জিন্নাহ’র সাদকায়ে জারিয়া ও মুজিবের গুনাহে জারিয়া

ফিরোজ মাহবুব কামাল

কোনটি সাদকায়ে জারিয়া এবং কোনটি গুনাহে জারিয়া?

যা কিছু অবিরাম জারি থাকে -আরবী ভাষায় সেটিকে “জারিয়া” বলা হয়। “জারিয়া” শব্দের অর্থ চলমান। করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালা কোন কোন নেক আমলের বিশাল মর্যাদা ও পুরস্কার রেখেছেন। এগুলি হলো সেই সব বিশেষ আমল যা মহান আল্লাহতায়ালার মিশন, ভিশন ও এজেন্ডাকে দুনিয়ার উপর বিজয়ী করে। এ আমলগুলিই মহান আল্লাহতায়ালাকে সবচেয়ে বেশী খুশি করে। সাদকায়ে জারিয়া’র বরকত হলো, আমলকারী মারা গেলেও সে আমলগুলি থেকে ছওয়াবের প্রাপ্তি থেমে যায় না। এমন কি ক্বিয়ামত অবধি সে নেক আমলগুলি তার আমল-নামায় ছওয়াব জমা করতে থাকে। এজন্যই এগুলি সাদকায়ে জারিয়া। এরূপ মর্যাদার কারণ, মানব জাতির কল্যাণে উক্ত আমলের বিশাল অবদান। তেমনি কিছু ভয়ানক পাপকর্মও আছে -যা পাপ কর্মের নায়কের এ্যাকাউন্টে ক্বিয়ামত অবধি অবিরাম গুনাহর অংকে বৃদ্ধি ঘটায়। এর কারণ, বৃহৎ মানবগোষ্ঠির উপর উক্ত পাপের সীমাহীন নাশকতা। এগুলিই হলো গুনাহে জারিয়া। সাদকায়ে জারিয়া’র কর্মগুলিই “সওয়াবে জারিয়া” দেয়। তাই অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো কোনটি “সাদকায়ে জারিয়া” এবং কোনটি “গুনাহে জারিয়া” -সেটি বুঝা। মুসলিমদের উচিত বেশী বেশী সওয়াবে জারিয়ার কাজে লিপ্ত হওয়া এবং সতর্কতার সাথে গুনাহে জারিয়াকে পরিহার করা।

সাদকায়ে জারিয়ার শ্রেণী ভেদ আছে। তেমনি শ্রেণীভেদ আছে গুনাহে জারিয়ারও। সবচেয়ে বড় সাদকায়ে জারিয়া তো তাই যা মানব সমাজের সবচেয়ে বড় কল্যাণটি করে। সবচেয়ে বড় গুনাহে জারিয়া হলো যা মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় অকল্যাণটি করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া, ভাল বই রচনা, হাসপাতাল নির্মাণ, রাস্তায় গাছ লাগানো, রাস্তা নির্মাণ বা কাউকে ঘর বানিয়ে দেয়া সাদকায়ে জারিয়া। কিন্তু তাতে মানুষের সবচেয়ে কল্যাণটি হয় না। সেগুলি জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা করে না। কারণ, সেগুলি কারো ঈমানকে শক্তিশালী করেনা এবং কাউকে মুজাহিদ রূপেও গড়ে তোলে না। সে বিচারে সবচেয়ে বড় সাদকায়ে জারিয়া হলো ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ। কারণ, কেবল মাত্র এমন রাষ্ট্রই জনগণকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে নেয়ার কাজ করে। ইসলামী রাষ্ট্রের হাতে থাকে মানুষকে ঈমানদার তথা জান্নাতমুখি বানানোর নানারূপ শক্তিশালী হাতিয়ার। সেগুলি হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশী রাষ্ট্র পরিচালিত শিক্ষা ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত, পুলিশ, প্রশাসন, প্রচারযন্ত্র ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানের কারণে রাষ্ট্র পরিণত হয় মানুষকে আল্লাহভীরু মুত্তাকী বানানোর সোসাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের শক্তিশালী মাধ্যম। রাষ্ট্র তখন কোটি কোটি মানুষকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে নেয়। এরূপ ইসলামী রাষ্ট্র কাজ করে জনগণকে জান্নাতে নেয়ার বাহন রূপে। ইসলাম রাষ্ট্রের নির্মাণ এ জন্যই সবচেয়ে বড় নেককর্ম। এজন্যই এমন রাষ্ট্রের নির্মাণে অর্থ, শ্রম, মধা ও প্রাণের কুরবানী হলো সবচেয়ে বড় সাদাকায়ে জারীয়া।

সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল এবং মুসলিমদের ব্যর্থতা

ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত ও সর্বশ্রেষ্ঠ সাদাকায়ে জারিয়া নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত নয়। মসজিদ-মাদ্রাসা-হাসপাতাল এবং রাস্তা-ঘাট নির্মাণও নয়। সেটি হলো ইসলামী রাষ্ট্র নির্মানের জিহাদ। এমন জিহাদ যেমন বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে হতে পারে, তেমনি হতে পারে শত্রুর সশস্ত্র হামলার প্রতিরোধ সশস্ত্র যুদ্ধ। বস্তুত এমন রাষ্ট্রের নির্মাণ হলো পৃথিবী পৃষ্ঠে সর্বশ্রেষ্ঠ জনকল্যাণ-মূলক নেক কর্ম। এ জন্যই মহান আল্লাহতায়ালা সবচেয়ে বড় পুরস্কার রেখেছেন এ কাজে। অন্য কোন ইবাদতে এরূপ পুরস্কার নাই। এ মহান কাজটি শুধু ব্যক্তির অর্থ, সময়, মেধা ও শ্রমের বিনিয়োগ চায় না, চায় তাঁর প্রিয় জানের কুরবানী। এ জিহাদে যারা শহীদ হয় মহান আল্লাহতায়ালা তাদের জন্য রেখেছেন বিনা হিসাবে জান্নাত। তিনি তাদেরকে মৃত বলা হারাম করেছেন। মহান নবীজী (সা:)’র নিজে এমন একটি মহান কল্যাণকর রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিয়ে তাঁর উম্মতদের সামনে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এমন একটি রাষ্ট্রের নির্মাণই হলো নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ লিগ্যাসি তথা সূ্ন্নত।  সে রাষ্ট্রের বরকতেই মুসলিমগণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং পেয়েছে নিরাপত্তা ও বিশ্বজুড়া ইজ্জত। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ পেয়েছে জান্নাতের পথে চলার সুযোগ।

ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণই হলো নেক আমলের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে ব্যয়বহুল খাত। এ কাজে ব্যয় হয় হাজার হাজার মানুষের জান, মাল, মেধা ও শ্রমের। বহু হাজার মসজিদ বা মাদ্রাসা গড়তে এতোটা ব্যয় হয় না। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে নবীজী (সা:)’র অর্ধেকের বেশী সাহবা শহীদ হয়েছেন। তাদের শাহাদতের বরকতে এবং নবীজী (সা:)’র মহান নেতৃত্বে যে ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে উঠে, তারই বরকতে মুসলিমগণ পেয়েছিল নিরাপদে পূর্ণ ইসলাম পালনের স্বাধীনতা। সে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা পায় মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিষ্ঠা পায় শরিয়তী আইন। সে রাষ্ট্র পরিণত হয় ইসলামের “শো-কেস”য়ে। সেটি দেখে জোয়ার এসেছিল ইসলামে প্রবেশে। সর্বোপরি সে রাষ্ট্রের মাঝে মুসলিমগণ সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তির জন্ম দিয়েছিল এবং গড়ে তুলেছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। হযরত মূসা (আ:) ও হযরত ঈসা (আ:) সে সুযোগ পাননি। বস্তুত সাহাবাদের সে নেক-আমলই হলো সমগ্র মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল। সে নেক আমলের কারণেই সাহাবাগণ মহান আল্লাহতায়ালার খাতায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রূপে গণ্য হয়েছেন। তাদেরকে তিনি ফেরশতাদের মজলিসে গর্ব করেছেন। 

নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের সাদাকায়ে জারিয়ার বরকতে বর্তমান বিশ্বের ১৫০ কোটির বেশী নরনারী মুসলিম। ফলে বর্তমানের মুসলিমদেরই শুধু নয়, অনাগত ভবিষ্যতের প্রতিটি মুসলিমের নেককর্মের ছওয়াবের অংশ তারাও ক্বিয়ামত অবধি পাবে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, আজকের মুসলিমদের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সাদকায়ে জারিয়াতে কোন আগ্রহ নেই। জান ও মালের কোরবানী দূরে থাক, এমন কি ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের দাবী  নিয়ে তারা রাস্তায় মিছিল করতে বা ভোট দিতেও তারা রাজী নয়। বুদ্ধিবৃ্ত্তির অঙ্গণে তারা ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে জিহাদ করতেও রাজী নায়। এর কারণ মুসলিমদের মাঝে ইসলাম প্রসঙ্গে গভীর অজ্ঞতা। এ অজ্ঞতার কারণে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত তারা চিনতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে পায়নি সে নেক কর্মে বিনিয়োগের সামর্থ্য। বরং এ অজ্ঞতার ভয়াবহ দিকটি হলো, অনেকেই শামিল হচ্ছে গুনাহে জারিয়ার মিশনে।  

সর্বনিকৃষ্ট গুনাহে জারিয়া

দুষ্ট চিন্তার সাহিত্য, বেশ্যালয়, নাচ-গানের স্কুল, মদের দোকান, ড্রাগব্যবসা, জুয়ার আড্ডা, সূদী কারবার, সূদী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা -এরূপ প্রতিটি পাপকর্মই নিকৃষ্টতম গুনাহে জারিয়া। কিন্তু সবচেয়ে বড় গুনাহে জারিয়ার কাজটি হলো ইসলামবিরোধী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দেয়া। তখন সে রাষ্ট্রের কাজ হয়, জনগণকে ইসলামের পথে চলা অসম্ভব করা। এমন রাষ্ট্রে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন, প্রচার মাধ্যম, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও বিচার ব্যবস্থা কাজ করে জনগণকে জাহান্নামের পথে নিতে। বস্তুত এমন ইসলামবিরোধী রাষ্ট্র তখন জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার বাহনে পরিণত হয়। অতি পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র হয়েছে গুনাহে জারিয়া’র হাতিয়ারে। এমন রাষ্ট্র অসম্ভব করে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানলাভ, শরিয়ত পালন তথা পূর্ণ মুসলিম হওয়া। এমন রাষ্ট্রে সরকারি উদ্যোগে পাপাচারের পথ খোলা হয় এবং সেগুলির উপর পাহারাদারী দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশের ন্যায় দেশে পতিতা পল্লী, মদের দোকান, সূদী ব্যাংকের ন্যায় পাপের প্রতিষ্ঠানগুলি তো বেঁচে আছে সরকারের অনুমতি ও পাহারাদারীর কারণে। তখন দেশের মানুষ জড়িত হয়ে পড়ে নেক কর্মের বদলে গুম-খুন-ধর্ষণ-সন্ত্রাসের ন্যায় নানা রূপ অপরাধ কর্মে। এভাবে রাষ্ট্র সুযোগ করে দেয় জনগণকে জাহান্নামের উপযোগী হয়ে বেড়ে উঠতে।  

হাজার হাজার মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে, শত শত ওয়াজ মহফিল করে এবং বিস্তর বই-পুস্তক লিখে এ বিশাল রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়া যায় না। বস্তুত এমন একটি অনৈসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দেয়াই হলো পৃথিবী পৃষ্ঠে সবচেয়ে বড় অপরাধ কর্ম। এমন অনৈসলামিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় ও প্রতিরক্ষায় অর্থ, শ্রম, মেধা এবং রক্তের বিনিয়োগ হলো সবচেয়ে বড় গুনাহে জারিয়া। এবং সবচেয়ে বড় নেক কর্ম হলো এমন রাষ্ট্রের জায়গায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেয়া। পরিতাপের বিষয় হলো, অধিকাংশ মুসলিম দেশের মুসলিমদের বিনিয়োগ তো এ গুনাহে জারিয়াতেই। তারা একাজে সমর্থন দেয় এবং বিপুল অংকের রাজস্বও দেয়। বাংলাদেশের মত দেশে অধিকাংশ সেক্যুলার রাজনৈতিক দল, সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার কাজ হয়েছে গুনাহে জারিয়ার সাথে জনগণকে জড়িত করা। ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাড়িয়েছে মূলত তারাই। এরাই পৃথিবী পৃষ্ঠে শয়তানের সৈনিক।  

মহম্মদ আলী জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের সাদকায়ে জারিয়া

বহুশত বছর পর দক্ষিণ এশিয়ার বুকে সবচেয়ে বড় সাদকায়ে জারিয়ার কাজটি ঘটে ১৯৪৭ সালে। মহম্মদ ঘোরীর হাতে দিল্লি বিজয় এবং ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের পর ভারতীয় মুসলিমদের ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেটি ঘটে কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে ও মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। এর ফলে আজকের পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ৪০ কোটি মুসলিম বেঁচে যায় হিন্দুদের নৃশংস গোলামী থেকে। পাকিস্তান সৃষ্টি যে কতবড় বিশাল নেক-আমল তথা সাদকায়ে জারিয়া ছিল সেটি বুঝা যায়, ভারতের আজকের ২০ কোটি মুসলিমদের অসহায় করুণ অবস্থার দিকে নজর দিলে। ভারতের মুসলিমদের জানমাল, ইজ্জত-আবরুর কোন নিরাপত্তা নাই। মুসলিম মহল্লাতে গেরুয়া পোষাকধারী হিন্দুরা তলোয়ার, চাকু, লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মিছিল করে এবং স্লোগান দেয়া: “মুসলিমো কো লিয়ে দো স্তান: পাকিস্তান, ইয়া কবরস্তান।” অর্থ: “মুসলিমদের জন্য দু’টি স্থান। হয় পাকিস্তান অথবা কবরস্থান।”

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মুসলিমদের গণহত্যা, গণধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। যখন তখন হিন্দুত্ববাদী খুনিরা মুসলিমদের প্রাণনাশ, ধর্ষণ এবং তাদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ধ্বংসে দাঙ্গা শুরু করে। এসব দাঙ্গায় ভারত সরকারের হিন্দু পুলিশ নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকে। ২০০২ সালে গুজরাতে তিন ধরে মুসলিমদের ঘরে আগুন দেয়া হয়েছে এবং ৫ হাজারেরর বেশী মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে। নারী-শিশুদেরও রেহাই দেয়া হয়নি। নরেন্দ্র মোদি তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু পুলিশ দাঙ্গা থামাতে যায়নি এবং কোন খুনিকে গ্রেফতার করে শাস্তিও দেয়নি। কাশ্মিরে চলছে জবর দখল। ইতিমধ্যে ১ লাখে মুসলিমকে ইতিমধ্যে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কাশ্মিরে দখল জমিয়ে আছে ৬ লাখের বেশী ভারতীয় সৈন্য। ভারতীয় অধিকৃতি বাঁচাতে সেখানে প্রতি দিন চলছে তাদের জুলুম-নির্যাতন।

ভারতের মুসলিমদের সংখ্যা জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ হলে কি হবে, চাকুরীতে মুসলিমগণ শতকরা ৪ ভাগও নয়। পাকিস্তানের করাচী বা বাংলাদেশের ঢাকার মত একটি শহরে যতজন মুসলিম ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, প্রফেসর, উকিল, আর্মী অফিসার, শিল্পপতির বসবাস তা সমগ্র ভারতের ২০ কোটি মুসলিম বিগত ৭০ বছরেও জন্ম দিতে পারেনি। পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে গরুর গোশতো খাওয়ার কারণে কাউকে নিহত হতে হয় না, অথচ ভারতে গণপিটুনীতে প্রাণ দিতে হয়। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে খোলা ময়দানে বা পার্কে ইচ্ছামত নামাজ পড়া যায়, কিন্তু ভারতে সেটি করতে গেলে নামাজীদের উপর হিন্দুরা পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয়। নতুন মসজিদ বানানোর জন্য অনুমতি দেয়া হয়।  পাকিস্তান ও বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মসজিদ থেকে ৫ ওয়াক্ত আজান শোনা যায়, ভারতের বহুস্থানে সেটি নিষিদ্ধ।

ভারতে গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে মসজিদ। ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংসের পর ষড়যন্ত্র হচ্ছে বানারসের ঐতিহাসিক জ্ঞানব্যাপী মসজিদ ধ্বংসের। মসজিদের মিনারে হিন্দুগণ তাদের গেরুয়া পতাকা টানিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন প্রদেশে মুসলিদের মসজিদে আযান দিতেও নিষেধ করছে। মাথায় টুপি দেয়ার কারণে মুসলিম ছেলেদের হিন্দু গুন্ডাদের হাতে পথে ঘাটে চড়-থাপ্পর খেতে হচ্ছে। মুসলিমদের “জয় শ্রীরাম” স্লোগান দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। স্কুলে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে ছাত্রীদের হিজাব। এ জুলুম ও নৃশংস গোলামী থেকে ৪০ কোটি মুসলিমদের বাঁচিয়েছে পাকিস্তান। অনেকেই জিন্নাহর ত্রুটি তালাশ করে, কিন্তু তারা তাঁর এই বিশাল “নেক-আমলে জারিয়া”র মূল্যায়ন করে না। অন্য কোন মুসলিম নেতা বা আলেম কি এতো বড় নেক আমল করেছে? কংগ্রস নেতা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধি না হলেও হিন্দুদের জন্য স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠা পেত। কিন্তু কায়েদে আযম মহম্মদ আলী জিন্নাহ না হলে কি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেত?

শেখ মুজিব ও তার গুনাহে জারিয়া

অপর দিকে শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগের “গুনাহে জারিয়া”র তালিকাটি বিশাল। মুজিবের “গুনাহে জারিয়া”র মূল উপাদানটি হলো ইসলাম ও মুসিলম স্বার্থের বিরুদ্ধে গাদ্দারীর। শেখ মুজিবই বাঙালি মুসলিমদের মাথার উপর চাপিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্রের ফিতনা। অথচ এ তিনটি মতবাদই ইসলামে হারাম। এগুলি চাপাতে তিনি কোন গণভোট নেননি। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনে এগুলি কোন ইস্যু ছিল না। বাঙালি মুসলিমদের মাথার উপর মুজিব এ আবর্জনাগুলি চাপিয়েছিল তার প্রভু দিল্লির শাসক চক্রকে খুশি করতে। জনগণ কি চায় –সেটি স্বৈরাচারি মুজিবের কাছে গুরুত্ব পায়নি। মুজিবের অপরাধ বাঙালি মুসলিমদের অবাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ও প্রতিশোধ পরায়ন করেছে। শরিয়তের আইনে এটি শাস্তিযোগ্য গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ। তার সে অপরাধ লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে নৃশংস অপরাধে উৎসাহিত করেছে। এরই পরিণত হলো, ৬ লাখের বেশী বিহারীকে তাদের ঘববাড়ি, চাকুরি-বাকুরি কেড়ে নিয়ে পথে বসানো হয়েছে। বাংলাদেশের মাটিতে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে। বহু হাজার অবাঙালি মহিলা ধর্ষিতা হয়েছে। বিহারীদের জন্য বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে আরেক মায়ানমার বা হিন্দুস্থানে। বাংলার মাটিতে কখনো কি এরূপ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। মুজিব তার অনুসারীদের এরূপ গুনাহর ভাগীদার ক্বিয়ামত অবধি হতে থাকবে।

মুসলিমের জন্য শুধু পানাহার হালাল হলে চলে না; হালাল হতে হয় তার রাজনৈতিক দর্শনও। কোন মুসলিম যেমন শুকরের গোশত, মদ, জুয়া ও পতিতাবৃত্তিকে হালাল রূপে গ্রহণ করতে পারেনা, তেমনি গ্রহণ করতে পারে না জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্রের ন্যায় হারাম মতবাদগুলিকেও। এ অতি সাধারণ কথাগুলি বুঝার জন্য বড় মাপের আলেম হওয়া লাগে কি? মুসলিম হওয়ার দায়বদ্ধতা হলো প্রতি পদে একমাত্র ইসলামের বিধান মেনে বাঁচা। রাজনীতি, আইন-আদালত ও অর্থনীতিতে ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন মতবাদ থেকে শিক্ষা নেয়া হারাম। অথচ মুজিব সে হারাম কর্মে বাংলাদেশীদের বাধ্য করেছে। এরূপ কাজ কি কোন ঈমাদাররের হতে পারে?

শেখ মুজিবের গুনাহে জারিয়া’র কারণেই বাংলাদেশ আজ ভারতের রাডারের নীচে অধীনত গোলাম রাষ্ট্র। এটিই আজকের বাস্তবতা। ভারত যা চায় তাই দিতে হয়। প্রতিবাদের সাহস নাই। মুজিবের কারণই ১৯৭১’য়ে খণ্ডিত হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। এতে বাঙালিরা হারিয়েছে পাকিস্তানের মাধ্যমে বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলার সুযোগ। অথচ পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে মুজিব জনগণের ভোট নেয়নি। ১৯৭০’য়ের মুজিব ভোট নিয়েছিল ৬ দফার উপর, পাকিস্তান ভাঙ্গার উপর নয়। অথচ জরুরি ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার উপর রিফারেন্ডাম করা। মুজিবের গাদ্দারী তাই যেমন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ’র বিরুদ্ধে, তেমনি বাঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধেও।

যে কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গাই শরিয়ত বিরোধী। এ কাজ হারাম ও কবিরা গুনাহ। মুসলিম হওয়ার শর্তই হলো তাকে সব সময় গড়ার রাজনীতি করতে হয় এবং বাঁচতে হয় ভাঙ্গার হারাম রাজনীতি থেকে। দেশ ভাঙ্গার রাজনীতে খুশি হয় শয়তান ও তার অনুসারীগণ। তাই মুজিবের রাজনীতিতে খুশি হয়েছে শয়তানের একনিষ্ট খলিফা ভারতীয় হিন্দুরা। এবং সে ভাঙ্গার রাজনীতি কাঁদিয়েছে শুধু ভারতীয় মুসলিমদেরই শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের। পাকিস্তান ভাঙ্গার কারণে শুধু উপমহাদেশের মুসলিমগণই দুর্বল হয়নি, দুর্বল হয়েছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ। এবং ভারত পেয়েছে মুসলিমদের উপর অত্যাচারের অবাধ সুযোগ। ভারতের প্রতি সেবাদাস চরিত্রের কারণে মুজিব ভারতের হিন্দুদের ঘরে তুলে দিয়েছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের সমগ্র ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজয়। মুজিবের কারণেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র কবরে গেছে, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নৃশংস ফ্যাসিবাদ। মুজিবের অপরাধ, সে তার “গুনাহে জারিয়া”র হারাম রাজনীতিতে বিপুল সংখ্যক বাঙালি মুসলিমকে ভাগিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছে।

কারা ভাগীদার গুনাহে জারিয়া’র রাজনীতির?

তবে পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে গুনাহে জারিয়া’র রাজনীতি শুধু শেখ মুজিবের একার ছিল না। ইসলাম বিরোধী এবং মুসলিমের স্বার্থবিনাশী সে হারাম রাজনীতির ভাগীদার ছিল ভাষানীর চীনপন্থী ন্যাপ, মুজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন মস্কোপন্থী ন্যাপ, কম্যুনিষ্ট পার্টির নানা গ্রুপ এবং হিন্দুগণ। ভাগীদার ছিল ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যে ছাত্র লীগ এবং চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন। এদের সবার রাজনীতির মূল উপাদানটি ছিল ইসলামবৈরীতা। ইসলামের পক্ষ নেয়াটি তাদের কাছে ছিল সাম্প্রদায়িকতা। তারা ভাসতো বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম ও মার্কসবাদের ন্যায় হারাম মতবাদে অবগাহন করে। মীর জাফরের কুকীর্তির পর বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর “গুনাহে জারিয়া”র রাজনীতি। বাংলার ইতিহাসের এটিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে সেটি পড়ানো হয় না। বুদ্ধিজীবীরাই এ নিয়ে আলোচনা করে না। অথচ আগামী দিনে সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে হলে এ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতেই হবে। ইসলামের ও বাঙালি মুসলিমের এই ঘৃণীত শত্রুদের কুকীর্তিগুলোকে অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে। নইলে ১৯৪৭ সালে অর্জিত ফসল যেমন প্লাবনে ভেসে গেছে, বার বার এভাবে ভেসেই যেতে থাকবে।  কারণ, শয়তান ও তার অনুসারীগণ সব সময় সক্রিয়। তার বার বার তাদের পক্ষে একাত্তরের ন্যায় জোয়ার আনবে।   

বাংলাদেশের বুকে আজ যেরূপ গুম-খুন-ধর্ষন ও ফ্যাসিবাদের তান্ডব এবং ভারতের অধিকৃতি তার মূল কারণ তো একাত্তরের ইসলাম বিরোধী অপশক্তির “গুনাহে জারিয়া”র রাজনীতি। লক্ষণীয় হলো, একাত্তরে কোন ইসলামী দল, কোন বিজ্ঞ আলেম ও কোন পীর সাহেবই এই “গুনাহে জারিয়া”র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না। তারা সে ভাঙ্গার রাজনীতিকে হারাম গণ্য করেছে।  “গুনাহে জারিয়া”র রাজনীতি শুধু পরকালেই আযাব দেয় না। দুনিয়াতেও কঠিন আযাব নিয়ে হাজির হয়। শেখ মুজিব ও তার দলের অপশাসনের কারণে দেশে ১৯৭৪ সালে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ এসেছে এবং তাতে ১৫ লাখের বেশী লোকের মৃত্যু হয়েছে। দেশ পরিণত হয়েছে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলিতে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার পর এ হলো বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে আধুনিক কালে সবচেয়ে বড় নাশকতা।

মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগের গুনাহ’র রাজনীতির কারণে শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের দেশে নিরাপত্তা হারিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমগণ। দাপট বেড়েছে হিন্দুদের এবং জোয়ার এসেছে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির। তাই রাস্তার মোড়ে মোড়ে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মুজিবের মুর্তি বসানো হচ্ছে। এবং মঙ্গল প্রদীপ হাতে জমকালো মিছিল হচ্ছে। বর্ষবরণ, বসন্তবরণ ও ভালবাসা দিবসের নামে চলছে মুসলিমদের ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজ। এসবই ইসলামের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। এদেশে আলেমদের জেলে যেতে হয়। ঘরে জিহাদের উপর বই রাখলে শাস্তি পেতে হয়। কুর’আনের তাফসির ও ওয়াজের উপর পুলিশী হামলা হয়। এবং ইসলামী দলের নেতাদের ফাঁসি হয়। শাসনতন্ত্র থেকে আল্লাহর উপর আস্থার বাণীও বিলুপ্ত করা হয়।এবং শরিয়তের প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে রাস্তায় নামাটি চিত্রিত হয় সন্ত্রাস রূপে। এসবই মুজিবের “গুনাহে জারিয়া”র রাজনীতির কারণে অর্জিত আযাব। হাসিনার কাজ হয়েছে তার পিতার গোনাহর রাজনীতিকে বহাল রাখা। বাঙালি মুসলিম কি বাঁ২চবে এ পাপের রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ নিয়ে? ০৪/০৬/২০২২

2 Responsesso far.

  1. সিরাজুল ইসলাম says:

    আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন!

  2. Mohammad Arifur Rahman says:

    great post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *