বঙ্গীয় বদ্বীপে শয়তানী শক্তির নাশকতা এবং বাঙালি মুসলিমের বিপদ
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on May 14, 2025
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
ঈমানদারের তাড়না এবং বেঈমানের তাড়না
ব্যক্তির রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ নির্ভর করে তার বাঁচার লক্ষ্য ও তাড়নার উপর। যারা সত্যিকার ঈমানদার, তাদের বাঁচার লক্ষ্য ও যুদ্ধটি হয়, মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা ও তাঁকে খুশি করা; এবং সে এজেন্ডার বিজয়ে নিজের সর্ব সামর্থ্যের বিনিয়োগের করা। এবং সে বিনিয়োগের লক্ষ্য, মাগফিরাত লাভ ও জান্নাত লাভের জন্য নিজেকে যোগ্যতর করা। বস্তুত এমন একটি মিশন নিয়ে বাঁচাই হলো মুসলিম জীবনের মূল এজেন্ডা। এবং সে এজেন্ডা পূরণে মুসলিমের জীবনের প্রবল তাড়নাটি একতা গড়া। কারণ, একাকী রাষ্ট্র নির্মাণ দূরে থাক এক খানি গৃহ নির্মাণও সম্ভব নয়। এ জন্যই মহান আল্লাহ তায়ালা চান, নানা বর্ণ, নানা ভাষা ও নানা এলাকার মুসলিমগণ একতাবদ্ধ হোক। আর আল্লাহ তায়ালার সে ইচ্ছার সাথে একাত্ম হওয়ার মাঝেই তো ঈমানদারি। আল্লাহ তায়ালা চান, মুসলিমগণ কাজ করবে এ পৃথিবী পৃষ্ঠে মহান আল্লাহ তায়ালার খলিফা রূপে। তিনি চান, তাঁর খলিফাগণ ঐক্যবদ্ধ ভাবে জিহাদ করবে তাঁর এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে। সে এজেন্ডাটি হলো, তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা। এবং এজেন্ডা হলো, মিথ্যা, দুর্বৃত্তি ও অবিচারের নির্মূল এবং সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা।
কে কতটা ঈমানদার বা বেঈমান -সেটি নির্ভর করে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে কতটা একাত্ব হলো ও তা নিয়ে জিহাদ করলো তার উপর। ঈমান যাচায়ের মূল মাপকাঠি হলো এই জিহাদ। যারা বাঁচে সে এজেন্ডার সাথে গাদ্দারী নিয়ে, তাদের নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত তাদেরকে কাফির, জালিম বা ফাসিক হওয়া থেকে বাঁচাতে পারেনা। সে ঘোষণাটি দেয়া হয়েছে পবিত্র কুর’আনের সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “কুর’আনে নাযিলকৃত আইন অনুযায়ী যারা বিচার পরিচালনা করে না, তারা কাফির, তারা জালিম ও তারা ফাসিক।” শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা যেহেতু মহান রব’য়ের এজেন্ডা, তাই সে এজেন্ডার সাথে গাদ্দারী নিয়ে কেউ কখনো মুসলিম হতে পারে না। এ এজন্যই ঈমানদার হওয়ার শর্ত শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন নয়, বরং হলো মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডা জানা এবং তার সাথে পূর্ণ ভাবে একাত্ম হওয়া।
মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্মতার তাড়নাই মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ রাখে। এবং সে তাড়নাটি বিলুপ্ত হলে, বিলুপ্ত হয় একতা। মুসলিম উম্মাহ তখন ভেঙ্গে যায়। মুসলিমগণ তখন বিভক্ত হয় নানা রূপ ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল ভিত্তিক পরিচয় নিয়ে। মুসলিমদের আজকের শক্তিহীনতা ও জিল্লতির মূল কারণ তো এই বিভক্তি। অথচ মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্মতার তাড়নাটি প্রবল হওয়াতে শতাধিক নবী-রাসূল একই সময়ে একই দেশে প্রেরিত হলেও তাদের মাঝে কোন বিভেদ বা দলাদলি সৃষ্টি হতো না; বরং দেখা যেত সীসাঢালা দেয়ালসম ঐক্য। তারা একতাবদ্ধ ভাবে নামতো জিহাদের ময়দানে। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবায়ে কিরামের জীবনে তো সেরূপ ঐক্যই দেখা গেছে।
আযাব কেন অনিবার্য হয়?
প্রতিটি মুসলিমের উপর তাই ফরজ হলো, সে বাঁচবে একতার তাড়না নিয়ে। এবং বাঁচবে এমন সব কিছু থেকে যা উম্মাহর দেহে বিভক্তি থেকে। একতা আনে সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিজয় ও রহমত; এবং বিভক্তি আনে আযাব ও বিপর্যয়। মুসলিম উম্মাহর আজকের শক্তিহীনতা, পরাজয় ও পরাধীনতার মূল কারণ তো উম্মাহর ৫০’য়ের বেশী টুকরায় বিভক্তি। একতা না থাকায় উম্মাহর বিশাল জনশক্তি ও অঢেল সম্পদও তাদেরকে পরাজয়ের গ্লানি থেকে বাঁচাতে পারছে না। সেরূপ একটি বিপর্যয় থেকে বাঁচতে মুসলিমদের উপর ফরজ শুধু মূর্তিপূজা, মদ্যপান ও ব্যাভিচার থেকে বাঁচা নয়, বরং বিভক্তি থেকে বাঁচাও। বিভক্তি থেকে বাঁচার সে নির্দেশটি এসেছে পবিত্র কুর’আন। এবং যারা বাঁচে বিভক্তি নিয়ে তাদের উপর অনিবার্য হয় ভয়ানক আযাব। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালার বয়ান হলো:
وَلَا تَكُونُوا۟ كَٱلَّذِينَ تَفَرَّقُوا۟ وَٱخْتَلَفُوا۟ مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلْبَيِّنَـٰتُ ۚ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌۭ
অর্থ: “এবং কখনোই তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বয়ান আসার পরও বিভক্ত হলো এবং মতভেদ গড়লো; এরাই হলো তারা, যাদের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৫)।
উপরিউক্ত আয়াতটি থেকে বুঝা যায়, মুসলিমগণ বিভক্ত হলো অথচ আযাব আসলো না -সেটি হয়না। বিভক্তি ও আযাব একত্রে চলে। এজন্যই মহান আল্লাহ তায়ালার আযাব পাওয়ার জন্য মূর্তিপূজারী, ব্যভিচারী ও মদ্যপায়ী হওয়া জরুরি নয়, বরং বিভেদ ও বিভক্তি নিয়ে বাঁচাই সে জন্য যথেষ্ট। মুসলিম উম্মাহ বিভক্ত হয়ে নিজেরাই উপরিউক্ত আয়াতটির সত্যতা প্রমাণিত করেছে। বিভক্ত উম্মাহর উপর আযাব রূপে হাজির হয়েছে ইসরাইল। আযাব রূপে হাজির হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ, ফরাসী, রুশ, চীন, ভারত ও মার্কিনী যুক্তরাষ্ট্র। তাই অধিকৃত হয়েছে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, জিংজিয়াং, আরাকান, চেচনিয়াসহ বহু মুসলিম ভূমি। বোমা হামলা, গণহত্যা ও ধ্বংস যজ্ঞের শিকার হয়েছে গাজা, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়ার ন্যায় মুসলিম ভূমি। বিভক্তি ও আযাবের পথ বেছে নিয়েছিল বাঙালি মুসলিমের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিব ও তার অনুসারীরা। ফলে বাঙালি মুসলিমের উপর আযাব রূপে এসেছে ভারতীয় অধিকৃতি, লুণ্ঠন, দুর্ভিক্ষ, বাকশালী ফ্যাসিবাদ, গণহত্যা, দুর্বৃত্তির প্লাবন, ফাঁসি ও আয়নাঘর। অপর দিকে মুমিনের জিহাদ হলো তাঁর সর্বোচ্চ ইবাদত। কারণ নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত যতই পালন করা হোক তা দিয়ে মহান আল্লাহর এজেন্ডা বিজয়ী হয়না। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠা পায় না ইসলামী রাষ্ট্র, আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব, শরিয়তী বিধান এবং সুবিচার। এবং জিহাদ শূণ্যতায় নির্মূল হয়না দুর্বৃত্তি, অবিচার ও স্বৈরাচারি জুলুম। জিহাদ সেজন্য অপরিহার্য। জিহাদই হলো বস্তুত মহান স্রষ্টার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার হাতিয়ার।
বাঙালি মুসলিম কেন শয়তানের টার্গেট?
ইতিহাসের শিক্ষা হলো, শয়তান কখনোই কাফিরদের বিপদগামী করে না। তারা তো পূর্ব থেকেই শয়তানের সৈনিক। শয়তান টার্গেট করে প্রতিটি ঈমানদারকে। নবীজী (সা:)’র হাদীস: “ঈমানদার মানবশূণ্য প্রান্তরে যখন একাকী চলে, তখনও তার পিছনে শয়তান লেগে যায়।” কারণ তাকে জাহান্নামে নেয়াই হলো শয়তানের মিশন। ফলে শয়তানের প্রচেষ্টা অবিরাম। এবং এভাবেই ঈমানের পরীক্ষা হয় প্রতিটি ঈমানদারের। ঈমানদার হওয়ার চ্যালেঞ্জটি মূলত এখানেই। তাকে পদে পদে পরীক্ষা দিতে হয়। নেতৃত্বের ভূমিকায় আসীন হলে সে বিপদটি শতগুণ বেড়ে যায়। একারণেই বাঙালি মুসলিমগণ পরিণত হয় শয়তানের মূল টার্গেটে। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর। তাদের অপরাধ, তারাই ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের অখণ্ড ভারত নির্মাণের স্বপ্নকে চুরমার করে দেয়। বাঙালি মুসলিমগণ তাদের পাকা ধানে মই দিয়ে দেয়।
শয়তানী শক্তির খাতায় বাঙালি মুসলিমদের অপরাধটি হলো, তারাই ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অবধি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাই ছিল মুসলিম লীগের মূল দুর্গ। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত এই ১১ বছরে তিনজন ব্যক্তি বাংলার প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হয়েছেন। তাদের সবাই ছিলেন মুসলিম লীগের। পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগ এমন বিজয় পায়নি। বাঙালি মুসলিমদের কারণেই সৃষ্টি হয় পৃথিবী পৃষ্ঠে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। মুসলিম উম্মাহ পায় সর্ববৃহৎ একটি মুসলিম রাষ্ট্র। শয়তানী শক্তিবর্গের কাছে এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কি হতে পারে। ফলে বাঙালি মুসলিমগণ পরিণত হয় শয়তানের মূল টার্গেটে। তাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ; এবং প্রেক্ষাপট প্রস্তুত করা হয় একটি প্রকাণ্ড সামরিক যুদ্ধের। তখন ভারত থেকে আসতে থাকে হিন্দুদের রচিত হিন্দুয়ানী সাহিত্য। প্লাবন শুরু হয় রবিন্দ্র সঙ্গীতের। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিমদের বদলে পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের চিত্রিত করা হয় বাঙালি মুসলিমের আপন জন রূপে।
সে সময় সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন থেকে আসা শুরু করে কম্যুনিস্টদের বই ও পত্র-পত্রিকা। শুরু হয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কম্যুনিজমের স্রোতে ভাসানোর কাজ। একাজে শয়তানের সাফল্যটি বিশাল। হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী দীক্ষা নেয় কম্যুনিজমে এবং পরিণত হয় পাকিস্তানের ঘরে শত্রুতে। ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত ঘেঁষে বসায় অনেকগুলি বেতার ট্রান্সমিটার। সেগুলির কাজ হয় পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমদের চেতনার ভূমিতে ইসলামী-চেতনা-নাশক বিষ প্রয়োগের কাজ। ভারতীয় অর্থায়নে গড়া হয় উদিচি ও ছায়ানটের ন্যায় সাংস্কৃতিক সংগঠন। লক্ষ্য একটাই মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের ইসলাম থেকে দূরে সরানো। শয়তানের এ খলিফাগণ জানতো ইসলাম থেকে দূরে সরলে প্যান-ইসলামী চেতনার উপর নির্মিত পাকিস্তান টিকবে না। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ শুরু হয় সে প্যান-ইসলামী চেতনার বিনাশে। জোয়ার আনা হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের। ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা RAW বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে বাঙালি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কি নতে -বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের নেতাদের। তাদের সে বাণিজ্য প্রচুর মুনাফা দেয়। নগন্য সংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া দল দুটির নেতাকর্মীর ভারতে সেবক এবং পাকিস্তানের শত্রুতে পরিণত হয়। এরাই একাত্তরের ভারতের কোলো গিয়ে উঠে। এবং এরাই ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধে যোগ দেয়। এবং ভারতীয় কাফিরদের বিজয়ী করে। শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকলে কেউ কি এমন হারাম কাজে অংশ নিত? বিপুল সংখ্যক বাঙালি মুসলিমের ঈমান ধ্বংসে শয়তানের প্রকল্প যে কতটা সফল হয় -এ হলো তার প্রমাণ।
সে সাথে সাংস্কৃতিক হামলা আসতে থাকে পাশ্চাত্যের দেশগুলি থেকেও। হলিউড থেকে আসতে শুরু করে পাশ্চাত্য জগতের যৌন উত্তেজক সিনেমা। এভাবেই শয়তানী শক্তিসমূহের যৌথ প্রজেক্ট চলতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমদের ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজে। পরিতাপের বিষয় হলো, শয়তানী শক্তির সে সম্মিলিত বুদ্ধিবৃত্তিক হামলার মুখে বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা কোন সফল প্রতিরোধ গড়তে থাকেনি। আজকের মত সেদিনও তারা ছিল অনৈক্যের শিকার; লিপ্ত ছিল পারস্পরিক কলহ-বিবাদে। ফলে যে প্যান-ইসলামী চেতনায় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলে সে চেতনা সেক্যুলারিজম ও বাঙালি ফ্যাসিবাদের জোয়ারে ভেসে যায়। বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের সে বিজয় তাদেরকে বিপুল সংখ্যক সৈনিক জুগায় ১৯৭১’য়ের পাকিস্তান ভাঙ্গার ভারতীয় যুদ্ধে।
সুস্পষ্ট দেখা যায় ঈমানদারী ও বেঈমানী
ব্যক্তির ঈমানদারী ও বেঈমানী কখনোই গোপন থাকার বিষয় নয়; সে দু’টি বৈশিষ্ট্য খালি চোখেই সুস্পষ্ট দেখা যায়। তবে তা নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে নয়। এরূপ আনুষ্টিকতা তো বহু ঘুষখোর, সূদখোর, মিথ্যাবাদী প্রতারকও পালন করে। সেগুলি পালন করে এমন কি জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী, ফ্যাসিবাদী ও বামধারার রাজনীতির পথভ্রষ্ট নেতাকর্মীরাও যারা আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের শত্রু। শয়তানের এসব খলিফারা তো তাহাজ্জুদ পড়া নিয়েও বড়াই করে। ঈমানদারী দেখা যায় মুসলিম উম্মাহর একতা প্রতিষ্ঠার তাড়নায়; আর বেঈমানী দেখা যায় বিভক্তির ষড়যন্ত্রে সক্রিয় দেখে। কারণ, যে উম্মাহর একতা নিয়ে ভাবে, বুঝতে হবে মুসলিম উম্মাহর বিজয় ও ইসলামের প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভাবে। আর যে বিভক্তি গড়ে, বুঝতে হবে সে ভাবে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে নাশকতা নিয়ে। তাই একাত্তরে যারা পাকিস্তান ভাঙ্গলো এবং বিজয়ী করলো পৌত্তলিক ভারতীয় কাফিরদের তাদের কি কখনো ঈমানদার বলা যায়? তাদের নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও দাড়ি-টুপি কি তাদের বেঈমানী ঢাকতে পারে?
ঈমান ও একতার তাড়না একত্রে বাড়ে। ঈমান বাড়লে একতার তাড়নাও বাড়ে। অপর দিকে কুফুরি তথা বেঈমানী বাড়লে বাড়ে বিভক্তির তাড়না। একটি সমাজে সেটি দেখা যায় অনৈক্য দেখে। অন্য ভাষা, অন্য বর্ণ, অন্য দেশ ও অন্য প্রদেশের মুসলিমদের ঐক্য প্রতিষ্ঠা জন্য যে নূ্ন্যতম ঈমানটুকু থাকা দরকার -তা বেঈমানদের থাকে না। বরং প্রবল আগ্রহ থাকে বিভক্তি গড়ায়। ১৯৭১’য়ে সে বেঈমানী প্রবল ভাবে প্রকাশ পায় মুজিবের অনুসারি বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার অনুসারীদের জীবনে। তারা শুধু পাকিস্তানই ভাঙ্গেনি, বরং লক্ষাধিক অবাঙালিকে হত্যা করেছে, মহিলাদের ধর্ষণ করেছে এবং তাদের ঘর-বাড়ী ও ব্যাবসা-বাণিজ্য দখলে নিয়েছে। একাত্তরে সবচেয়ে বড় গণহত্যা ও গণধর্ষণ তো হয়েছে অবাঙালির বিরুদ্ধে। শরিষার দানা পরিমান ঈমান থাকলেও কি তারা এতবড় অপরাধে লিপ্ত হতো?
স্বার্থপরতাই বিভক্তির জন্ম দেয়
ঈমানদারের রাজনীতি হলো মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ। তাই এটি সর্বোচ্চ ইবাদত। নবীজী (সা:) এবং সাহাবাদের জীবনে সে রাজনীতি দেখা গেছে। সে রাজনীতির বরকতে মুসলিম উম্মাহ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু রাজনীতির নিয়ন্ত্রক যখন ব্যক্তি স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ, গোত্রীয় স্বার্থ বা জাতীয় স্বার্থ, তখন সেটি আর ইবাদত থাকে না, পরিণত হয় অপরাধের হাতিয়ারে। এবং পরিণত হয় মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করার হাতিয়ারে। স্বার্থ হাছিলের সে রাজনীতিতে বেঈমানেরা এমন কি রক্তাক্ত যুদ্ধের পথও বেছে নেয়। ১৯৭১’য়ে সে স্বার্থান্বেষী রাজনীতিই দেখা গেছে মুজিব ও তার অনুসারী বাঙালি ফ্যাসিস্টদের জীবনে।
নামে মুসলিম হলেও মুসলিম উম্মাহর বিজয় বা কল্যাণ নিয়ে শেখ মুজিবের কোন ভাবনা ছিল না। ভাবনা ছিল না বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা নিয়েও। তার অনুসারীরা সে লক্ষ্যে একাত্তরে যুদ্ধ করেনি। বরং ক্ষমতা হাতে পেতে তারা ভারতকে বিজয়ী করেছে। বাঙালির স্বাধীনতার ভাবনা থাকলে মুজিব কেন ক্ষমতা হাতে পেয়ে গণতন্ত্রকে কবরে পাঠাবে? কেন একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা দিবে? কেন কেড়ে নিবে জনগণের রাজনৈতিক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা? মুজিবের লড়াই ছিল স্রেফ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পাওয়ার লড়াই -প্রয়োজনে পাকিস্তানকে খণ্ডিত করে হলেও। বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের মাঝে অনৈক্যের মূল কারণ হলো এই স্বার্থপরতার রাজনীতি। ক্ষমতায় ভাগ বসানোর লক্ষ্যে এমন কি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের ন্যায় ইসলামের শত্রুদের সাথেও তারা কোয়ালিশন গড়েছে। অথচ মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে সবাই কাজ করলে তখন সকল ইসলামপন্থীদের মাঝে অবশ্যই একতা দেখা যেত। তারা পরিহার করতো অনৈক্যের পথ। কারণ, অনৈক্যের পথ যে ভয়ানক আযাব প্রাপ্তির পথ -সে ভয় তাদের মগজে সর্বক্ষণ কাজ করতো।
শয়তানের খলিফা রূপে মুজিব
এজেন্ডা থাকলে সে এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জন্য অবশ্যই খলিফা চাই। মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জন্য খলিফা হলো প্রতিটি ঈমানদার। আর শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করা জন্য খলিফা হলো প্রতিটি বেঈমান। শয়তানের খলিফাদের কাজ যেমন মুসলিম উম্মাহকে খন্ডিত রাখা, তেমনি মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনকে মুসলিম ভূমিতে বিলুপ্ত রাখা। শয়তানের সে এজেন্ডা নিয়েই পাকিস্তানের রাজনীতিতে আবির্ভুত হয় জাতয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার রাজনৈতিক বহুদল। মুজিব আবির্ভুত হয় বাঙালি ফাসিস্টদের নেতারূপে। মুজিব ও তার অনুসারীদের সখ্যতা গড়ে শয়তানের পৌত্তলিক খলিফা ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক চক্রের সাথে। তখন তাদের মধ্য কোয়ালিশন গড়ে উঠে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের বিনাশে।
উসমানিয়া খেলাফত বিলুপ্ত করার পর শয়তানী শক্তির প্রধান টার্গেট হয় অখণ্ড পাকিস্তানের বিলুপ্তি। পাকিস্তানের অপরাধ, দেশটি মুসলিম উম্মাহর বুকে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিল। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ দেশটিকে অভিভাবক রূপে দেখতো। দেশটিকে খণ্ডিত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসলামী চেতনাশূণ্য বাঙালি সেক্যুলারিস্ট মুসলিমদের পিছনে কলকাঠি নাড়ানো শুরু করে ভারত সরকার। ভারত পাকিস্তানের জন্ম যেমন চায়নি, দেশটি বেঁচে থাকুক সেটিও চায়নি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ তাই ১৯৪৭ সাল থেকেই। পাকিস্তান প্রসঙ্গে একই দর্শন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদীদেরও।
ষাটের দশক থেকেই বাংলাদেশের সেক্যুলার রাজনীতিতে শয়তানের প্রধান খলিফা রূপে আবির্ভুত হয় শেখ মুজিব; এবং শয়তানের প্রধান দল রূপ হাজির হয় আওয়ামী লীগ। বাঙালি পৌত্তালিকরা দলে দলে তখন তাদের ভরসার স্থল এদলটিতে যোগ দেয়। শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করায় এবং ইসলামের ক্ষতিসাধনে শেখ মুজিব ও তার দলের সাফল্যটি বিশাল। বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে মীর জাফেরর পর আর কোন ব্যক্তিই মুসলিম উম্মাহর এতো বড় ক্ষতি করতে যা করেছে শেখ মুজিব। শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করার ক্ষেত্রে মুজিবের বড় বড় দুটি অবদান হলো: এক). বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রকে খণ্ডিত করে মুসলিম উম্মাহর কোমর ভেঙ্গে দিতে পেরেছে। দুই). ভারতের ন্যায় শয়তানের সর্ববৃহৎ পৌত্তলিক খেলাফতকে একাত্তরের যুদ্ধে বিজয়ী করে দক্ষিণ এশিয়ার বুকে প্রধান শক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে এবং পরিণত করেছে বিশ্বের অন্যতম শক্তিতে। ভারতীয় হিন্দুত্বাবাদীদের কাছে মুজিব ও তার পরিবার এজন্যই এতো আদরণীয়। তাই পলাতক হাসিনাকে বিশ্বের কেউ আশ্রয় না দিলেও আশ্রয় দিয়েছে ভারত।
বিভাজনটি হিজবুল্লাহ ও হিজবুশ শায়তানের
বুঝতে হবে, মহান আল্লাহ তায়ালার বিচারে মানব জাতির বিভাজন মাত্র দু’টি দলে। একটি হলো আল্লাহর দল (হিজবুল্লাহ); এবং অপরটি হলো শয়তানের দল (হিজবুশ শায়তান)। মহান রব’য়ের বিচারে তৃতীয় কোন দল নাই। প্রতিটি মানব সন্তান এ দুটি দলের কোন একটির সদস্য। সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এরূপ দুই দলে বিভাজনের কথাটি এসেছে পবিত্র কুর’আনে। অতএব হিসাবটি অতি সহজ; যারাই আল্লাহর দলে নেই, তারাই হলো শয়তানের দলের। আল্লাহর দলের পরিচয়টিও অতি সহজ। সে পরিচয়টি নিহিত রয়েছে সে দলের সদস্যদের দর্শন, আক্বিদা-বিশ্বাস, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও লড়াইয়ের মধ্য। তাদের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির লড়াইটি হলো মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা। কুর’আনে ঘোষিত সে এজেন্ডার মূল বিষয় হলো: তাঁর সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠ। এবং সে সাথে তাদের রাজনীতিতে গুরুত্ব পায় মিথ্যাচার ও দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠার জিহাদ।
যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উপরিউক্ত এজেন্ডার কোন স্থান নাই এবং দলটি নিজেও কখনো ইসলামপন্থী দল রূপে দাবী করে না, অতএব দলটি নিশ্চয়ই শয়তানের। শয়তানের এ বিশাল দলটি জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী, ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারি, সমাজবাদী, সেক্যুলারিস্ট এরূপ নানা উপদলে বিভক্ত থাকতে পারে। তবে সব উপদলের অবস্থান একই ছাতার নীচে। এবং সে বড় ছাতাটি হলো শয়তানের। আওয়ামী লীগ তার নিজের সে পরিচয়টি অবিরাম প্রকাশ করেছে শয়তানের পৌত্তলিক ভারতীয় খলিফাদের সাথে অটুট সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে। সেটি তারা আরো প্রকট ভাবে প্রমাণ করেছে একাত্তরে ভারতে গিয়ে ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে ভারতকে বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে।
মুজিবের নাশকতার রাজনীতি
মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি ফ্যাসিস্টদের নাশকতার রাজনীতির শুরু মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য যে, খেলাফতের বিলুপ্তির পর একমাত্র পাকিস্তানই ছিল বহু ভাষা, বহু বর্ণ, বহু ফিরকা ও বহু অঞ্চল ভিত্তিক রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের মধ্যে ছিল বাঙালি, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পশতু ও বেলুচ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠি। এসব ভাষার জনগণের সামর্থ্য ছিল নিজ নিজ ভাষা ও গোত্র ভিত্তিক নেশন স্টেট বা গোত্রীয় রাষ্ট্র গড়ার -যেমনটি গড়েছে বিশ্বের অন্য ভাষী মুসলিমেরা। কিন্তু একমাত্র পাকিস্তানের মুসলিমরাই নির্মাণ করেছিল ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও প্রাদেশিক পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে একটি প্যান-ইসালামী রাষ্ট্র। এমন রাষ্ট্রকেই বলা হয় মুসলিম সিভিলাইজেশনাল স্টেট। ফলে এ রাষ্ট্র নিয়ে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ স্বপ্ন দেখতো। মুসলিম ইতিহাসে সর্ব প্রথম এমন রাষ্ট্রই গড়েছিলেন নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ। পরবর্তীতে সে রাষ্ট্রের উপর নির্মিত হয় মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। এবং মুসলিমগণ বেড়ে উঠে বিশ্বশক্তি রূপে। পাকিস্তানের নির্মাতাদের সেরূপ একটি ভিশন ও মিশন ছিল। পাকিস্তানের সামনে সেরূপ সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু শয়তান ও তার খলিফাদের সেটি ভাল লাগেনি। ফলে তারা পাকিস্তানের বিনাশে লেগে যায়। মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগের কর্মীবাহিনী পরিণত হয় সে শয়তানী প্রকল্পের মাঠ সৈনিকে। তাদের যুদ্ধ শুরু পাকিস্তান, ইসলাম ও ইসলামপন্থী সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে।
মহান আল্লাহ তায়ালা খুশি হন নানা ভাষী নানা অঞ্চলের মুসলিমদের ঐক্য দেখে, আর শয়তান খুশি হয় অনৈক্য দেখে। বাঙালি মুসলিমগণ ১৯৪৭ সালে মহান আল্লাহ তায়ালাকে প্রচণ্ড খুশি করেছিল বিহারী, পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি, বেলুচ, গুজরাতী ইত্যাদি নানা পরিচয়ের অবাঙালি মুসলিমদের সাথে একতা গড়ে। সে নেক আমলের প্রতিদান রূপে তারা মহান আল্লাহ তায়ালা থেকে পেয়েছিল পাকিস্তান। অখণ্ড পাকিস্তানের আয়োতন ছিল ১০ লাখ ৩০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আর বাংলাদেশের আয়োতন হলো এক লাখ ৪৮ হাজার। পাকিস্তান তাই বাংলাদেশের চেয়ে ৭ গুণ বড়। ফলে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা বাঙালি মুসলিমদের জন্য সুযোগ করে দিয়েছিল বাংলাদেশের চেয়ে ৭গুণ বৃহৎ রাষ্ট্রের রাজনীতিকে প্রভাবিত করার। সে সাথে সুযোগ দিয়েছিল বিশ্ব রাজনীতিতে এবং মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা রাখার। উল্লেখ্য বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মুসলিম রাষ্ট্রটির ৪ জন প্রধান মন্ত্রী হয়েছেন বাঙালি। দুই জন রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় সংসদের তিন জন স্পীকার হয়েছেন বাঙালি। অথচ এর পূর্বে বাঙালি মুসলিমগণ এমন কি নিজ দেশের উপরও কখনো শাসন করেনি। ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে তারা শাসিত হয়েছে অবাঙালিদের দ্বারা। কিন্তু শয়তানের খলিফাদের কাছে বাঙালি মুসলিমদের এ সুযোগ ভাল লাগেনি। ফলে উদ্যোগী হয় দেশটিকে খণ্ডিত করায়।
শেখ মুজিব ও তার অনুসারী বাঙালি ফ্যাসিস্টদের নাশকতার রাজনীতি শুধু পাকিস্তান ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ছিল না। ভয়ানক নাশকতা ছিল বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধেও। ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশীরা সেটি স্বচোখে দেখেছে। সেটি ছিল ভারতের গোলামী, ভারতীয় লুণ্ঠন, লুণ্ঠন-জনিত দুর্ভিক্ষে ১৫ লাখ বাংলাদেশীদের মৃত্যু, বাকশালী ফ্যাসিবাদ, গণতন্ত্র হত্যা, বার বার গণহত্যা, পিল খানায় সামরিক অফিসার হত্যা, সীমান্ত হত্যা ও আয়নাঘর। তাদের চোখের সামনে ধ্বংস করা হয়েছে পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত কল-কারখানাগুলি। ভারত লুণ্ঠন করে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার পাক বাহিনীর অব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্র। ধ্বংস করা হয়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, মিডিয়া, সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনীসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান।
সবচেয়ে বড় নাশকতাটি মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে
গণহত্যা, অপরাধের রাজনীতি ও বাংলাদেশ বিরোধী নাশকতার কারণে আওয়ামী লীগ অবশেষে নিষিদ্ধ হলো। তবে দলটির সবচেয়ে বড় নাশকতা ছিল মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে। কারণ, মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক রাষ্ট্র ছিল পাকিস্তান। সে রাষ্ট্রটি ভেঙ্গে যাওয়ার পর মুসলিম উম্মাহর ৫০টির বেশী নেশন স্টেট থাকলেও কোন সিভিলাইজেশনাল স্টেট নাই। অথচ সেরূপ সিভিলাইজেশনাল স্টেট হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদী ও চীনাদের রয়েছে। কারণ সেরূপ রাষ্ট্র হতে হলে ভাষা ও আঞ্চলিক পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠতে হয়। সে সামর্থ্য কেড়ে নেয় জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, গোত্রীয়বাদ ও আঞ্চলিকতাবাদ। তাই সেগুলি ইসলামে হারাম। ইসলামী পরিভাষায় এগুলি হলো আসাবিয়াত। মুজিব ও তার অনুসারিদের রাজনীতি ছিল সেই হারাম মতবাদের প্রতিষ্ঠা নিয়ে। তাই মুজিবের রাজনীতি ছিল বাঙালি মুসলিমদের গুনাহগার বানানোর শয়তানী প্রকল্প। পাকিস্তান শয়তানী শক্তির নাশকতার শিকার না হলে দেশটি হতো চীন ও ভারতের পর ৪৪ কোটি জনসংখ্যার বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমানবিক শক্তি।
পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ভারত, আরাকান ও উইঘুর মুসলিমদের পক্ষে খাড়া হওয়ার মত কোন বৃহৎ মুসলিম শক্তি নাই। গোত্রীয় ও জাতীয় রাষ্ট্রগুলি গোত্রীয় ও জাতীয় স্বার্থ দেখে মাত্র; নির্যাতিত মুসলিম উম্মাহ নিয়ে ভাবার আগ্রহ ও সময় তাদের থাকে না। সে ভাবনা কোন কালেই বাঙালি ফ্যাসিস্টদেরও ছিলনা। ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চলে, সেখানে মসজিদ ধ্বংস করা হয়, মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে মন্দির নির্মাণ করা হয়, মুসলিমদের মহল্লায় বুলডোজার চালিয়ে তাদের ঘরবাড়ী ও দোকান-পাট ধ্বংস করা হয়, গৃহে গরুর গোশতো রাখার অজুহাতে মুসলিমদের হত্যা করা হয়, কারো টুপি-দাড়ি দেখলে তাকে রাস্তায় পিটিয়ে “জয় শ্রীরাম” বলতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তা নিয়ে বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার লোকেরা নীরব; তাদের মুখে কোন নিন্দাবাক্য নাই। কারণ, শয়তানের এক খলিফা কখনোই আরেক খলিফার অপরাধের নিন্দা করে না। তারা সবাই যে একই দলের -তার প্রমাণ তো এই নীরবতা।
বাঙালি মুসলিমের মহাবিপদ
১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে শয়তানের বাঙালি খলিফারা মুসলিম উম্মাহর কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে। সে নাশকতার মধ্য দিয়ে তারা শয়তান ও তার পৌত্তলিক খলিফাদের প্রচণ্ড খুশি করেছে। বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে আর কেউই শয়তান ও তার পৌত্তলিক খলিফাদের ঘরে এতো বড় বিজয় তুলে দিতে পারিনি। ১৬ ডিসেম্বর এলে ভারতীয় পৌত্তলিকগণ আজও তা নিয়ে উৎসব করে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের কাছে এজন্যই মুজিব ও তার পরিবার এতো আপন। ২০২৪’য়ের ৫ আগস্ট পলায়নের পর হাসিনা তাই অন্য দেশে অআশ্রয় না পেলেও আশ্রয় পেয়েছে ভারতে। এবং ভারত তাকে বাংলাদেশের ফিরত দিচ্ছে না।
একাত্তরের বিজয়টি ছিল নিতান্তই ভারতীয় পৌত্তলিক শক্তির বিজয়। পৌত্তলিক শক্তির বিজয় এবং মুসলিমদের বিজয় কখনোই একত্রে একই ভূমিতে ঘটে না। পৌত্তলিক শক্তির বিজয়ের অর্থই হলো মুসলিমদের পরাজয়। ইসলামী ইতিহাসের এটি বুনিয়াদি বিষয়। অথচ অতি বিস্ময়ের বিষয় হলো, শয়তানের এ বিশাল বিজয় নিয়ে অনেক বাঙালী ইসলামপন্থী দল ও ছাত্র সংগঠন ১৬ ডিসেম্বর এলে উৎসব করে। রাজপথে বিশাল বিশাল মিছিল বের করে। এবং গর্ব বোধ করে ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে। প্রশ্ন হলো, যে বিভক্তিকে মহান আল্লাহ তায়ালা হারাম করলেন, এবং যাকে হারাম বলে ফতোয়া দিলেন একাত্তরের আলেমগণ -সেটি আজ উৎসব রূপে গণ্য হয় কি করে?
তাই পচন শুধু বাঙালি সেক্যুলারিস্ট, ফ্যাসিস্ট ও বামধারার লোকদের একার নয়, সে পচন থেকে রক্ষা পায়নি বাংলাদেশের তথাকথিত বহু ইসলামপন্থী দলের নেতা-কর্মী ও আলেমগণ। কোনটি শয়তানের বিজয় আর কোনটি ইসলামের বিজয় -সে সহজ বিষয়টি বুঝতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। বাঙালি মুসলিমের বিপদ যে কত গভীর তা বুঝতে কি এরপরও কিছু বাকি থাকে? মুজিবের মত শয়তানের দলের লোককে যারা পিতা, নেতা ও বন্ধু রূপে গ্রহণ করে তাদের বিপদটি তো ভয়ানক। কারণ, তাদেরকে তখন পরিকল্পিত ভাবে সত্য থেকে মিথ্যার দিকে নেয়া হয়। বাংলাদেশে বিজয়ী শয়তানের পক্ষটি দীর্ঘকাল প্রচার চালিয়ে সে কাজটিই তো করেছে। ফলে একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গার হারাম কাজটিও এদেশে প্রশংসনীয় ও উৎসবযোগ্য গণ্য হচ্ছে! এরা ১৬ ডিসেম্বর এলে উৎসব করে। এবং পাকিস্তান ভাঙ্গাকে স্বাধীনতা বলে। যেন অখণ্ড পাকিস্তানে তারা পরাধীন ছিল। অথচ পাকিস্তানের ৪ জন প্রধানমন্ত্রী, দুই জন রাষ্ট্রপ্রধান ও ৩ জন স্পীকার ছিলেন বাঙালি। বাঙালি মুসলিমের চেতনা বিভ্রাট যে প্রকট -এ হলো তার দলিল। প্রশ্ন হলো, এরূপ মিথ্যার জোয়ারে ভেসে কি সভ্য মানব ও সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণ করা যায়? যে কোন সভ্য কাজে তো সর্বপ্রথম মিথ্যা থেকে মুক্তি পেতে হয়। অথচ সেটিই বাংলাদেশে হচ্ছে না। বরং মিথ্যার জোয়ার ভাসাটাই শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এখানেই বাঙালি মুসলিমের মূল বিপদ। ১৪/০৫/২০২৫
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বঙ্গীয় বদ্বীপে শয়তানী শক্তির নাশকতা এবং বাঙালি মুসলিমের বিপদ
- একাত্তর নিয়ে পিনাকী ভট্টাচার্যের ভ্রম
- রাজনীতিতে মুসলিম এজেন্ডা এবং হিন্দু এজেন্ডা
- আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার এখনই কেন উপযুক্ত সময়?
- The Unfettered Crimes of Israel and the Death of Humanity
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- May 2025
- April 2025
- March 2025
- February 2025
- January 2025
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018