অপরাধী জনগণ এবং ব্যর্থ রাষ্ট্র

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

জনগণের অপরাধ

বাংলাদেশের বহুবিধ ব্যর্থতার জন্য শুধু সরকার দায়ী নয়, বরং চরম ভাবে দায়ী দেশের জনগণ। এবং জনগণের অপরাধের তালিকাটি অতি বিশাল। জনগণের মূল অপরাধটি হলো তাদের জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা। সে অজ্ঞতাটি যেমন কুর’আন-হাদীসের জ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান ও রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে, তেমনি অজ্ঞতা হলো রাজনৈতিক নেতাদের অপরাধ, অযোগ্যতা ও দুর্নীতি নিয়ে। বাংলাদেশের মত দেশে সবচেয়ে ভয়ংকর চোর-ডাকাত,খুনি, সন্ত্রাসী ও অর্থপাচারকারীদের সবচেয়ে বড় উপস্থিতিটি হলো দেশের রাজনীতির অঙ্গণে। বসত ভিটার পাশে বাস করে যেসব হিংস্র পশু, বিষাক্ত সাপ ও ক্ষতিকর পোকা মাকড় -তাদেরকে অবশ্যই চিনতে হয় এবং নির্মূল করতে হয়। নইলে সেখানে বসবাসই বিপদজনক হয়। তেমনি জানতে হয় ও খুঁজে বের করতে হয় দেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণের অপরাধীদের। এবং সমূলে নির্মূল করতে হয় তাদেরও। নইলে নৃশংস দুর্বৃত্তরা শাসকে পরিনত হয়; এবং রাষ্ট্র তখন গুরুতর অপরাধীদের হাতে অধিকৃত জেল খানায় পরিণত হয়। মুজিব-হাসিনার আমলে বাংলাদেশে তো সেটিই ঘটেছিল। বাংলাদেশের জনগণের নিদারুন ব্যর্থতা যেমন অপরাধীদের সনাক্ত করায়, তেমনি ব্যর্থতা তাদের নির্মূলেও। অথচ সেটিই হলো পবিত্র কুর‌’আনে ঘোষিত মুসলিম জীবনের মূল মিশন। মহান আল্লাহ তায়ালার ভাষায় সেটি হলো, নেহী আনিল মুনকার অর্থাৎ দুর্বৃত্তদের নির্মূল। বাঙালি মুসলিমের অপরাধ, তাদের গাদ্দারি মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশের সাথে। দুর্বৃত্তদের নির্মূল না করে সম্মানিত করেছে; সেটি জাতির নেতা, পিতা, বন্ধু, প্রসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে।    

জনগণের আরেক গুরুতর অপরাধ, তারা রাজনীতির ময়দান থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। দেশ দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হলেও তারা প্রতিবাদে রাস্তায় নামে না। নিজেদের ভোট ডাকাতি হয়ে গেলেও তারা নিষ্ক্রিয় থাকে। মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন বিলুপ্ত করা হলেও তারা তার প্রতিষ্ঠায় নামে না। এটি জনপদে বাঘ-ভালুক বা চোর-ডাকাত ঢুকলেও ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকার মত। এমন নিষ্ক্রিয়তায় কি ইসলাম পালন হয়? তারা নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালনের মাঝেই ইসলাম পালন ভাবে। অথচ এতে গাদ্দারি হয় নবীজী (সা:)’র সূন্নতের সাথে। রাজনীতি হলো সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্বৃত্তি নির্মূলের হাতিয়ার। তাই এটি জিহাদ।  নবীজী (সা:)’র জীবনে রাজনীতি ছিল; তিনি ১০টি বছর রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিল রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বৈচারিক নীতি এবং ছিল সমাজ কল্যাণ ও সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ক পলিসি। নবীজী (সা:)’র সে রাজনৈতিক সূন্নত থেকে দূরে সরে কি মুসলিম হওয়া যায়? তাতে গাদ্দারি হয় অর্পিত খেলাফতের দায়িত্বের সাথে।

তাছাড়া অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মুসলিম উম্মাহর  কল্যাণ-অকল্যাণের সাথে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার চুড়ান্ত ফয়সালাটি কখনোই মসজিদ-মাদ্রাসা, ক্ষেত-খামার বা হাট-বাজারে  হয় না, বরং হয় রাজনীতির ময়দানে। বস্তুত মহান আল্লাহ তায়ালার খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনের মূল হাতিয়ারটি হলো রাজনীতি। এবং সে দায়টি প্রতিটি নাগরিকের। তবে সে দায়িত্ব পালনের কাজটি স্রেফ ভোট দিয়ে হয়না, বরং সে লক্ষ্যে অর্থ, শ্রম, মেধা -এমনকি রক্তের বিনিয়োগ করতে হয়। ইসলামে এটি পবিত্র জিহাদ তথা সর্বোচ্চ ইবাদত। শয়তানের এজেণ্ডা কতটা পরাজিত হবে এবং কতটা বিজয়ী হবে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডা -তার পুরোটাই নির্ভব করে এই জিহাদের উপর।  

নামাজ-রোজা পালন না করলে মানুষ কাফির হয়। আর নামাজ-রোজা পালন করেও কেউ যদি ইসলামকে বিজয়ীর করার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদটি না করে তবে সে মুনাফিকে পরিণত হয় -কাফিরের চেয়েও যা নিকৃষ্টতর। নবীজী (সা:)’র যুগে তাই নামাজ-রোজা-যাকাত পালন করেও জিহাদে না থাকায় মুনাফিকের খেতাব পেয়েছে আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার তিন শত অনুসারি। অপর দিকে জিহাদের দায় পালন করতে গিয়ে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। মুসলিম ইতিহাসের এগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষনীয় বিষয়। তাই কোন দেশে দুর্নীতির প্লাবন, দুঃশাসন ও পাপাচার দেখে নিশ্চিত বলা যায় দেশের সরকারই শুধু অপরাধী নয়, অপরাধী দেশের জনগণও। অপরাধটি এখানে দায়িত্বা পালন না করার। গাছ মাত্রই ফল দিবে -সেটিই কাঙ্খিত। নইলে আগাছা গণ্য হয়। তেমনি মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো তাকে জিহাদে অংশ নিতে হয়। নইলে সে মুনাফিক গণ্য হয়। মুসলিমদের গৌরব যুগে প্রতিটি মুসলিমই ছিলেন মুজাহিদ; দ্বীন পালনকে তারা নিছক নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে সীমিত রাখেননি। দেশ নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সাথে দেশের প্রতিরক্ষায়ও তারা প্রাণপণ জিহাদ করেছেন এবং অর্থ ও রক্ত দিয়েছেন। অথচ বাঙালি মুসলিম নাগরিকগণ দেশের কল্যাণে সেরূপ কোন ভূমিকাই রাখেনি। এমন কি সৎ, যোগ্য ও ঈমানদার প্রার্থীদের ভোট দেয়ার কাজটিও তারা করেনি।

অথচ প্রতিটি নির্বাচনই নাগরিকদের মোক্ষম সুযোগ দিয়েছে শাসক পরিবর্তনের। রণাঙ্গণে যুদ্ধের ন্যায় কঠিন কাজ দূরে থাক, জনগণ যদি যোগ্য ও ঈমানদার প্রার্থীদের যদি ভোট দিত, তাতেই দেশে শান্তি ও উন্নয়নের জোয়ার শুরু হতো। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সে কাজটুকুও জনগণ করেনি। তারা বরং সমাজের চরিত্রহীন, দুর্নীতিবাজ, প্রতারক, বিদেশী শক্তির এজেন্ট ও ইসলামের শত্রুদের ভোট দিয়েছে। বাজারে গেলে তারা দোকানে দোকানে ঘুরে উত্তম খাদ্য সামগ্রী খোঁজে; অথচ নির্বাচন কালে চেষ্টা করে না সৎ, যোগ্য ও ঈমানদার ব্যক্তিদের খুঁজে বের করায়। নিজ দলের প্রার্থী হলে পরিচিত দুর্বৃত্তদেরও তারা ভোট দেয় ও বিজয়ী করে।  

 

জনগণ নিজেই যেখানে নাশকতার হাতিয়ার

ইসলামে জাহেল বা অজ্ঞ থাকাটিই সবচেয়ে বড় পাপ। অজ্ঞতা মানুষকে শুধু অযোগ্য করে না, বরং নানারূপ নাশকতার নৃশংস হাতিয়ারে পরিণত করে। যুগে যুগে অজ্ঞ মানুষেরাই ফিরাউন, নমরুদ ও মুজিব-হাসিনার ন্যায় দুর্বৃত্ত শাসকের সৈনিক রূপে খাড়া হয়েছে। এমন কি মুসলিম নামধারীরা বিপুল সংখ্যায় দাস সৈনিকে পরিণত হয়েছে ইংরেজ, ফরাসী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তির। বস্তুত শয়তানের এজেন্ডাই হয় জাহিল লোকদের এজেন্ডা। দেশকে এরা বসবাসের অযোগ্য ও জাহান্নামের বাহনে পরিণত করে। বস্তুত দেশ ও দেশবাসীদের বিরুদ্ধে বড় বড় নাশকতাগুলি হিংস্র পশু ও রোগজীবাণুর দ্বারা হয়নি, বরং হয়েছে জাহেল মানুষদের হাতে। বুঝতে হবে, মানব জীবনের সবচেয়ে বড় নেক আমলটি অর্থদান নয়, বরং সেটি হলো মানুষকে অজ্ঞতা তথা জাহিলিয়াত থেকে বাঁচানো। সুরা ফুরকানের ৬২ নম্বর আয়াতে অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জ্ঞানবান ব্যক্তির যুদ্ধকে “জিহাদকে জিহাদা কবিরা’ বলা হয়েছে।

অথচ বাংলাদেশে বহু লক্ষ মসজিদ ও বহু হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা পেলেও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে “জিহাদা কবিরা’র কাজটি হয়নি। ফলে নির্মূল হয়নি মানব মনের অজ্ঞতা তথা জাহিলিয়াত।  বরং দিন দিন সে অজ্ঞতা আরো গভীরতর হয়েছে। মানুষ তাতে আখেরাতমুখী না হয়ে দুনিয়ামুখী তথা সেক্যুলারিস্ট হয়েছে। আখেরাতমুখীতা ব্যক্তিকে নেক আমলে তৎপর করে। আর সবচেয়ে বড় নেক আমল তো হলো জিহাদ। সে জিহাদ যেমন দুর্বৃত্তির নির্মূলে, তেমনি সুনীতি ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠায়। আর পার্থিবমুখীতা তথা সেক্যুলারিজম নেয় পাপের পথে। বাঁচার তাড়নাটি তখন জৈবিক সুখ লাভের। তখন ইন্দ্রিয় সুখ লাভের আয়োজনটি বাড়াতেই গুরুত্ব পায় হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে নগর-বন্দরে পতিতাবৃত্তি, মদের দোকান, জুয়ার ক্যাসিনো, সূদী ব্যাংকের ন্যায় হারাম প্রতিষ্ঠান। তখন সেক্যুলার সরকারের দায়িত্ব হয়, পাপের এ প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে পাহারাদারীর ব্যবস্থা করা। তখন জাহেল জনগণের কাজ হয় অর্থ দিয়ে, শ্রম দিয়ে, ভোট দিয়ে,  এমন কি লড়াই করে তাদেরকে বিজয়ী করা -যারা সেক্যুলার রাজনীতির নেতা-কর্মী।

সেক্যুলারিস্টদের ভাবনা, কর্ম, আচরণ ও ভোটদানে পরকালের গুরুত্ব নাই; গুরুত্ব পায় স্রেফ ইহজাগতিক তৃপ্তি ও স্বার্থপ্রাপ্তির ভাবনা। সে ভাবনা থেকেই পার্থিব স্বার্থশিকারী জনগণ মুজিব ও হাসিনার ন্যায় অপরাধীদেরকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছে। তাদের সামান্যতম বিনিয়োগ নাই মহান আল্লাহতায়ালার এজেণ্ডাকে বিজয়ী করায়। তাদের গাদ্দারীটা তাই ইসলামের সাথে। তাদের গাদ্দারীর কারণেই বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নবীজী (সা:) প্রতিষ্ঠিত ইসলাম বেঁচে নাই। নবীজী (সা:) সে ইসলাম বাঁচলে তো বাংলাদেশেও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেত -যেমন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল নবীজী (সা:)’র আমলে। তখন প্রতিষ্ঠা পেত শরিয়তী বিচার এবং নির্মূল হতো মিথ্যা, দুর্বৃত্তি ও অবিচার। মুসলিম উম্মাহ তখন বিশ্বশক্তিতে পরিণত হতো।

 

অপরাধ শুধু ঘর ভাঙ্গা নয়, দেশভাঙ্গাও

বুঝতে হবে, কোন মুসলিমের ঘর ভাঙ্গাই শুধু অপরাধ নয়, বরং গুরুতর অপরাধ হলো মুসলিতম দেশ ভাঙ্গা। মুসলিম উম্মাহর পতনের শুরু তো তখন থেকেই যখন মুসলিম দেশ ভাঙ্গার অপরাধটি তাদের কাছে আর অপরাধ থাকেনি বরং উৎসবের বিষয়ে পরিনত হয়েছে। দেশের ভৌগলিক আয়োতন বাড়লে উম্মাহর শক্তি, স্বাধীনত ও ইজ্জতও বাড়ে; অপর দিকে দুর্বলতা ও পরাধীনতা বাড়ে দেশের আয়োতন ক্ষুদ্রতর হলে। মহান আল্লাহ তায়ালা চান, তাঁর ঈমানদার বান্দাগণ শক্তি, নিরাপত্তা ও ইজ্জত নিয়ে বসবাস করুক। তাই  ভূগোলে লাগাতর বৃদ্ধি আনা তো নবীজী (সা‍) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামদের সূন্নত। সে পথ ধরেই মদিনার ক্ষুদ্র গ্রামীন শহর ভিত্তিক রাষ্ট্র থেকে ইসলামী রাষ্ট্র বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিম দেশের অখণ্ড ভূগোলের সুরক্ষাকে ফরজ করেছেন, এবং হারাম করেছেন সে ভূগোল খণ্ডিত করাকে। মুসলিম দেশের ভূগোল খণ্ডিত করা তো ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের ন্যায় সনাতনি শয়তানী শক্তির এজেন্ডা। অথচ একাত্তরে মুজিব ও জিয়া -উভয়ে শয়তানের সে এজেন্ডাকে বিজয়ী করেছে এবং দুর্বল করেছে মুসলিম উম্মাহকে।  জনগণের অপরাধ, তারা ব্যর্থ হয়েছে ভারতের ন্যায় বিদেশী শত্রু শক্তি ও তাদের বাঙালি দালালদের চিনতে। তাই একাত্তরে মুজিব ও জিয়ার যেসব অনুসারীগণ ভারতীয় কাফিরদের ঘরে আশ্রয়, প্রশ্রয় ও প্রশিক্ষণ পেল এবং ভারতের অর্থ ও অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার ভারতীয় এজেণ্ডাকে সফল করলো -সে অপরাধীদেরকে তারা যেমন নেতা রূপে মাথায় তুলেছে, তেমনি ভোট দিয়ে বিজয়ীও করেছে। অথচ অপরাধ করাই শুধু অপরাধ নয়, অপরাধীদের সমর্থন করাও অপরাধ।

মুজিব ও জিয়া উভয়ই মারা গেছে, কিন্তু তাদের পাকিস্তান ভাঙ্গার অপরাধটি ক্বিয়ামত অবধি বেঁচে থাকবে এবং ঘৃণা কুড়াবে। কারণ মানব হত্যাই শুধু অপরাধ নয়, গুরুতর অপরাধ কর্ম হলো রাষ্ট্রকে হত্যা করা। কয়েক লাখ মানুষের নিহত হওয়াতে দেশবাসী স্বাধীনতা হারায় না, শত্রুর গোলামও হয় না। অতীতে বহু লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষ, মহামারি ও জ্বলোচ্ছ্বাসে নিহত হয়েছে, কিন্তু তাতে দেশবাসী ভারতে ন্যায় বিদেশী শক্তির গোলাম হয়নি।  দেশবাসী গোলাম হয় এবং স্বাধীনতা হারায় দেশ খণ্ডিত হলে বা বিলুপ্ত হলে। ফিলিস্তিনীরাসহ আরবগণ স্বাধীনতা হারিয়েছে খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়াতে। আর বাঙালি মুসলিমগণ ১৯৪৭’য়ে অর্জিত স্বাধীনতা হারিয়ে ভারতের অধিনত প্রজাতে পরিণত হয়েছে ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে। তাই যারা পাকিস্তান ভাঙ্গার সাথে জড়িত তাদেরকে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে এ হারাম কাজের জন্য অবশ্যই জবাব দিতে হবে।  শুধু আল্লাহ তায়ালার দরবারে নয়, শত শত বছর পর মুসলিম উম্মাহর আদালতেও এ অপরাধের দায় নিয়ে ইতিহাসের কাঠগড়ায় খাড়া হতে হবে। ‌কারণ, তাদের নাশকতাটি শুধু পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ছিলনা, ছিল মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধেও। কারণ পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে দুর্বল হয়েছে মুসলিম উম্মাহ।

 

অবাঙালি মুসলিমগণ গণ্য হয়েছে শত্রু রূপে

জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ -এসব মতবাদ অতি সংক্রামক। এ দুষ্ট মতবাদগুলি অন্য ভাষী, অন্য বর্ণ ও অন্য অঞ্চলের মানুষদের ঘৃণা করতে শেখায়। ইসলামে এরূপ ঘৃণা হারাম; এমন ঘৃণা করা কবিরা গুনাহ। সুরা হুজরাতের ১১ নম্বর আয়াতে এরূপ ঘৃণাকে হারাম করেছেন। বলা হয়েছে:

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا يَسْخَرْ قَوْمٌۭ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُونُوا۟ خَيْرًۭا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَآءٌۭ مِّن نِّسَآءٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُنَّ خَيْرًۭا مِّنْهُنَّ

অর্থ: “হে ঈমানদারগণ, এক সম্প্রদায়ের লোকেরা যেন অন্য সম্প্রদায়ের লোকেদের বিদ্রুপ না করে। হতে পারে তোমাদের থেকে তারা উত্তম। তেমনি মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা তাদের থেকে উত্তম।”   

মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু নামাজী, রোজাদার বা হাজী হওয়া নয়, বরং অন্য মুসলিমদের কাছে নিজেকে গভীর ভালবাসার দ্বীনি ভাই রূপে পেশ করা। সেরূপ ভালবাসা ও ভাতৃত্ব না থাকাটিই বেঈমানী। অথচ জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী ও আঞ্চলিকতাবাদী রাজনীতির মূল ভিত্তি হলো অন্যভাষী, অন্য বর্ণ ও অন্য অঞ্চলের মানুষদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করা। বস্তুত সেটিই হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের রাজনীতি। তখন তাদের কাছে অসহ্যকর গণ্য হয় প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্বের রাজনীতি। যে দেশে এরূপ ঘৃণা ও বিভক্তির রাজনীতি বলবান হয় সে দেশে বিলুপ্ত হয় পারস্পারিক ভাতৃত্ব ও সংহতি। তখন সমাজ যেমন বিভক্ত হয়, তেমনি দেশও বিভক্ত হয়। পাকিস্তান ছিল বাঙালি ও অবাঙালি উভয়েরই দেশ। ফলে দেশের শিল্পোন্নয়নে উভয়ের ভূমিকা রাখা জরুরি ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে পূর্ব পাকিস্তানীদের দায়িত্বটি ছিল বেশী। কিন্তু কোন পূর্ব পাকিস্তানী ব্যক্তি পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে কোন কল-কারখানা নির্মাণ করেছে তার প্রমাণ নেই। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নে অবাঙালি ব্যবসায়ীদের অবদানও ছিল বিশাল। ১৯৪৭’য়ে অবাঙালি পুঁজিপতিরা বিনিয়োগে এসেছে নিজেদের থেকেই। কিন্তু অবাঙালি হওয়ার কারণে তাদেরকে আওয়ামী লীগ ও বাম ধারার রাজনৈতিক নেতাকর্মীগণ বাঙালির শত্রু ও শোষক রূপে চিত্রিত করেছে। তাদের কাছে শিল্পমালিক হওয়াটাই ছিল অপরাধ। ষড়যন্ত্র শুরু হয় বিনিয়োগ কারীদের বিতাড়নে। আদমজী জুট মিলে অবাঙালি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা বাধানো হয়েছে। লক্ষ্য ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে পুঁজি বিনিয়োগের পরিবেশ বিনষ্ট করা। ভারতও সেটিই চাচ্ছিল। এবং তাতে সফলও হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে তিনটি উর্দুভাষী ধনী ব্যক্তিদের গড়া জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান সমূহের একটি বিবরণ দেয়া যাক:

১. বাওয়ানী শিল্প মালিকদের গড়া প্রতিষ্ঠানগুলি:

  • বায়তুল মোকাররম মসজিদ।
  • আহমেদ বাওয়ানী স্কুল এন্ড কলেজসহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
  • হাসপাতাল, ক্লিনিক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপন

 

২. ইস্পাহানী পরিবারের গড়া প্রতিষ্ঠানগুলি:

  • ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ফার্মগেট।
  • এম.এ ইস্পাহানি ইন্সটিটিউট অব অফ্থ্যালমোলজি।
  • ইস্পাহানি কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী কলেজসহ সারাদেশে মোট ৯ টি স্কুল কলেজ।

 

আদমজী পরিবারের গড়া প্রতিষ্ঠানগুলি:

  • আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ।
  • আদমজী সাহিত্য পুরস্কার।
  • আদমজী জুট মিলস হাসপাতালসহ একাধিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান।

 

উপরিউক্ত অবাঙালি পরিবারবর্গ এগুলো নির্মাণ করেছিল মাত্র ২২ বছরের পাকিস্তানী আমলে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলি তারা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেননি। তারা জমি কিনে, ভবন বানিয়ে, অনান্য আনুষঙ্গিক জিনিষপত্র দিয়ে প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতনও দিতেন। এই পরিবারগুলো বার্মা এবং ভারত থেকে হিজরত করে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল। তারা যেহেতু অবিভক্ত পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, পাকিস্তান ভাঙ্গার পর তাদের সম্পদ ও প্রতিষ্ঠানগুলি লুটপাট করে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। তাদের লুটপাট থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল এবং বাংলাদেশের একটি অতি লাভজনক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।

 

উপরিউক্ত পরিবারগুলির বিরুদ্ধে কোন দুর্নীতির প্রমাণ মেলেনি। তারা কোন ব্যাংক লুট করেননি।  সিন্ডিকেটি করেও তারা অর্থ লুট করেনি। প্রশ্ন হলো, তাদের তূলনায় বাঙালি ধনী পরিবারগুলির অবদান কি? বসুন্ধরা গ্রুপ, সালমান রহমান, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম পরিবার বা মুসা বিন শমসেররা এ অবধি কয়টি জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়েছে বিগত ৫৪ বছরের বাংলাদেশ আমলে? তারা তো ইতিহাস গড়েছে সিন্ডিকেট গড়ে, ব্যাংক লুটে ও শেয়ার মার্কেট ধ্বংসে।

 

১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শিল্প উন্নয়নের বিপ্লব শুরু হয়েছিল। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে পাকিস্তানকে তৃতীয় বিশ্বে উন্নয়নের মডেল রূপে দেখিয়ে একটি প্রচ্ছদ প্রবন্ধও ছেপেছিল।  পাকিস্তান তখন শিল্পোন্নয়নে দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়েও এগিয়ে ছিল। কোরিয়া থেকে উদ্দোক্তারা ও পরিকল্পনাবিদগণ আসতো উন্নয়নের সে পাকিস্তানী মডেল দেখতে। তখন টাকার মূল্য ভারতীয় রূপীর চেয়ে বেশী ছিল। ভারতের জিডিপি তখন পাকিস্তানের চেয়ে কম ছিল। ভারতে তখন খাদ্যাভাব লেগেই থাকতো। অথচ পাকিস্তানের ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে কোন দুর্ভিক্ষ আসেনি। আওয়ামী লীগ ও বাম ধারার কাপালিকদের কাছে উন্নয়নের সে ধারা ভাল লাগেনি। ভারতেরও ভাল লাগেনি। তাই উন্নয়ন রুখতে ষড়যন্ত্র শুরু হয়।

 

আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ১৯৭০’য়ে নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশ্ন তুলেছিল, পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন? প্রশ্ন হলো, তারা কি জানে শ্মশান কাকে বলে? শ্মশান ঘাটে কি এতো পাটকল, বস্ত্রকল, বন্দর, বিমান বন্দর, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও ক্যাডেট কলেজ থাকে? মিথ্যাচারই যাদের রাজনীতির পুঁজি তারা কি কখনো সত্য কথা বলতে পারে? মিথ্যাই হলো তাদের রাজনীতির মূল হাতিয়ার। আজ ২০২৫ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে শেখ হাসিনা নিশ্চিত জোর গলায় বলতো, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে একজন ব্যক্তিও পুলিশের গুলীতে মারা যায়নি। যেমন ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের গণহত্যা নিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিল একজনও মারা যায়নি। হাসিনা মস্করা করে বলেছিল, “হিফাজতে ইসলামের মুসল্লীরা নাকি গায়ে লাল রং মেখে রাস্তায় শুয়ে ছিল, পুলিশ দেখে দৌড়িয়ে পালিয়েছিল।”

 

অজ্ঞতার নাশকতাটি বিশাল। অজ্ঞতাই মানুষকে জাহান্নামে নেয়। অজ্ঞতার কারণে মানুষ যেমন হাতে গড়া মূর্তি, পুরুষের লিঙ্গ, সাপ-শকুন এবং গরুকেও পূজা করে, তেমনি মুজিবের ন্যায় দুর্বৃত্ত, খুনি, মিথ্যুক এবং ভারতের চরকেও বাঙালির নেতা, বন্ধু ও জাতির পিতার আসনে বসিয়েছে। অতীতে এমন জাহেলগণই নবী-রাসূলদের উপর পাথর বর্ষণ করেছে এবং তাদেরকে হত্যা করেছে। এমন অজ্ঞ ও বিভ্রান্ত বাঙালিরাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুজিবের ন্যায় ভয়ানক অপরাধীকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে।

 

এজন্যই মানব জীবনের সবচেয়ে বড় পাপটি হলো অজ্ঞ থাকা। সে অজ্ঞতা নানারূপ পাপের রাস্তা খুলে দেয়। এবং অসম্ভব করে সত্য ও কল্যাণের পথে চলা। নবীজী (সা:) এজন্যই অজ্ঞতা তথা জাহিলিয়াতকে সকল পাপের জননী বলেছেন।  অজ্ঞতারে গর্ভে জন্ম নেয় যেমন নানা রূপ মিথ্যা, তেমনি শয়তানের সৈনিকেরা। এমন অজ্ঞদের দেশে ইসলামের বিজয় বা ইসলামী রাষ্ট্বর নির্মাণ অসম্ভব। লক্ষ লক্ষ মুসলিমের রক্তে গড়া পাকিস্তান প্রজেক্ট তাই একাত্তরে এরা ব্যর্থ করে দিয়েছে এবং বিজয়ী হয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারতের এজেন্ডাকে। এজন্যই ইসলামে অতি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ হলো অজ্ঞতার নির্মূলে জ্ঞানদান ও জ্ঞানার্জন। অজ্ঞতার নাশকতা থেকে মুক্তি দিতে মহান আল্লাহ তায়ালা তাই নামাজ-রোজার আগে জ্ঞানদান ও জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছেন। অথচ বাঙালি মুসলিমগণ সে ফরজ পালন করেনি; ফলে তারা সহজেই ধরা খেয়েছে মুজিবের ন্যায় প্রতারকের জালে। তবে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় আযাবটি অপেক্ষা করছে আখেরাতে।     

 

হারাম চিরকালই হারাম

যা কিছু হারাম, তা চিরকালই হারাম। তা কখনোই হালাল হয়না। তেমনি কোন অবস্থাতেই হালাল হয় না মুসলিম দেশ ভাঙ্গার ন্যায় হারাম কর্মকাণ্ড। তাছাড়া সকল হারাম কাজের নাশকতা সমান নয়। দেশে বৈষম্য, দুর্নীতি বা হত্যাকাণ্ডের ন্যায় হারাম কর্ম যতই হোক, সেগুলি কখনোই মুসলিম দেশ ভাঙ্গার ন্যায় হারাম কর্মকে জায়েজ করে না। বরং ইসলামে ফরজ হলো অন্যায়-অবিচারের নির্মূলের জিহাদ। যে কোন মুসলিম দেশে বৈষম্য, অবিচার ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতেই পারে। সেরূপ অনাকাঙ্খিত অপরাধ কর্ম ঘটেছে উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানিয়া খেলাফতের আমলেও। ভারতের ন্যায় বহু অমুসলিম দেশেও সেরূপ অপরাধ অহরহ ঘটে। কিন্তু সেগুলি কি দেশ ভাঙ্গার দলিল হতে পারে? কিন্তু সেগুলিকে দেশভাঙ্গার পক্ষে দলিল বানিয়েছে বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বাম ধারার কাপালিকগণ। কারণ, শয়তানের এ খলিফাদের মূল লক্ষ্য ছিল, মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি সাধন এবং তাদের প্রভু ভারতকে বিজয়ী করা। এবং সেটি মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রটি খণ্ডিত করার মাধ্যমে। ভারত আজ শক্তিশালী। ১৯৭১’য়ের আগে ভারত এতো শক্তিশালী ছিল। ১৯৪৮ ও ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুটি যুদ্ধ করেছে।   

হিন্দু ধর্মে দেশ ভাঙ্গা হারাম নয়। ভারতে কত গণহত্যা ও কত অপরাধই না ঘটে। কিন্তু তারপরও ভারতীয় হিন্দুরা দেশ ভাঙ্গেনি। ভারতকে তারা অখণ্ড রেখেছে। ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP) রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (RSS) য়ের স্লোগান হলো‍: “বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে।” অর্থ: যদি তোমরা বিভক্ত হও তবে তোমাদেরকে কাটবে।” ভারতীয় হিন্দুদের তারা এই বলে সাবধান করছে, যদি তোমরা ভাষা, বর্ণ, প্রদেশ ও জাত-পাতের নামে বিভক্ত হও, তবে শত্রুরা তোমাদের গলা কাটবে। শত্রু বলেত তারা মুসলিমদেরই বুঝিয়ে থাকে। ভারতের শক্তি তো তার বৃহৎ ভূগোল। ভারতীয়দের মাথা পিছু আয় কাতার বা কুয়েতের মাথাপিছু আয়ের ১০ ভাগের এক ভাগও নয়। ভারতের ৮০ কোট মানুষ বাঁচে সরকারের দেয়া রেশনের উপর। কিন্তু এরপরও কাতার বা কুয়েতের চেয়ে ভারত বহুগুণ শক্তিশালী। সে শক্তির কারণ, ভারতের ১৪০ কোটি জনগণ ও বৃহৎ ভূগোল। রাশিয়ার অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতির চেয়েও দুর্বল। কিন্তু বৃহৎ ভূগোলের কারণে রাশিয়া আজ বিশ্বশক্তি।

মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে কারো পদানত নয়, বরং বিশ্বশক্তি রূপে দেখতে চান। সেজন্য তিনি একতাকে ফরজ ও বিভক্তিকে হারাম করেছেন। একতার সে পথ ধরেই বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেয়েছিল গৌরব যুগের মুসলিমগণ। মুসলিমদের পতনের শুরু তো তখন থেকেই যখন থেকে তারা একতার বদলে বিভক্তির পথ বেছে নিয়েছে। এবং সে বিভক্তির পথটিই হলো শেখ মুজিব ও জেনারেল জিয়ার পথ। মুজিব ও জিয়ার অনুসারীদের জন্ম তাই একই আদর্শিক মাতৃগর্ভে। সেটি সেক্যুলারিজম ও ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের। তাই যারা আওয়ামী লীগের তারাই বিএনপির সদস্য হতে পারে। তারা সবাই ফেরি করে একাত্তরের হিন্দুত্ববাদী বয়ান। তাই একাত্তরে যারা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি -এ উভয় দলের নেতাকর্মীগণ সব সময় একই ভাষায় গালি দেয়।         

 

একাত্তর নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র

একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীদের হাতে গণহত্যার ভয়ানক কাণ্ড ঘটেছে। সে অপরাধের জন্য পাকিস্তান কেন বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়না -আজও সে অভিযোগ অনেক বাঙালি ফ্যাসিস্টদের মুখে মুখে। অথচ তারা ভূলে যায়, একাত্তরের পাক সেনাবাহিনীর হাতে সংঘটিত  হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমতা চেয়েছে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো এবং প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররাফ। পাকিস্তান ক্ষমা চাইলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সেক্যুলারিস্টগণ শুধু একাত্তরের হিন্দুত্ববাদী বয়ানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই পাকিস্তানকে বার বার ক্ষমতা চাইতে বলে। তারা চায় পাকিস্তানীদের সাথে বাঙালি মুসলিমদের বিবাদ দীর্ঘজীবী হোক। ভারত সেটিই চায়। তবে এর পিছনে ভূ-রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের যে সম্ভাবনা দেখে দিয়েছে -ভারত তাতে উদ্বিগ্ন। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের মনে এখন প্রচণ্ড মুসলিম ভীতি। তাদের ভয়, ১৯৪৭’য়ে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান যেরূপ এক হয়েছিল, আবার যেন সেরূপ এক না হয়ে যায়! তাই তারা বাঙালি ও অবাঙালি মুসলিমের একাত্তরে বিবাদকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। ভারতে সে লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মাঝে লুকানো ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা RAW য়ের এজেন্টরা। ভারত বহুদিন যাবত বহু শত কোটি টাকা ব্যয়ে তাদের প্রতিপালন দিয়ে যাচ্ছে। সেটি ১৪ বিলিয়ন ডলার মার্কেট ও বাংলাদেশের উপর তাদের দখলদারীটা বাচিয়ে রাখার স্বার্থে। ভারত যা চায়, ভারতের এ এজেন্টগণও সেটিই চায়। অথচ ভারতপালিত এসব এজেন্টগণ কখনোই এ প্রশ্ন তোলে না, ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে অধিকৃত হওয়ার পর ভারতীয় সেনারা যে হাজার হাজার কোটি টাকার যুদ্ধাস্ত্র, সেনানীবাসের আসবাবপত্র, রেলওয়ে ইঞ্জিন ও বগি, নৌ-জাহাজ, কল-কারখানার যন্ত্রাংশ, বেসামরিক অফিসের মালামাল লুট করলো -তা কেন ফেরত দেয়না কেন?   

ভারতসেবী এসব বাংলাদেশীরা ভূলে যায়, পাকিস্তানে যা কিছু গণহত্যা ঘটেছে সেটি শুধু ৯ মাস যুদ্ধকালীন সময়ে। ১৯৭১’য়ের যুদ্ধ শুরুর আগে ২৩ বছরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে একজন বাঙালিও কি কোথাও খুন হয়েছে?একাত্তরের গণহত্যার জন্য দায়ী তো তারা যারা এমন একটি যুদ্ধকে ডেকে এনেছিল। সে যুদ্ধকে অনিবার্য করেছিল তো তারা যারা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ বানাতো চেয়েছিল। সেরূপ একটি যুদ্ধের ষড়যন্ত্র তো শেখ মুজিব ও তার সহচরগণ ভারতের সাথে মিলে ষাটের দশকেই করেছিল -যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। যুদ্ধ যখন আসে, সেটি কখনোই একাকী আসে না, সাথে গণহত্যাও আনে।

প্রশ্ন হলো, মুজিব ও জিয়ার পাকিস্তান ভাঙ্গার হারাম রাজনীতি না থাকলে কি কখনো পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার ঘটনা ঘটতো? বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহ্ত্যা পরিচালনার জন্য তো ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়নি। বরং দেশটির ২ জন রাষ্ট্র প্রধান, ৩ জন স্পীকার এবং ৪ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছে বাঙালি। যারা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তারা হলের খাজা নাজিমুদ্দীন, মহম্মদ আলী বোগরা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং নুরুল আমীন। অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচলে তো পাকিস্তান হতো ৪৩ কোটি জনসংখ্যার বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমানবিক রাষ্ট্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় বাঙালি মুসলিমগণ তখন পেত বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলার সুযোগ। কিন্তু মুজিব ও জিয়ার ন্যায় কাপালিকগণ চায়নি বাঙালি মুসলিমগণ ইজ্জত নিয়ে ও স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচুক। তাই তারা হিন্দুত্ববাদী ভারতের কোলে গিয়ে উঠেছে। এবং ভারতকে বিজয়ী করেছে। মীর জাফরের পর বাঙালি মুসলিম সমগ্র ইতিহাসে শেখ মুজিব ও জেনারেল জিয়ার ন্যায় এতো বড় শত্রু কি আর কখনো জন্ম নিয়েছে? মুজিব ভারতের সাথে নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করেছে বটে কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার সাহস করেনি। কিন্তু মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণার ন্যায় হারাম কাজটি করেছে।       

বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন চিরকাল থেকে যায়। সেটি হলো, একাত্তরে যে ভাবে দুই লাখের বেশী বিহারীকে হত্যা করা হলো, হাজার হাজার বিহারী নারীদের ধর্ষণ করা হলো এবং বিহারীদের প্রতিটি গৃহ ও দোকানকে যেভাবে জবর দখল করে নেয়া হলো এবং তাদের বস্তিবাসী করা হলো -সেটিও কি কম অসভ্য ও কম নৃশংস? বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ে কি সে ঘৃণ্য অপরাধের সামান্যতম উল্লেখ আছে? প্রশ্ন হলো সে অপরাধ কি বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসের অংশ নয়? সে নৃশংস অপরাধের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা দূরে থাক, অধিকাংশ বাংলাদেশীদের মনে সে গুরুতর অপরাধ নিয়ে সামান্যতম অনুশোচনাও কি আছে? নাই।  সে অনুশোচনা যেমন মুজিবের মনে ছিলনা, তেমনি জিয়ারও মনে ছিলনা। বিহারীদের বিরুদ্ধে যে সেদিন নৃশংস গণহত্যা ও ধর্ষণের ন্যায় অপরাধ ঘটেছে সে কথা একটি বারও শেখ মুজিব মুখে আনেনি। জিয়াও আনেনি। তারও কারণ রয়েছে। কারণ, অপরাধকে অপরাধকে দেখার মত বিবেক অপরাধীদের থাকেনা।

তাছাড়া বাঙালি ফ্যাসিবাদ ও হিন্দুত্ববাদী বয়ানের প্রচারকগণ ভাল করেই জানে, বিহারীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও তাদের ঘরবাড়ী দখলে নেয়ার যে নৃশংস কাণ্ডগুলি ঘটেছে সেগুলির চর্চা বাড়লে একাত্তরে নিয়ে তাদের হিন্দুত্ববাদী বয়ানের মৃত্যু হবে। এজন্যই সে বর্বরতার ইতিহাসকে তারা আড়াল করতে চায়। বরং বিহারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংস অপরাধকে ঢাকতে তারা ৩০ লাখ বাঙালি নিহত হওয়া ও দুই লাখ বাঙালি নারী ধর্ষিত হওয়ার বয়ান বাজারে ছেড়েছে। সেটি যেমন বাকশালীদের পক্ষ থেকে, তেমনি বিএনপি’র পক্ষ থেকে। এবং তাতে বাহবা দিচ্ছে ভারত ও ভারতীয় মিডিয়া। এ প্রচারের পিছনে তাদের একটিই লক্ষ্য; সেটি হলো ইসলামপন্থীদের চরিত্রহনন। কারণ ইসলামপন্থীর অর্থই তো অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষের শক্তি। লক্ষণীয় হলো, বাংলাদেশে ইসলামের জাগরণ যতই বলবান হচ্ছে ততই বাড়ছে একাত্তর নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের পুরনো বয়ান। তাদের বয়ানে, ভারতের ন্যায় পৌত্তলিক কাফিরদের সাথে নিয়ে পাকিস্তানের ন্যায় একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গা অতি গৌরবের কাজ। আর সেটির বিরোধীতা তাদের কাছে অপরাধ। শয়তান তো সেটিই চায়। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার রায় তো ভিন্ন। তিনি চান মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিকএকতা। তিনি হারাম করেছেন বিভক্তিকে।  মুসলিম উম্মাহ আজ শক্তিহীন তো শয়তানের এজেন্ডা বিজয়ী হওয়াতে। বাংলার ভূমিতে শয়তানের সে এজেন্ডা বাস্তবায়নে একাত্তরে ভারতীয় কাফিরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে মুজিবপন্থী ও জিয়াপন্থীরা। তাই ভারতীয়দের কাছে তারা এতো প্রিয়। বাংলাদেশে ইসলামের উত্থান রুখতে এরাই হলো এখন মূল শক্তি।       

 

বয়ান পাল্টাতে হবে 

কোন দেশকে পাল্টাতে হলে সর্বপ্রথম সে দেশের রাজনীতির মাঠের বয়ানকে পাল্টাতে হয়। কারণ, বয়ানই নির্ধারিত করে রাজনীতির অঙ্গণে কোনটি কাঙ্খিত ও প্রশংসিত এবং কোনটি ঘৃণার বিষয় ও পরিতাজ্য। একাত্তরের সে বয়ানে বিচিত্র ভাষা, বিচিত্র বর্ণ ও বিচিত্র এলাকার মুসলিমদের নিয়ে পাকিস্তানের ন্যায় বৃহৎ ও শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র নির্মাণের বিশাল কাজটি নন্দিত না হয়ে বরং নিন্দিত হয়। এমন দেশে স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচার কাজটি অসম্ভব হয়। এমন দেশে আগ্রাসী ভারতের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকৃতি প্রতিষ্ঠা পাবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। কারণ একাত্তরের এ বয়ান  হিন্দুত্ববাদীকে ভারতকে বন্ধু রূপে ভাবতে শেখায়। চরিত্র হনন করে সেসব রাজাকারদের যারা একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙার হারাম কাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল। বাংলাদেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিরর অঙ্গণ থেকে একাত্তরের  হিন্দুত্ববাদী এ বয়ান নির্মূল করতে না পারলে এ দেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির কোন ভবিষ্যত নাই। তারা শুধু নিন্দিতই হতে থাকবে। এবং প্রশংসিত হতে থাকবে ইসলামের শত্রুরা। তখন বাজার পাবে ভারতের রাজনীতি। তখন  অসম্ভব থেকে যাবে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ। ০৩/০৫/২০২৫

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *