কীরূপে বাঁচানো যাবে স্বাধীনতা?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

সংকটের মুখে স্বাধীনতা

ভারত যদি বাংলাদেশ দখল করে নেয়, তবে সে ভারতীয় দখলদারির বিরুদ্ধে ক’জন বাংলাদেশী যুদ্ধে নামবে? সে প্রস্তুতি ক’জনের? মুজিব ও হাসিনার আমলে ভারতের দখলদারি কি কম হয়েছিল? তারা কি কম নিয়েছিল?লুণ্ঠনে লুণ্ঠনে তো দুর্ভিক্ষ দিয়েছিল। হাসিনার আমলে নদীর পানি, সমুদ্র বন্দর, নদী বন্দর, রেল ও সড়ক পথ, বাজার, গণতন্ত্র ও দেশের সরকার -এসবই তো ভারত দখলে নিয়েছিল। দেশের বুক চিরে নিয়েছিল করিডোর। হাইকোর্টের আঙ্গিনা থেকে সাক্ষী ধরে নিয়ে কলকাতার জেলে নেয়া হয়েছে। ঘর থেকে বিরোধী দলীয় নেতাকে তুলে নিয়ে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। একি স্বাধীনতার নমুনা? কিন্তু প্রতিবাদে ক’জন রাস্তায় নেমেছিল?

১৭৫৭ সালে ইংরেজরা যখন পলাশীর প্রান্তরে বালার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিল, সেদিনই বা ক’জন যুদ্ধে নেমেছিল? স্বাধীনতা বাঁচানোর দায় কি শুধু সিরাজৃদ্দৌলার ছিল? বাস্তবতা হলো, স্বাধীনতা বাঁচানোর যুদ্ধে সবাই নামে না। এ মহান কাজ অর্থ, সময় ও রক্তের কুরবানী চায়। যারা শুধু নিজের বা নিজ পরিবারের জন্য বাঁচে বা ক্ষমতা লাভের স্বপ্ন দেখে, স্বাধীনতার যুদ্ধে তাদের আগ্রহ থাকে না। এ কাজটি তো একমাত্র তাদের, যারা ঈমানের বলে বলিয়ান। যারা বাঁচে একমাত্র মহান আল্লাহকে খুশি করতে। কাফির শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে যারা জিহাদ মনে করে। এবং জিহাদে প্রানদানকে জান্নাতে প্রবেশের হাতিয়ার মনে করে।

এ বিশ্বে নানা বর্ণ ও নানা ভাষার বহু জনগোষ্ঠি; কিন্তু প্রকৃত স্বাধীন জাতি বা জনগোষ্ঠির সংখ্যা অতি নগন্য। তাদের অধিকাংশই ব্যর্থ হয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্র ও সভ্যতা নির্মাণে। তারা বিলীন হয়ে গেছে বৃহৎ কোন শক্তিশালী জনগোষ্ঠির গর্ভে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার বুকে ভারত কাজ করছে মেল্টিং পট রূপে। পাশ্চাত্য বিশ্বে একই রূপ মেল্টিং পট হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে সেরূপ মেল্টিং পট ছিল বিশাল খেলাফতি রাষ্ট্র। আলু, পটল, বেগুন একত্রে সিদ্ধ করলে সেগুলি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যেমন একাকার হয়ে যায়, তেমনি অবস্থা হয় বৃহৎ জাতির মাঝে বসবাসকারী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির। স্রেফ বাংলা ভাষা ও বাঙালি পরিচয় পশ্চিম বাংলাবাসীদের অখণ্ড ভারতে বিলীন হওয়া থেকে বাঁচাতে পারছে না। তারা হিন্দুত্ববাদী গো-বলয়ে ক্রমান্বয়ে একীভূত হয়ে যাচ্ছে। একই পরিণতি অপেক্ষা করছে এপার বাংলার বাঙালিদের জন্য, যদি তারাও শুধু বাংলা ভাষা ও বাঙালি পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠতে চায়। মুজিব ও হাসিনার শাসনামলে শুরু হয়েছিল সে ভারতীয়করণের প্রবল প্রক্রিয়া। ভারতীয়করণের অর্থ হলো হিন্দুত্বকরণ। সে প্রক্রিয়াকে বলবান করা হয়েছিল অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন লালনকারী রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশীদের উপর চাপিয়ে দিয়ে। সে প্রক্রিয়ার অংশ রূপেই জাতীয় সঙ্গীত রূপে চাপানো হয় রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিক গান “আমার সোনার বাংলা”কে।  শুরু করা হয় ২১’য়ে ফেব্রেয়ারীতে নগ্নপদে ফুল দেয়ার স্তম্ভপূজা। বসানো শুরু হয় মুজিবে মূর্তি। শক, হুন ইত্যাদি বহু জনগোষ্ঠি ভারতের মেল্টিং পটে বিলীন হয়ে গেছে। মুসলিমগণ বিলীন না হয়ে আলাদা পরিচয় নিয়ে বেঁচে আছে শুধু ইসলামের রশিকে শক্তি ভাবে ধারণ করার কারণে।

 

যুদ্ধের শুরুটি হয় চেতনার ভূমিতে

বাঙালি মুসলিমগণ আজ যুগ সন্ধিক্ষণে; সেটি যেমন এক দিকে হিন্দুত্বের মাঝে বিলীন হওয়ার, অপর দিকে স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে বাঁচার। প্রথম পথটি স্বাধীনতার বিলুপ্তির। একমাত্র ইসলামই বাঙালি মুসলিমদের হিন্দু ভারতে বিলীন হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। বাংলাদেশীদের স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচাতে হলে অবশ্যই বলবান করতে হবে ইসলামের সাথে বন্ধনকে। তাই স্বাধীনতার লড়াইটি যতটা রাজনীতির অঙ্গণে, তার চেয়ে বেশী চেতনার ভূমিতে। এ যুদ্ধটি বুদ্ধিবৃত্তিক। বুদ্ধিবৃত্তিক এ যুদ্ধে হেরে গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাচানোই অসম্ভব হবে। এ যুদ্ধে মূল অস্ত্র হলো পবিত্র কুর’আন। একাজে জরুরি হলো প্রতিটি মুসলিম শিশুর চেতনায় কুর’আনী জ্ঞানের পুষ্টিকে শক্তিশালী করা। কুর’আন থেকে দূরে সরানোর যে সেক্যুলার প্রকল্প, সেটি মূলত বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার প্রকল্প। সেক্যুলারিজমের কারণে অখণ্ড খেলাফত যেমন বাঁচেনি। তেমনি বাঁচেনি অখণ্ড পাকিস্তানও। সেক্যুলারিজমে বাঁচবে না স্বাধীন বাংলাদেশও। সেক্যুলারিজম মূলত মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে শয়তানের নাশকতার হাতিয়ার।

সেক্যুলারিজমের গর্ভে জন্ম নেয় জাতীয়তাবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ ও বর্ণবাদ। ইসলাম বাঁচলে প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্বও বাঁচে। তখন সে চেতনায় অখণ্ডতা বাঁচে নানা ভাষা, নানা অঞ্চল ও নানা বর্ণের মানুষদের নিয়ে গড়া বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের ভূগোল। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ক্ষতিসাধনই যাদের এজেন্ডা তাদের মূল যুদ্ধটি ইসলাম এবং ইসলামের প্যান-ইসলামী চেতনার বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের শত্রুরা তাই দেশটির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে সেক্যুলারিজমের প্রচার শুরু করে। সাথে পার্টনার রূপে পায় হিন্দুত্ববাদী ভারত। আজও যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু তাদের অস্ত্রটি হলো সেক্যুলারিজম। তারাই হলো ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের পরম বন্ধু।  

ইসলাম থেকে জনগণকে দূরে সরানোর লক্ষ্যকে সামনে রেখেই দিল্লির শাসক চক্র ১৯৭১ সালে যুদ্ধজয়ের পর বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে মুজিবকে দিয়ে সেক্যুলারিজমের প্রবেশ ঘটায়। লক্ষ্য ছিল, ইসলামের পক্ষের রাজনীতিকে এভাবে সাংবিধানিক ভাবে নিষিদ্ধ করা। এভাবে চেষ্টা চালানো হয় বাঙালি মুসলিমদেরকে বিশ্বের অবাঙালি মুসলিমদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা। মুজিবের পক্ষ থেকে তখন যুদ্ধ শুরু করা হয় ইসলামের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধকে তীব্রতর করে হাসিনা। অথচ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুজিব সেক্যুলারিজমের পক্ষে জনগণের ভোট নেয়নি।

 

সেক্যুলারিজমের নাশকতা

বিষ যেমন দেহের মৃত্যু ঘটায়, সেক্যুলারিজম তেমনি ঈমানের মৃত্যু ঘটায়। সেক্যুলারিজমের আভিধানিক অর্থ ইহজাগতিকতা; এ চেতনায় কাজ করে পরকালের বদলে কেবল পার্থিব স্বার্থচেতনা। তখন মগজে ভর করে দলীয়, গোত্রীয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থ। তখন প্যান-ইসলামী চেতনার স্থলে কাজ কলে বর্ণ, ভাষা ও দল ভিত্তিক বিভক্তি গড়ার চেতনা।  অথচ ঈমানদারকে প্রতি মুহুর্ত বাঁচতে হয় আখেরাতে মহান আল্লাহ তায়ালের কাছে জবাবদেহীতার ভয় নিয়ে। তাই তাঁর রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বত্র জুড়ে থাকে পরকালের ভয়। ব্যক্তির কাছে যেমন তার গৃহ, মুসলিম উম্মাহর কাছে তেমনি রাষ্ট্র। তাই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা বাঁচানো তার কাছ পবিত্র জিহাদ মনে হয়। অথচ সেক্যুলারিস্টদের ভাবনাই ভিন্ন। তাদের ভাবনায় ইবাদতের প্রেরণা কাজ করেনা। দেশের স্বাধীনতা বাঁচার লড়াই তাই তার কাছে ইবাদত মনে হয়না। সে ভীতিকে তারা পশ্চাদপদতা বলে। সে বরং মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে নাশকতায় ভারতের ন্যায় শত্রুশক্তির সৈনিকে পরিণত হয় -যেমনটি ১৯৭১’য়ে দেখা গেছে। তাই আজও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বড় শত্রু হলো ভারতপন্থীরা।

পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহ তায়াল মানুষের চেতনাগত যে রোগটির অতিশয় নিন্দা করেছেন, সেটি হলো আখেরাতের ভয়শূণ্যতা তথা সেক্যুলারিজমকে। যেমন সুরা ক্বিয়ামা’র ২০ ও ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

   كَلَّا بَلْ تُحِبُّونَ ٱلْعَاجِلَةَ

وَتَذَرُونَ ٱلْـَٔاخِرَةَ

অর্থ: “কখনো না, বরং তোমরা ভালবাস দুনিয়ার জীবনকে এবং পরিহার করেছো আখেরাতকে।”  একই অভিযোগ আনা হয়েছে সুরা ইনসানে ২৭ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

 إِنَّ هَـٰٓؤُلَآءِ يُحِبُّونَ ٱلْعَاجِلَةَ وَيَذَرُونَ وَرَآءَهُمْ يَوْمًۭا ثَقِيلًۭا

অর্থ: “নিশ্চয়ই এরাই হলো তারা, যারা ভালবাসে দুনিয়ার জীবনকে এবং পিছনে পরিত্যক্ত রূপে ফেলে রাখে আখেরাতের ভারী দিনগুলোর ভাবনাকে”। এরূপ আখেরাতবিমুখ ব্যক্তিগণ কি কখনো জান্নাত পায়?

 

অভাব জিহাদী চেতনা নির্মাতার

রণাঙ্গণের যুদ্ধে জিততে হলে জনগণের চেতনার ভূমিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে হয়। প্রতিটি মুসলিমকে মুজাহিদে পরিণত করতে হয়। মুসলিমের প্রতিটি যুদ্ধই হলো জিহাদ। যে যুদ্ধ জিহাদ নয়, সে যুদ্ধে যোগদান করা হারাম। এজন্যই একাত্তরে ভারতীয় কাফিরদের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্বে পরিচালিত সেক্যুলার যুদ্ধে কোন আলেম বা ইসলামপন্থী যোগ দেয়নি। এ যুদ্ধ ছিল বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট, কম্যুনিস্ট ও হিন্দুত্ববাদীদের পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধে। এ যুদ্ধের লক্ষ্য কখনোই বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র ছিল না। বরং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পরই গণতন্ত্রের স্থান হয় কবরে। স্বাধীনতার বদলে বাংলাদেশ পরিণত হয় ভারতের অধিকৃত কলোনীতে।

ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ঈমানদারের প্রতিটি সামর্থ্যই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার ক্রয়কৃত সম্পদ। ঈমানদারের সাথে মহান রব’য়ের সে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির ঘোষণাটি এসেছে সুরা তাওবার ১১১ নম্বর আয়াতে। তাই ঈমানদারের জান ও মাল হলো তাঁর রব’য়ের ক্রয়কৃত সম্পদ -যা হলো তাঁর কাছে তার রব’য়ের গচ্ছিত আমানত। সে আমানতকে সো কখনোই কোন সেক্যুলার যুদ্ধে বা কর্মে বিনিয়োগ করতে পারে না। সেটি হারাম এবং সেটি স্রষ্টার সাথে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির সাথে গুরুতর গাদ্দারী। তাই কোন হারাম যুদ্ধে যোগ দেয়ার অপরাধটি চরম খেয়ানত -যা অনিবার্য করে জাহান্নাম।

প্রতিটি মুসলিমকে মুজাহিদ রূপে গড়ে তোলার দায়িত্বটি দেশের প্রতিটি আলেম, ইমাম ও ইসলামী বুদ্ধিজীবীর। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটি হয়নি। দেশের স্বাধীনতা বাঁচানোর প্রশ্নে মূল সংকটটি এখানেই। দেশে প্রচণ্ড অভাব জিহাদী চেতনা নির্মাতার। দেশে জনগণের মনে নামাজ-রোজা-হজ্জে আগ্রহ বাড়ানোর লোক প্রচুর। কিন্তু লোকদের মাঝে জিহাদে আগ্রহ বাড়াবে তেমন বিজ্ঞ লোক নাই। এ বিষয়ে বাঙালি মুসলিমদের তূলনা করা যাক ইরানী ও আফগান মুসলিমদের সাথে। এ দেশ দুটিতে জিহাদীদের সংখ্যা বিশাল। ফলে বিশ্বের প্রায় সবগুলি দেশ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের দখলে গেলেও এ দুটি দেশকে তারা দখলে নিতে পারেনি। অথচ জনসংখ্যায় তারা বাঙালি মুসলিমদের অর্ধেকও নয়। তৃতীয় আর যে দেশটি স্বাধীনতা হারায়নি -সেটি হলো তুরস্ক।

ব্রিটিশরা একবার ইরান দখলের চেষ্টা করেছিল। সে আগ্রাসন রোধে ইরানের সেনাবাহিনীক সীমান্তে যুদ্ধে হাজির হতে হয়নি, সে দায়িত্ব সর্বপ্রথম কাঁধে তুলে নেয় দেশের আলেম সমাজ ও সাধারণ জনতা। হাতের কাছে যা আছে তা দিয়ে যুদ্ধে হাজির হয়। ব্রিটিশদের সে আগ্রাসনকে তারা ব্যর্থ করে দেয়। ব্রিটিশরা একবার রাজাকে হাত করে ইরান জুড়ে তামাকের উৎপাদন ও বাজারজাত করণের  ব্যবসার মনোপলি নিয়েছিল। সেবারও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের এই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য রুখতে এগিয়ে এসেছিল আলেমগণ। সেটি ছিল ১৮৮৯ সাল। সে সময় ইরানের গ্রান্ড আয়াতুল্লাহ মীর্জা সিরাজী ফতোয়া দেন, তামাকের ব্যবহার হারাম। সে ফতোয়ার পক্ষে যুক্তি ছিল, যে ব্যবসায় কাফির শত্রুদের অর্থনৈতিক মুনাফা হয় ও তাদের অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ে, সে ব্যবসা মুসলিমদের জন্য হারাম। মুসলিম কখনোই শত্রু শক্তির শক্তি বৃদ্ধিতে অংশ নিতে পারে না। সম্ভবত সেটিই ছিল মুসলিম ইতিহাসে সর্বপ্রথম অর্থনৈতিক বয়কট। সে বয়কটের ফল হলো, সাথে সাথে ইরানে বন্ধ হয়ে যায় ব্রিটেশের তামাক ব্যবসা।

 

বাঙলি আলেমদের ব্যর্থতা

প্রশ্ন হলো, ব্রিটিশ পণ্য যে হারাম -সে ফতোয়া তো ১৭৫৭ সালের বাঙালি আলেমগণ দিতে পারতো। দিলে তাতে ব্রিটিশের পণ্যের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হতো। কিন্তু সেরূপ ফতোয়া তারা দেয়নি। তারা ফতোয়া দিতে পারতো ইসরাইলী ও ভারতীয় পণ্যের বয়কটের পক্ষে। কারণ ইসরাইল ও ভারতের পণ্য ক্রয়ের অর্থ হলো শত্রুকে হামলায় শক্তি জোগানো। তাতে অর্থ জোগানো হয় অস্ত্র নির্মাণে -যা দিয়ে শত্রু দেশ দুটি মুসলিম হত্যা করে। মার্কিনীরা কি কোন দেশকে অস্ত্র দিত -যে অস্ত্র দিয়ে মার্কিনীদের হত্য করা হয়।  বুঝতে হবে, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধু রণাঙ্গণে হয়না, বড় যুদ্ধটি হয় অর্থনৈতিক অঙ্গণে। যুদ্ধ হয় বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণেও। কিন্তু সে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞা ও সচেতনতা বাঙালি আলেমগণ ১৭৫৭ সালে  যেমন দেখায়নি, আজও দেখাতে পারছে না। ভারতের ন্যায় একটি শত্রু রাষ্ট্রের পণ্য বর্জনের পক্ষে কোন ফতোয়া শীর্ষ আলেমদের পক্ষ থেকে আজও আসেনি। অথচ ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহবান এসেছে পিনাকী ভট্টাচার্যের ন্যায় এক জন হিন্দুর পক্ষ থেকে।

১৭৫৭ সালের পরাজয়টি শুধু সামরিক ছিল না, সেটি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক পরাজয়ও। সে পরাজয়ের ফলে ব্রিটিশগণ সেদিন তাদের নিজেদের পণ্যের অবাধ বাজার পেয়েছে এবং ধ্বংস করেছে বাংলার মসলিন ও মখমল শিল্পকে। এবং একই ভাবে ১৯৭১’য়ের পর বাংলাদেশে অবাধ বাজার পেয়েছে ভারতীয় পণ্য। পরিতাপের বিষয় হলো, ইমামতি, মুয়াজ্জিনী, মুর্দার জানাজা, মিলাদ পড়ানো ও বিবাহ পড়ানোর বাইরে অন্য কোন বিষয়ে ভাবতে বা দায়িত্ব নিতে আলেমদের দেখা যায় না। আফগানিস্তান দখলের দুই বার চেষ্টা করেছিল ব্রিটিশেরা। দখলে নেয়ার চেষ্টা করেছে সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবারই সে আগ্রাসন রুখে দিয়েছে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ। অথচ সেসব যুদ্ধে দেশের সরকারি সেনাবাহিনীকে দেখা যায়নি। কিন্তু শত্রুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধ সেরূপ প্রতিরোধ বাংলার মুসলিমদের পক্ষ থেকে গড়ে উঠেনি। বরং নবাব সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে বিজয়ের পর ক্লাইভের বাহিনী মুর্শিবাদে যে বিজয় মিছিল করেছিল, তাতে বাঙালি মুসলিমগণ বিপুল সংখ্যায় দর্শক রূপে হাজির হয়েছিল। তাদের মধ্যে ব্রিটিশের গোলামীর বিরুদ্ধে সে ঘৃণাবোধও দেখা যায়নি। কাফিরদের অধিকৃতি যে কতটা ভয়ানক হতে পারে -সে বোধও তাদের ছিল না। এর কারণ, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা। এমন বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা নিয়ে কি কোন দেশের স্বাধীনতা বাঁচে?       

 

স্বাধীনতা বাঁচাতে যা করণীয়

স্বাধীনতা বাঁচানোর যুদ্ধটি ইসলামে পবিত্র জিহাদ। দেশী ও বিদেশী নেকড়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই, উভয় প্রকার নেকড়েই সমান প্রাণনাশী। তেমনি পার্থক্য নাই স্বাধীনতার দেশী ও বিদেশী শত্রুর মাঝে। তাই স্বাধীনতার শত্রু শুধু ভারত নয়, ভারতসেবী স্বৈরাচারীগণও। কাশ্মীরে যে ভারতীয় নৃশংসতা, তার চেয়ে হাসিনার নৃশংসতা কি কম নৃশংস ছিল? নরেন্দ্র মোদীর বিজিপি ও আরএসএস’য়ের নৃশংস খুনিদের চেয়ে ছাত্র লীগের খুনিরা কি কম নৃশংস? তাই স্বাধীনতা নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তাদের শুধু ভারতীয় হামলার বিরুদ্ধে লড়লে চলে না। স্বাধীনতার দেশী শত্রুদের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়।

ঈমানদারের ঈমানের আসল পরীক্ষা হয় জিহাদের ময়দানে। কিন্তু কোথায় সে লড়াকু সৈনিক? যে জাতি এরূপ লড়াকু সৈনিক তৈরী করতে পারে না, সে বন্ধা জাতির স্বাধীনতা কখনো বাঁচে না। বাঁচতে হয় গোলামী নিয়ে। লড়াকু সৈনিক নির্মাণের দায়িত্বটি দেশের আলেম, লেখক, শিক্ষক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের। এরাই হলো একটি জাতির বিবেক এবং চেতনা ও সংস্কৃতির নির্মাতা। তাই দেশের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে শুধু চাষবাদ, শিল্প ও পশুপালন বাড়ালে চলে না, বাড়াতে হয় সে জিহাদী চেতনা নির্মাতাদের সংখ্যাও। একটি দেশের পরাধীনতা, পশ্চাদপদতা ও সর্বত্র ব্যর্থতা দেখে নিশ্চিত বলা যায়, সে নির্মাতাদের সংখ্যা দেশটিতে অতি নগন্য। বাংলাদেশ তো তেমনই একটা দেশ।  ০১/০৬/২০২৫

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *