বিবিধ ভাবনা (২৮)

ফিরোজ মাহবুব কামাল

১. ধর্মের নামে ব্যবসা ও দুর্বৃত্ত শক্তির বিজয়

বাংলাদেশে যারা নিজেদেরকে মুসলিম রূপে পরিচয় দেয় তাদের সংখ্যা ১৬ কোটির অধিক। দেশে ইসলামী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও অসংখ্য। তাবলিগ জামায়াতের ইজতেমায় ২০ লাখের বেশী জমায়েত হয়। অথচ দেশটিতে ইসলাম দারুন ভাবে পরাজিত। দেশের আদালতে শরিয়তী আইনের কোন স্থান নাই। শিক্ষাব্যবস্থায় কোর’আন শিক্ষার আয়োজন নাই। সংস্কৃতির উপর প্রভাব হিন্দু সংস্কৃতির এবং সে হিন্দু সংস্কৃতির অনুসরণে শুরু হয়েছে মুর্তি নির্মাণ ও মুর্তি পুজা। দেশে অর্থনীতি চলছে সূদের উপর। অথচ হাদীসে সূদ খাওয়া ও সূদ দেয়া মায়ের সাথে জ্বিনার সমান পাপ বলা হয়েছে। সেটিকে বলা হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধ রূপে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, বাংলাদেশে মুসলিমগণ নিজেদের পরিচয় দেয় মুসলিম রূপে, কিন্তু বাঁচছে ইসলাম ছাড়াই। এতে আখেরাতে পরিণাম যে কি হবে -সেটি কি বুঝতে বাঁকি থাকে?

ইসলামের এ নিদারুন পরাজয়ের মাঝেও বাংলাদেশে দারুন ব্যবসা বেড়েছে ধর্মের নামে। সেটি শত শত কোটি টাকার ব্যবসা। রম রমা হয়েছে দেশের মসজিদ বিল্ডিং, মাদ্রাসা ভবন, দলীয় দফতর, পীরের আস্তানা ও মাজার। বেতন বেড়েছে মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক এবং দলীয় “হোল টাইমার”দের। অথচ মুসলিমগণ যখন খেজুর পাতা ও কাদামাটির মসজিদে নামায পড়েছে তখন বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হয়েছে। হেতু কী? কারণ, ইসলামকে বিজয়ী করা এসব ধর্মব্যবসায়ীরা আদৌ আগ্রহী নয়। আগ্রহী নয় সূদকে নির্মূল করা, কোর’আন বুঝা ও বুঝানো ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠায়। বরং ভাবে, কি করে সংগঠনের উপার্জন, প্রতিষ্ঠা ও প্রচার বাড়ানো যায়। তেমন একটি লক্ষ্য নিয়ে ইসলামী দলের নেতাকর্মী, দলীয় ক্যাডার, পীরের মুরিদ ও মাজারের খাদেমগণ পরিণত হয়েছে সার্বক্ষণিক চাঁদাবাজে। ফলে তাদের আয় ভাবে বাড়লেও ইসলাম বিজয়ী হচ্ছে না।

যারা ব্যবসায়ে মনযোগী তারা ভালই বুঝে, ইসলামের বিজয়ে নামলে লড়াইয়ে নামতে হয়। তখন দেশে বিপ্লবের প্রসব বেদনা শুরু হয়, অস্থিরতা আসে। তখন জানমালের খরচ বাড়ে এবং কমে যায় অন্যদের থেকে প্রাপ্তির পরিমান। তাতে মন্দা আসে ব্যবসায়। ফলে কমে যায় নেতাকর্মী ও ক্যাডারদের মাসিক বেতন। সে মন্দার ভয়ে দেশে যতই দুর্বৃত্ত শাসন হোক – এ ধর্মব্যবসায়ী লড়াই নামে না। তারা চায় “স্টাটাস কো”। চায়, যা আছে তাই বেঁচে থাক। এটিই হলো ধর্মব্যবসায়ীদের নিরেট দুনিয়াদারী। এতে বিজয়ের পর বিজয় পায় এবং দীর্ঘায়ু পায় শয়তানপন্থীরা। বাংলাদেশ তো তারই দৃষ্টান্ত।

অথচ একটি দেশে সত্যিকার ইসলামী দল থাকলে সেদেশে দুর্বৃত্ত শক্তির শাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ অনিবার্য রূপে দেখা দেয়। কারণ ইসলামপন্থী ও শয়তানপন্থীদের মধ্য শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানটি অভাবনীয়। তখন সে দেশে জান্নাতের পথে যাত্রী শহীদদের সংখ্যা বাড়ে। আর শহীদের রক্তদানের ফলেই তো একটি জনগোষ্ঠীর ঈমান শূণ্যতা দূর হয়। তাই যেদেশে শহীদদের সংখা কম, সেদেশের মানুষের ঈমানশূণ্যতা অতি প্রকট। ঈমানের শ্রেষ্ঠতায় সাহাবাগণ সমগ্র মানব ইতিহাসে তূলনাহীন। কারণ, তাদের শতকরা ৬০ ভাগের বেশী রক্তদান করেছেন শহীদ হয়ে। মুসলিমগণ যেরূপ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল, তার মূলে ছিল শহীদদের সে রক্ত ও ঈমান। বাংলাদেশে মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে সাহাবাদের সে পথ থেকে দূরে থেকে এবং নীচে নেমে।   

২. ডাকাত সর্দার সেনাপ্রধান!

বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের লজ্জা পাওয়া উচিত এ নিয়ে যে, তারা স্যালুট করে সাজাপ্রাপ্ত খুনিদের ভাই ও তাদের দুর্বৃত্তির সহায়তা দানকারী আরেক দুর্বৃত্তকে। এবং আরো লজ্জা হওয়া উচিত এ জন্য, যাকে তারা স্যালুট করে সে জড়িত ছিল ২০১৮ সালের নৈশকালীন ভোটডাকাতির সাথে। অর্থাৎ সেনাপ্রধান শুধু ভোটডাকাতই নয়, সে ডাকাতদলটির সর্দারও। এমন ডাকাতকে স্যালুট করা তো ডাকাত দলের কালচার, তা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে প্রতিষ্ঠা পায় কি করে?

৩. বইয়ের গুরুত্ব

অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধ হয় না। তেমনি বই ছাড়া কোন বিপ্লব হয় না। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপ্লবটি হলো নবীজী(সা:)র’ নেতৃত্বের ইসলামী বিপ্লব। সে বিপ্লবের মূলে ছিল মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব আল কোর’আন। এ পবিত্র কিতাব ছাড়া সে বিপ্লব অসম্ভব ছিল। ইউরোপের ইতিহাস সবচেয়ে বড় বিপ্লব ছিল ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব। সে বিপ্লবের মূলে ছিল রুশো, ভল্টিয়ার ও অন্যান্য মনিষীদের রচিত বই।

বই আনে জনগণের চেতনার মডেলে পরিবর্তন। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় সেটিকে বলা হয় প্যারাডাইম শিফ্ট। যা বিপ্লব আনে রাজনৈতিক অঙ্গণে। বাংলাদেশেও বিপ্লব আনতে হলে চাই বই। ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া যায় না, তাই জ্ঞানের রাজ্যে বিপ্লব ছাড়া রাজনৈতিক ও সমাজ বিপ্লব আনা যায় না। তাই অপরিহার্য হলো, চিন্তার মডেলে তথা জ্ঞানের ভূবনে বিপ্লব। এবং সে কাজে পবিত্র কোর’আনের চেয়ে শ্রষ্ঠ গ্রন্থ্য আর কি হতে পারে?

৪. শয়তানী শক্তির স্ট্রাটেজী

শয়তানী শক্তির সনাতন স্ট্রাটেজী শুধু ইসলামী ব্যক্তিদের নির্মূল নয়, বরং অকার্যকর করা ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। শয়তানী শক্তির হাতে অধিকৃত হওয়ার এখানেই বিপদ। বাংলাদেশ তারই উদাহরণ। শেখ হাসিনার ন্যায় স্বৈরাচারী ভোটডাকাতের হাতে রাষ্ট্র অধিকৃত হলে সেটি আর মুসলিম রাষ্ট্র থাকে না। সেটি পরিনত হয় শয়তানের দুর্গে। শয়তানের সে দুর্গের পেটের মধ্যে লাখ লাখ মসজিদ গড়েও ইসলামের বিজয় আসে না। তখন ইসলামের প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার থাকলে দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। জিহাদ বিষয়ক বই রাখলে জেলে যেতে হয়।

মাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচে না, তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও ইসলামী সংগঠন বাঁচে না। তাই সবচেয়ে বড় নেককর্মটি মসজিদ-মাদ্রাসা ও ইয়াতিম খানা নির্মাণ নয়, বরং সেটি হলো ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ।

ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত হলে সেটি তখন কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিনত হয়। তখন জনগণকে এতিমখানা ও মাদ্রাসা নির্মাণ করা লাগে না। সে কাজ রাষ্ট্রই করে। নবীজী (সা:) এজন্যই মদিনায় হিজরাতের পর নিজের ঘর না গড়ে ইসলামী রাষ্ট্র গড়েছেন। এবং তিনি স্বয়ং সে রাষ্ট্রের শাসকের পদে বসেছেন। কিন্তু নবীজী (সা:)’র সে শিক্ষা কতটুকু বেঁচে আছে বাংলাদেশে?  

৫. উপেক্ষিত শ্রষ্ঠ সূন্নত

নবীজী (সা:)র যে মহান সূন্নতটি পালনে মানব জাতির সবচেয়ে বড় কল্যাণটি হয় -সেটি টুপি, দাড়ি ও মেছওয়াক করার সূন্নত নয়। সেটি তাঁর রাজনীতির সূন্নত। নিজে শাসকের আসনে বসে তিনি সে সূন্নত দেখিয়ে গেছেন। পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের হুজুরগণ নবীজী (সা:)’র বহু সূন্নতের বয়ান করলেও তিনি যে দেশের শাসক ছিলেন এবং রাজনীতি  করেছেন -সে সূন্নতের কথা তারা বলেন না। সে সূন্নত পালনও করেন না। বরং সে সূন্নত থেকে দূরে থাকাটি দ্বীনদারী মনে করেন। এবং রাজনীতিতে অংশ নেয়াকে দুনিয়াদারী বলেন। অবশ্য এর কারণ রয়েছে। এ সূন্নতটি যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি বিপদ ডেকে আনে আরাম-আয়াশে। এটি হলো জিহাদ। এ সূন্নত পালনে অর্থদান, শ্রমদান ও রক্তদান লাগে। সে সামর্থ্য ক’জন আলেমের? ফলে তারা বেছে নিয়েছেন টুপি, দাড়ি, পাগড়ি, মেছওয়াক ও মিষ্টি খাওয়ার সহজ সূন্নত।

৬. সন্মানিত হলো ডাকাত

কোন সভ্য দেশে চোরডাকাতদের রাস্তার ঝাড়ুদার বানানোরও রীতি নাই। কারণ, সেখানেও তারা কাজে চুরি করে বা নানারূপ কু্-কর্ম করে। একমাত্র কারাগারে রাখাতেই দেশবাসীর জন্য কল্যাণ। এরূপ অপরাধ থেকে জনগণকে বাঁচাতে ইসলাম তাই চোরদের হাত কাটার নির্দেশ দেয়। জীবাণু না মারলে যেমন দেহ বাঁচে না, তেমনি চোর-ডাকাত নির্মূল না করলে দেশ বাঁচে না। অথচ বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ন্যায় যে ডাকাতটি ভোটডাকাতির ন্যায় জঘন্য অপরাধটি করলো -সে এখন প্রধানমন্ত্রীর আসনে। আরেক অপরাধী জেনারেল আজীজ –যে ২০১৮ সালের ভোটের উপর নৈশ ডাকাতির নেতৃত্ব দিল, সে এখন সেনাবাহিনীর প্রধান। কোন সভ্য দেশে কি এমনটি আশা করা যায়?

৭. ভারতের এজেন্ডা

ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকদের মূল এজেন্ডা হলো উপমহাদেশের মুসলিম শক্তির বিনাশ। চায়, হিন্দুদের অখণ্ড রাষ্ট্র ভারত। এ লক্ষেই তারা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিল। পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠা পায় তখনও দেশটিকে মেনে নেয়নি। এবং ১৯৭১ সালে দেশটিকে ভাঁঙ্গতে সফল হয়। তবে মুসলিম শক্তির বিনাশের কাজটি একাত্তরের পর শেষ হয়নি; এখন দেশটি বাংলাদেশীদেরও কোমর ভাংঙ্গতে চায়। একাজে ভারতকে সাহা্য্য করছে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ।

শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশকে শক্তি ও সামর্থ্য জোগায় সে দেশের জনগণের সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বল। তাই কোন দেশকে শক্তিহীন করার সবচেয়ে সফল স্ট্রাটেজী হলো, জনগণকে সে সামর্থ্য নিয়ে বেড়ে উঠতে না দেয়া। এবং সে কাজে মোক্ষম উপায় হলো জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার কেড়ে নেয়া। জনগণ তখন প্রতিরোধহীন হয় এবং শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণের পথ বেছে নেয়। স্বৈরশাসনের এটিই তো সবচেয়ে বড় নাশকতা। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা তো শত্রুর সে কাজটিই করছে। ভারতের কাছে এজন্যই হাসিনা এত প্রিয়।  

৮. বিচারে ব্যর্থতার পরিণাম

বিচারে ব্যর্থতার পরিণামটি ভয়ানক। রোগের চিকিৎসা না হলে -যা হয়। তাই যে কোন সভ্য দেশ সামান্য কিছু চুরি হলেও তার বিচার হয়। কারণ, চোরকে প্রশ্রয় দিলে চোরগণ দলে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তখন চোরদের হাতে সমগ্র দেশ ডাকাতি হয়ে যায়। শেখ হাসিনার ন্যায় ভোটডাকাতের হাতে বাংলাদেশের ভাগ্যে তো সেটিই ঘটেছে।

বাংলাদেশের বড় ব্যর্থতা হলো, ২০১৮ সালে এতো বড় একটা ভোটডাকাতী হয়ে গেল –সে জন্য কারো কোন শাস্তি হলো না। বিস্ময়ের বিষয় হলো, বাংলাদেশে রাজনীতিতে এটি যেন কোন এজেন্ডাই নয়। জনগণও তা নিয়ে ভাবে না। বুদ্ধিজীবীগণও তা নিয়ে লেখে না। মৃত্যুশয্যায় শায়ীত মুমূর্ষু ব্যক্তি যেমন নিজের চিকিৎসা আর ভাবে না, তেমনি এক করুণ অবস্থা এখন বাংলাদেশের। নৈতিক পচন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ডাকাত সর্দারনীকে শাসকের আসনে বসিয়ে তাকে মাননীয় নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বলা হয়। সেটি শুধু চোর-ডাকাতগণই বলে না, নিজেদেরকে যারা সুশীল বলে দাবী করে তারাও বলে। কোন সভ্য সমাজে কি এমনটি ভাবা যায়? বাংলাদেশ আর কত নীচে নামবে? ১৯/০২/২০২১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *