। তারা বলে এ বোমা বর্ষণ নাকি করেছিল পাকিস্তানী বিমান বাহিনী। শর্মিলা বোস যখন ঢাকায় তাদের কাছ থেকে এরূপ কথা শোনেন তখন তাদের প্রশ্ন করেন,“পাকিস্তান বিমান বাহিনী তো ৬ ডিসেম্বরই পঙ্গু হয়ে যায়, ফলে তাদের তো হামলার সামর্থ্যই ছিল না। তারা বোমা ফেল্লো কি করে?” তখন তারা বলে, “পাকিস্তানীরা হেলিকপ্টার দিয়ে এ বোমা ফেলেছিল।” শর্মিলা বোস পাকিস্তানে গিয়েও সেনা-অফিসারদের কাছে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের বিমান বাহিনীতে হেলিকপ্টার কখনই বোমা ফেলার কাজে ব্যবহৃত হয়নি। ভারতপন্থীদের এমন প্রপাগাণ্ডার কারণ, ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধকে আড়াল করা। যেমন ভারত আড়াল করেছে মুক্তিবাহিনীর অপরাধকে। তাই ভারতের হাতে ৩০০ জন ইয়াতিম হত্যা যেমন মুক্তিবাহিনী বা আওয়ামী লীগনেতাদের কাছে অপরাধ গণ্য হয়নি, তেমনি কাদের সিদ্দিকীর ও তার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঢাকা স্টেডিয়ামে হাতপা বাঁধা ৪ জন রাজাকারকে হত্যা করলো তখন সে অপরাধ ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে কোন অপরাধ গণ্য হয়নি। অপরাধ গণ্য হয়নি দেশের নানা প্রান্তে বিহারী এবং রাজাকার হত্যাও। অথচ দখলদার বাহিনী রূপে ভারতীয় বাহিনীর দায়িত্ব ছিল বাঙালী-অবাঙালীর সবার জানমালের নিরাপত্তা দেয়া।

ভারতীয় বিমানবাহিনী আরেক নৃশংস যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছিল নারায়নগঞ্জে। ভারত-অনুগত বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা সে জঘন্য অপরাধকে আড়াল করেছে। নারায়নগঞ্জের পাওয়ার স্টেশনে বোমা ফেলতে গিয়ে বোমা ফেলা হয়েছিল আধা মাইল দূরে অবস্থিত ছিন্নমূল মানুষের আবাসিক বস্তিতে। সে হামলায় ৪শত থেকে ৫শত নিরীহ বেসামরিক মানুষকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল। দেড় শত আহত মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। লন্ডনের দি অবজার্ভার পত্রিকার রিপোর্টার তাঁর “ঢাকা ডায়েরী”তে লিখেছিলেন, “Bombing at night: Indian pilots had hit the sleeping heart of a pauper residential area half a mile from a power-station. Four or five hundred civilians were killed and 150 were in hospital. -(The Observer, 12 December, 1971). অনুবাদঃ “রাতের বোমাবর্ষনে: ভারতীয় পাইলট পাওয়ার স্টেশন থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে দরিদ্র আবাসিক এলাকার হৃৎপিণ্ডে আঘাত হানে। নিহত হয় চারশত থেকে পাঁচশত নিরপরাধ মানুষ। ১৫০ আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেয়া হয়।”

 

ব্যর্থতা বিবেক নিয়ে বেড়ে উঠায়

একাত্তরে বাঙালীর বহু ব্যর্থতাই অতি প্রকট ভাবে প্রকাশ করেছে। সবচেয়ে প্রকট ভাবে প্রকাশ পেয়েছে সুস্থ বিবেক নিয়ে বেড়ে না উঠার ব্যর্থতাটি। প্রকাশ পেয়েছে মিথ্যার প্রতি মোহ,সত্যে অনাগ্রহ এবং নৃশংসতা।ব্যক্তির বিবেকের সুস্থতা ও উন্নত মানবিক গুণের পরিচয় মেলে সত্যের পক্ষ নেয়া ও মিথ্যা বর্জনের সামর্থ্যে। বিবেকের সে গুণটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে প্রকাশ পায় না, স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণ এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও নয়। রাষ্ট্র নির্মাণ, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিস্ময়কর সাফল্য দেখাতে পারে অতিশয় মিথ্যাবাদি, চরিত্রহীন ও গণহত্যার ভয়ংকর দানবগণও। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলি যখন সাম্রাজ্যবাদী, ফ্যাসিবাদী, বর্ণবাদী ও উপনিবেশিক শোষকদের হাতে অধিকৃত হয় তখন সে দেশগুলি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও অর্থনীতিতে বিশাল বিপ্লব এনেছিল। হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানী তো আবিষ্কার ও উন্নয়নে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিল। মানবরূপী এ দানবগণ যে কতটা মানবশূণ্য সেটির প্রমাণ রেখেছিল মাত্র দুটি বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি মানুষ হত্যা করে। তারা চরিত্রের কদর্যতা রেখেছে আনবিক বোমা নিক্ষেপ করে। ইতিহাস গড়েছে গ্যাসচেম্বারে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জীবন্ত জ্বালিয়ে। অথচ সত্যের আবিস্কার ও মিথ্যার বর্জনে ইতিহাস গড়েছিল আরবের নিরক্ষর মানুষ। সে সফলতার কারণেই তারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়তে পেরেছিলেন। সভ্যতার মান এতোটা উচ্চে পৌঁছেছিল যে, বিশাল মুসলিম রাষ্ট্রের খলিফা হযরত উমর (রাঃ) তার সঙ্গি ভৃত্যকে উঠের পিঠে চড়িয়ে নিজে উঠের রশি ধরে টেনেছেন। অথচ সে রাষ্ট্র ভেঙ্গে বাংলাদেশের ন্যায় অন্তত ৫০টি বাংলাদেশ গড়া যেত। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালাও তাদের প্রশংসা করেছেন।

সত্যের আবিস্কার ও তার প্রতিষ্ঠার কাজটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ ও মহামূল্যবান যে মহান আল্লাহতায়ালা সে কাজের সফলতার পুরস্কার দেন অনন্ত অসীম কালের জন্য নিয়ামত ভরা জান্নাত দিয়ে। শত শত বৈজ্ঞানিক আবিস্কারেও সে পুরস্কার জু্টে না। অপর দিকে মিথ্যার প্রচারক হওয়ার শাস্তিটি ভয়ানক। তখন জু্টে জাহান্নামের আগুণ। সেটি শুধু কোটি কোটি বছরের জন্য নয়, বরং অনন্ত অসীম কালের জন্য। কিন্তু সত্যের আবিষ্কারে ও সত্যের পক্ষ নেয়ায় বাংলাদেশীদের ব্যর্থতাটি বিশাল। ফলে আবিষ্কৃত হয়নি একাত্তরে নিহতদের সঠিক তথ্য। তারা ব্যর্থ হয়েছে কোরআনী সত্যের পক্ষ নিতেও। ফলে দূরে সরেছে শরিয়ত ও জিহাদের ন্যায় ইসলামের শ্রেষ্ঠ বিধান থেকে। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশে পরাজিত হয়েছে ইসলাম। জনগণ ব্যর্থ হয়েছে রাজনীতির ময়দানে মহান আল্লাহতায়ালার নির্ধারিত জীবনবিধান ইসলামের পক্ষ নিতে। বরং তাদেরই অর্থে ও ভোটে বার বার বিজয়ী হয়েছে মিথ্যার প্রচারকগণ।এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নিহত তিরিশ লাখের ন্যায় অসংখ্য মিথ্যা।

বাংলাদেশ জুড়ে নিহত তিরিশ লাখের প্রকাণ্ড মিথ্যাটি যেরূপ ব্যাপক ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে -সেটি কি স্রেফ মুজিবের কাজ? বরং সে কাজ তো সেসব পুরোহিতদেরও যারা নিজেদেরকে গুরুজন, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী বা দেশের মেধা রূপে গণ্য করেন! মিথ্যার প্রচারক শুধু শেখ মুজিব ও তার বাকশালী সহচরগণই নয়, বরং সে পাপাচারে বিপুল সাফল্য দেখিয়েছে তারাও যারা দেশে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, লেখক, শিক্ষক, মিডিয়াকর্মী, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ ও আইনবিদ। নিহত তিরিশ লাখের মিথ্যাটি নিয়ে তাদের মাঝে কোন প্রতিবাদ নাই। বরং আছে সে বিকট মিথ্যার কাছে সচেতন আত্মসমর্পণ। কোথাও কিছু বলা বা লেখার সুযোগ পেলেই তথাকথিত এ শিক্ষিতজনেরা সে বিশাল মিথ্যাটির পক্ষে প্রচারণা শুরু করে। ঈমানদারের মুখে প্রতিনিয়ত লা-শরীক মহান আল্লাহতায়ালা এবং তাঁর রাসূলের পক্ষে সাক্ষ্যদানের কালেমা ধ্বনিত হয়।এ কালেমা ছাড়া কারো ঈমান বাঁচে না। মিথ্যার উপাশকদের মুখেও তেমনি কালেমা থাকে। সেটি মিথ্যার পক্ষে সাক্ষ্যদানের কালেমা। বাংলাদেশে মিথ্যাচারিদের সে প্রধান কালেমাটি হলো একাত্তরে তিরিশ লাখ নিহতের কথা। এ কালেমা ছাড়া এসব মিথ্যাচারিদের একাত্তরের চেতনা বাঁচে না। এটি কি কম অপরাধ? বাঙালী মুসলিমের এটি এক বিশাল ব্যর্থতা। বাংলাদেশে মিথ্যা যে কতটা বিজয়ী এবং সত্য যে কতটা পরাজিত -সেটি প্রমাণের জন্য এরপরও কি কোন গবেষণার প্রয়োজন আছে? চেতনার এরূপ রুগ্ন অবস্থায় নিহত তিরিশ লাখের ন্যায় বিশাল বিশাল মিথ্যা্গুলিও যে দেশজুড়ে ব্যাপক স্বীকৃতি পাবে তা নিয়েও কি সন্দেহ থাকে?

গ্রন্থপঞ্জি

  1. Bose, Sarmila, 2011: Dead Reckoning: Memories of the 1971 Bangladesh War, C. Hurst & Company, London.
  2. Sisson, Richard and Leo Rose (1990): War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh, University of California; Berkeley.
  3. Niazi, Lt Gen AA K (2002); The Betrayal of East Pakistan, Oxford University Press, Karachi.
  4. General Niazi, 2001: spoke to India Abroad — the Indian-American newspaper, which is owned by com – in December 2001: interview conducted by Amir Mir.
  5. Shahriar Kabir, 2010; “Bangladesh Holocaust of 71” published in Forum, a monthly publication of The Daily Star, Vol. 4, Issue 12, Dec. 2010.
  6. Hamoodur Rehman Commission (HRC); Report of Inquiry into the 1971 War, Vanguard Books Lahore, 513
  7. কাদের সিদ্দিকী, ১৯৯৭; স্বাধীনতা ‘৭১, অনন্যা, ৩৮/২ বাংলা বাজার, ঢাকা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *