বাঙালি মুসলিমের বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 রোগ বুদ্ধিবৃত্তিতে                                                                                           

মানুষের সকল সফলতার মূলে যে সামর্থ্যটি কাজ করে সেটি দৈহিক বল নয়, সেটি হলো বুদ্ধিবৃত্তিক বল। দৈহিক বলে মানব বহু পশুর চেয়েও দুর্বল। অথচ বুদ্ধিবৃত্তিক বলের কারণে একজন মানুষ হাজার হাজার পশুকে পরাস্ত করতে পারে এবং সাগর, মহাসাগর ও মহাশূণ্যে পাড়ি জমাতে পারে। মানব সভ্যতা আজ যেরূপ সামনে এগিয়েছে এবং আজকের এ পর্যায়ে পৌঁছেছে তার মূলে হলো বুদ্ধিবৃত্তিক বল। তেমন একটি দেশের নানা রূপ ব্যর্থতা, কদর্যতা ও পিছিয়ে পড়া দেখে নিশ্চিত বলা যায়, এর কারণ জনগণের বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা। তাই বাঙালি মুসলিমের জীবনে আজ যেরূপ দুর্বৃত্তি, গুম, খুন, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, সন্ত্রাস ও ধর্ষণের জোয়ার সে জন্য দেশের ভূগোল, ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ুকে দায়ী করার পিছেন কোন যুক্তি নাই। ব্যর্থতাটি চেতনা তথা বুদ্ধিবৃত্তির জগতে।

মানুষ বাঁচে, বেড়ে উঠে এবং নিজের জীবনে পরিশুদ্ধি আনে চিন্তা-ভাবনার গুণে। নিজেক নিয়ে ও অন্যদের নিয়ে ভাবনা বন্ধ হলে শুধু পতনই শুরু হয় না, নৈতিক মরণও শুরু হয়। পশুর আমৃত্যু লড়াইটি শুধু নিজেকে দৈহিক ভাবে বাঁচিয়ে রাখার। কিন্তু মানুষকে বাঁচতে হয় শুধু দেহ নিয়ে নয়, এবং শুধু নিজেকে নিয়েও নয়। দৈহিক ভাবে বাঁচার সাথে সেটি যেমন পরিশুদ্ধ মন ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে বাঁচার লড়াই, তেমনি নিজেকে বাঁচানোর সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রকে উন্নততর করার লড়াই। সেরূপ অতি মানবিক ভাবনাটি বন্ধ হলে মানুষ শুধু পশুতে নয়, পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়। মানব জীবনে চিন্তাভাবনার গুরুত্ব যে কতটা গভীর -সেটি বুঝা যায় মানবকে উদ্দেশ্য করা মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার নিম্নোক্ত কয়েকটি প্রশ্নের দিকে নজর দিলে। পবিত্র কুর’আনে তিনি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানবকে লক্ষ্য করে সরাসরি কয়েকটি প্রশ্ন রেখেছেন: “কেন তোমরা ভাব না (আ’ফালা তাফাক্কারুন)?”, “কেন তোমরা নিজেদের আক্বলকে কাজে লাগাও না (আ’ফালা তা’ক্বিলুন)?, “কেন তোমরা মনকে গভীর ভাবে নিবিষ্ট করো না (আ’ফালা তাদাব্বারুন)? মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার এ প্রশ্নগুলোর মূল লক্ষ্য হলো, মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়া এবং নিবিড় চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বেড়ে উঠতে উৎসাহ দেয়া।

চেতনাই মানব জীবনের ইঞ্জিন। কর্ম, চরিত্র, বিশ্বাস ও আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় চেতনার ভূমি থেকে। তাই মানবকে জাগাতে হলে তার ইঞ্জিনকে তথা চেতনাকে চালু করতে হয়। মহান আল্লাহতায়ালার উপরুক্ত প্রশ্নগুলির মূল লক্ষ্য তো সেটিই। মহাজ্ঞানী মহান প্রভু চান, মানুষ তার নিজেকে নিয়ে ভাবুক। ভাবুক, কিসে তার পার্থিব ও আখেরাতের জীবনের কল্যাণ –সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি নিয়ে। ভাবুক, কিসে জাহান্নামে আগুন থেকে পরিত্রাণ –তা নিয়ে। কল্যাণের পথ তো সেই পায় যে ব্যক্তি সে কল্যাণের পথটি পেতে চিন্তা-ভাবনা করে। এরূপ কল্যাণ-চিন্তা ভাবনাশূণ্য মানুষের জীবনে কখনোই আসে না। ভাবনাশূণ্য মানুষেরাই জীবনে লক্ষ্যশূণ্য ও কর্মশূণ্য হয়। এমন ভাবনাশূণ্য মানুষেরদের বিভ্রান্ত করা সহজ। তাদের চেতনার ভাবনাশূণ্য স্থানটি শয়তান সহজেই দখলে নেয়। এরাই সহজে শয়তানের ফাঁদে পড়ে এবং জাহান্নামের পথে চলে। সে ভাবনাশূণ্য ভয়ানক অবস্থা থেকে বাঁচাতে চিন্তা করাকেও মহান আল্লাহতায়ালা ফরজ করেছেন। চিন্তাভাবনা তথা বুদ্ধিবৃত্তি তাই কোন পেশাজীবীর পেশা বা নেশা নয়। প্রতিটি ঈমানদারের জন্য এটি বাধ্যতামূলক। ইসলামে এটি ফরজ ইবাদত।

নবীজী (সা:)’র হাদীস: আফজালুল ইবাদাহ তাফাক্কুহ। অর্থ: উত্তম ইবাদত হলো চিন্তা ভাবনা করা। হযরত আলী (রা:) বলেছেন: ইবাদত ওজনহীন তথা মূল্যহীন হয় যদি তা ভাবনাশূণ্য হয়। ঈমানদারের ভাবনাই হলো তাঁর ধ্যানমগ্নতা। তাই নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও নেক আমলে ওজন বাড়াতে হলে তাতে গভীর ভাবনার তথা ধ্যানের সংযোগ ঘটাতে হয়। এই ভাবনাই তো মু’মিনের যিকর। মহান আল্লাহতায়ালা আমলের ওজন দেখেন, সংখ্যা নয় –সেটিও তিনি বার বার উল্লেখ করেছেন পবিত্র কুর’আনে। সাধু-সন্যাসীগণ বন-জঙ্গলে গিয়ে ধ্যানে বসে, আর মু’মিন ব্যক্তি ধ্যান করে চলতে-ফিরতে, উঠা-বসায়, কর্ম ও অবসরে, শয়নে এবং পথচলার প্রতি কদমে। ঈমানদারের সে গুণটিই মহান আল্লাহতায়ালা বর্ণনা করেছেন সুরা আল ইমরানের ১৯১ নম্বর আয়াতে। পবিত্র কুর’আনের কৃতিত্ব তো এখানেই, এ গ্রন্থটি আরবের বিপুল সংখ্যক মানুষকে জগত-বিখ্যাত দার্শনিকে পরিণত করেছে। দুনিয়ার আর কোন দেশে এবং আর কোন যুগে এত দার্শনিক গড়ে উঠেনি। এবং সেটি সম্ভব হয়েছে, পবিত্র কুর’আনে ছত্রে ছত্রে চিন্তা-ভাবনার উপর তাগিদ দেয়ার কারণে।

অথচ আজ মুসলিমগণ চিন্তাশূণ্যতায় রেকর্ড গড়েছে। যারা চিন্তাশূণ্যতায় রেকর্ড গড়ে তারাই মূলত নীতি-নৈতিকতার স্কেলে দ্রুত নীচে নামায় রেকর্ড গড়ে। এদিক দিয়ে বাংলাদেশ সবার আগে। ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যান মতে এ শতাব্দীর শুরুতে যে দেশটি বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশকে হারিয়ে পর পর দুর্নীতিতে ৫ বার প্রথম হওয়ার বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে -সেটি কোন অমুসলিম দেশ নয়। সেটি হলো শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের দেশ বাংলাদেশ। ভাবনাশূণ্য জনগণই এতোটা দ্রুত নীচে নামতে পারে। কারণ, চিন্তাশূণ্যতার বিলুপ্ত হয় ইজ্জত হারানোর শরম। পাগলের সে ভাবনা থাকে না বলেই তারা জনসম্মুখে উলঙ্গ হয়। এমন ভাবনাশূণ্য ব্যক্তিগণই দিনের ভোট রাতে ডাকাতি করে নিতে পারে। তাদের মগজ থেকে বিলুপ্ত হয় এ সভ্য ভাবনা যে, এরূপ ভোটডাকাতি করলে দুনিয়ার মানুষ কি বলবে। মানব জাতির ইতিহাসে কোথাও কি এমন রেকর্ড নির্মিত হয়েছে? বিশ্বের কোন দেশে কি এমন একজন মানুষও পাওয়া যায় যে ডাকাতকে মাননীয় বলে? প্রতিটি সভ্যদেশে দুর্বৃত্তকে ঘৃণা করাই রীতি। এবং ডাকাতকে কারাগারে পাঠানো হয়। এটিই ন্যূনতম মানবিক গুণ। এ গুণ অর্জনে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী লাগে না। সভ্য দেশে নিরক্ষরদেরও সেটুকু সামর্থ্য থাকে। কিন্তু কি বিস্ময়! বাংলাদেশে সে ন্যূনতম গুণেরই প্রচণ্ড আকাল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের ডাকাত-সর্দারনী হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে তাকে শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় বলা হয়। এরূপ দুর্বৃত্তকে যারা সন্মান করে তারা সবাই নিরক্ষর বা অশিক্ষিত নয়। তাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, সেনাবাহিনীর জেনারেল, আদালতের বিচারক, প্রশাসনের সচিব, বুদ্ধিজীবী, পত্রিকার কলামিস্ট, মিডিয়া কর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী পেশাজীবী। সংখ্যায় এরা লক্ষ লক্ষ। বাঙালি মুসলিমের চেতনার ইঞ্জিন যে কতটা বিকল -সেটি বুঝতে কি এর পরও কিছু বাকি  থাকে?

পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে উত্থাপিত উপরুক্ত প্রশ্নগুলো বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ বার বার পড়ে। কিন্তু তার আছড় কই? বিবেকের সেই জাগরণ কই? পশুপাখি ও গাছপালাকে উদ্দেশ্য করে এ প্রশ্নগুলো করা হলে নিশ্চয়ই তার আছড় হতো না। কারণ চিন্তা-ভাবনার সামর্থ্য পশুপাখি ও গাছপালাকে দেয়া হয়নি। কিন্তু মুসলিমদের -বিশেষ করে বাঙালি মুসলিমদের অবস্থা কি পশুপাখি ও গাছপালা থেকে ভিন্নতর? মহান আল্লাহতায়ালার এ প্রশ্নাগুলিকে মুসলিমগণ যতটা মুখস্থ করেছে -তা নিয়ে ততটা চিন্তা করেনি। সেগুলোকে আমলেও নেয়নি। আমলে নিলে দেশে মুসলিমদের গৌরব যুগের ন্যায় বাংলাদেশেও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব আসতো। কিন্তু সে বিপ্লব আসেনি। ফলে ১৭ কোটি মুসলিমের দেশে বহু লক্ষ হাফেজ ও ক্বারী সৃষ্টি হলেও ফকিহ, মোজতাহিদ বা চিন্তাবিদ গড়ে উঠেনি। লেখা হয়নি বাংলাতে কোন তাফসিরে কুর’আন বা ইসলামের উপর মৌলিক বই। দেশটির দ্বীনী মাদ্রাসায় যে তাফসির গ্রন্থ গুলো পড়ানো হয় তার অধিকাংশই উর্দু বা আরবী ভাষা থেকে অনুদিত। দর্শন, সমাজ বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেই বা ক’খানী বই লেখা হয়েছে? এগুলো হলো বাঙালি মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতার দলিল।

তবে বাঙালি মুসলিমের বুদ্ধিবৃত্তিক এ পশ্চাৎপদতা আজকের নয়, বহু শত বছরের। বাংলাদেশে ইসলামের প্রবেশ বঙ্গবিজয়েরও বহু পূর্বে। মুসলিমদের হাতে বঙ্গবিজয় হয়েছে প্রায় আটশত বছর আগে। এ দীর্ঘ সময়ে জাতির চিন্তা-চেতনায় বিপ্লব আসতে পারতো। সৃষ্টি হতে পারতো বহু লক্ষ বইয়ের বিশাল ভূবন। যেমন হয়েছে আরবী, ফার্সি ও উর্দুতে। ইসলামের আগমনের মাত্র একশত বছরের মধ্যেই আরবে ও ইরানে বিস্ময়কর বিপ্লব এসেছিল বুদ্ধিবৃত্তিতে। অথচ সে আমলে তাদের সমুদয় লোকসংখ্যা আজকের ঢাকা শহরের চেয়ে বেশী ছিল না। এমনকি আফগানরাও ছিল সংখ্যায় অতি নগন্য। অথচ একমাত্র সুলতান মাহমুদের সাম্রাজ্যে যতজন বিজ্ঞানীর বসবাস ঘটেছিল, আমরা বিগত এক হাজার বছরেও ততজন বিজ্ঞানী গড়তে পারিনি। উল্লেখ্য হলো, ইবনে সীনা, ইবনে ফারাবী, আল বেরুনীসহ সমকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী সুলতান মাহমুদের সাম্রাজ্যে বসবাস করতো। তার আমলে বাজেটের একটি মোটা অংক ব্যয় হত শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিচর্যায়।

ইসলাম হলো আক্বল তথা বুদ্ধিবৃত্তির ধর্ম। কুর’আনের প্রতিটি আয়াত ব্যক্তিকে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। এক মুহুর্তের চিন্তা-ভাবনাকে নবীজী (সা:) সারা রাতের নফল ইবাদতের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলেছেন। চিন্তাভাবনার অভাবে নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের ন্যায় ইবাদতগুলি নিছক চিন্তাশূণ্য আনুষ্ঠিকতায় পরিণত হয়েছে। চিন্তার যোগফলেই আমলের ওজন বাড়ে। আর মহান আল্লাহতায়ালা তো মানুষের আমলের ওজন দেখেন, সংখ্যা নয়। যার মধ্যে চিন্তাভাবনা নাই, তার মধ্যে আল্লাহভীতিও নেই। মহান আল্লাহতায়ালার ভয় তো আসে পরকালের ভয় থেকে। সেটি আসে আখেরাতে নিজের সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে ভয়ের কারণে। আর ভয় তো সৃষ্টি হয় জ্ঞানের কারণে। এই জ্ঞানশূণ্য ও ভয়শূণ্যদের বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন: “এদের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে এরা দেখে না। তাদের কান আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা শুনে না। তাদের ক্বালব আছে বটে কিন্তু তা দিয়ে তারা ভাবে না।” ভাবনার সামর্থ্য তো তারাই পায় যারা তাদের চোখ, কান ও ক্বালবের দরোজা সব সময় খোলা রাখে। এবং বিশ্বচরাচরে মহান আল্লাহতায়ালার যে আয়াত বা নিদর্শনগুলো ছড়িয়ে ছিটেয়ে আছে -সেগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। এই হলো ঈমানদারের স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ঠ -যা বর্ণিত হয়েছে সুরা আল-ইমরানের ১৯০ নম্বর আয়াতে।

 অজ্ঞতায় অসম্ভব হয় মুসলিম হওয়া

বুদ্ধিবৃত্তির গুরুত্ব যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি বুঝা যায় পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার একটি বয়ান থেকে। সেটি হলো, ‘‘ইন্নামা ইয়াখ’শাল্লাহা মিন ইবাদিহিল উলামা।’’ অর্থ: সমগ্র সৃষ্টিকূলের মাঝে একমাত্র জ্ঞানীরাই আমাকে ভয় করে। এখানে জ্ঞানী বলতে তাদের বুঝায় যারা পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানে জ্ঞানী। এর অর্থ দাড়ায়: পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান ছাড়া মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি ভয় সৃষ্টি হয়না। উপরুক্ত আয়াতে যে সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে তা হলো: প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য অপরিহার্য হলো হৃদয়ে সব সময় মহান আল্লাহতায়ালার ভয় নিয়ে বাঁচা। সে ভয় সৃষ্টি করে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান। ঈমানের খাদ্য হলো এই জ্ঞান। ঈমান বাঁচাতে হলে এ খাদ্যের বিকল্প নাই। অনেক বিজ্ঞবান ব্যক্তি জ্ঞানকে সরাসরি সংজ্ঞায়ীত করেন আল্লাহভীতি রূপে। মক্কার আবু জেহল নিরক্ষর বা অশিক্ষিত ছিল না, কিন্তু তাকে অজ্ঞতার পিতা বলা হতো এই জন্য যে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি ভয়হীনতায় সে সবার শীর্ষে ছিল। এর অর্থ দাঁড়ায়, যারা মধ্যে আল্লাহর ভয় নাই তার হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রি থাকতে পারে কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান নাই। প্রকৃত অর্থ সে ব্যক্তি জাহেল তথা অজ্ঞ। উপরুক্ত আয়াত থেকে শিক্ষণীয় মূল বিষয়টি হলো: ঈমান ও মহান আল্লাহতায়ালার ভয় কখনোই অজ্ঞতার উপর গড়ে উঠে না। বীজ রোপন করতে হলে প্রথমে আগাছা সরাতে হয়। তেমনি ঈমানের বীজ রোপনে চেতনার ভূমি থেকে প্রথমে অজ্ঞতা সরাতে হয়। নামাজ-রোজা পালন করেও অনেকে ঘুষ খায়, সূদ খায় এবং মিথ্যা কথা বলে। বেপর্দাও হয়। এর কারণ, তাদের নামাজ-রোজা ব্যর্থ হয়েছে তাদের মনে তাকওয়া তথা আল্লাহতায়ালার ভয় সৃষ্টিতে। অভাব এখানে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানে। কুর’আনী জ্ঞানের শূণ্যতায় ইবাদতও যে লক্ষ্য অর্জনে পুরাপুরি ব্যর্থ হয় -তার প্রমাণ হলো অপরাধ জগতের এই নামাজী-রোজাদারগণ।

যে ব্যক্তি তার জ্ঞানচক্ষুতে সামনে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখতে পায়, সে ব্যক্তি প্রতিটি মহুর্ত বাঁচে আখেরাতের ভয় নিয়ে। এমন ব্যক্তি অফিসে বসে কখনোই ঘুষ খায়না। দোকানে বসে এমন ব্যক্তি কখনোই ক্রেতাকে ঠকায় না। সে পাপাচারে অনন্ত অসীম আখেরাতকে নষ্ট করতে ভয় পায়। শিশু আগুনে হাত দেয় আগুনের দাহ্য ক্ষমতা না জানার কারণে। নামাজীও তেমনি ঘুষ খায় বা মিথ্যা কথা বলে হৃদয়ে পরকালের জ্ঞান বদ্ধমূল না হওয়াতে। অজ্ঞতা নিয়েও নামাজী ও রোজাদার হওয়া যায়। বার বার হজ্জ-উমরাহও করা যায়। কিন্তু পরিপক্ক ঈমানদার ও আল্লাহভীরু হওয়া যায় না। সে সাক্ষ্যটি অন্য কারো নয় বরং সেটি মহাজ্ঞানী ও মহাপ্রভু মহান আল্লাহতায়ালার।

অজ্ঞতার ইসলামী পরিভাষা হলো জাহিলিয়াত,  যার মধ্যে এই অজ্ঞতা তাকে বলা হয় জাহেল। এর বিপরীত শব্দ হলো মা’রেফাত। যিনি এর অধিকারী তিনিই আরেফ। যিনি অজ্ঞতামুক্ত তাকে সাধারণ মানুষেরা আলেমও বলে। মৃত্যুর এপারে বসে পরকালে কি হবে -তা উপলব্ধি করার সামর্থ্যই হলো মা’রেফাত। এ সামর্থ্যটি চোখের নয়, অন্তরের। সে দৃষ্টি একমাত্র কুর’আন-লব্ধ জ্ঞানেই সৃষ্ঠি হয়। এমন জ্ঞানই মানুষকে পাপাচারের থেকে দূরে রাখে। অপর দিকে জাহেল শুধু নাস্তিকেরা নয়, বহু আস্তিকও। যুগে যুগে ইসলামের সর্বনাশ হয়েছে মুসলিম বেশধারী এসব জাহিল আস্তিকদের কারণে। ইবাদতের নামে এসব অজ্ঞরা স্বাস্থ্যপতন ঘটালেও তাদের মনে মহান আল্লাহতায়ালার ভয়ের চেয়ে এজিদদের ন্যায় দুর্বৃত্তদের ভয়ই অধিক ছিল। সে যুগে এজিদের বাহিনীতে যারা যুদ্ধে খেটেছে তারা কেউ স্বঘোষিত কাফির  ছিল না। অথচ এদের হাতে জান্নাতের যুব-ইমাম হযরত ইমাম হোসেন (রা:) শুধু নিহতই হননি, তাঁর লাশকে ঘোড়ার পায়ের নীচে দলিত-মথিতও করা হয়েছে। তার মস্তক কেটে দামেস্কে নিয়ে এজিদের দরবারে পেশ করেছে। যার মধ্যে আল্লাহতায়ালা ও আখেরাতের ভয় আছে সে কি এরূপ বীভৎস নৃশংসতায় লিপ্ত হতে পারে? আজও মুসলিম দেশগুলিতে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনকে যারা বিলুপ্ত করে রেখেছে তারা কি পৌত্তলিক কাফির? এরা তো তারাই যারা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এবং হজ্জ-ওমরাহ করে। অতীতে হযরত ইমাম হোসেন (রা:)কে যারা হত্যা করেছিল তারাই এখন শরিয়তের প্রতিষ্ঠা রুখছে।

বিপদের আরো কারণ, কুর’আনের জ্ঞানে অজ্ঞ বা জাহেল থাকাকে মুসলিম জনগণের বিশাল ভাগ আজ আর পাপ ভাবে না। অজ্ঞ থাকাটাই যে ইসলামে সবচেয়ে বড় পাপ –সে হুশও তাদের নাই। ইসলামী চেতনা শূণ্য ও নামসর্বস্ব এ মুসলিমগণ নিজ শহরে পতিতাপল্লী, সূদী ব্যাংক, জুয়ার আখড়া ও মদের দোকান নিয়ে যেমন বাঁচছে, তেমনি বাঁচছে চেতনা রাজ্যে রাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, সেক্যুলারিজম, পুঁজিবাদ ও সোসালিজমের ন্যায় অজ্ঞতার গভীর অন্ধকার নিয়ে। সব পাপের জন্ম তো এই অজ্ঞতা থেকেই। ইসলামের মূল যুদ্ধটি তো এ অজ্ঞতার নির্মূলে। অজ্ঞতার ন্যায় এই কবিরা গুনাহ দূর করতেই ইসলাম সকল নরনারীর উপর জ্ঞানার্জনকে নামাজ-রোজার বহু আগে ফরজ করেছে। কুর’আনের প্রথম নির্দেশটি নামাজ-রোজা বা তাসবিহ-তাহলিল না হয়ে “ইকারা” বা “পড়” হওয়ার তাৎপর্য তো এটিই। “ইকরা” বা “পাঠ করা” হলো জ্ঞানার্জনের চাবী। এ চাবী ছাড়া  জ্ঞানের দরোজায় ঢুকা অসম্ভব। কুর’আন-হাদীসের জ্ঞান নয়, নিছক অক্ষর-জ্ঞান দানের বিনিময়ে নবীজী (সা:) বদরযুদ্ধের হত্যাযোগ্য বন্দীদের মুক্তি দিয়েছিলেন। এ থেকে বুঝা যায়, ইসলামে জ্ঞানদান ও জ্ঞানলাভের গুরুত্ব কত অধিক। জ্ঞানার্জনকে অত্যাধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই সেকালে মুসলিমগণ স্বল্পসময়ে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিলেন। অথচ আজকের মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে অজ্ঞতায়। অজ্ঞতার পথে চলার অর্থই তো শয়তানের পথে চলা। তখন অসম্ভব হয় ইসলামে পথে চলা। পাশ্চাত্যের দেশগুলি যেখানে অন্ধ, বধির ও বোবাদের জন্যও জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা করেছে, অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশে এখনো প্রায় ৩০ ভাগ সুস্থ মানুষ নিরক্ষর। যারা অক্ষর জ্ঞান পেয়েছে তাদের জ্ঞানের গভীরতাই বা কতটুকু? তারা বা কতটা সুশিক্ষিত? তথাকথিত এই শিক্ষিতরাই তো বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে সমগ্র বিশ্বে ৫ বার প্রথম করেছে।

সত্য-অসত্য, ন্যায়-অন্যায় এবং শ্লীল-অশ্লীল চিনতে অতি জরুরি হলো চিন্তা-ভাবনার সামর্থ্য। কারণ, সে বাছ-বিচারটি হয় চেতনার ভূবনে। বিবেকবান মানুষ হওয়ার পথে সে চিন্তার সামর্থ্যটাই মূল। চিন্তার সামর্থ্য একমাত্র চিন্তাতেই বৃদ্ধি পায়। চিন্তার অনভ্যাসে সুস্থ মানুষও আহম্মকে পরিণত হয়। তখন পঙ্গুত্ব আসে বুদ্ধিবৃত্তিতে। যেমন দীর্ঘকাল ব্যবহার না করায় রোগীর সুস্থ হাত-পা-গুলোও শক্তিহীন হয়। অথচ নিয়মিত ব্যবহারে তা শুধু সুস্থই থাকে না, সবলও হয়। নবীজী (সা:)’র আগমনের কয়েক দশকের মধ্যে আরব ভূমি যে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তানায়কদের জন্ম দিল সে ভূমি কয়েক বছর আগেও দুর্বৃত্তদের জন্মভূমি ও লালনভূমি রূপে পরিচিত ছিল। কারণ, সে আমলে আরব জনগণ সুচিন্তা থেকে নিবৃত ছিল। তাতে মৃত্যু ঘটেছিল তাদের বিবেকের। ফলে ব্যভিচার, দস্যুবৃত্তি, উলঙ্গতা বা নিজ কন্যার জীবন্ত দাফনেও সে বিবেকে দংশন হতো না। এমন বিবেকহীনদেরকে সুচিন্তায় অভ্যস্থ করে কুর’আন বস্তুত তাদের মৃত বিবেককেই জীবিত করেছিল। অভ্যস্থ করেছিল আমৃত্যু এ ভাবনায় ও প্রচেষ্ঠায় যে কি করে দিন দিন আরো সভ্যতর হওয়া যায়। এভাবেই শুরু হয়েছিল তাদের অবিরাম উপরে উঠার প্রক্রিয়া। এর ফলেই তাঁরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়তে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু যখনই তারা চিন্তা-ভাবনা থেকে বিরত হয়েছে তখনই তারা দূরে সরেছে ইসলাম থেকে এবং চলেছে পতনের পথে। এবং সে পতন যাত্রা আজও অব্যাহত রয়েছে।

বিকল বুদ্ধিবৃত্তির ইঞ্জিন

মগজ রুগ্ন হলে দেহ হুশ হারায়। তখন শক্তি হারায় হাত, পা ও দেহ। তেমনি জাতির মগজ হলো আলেম বা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। জাতির পতনের শুরু আলেমদের তথা বুদ্ধিজীবীদের পচন বা অসুস্থতা থেকে। এজন্যই পতনশীল একটি জাতিকে দেখে অন্তত এটুকু সঠিকভাবেই বলা যায়, সে জাতির আলেমগণ বা বুদ্ধিজীবীগণ যথাযথ দায়িত্বপালন করেনি। বুঝা যায়, নিজেদের শিক্ষিত হওয়ার কাজটিও তারা যথার্থ ভাবে করেনি। বনি ইসরাইলের পতনের বড় কারণ ছিল তাদের আলেমগণ। মহান আল্লাহতায়ালা সুরা জুম্মা’তে তাদেরকে ভারবাহী গাধার সাথে তুলনা করেছেন। গাধা বই বহন করতে পারে কিন্তু সে বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে তারা ভাবতে পারেনা। সেরূপ ইহুদী আলেমদের ন্যায় আলেম কি মুসলিমদের মাঝে কম?

বুদ্ধিবৃত্তি বা ইলমচর্চা মানুষকে ব্যক্তিস্বার্থের উর্দ্ধে উঠে সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র বিশ্বকে নিয়ে ভাবতে ও ত্যাগে উৎসাহিত করে। এগুণটি ছাড়া সমাজের বুকে উচ্চতর ও সভ্যতর বিবর্তন অসম্ভব। তখন জাতির কাঁধে ভর করে ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা ও হানাহানি। বিভক্তি, অজ্ঞতা ও হানাহানীর মধ্যেই আত্মবেদনা এবং সৃষ্টিশীলতা ও ভাতৃত্বের মাঝেই অনাবিল আনন্দ –সেই উপলব্ধিটিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ব্যক্তিকে ক্ষুদ্র স্বার্থ ও অজ্ঞতা থেকে দূরে রাখতে। তখন ব্যক্তির মনে জাগে দিন দিন লাগাতর মহত্তর, সৃষ্টিশীলও প্রজ্ঞাবান হওয়ার প্রেরণা। ইবনে সীনা বা ফারাবীদের ন্যায় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠশীল ও জ্ঞানবান মানবগণ এজন্যই কখনোই কোন দুর্বৃত্ত শাসকের গোলামে পরিণত হননি। সেরূপ গোলাম হওয়াতে শৃঙ্খলিত হয় বিবেক। যে সমাজে চিন্তাশীল ও প্রজ্ঞাবান মানুষের অভাব- সে সমাজে স্বার্থশিকারী মনুষ্যজীবের সংখ্যাই অধিক।

জনগণের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের মাঝে সজ্ঞানতা ও বুদ্ধিবৃত্তির সামর্থ্য বৃদ্ধি। পানাহারে দেহের বল বাড়লেও তাতে মনের বল বাড়ে না। অথচ অন্যের গোলাম না হয়ে স্বাধীন ভাবে বাঁচার জন্য মনের বলই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। দৈহিক বল অধিক থাকায় গোলাম চরিত্রের লোকেরা বাজার খোঁঝে সে বল নিয়ে অন্যের গোলাম হওয়ায়। বিশ্বে রাজনৈতিক বিপ্লব কম হয়নি, কিন্তু তাতে মানব জাতির সভ্যতর উত্তরণ ততটা হয়নি। রাজা বদল সহস্রবার হলেও এতে দুর্বল ও ভাগ্যাহতদের ভাগ্য একবারও বদলায়নি। অথচ মানব জাতির ইতিহাসের মোড় পাল্টে দেয় ইসলাম। কারণ জ্ঞানচর্চাকে ইসলাম জনগণের স্তরে নামিয়ে আনে। পেশাদারীর স্থলে এটিকে ফরজ ইবাদতে পরিণত করে। এতে বুদ্ধিবৃত্তি পরিণত হয় ব্যক্তির সার্বক্ষণিক অভ্যাসে। ফলে সুচিন্তায় তথা বুদ্ধিবৃত্তিতে অভ্যস্থ্য হয় কৃষক, শ্রমিক, তাঁতী, ব্যবসায়ীসহ সর্বশ্রেণীর মানুষ। তখন পাঠশালায় পরিণত হয় সমগ্র দশ, প্রতিটি জনপদ ও প্রতিটি গৃহ। এর ফলে গর্জে উঠে ব্যক্তির মাঝে ঘুমিয়ে থাকা বিবেকের ইঞ্জিন। ফলে গতি পায় সমগ্র জাতি। এ কারণেই ইসলাম শুধু একটি জনগোষ্ঠির ধর্মই পাল্টে দেয়নি, বিপ্লব এনেছে তাদের রুচিবোধ, মূল্যবোধ, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে। কৃষক পরিণত হয়েছে বিচারক ও প্রশাসকে। ক্রীতদাস পরিণত হয়েছে সফল সেনাপতিতে। ভেড়ার রাখাল পরিণত হয় সফল গভর্নরে। সেদিন কয়েক লক্ষ আরবদের মাঝে সেদিন যে মাপের ও যে সংখ্যায় চিন্তানায়কের জন্ম হয়েছিল তা আজকের মুসলিম বিশ্বের প্রায় দেড় শত কোটি মুসলিমও জন্ম দিতে পারছে না। এ ব্যর্থতার কারণ তাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা। কারণ এ শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ হচ্ছে জীবনের মূল পাঠটি শেখাতে। ব্যর্থ হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিকে ইবাদতে পরিণত করতে। ফলে ব্যর্থ হচেছ ব্যক্তির সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিন তথা বিবেককে চালিত করতে। বাংলাদেশ যে কারণে দুর্নীতিতে বিশ্ব রেকর্ড করেছে সেটি নিরক্ষতার কারণে নয়। বরং কুশিক্ষা দানকারী শিক্ষানীতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারণে। 

বিজয় ইসলামের শত্রুপক্ষের

মুসলিমগণ বুদ্ধিবৃত্তিকে পরিহার করেছে দীর্ঘকাল আগেই। সেটিই প্রকট ভাবে দেখা যায় বাঙালি মুসলিমদের মাঝে। আক্বলের প্রয়োগ ছেড়ে নকলকে তারা ইলমচর্চা মনে করে। ফলে গুরুত্ব হারিয়েছে সৃষ্টিশীল জ্ঞানচর্চা। যে শিক্ষা শুধু মুখস্থ করতে শেখায় এবং ভাবতে শেখায় না -তাকে কি আদৌ শিক্ষা বলা যায়? ভাবতে শিখলে ব্যক্তি তখন নিজেই নিজের শিক্ষকে পরিণত হয়। মগজ তখন জ্ঞানের উৎপাদনে পাওয়ার হাউসে পরিণত হয়। সক্রেটিসের মত বিশ্বের বহু শিক্ষিত ব্যক্তিগণ তাই স্বশিক্ষিত। শিক্ষকের প্রকৃত কাজ হলো, কিভাবে শিখতে হয় এবং কি ভাবে ভাবতে হয় -সেটি শেখানো। কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যালয়গুলিতে সে কাজ হয়না। কোন শিক্ষা নীতিই ভাল শিক্ষক ছাড়া চলেনা, যেমন ডাক্তার ছাড়া ভাল হাসপাতাল চলে না। বাংলাদেশে প্রকৃত অভাবটি ভাল শিক্ষকের। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ নিজেরাই ভাবতে ও শিখতে আগ্রহী নয়। ফলে ছাত্রদের তারা ভাবতে ও শিখতে আগ্রহী করবে কী করে? শিক্ষকগণ যে ভাবতে আগ্রহী নয় -সেটি বুঝা যায় বুদ্ধিবৃত্তি ও লেখালেখির জগতে তাদের অনুপস্থিতি দেখে। উন্নত দেশের প্রফেসরগণ বিখ্যাত হন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কারণে নয়, বরং জ্ঞানসমৃদ্ধ বই লেখার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে অধিকাংশ প্রফেসর কবরে যান একখানী বই না লিখেই।

বাঙালি মুসলিমদের বিগত আটশত বছরের ইতিহাসে ইসলামের উপর যে কয়খানী বই লেখা হয়েছে তার শতকরা নিরানব্বই ভাগ সম্ভবতঃ লেখা হয়েছে বিগত ৫০ বছরে। প্রশ্ন হলো বাকি  সাড়ে সাতশত বছর আমরা কি করেছি? এখনো যা হচ্ছে সেটিও কি আশাব্যঞ্জক? বুদ্ধিচর্চার ময়দানে সেক্যুলার পক্ষ তথা ইসলামের শত্রুপক্ষ এখনো  বিজয়ী। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগের লিখক সম্ভবতঃ তারাই। ইসলামপন্থীরা এদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েই দায়িত্ব সেরেছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং এভাবে নিজেদের ভাবমূর্তিকে তারা বিনষ্ট করেছে। নিজেরা যে চিন্তাবিমুখ সেটিই তারা জনসম্মুখে প্রমানিত করেছে। ইসলামপন্থীদের দায়িত্ব ছিল, বিপক্ষের যুক্তিকে খন্ডন করে অন্ততঃ বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে ইসলামকে বিজয়ী করা। এজন্য প্রয়োজন ছিল দুয়েক জন নয়, বহু হাজার উঁচু মাপের জ্ঞানী বা বুদ্ধিজীবীর। শত্রুপক্ষের জবাবে ইসলাম যা বলতে চায় তা সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলা। কিন্তু সে কাজ হয়নি। ফলে চেতনার রাজ্যে সুচিন্তার চাষাবাদ বাড়েনি, পবিত্র কুর’আন যা বলতে চায় বা যুক্তি দেখায় -সে গুলোকেও মানুষের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছানো হয়নি। ফলে কুর’আন সবচেয়ে অধিক পঠিত কিতাব হওয়া সত্ত্বেও তাতে সমাজের অন্ধকার দুর হয়নি। অথচ ইসলামের আলো বিতরণের কাজে প্রতিটি মুসলিমই দায়বদ্ধ।

মহান আল্লাহতায়ার নাযিলকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পবিত্র কুর’আনের সাথে যে জুলুম হয়েছে সম্ভবতঃ কোন কেচ্ছাকাহিনীর বইয়ের সাথেও তা হয়নি। কেচ্ছাকাহিনীর বই যাতে শিশুরা বুঝতে পারে -সে চেষ্টা করা হয়। ভিন্ন ভাষায় হলে সেটির অনুবাদ করা হয়। অথচ বাংলাদেশে সাত শত বছর ধরে কুর’আন পঠিত হয়েছে অনুবাদ ছাড়াই। জ্ঞানের সর্বোচ্চ উৎস্যের সাথে এমন কান্ডজ্ঞানহীন আচরন একমাত্র বিবেকের পঙ্গুত্বেই সম্ভব, সুস্থতায় নয়। এ দীর্ঘকাল যাবত বুদ্ধিবৃত্তি এদেশটিতে যে কতটা গুরুত্বহীন ছিল -সেটি এ থেকেই বুঝা যায়। অনেকে বলেন, কুর’আন বুঝা নিছক আলেমদের কাজ। কথাটি অসত্য। সমগ্র কুর’আন ও হাদিসে এর স্বপক্ষে একটি প্রমাণও নেই। একজনের খাদ্য গ্রহণে আরেক জন বাঁচেনা। খেতে হয় সবাইকেই। তেমনি কুর’আন থেকে এক জনের জ্ঞানার্জনে অন্যের ঈমান পুষ্টি পায় না। জ্ঞানার্জনের ফরজও আদায় হয়না। ফলে তার জন্য মুসলিম থাকাই তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। রোজ হাশরের বিচার দিনে কোন আলেমই অন্য কারো পক্ষে দাঁড়াবে না। অজ্ঞ থাকায় যে মহাপাপ –সে পাপের জন্য সবাইকে নিজের হিসাব নিজে দিতে হবে। পানাহারের ন্যায় জ্ঞানার্জনের দায়িত্বও সবার। নবীজী (সা:)’র আমলে পবিত্র কুর’আন বুঝার চেষ্টা করেছেন ক্ষেত খামারের সাধারণ মানুষ। তাদের ইবাদত স্রেফ নামাজ-রোজায় সীমিত থাকেনি; জ্ঞানার্জন সেদিন ইবাদত রূপে গণ্য হয়েছিল। এবং জ্ঞানচর্চা সেদিন গণমুখীতা পেয়েছিল। ফলে ঘরে ঘরে সেদিন আলেম ও শহীদ সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, যে ভূমিতে জ্ঞানী পয়দা হয়, সেখানে শহীদও পয়দা হয়। তখন দ্বীনের বিজয় সে ভূমিতে অনিবার্য হয়। মদিনার ক্ষুদ জনপদে সেদিন যত মুজাহিদ ও মুজতাহিদ ফকিহর জন্ম হয়েছিল -বাংলাদেশে বিগত হাজার বছরে তার শত ভাগের এক ভাগও হয়নি। অথচ সে আমলে মদিনার জনসংখ্যা বাংলাদেশের আজকের একটি থানার সমানও ছিল না। এ থেকে বুঝা যায় জ্ঞানার্জন সেদিন কতটা প্রায়োরিটি পেয়েছিল। এবং এটিও বুঝা যায়, জ্ঞানার্জন কতটা গুরুত্ব হারিয়েছে বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশে।

বিভ্রাট ইলমচর্চা ও নেক আমল নিয়ে

অনেকে বলেন, মুসলিমদের সমস্যা ইলমে নয়, সেটি আমলে। তাদের অনেকে বলেন, ইলমচর্চা যথেষ্ট হয়েছে এখন আমল প্রয়োজন। অথচ তারা ভূলে যান, আমল ইলমেরই ফসল। ব্যক্তির কদর্য আমল দেখেই বুঝা যায়, তার ইলমচর্চার কাজটাই হয়নি। গাছ ছাড়া যেমন ফল আশা করা যায় না, তেমনি ইলম ছাড়া আমলও আশা করা যায় না। ইলমের আগে আমলে পরিশুদ্ধি চাওয়া অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার মত। আমলে সমস্যা সৃষ্টি হয় ইলমে সমস্যা থাকার কারণে। ইলম অর্থ সার্টিফিকেট লাভ নয়, কিছু বই পাঠও নয়। এটি হলো ব্যক্তির মনের গভীরে আল্লাহভীতি। সেটি তার আত্ম-উপলব্ধি, আত্ম-আবিস্কার ও আত্ম-পরিশুদ্ধির সামর্থ্য। একমাত্র এ সামর্থ্যটি অর্জনের পরই বিপ্লব আসে আমলে, এর পূর্বে নয়। উত্তাপ না থাকলে বুঝতে হবে সেখানে কোন আগুণ নাই। তেমনি নেক আমল না থাকলে বুঝতে হবে সেখানে ইলম নাই। তাই আমলে বিপ্লব আনতে হলে ইলমের ভূবনে বিপ্লব আনতে হবে। কুর’আনী জ্ঞানের বড় অবদান হলো, এটি ব্যক্তির চিন্তাভাবনা ও বুাদ্ধিবৃত্তিকে প্রবল ভাবে সক্রিয় করে। চিন্তাশীল বিবেক তখন সৎকাজে প্রবল উৎসাহ পায়। সে জ্ঞান নিবৃত করে অন্যায় এবং অসৎ কাজ থেকে। সেটি না হলে বুঝতে হবে, ঐ আলেম নামধারী ব্যক্তিটি কুর’আন তেলাওয়াত ও কুর’আন হিফযের কাজ যতই করুক, কুর’আনী জ্ঞানার্জনের কাজটি করেনি।

ঔষধের নামে বিষপান সমাজে কম হয় না। তেমনি কম হয় না শিক্ষার নামে কুশিক্ষা এবং জ্ঞানের নামে অজ্ঞতার বিতরন। এজন্যই মাদ্রাসাতে নকল হয়, বিশ্ববিদ্যালয়েও ধর্ষণে উৎসব হয়। হাজা, মজা, চড়াজাগা নদীতে যে সামান্য পানি থাকে -তাতে নৌকা চলে না, প্লাবনও আসে না। তলানীতে পৌঁছা সামান্য পানি দিয়ে চাষাবাদের কাজ চলে না। তেমনি বিষয়টি জ্ঞানের ক্ষেত্রেও। ব্যক্তির চরিত্র, চেতনা ও জীবনের মোড় পাল্টাতে চাই গভীরতর জ্ঞানের জোয়ার। কয়েক খানি বই পাঠে সেটি হয় না। বাড়াতে হয় জ্ঞানের গভীরতা। কুর’আনী জ্ঞানে ব্যক্তিকে সমৃদ্ধ করার প্রয়োজনে নিয়মিত কুর’আন পাঠ এবং কুর’আন মুখস্থ করার উপর তাই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। হাদীসে বলা হয়েছে: পবিত্র কুর’আনের একটি হরফ পাঠে ১০টি নেকী। এর উদ্দেশ্য কুর’আনের সাথে সম্পর্ককে নিবিড়তর করা। এবং কুর’আনের জ্ঞানকে গভীরতর করা। গভীর জ্ঞানেরই ফলেই আসে ব্যক্তির ঈমান, আমল ও চিন্তার মডেলে পরিবর্তন। যে কোন সমাজ বিপ্লবের জন্য এরূপ জ্ঞানের বিপ্লব শুধু জরুরি  নয়, অপরিহার্যও। না বুঝে তেলাওয়াতে জ্ঞানার্জনের সে কাজটি হয়না। সেটি সম্ভব হলে বাঙালি মুসলিমগণই হতো জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব পবিত্র কুর’আনের এতো তেলাওয়াত ও হিফয সম্ভবতঃ আর কোন দেশেই হয়না, যতটা হয় বাংলাদেশে।

সমস্যা হলো, অজ্ঞতাই যে আমাদের সকল দুরাবস্থার মূল কারণ -সেটির উপলব্ধি নিয়েও রয়েছে ব্যর্থতা। সঠিক পথের সন্ধান লাভের পর কোন সুস্থ ব্যক্তিই ভ্রান্ত পথে দৌঁড়ায় না। ভ্রান্ত পথে শত শত বছর চলার পরও যদি সাফল্য না আসে, তবে বুঝতে হবে পথটি সঠিক নয়। আমাদের ব্যর্থতাই প্রমান করে, আমরা চলেছি ভ্রান্ত পথে। এবং সঠিক পথটি আমাদের চেনাই হয়নি। জাহান্নামের আযাব এতোই কঠিন যে, সে আযাবের সামান্য জ্ঞান ও উপলব্ধিও ব্যক্তির জীবনে আমূল বিপ্লব আনতে বাধ্য। সে বিপ্লব না আসলে বুঝতে হবে, সে আযাবের জ্ঞানলাভই তার ঘটেনি। সে অজ্ঞতাটি তখন তার আমলে সুস্পষ্ট রূপে ধরা পড়ে। নবীজী (সা:) তাঁর ১৩ বছরের মক্কী জীবনে মুসলিমদের মাঝে পরকালের ভীতি তথা আখেরাতের জ্ঞানকেই মজবুত করেছিলেন। সে জ্ঞানের পিছনে ছিল কুর’আনের জ্ঞান। মক্কায় নাযিলকৃত সুরাগুলির আলোচ্য বিষয় হলো এগুলি। সে সময়ে মুসলিমদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন হয়েছে। কিন্তু সে নির্যাতন তাদের কুর’আনলব্ধ জ্ঞানকে আরো শানিত করেছিল। ধারালো করেছিল তাদের ঈমান ও উপলব্ধিকে।

 বুদ্ধিবৃত্তি শানিত হয় জিহাদ

মৃত্যুর মুখোমুখী দাঁড়িয়ে সত্যের সম্যক উপলব্ধির যে সামর্থ্য সৃষ্টি হয় -সেটি বক্তৃতায় বা ওয়াজে সৃষ্টি হয় না। ফলে মক্কায় যে কুর’আনী জ্ঞানের ভান্ডার গড়ে উঠেছিল সেটি আজও অতুলনীয়। মদিনার বুকে ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল বস্তুত মক্কী আমলে অর্জিত জ্ঞানের সে শক্ত বুনিয়াদের উপর ভিত্তি করেই। জ্ঞানের গভীরতম স্তরে পৌঁছার এ মারেফতী জ্ঞান পীরের খানকাতে সৃষ্টি হয় না। ওয়াজের মাহফিলেও নয়। বাংলাদেশে যেরূপ লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে ওয়াজ বা ইজতেমা হয়, নবীজী (সা:)’র আমলে সেটি হয়নি। নবীজী (সা:) মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমায়েতে পবিত্র কুর’আনের আয়াত ভিত্তিক যে ওয়াজ দিতেন, সেগুলিই জোগাতো তাঁর সাহাবাদের মাঝে আত্ম-উপলব্ধি ও বুদ্ধিবৃত্তির সামর্থ্য। এটিই তো হলো বুদ্ধির প্রকৃত প্রয়োগ। ইসলামী পরিভাষায় এটিই হলো তাদাব্বুর, তাওয়াক্কুল ও তাফাক্কুর। অথচ বাংলাদেশে এটিরই মহা সংকট। দেশে মাদ্রাসা বাড়ছে, মসজিদও বাড়ছে। বাড়ছে নামাজীর সংখ্যাও। কিন্তু যা বাড়েনি বা বাড়ছে না -তা হলো তাদাব্বুর, তাওয়াক্কুল ও তাফাক্কুর। অর্থাৎ বাড়ছে না বুদ্ধিবৃত্তি তথা বিবেককে কাজে লাগানোর সামর্থ্য। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ: “ফাযাক্কির বিল কুর’আন”। অর্থ: “কুর’আন দিয়ে মানুষকে সাবধান করো”। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো মহান আল্লাহতায়ালার সে হুকুম মানা হয়নি। পবিত্র কুর’আনকে দিয়ে জনগণকে সাবধান করার সে ফরজ কাজটাই হয়নি। শুধু তেলাওয়াত শিখিয়ে কি সেটি হয়? কুর’আনকে দিয়ে সাবধান করতে হলে মানুষের মধ্যে কুর’আন বুঝার সামর্থ্য সৃষ্টি করতে হয়। যে কুর’আনকে দেশের জনগণ বুঝলোই না -সে কুর’আনের আয়াত বার বার শুনিয়ে বা তেলাওয়াত করতে বলে কি মানুষকে সাবধান করার কাজটি যায়?   

দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, বিচার ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণ জুড়ে যে বিবেকহীনতা -সেটিই প্রমান করে সমাজকে সভ্যতর করার কাজে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নবীজী (সা:) যেখান থেকে তাঁর কাজের শুরু করেছিলেন সেখান থেকে কাজটি শুরুই হয়নি। মুসলিম বাঁচছে নবীজী (সা:) পরীক্ষিত সাফল্যের পথটি পরিত্যাগ করে। বরং আবিষ্কার নানাবিধ ব্যর্থতার পথ। চেতনা রাজ্যে যেভাবে নানা মতবাদ ও নানা ফেরকার নামে আগাছা বাড়ছে তাতে প্রমানিত হয়, কুর’আনী জ্ঞানের বীজ সেখানে রোপনই করা হয়নি। অথচ একাজের দায়িত্বটি বিশেষ কোন নেতা বা দলের নয়, প্রতিটি মুসলিমের। কারণ, আল্লাহতায়ালার কাছে এজন্য সবাই দায়বদ্ধ। এ ব্যর্থতার জবাব সবাইকে আলাদা ভাবে দিতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে এভাবে পিছিয়ে থাকলে সভ্যতর মানব, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ যে অসম্ভব –সে বোধটুকুই বা ক’জনের? এতে পরাজয় ও ব্যর্থতাই যে দিন দিন গভীরতর হয় -তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? দুর্বৃত্তি ও নানা রূপ ব্যর্থতার ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলো কি সেটিই প্রমাণিত করছে না? আর কত কাল চলতে থাকবে পতনমুখী এ যাত্রা?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *