বিজয় সেক্যুলারিস্টদের এবং পরাজয় নবী-আদর্শের

ফিরোজ মাহবুব কামাল

রাষ্ট্রের শক্তি ও সামর্থ্য বিশাল। পৃথিবী পৃষ্ঠে রাষ্ট্রই হলো সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। তাই মানব ইতিহাসে যত যুদ্ধ-বিগ্রহ -তা এই রাষ্ট্রের উপর দখলদারী প্রতিষ্ঠা নিয়ে। এজন্যই ইসলামের সবচেয়ে বড় ইবাদতটি হলো রাষ্ট্রকে ইসলামের পক্ষের শক্তির দখলে রাখা। রাষ্ট্রকে নিজ পক্ষে বা নিয়ন্ত্রনে না রাখলে পাগলা হাতির ন্যায় তছনছ করে দেয় ধর্ম, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সভ্য জীবন-যাপনের সকল আয়োজন। আজকের বাংলাদেশে হলো তো তারই উদাহরণ। বাংলাদেশে বিজয়টি সেক্যুলারিস্টদের এবং পরাজয় ইসলামের। রাজার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর আইন মানা না হলে রাজার রাজত্ব বাঁচে না। তেমনি ইসলামের পরাজয়ের অর্থ রাষ্ট্রের উপর আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও আদালত থেকে তাঁর শরিয়তী আইনের বিলুপ্তি। বাংলাদেশে সেটিই হয়েছে। দেশ চোর-ডাকাত, ভোটডাকাত ও ইসলামের শত্রুপক্ষের দখলে গেলে লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করেও লাভ হয় না। মসজিদের ইমাম এবং মুসল্লীদের তখন মসজিদের মেঝেতে বসে ইসলামের নৃশংস শত্রু জালেম শাসকের জন্য দোয়া করতে বাধ্য করা হয়। তখন মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীগণ বাধ্য করা হয় জাতীয় সঙ্গীতের নামে হিন্দুত্ববাদী পৌত্তলিক গান গাইতে। তখন রাষ্ট্রের প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবাহিনী দুর্বৃত্ত শাসকের চৌকিদারে পরিণত হয়। ফলে বিপন্ন হয় শুধু ইসলামই নয়, বরং নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষের জানমাল এবং ইজ্জত-আবরু।

ইসলামের বিজয় শুধু মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়িয়ে চলে না। সেটি সম্ভব হলে এবং মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সে কাজটি পছন্দের হলে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম স্রেফ মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ায় মনযোগী হতেন। নিজেদের ঘরবাড়ী ছেড়ে শত্রু শক্তির নির্মূলে জিহাদে ময়দানে নামতেন না। ইবাদতের অর্থ স্রেফ নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও তাসবিহ পাঠ হলে শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবাকে জিহাদে শহীদ হতে হতো না। এবং নবীজী (সা:)কে রণাঙ্গণে আহত এবং ১০টি বছর রাষ্ট্রনায়কের আসনে বসতে হতো না। রাজনীতিমূক্ত জীবন জায়েজ হলে রাষ্ট্র পরিচালনার গুরু দায়ভারটি নিজ কাঁধে না নিয়ে তিনিও আজকের হুজুরদের মত জায়নামাজে বসে ইবাদতে মশগুল থাকতে পারতেন। এবং কুর’আনের জ্ঞানদানের মাঝেই নিজের দায়িত্বপালনকে সীমিত রাখতেন। তাঁর ইন্তেকালের পর সাহবাগণ গড়তেন না খেলাফতে রাশেদা। এবং জান্নাতের যুব সর্দার ইমাম হোসেন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে কারবালায় শহীদ হতেন না।

নবীজী (সা:)’র জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটি হলো, রাষ্ট্রের পূর্ণ ইসলামীকরণ। এটিই হলো ইসলামের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রজেক্ট। এখানে খরচ হয় বিপুল অর্থ, শ্রম ও রক্তের। ইসলাম শুধু ওয়াজ-নসিহত ও দোয়া-দরুদে প্রতিষ্ঠা পায় না, সে জন্য চাই সমগ্র রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির পূর্ণ ব্যবহার। সে লক্ষ্যে চাই ইসলামী শত্রুশক্তির নির্মূল। চাই, সুবিচারের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ও দুর্বৃত্তির পূর্ণ বিলুপ্তি। একাজে সামান্য আপোষ চলে না। ইসলামের এরূপ প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য যে রাজনৈতিক লড়াই –সেটিই হলো ইসলামের শ্রেষ্ঠ ইবাদত। এটিই হলো ঈমানদারের জিহাদ। এ কাজে চাই প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও সামরিক বল। ছোট্ট এক টুকরো ভূমির উপর কি বিশাল দুর্গ গড়া যায়? তেমনি বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে উঠা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নমুনা রূপে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য তো চাই বিশাল ভৌগলিক মানচিত্র। নবীজী (সা:) এবং গৌরব যুগের মুসলিমগণ তে সেটিই করেছেন। সে লক্ষ্যে চাই, নানা ভাষা, নানা অঞ্চল ও নানা বর্ণের মানুষের মাঝে সীসাঢালা দেয়ালসম একতা।

লক্ষণীয় হলো, নবীজী (সা:) ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিয়েই থেমে যাননি। দ্রুত সে রাষ্ট্রের সীমানা বাড়াতেও মনোযোগী হয়েছিলেন। ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বাড়াতে তাঁকে রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়তে হয়েছে।এবং মৃত্যুর আগে তিনি সাহাবাদের নসিহত করে যান, তাঁরা যেন রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানি কন্সটান্টিনোপল দখলে আনার চেষ্ঠা করে। এটি ছিল নবীজী (সা:)’র স্ট্রাটেজিক ভিশন। তিনি শুধু ধর্মনায়ক ছিলেন না, ছিলেন রাষ্ট্রনায়কও। এ থেকে বুঝা যায়, নবীজী (সা:) ভবিষ্যতের ইসলামী রাষ্ট্র নিয়ে কীরূপ ভাবতেন এবং কতটা গুরুত্ব দিতেন সে রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক শক্তির। নবীজী (সা:)’র সে ভিশন নিয়েই মুসলিমগণ তাদের জানমালের সবচেয়ে বড় কুর’বানী পেশ করেছে মুসলিম রাষ্ট্রের শক্তি বাড়াতে। পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, দুর্গম মরুভূমি পাড়ি দিয়ে তারা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের নানা দেশে পৌঁছেছেন। তাদের দ্বারা পরিপূর্ণ দ্বীন পালন, সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণ ও বিশ্বমাঝে সুমহান মর্যাদায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর সামর্থ্য সৃষ্টি হয়েছে তো এভাবেই। আজও  মুসলিমদের সামনে এটিই হলো নবীজী (সা:)’র অনুকরণীয় সূন্নত। কিন্তু নবীজী (সা:)’র সে মহান সূন্নত মুসলিমদের মাঝে বেঁচে নাই। ইসলামের বিজয় নিয়ে তাদের আগ্রহ নাই, তারা বেঁচে আছে ইসলামের পরাজয় মেনে নিয়ে।

মুসলিম বিশ্বে আজ যারা সেক্যুলারিস্ট তারা কট্টোর বিরোধী নবীজী (সা:)’র এই পরীক্ষিত রাজনৈতিক আদর্শের। তারা চায় না, মুসলিমগণ কোন ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে তুলুক। বেশ্যাবৃত্তি, সূদী ব্যাংক, কুফুরি আইন, মদের দোকান, নাচ-গানের মহফিলের জন্য রাষ্ট্রীয় অঙ্গণ ছেড়ে দিতে তারা সব সময় রাজী, কিন্তু রাজী নয় ইসলামী বিধানের জন্য সামান্য জায়গা দিতে। দেশের আইন-আদালতের অঙ্গণ তো নয়ই। তাদের অবিরাম যুদ্ধটি মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। মুসলিমকে তার প্রতিটি কাজের শুরু করতে হয় “বিসমিল্লাহ” বলে তথা মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র নাম নিয়ে। অথচ সেক্যুলারিস্টদের দাবী, রাজনীতি করতে হবে সেই আল্লাহর নাম ও তাঁর বিধানকে বাদ দিয়ে। তাদের কথা, রাজনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনায় ইসলামের নাম নিলে রাষ্ট্রের সেক্যুলার চরিত্রটি নষ্ট হয়। তাদের অঙ্গীকার তাই রাষ্ট্রের অঙ্গণ থেকে ইসলামকে দূরে রাখা এবং এভাবে আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে পরাজিত রাখা। তাদের এজেন্ডা তাই শয়তানকে খুশি করা। তাদের লাগাতর যুদ্ধটি নবীজী (সা)’র রাজনৈতিক সূন্নতের বিরুদ্ধে। অথচ, নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ তো তাই করেছেন -যা মহান আল্লাহতায়ালা চান। তাই যাদের যুদ্ধ নবীজী (সা:)’র সূন্নতের বিরুদ্ধে, তাদের যুদ্ধ মূলত মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে।

সেক্যুলারিস্টগণ চায়, রাষ্ট্র গড়ে উঠবে স্রেফ ভাষা ও অঞ্চল ভিত্তিক পরিচয়ের ভিত্তিতে –যেমনটি গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় এমন রাষ্ট্রকে বলা হয় নেশন স্টেট তথা জাতীয় রাষ্ট্র। মুসলিম বিশ্ব আজ ৫০টির বেশী নেশন স্টেটে বিভক্ত। নেশন স্টেটের এই ধারণাটি নবীজী (সা:)’র আদর্শের বিরোধী। ইসলামে নেশনের কোন ধারণা নাই, আছে উম্মাহর ধারণা। নেশন স্টেটের মাধ্যমে মুসলিমগণ একতাবদ্ধ হয়। উম্মাহর ধারণাটি মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করে। নবীজী (সা:) এবং তাঁর সাহাবাগণ অখণ্ড রাষ্ট্র গড়েছেন নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা অঞ্চলের মানুষকে নিয়ে। নেশন স্টেটের বদলে তারা গড়তেন উম্মাহ-ভিত্তিক স্টেট –যার ভিত্তি হলোভাষা বা ভঞ্চলের বদলে বিশ্ব মুসলিম ভাতৃত্ব ও একতা। লক্ষ্য এখানে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিমদের শক্তিবৃদ্ধি ও বিজয়। অথচ সেক্যুলারিস্টগণ তেমন রাষ্ট্র গড়ার বিরোধী। তাদের রাজনীতির লক্ষ্য ভাষা বা অঞ্চল-ভিত্তিক এজেন্ডা-পূরণ। সে লক্ষ্যে বৃহৎ কোন মুসলিম রাষ্ট্রকে ভাঙ্গাও তাদের জন্য গৌরব ও উৎসবের বিষয় গণ্য হয়। এরূপ বিভক্তির রাজনীতির কারণেই মুসলিমগণ আজ ৫০টির বেশী রাষ্ট্রে বিভক্ত ও শক্তিহীন। তাছাড়া এরূপ বিভক্তি যে মহান আল্লাহতায়ালার আযাব নামিয়ে আনে সেটি তো প্রতিশ্রুত –যার ঘোষণা এসেছে সুরা আল ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে। তখন সে আযাবের হাতিয়ারে পরিণত হয় দুর্বৃত্ত জালেম শাসকের নৃশংস শাসন। বাংলাদেশীদের উপর তো তেমন এক অসভ্য ও নৃশংস শাসনই চেপে বসেছে। ফলে দেশে প্লাবন এসেছে স্বৈর শাসন, গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, অর্থপাচার, জেল-জুলুম ও সন্ত্রাসের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *