কবি রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বাংলাদেশীদের বোকামী ও অর্জিত পরাধীনতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

বহু বাংলাদেশী কবি রবীন্দ্রনাথকে কঠোর ভাষায় গালি দেয় এই জন্য যে, তিনি ভারতের রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষার পক্ষ না নিয়ে হিন্দি‌’র পক্ষ নিয়েছিলেন। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস, ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, এমনকি জীবনানন্দ দাশও ভারতের রাষ্ট্রভাষা রূপে হিন্দির পক্ষ নিয়েছিলেন। এমন কি পশ্চিম বাংলার কোন হিন্দু বাঙালি রাজনীতিবিদ -তা কংগ্রেস দলের হোক বা কম্যুনিস্ট পার্টির হোক, তারাও বাংলা ভাষাকে ভারতের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী তোলেননি। তারা সবাই হিন্দির পক্ষ নিয়েছেন। বিষয়টি ভাববার বিষয়। তাদের সে সিদ্ধান্তের পিছনে কোন রাজনৈতিক ভাবনাটি কাজ করেছিল -সেটি বুঝার সামর্থ্য কি বাংলাদেশী বাঙালি কাপালিকদের আছে? তাদের অহংকার, একমাত্র তারাই বাংলা ভাষার পক্ষের শক্তি। এবং বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ একমাত্র বাংলাদেশী বাঙালিদের হাতে। যে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাই এতো লিখলেন, বাংলা ভাষার প্রতি তার যেন কোন দরদই ছিল না!

বাংলাদেশী বাঙালিগণ বুঝতে ভুল করে, রবীন্দ্রনাথ, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ চন্দ্র বোস, জীবনানন্দ দাশ এবং পশ্চিম বাংলার অন্যান্য বাঙালি কবি-সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীগণ শুধু বাঙালি ছিলেন না, মনে প্রাণে তাঁরা হিন্দুও ছিলেন। তাদের চেতনায় কাজ করতো ভারতকে একটি শক্তিশালী বিশ্বশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়ার ভাবনা। সেজন্য ভারতের ঐক্যকে তারা গুরুত্ব দিতেন।‌ সেরূপ একটি ভাবনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কট্টোর মুসলিম বিদ্বেষী মারাঠী নেতা শিবাজীকে ভারতের জাতীয় বীরের মর্যাদা দেন এবং কলকাতায় শিবাজী পূজা উৎসব শুরু করেন। শিবাজীর নামে কবিতাও লেখেন। বাংলা ভাষাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার জিদ ধরলে সে হিন্দু ঐক্যে ফাটল ধরতো। তখন পাকিস্তানের ন্যায় ভারতও ভেঙ্গে যেত। ‌কারণ বাংলার বাইরে বাংলার ভাষার কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। কিন্তু হিন্দি ভাষা বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, দিল্লি, হরিয়ানা ও রাজস্থানের  মত বহু ভারতীয় প্রদেশের জনগণ বুঝে।

রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য যেসব বাঙালি নেতাগণ হিন্দির পক্ষ অবস্থান নিয়েছিলেন -তারা শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বটি বুঝতেন। এখানেই তাদের প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি। একই রূপ দূরদৃষ্টি থাকার কারণে কায়েদে আজম মহম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার করার পক্ষ নেন। অথচ উর্দু তাঁর নিজের মাতৃভাষা ছিল না। তিনি ছিলেন গুজরাতী। একই কারণে খাজা নাজিমুদ্দীন, নূরুল আমীনের মত বাঙালি নেতারাও উর্দুর পক্ষ নেন। সেরূপ দূরদৃষ্টি পাকিস্তানের পাঞ্জাবী জনগণেরও মধ্যেও দেখা যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে বাংলা কখনোই কোন দেশের রাষ্ট্র ভাষা ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্র ভাষা ছিল পাঞ্জাবী। পাঞ্জাব যখন শিখদের দ্বারা শাসিত হয়, তখন পাঞ্জাবের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় পাঞ্জাবী ভাষা। পাঞ্জাবী ভাষা আজ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মনুষের ভাষা। সে যুক্তি দেখিয়ে পাঞ্জাবী জনগণ পাঞ্জাবী ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জিদ ধরলে পাকিস্তান আরো চার টুকরোয় বিভক্ত হতো। পাকিস্তানের পাঞ্জাবী জনগণ সেটি বুঝে। তাই তারা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা রূপে মেনে নিয়েছে। তারা শক্তিশালী পাকিস্তান রাষ্ট্রকে বাঁচাতে আগ্রহী।

অনেক বাংলাদেশী বিশ্বাস করে, রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি না পেলে ভাষার মৃত্যু ঘটে। তাই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা রূপে উর্দুর ঘোষণা দিলে তারা বলা শুরু করে, বাঙালির মুখে ভাষা কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। যেন হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্র ভাষা করাতে পশ্চিম বাংলার বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু অবান্তর কথা! বাংলাদেশীগণ এ বিষয়টি বুঝতে ব্যর্থ হয় যে, ভাষার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো শক্তিশালী রাষ্ট্রের নির্মাণ। কারণ, শক্তিশালী রাষ্ট্র নির্মাণ না করলে কখনোই স্বাধীনতা বাঁচে না। তখন জনগণের জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তাও সুরক্ষিত হয়না। শক্তিশালী রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হলে দেশের ভৌগলিক আয়োতন বাড়াতে হয়। ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠতে হয়। এজন্যই গৌরবযুগের মুসলিমগণ দেশের ভূগোলে লাগাতর বৃদ্ধি এনেছেন। সেটিকে তারা জিহাদ গণ্য করতেন। আরব, ইরানী, তুর্কী,  কুর্দি ও অন্যান্য বহুভাষী মুসলিম একতাবদ্ধ হয়েছেন। ইসলামে এরূপ একতা ফরজ। এবং বিভক্তি হারাম। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিগণ হারাম পথটিকে বেছে নেয়।

বাংলাদেশের মূল দুর্বলতা হলো তার ক্ষুদ্র ভূগোল। এ ক্ষুদ্র ভূগোল নিয়ে আগ্রাসী ভারতের পাশে স্বাধীন থাকাই অসম্ভব। পরাধীনতা এখানে অনিবার্য। একাত্তরে ভারত যুদ্ধ করেছে এমন একটি পরাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যেই। সেটি বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই প্রমাণিত হয়ে আসছে। আজকের বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে সাবেক পূর্ব বাংলা নিয়ে। তিন দিক থেকে ভারত দ্বারা পরিবেষ্ঠিত ক্ষুদ্র পূর্ব বাংলার স্বাধীন থাকার সামর্থ্য আছে -সেটি যদি শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দীন বিশ্বাস করতেন তবে ১৯৪৭ সালেই তারা স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণ করতেন। তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা মুজিবের চেয়ে অধিক ছিল। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও মুজিবের চেয়ে অধিক ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পড়াশুনা করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, খাজা নাজিমুদ্দীন পড়াশুনা করেছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে । শেরা বাংলা পড়াশুনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুজিবের এসব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালযের দরজায় ঢুকার সামর্থ্য ছিল না। রাজনৈতিক প্শিক্ষণও তিনি পাননি। তাছাড়া শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সহরোয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দীনের দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও ছিল। তারা যেরূপ হিন্দুদের সাথে প্রতিয়োগিতা করে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, সেরূপ প্রাতিযোগিতা মুজিব করতে হয়নি। মুজিব বেছে নেয় ভারতীদয় গুপ্তচরদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্রের পথ। তার প্রমাণ, আগরতলা ষড়যন্ত্র। স্বাধীন থাকার প্রয়োজনে একতা গড়ার গুরুত্ব ইউরোপের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশগুলি বুঝছে। তাই তারা দ্রুত ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে শামিল হচ্ছে। একই কারণে ১৯৪৬ সালে বাংলার মুসলিম নেতাগণ মুসলিম লীগের দিল্লি সম্মেলনে লাহোর প্রস্তাবে সংশোধন এনে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানভূক্ত করার উদ্যোগ নেন। সেটি না করলে পূর্ব বাংলা ১৯৪৮ সালেই ভারতের পেটে হজম হয়ে যেত – যেমন হয়েছে কাশ্মীর, হায়দারাবাদ, গোয়া, মানভাদর ও সিকিম।       

বাংলাদেশী বাঙালীদের সমস্যা হলো, তাদের ভাষা প্রেম আছে, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা। ফলে তাদের নাই শক্তিশালী স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র নির্মাণের ভাবনা। ‌ ফলে ১৯৪৭ সালের বাঙালি  মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ঘিরে শক্তিশালী সিভিলাইজেশনাল স্টেট নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন -সেটি সেকুলারিস্ট বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের কাছে সাম্প্রদায়িক মনে হয়েছে। তারা মনযোগী হয় বাংলা ভাষার নামে একটি বাঙালি ট্রাইবাল রাষ্ট্র নির্মাণে। তাই একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গতে ভারতের সাথে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অথচ পাকিস্তান খণ্ডিত না হলে দেশটি পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র রূপে বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারতো। দেশটির সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠি রূপে বাঙালিগণও পেত বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলার সুযোগ। আজকের মত ভারতের গোলাম হতো না। তাদের হাতে থাকতো পারমানবিক অস্ত্র। পাকিস্তানের ২৩ বছরে ৩ জন প্রধানমন্ত্রী এবং ২ জন রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছে বাঙালি। কায়েদে আজমের মৃত্যুর পর তার আসনে বসেছেন বাঙালি খাজা নাজিমুদ্দীন। পাকিস্তানের ২৩ বছরে কখনো পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও শাপলা চত্তরের গণহত্যার ন্যায় হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। দেশটিতে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ন্যায় ভোটডাকাতিও হয়নি।   

অনেকেই এখন আফসোস করে বলেন, বাংলাদেশ আজ ভারতের অধিকৃত করদ রাষ্ট্র। তাদের অভিযোগ, ভারতের প্রদেশগুলোর যে স্বাধীনতা রয়েছে, সে স্বাধীনতাটুকু বাংলাদেশের নাই। কথাটি সত্য। ভারতীয় প্রদেশগুলির জনগণ অন্তত ভোট দিয়ে প্রাদেশিক সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের সে স্বাধীনতা নেই। এদেশে ভোটের ইজ্জত নাই, ইজ্জত রয়েছে কেবল ভোটচোর, ভোটডাকাত ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীদের। অথচ এ পরাধীনতা তাদের উপর কেউ চাপিয়ে দেয়নি। এটি তাদের নিজহাতে একাত্তরের অর্জন। এ পরাধীনতার জন্য দায়ী বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। তারা ভোট দিয়ে, অর্থ দিয়ে, শ্রম দিয়ে ও রক্ত দিয়ে এ পরাধীনতা অর্জন করেছে।

একাত্তরের যারা অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তারা বরং ভারতীয় অধিকৃতির বিপদের কথা সেদিনই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ভারতের গোলাম হতে চায়নি। তাদের দূরদৃষ্টি সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। তারই ছিল স্বাধীনতার প্রকৃত পক্ষের শক্তি -যেমন ছিলেন ১৯৪৭য়ের সোহরাওয়ার্দী, নাজিমুদ্দীন, শেরে বাংলা। কিন্তু বাঙালি কাপালিকগণ সেটি ইচ্ছা করেই বুঝতে চায়না। অজ্ঞতার কারণে শিশুরা আগুনে হাত দেয়।  সেরূপ অজ্ঞতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিগণও হিন্দুত্ববাদী ভারতকে বন্ধু ভেবে গলা জড়িয়ে ধরেছে। বাঙালি মুসলিমের সর্বকালের ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় ভূল সিদ্ধান্ত। এখন সে ভূলেরই মাশুল দিতে হচ্ছে ভারতে পদতলে অধিকৃত হয়ে। এ অধিকৃতি থেকে কি সহজে মুক্তি আছে? ভূল করতে সময় লাগেনা। কিন্তু সে ভূলের মাশুল দিতে হয় শত শত বছর ধরে। ০৫/০৩/২০২৪

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *