কারা রাজাকার ও কি তাদের মিশন-ভিশন-প্যাশন?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজকের বিরোধটি হিন্দু ও মুসলিমের নয়। বাঙালি ও অবাঙালিরও নয়। বরং প্রবল বিরোধটি এখন রাজাকার ও ভারতসেবী বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের মাঝে। এ দুটি ভিন্ন শিবির থেকে দুটি চেতনা কথা বলে। তাই জরুরি হলো এ দুটি পক্ষ ও তাদের চেতনাকে সঠিক ভাবে চেনা। কিন্তু বাংলাদেশে পাঠ্য বইয়ে তাদের সঠিক পরিচয়টি তুলে ধরার কাজটি হয়নি; বরং হয়েছে মিথ্যা ইমেজ গড়ার কাজ। কারা ভারতসেবী বাঙালি পক্ষ? বাংলাদেশে এ পক্ষটি পরিচিত একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা রূপে। এরাই ১৯৭১’য়ে ভারতে গিয়েছিল এবং ভারতের অস্ত্র নিয়ে ভারতীয় সেনাদের সাথে মিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এবং এরাই ভারতের ঘরে বিজয় তুলে দিয়েছিল। ইসলামের বিরুদ্ধে এবং ভারতের বিরুদ্ধে এদের যুদ্ধ ১৯৭১’য়ে শেষ হয়নি। এরা বরং বাংলাদেশের প্রতি কোনে এখনো যুদ্ধ লড়ে যাচ্ছে। আবরার ফাহাদের মত যারাই দেশপ্রেমিক -তারাই তাদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু। আবরার ফাহাদ তাদের কাছে নব্য রাজাকার। এরাই দেশের ইসলামবিরোধী সেক্যুলারিস্ট পক্ষ।

ইসলামবিরোধী এ সেক্যুলারিস্টদের ৫টি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো: এক).  মুজিবের ন্যায় গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট ও ভারতের এজেন্টকে তারা বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা বলে; দুই).এরা মুজিবের মূর্তি গড়ে এবং সে মূর্তিতে পূজা দেয়া; তিন). এরা ভারত ও ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রশংসা গায়; চার). ক্ষমতায় গেলে ভারত যা চায়, তারা তাই দেয়। ভারতকে এরা ভারতীয় পণ্যের বাজার, বাংলাদেশের পেটের উপর দিয়ে করিডোর ও সমুদ্রবন্দরের সুবিধা দিয়েছে। তাদের কাছে গণতন্ত্র হলো জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে নৃশংস স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠা। পাঁচ). ইসলামপন্থীদের কুপানো। কারণ, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের ন্যায় এ বাংলাদেশী সেক্যুলারিস্টদেরও রয়েছে প্রবল ইসলামভীতি।  

কিন্তু কারা রাজাকার? কি তাদের পরিচয়? কি তাদের মিশন-মিশন? রাজাকার ফার্সি শব্দ। বিশেষ কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক লক্ষ্যকে সফল করতে যারা স্বেচ্ছায় নিজেকে নিয়োজিত করে -তারাই হলো রাজাকার। ইংরেজী ভাষায় রাজাকার শব্দের অর্থ ভলেন্টেয়ার। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসের রাজাকার বলতে সেসব পূর্ব পাকিস্তানী স্বেচ্ছাসেবকদের বুঝায়, যারা ১৯৭১’য়ে অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচাতে ভারত ও ভারতসেবীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নেমেছিল। ভারতসেবীদের হামলা থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ও সম্পত্তি বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়েছিল। তাদের প্রবল একটি রাজনৈতিক দর্শন ছিল। তারা ছিল বিশ্বমুসলিম ভাতৃত্বে প্রবল বিশ্বাসী তথা প্যান-ইসলামী; ফলে তারা ছিল ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের নামে মুসলিমদের মাঝে বিভক্তির দেয়াল গড়ার প্রবল বিরোধী। তারা গর্বিত ছিল পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক নাগরিক রূপে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা বাঁচানোকে তারা ঈমানী দায়িত্ব মনে করতো। যেসব বাঙালি মুসলিমগণ ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ এবং ১৯৪৭ সালে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল -তারা ছিল তাদের উত্তরসুরি। তাদের অধিকাংশের পরিবার ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী বা অন্য কোন ইসলামী দলের নেতা, কর্মী বা সমর্থক। তারা স্বপ্ন দেখতো বিশ্ব শক্তি রূপে মুসলিম উম্মাহর বেড়ে উঠায়।

১৯৭১’য়ে ভারতের বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তানের ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছে। ভারত সেদিন একা ছিল না। ভারতের পাশে ছিল সোভিয়েত রাশিয়া ও ইসরাইল। সেদিন পাকিস্তান পরাজিত না হলে দেশটি আজ পরিণত হতো পারমানবিক অস্ত্রধারী ৪৩ কোটি জনসংখ্যার বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে বাঙালি মুসলিমগণ সেদিন দেশটির ড্রাইভিং সিটে বসতো এবং বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলার সুযোগ পেত। উল্লেখ্য যে, দেশটি ভেঙ্গে যাওয়ার আগে ৪ জন বাঙালি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে।

১৯৭১’য়ে অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচানো রাজাকারদের কাছে নিছক রাজনীতি ছিল না, বরং ছিল তাদের মিশন, পবিত্র স্বপ্ন ও ঈমানী তাড়না (mission, vision & passion)। কিন্তু যারা বাংলা ও বাংলা ভাষা ভিত্তিক বাঙালির জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠতে রাজী নয় -তাদের কাছে রাজাকারের সে মিশন, পবিত্র স্বপ্ন ও মিশন ভাল লাগেনি। শয়তানের এই বর্ণবাদী বাঙালি খলিফাদের কাছে রাজাকারগণ একাত্তরের ন্যায় আজও তাই ঘৃণার পাত্র। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কাছে যারা প্রিয়তর হতে চায় এবং একাত্ম হতে চায় কুর’আনে ঘোষিত তাঁর পবিত্র এজেন্ডার সাথে, তাদের সামনে শয়তানের সেবকদের থেকে গালি খাওয়া ছাড়া ভিন্ন পথ আছে কি? এরূপ গালি খাওয়া তো নবী-রাসূলদের সূন্নত।   

রাজাকারদের বুঝতে হলে অবশ্যই বুঝতে হয় মহান আল্লাহ তায়ালার পবিত্র এজেন্ডাকে। আল্লাহ তায়ালা চান, মুসলিম উম্মাহ ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল ভিত্তিক পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠুক এবং বেড়ে উঠুক প্যান-ইসলামী চেতনায় বিশ্বাসী বিশ্বশক্তি রূপে -যেমনটি দেখা গেছে নবীজী এবং সাহাবায়ে কেরামের যুগে। এবং যেমনটি দেখা গেছে উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানিয়া খলিফাদের আমলে। তাই ঈমানদারকে বীর দর্পে দাঁড়াতে হয় মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করার যে কোন শয়তানী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। ভারত ও তার দোসরদের পক্ষ থেকে তেমনি একটি ষড়যন্ত্র যুদ্ধ রূপে হাজির হয় ১৯৭১’য়ে। সে যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল, মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তানকে খণ্ডিত করা। শয়তানী শক্তির পক্ষ থেকে এরূপ হামলা হলে, যারা মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হয় তাদের সামনে রাজাকার হওয়া ছাড়া উপায় থাকে কি? রাজাকার হওয়াটাই তখন তাঁর ঈমানী পরিচয়ে পরিণত হয়। কারণ, ঈমানদার কি কখনো পাকিস্তানের ন্যায় একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গার ব্রত নিয়ে ভারতের ন্যায় কাফির দেশে গিয়ে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষন নিতে পারে? সেটি তো হারাম।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের সে প্রবল জোয়ারের মুখে রাজাকার হওয়া মামূলী ব্যাপার ছিলনা। সে জন্য তো মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে উঠার প্রবল স্বপ্ন থাকতে হয়। থাকতে হয় মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার প্রবল তাড়না। সেটি না থাকলে জাতীয়তাবাদের স্রোতে ভেসে যাবে, ভারতের পক্ষ নিবে এবং রাজাকারদের গালি দিবে –সেটি অতি স্বাভাবিক। ১৯৭১’য়ে বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বাম কাপালিকদের জীবনে তো সেটিই দেখা গেছে। তারা ভারতের কোলে বসে প্রচুর নিমক খেয়েছে, অর্থ ও অস্ত্র নিয়েছে এবং যুদ্ধ করে ভারতকে বিজয়ী করেছে। ভারতের প্রতি নিমকহালালীই তাদের রাজনীতি। এবং আজও এটিই স্বাভাবিক যে, ইসলাম থেকে বাঙালি যতই দূরে সরবে ততই ঘৃনা করবে রাজাকারদের এবং নতজানু হবে ভারতের প্রতি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তো সেটি আজ প্রবল বাস্তবতা। ০৫/০৫/২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *