মুসলিম উম্মাহর এ পতনযাত্রার হেতু কী?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

অতীতের ইতিহাস ও আজকের ইতিহাস

মুসলিমদের বিজয়যাত্রা যখন শুরু হয়েছিল তখন তারা বড়ই নিঃস্ব ছিলেন। তারা ছিল শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত। কি সংখ্যায়, কি সম্পদে, কি অস্ত্রে –কোন ক্ষেত্রেই তাঁরা প্রতিদ্বন্দী শত্রুর চেয়ে ভালো অবস্থায় ছিলেন না। তাদের অবস্থা এতটাই নাজুক ছিল যে, খোদ নবীজী (সাঃ)ও তাঁর সাহাবাগণ নিজ জন্মভূমি মক্কাতে বসবাস করতে পারেননি। নিজ ঘরবাড়ী, সম্পদ ও ব্যবসা-বানিজ্য ছেড়ে তাঁদেরকে মদিনাতে হিজরত করতে হয়েছে। অথচ মুসলিম ইতিহাসের যা কিছু গৌরবের -তার সিংহ ভাগের সৃষ্টি তাঁদের হাতে। অপর দিকে মুসলিমদের আজকের সংখ্যাটি বিশাল। ধনসম্পদও তাদের কম নয়। হাতে রয়েছে পৃথিবীপৃষ্টের অতি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক ভূ-ভাগ। একটি অমুসলিম দেশের রাজধানী লন্ডন শহরে আজ যতজন মুসলিমের বসবাস, নবীজী(সাঃ)’য়ের জীবনের শেখ দিনগুলিতে এতোজন মুসলিমই ছিল না। এমনকি বাংলাদেশের মত একটি মাত্র দেশে যত মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়া হয়েছে, খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে এমনকি উমাইয়া ও আব্বাসী আমলেও সমগ্র মুসলিম জাহানে তা ছিল না। শুধু কুয়েত, কাতার ও দুবাই’য়ের ন্যায় ক্ষুদ্র তিনটি জনপদে যে পরিমান সম্পদ জমা হয়েছে তা উমাইয়া বা আব্বাসী খলিফাদের আমলে মুসলিমদের রাষ্টীয় ভান্ডারে ছিল না।

কিন্তু এতো বিশাল জনসংখ্যা ও এতো সম্পদে মুসলিমদের গৌরব বেড়েছে কী? বেড়েছে কী তাদের শক্তি ও সামর্থ্য? বরং বেড়েছে পরাজয়,অপমান ও ভিক্ষাবৃত্তি। বেড়েছে মুসলিম উদ্বাস্তু। এবং বেগবান হয়েছে পতনযাত্রা্। মুসলিম ইতিহাসে যত পরাজয় ও অপমান -তার সিংহ ভাগের কারণ আজকের মুসলিমগণ। অতীতের ইতিহাস ছিল বিজয়ের, আর আজকের ইতিহাস হলো শত্রুর সামনে নিঃশর্ত আত্মমর্পণের। ইসলামের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, আইন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, পোষাক-পরিচ্ছদ থাকতেও তারা জীবন-যাপনের সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি  নিয়েছে বিদেশীদের থেকে। বিধর্মীদের কাছে আত্মসমর্পণ ও মানসিক গোলামীর এমন রেকর্ড মুসলিম ইতিহাসে অতীতে কখনোই প্রতিষ্ঠা পায়নি। অতীতে মুসলিমগণ দেশে দেশে ঘর বেঁধেছেন বিজয়ের বেশে। বিশ্বের বহু দেশে তাঁরা বহু শহর গড়েছেন। সেখানে মসজিদ গড়েছেন এবং ইসলামের প্রচার ও প্রতীষ্ঠা দিয়েছেন। এভাবেই মানবজাতিকে ইসলামের সভ্যতর জীবনবোধের সাথে পরিচিত করেছেন। তাদেরকে দিয়েছেন জান্নাতের পথে সিরাতুল মুস্তাকীমের সন্ধান। স্পেনে যখন মুসলিমদের শাসন তখন মুসলিমদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সমগ্র ইউরোপ থেকে ছাত্ররা সেখানে অধ্যায়ন করতে আসতো।

অথচ আজকের চিত্রটা সম্পন্ন ভিন্ন। মুসলিমগণ নিজেরাই আজ ইসলামের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। ইসলামের বিজয় ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় বিরোধগুলি আসছে মুসলিম দেশের শাসকদের তরফ থেকে। সৈয়দ জামাল উদ্দিন আফগানী বলেছিলেন, মেঘ যেমন সূর্যকে আড়াল করে রাখে মুসলিমগণও তেমনি আড়াল করে রেখেছে ইসলামকে। বস্তুত মুসলিমদের জন্যই অমুসলিমগণ প্রকৃত ইসলামকে দেখতে ও চিনতে ব্যর্থ হচ্ছে। মুসলিম ব্যবসায়ীগণ যখন বাংলা, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মত দেশগুলিতে ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্য গেছেন, তাদের দেখেই হাজার হাজার স্থানীয় মানুষ ইসলাম কবুল করেছেন। কারণ তারা showcasing করতেন ইসলামের। অথচ এখন মুসলিমদের দেখে অন্যরা দূরে সরছে। এমন কি দূরে সরছে তাদের নিজ সন্তানগণও। হেতু কী?

কারণগুলি সুস্পষ্ট। মুসলিমগণ নিজেদের কথা, কর্ম ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে যা কিছুর প্রকাশ ঘটাচ্ছে তা ইসলামের নয়, বরং বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, সেক্যুলারিজম, লিবারালিজমের ন্যায় নানা জাহিলী মতবাদের। রাজনীতি, শিক্ষাসংস্কৃতি, আইন-আদালত, বুদ্ধিবৃত্তি ও পোষাকপরিচ্ছদের মধ্য দিয়ে তারা যা কিছুর showcasing করে সেগুলি অমুসলিমদের। ইসলামের সর্বাঙ্গসুন্দর জীবন বিধানের সাথে তারা সংযোগ ছিন্ন করেছে অনেক আগেই। তারা দাঁড়িয়ে আছে অন্যদের আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক রোগগুলি নিজ দেহে ধারণ করে। খড়কুটো ও কচুরিপানা যেমন স্রোতে ভাসে, মুসলিমগণও তেমনি ভেসে চলেছে নানারূপ রাজনৈতিক, আদর্শিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক স্রোতে। একই রূপ স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলিতে বসবাসকারি হাজার হাজার মুসলিম সন্তান। অথচ মুসলিমদের ইতিহাস তো অন্যদের সৃষ্ট স্রোতে না ভেসে নিজেরাই স্রোতের জন্ম দেয়া। জীবিকার মোহে যেসব অমুসলিম দেশে তাদের বসবাস সে দেশেও তাদের শিকড় গভীরে যায়নি। গড়ে তুলতে পারিনি নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠাও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। অথচ ঈমানে পুষ্টি জোগানো ও মুসলিম রূপে বাঁচার জন্য চাই কোর’আনের জ্ঞান। সে জন্য চাই ইসলামী শিক্ষা। স্রেফ পানাহারে দেহ বাঁচে বটে, তবে তাতে ঈমান বাঁচে না। এবং ঈমান না বাঁচলে বাঁচা যায় না জাহান্নাম থেকেও। পশু থেকে এখানেই ঈমানদারের পার্থক্য। পশুকে পানাহার নিয়ে বাঁচলেই চলে, কিন্তু ঈমানদারকে বাঁচতে হয় ঈমান নিয়ে। সে লক্ষ্যে ঈমানদারকে তাই মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা দিতে হয়। সংযোগ গভীরত করতে হয় কোর’আন ও হাদীসের সাথে। কিন্তু এক্ষেত্রে মুসলিমদের ব্যর্থতাটি ভয়ানক।

মুসলিমদের কাছে দৈহিক ভাবে বাঁচাটি গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু গু্রুত্ব হারিয়েছে ঈমান নিয়ে বাঁচাটি। দৈহিক ভাবে বাঁচাটি আনন্দময় করার লক্ষ্যে মুসলিম দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সেগুলিই গুরুত্ব পাচ্ছে যা উপার্জন বাড়ায়। ‌এবং তাতে গুরুত্ব হারিয়েছে পরকাল এবং পরকালে সফল হওয়ার জ্ঞান –অর্থাৎ কোর’আন-হাদীসের জ্ঞান। এমন কি অনেকের চেতনা থেকে বিলুপ্ত হয়েছে কোনটি হারাম এবং কোনটি হালাল –সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিও। তাই উপার্জন বাড়াতে এক কালে –বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে, হাজার হাজার মুসলিম সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ, ফরাসী ও ইটালিয়ানদের সৈনিক রূপে ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, সূদানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে মুসলিম হত্যায় নেমেছে। আর এখন পাশ্চাত্যের দেশের হোটেল-রেস্তোরাঁ’য় বয়-বেয়ারার চাকুরি নিয়ে খরিদদারদের হাতে মদের পেয়ালা তুলে দিচ্ছে। বাংলাদেশের মত দেশে ব্যবসায়ের নামে অনেকে নেমেছে নারী রপ্তানীতে। জঘন্য পাপাচারেরও একটি সীমা থাকে, বহু মুসলিম সেটিও অতিক্রম করেছে। দুর্বৃত্তিতে তারা কাফেরদেরও হার মানিয়েছে। 

 

অধিকৃত চেতনা

ঈমানদারদের বাঁচার মধ্যে প্রতি মুহুর্তে থাকে প্রবল অঙ্গিকার। সে অঙ্গিকারের মূলে কাজ করে একটি বলিষ্ঠ চেতনা। এবং সে চেতনার মূলে হলো কোর’আন-হাদীসের জ্ঞান। সে চেতনার প্রবল প্রকাশ ঘটে তাঁর কথা, কর্ম, চরিত্র ও বুদ্ধিবৃত্তির মাঝে। সে চেতনাই নির্ধারিত করে তাঁর বাঁচবার রূচীবোধ, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি। সে চেতনাটি তাঁর জীবনে বস্তুত কম্পাসের কাজ করে। এবং সে চেতনার মূল উপাদান হলো মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর দ্বীনের বিজয়ে আপোষহীন নিষ্ঠা। চেতনার এ ক্ষেত্রটুকু অনৈসলামিক ধ্যানধারণা দ্বারা অধিকৃত হলে মুত্যু ঘটে ঈমানের। তখন সে চেতনার ভূমিতে বেড়ে উঠে পরকালের ভয়শূণ্য জৈবিক তাড়না। নামে মুসলিম হলেও কাজে-কর্মে ও আচার-আচরণে অমুসলমান থেকে এমন ব্যক্তিদের কোন পার্থক্যই থাকে না।

ঈমান প্রবলতর হলে সেটির প্রকাশে ভাষা লাগে না। নামও লাগে না। ঈমান তার নিজস্ব গুণাবলী নিয়ে তখন নিজস্ব ভাষাতেই বিমুর্ত হয়। আগুণের উত্তাপ বা ফুলের ঘ্রাণ টের পেতে অন্ধেরও অসুবিধা হয় না। তেমনি অসুবিধা হয় না প্রকৃত মুসলিমকে মুসলিম রূপে চিনতে। প্রতিটি মুসলিমের মাঝেও প্রবলতম সে গুণটি হলো ঈমানের গুণ। নবীজীর (সা) যুগে সেগুণের বলেই একজন ঈমানদার অন্যদের কাছে মুসলিম রূপে স্বীকুতি পেত। পিতামাতার দেওয়া নামের চেয়ে এটিই হলো সবচেয়ে বড় পরিচয়। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তো এ পরিচিতিটিই গুরুত্ব পায়। এ পরিচিতির বাইরের যে পরিচিতি -সেটি কাফের ও মুনাফিকের। মুসলিম শব্দটি মূলত এক চেতনার প্রতীক। অভিধানিক অর্থে মুসলিম বলতে বুঝায় এমন এক ব্যক্তিকে যে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে আত্মসমর্পণকারী। সে বাঁচে একমাত্র আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার জন্য এবং প্রাণও দেয় আল্লাহর জন্য। অথচ আজ নামসর্বস্ব মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে শয়তানী শক্তির এজেন্ডার কাছে আত্মসমর্পণে। তারা শ্রম দেয়, মেধা দেয় এমন কি প্রাণ দেয় শয়তানী সেনাবাহিনীকে বিজয়ী করতে। মুসলিম নামটির উদ্ভাবক হযরত ইব্রাহীম (আঃ); তাঁকে বলা হয় মুসলিম উম্মাহর আদি পিতা। যখনই তাঁর উপর মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে কোন হুকুম বা পরীক্ষা এসেছে তখনই তিনি লাব্বায়েক বলেছেন। তাঁর জীবনে কখনোই সে হুকুমের বিরুদ্ধে কোনরূপ অবাধ্যতা স্থান পায়নি। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে আত্মসমর্পণে তিনি ইতিহাস গড়েছে। বস্তুত তিনিই হলেন সর্বকালের মুসলিমদের সামনে  আত্মসমর্পণের আদি মডেল।  

 

বিচ্যুতিটি সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে

ভুল লক্ষ্যে পথচলায় সফলতা আসে না। বিফলতা তখন অনিবার্য হয়। তাই মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডাটি স্রেফ পথ চলা নয়, বরং সঠিক পথটি খুঁজে বের করা। তবে যে কোন মানুষের জন্যই এটি এক অসাধ্য কাজ। সে সামর্থ্য এমন কি নবী-রাসূলদেরও ছিল না। নবী-রাসূলগণ তো সে পথেই চলেছেন যে পথে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মানব যখনই এ অসাধ্য কাজটি নিজ থেকে করতে গিয়েছে তখনই ভ্রান্ত পথের আবিস্কার করেছে। ইতিহাসে মানব রচিত নানা ধর্ম ও নানা মতবাদের জন্ম তো এভাবেই হয়েছে। সঠিক পথ দেখানোর কাজ একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার। তাঁর নিজের ভাষায়, “ইন্না আলায় নাল হুদা” অর্থঃ নিশ্চয়ই পথ দেখানোর দায়িত্বটি আমার। মুসলিমদের পতনের বড় কারণ, তারা সে প্রদর্শিত পথে পথ চলেনি। তারা যে পথে পথ চলেছে -সেটি কোর’আনে বর্ণীত সিরাতুল মুস্তুাকীম নয়। এটি তাদের নিজেদের বা অন্যদের আবিস্কৃত বিভ্রান্তির পথ, তথা পতনের পথ। মুসলিমদের জন্য এটি যথার্থ নয় যে, স্রেফ উপার্জনের লক্ষ্যে সমগ্র জীবনটাই ব্যয় করে দিবে। অর্থ-উপার্জনই বাঁচবার একমাত্র প্রেরণা বা মটিভ হবে -এটি ঈমানদারের কাম্য হতে পারে না।এমন জৈবিক প্রেরণায় মানুষ অর্থনৈতিক জীবে পরিণত হয়। আজ বস্তুত সেটিই হয়েছে। কোর’আনের ভায়ায় এরাই হলো ক্ষতিগ্রস্তদের দল।

মহান আল্লাহতায়ালা চান, মানুষ তাঁর আশরাফুল মাখলুকাত তথা সর্বশ্রেষ্ঠ জীবের পরিচয় নিয়ে গড়ে উঠুক। বিবেকমান ব্যক্তি কখনোই স্রেফ পানাহারের জন্য বাঁচে না। পানাহারের লক্ষ্য, জীবন বাঁচানো। এবং বাঁচার লক্ষ্য, জীবনের এজেন্ডা পূরণ। মানব জীবনের এজেন্ডা তো তাই -যা পূরণকল্পে মহান আল্লাহতায়ালা তাকে সৃষ্টি করেছেন। ফলে প্রতিটি ব্যক্তিকে বাঁচতেও হয় আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বেঁধে দেয়া এজেন্ডা নিয়ে। একমাত্র তখন মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে বান্দার বাঁচার এজেন্ডার মিলন ঘটে। এরূপ বাঁচার  মধ্য্ইে প্রকৃত সফলতা -শুধু দুনিয়ায় নয়, আখেরাতেও। অন্যথায় বাঁচাটি হয় শয়তানের এজেন্ডা নিয়ে। সেরূপ বাঁচায় অনিবার্য হয় জাহান্নামে পৌঁছা।

মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা পূরণের বদলে যাদের জীবনে শুধু শান শওকতে বেঁচে থাকাটি গুরুত্ব পায়, তারা বাঁচে অর্থের নেশায়। এমন নেশা ব্যক্তিকে লক্ষ্যচ্যুৎ করে জীবনের মূল মিশন, ভিশন  ও লক্ষ্য থেকে। অথচ অর্থ-উপার্জন বাঁচবার অবলম্বন মাত্র, জীবনের মূল উদ্দেশ্য নয়। নৌকা চালনায় পানি অপরিহার্য, কিন্তু সে পানি নৌকার ভিতরে ঢুকলে নৌকাডুবি হয়। তেমনি অর্থের বিষয়টিও। শয়তান অর্থের লোভ দেখিয়েই মানবকে নিজ এজেন্ডার সেবকে পরিণত করে। এবং ভূলিয়ে দেয় জান্নাতের পথ। সে কাজে শয়তানের সফলতাটি বিশাল। ফলে মানবের সামর্থ্য ও সময়ের সিংহভাগ খরচ হয় অর্থের পিছে এবং ভূলে থাকে জীবনের মূল এজেন্ডা থেকে। এমন লক্ষ্যহীন জাতি কি কখনই বিজয় দেখে? দেখছে না আজকের মুসলিমগণও । ফলে তাদের সংখ্যা বাড়লেও শক্তি, বিজয় ও ইজ্জত বাড়ছে না।

 

কারণ ঈমানশূণ্যতা

ব্যক্তির জীবনে নৈতিক শক্তির মূল জেনারেটর হলো ঈমান। নৈতিক শক্তিই ব্যক্তির সকল দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যকে কাজে লাগায়। এবং যতই বাড়ে ঈমান, ততই বাড়ে নেক আমলে আগ্রহ, শক্তি ও তাড়াহুড়া। ঈমানদার ব্যক্তি প্রতি মুহুর্ত ব্যয় করে মহান আল্লাহতায়ালকে খুশি করার কাজে। সেটি নেক আমলের মাধ্যমে। ফলে দেশে ঈমানদারের সংখ্যা বাড়লে নেক আমলে প্লাবন আসে। ফলে আসে প্রাচুর্য। এমন শক্তিমান ও কর্মশীল ব্যক্তিদের কারণে শক্তি বাড়ে জাতির। তখন জাতীয় জীবনে শক্তির বিস্ফোরণ ঘটে। এটিই এককালে আরবের ধুসর মরু ভূমিতে মহাশক্তির বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল এবং পরাজিত করেছিল তৎকালিন বিশ্বের দুই বিশ্বশক্তিকে। অথচ তখন পরাক্রমশালী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মুসলিমদের হাতে উন্নত রশদ বা অস্ত্র দূরে থাক, অনেকের পায়ে জুতা এবং যুদ্ধে গমনের জন্য ঘোড়াও ছিল না। অথচ তারাই বিজয়ী হয়েছেন। যেন ট্যাংক বাহিনীর বিরুদ্ধে পদাতিক বাহিনীর বিজয়।

 

ঈমানদারের ঈমান অন্য ঈমানদারদের সাথে একতাবদ্ধ হতে বলে। ফলে ঈমান বাড়লে উম্মাহর জীবনে সংহতি বাড়ে। ফলে বাড়ে শক্তি্ও। অপর দিকে ঈমানশূণ্যতায় প্রবলতর হয় অনৈক্য ও বিভক্তি। বিভক্ত হতে বলে গোত্রবাদ, বর্ণবাদ ও জাতীয়তাবাদের ন্যায় ইসলামবিরোধী মতবাদগুলি। তখন বাড়ে শক্তিহীনতা। তখন অনিবার্য হয় পরাজয় ও পতন। ৫৭টি রাষ্ট্রে বিভক্ত মুসলিম উম্মাহর পতনের মূল কারণ তো এই বিভক্তি। এবং বিভক্তির কারণ তো ঈমানশূণ্যতা। যতদিন এ বিভক্তি থাকবে ততদিন এ পতনযাত্রা থেকে যে মুক্তি নাই -তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? তাছাড়া এ বিভক্তির জন্য বড় আযাব অপেক্ষা করছে আখেরাতে –যার ঘোষণা এসেছে সুরা আল-ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে।

 

মানুষের আশরাফুল মাখলুকাত বা সেরা সৃষ্টির মর্যাদাটি দৈহিক সামর্থ্যের কারণে নয়, বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার কারণেও নয়। বরং সেটি মানবিক গুণের কারণে। আর মানবিক গুণের মধ্যে সবচেয়ে বড় গুণটি হলো ব্যক্তির ঈমান। এবং সে ঈমান শুধু আল্লাহতায়ালা ও তাঁর নবী-রাসূলদের উপর বিশ্বাস নয়, বরং তাঁর কাছে জবাবদেহীতার উপর বিশ্বাস। এ জবাবদেহীতাই ঈমানদারের জীবনে তাকওয়ার জন্ম দেয়। এবং এ তাকওয়া তাঁকে ভাল কাজে উৎসাহিত করে এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। এবং এ তাকওয়ার বলেই মানুষ উন্নত সভ্যতার জন্ম দেয়। ধনসম্পদ, দৈহিক বল ও মেধার সাথে তাকওয়ার বলের সংযোগ হলে উদ্ভব ঘটে এক অবিশ্বাস্য শক্তির। ইসলামের প্রাথমিক কালে এ শক্তির বলেই মুসলিমগণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল।

 

 

 

তান্ডব অসভ্যতার

 

পাশ্চাত্য সভ্যতার হাতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বৈষয়িক সম্পদ থাকলেও তাদের অভাবটি ঈমানের। তাই তারা উন্নত নগর-বন্দর, বিপুল শিল্প-কলকারখানা ও অত্যাধুনিক অস্ত্র গড়লেও ব্যর্থ হচ্ছে সভ্যতর মানবিক সভ্যতার জন্ম দিতে। বরং তাদের হাতে বেড়েছে নিদারুন অসভ্যতা। মানব জীবনে নৃশংস যাতনা বাড়াতে তারাই জন্ম দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ, জাতীয়তাবাদ, কম্যুনিজম, জাতিগত নির্মূল, বিশ্বযুদ্ধ ও পারমানবিক অস্ত্রের। ব্যভিচার ও সমকামিতার ন্যায় পাপাচারকেও তারা বৈধতা দিয়েছে। পুরুষের সাথে পুরুষের এবং মহিলার সাথে মহিলার বিবাহকেও জায়েজ করেছে। এভাবেই তারা জন্ম দিয়েছে নানা রূপ জাহিলিয়াত। এবং ভয়ানক ভাবে বাড়িয়েছে অসভ্যতার তান্ডব। ঈমান ছাড়া সভ্য সমাজ নির্মাণ যে অসম্ভব পাশ্চত্য সভ্যতার এ ব্যর্থতা তো সেটিরই প্রমাণ। ফলে এ ব্যর্থদের অনুসরণ করে মুসলিমগণও কি সফলতা পেতে পারে?

 

 

 

উদ্ধার যে পথে

 

চেতনার অসুস্থ্যতা যতই তীব্রতর হয়, ততই বেগবান হয় জাতির পতনযাত্রা। এবং চেতনার অসুস্থ্যতার মূল কারণটি ঈমানশূণ্যতা। তাই স্রেফ রাস্তাঘাট, কৃষিউৎপাদন, কলকারখানা, হাসপাতাল –এসব বাড়িয়ে এ অসুস্থ্যতা দূর করা অসম্ভব। মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নতও সেটি নয়। নবীজী (সাঃ)র মাধ্যমে মহান আল্লাহতায়ালা যেখান থেকে তাঁর মিশনটি শুরু করেছিলেন, আজকের মুসলিমদেরও সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। সেটি কোর’আনী জ্ঞানে সমৃদ্ধি এনে। এটিই মানব জাতির উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহতায়ালার একমাত্র প্রেসক্রিপশন। এবং অনুসরণ করতে হবে পুরা প্রেসক্রিপশনকে।

 

কোন রোগই এমনিতেই সেরে উঠে না। রোগমুক্তির জন্য আশু চিকিৎসার প্রয়োজন। যাদের বিবেক আছে, ভাবনার সামর্থ্য আছে এবং কোর’আনের জ্ঞান আছে -তাদের অন্তত মুসলিম উম্মাহর এ পতনকালে এগিয়ে আসা উচিত। অজ্ঞ ও জ্ঞানীর দায়িত্ব কখনই এক নয়। উভয়ের মর্যাদাও এক নয়। দায়িত্বহীনতা শুধু আল্লাহতায়ালার আযাবই ডেকে আনবে না, অবাক করবে পরবর্তী বংশধরদেরও। এমনকি ইজ্জতহানী হবে নিজেদের সন্তানদের কাছেও। শত বছর পর তারা বিস্ময়ে শুধু ধিক্কারই দিবে না বরং প্রশ্ন করবে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কি এতটাই বিবেকশূণ্য ও দায়িত্বশূণ্য ছিল যে পতন ও অপমান থেকে বাঁচতে তারা কোন চেষ্টাই করেনি? প্রশ্ন উঠবে, মহান আল্লাহতায়ালার সেরা দান থেকে কি তারা কোন শিক্ষাই নেয়নি? আরো ভয়ানক বিষয় হলো, সে প্রশ্ন তো রোজ হাশরের বিচার দিনেও উঠবে।  ১ম সংস্করণ ১৭/০২/১৯৯৯; ২য় সংস্করণ ১৭/১২/২০২০।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *