ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা কেন শ্রেষ্ঠ ইবাদত?
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on February 19, 2021
- Bangla Articles, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম
মানব ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণের কাজে হযরত মহম্মদ (সাঃ)’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানটি শুধু ইসলাম প্রচার ছিল না, বরং সেটি ছিল বিশাল ভূ-ভাগ থেকে দুর্বৃত্ত শাসকদের নির্মূল এবং ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এ কাজটি না হলে স্রেফ কোর’আন তেলাওয়াত, নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত পালন এবং মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা বাড়িয়ে ইসলামের বিজয় ও মুসলিমের গৌরব বৃদ্ধি করা যেত না। উচ্চতর সভ্যতাও নির্মাণ করা যেত না। এবং সম্ভব হতো না মানব জাতির কল্যাণে শিক্ষণীয় অবদান রাখাও। কারণ, জনকল্যাণে রাষ্ট্রের যে বিশাল ক্ষমতা -সেটি মসজিদ-মাদ্রাসা বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের থাকে না। এদিকে ইসলাম অন্য ধর্ম থেকে পুরাপুরি ভিন্ন। কারণ, অন্যায়ের নির্মূল (নেহি আনিল মুনকার) ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা (আ’মারু বিল মারুফ)’র বিষয়টি ইসলামের অতি কেন্দ্রীয় বিষয়। এ কাজটিকে মুসলিম জীবনের মিশন রূপে নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি রূপে মুসলিমদের যে আল্লাহতায়ালাপ্রদত্ত মর্যাদা সেটি এ কারণে নয় যে, তারা বেশী নামায-রোযা পালন করে। বরং একারণে যে, তারা বাঁচে অন্যায়ের নির্মূল ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে। এবং সে কাজে নিজের জান ও মালের বিনিয়োগ করে। একারণেই মুসলিম জীবনে অনিবার্য ও অবিরাম হয়ে উঠে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইসলামের পক্ষে রাষ্ট্রীয় শক্তি না থাকলে দুর্বৃত্ত শক্তির বিরুদ্ধে সে যুদ্ধে বিজয় অসম্ভব হয়ে পড়ে। মুসলিম জীবনে তখন আসে আত্মসমর্পণ এবং বাঁচতে হয় শত্রু শক্তির কৃপার উপর। এজন্যই মুসলিম জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা নয়, বরং সেটি ইবাদত ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। মানব সভ্যতার সমগ্র ইতিহাসে এটিই হলো সবচেয়ে বড় নেক কর্ম। দুর্বৃত্তগণ ইসলামের শক্তির এ পরিচিত উৎস্যটি জানে। এজন্যই সকল শয়তানী শক্তির প্রধান এজেন্ডা হলো পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে প্রতিহত করা। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাই বলেছিল, কোথাও ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেয়া হলে সেটিকে বোমা মেরে ধুলায় মিলিয়ে দেয়া হবে। তেমন একটি লক্ষ্যে শয়তানী শক্তিবর্গের কোয়ালিশনটি দুনিয়াব্যাপী।
ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা না থাকলে কাফের শক্তির সাথে সংঘাতের কোন কারণই সৃষ্টি হতো না। তাবলিগ জামায়াতের কর্মীদের এজন্যই কোন শত্রু নেই; তাদের জীবনে কোন সংঘাতও নাই। অথচ সংঘাত এড়াতে পারেননি নবী-রাসূলগণ। মুসলিম জীবনে এরূপ সংঘাত না থাকার অর্থ ইসলামকে প্রতিষ্ঠা দেয়ায় আগ্রহ না থাকা। হৃদয়ে ঈমান থাকলে সেটি কি সম্ভব? এমন লড়াইহীন জীবন তো ঈমানের শূণ্যতাতেই সম্ভব। মহান আল্লাহতায়ালা ঈমানদারদের সামনে অনুকরণীয় মডেল রূপে খাড়া করেছেন মুসলিম উম্মাহর আদি পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ:)কে। তাঁর কোন লোকবল ছিল না; তিনি ছিলেন একা। কিন্তু নমরুদের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত কাফের শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন এ হুংকার দিয়ে: “শুরু হলো তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”। তাঁর সে সাহসী ঘোষণাটি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এতোই ভাল লেগেছিল যে, সেটিকে তিনি রেকর্ড করেছেন পবিত্র কোরআনের সুরা মুমতাহেনার ৪ নম্বর আয়াতে। এবং তাঁকে পেশ করেছেন অনুকরণীয় আদর্শ রূপে। ঈমানদারদের উদ্দেশ্য বলা হয়েছে, “তোমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে ইব্রাহীম (আ:)’য়ের জীবনে।” এ থেকে বুঝা যায়, ইসলামের শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে মুসলিম জীবনে যে লড়াই –সেটি মহান আল্লহাতায়ালার কাছে কতটা প্রিয়।
নবীজী (সা:)’র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি হলো, ইসলামের শত্রুশক্তির নির্মূল স্রেফ দোয়ার মাধ্যমে হয়না। অথচ তিনি ছিলেন মহান আল্লাহতায়ালার মহান রাসূল। দুর্বৃত্ত শক্তির নির্মূলে তাকেও দোয়ার সাথে সশরীরে জিহাদে নামতে হয়েছে। এবং সে পথেই প্রতিষ্ঠা করেছেন ইসলামী রাষ্ট্র। এটিই নবীজী (সা:)’র শ্রষ্ঠ সূন্নত। লড়াই না থাকলে বিজয়ের প্রশ্নই উঠে না –সেটি বীজ না বুনে ফসল তোলার ন্যায় কল্প বিলাস। তখন অসম্ভব হয় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। আর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না পেলে লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা গড়েও শরিয়ত পালন ও পূর্ণ ইসলাম অসম্ভব হয়। তখন অসম্ভব হয় মুসলিম উম্মাহর শক্তিবৃদ্ধি। বাংলাদেশে ঢাকা’র ন্যায় একটি জেলাতে যত মাদ্রাসা ও মসজিদ আছে তা খলিফা রাশেদার আমলে সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্র জুড়ে ছিল না। কিন্তু তাতে লাভ কি হয়েছে? দেশে কি ইসলামের প্রতিষ্ঠা বেড়েছে? গৌরব বেড়েছে কি বাঙালী মুসলিমের। বরং ইতিহাস তো দুর্নীতিতে ৫ বার বিশ্বে প্রথম হওয়ার। দূর্নীতি নির্মূলের প্রধান ও শক্তিশালী হাতিয়ারটি হলো রাষ্ট্র। কিন্তু সে রাষ্ট্র যদি দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হয় –তবে দুর্নীতিতে প্লাবন আসবে সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? নবীজী (সা:)’র ইসলাম –যার অপরিহার্য উপাদান হলো শরিয়ত, হুদুদ, দুর্বৃত্তিমুক্ত সমাজ, খেলাফত, শুরাভিত্তিক শাসন, মুসলিম ঐক্য ও জিহাদ -সে ইসলাম বাংলাদেশে নাই। যেটি আছে সেটি হলো অপূর্ণাঙ্গ ও বিকৃত ইসলাম। পূর্ণাঙ্গ ইসলাম না থাকাতে সমাজ জুড়ে বেড়ে উঠেছে অধর্ম ও ভ্রষ্টতা। এজন্যই দেশ বিশ্বরেকর্ড গড়েছে দুর্বৃত্তিতে। রেকর্ড গড়ছে এমন কি পৌত্তলিক সংস্কৃতির পরিচর্যাতেও। বর্ষবরণ ও বসন্তবরণের নামে দেশে যেরূপ পৌত্তলিক সংস্কৃতির জোয়ার সৃষ্টি হয় -তা এমন কি কলকাতার হিন্দু সংস্কৃতিকেও হার মানায়। ঢাকা শহরে বাংলা ১৪২৫’য়ের নববর্ষ পালন দেখে অভিভুত হয়েছেন কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকার রিপোর্টার। তা নিয়ে উক্ত পত্রিকায় তিনি একটি রিপোর্টও ছেপেছেন।
ঈমানদারীর পথ ও গাদ্দারির পথ
ইসলামের মৌল বিশ্বাস ও অনুশাসনের নির্মূলে রাষ্ট্রীয় ভাবে যখন রাজনৈতিক ও সামাজিক ইঞ্জিনীয়ারীং চলে, তখন লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসাও যে কতটা ব্যর্থ হয় –বাংলাদেশ মূলত তারই উদাহরণ। অথচ ইসলামের শত্রুশক্তি নির্মূল হলে এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সমগ্র দেশ পরিণত হয় মসজিদ-মাদ্রসায়। নবীজী (সা:)’র হাদীস: কেউ মসজিদ নির্মাণ করলে মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর জন্য জান্নাতে ঘর তৈরী করে দেন। মসজিদ নির্মাণে অর্থ ব্যয় হয়, কিন্তু তাতে রক্তের বিনিয়োগ হয় না। কিন্তু বিপুল অর্থ ও হাজার হাজার মানুষের রক্তের বিশাল বিনিয়োগটি অপরিহার্য হয় ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণে। ইসলামী রাষ্ট্র দেয়, মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তের বিজয়। দেয়, শত্রুর হামলার মুখে মুসলিম উম্মাহর প্রতিরক্ষা। দেয়, বিশ্বশক্তি রূপে উত্থানের সামর্থ্য। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণের পুরস্কার যে কতো বিশাল -সেটি বুঝে উঠা কি এতই কঠিন? যে সমাজে সে কাজটি বেশী বেশী হয়, সে সমাজ পায় মহান আল্লাহতায়ালার অফুরন্ত নেয়ামত। তাদের সাহায্যে হাজার হাজার ফেরেশতা নেমে আসে। জুটে শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়। ফলে এ পৃথিবী পৃষ্ঠে এর চেয়ে সেরা নেক কর্ম এবং শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিশীল কাজ আর কি হতে পারে? সেটি না হলে সে রাষ্ট্রের বুকে যা নেমে আসে তা হলো কঠিন আযাব। ইসলামী রাষ্ট্রটি সবচেয়ে সফল ভাবে হয়েছিল সাহাবায়ে কেরামদের যুগে। নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সে কাজে শহীদ হয়েছেন। তাদের অর্থ ও রক্তের বিনিয়োগের ফলে অর্জিত হয়েছিল বিশ্বব্যাপী ইজ্জত। এবং তাতে মুসলিম উম্মাহর উত্থান ঘটেছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তি রূপে। কিন্তু আজ সে কোরবানি নাই, ফলে মুসলিম উম্মাহর সে শক্তি এবং ইজ্জতও নাই। কারণ, ঈমানদারীর বদলে তারা বেছে নিয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের সাথে গাদ্দারির পথ।
মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের সাথে গাদ্দারির ইতিহাস গড়েছিল বনি ইসরাইলীরা। ফিরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি দেয়ার পর হযরত মুসা (সা:) এবং তাঁর অনুসারি বনি ইসরাইলীদের উপর যে হুকুমটি এসেছিল -সেটি উপাসনালয় বা মাদ্রাসা গড়ার নয়। বরং সেটি ছিল ফিলিস্তিন থেকে স্বৈরশাসন নির্মূলের। নির্দেশ ছিল, স্বৈরশাসনের নির্মূল করে সেখানে তাওরাতে ঘোষিত শরিয়ত প্রতিষ্ঠা দেয়ার। কিন্তু ইহুদীগণ সে হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। তাদের আচরণ এতটাই উদ্ধত ছিল যে তারা হযরত মূসা (আ:)কে বলেছিল, “হে মূসা! তুমি ও তোমার আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ করো, আমরা অপেক্ষায় আছি।” তাদের গাদ্দারির ফলে স্বৈরাচারের নির্মূল ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠার কাজ সেদিন সফল হয়নি। ফলে হযরত মূসা (আ:) উপর অবতীর্ণ শরিয়তি বিধান স্রেফ তাওরাতেই রয়ে গেছে, বাস্তবায়ীত হয়নি। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে এরূপ গাদ্দারি কি কখনো রহমত ডেকে আনে? বরং ঘিরে ধরেছিল কঠিন আযাব। ফিলিস্তিনে ঢুকা তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়; শত শত বছর তারা নানা দেশের পথে পথে ঘুরেছে উদ্বাস্তুর বেশে। অথচ তাদের যে জনবল ছিল তা মহান নবীজী (সা:) পাননি। নবীজী (সা:) তাঁর মক্কী জীবনের ১৩ বছরে ২০০ জনের বেশী লোক তৈরী করতে পারেননি। অথচ মিশর থেকে হিজরত কালে হযরত মূসা (আ:) সাথে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। কিন্তু সে বিশাল জনবল তাদের শক্তি ও ইজ্জত না বাড়িয়ে অপমানই বাড়িয়েছে। একই পথ ধরেছে আজকের মুসলিমগণ। বিপুল সংখ্যায় বাড়ছে তাদের জনবল; কিন্তু বাড়েনি মহান আল্লাহতায়ালার পথে তাদের অঙ্গিকার ও কোরবানী। ইহুদীদের ন্যায় তারাও নিষ্ক্রিয় স্বৈরশাসকদের নির্মূলে। এক্ষেত্রে বাঙালী মুসলিমদের ব্যর্থতাটি কি কম? দীর্ঘকাল যাবত তাদের ঘাড়ে চেপে বসা স্বৈরশাসন এবং ইসলামের পরাজয় বস্তুত সে ব্যর্থতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম মেনে চলায় সামান্য অঙ্গিকার থাকলে এ জালেম স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গ্রামে গঞ্জে জিহাদ শুরু হতো।
বিপদ জিহাদশূণ্যতার
যে কৃষক ফসল ফলাতে জানে, তার ফসল বানের পানিতে বার বার ভেসে গেলেও সে আবার চাষাবাদে নামে। নিষ্ক্রিয় হওয়া, মনের দুঃখে হতোদ্যম হওয়া বা হতাশায় দেশ ছেড়ে যাওয়াটি তাঁর রীতিবিরুদ্ধ। গৃহে বার বার চুরি-ডাকাতি হবে এবং দিনের পর দিন গৃহ চোর-ডাকাতদের হাতে অধিকৃত থাকবে –এটি কি কোন সভ্য মানুষ মেনে নেয়? সেটি মেনে নেয়াটি শুধু অক্ষমতা নয়, বরং অসভ্যতাও। সভ্য মানুষ তাই চোর-ডাকাত তাড়াতে হাতের কাছে যা পায় তাই নিয়ে লড়াইয়ে নামে। ইসলামে সে লড়াইটিই তো জিহাদ। এরূপ জিহাদের কারণেই রাষ্ট্র থেকে নির্মূল হয় শয়তানী শক্তির দখলদারি। শত্রুর নির্মূলে ও মুসলিম উম্মহর প্রতিরক্ষায় একমাত্র জিহাদই হলো মূল হাতিয়ার। ফলে শত্রু শক্তির লাগাতর হামলাটি নামায-রোযা বা হজ্ব-যাকাতের বিরুদ্ধে নয়; বরং সেটির লক্ষ্য মুসলিম জীবন থেকে জিহাদের বিলুপ্তি। এবং জনগণ জিহাদমুক্ত হলে তাদের দখলদারীটি বিপদমুক্ত হয়।
প্রতিটি মুসলিম সমাজে জিহাদের বিরুদ্ধে শয়তানের কৌশলটিও চোখে পড়ার মত। শয়তান সমাজে শয়তান রূপে নামে না; নামে মোল্লা-মৌলভী, আলেম-উলামা, পীর-দরবেশ, ইমাম, হুজুর ও বুদ্ধিজীবীর ছদ্দবেশে। এরা বলে পবিত্র কোরআনে ইসলামি রাষ্ট্র বলে কিছু নেই। বলে, শরিয়তের প্রতিষ্ঠা বলে কিছু নাই্। বলে, জিহাদ বলেও কিছু নাই। যেন নবীজী (সাঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও সে রাষ্ট্রের প্রধান হয়ে কোরআনের বিরুদ্ধে চলে গেছেন! (নাউযু বিল্লাহ।) যেন ইসলামে খোলাফায়ে রাশেদা বলে কিছু ছিল না। বদর, ওহুদ, খন্দক ও হুনায়ুনের যুদ্ধ বলেও কিছু ছিল না। তাদের কাছে ইসলাম হলো স্রেফ তাওহীদে বিশ্বাস এবং নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিল পালন। নহিসত দেয়, জিহাদে নামার আগে ফেরেশতা হওয়ার। অথচ তারা জানে ফেরেশতা হওয়াটি অসম্ভব ব্যাপার। যে কাজ ফেরেশতাদের, সে কাজ মানুষের নয়। এক্ষেত্রে তাদের নিজেদের ব্যর্থতাটিও কি এ ক্ষেত্রে কম? এরূপ লক্ষ লক্ষ আলেম, ইমাম, হুজুর, পীর, সুফি ও দরবেশ প্রতি বছর দুনিয়া থেকে বিদায় নয় ফেরেশতা না হয়েই। নামায-রোযার ভাণ্ডারে অনেক ইবাদত জমলেও কতটুকু পূর্ণ হয় তাদের ঈমানের ভাণ্ডার? একটি দিনের জন্যও কি তারা জিহাদে হাজির হয়েছে?
জিহাদ থেকে অধিকাংশ মুসলিমের দূরে থাকার কারণে মুসলিম দেশে শরিয়তের প্রতিষ্ঠাও ঘটেনি। অথচ দেশ যেখানে ,অধিকৃত ইসলামের শত্রু শক্তির হাতে এবং শরিয়ত যেখানে নির্বাসিত, সে দেশে জিহাদের ময়দান তো হাজির হয় প্রতিটি ব্যক্তির দরজার সামনে। এবং জিহাদ প্রসঙ্গে নবীজী (সাঃ)’র প্রসিদ্ধ হাদীস: “যে ব্যক্তিটি জীবনে কোন দিন জিহাদ করলো না এবং জিহাদের নিয়েতও করলো না -সে ব্যক্তি মুনাফিক।” কারণ জিহাদ তো ঈমানের ফসল। বীজ থেকে যেমন চারা গজায়, ঈমান থেকে তেমনি জিহাদ জন্ম নেয়। তাই ঈমান থাকলে মু’মিনের জীবনে জিহাদ অনিবার্য ভাবেই এসে যায়। তাই নবীজী (সা:)’র অনুসারি এমন কোন সুস্থ্য সাহাবী ছিলেন না যিনি জিহাদের ময়দানে প্রাণ দানে হাজির হননি। অথচ যারা মুনাফিক, তাদের জীবনে নামায-রোযা থাকলেও জিহাদ থাকে না।
ঈমানের পরিচয়
ঈমান কাকে বলে এবং কীভাবে তার প্রকাশ ঘটে -পবিত্র কোরআন থেকে একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ফিরাউনের প্রাসাদে মূসা (আ:)’র সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে যাদুকরদের যে দলটি ঈমান এনে শহীদ হয়েছিলেন তাদের কেউই ফেরেশতাদের ন্যায় পুতঃপবিত্র ছিলেন না। তারা সারা কর্মজীবন কাটিয়েছিলেন যাদুর ন্যায় কবিরা গুনাহর রাজ্যে। তাদের নামায-রোযার ভাণ্ডারটি ছিল শূণ্য। হযরত মূসা (আ:)’র সাথে যাদুকরদের প্রতিযোগিতা দেখতে সেখানে হাজির ছিল বহু হাজার মানুষ। হযরত মূসা (আ:)’র একই মোজেজা তারাও দেখেছিল; কিন্তু তাদের কেউই ঈমান আনেনি। অথচ ঈমান আনার সামর্থ্যটুকুই মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সামর্থ্য। মহান আল্লাহতায়ালার বিচারে সে সামর্থ্যটুকুর মূল্য অতি বিশাল। সে সামর্থ্যকে তিনি পুরস্কৃত করেন জান্নাত দিয়ে। জীবনের প্রতি পদে তো সে সামর্থ্যেরই পরীক্ষা হয়।
যাদুকরদের কালেমায়ে শাহাদত মহান আল্লাহতায়ালার কাছে যে শুধু কবুল হয়েছিল তা নয়, বরং মহান রাব্বুল আ’লামিন তাদের মুখে সে কালেমা শুনে এতোই খুশি হয়েছিলেন যে তাদের সে কাহিনী পবিত্র কোর’আনে বার বার বর্ণনা করেছেন। এভাবে সমগ্র মানব জাতির জন্য সেটিকে শিক্ষণীয় করে রেখেছেন। হযরত মূসা (আ:)’র মোজেজা দেখার সাথে সাথে তাদের ঈমানের ভাণ্ডারটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে এবং তাঁরা সেজদায় পড়ে যান। ঈমান আনার অপরাধে ফিরাউন তাদেরকে নির্মম ভাবে হাত-পা কেটে হত্যার হুকুম শুনেয়েছিল। কিন্তু সে নৃশংসতায় তাঁরা আদৌ বিচলিত হননি, তারা অটল বিশ্বাসে শহীদ হয়ে গেছেন। তাদের লক্ষ্য ছিল, স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করা। এমন একটি চেতনার কারণে মু’মিনের জীবনে ঈমান কখনোই গোপন থাকে না। সে বলিষ্ঠ ঈমান ব্যক্তিকে যেমন নামাযে নেয়, তেমনি জিহাদেও নেয়। ঈমান বলতে কী বুঝায় এবং কীভাবে তার প্রকাশ ঘটে -সেটি বুঝাতেই যাদুকরদের সে কাহিনীকে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে তাঁর নিজের কালামের পাশে সংকলিত করে ক্বিয়ামত অবধি জিন্দা করে রেখেছেন। প্রশ্ন হলো, সারা জীবন নামায-রোযা পালন করার পরও যদি ঈমানের এরূপ প্রকাশ না ঘটে -তবে মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে সে নামায-রোযার মূল্য কতটুকু?
শত্রুর মুখে নির্মূলের হুংকার এবং ঈমানদারের জিহাদ
প্রশ্ন হলো, মুসলিম ভূমি ইসলামের শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃত দেখেও নীরব থাকাটি কি ঈমানদারী? ঈমানের প্রকাশ তো শত্রুশক্তির অধিকৃতি নির্মূলে জিহাদে নামায়। যারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও হিন্দু আধিপত্যবাদ -এ দুই শক্তির বিরুদ্ধে রক্তাত্ব লড়াই করে ১৯৪৭-য়ে বিজয় এনেছিল, তারা কি ভারত ও তার সেবাদাসদের অধিকৃতির মুখে নিষ্ক্রীয় থাকতে পারে? ভারতের ন্যায় আগ্রাসী হিন্দু সাম্প্রদায়ীক শক্তির ভয় এরূপ জিহাদী ঈমানদারদের নিয়ে। তাই ভারতসেবীদের মুখে তাদের বিরুদ্ধে নির্মূলের হুংকার। তাদের ভয়, পূর্ব সীমান্তে নতুন মুসলিম শক্তির উদ্ভবের। ভয় থেকে বাঁচতে মানুষ সাথি খোঁঝে। এবং অন্যদের নিয়ে কোয়ালিশন গড়ে। ভারতীয়দের পক্ষ থেকে কলাবোরেটর রূপে শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে বেছে নেয়ার হেতু তো সেটিই। তাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে লড়াই -তাতে ভারতও যে জড়িয়ে পড়বে -সেটিই তো স্বাভাবিক।
শত্রুদের কাজ শুধু দেশ-ধ্বংস, মানব-হত্যা ও নারী-ধর্ষণ নয়। তারা ধ্বংস করতে চায় দেশবাসীর চেতনা ও গৌরবের ইতিহাসকে। কারণ চেতনা ও ইতিহাস বিলুপ্ত হলে বিলুপ্ত হয় আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রতিষ্ঠার আগ্রহ। তখন মানুষ ভূলে যায় নিজ জীবনের মিশন ও ভিশন। শত্রুগণ জানে, ১৯৪৭’য়ের বিজয়ের পিছনে বাংলার ভূমি বা জলবায়ুর কোন ভূমিকা ছিল না; বরং সেটি ছিল বাঙালী মুসলিমদের ইসলামী চেতনা ও ঈমানী দায়িত্ববোধ। তাই শত্রুগণ সে চেতনার বিরুদ্ধে নাশকতায় নেমেছে। তবে সে নাশকতার কাজে বাঙালী মুসলিমদের শত্রু শুধু বিদেশে নয়, দেশের ভিতরেও। ভিতরের শত্রু হলো ঘাড়ে চেপে বসা ঘাতক স্বৈরশাসক ও তার সাঙ্গপাঙ্গগণ। ইসলামি চেতনা বিনাশে ময়দানে নামিয়েছে ইসলামচ্যুৎ সেক্যুলারিস্ট বাঙালী কাপালিকদের। উঁই পোকার ন্যায় তারা ভিতর থেকে বিনাশ করছে বাঙালী মুসলিমের ঈমান, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আত্মবিশ্বাস। মুসলিম দেশে স্বৈরশাসকের নাশকতাটি তাই ব্যাপক ও সর্বগ্রাসী। ফলে তাদের নাশকতাপূর্ণ সে রাজনীতির নির্মূলের চেয়ে মুসলিম সমাজে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা আর কি হতে পারে? বাঙালী মুসলিমদের স্বৈরাচার বিরোধী লড়াইটি তাই স্রেফ গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই নয়, ঈমান বাঁচানোরও। এটি নিছক রাজনৈতিক লড়াই নয়, বরং পরিপূর্ণ এক জিহাদ। আর এ জিহাদ বাঙালী মুসলিমদের সামনে পেশ করেছে অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্ত বিনিয়োগের এক পবিত্র অঙ্গণ। এ অঙ্গণে কার কি বিনিয়োগ -সেটিই নির্ধারন করবে অনন্ত অসীম পরকালে কে কোথায় স্থান পাবে সে বিষয়টি। ফলে কোন সুস্থ্য ব্যক্তির জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর কি হতে পারে? ১ম সংস্করণ ০৮/০৯/২০১৮; ২য় সংস্করণ ১৯/০২/২০২১। Tweet:@firozMkamal; facebook.com/firozkamal
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- ভারতীয় আগ্রাসনের হুমকি: বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুরক্ষা কীরূপে?
- ভারতীয় ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
- সম্প্রতি বাংলাদেশে যা দেখলাম
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018