ব্যর্থতা সবচেয়ে বড় সত্যটির আবিষ্কারে এবং তার শাস্তি

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

 প্রসঙ্গ: সবচেয়ে বড় সাফল্য এবং সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা

মানবের সকল সাফল্যের মাঝে সবচেয়ে বড় সাফল্যটি হলো বিশ্বজগতের সবচেয়ে বড় সত্যটি আবিস্কার। এবং সকল ব্যর্থতার মাঝে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি হলো, সে বড় সত্য আবিষ্কারে ব্যর্থতা। মানবের সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাব নিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিচার্য বিষয় হলো এই সত্য আবিষ্কারে সাফল্য ও ব্যর্থতা। বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করে একজন ব্যক্তি নবেল প্রাইজ পেতে পারে, কিন্তু তাকে জাহান্নামের আগুনে অনন্ত অসীম কালের জন্য পুড়তে হবে সে সত্য আবিষ্কারের ব্যর্থ হওয়াতে। এ বিশ্বজগতের সবচেয়ে বড় সত্যটি অন্য কোন গ্রহে জীবের বসতি আছে কিনা -সে প্রসঙ্গে নয়। সে সত্য আর্টফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা পারমানবিক শক্তির সামর্থ্য নিয়েও নয়। বরং সে সত্যটি হলো এ বিশ্বজগতের  স্রষ্টার সঠিক পরিচয় নিয়ে। সে সত্য মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে। সে সাথে সে সত্য ধর্মকে নিয়ে যা ইহকালীন ও পরকালীন -এ উভয় জীবনের সাফল্যের গ্যারান্টি দেয়। এ সত্য আবিষ্কারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় মানব জীবনে থাকতে পারে না। প্রতিটি ব্যক্তির মেধার মূল পরীক্ষাটি হয় সে আবিষ্কারের সামর্থ্যে। এটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, জাহান্নামের আগুন থেকে একমাত্র তারাই বাঁচবে যারা এ পরীক্ষায় পাশ করবে।

 

অতি পরিতাপের বিষয় হলো, মানব জাতি নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে বিস্ময়কর সাফল্য দেখালেও অতিশয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি আবিষ্কারে। মানব জাতির সকল বিপর্যয়ের মূল কারণ, সত্য আবিষ্কারে এ ব্যর্থতা। এবং এ ব্যর্থতার প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই। মিশরীয়দের গড়া পিরামিড সপ্তাশ্চর্যের মাঝে অন্যতম বিস্ময়কর সৃষ্টি। কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্যটি আবিষ্কারে তাদের ব্যর্থতা এমনই করুন যে তারা ভগবানকে খোদা বলতো। সে ব্যর্থতা ইউরোপ-আমেরিকার বিজ্ঞানীদেরও কি কম? তারা চাঁদের পিষ্ঠে পা রাখতে সমর্থ রাখলেও যে যীশু ৯ মাস একজন নারীর গর্ভে কাটালো এবং জেরুজালেমের রোমান শাসক যার উপর নির্যাতন করলো এবং যাকে শূলে উঠিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করলো -তাকে তারা খোদা মনে করে। যে খোদাকে নারীর গর্ভে ঢুকে জন্ম নিতে হয় এবং যার সামর্থ্য নাই জালেম শাসক থেকে নিজেকে বাঁচানোর -সে খোদা হয় কি করে? খৃষ্টানদের আরো দাবী, মানুষের রূপ ধরে ঈশ্বরের বাণী পৌছিয়ে দিতেই দুনিয়াতে এসেছিলেন। এবং আরো দাবী, শূলে চড়ে প্রাণ দিয়ে তিনি নাকি সকল পাপীদের প্রায়শ্চিত্ত করে গেছেন। ফলে তারা মনে করে, কেউ যীশুকে খোদা বলে স্বীকার করলে, সে যত পাপই করুক সে পরকালে মাফ পেয়ে যাবে! কি বিসস্মকর মিথ্যা। মহান আল্লাহ তায়লার ভাষায় এ হলো আকাশ বিদীর্ণ হওয়ার ন্যায় মিথ্যা। অথচ এ মিথ্যার উপর দাড়িয়ে আছে সমগ্র খৃষ্টান ধর্ম। সত্য আবিষ্কারে কদর্য ব্যর্থতা হিন্দু বিজ্ঞানীদেরও কি কম? তারা পারমানবিক বোমা ও ক্ষেপনাস্ত্র আবিষ্কারে সাফল্য দেখালেও গরু, সাপ, হুনুমান, মূর্তি, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা ইত্যাদিকে ভগবান বলে। লিঙ্গের মাথায় দুধ ঢেলে সেটির পূজা করে!

 

 

মানবের অক্ষমতা ও আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত

 

যুগ যুগ ধরে মানব সন্তানেরা এরূপ কদর্য ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছে, যে সত্যটি তাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ -সে সত্য আবিষ্কারের তারা অক্ষম। মানবের সে অক্ষমতা সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালা জানেন। তাই তিনি সত্যটি জানানোর দায়িত্বটি করুণাময় আল্লাহ নিজ দায়িত্বে নিয়েছেন। তাই কুর’আনের বয়ান:

 

إِنَّ عَلَيْنَا لَلْهُدَىٰ   অর্থ: “নিশ্চয়ই মানুষকে পথ দেখানের দায়িত্ব আমার।” –(সুরা লাইল, আয়াত ১২) ।

 

তাই সে মহা সত্যটি জানাতেই এ পৃথিবী পৃষ্ঠে মহান আল্লাহ তায়ালা লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন এবং আসমানী কিতাব নাজিল করেছেন। এবং সে ধারাবাহিকতায় নবীজী (সা:) হলেন সর্বশেষ রাসূল এবং কুর’আন হলো সর্বশেষ আসমানী কিতাব। এক্ষেত্রে অতি লক্ষণীয় বিষয়টি হলো, নবী-রাসূলদের জন্ম পরস্পরে বহু শত বছরের ব্যবধানে হলে তাদের প্রচারিত বক্তব্য এক ও অভিন্ন। মহান আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা, মানবের পুনরুত্থান, রোজ হাশর, জান্নাত-জাহান্নাম, পৌত্তলিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে তাই হযরত মূসা (আ:) যা বলেছেন – সে একই কথা বলেছেন তাঁর জন্মের প্রায় হাজার বছর পর জন্ম নেয়া হযরত মহম্মদ (সা:)। সত্যের সূত্র যেহেতু এক, তাদের বয়ানে তাই অভিন্ন। বস্তুত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্যের এই যে প্রকাশ -সেটিই হলো তাঁর পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় দান। এবং যে ব্যক্তি সে দানটি পেল, সেই অনন্ত অসীম কালের জন্য জান্নাত পেল। এবং যে ব্যর্থটি হলো সে সত্যটি জানায় ও অনুসরণে -সে নিশ্চিত জাহান্নামের নেয়।       

 

বাসা বাঁধা, সন্তানের জন্মদান, সংসার পালন ও পানাহারে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে এমন কি পশু-পাখিরাও ভূল করে না। তাই স্রেফ বাঁচায় কোন কৃতিত্ব নাই। এমন কি চরিত্রহীন, স্বার্থপর এবং অতিশয় দুর্বৃত্তরাও সফল ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, উকিল, বিজ্ঞানী ও ব্যবসায়ী হয়। কিন্তু এমন দুর্বৃত্তরা ঈমানদার হওয়ার পরীক্ষায় দারুন ভাবে ফেল করে। শুধু মহান আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রাসূল ও তার কিতাব কুর’আনকে বিশ্বাস করলেই নৈতিক পরীক্ষায় পাশ জুটে না। সে জন্য চোর-ডাকাত, ভোটডাকাত এবং সকল দুর্বৃত্ত ও অপরাধীদের চেনা, তাদেরকে ঘৃনা করা ও তাদের নির্মূলে লড়াইয়ে নামার সামর্থ্যও থাকতে। বাংলাদেশীদের মাঝে সে সামর্থ্য যে অতি সামান্য -তা হাসিনার ন্যায় ভোটডাকাতের দীর্ঘকালীন শাসনই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে।

 

 

 

যে কারণে অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে

 

মূর্তিপূজা, গরুপূজা, বর্ণপূজা, গোত্রপূজা, নেতাপূজা ও দলপূজার ন্যায় আদিম অজ্ঞতা নিয়ে বাঁচায় আদৌ কোন কৃতিত্ব নাই। অজ্ঞ হিন্দুও সেটি করতে জানে। সত্যকে চিনতে হয় এবং মানতে হয়। এখানে আপোষ হলে জাহান্নামে যেতে হয়। বিস্ময়ের বিষয় হলো, মানুষ তার বাপদাদার রেখে যাওয়া বাড়ী-গাড়ির মডেল পাল্টাতে যতটা তৎপর, সেরূপ তৎপরতা নাই ধর্মের নামে পূর্ব পুরুষের রেখা যাওয়া সনাতন অজ্ঞতা ও আচার পাল্টাতে। ভারতের ১১০ কোটি হিন্দু তাই বেঁচে আছে তাদের পূর্ব পুরুষদের অজ্ঞতাপ্রসূত ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার নিয়ে। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার কোটি কোটি মানুষ তাদের পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়অ ভ্রন্তা ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার পাল্টালেও তা পাল্টাতে রাজী হয় ভারতের প্রায় ১১৫ কোটি হিন্দু। তাদের প্রচণ্ড গর্ব অতীতের সনাতন মিথ্যাকে নিয়ে। সেটিকে তারা সনাতন ধর্ম বলে। ফলে তারা বাঁচছে বর্ণ বিভেদ,শ্রেণী বিভেদ ও জাতি বিভেদের অভিশাপ নিয়ে। এবং ব্যর্থ হচ্ছে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা দিতে। বরং বিভেদ, ঘৃণা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক বর্জন (exclusion)’য়ের নীতিই হলো তাদের রাজনীতি ও সমাজ নীতি। তাই ভারতের রাজনীতিতে ২৫ কোটি মুসলিম ও প্রায় ৩০ কোটি দলিত হিন্দুদের জন্য কোন স্থান নেই। মুসলিমদের মধ্য থেকে কোন মন্ত্রী নাই। সরকারি দলে কোন মুসলিম এমপিও নাই। জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগ হলে কি হবে, চাকুরিতে শতকরা ৪ ভাগও মুসলিম নাই। অবিচারই সেখানে বিচার। বঞ্চনাই সেখানে নীতি।    

 

অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে মানুষ খুন, চুরি-ডাকাতি বা ব্যাভিচারের কারণে নয়, বরং বিবেকের পরীক্ষায় ফেল করার কারণে। অর্থাৎ মহান স্রষ্টা তথা আল্লাহ তায়ালাকে চিনতে ফেল করায়। বিশ্বজগতের সকল সৃষ্টির পিছনে যে একজন সর্বজ্ঞানী মহান স্রষ্টা আছে –সে বিশাল সত্যটি বুঝতে ব্যর্থ হওয়া কি কম ব্যর্থতা? এটি মধ্য আকাশে জ্বলন্ত সূর্য্যকে চিনতে ব্যর্থ হওয়ার চেয়ে কম নয়। এ ব্যর্থতা নিয়ে কি কেউ জান্নাত পেতে পারে? পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানলাভ এ জন্য ফরজ যে, কুর’আনের জ্ঞান বিবেক বা নৈতিক পরীক্ষায় পাশের সামর্থ্য বাড়ায়।

 

 

কুর’আনের শক্তি: সক্রিয় করে আক্বলকে

 

সকল সৃষ্টিকুলের মাঝে  মানবের সর্বশ্রেষ্ঠত্বের কারণ, তার দৈহিক বল নয়, বরং তার আক্বলের বল তথা চিন্তা-ভাবনার বল। চিন্তা-ভাবনার সামর্থ্যে যারা বিপ্লব আনতে পারে, একমাত্র তারাই বিপ্লব আনতে পারে মানবতা ও বিবেক বোধে। তারাই সফল হয় সভ্যতর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে। মুসলিমগণ যেভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল তার মূলে কোন শিল্প, কৃষি বা অর্থনৈতিক বিপ্লব ছিল না, বরং সেটি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব। সেটি মুসলিমদের আক্বল তথা চিন্তাভাবনাকে সক্রিয় করার বিপ্লব। আর সে বিপ্লবের মূলে ছিল পবিত্র কুর’আন। কুর’আন চিন্তা-ভাবনায় তাদেরকে প্রবল ভাবে অনুপ্রেরিত করেছিল। এবং সেটি চলতো প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। যে কুর’আন তারা প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজের প্রতি রাকাতে পাঠ করতো -তা তাদের ঘুমন্ত বিবেককে বার বার জাগিয়ে তুলতো। আরবদের চিন্তাভাবনার যে সামর্থ্য হাজার হাজার বছর ঘুমিয়ে ছিল, তা কুর’আনের বরকতে প্রবল ভাবে জেগে উঠেছিল। কুর’আন মানুষের আক্বলকে সক্রিয় করে, এবং অভূতপূর্ব সামর্থ্য জুগায় সত্য আবিষ্কারে। পবিত্র কুর’আনের এটিই হলো এক বিশাল মোজেজা। এর প্রমাণ, আরবী ভাষায় কুর’আনের পূর্বে কোন কিতাব ছিলনা। অথচ কুর’আনের বদৌলতে আরবদের আক্বল এতটাই সক্রিয় হয় যে, তারা আরবী ভাষাকে কিছু বছরের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত করে। এবং মুসলিম ভূমিতে শুরু হয় বিজ্ঞানের পথে নবযাত্রা।

 

আক্বলকে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেও পবিত্র কুর’আনের সে মোজেজার কথাটি বার বার উল্লেখ করেছেন। যেমন বয়ান এসেছে:

 

كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمْ ءَايَـٰتِهِۦ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

 

অর্থ‍: “এই ভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য কুর’আনের আয়াতে বর্ণনা করে থাকেন যাতে তোমাদের আক্বল ভাবনায় সক্রিয় হয়।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ২৪২)। আরো বলা হয়েছে:

 

كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمُ ٱلْـَٔايَـٰتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

 

অর্থ: “এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য বয়ান করেন তাঁর আয়াতকে -যাতে তোমরা তা দিয়ে তোমাদের আক্বলকে কাজে লাগাতে পার।” –(সুরা নূর, আয়াত ৬১)। অনুরূপ বয়ান এসেছে সুরা হাদীদের ১৭ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ ٱلْـَٔايَـٰتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

 

অর্থ: “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আমার আয়াতকে আমি বর্ণনা করেছে যাতে তোমরা তোমাদের আক্বল তথা বুদ্ধিকে সক্রিয় করতে পার।”

 

 

 

আরবী ভাষার অনন্য বৈশিষ্ট্য

 

পবিত্র কুর’আন যদি আরবী ভাষার বদলে হিব্রু, আরামিক, সিরিয়াক,কপটিক বা অন্য কোন ভাষায় নাজিল হতো তবে নবীজী (সা:) ও তাঁর আরব জনগণের জন্য কুর’আনের বাণী বুঝে উঠা অসম্ভব হতো। সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরবীতে নাজিল হওয়ায় কুর’আন বুঝা তাদের জন্য সহজ হয়েছে। তবে আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার বিষয়ও এতে রয়েছে। তবে অন্য ভাষার বদলে আরব ভাষাকে বেছে নেয়ার পিছনে নিশ্চয়ই সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব হিকমত রয়েছে। বুঝতে হবে, সব খাদ্য যেমন সমান পুষ্টি দেয় না, তেমনি সব ভাষা চেতনার ভূবনে সমান পুষ্টি জুগায় না। এখন বিশ্বে শত শত এমন ভাষা আছে যে ভাষায় ভাল কবিতা লেখা যায়না। এবং সেসব ভাষায় লেখা যায়না দর্শন বা বিজ্ঞানের কোন বই। কারণ, সে জন্য চাই সমৃদ্ধ শব্দ ভাণ্ডার। সে শব্দ ভাণ্ডার রয়েছে আরবী ভাষার।  

 

কুর’আন নাজিলের সমকালীন সময়ে বিশ্বের অন্যান্য ভাষার তুলনায় আরবী ভাষা ছিল নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতম ভাষা। সে সময় ইংরেজী, ফরাসী, ল্যাতিন, বাংলা, উর্দু, হিন্দির ন্যায় বহু ভাষার জন্মই তখন হয়নি। আরবী ভাষা ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছিল মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষা রূপে। বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষা তো সেটিই যার শব্দাবলী মানুষে মগজে ধাক্কা দেয় এবং চেতনাকে জাগিয়ে তোলে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আরবী ভাষার প্রতিটি শব্দ গঠিত হয় মাত্র তিনটি অক্ষর দিয়ে; সে শব্দ থেকে নির্মিত হয় অসংখ্য সংখ্যক বর্ধিত শব্দ। মজার বিষয় হলো, বর্ধিত করণের নিয়মের মধ্যে একটি দর্শন কাজ করে -যা নতুন শব্দের অর্থ নির্ধারণ করে দেয়। এদিক দিয়ে আরবী ভাষা বিশ্বে অনন্যা। শুধু আরবগণ নয়, এমন কি আনারবগণও আরবী ভাষায় কুর’আন পড়ে যেরূপ অনুপ্রাণিত হয়, তেমনটি কুর’আনের অনুবাদ পড়ে হয় না। এবং পবিত্র কুর’আনকে আরবী ভাষায় নাজিলের পিছনে সেটিও একটি বড় কারণ হতে পারে। তবে সর্বজ্ঞানী আল্লাহই সেটি ভাল জানেন।

                                                                                                                                    

তবে সত্যকে তুলে ধরা এবং সত্য আবিষ্কারে বিবককে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে পবিত্র কুর’আনের যে বিস্ময়কর সামর্থ্য রয়েছে -তার প্রমাণ হলো ইউরোপ-আমেরিকার বিপুল সংখ্যক মানুষের ইসলাম গ্রহণ। এসব নওমুসলিমদের অধিকাংশই কারো পক্ষ থেকে ইসলামের দাওয়াত পেয়ে ইসলাম কবুল করছে না; তারা ইসলামে আকৃষ্ট হচ্ছে সরাসরি কুর’আন পড়ে। পবিত্র কুর’আনের সে বিশেষ সামর্থ্যের দিকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় নীচের আয়াতে। বলা হয়েছে:

إِنَّآ أَنزَلْنَـٰهُ قُرْءَٰنًا عَرَبِيًّۭا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

 

অর্থ‍: “নিশ্চয়ই আমি এ কিতাবকে নাজিল করেছি আরবী কুর’আন রূপে -যাতে তোমরা তোমাদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাতে পার।” –(সুরা ইউসুফ, আয়াতা ২)।

উপরিউক্ত আয়াতে বস্তুত আরবী ভাষায় নাজিলকৃত কুর’আনের অতুলনীয় শক্তির দিকেই ইশারা করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায়, পবিত্র কুর’আনী জ্ঞানের গভীরে যারা ঢুকতে চায়, তাদের জন্য আরবী ভাষায় জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নাই। কুর’আনের আয়াতগুলি মাঝে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যে প্রবল emotional force যুক্ত করা হয়েছে -তার অনুবাদ অসম্ভব। সে emotional force’ই সে আমলে আল্লাহর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদে মুসলিমদের নিজ মেধা, নিজ অর্থ ও নিজ রক্তের বিনিয়োগে অনুপ্রাণিত করতো। গৌরব যুগের মুসলিমগণ সে বিষয়টি বুঝতেন; এজন্যই মিশর, ইরাক, সিরিয়া, সুদান, মরক্কো, আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া, মৌরতানিয়অ, লিবিয়ার ন্যায় অনারব দেশের জনগণ অনুবাদ না করে পবিত্র কুর’আনকে কুর’আনের ভাষাতে বুঝার চেষ্টা করেছেন এবং নিজেদের মাতৃভাষাকে কবরে পাঠিয় দিয়েছেন। আর এভাবে আরবী ভাষা গ্রহণ করার কারণে শুধু কুর’আন বুঝাতেই তারা সফল হয়নি, তারা সফল হয়েছে ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহর জন্ম দিতে। ফলে মুসলিম উম্মাহব বেড়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূ-রাজনৈতিক শক্তি রূপে। তাই এ ক্ষেত্রে কুর’আনের অবদানটি বিশাল।

অথচ আজ মুসলিমগণ ইংরেজী, ইটালিয়ান, ফরাসী, জাপানী, চীনা, স্পানিশ, কোরিয়ান ইত্যাদি নানা ভাষা শিখলেও আগ্রহ নাই কুর’আনের ভাষা শেখায়। তারা কুর’আন পাঠ করে কুর’আন না বুঝেই। কুর’আনের প্রতি এর চেয়ে বড় অবমাননা আর কি হতে পারে? ফলে তারা যেমন কুর’আন থেকে দূরে সরেছে, তেমনি ব্যর্থ হচ্ছে একতাবদ্ধ মুসলিম উম্মাহ রূপে বেড়ে উঠতে। বরং বেছে নিয়েছে ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চলের নামে বিভক্তির পথ। আর বিভক্তির পথ যে আযাব অনিবার্য করে -সে ঘোষণাটি শোনানো হয়েছে পবিত্র কুর’আনের সুরা আল ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে। বাস্তবতা তো এটিই, আজকের মুসলিমদের বসবাস সে আযাবের মধ্যেই। ফলে মুসলিম বিশ্বের কোথাও নাই শান্তি, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সম্মান। মুসলিমদের জন্য উম্মুক্ত জেলখানায় পরিণত হয়েছে ফিলিস্তিন, কাশ্মীার, ভারত, জিংজিয়াং, আরাকান এবং স্বৈরশাসিত আরব দেশগুলি।  এবং কোথাও বেঁচে নাই নবীজী (সা:) ইসলাম -যাতে ইসলামী রাষ্ট্র ছিল, মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ছিল, প্যান-ইসলামী ঐক্য ছিল এবং দুর্বৃত্তির নির্মূলে এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠায় লাগাতর জিহাদ ছিল। ফলে মুসলিমগণ বাঁচছে প্রকৃত ইসলাম ছাড়াই। মুসলিমদের জন্য এর চেয়ে বড় বিপর্যয় আর কি হতে পারে?     

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *