মুসলিম-জীবনের দায়ভার ও ব্যর্থ মুসলিম
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on December 31, 2020
- Bangla Articles, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
যে দায়িত্বটি সাক্ষ্যদানের
মুসলিম জীবনে যেটি সর্বসময় অপরিহার্য তা হলো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে সাক্ষ্যদান। সে সাক্ষ্যদানের উপর নির্ভর করে তার মুসলিম হওয়া ও না হওয়ার বিষয়টি। এ সাক্ষ্যটি স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বের পক্ষে নয়, বরং সেটি তাঁর সর্বময় সার্বভৌম কর্তৃত্ব, তিনিই যে একমাত্র উপাস্য, তার নির্দেশিত ইসলামই যে একমাত্র সঠিক ধর্ম, তাঁর আইনই যে একমাত্র বৈধ আইন এবং পবিত্র কোর’আনই যে জান্নাতে পৌঁছার একমাত্র পথ –সেগুলোর পক্ষেও সাক্ষ্য দেয়া। আরো সাক্ষ্য দিতে হয়, রাসূলে পাক হযরত মহম্মদ (সাঃ) হচ্ছেন তাঁর গোলাম ও রাসূল। ইসলামী পরিভাষায় এরূপ সাক্ষ্যদানকে বলা হয় শাহাদাহ। মুসলিম হতে আগ্রহী প্রতিটি ব্যক্তিকে এ কালেমায়ে শাহাদাহ পাঠ করতে হয়; নইলে মুসলিম হওয়ার চিন্তাও করা যায়না। মুসলিম জীবনে সকল বিপ্লবের উৎস হলো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে অন্তরের গভীর থেকে এ সাক্ষ্যদান।
মুসলিমের জীবনে জান্নাতে পথে রূপে যাত্রা শুরু হয় বস্তুত “কালেমায়ে শাহাদা” পাঠের মধ্য দিয়ে।শাহাদা তথা সাক্ষ্যদান একটি প্রবল বিশ্বাসের প্রতিধ্বনী। ঈমানদারকে আজীবন বাঁচতে হয় সে বিশ্বাস নিয়ে। সে বিশ্বাস হারানোর অর্থই বেঈমান বা কাফের হয়ে যাওয়া। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে এরূপ সাক্ষ্যদানের মধ্যে ঈমানদার পায় তাঁর বাঁচার মূল এজেন্ডা ও মিশন। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ন কোন এজেন্ডা ও মিশন যে নেই –ঈমানদারকে বাঁচতে হয় সেরূপ একটি বলিষ্ঠ বিশ্বাস নিয়েও। এ বিশ্বাস থেকে সামনে হটলে সে আর মুসলিমই থাকেনা। নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাতের ন্যায় ইবাদতগুলোর মূল কাজ হচ্ছে ঈমানদারের জীবনে সাক্ষ্যদানের সে সামর্থ্য-বৃদ্ধি। কিন্তু নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত পালন করা সত্ত্বেও কোন ব্যক্তি যদি মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর আইন পালনের চেয়ে কোন শাসক, দল বা পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ও আইনকে প্রাধান্য দেয় -তবে বুঝতে হবে তার ইবাদত মূল্যহীন। সে সাথে পোক্ত বেঈমানও।
জনসম্মুখে সাক্ষ্যদাতার গুরুত্বটি প্রতি সমাজেই অপরিসীম। জনগণের আদালতে সত্যকে বিজয়ী করতে হলে তার পক্ষে সাক্ষ্যদানকারি চাই। সত্য যে প্রকৃতই সত্য এবং মিথ্যা যে প্রকৃতই মিথ্যা -সেটুকু বলার জন্যও তো লোক চাই। নইলে সমাজের সাধারণ মানুষ সত্যকে জানবে কেমনে? মিথ্যাকেই বা চিনবে কেমনে? সাক্ষ্যদানের সে কাজটি না হলে মিথ্যার নির্মূল ও সত্যের প্রতিষ্ঠাই বা কীরূপে হবে? মহান আল্লাহতায়ালার অস্তিত্ব ও কুদরত যে সত্য এবং তাঁর কোর’আনী বাণী যে সত্য – সে ঘোষণা দেয়া এবং সে সত্যের প্রতিষ্ঠায় তো সাহসী লোক চাই। মানব সমাজে সে কাজটি ফেরেশতাদের নয়; সেটি ঈমাদারদের। একাজের জন্যই তাঁরা মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত খলিফা। এবং এ মহান কাজের পুরস্কারটিও সর্বোচ্চ; সেটি জান্নাত। আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে মুসলিম জীবনে কাজে শুরু তাই শাহাদা বা সাক্ষ্যদান থেকে।
আরবের বুকে সত্যের ঝান্ডা নিয়ে নবীজী (সাঃ) দাঁড়িয়েছিলেন বলেই অগনিত মানুষ সেদিন মহান আল্লাহতায়ালাকে চিনেছিলেন। চিনেছিলেন তাঁর দ্বীনকে। পেয়েছিলেন জান্নাতের পথ। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে বলিষ্ঠ সাক্ষ্যদানের যে সূন্নত মহান নবীজী (সাঃ) পেশ করেছিলেন, সে সূন্নতকেই মহান সাহাবাগণ তাদের বাঁচার মূল লক্ষ্য ও মিশনে পরিণত করেছিলেন। এ মিশন নিয়ে বহু কষ্ট সয়ে বহু দুর্গম পাহাড়-পর্বত ও মরুভূমি পাড়ি দিয়ে তাঁরা বহু দেশে গেছেন। তাদের সে কোরবানীর ফলেই সেসব দেশের মানুষের পক্ষেও সত্যপথ-প্রাপ্তি সেদিন সম্ভব হয়েছিল। এবং তাতে সম্ভব হয়েছিল ইসলামে বিজয় এবং নির্মিত হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে আর কোন জনগোষ্ঠিই মহান আল্লাহতায়ালার নামকে বড় করতে এবং তাঁর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা দিতে নিজেদের অর্থ, রক্ত, সময়, মেধা ও সামর্থ্যের এরূপ বিনিয়োগ করেননি। এজন্যই তারা পরিচিতি পেয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রূপে। মহান আল্লাহতায়ালা যে তাঁদের কর্মে সন্তুষ্ট সে ঘোষণাটি তিনি দিয়েছেন পবিত্র কোর’আনে। এজন্যই সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সামনে তারাই শ্রেষ্ঠ মডেল।
মহান আল্লাহতায়ালা চান, তাঁর নিজের সত্য পরিচয় ও সত্য দ্বীন প্রতিটি দেশে পরিচিতি পাক ও বিজয়ী হোক। এবং পরাজিত হোক শয়তানের এজেন্ডা। এ কাজ তিনি ফেরাশতাদের দ্বারাও করতে পারতেন। করতে পারতেন নিজ কুদরত দ্বারাও। যে কুদরতের বলে চন্দ্র-সূর্য নিজ কক্ষপথ থেকে সামান্য ক্ষণের জন্যও বিচ্যূত হয় না, তেমনটি মানুষের জন্যও নির্ধারণ করতে পারতেন। কিন্তু সেটি হলে মানুষের জন্য পরীক্ষা ও পরীক্ষা পরবর্তী শাস্তি ও পুরস্কারের যে ব্যবস্থা রেখেছেন -সেটি অসম্ভব হতো। এ পৃথিবীটি তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানবকে পরীক্ষার জন্য; ফেরেশতাদের জন্য নয়। তিনি চান, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষকে নেয়ামত ভরা জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করতে। একাজ ফেরেশতাগণ করলে মানব সন্তানেরা জান্নাতের হকদার হতো কোন যুক্তিতে?
পরীক্ষায় পাশে সামর্থ্য বাড়াতে মানব জাতির উপর মহান আল্লাহতায়ালার অপার রহমতটি হলো, তিনি সত্যদ্বীনসহ লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। কিতাব নাযিল করেছেন। কি ভাবে সে পরীক্ষায় পাশ করতে হয় ও জান্নাতের যোগ্য রূপে কিভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে হয় -নবী-রাসূলদের কাজ ছিল সে জরুরি বিষয়গুলো শেখানো। এবং ঈমানদারদের কাজ হলো নবী-রাসূলদের যে শিক্ষাগুলোকে রাষ্ট্রের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও জীবন-যাপনের রীতি-নীতিতে পরিণত করা। পবিত্র কোর’আনে মুসলিমদের উপর সে অর্পিত দায়িত্বের বর্ণনাটি এসেছে এভাবে: “ওয়া কাযালিকা জায়ালনাকুম উম্মাতাও ওসাতাল লি’তাকুনু শুহাদা’আ আলান্নাস ওয়া ইয়াকুনার রাসূলু আলায়কুম শাহিদা।” অর্থ: (হে মুসলিমগণ) অতঃপর এভাবে তোমাদেরকে প্রতিষ্ঠা করলাম সত্যপন্থি একটি উম্মাহ রূপে -যাতে তোমরা সাক্ষ্য দাও সমগ্র মানব জাতির উপর এবং রাসূল সাক্ষ্য দিবেন তোমাদের ব্যাপারে। -(সূরা বাকারা, আয়াত ১৪৩)।
যে দায়ভারটি জিহাদের
মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু মহান আল্লাহতায়ালাকে বিশ্বাস করা নয়, বরং তাঁর পক্ষে প্রতি জনপদে আমৃত্যু সাক্ষ্যদানকারি হয়ে যাওয়া। তাই অন্য কোন ধর্মবিশ্বাস বা মানুষের গড়া কোন মতবাদ ও আইনের অনুসারি হওয়াটি মুসলিম জীবনে অভাবনীয়। সেগুলির পক্ষে সাক্ষীদাতা হওয়াটি হারাম। ইসলামী আক্বীদার সাথে সেটি সুস্পষ্ট বেঈমানী। কারণ সাক্ষ্যদানের অর্থ তো সেগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করা। তাই জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, সেক্যুলারিজম, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ –এসব অনৈসলামিক মতবাদে বিশ্বাসী হওয়াটি ইসলামের সাথে সুস্পষ্ট গাদ্দারী। এরূপ গাদ্দারীতে বিজয়ী হয় শয়তান এবং পরাজিত হয় ইসলাম। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে সাক্ষ্যদানের কাজটি হতে হয় পরিপূর্ণ; কোর’আনে ঘোষিত বিধানের কোন একটি বিষয়কে বাদ দেয়া এবং তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো হারাম। এবং সাক্ষ্যদানটি শুধু মৌখিক ভাবে দিলে চলে না; সেটিকে হতে হয় প্রতিটি কথা, কর্ম, লেখনি, বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি -এমনকি নিজের জীবন দিয়ে। কারণ, ঈমানের পরীক্ষাটি শুধু কথার নয়, আমলেরও। ইসলাম তাই শুধু মৌখিক বিশ্বাস চায় না, কোরবানীও চায়। কারণ, অন্যায় ও অসত্যের শয়তানী পক্ষটি কখনোই বিনাযুদ্ধে নিজেদের মিথ্যার ব্যবসাটি গুটিয়ে নিতে রাজি নয়। তারা চায়, তাদের মনগড়া মিথ্যার বিজয় এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার অব্যাহত সুযোগ। এটি নিশ্চিত করতেই তারা নিশ্চিহ্ন করতে চায় সত্যকে ও সকল সত্যপন্থিদের। মিথ্যাকে বাঁচাতে অতীতে তারা নবী-রাসূলদের মত মহামানবদেরও হত্যা করেছে। তারা যুদ্ধ করেছিল মহান নবীজী (সা:) ও তাঁর সাথীদের নির্মূলে। আরবের কাফেরগণ সে লক্ষ্যে বদর, ওহুদ, খন্দক, হুনায়ুনের ন্যায় রণাঙ্গণে বিপুল সংখ্যায় হাজির হয়েছিল। যুগ পাল্টায়, কিন্তু শয়তানী শক্তির এজেন্ডা ও স্ট্রাটেজী পাল্টায় না। ফলে মিথ্যার সাথে সংঘাত এড়ানোর পথ কখনো খোলা থাকে না। ফলে নবীজীর (সাঃ) ন্যায় অতি শান্তিপ্রিয় ব্যক্তির পক্ষেও যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়নি। তাই বাস্তবতা হলো, যেখানেই ঈমান, জিহাদ সেখানেই অনিবার্য। ফলে যে জীবনে জিহাদ নাই, বুঝতে হবে সে জীবনে ঈমানও নাই।
শয়তানী শক্তির সাথে সংঘাতময় পরিণতির কথা মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহপাকের চেয়ে আর কে বেশী জানেন? তাই পবিত্র কোর’আনে ঈমানের সাথে বার বার জিহাদ এবং সে জিহাদে জানমালের কোরবানীর কথাও বলা হয়ছে। যারা প্রাণ দেয় তারা পেশ করে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে সর্বোচ্চ কোরবানী। তাদের সে কোরবানীতে মহান আল্লাহতায়ালা যে কতটা খুশী হন -সেটিরও বার বার প্রকাশ ঘটেছে পবিত্র কোর’আনে। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে শহীদদের মর্যাদাই ভিন্ন; তাঁদেরকে মৃত বলাকে তিনি হারাম বলেছেন। তাঁদেরকে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করাবেন বিনা হিসাবে। মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় সন্মান এবং বড় বিজয় আর কি হতে পারে? মহান আল্লাহতায়ালা এমন বিজয় দিতে চান প্রতিটি ঈমানদারকে। সে বিজয়কে সুনিশ্চিত করতেই মহান আল্লাহতায়ালা ইসলাম কবুলের সাথে সাথে প্রতিটি মুসলিমকে একটি পবিত্র অগ্রিম চুক্তিতে আবদ্ধ করেন। সেটি হলো জান্নাতের বিনিময়ে ঈমানদারের জানমাল ক্রয়ের চুক্তি। সে চুক্তিটির ঘোষণা এসেছে এভাবে: “ইন্নাল্লাহা আশতারা মিনাল মু’মিনিনা আনফুসাহুম ওয়া আমওয়ালাহুম বি আন্নালাহুমুল জান্নাহ। ইউকাতেলুনু ফি সাবিলিল্লাহি, ফাইয়াকতুলুনা ও ইয়ুকতালুন।” অর্থ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মুনিদের জানমাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে এবং অতঃপর তারা নিহত হয় বা (শত্রুদের) হত্যা করে।” -(সুরা তাওবাহ, আয়াত ১১১)।
নিরপেক্ষতা যেখানে হারাম
ঈমানদার হওয়ার অর্থই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সাথে সম্পাদিত পবিত্র চুক্তির শর্ত নিয়ে বাঁচা। নইলে পুরা বাঁচাটাই হারাম পথে হয়। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন মতবাদ বা ভিন্ন শক্তির পক্ষে যাওয়া দূরে থাক, মহান আল্লাহতায়ালার সাথে এরূপ চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি কি কখনো নিরপেক্ষ থাকার কথা ভাবতে পারে? তাতে ভঙ্গ হয় সে পবিত্র চুক্তি। তাতে মহান আল্লাহতায়ালার অবাধ্যতাই শুধু হয় না, চরম অবমাননাও হয়। এটি ইসলামের এতোই মৌলিক বিষয় যে ১৪ শত বছর পূর্বের নিরক্ষর বেদূঈনগণও সেটি ষোল আনা বুঝতেন। তারা জানতেন, মুসলিম হওয়ার অর্থই ইসলামের পক্ষ নেয়া। ফলে ইসলাম ও অনৈসলামের দ্বন্দে নিরপেক্ষ থাকার বিষয়টি তারা ভাবতেই পারেননি। সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলিম বিশ্বে আজ যেটি প্রচলিত -সেটি নবীপাকের সময় যেমন ছিল না, তেমনি সাহাবায়ে কোরমের সময়ও ছিল না। এ মতবাদের জন্ম ইউরোপীয় অমুসলিমদের হাতে। সেটি জনজীবনে খৃষ্টান পাদ্রীদের অত্যাচার রুখতে। ইসলামের মৌলিক শিক্ষায় যারা অজ্ঞ, নবীজীর (সাঃ) সূন্নতের সাথে যারা অপরিচিত এবং সুস্পষ্ট ভাবেই যারা পথভ্রষ্ট -একমাত্র তারাই সেক্যুলার হতে পারে, কোন মুসলিম নয়। অপর দিকে যার জীবনে জিহাদ নাই, বুঝতে হবে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে তার কোন চুক্তিবদ্ধতাও নাই। এমন ব্যক্তির চুক্তি শয়তানের সাথে। সে তখন নিজের অর্থ, শ্রম, সময়, মেধা এবং জানের বিনিময় করে ইসলামকে পরাজিত ও শয়তানী শক্তিকে বিজয়ী করার কাজে। দেশে দেশে ইসলাম পরাজিত তো এসব মুসলিম নামধারী শয়তানপন্থিদের কারণেই।
মহান আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট নির্দেশটি যেখানে তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করায় লক্ষে সাক্ষ্যদান, অর্থদান, শ্রমদান, মেধাদান, এমনকি প্রাণদানের –সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ থাকা জায়েজ হয় কি করে? দুই শত বছরের উপনিবেশিক শাসনে মুসলিম ভূমিতে পতিতাবৃত্তি, সূদী লেনদেন, মদ্যপান, জুয়া, অশ্লীলতা, নগ্নতা ও নানারূপ পাপকর্ম যেমন বাণিজ্য ও সংস্কৃতি রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে -তেমনি ধর্মনিরপক্ষতার মত হারাম ধারণাটিও রাজনৈতিক মতবাদরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এরাই মুসলিম দেশগুলিতে শয়তানি শক্তির বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। এদের কারণেই আফগানিস্তান বা ইরাক দখলে সাম্রাজ্যবাদী কাফেরদের বন্ধুর অভাব হয় না। মুসলিমদেরকে ইসলামে অঙ্গিকারহীন ও নিষ্ক্রীয় করার লক্ষ্যে শত্রুপক্ষ এদের শাসনকেই মুসলিম দেশগুলোতে দীর্ঘায়ীত করতে চায়। এসব পাশ্চাত্য-দাসদের শাসন বাঁচাতে এরা ঘাঁটি গেড়েছে মুসলিম বিশ্বের কোনে কোনে। ইসলামের উত্থান রুখতে এরা নিরীহ জনগণের উপর গণবিধ্বংসী অস্ত্রও প্রয়োগ করছে।
মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে সাক্ষ্যদান শুধু মুসলিম হওয়ার শর্ত নয়, ঈমানের বড় পরীক্ষাও। এ সাক্ষ্যদান যেমন মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে, তেমনি শয়তানি শক্তির বিপক্ষে। দুর্বৃত্ত কবলিত সমাজে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদান বিপদ ডেকে আনে। ফিরাউনের বিরুদ্ধে যে ক’জন মিশরীয় যাদুকর ঈমান এনেছিলেন তারা ফিরাউনের বিরুদ্ধে কোন অপরাধই করেনি। সমাজে কোন অঘটনও ঘটায়নি। তারা স্রেফ হযরত মূসা (আ:) ও হযরত হারুন (আ:)’র মাবুদ মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে জনসন্মুখে সাক্ষ্য দিয়েছিল মাত্র। তাতেই তাদের হাত-পা কেটে অতি নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। একই অবস্থা হয়েছিল হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সাথে। তিনিও কারো বিরুদ্ধে কোন অপরাধ করেননি। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে শুধু সাক্ষ্যদানের কারণে তাকে আগুণে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আগুণ থেকে রক্ষা পাওয়ার পর তাঁকে দেশ ত্যাগে বাধ্য হতে হয়েছিল। নবী পাক (সাঃ)’এর সাথে যা ঘটেছিল সেগুলোও ভিন্নতর ছিল না। তাঁকেও মক্কার কাফেরদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে হিজরত করতে হয়েছিল। অবস্থা আজও ভিন্নতর নয়।
আজকের ফিরাউনগণও মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে সাক্ষ্যদানকারিদের বিরুদ্ধে একই রূপ হিংস্র ও নৃশংস। ইসলামের পক্ষ নেয়াটিও তাদের কাছে হত্যাযোগ্য অপরাধ গণ্য হয়। আলজিরিরায় ইসলামপন্থিগণ যখন নির্বাচনে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন তাদের উপর সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দেয়া হলো। লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করো হলো এবং নেতাদের বিনা-বিচারে কারারুদ্ধ করা হলো। কারণ, শয়তানি শক্তির কাছে অসহ্য ছিল ইসলামপন্থিদের বিজয়। তারা জানতো, ইসলামের বিজয়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, শিক্ষা, আইন-আদালত সবই মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে। প্রতিষ্ঠা পাবে শরিয়ত। তাই ইসলামপন্থিদের ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। আসতে দিতে চায় না ভবিষ্যতেও। একই তান্ডব ঘটানো হয়েছে মিশরে। চলছে লিবিয়াতে। চলছে সিরিয়াতেও। এসবের পিছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ। ইসলামকে পরাজিত রাখার যুদ্ধে যোগ দিয়েছে রাশিয়া ও ফ্রান্স। তাই ইসলাম নিয়ে বাঁচতে হলে কি এ সংঘাত এড়ানোর উপায় আছে?
ভিন্ন পথ নেই
আফগানিস্তানে যখন পাথরের বুদ্ধের মূর্তি ভাঙ্গা হলো -তা নিয়ে তখন বিশ্বব্যাপী শোরগোল তোলা হয়েছিল। অথচ আলজেরিয়ায় যে প্রায় দেড় লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হলো -তা নিয়ে তাদের মুখে প্রতিবাদ নেই। আল্লাহতায়ালার দ্বীন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গিকারবদ্ধ প্রতিটি মুসলমানই এভাবে পরিণত হয়েছে হত্যাযোগ্য টার্গেটে। ফলে মুসলিমগণ যতই শান্তিবাদী হোক –শত্রু শক্তির চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। তাদের এজেন্ডা সুস্পষ্ট। তারা চায়, মুসলিমগণ ভূলে যাক নবীজী (সা:)’র যুগের ইসলাম –যাতে রয়েছে ইসলাম রাষ্ট্র, শরিয়ত, জিহাদ, খেলাফত ও মুসলিম ঐক্য। তারা চায়, কোর’আন বাদ দিয়েই মুসলিমগণ ইসলাম পালন করুক। বেছে নিক, আত্মসমর্পণের পথ। কিন্তু আত্মসমর্পণের পথ তো ঈমানের পথ নয়। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো, পরিপূর্ণ ইসলাম নিয়ে বাঁচা। এবং ইসলাম নিয়ে বাঁচার অর্থই হলো ইসলাম রাষ্ট্র, শরিয়ত, জিহাদ, খেলাফত ও মুসলিম ঐক্য নিয়ে বাঁচা। নইলে মুসলমানত্ব বাঁচে না। তাই ইসলাম রাষ্ট্র ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি মুসলিমদের কাছে নিছক রাজনীতি নয়, এটি আখেরাত বাঁচানোর বিষয়। আল্লাহপাকের ঘোষণা হলো, “মাল লাম ইয়াহকুম বিমা আনযালাল্লাহু ফা উলায়িকা হুমুল কাফিরুন।” অর্থ: “আল্লাহর নাযিলকৃত আইন অনুযায়ী যারা বিচারকার্য পরিচালনা করে না -তারা কাফের।” (সুরা মায়েদা, আয়াত ৪৪)। সুরা মায়েদা, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে তাদেরকে জালেম ও ফাসেক তথা দুর্বৃত্ত বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে।
ফলে কাফের, জালেম ও ফাসেক তথা দুর্বৃত্ত শুধু মূর্তিপূজকেরাই নয়, যারা শরিয়ত অনুযায়ী দেশ শাসন করে না তারাও। অথচ মুসলিম দেশগুলোতে তাদেরই শাসন চলছে। নামায-রোযা থেকে দূরে সরলে যেমন ঈমান বাঁচে না, তেমনি ঈমান বাঁচে না শরিয়ত থেকে দূরে সরলেও। ফলে শয়তানি শক্তির সাথে সংঘাত যত অনিবার্যই হোক এবং শত্রু যত ক্ষমতাধরই হোক -কোন মুসলিম কি শরিয়ত প্রতিষ্ঠার কাজ থেকে পিছিয়ে থাকতে পারে? জান বাঁচানোর জন্য কি তারা ঈমান বর্জন করতে পারে? অনন্ত অসীম কালের জান্নাত লাভে অবশ্যই মূল্য পেশ করতে হয়। এ জীবনের অতি তুচ্ছ বস্তুটিও বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। বিনা মূল্যে কি তাই জান্নাত আশা করা যায়? দুনিয়ার সমূদয় সম্পদ দিয়ে জান্নাতের এক ইঞ্চি ভূমিও ক্রয় করা যায় না। শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে সংঘাতে অর্থদান, রক্তদান বা প্রাণদান তো সে মূল্যদানেরই প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াই হলো অতীতের নবী-রাসূল ও ঈমানদারগণের প্রক্রিয়া। এটিই হলো জিহাদ। নবী পাকের (সাঃ) সাহাবীগণ যত বৃদ্ধ, যত দরিদ্র বা যত নিরক্ষরই হোক, জিহাদে অংশ নেননি এমন নজির নেই। আশি বছরের বৃদ্ধ সাহাবীও শত্রুর সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তাই এ যুগের মুসলিমগণ জিহাদে অংশ না নিয়ে আল্লাহপাক খুশি হবেন -সেটি কি ভাবা যায়? নিছক কালেমা পাঠ ও নামাজ-রোযা আদায়ে কি সেটি সম্ভব? এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের ঘোষণা, “আম হাসিবতুম আন তাদখুলুল জান্নাতা ওয়া লাম্মা ইয়াতিকুম মাসালুল্লাযীনা খালাউ মিন কাবলিকুম মাস্সাতহুমুল বা’সায়ু ওয়া জাররায়ু ওয়া জুলজিলু হাত্তা ইয়াকুলাররাসূলু ওয়াল্লাযীনা আমানু মায়াহু মাতা নাসরুল্লাহ, আলা ইন্না নাসরুল্লাহিল কারিব।” অর্থ: তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের কাছে সে পরীক্ষার দিন এখনও আসেনি যা পূর্ববর্তী নবী রাসূলদের উপর এসেছিল। তাদের উপর এমন বিপদ-আপদ ও ক্ষয়ক্ষতি মধ্যে পড়েছিল এবং তাদেরকে এমন ভাবে প্রকম্পিত করা হয়েছিল যে, এমনকি রাসূল এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তাঁরা আওয়াজ তুলতো এই বলে যে আল্লাহর সাহায্য কোথায়? নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটবর্তী।” -(সুরা বাকারা, আয়াত ২১৪)।
সংস্কৃতি গাদ্দারীর
পরাজয়ের কারণ, মুসলিমদের সংখ্যা বাড়লেও মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে সাক্ষ্যদানকারীদের সংখ্যা বাড়েনি। বরং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাঁর এজেন্ডার সাথে চরম গাদ্দারীর। মুসলিম রূপে পরিচয় দিলেও শরিয়তী আইন যে মানুষের গড়া আইনের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর -সে সাক্ষ্যটিও তারা দিচ্ছে না। দিলে তার প্রতিষ্ঠা কই? বরং ইসলামের সাথে গাদ্দারী এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শরিয়তের পক্ষ নেওয়াকে তারা মৌলবাদ ও সন্ত্রাস বলে। ইসলামের বিজয় চাওয়াকে সাম্প্রদায়িকতা বলে। মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে শরিয়তকে। তারা ভাবে, এসব যুদ্ধ-বিগ্রহ, ক্ষয়ক্ষতি ও অশান্তির পথ। অথচ মুসলিম বিশ্ব জুড়ে আজ যে অশান্তি ও পরাজয় তার মূল কারণ তো আল্লাহর আইনের অনুপস্থিতি। দায়ী তাদের ক্ষমতালিপ্সা ও দুর্নীতি। ইসলামের যারা আত্মস্বীকৃত শত্রুপক্ষ, শরিয়তের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান সুস্পষ্ট -তাদেরকে বিজয়ী করতে এরা শুধু অর্থ ও ভোটই দেয় না, তাদের পক্ষে অস্ত্র ধরে এবং রক্তও দেয়। মহান আল্লাহতায়ালা ঈমানদারের পরিচয়ের সাথে তাদের পরিচয়টি তুলে ধরেছেন এভাবে: “যারা ঈমানদার তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে, আর যারা কাফের তারা যুদ্ধ করে শয়তানের পথে।” ফলে আল্লাহর পথে লড়াই করা ছাড়া মুসলিম থাকার আর কোন পথ খোলা আছে কি?
বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোতে মানুষ যে অর্থ, শ্রম ও রক্ত দিচ্ছে না তা নয়। বরং তাদের খরচের খাতটি বিশাল। বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে একাত্তরেও। তবে তাদের অর্থ, শ্রম ও রক্তদানে বিজয়ী হচ্ছে শয়তানী শক্তি, ইসলাম নয়। অথচ হওয়া উচিত ছিল এর উল্টোটি। ফলে পাপ শুধু ইসলামে অঙ্গিকারহীন সেক্যুলার রাজনৈতিক নেতাদেরই নয়, মুসলিম পরিচয় দানকারী সাধারণ মানুষেরও। মহান আল্লাহতায়ালার নাম ও তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করতে যখন এতো অনিহা -তাতে কে দোয়া কবুল হয়? তাই মুসলিম বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম যখন মহান আল্লাহতায়ালার কাছে আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, রোহিঙ্গা, উইঘুর বা কাশ্মিরের নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে সাহায্য চেয়ে হাত তুলেন –সে দোয়া কবুল হয়না। কারণ, দোয়া কবুলের আগে আল্লাহপাক মুসলিমদের নিজেদের বিনিয়োগটা দেখেন। অথচ সাহাবায়ে কেরামের দোয়া অতীতে কবুল হয়েছে। কারণ, ইসলামের বিজয়ে তাদের বিনিয়োগটি ছিল বিশাল। সমুদয় সম্পদই শুধু নয়, এমনকি নিজ জীবনখানি দান করতেও তারা সদাপ্রস্তুত ছিলেন। সত্যিকার অর্থেই তারা ছিলেন আল্লাহর বাহিনী তথা হিযবুল্লাহ। ফলে আল্লাহপাক তার নিজ বাহিনীর বিজয় না চেয়ে বিপক্ষ শয়তানের বিজয় সহয়তা দিবেন -সেটি কি হতে পারে? তাই সেদিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী বিশাল বিশাল শত্রুবাহিনীর উপর বিজয়ী হয়েছে। শূণ্য থেকে তারা তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সবচেয়ে সভ্যতর সভ্যতার জন্ম দিয়েছেন। তাদের হাতে পরাজিত হয়েছে রোমান ও পারসিক সাম্রাজ্যের ন্যায় দুটি বিশ্বশক্তি।
মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুত সাহায্য লাভের শর্ত হলো, তাঁর দ্বীনের বিজয়ে পরিপূর্ণ সাহায্যকারী হয়ে যাওয়া। আর এ কাজটি শুধু মুসলিম রাজনীতিবিদ ও ইসলামি সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীদের নয়, বরং প্রতিটি মুসলিমের। মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে প্রতিটি মুসলিমকে আলাদা ভাবে হাজির হতে হবে। ইসলামকে বিজয়ী করায় কার কি বিনিয়োগ -সেদিন হবে সে হিসাব দেয়ার পালা। নেতারা কে কি করছেন সে প্রশ্ন সেখানে অবান্তর। মুসলিম হিসাবে ইসলামি দলের নেতার যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি দায়িত্ব রয়েছে প্রতিটি নাগরিকেরও। অধিকাংশ মানুষ পঙ্গু নয়, নিঃস্ব নয়, শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিকল বা বোধশূণ্যও নয়। ফলে দায়শূণ্যও নয়। ইসলামের বিজয়ে যে সব সাহাবায়ে কেরাম তাদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলেন তাদের চেয়ে আজকের মুসলিমদের শারীরিক ও আর্থিক যোগ্যতা কি কম? বাড়ী-গাড়ি, বিদ্যাশিক্ষা ও বাঁচবার আয়োজন বরং তাদের চেয়ে সমৃদ্ধতর। ফলে বিচার দিনে এ প্রশ্ন উঠবেই, তাদের তুলনায় বিনিয়োগটি কই?
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে: “ছুম্মা লা’তুসআলুন্না ইওয়ামা’ইজিন আনিন্নায়ীম।” অর্থ: “অতঃপর সেদিন এ প্রদত্ত নিয়ামতের ব্যাপারে অবশ্যই প্রশ্ন করা হবে।” -(সুরা তাকাছুর, আয়াত ৮)। এ জীবন, এ মেধা, এ সময়, এ সহায়-সম্পদ – সব কিছুই মহান আল্লাহতায়ালার দান। এগুলি যেমন নিজ সৃষ্টি নয়, তেমনি কোন নেতা বা শাসকের দানও নয়। ফলে মহান আল্লাহ-প্রদত্ত এ নেয়ামত খরচ হওয়া উচিত ছিল তাঁরই রাস্তায়। অথচ সেটি বিনিয়োগ হচ্ছে ইসলামের শত্রুপক্ষকে ক্ষমতাসীন করার কাজে। মুসলিমগণ এভাবে পরিণত হয়েছে শয়তানের সাহায্যকারীতে। তাদের শ্রম, রাজস্ব ও ভোটদানের ফলেই তাদের মাথার উপর বসে আছে ইসলামের বিপক্ষ শক্তির আধিপত্য। শুধু মুখে কালেমা পাঠ করলে কি সাক্ষ্যদান হয়? সাক্ষ্য দিতে হয় প্রতিটি কর্ম, কথা ও লেখনী দিয়ে। সাক্ষ্য দিবে তাদের গড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠান। আল্লাহতায়ালা ও তাঁর দ্বীনের পক্ষে এরূপ লাগাতর সাক্ষ্যদানের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি সত্যের পক্ষে সাক্ষ্যদান তখন মোমেনের জীবনে অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন বিলুপ্ত হয় মিথ্যা। এবং পরাজিত হয় মিথ্যার পক্ষের শক্তি। সভ্যতর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র তো এভাবেই গড়ে উঠে।
বিনিয়োগ শত্রুর বিজয়ে
শুধু আয়ের পথটি হালাল হলে চলে না। ব্যয় বা বিনিয়োগের পথটিও শতভাগ হালাল হতে হয়। হারাম আয়ের যেমন কঠোর শাস্তি আছে, তেমনি কঠোর শাস্তি আছে হারাম বিনিয়োগেরও। অথচ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুসলিমদের পাপটি বিশাল। বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে তাদের অর্থ, মেধা, শ্রম এবং সময়ের বিশাল বিনিয়োগ হচ্ছে ইসলামের শত্রুপালনে ও শত্রুর বিজয়ে। এটি পাপের এক বিশাল খাত। এ বিনিয়োগের কারণেই বাংলাদেশে ইসলাম আজ পরাজিত। দেশটিতে যারা ইসলামের বিপক্ষ শক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাদেরকে অর্থ দেয় ও সমর্থণ দেয় -এমন অনেকেই যারা নামায পড়ে এবং রোযা রাখে। মুসলিম রূপে পরিচয় দিতে তাদের অনেকে গর্ববোধও করে। অথচ মুসলিমদের দায়ভার শুধু হারাম পানাহার, সূদ, ঘুষ বা মুর্তিপূজার ন্যায় পাপ থেকে বাঁচা নয়; বাঁচতে হয় হারাম রাজনীতি ও হারাম সংগঠন থেকেও। কারণ জাহান্নামে নেয়ার বাহন রূপে কাজ করে সে রাজনীতি ও সংগঠনও।
কিন্তু বাংলাদেশের মুসলিমগণ নিজেদের অর্থদান, শ্রমদান ও মেধাদানে যেসব শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়েছে – ইসলামের বিজয়ে সেগুলির অবদান কতটুকু? বরং দেশ জুড়ে ইসলামের বিপক্ষ শক্তির বিজয়ের মূল কারণ তো এগুলিই। এরূপ বিনিয়োগের কারণেই গড়ে উঠেছে শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া কর্মীর নামে একপাল পথভ্রষ্ট মিথ্যাজীবী। টানছে জাহান্নামের পথে। দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া ও আদালত তো এদের দ্বারাই পরিপূর্ণ। এ বিনিয়োগে শুধু রাষ্ট্রের ব্যর্থতাই বাড়ছে না, বাড়ছে জনগণের পাপের অংকটাও। এতে আযাব শুধু দুনিয়াতেই বাড়ছে না, প্রশস্ততর হচ্ছে আখেরাতের আযাবের পথও। মানব জীবনে এর বড় বিপর্যয় আর কি হতে পারে?
বিপদ পাওনা শাস্তির
কিসে কল্যাণ আর কিসে মহা অকল্যাণ -সে জরুরি বিষয়টিও যেন মুসলিম চেতনা থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। এ জীবন ব্যর্থ হওয়ার জন্য কি এরূপ ভাবনাশূণ্যতাই যথেষ্ট নয়? এর চেয়ে বড় আযাবই বা কি হতে পারে? তবে যারা মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত দায়ভারের কথা ভূলে যায়, এরূপ আত্মবিস্মৃতিই যে পাওনা শাস্তি -সে প্রতিশ্রুতি তো এসেছে পবিত্র কোর’আনে। শাস্তির সে প্রতিশ্রুতি শোনানো হয়েছে সুরা হাশরের ১৯ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “এবং তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা ভূলে গিয়েছিল আল্লাহকে তথা মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতাকে, অতঃপর তাদেরকে ভূলিয়ে দেয়া হলো নিজ কল্যাণ চিন্তাকে।”
মুসলিমগণ যে মহান আল্লাহতায়ালকে ভূলেছে এবং ভূলেছে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতাকে -সে প্রমাণ তো প্রচুর। সে ভূলে থাকার কারণেই বাংলাদেশের ১৭ কোটি মুসলিম নিজেদের অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগটি তাঁর শরিয়তকে বিজয়ী করার জন্য করে না। বরং তারা ভোট দেয়, অর্থ দেয় এবং রক্ত দেয় তাদের বিজয়ী করতে -যারা ইসলামকে পরাজিত রাখতে চায়। মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণ তাদের চেতনায় সামাত্যম অবশিষ্ঠ থাকলে কি এরূপ আচরণ শোভা পেত? যাদের চেতনা থেকে এভাবে বিলুপ্ত হয় মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করা এবং তাঁর নামকে বড় করার ভাবনা -তারা কি তাঁর রহমত পায়? বরং তাদেরকে তিনি ভূলিয়ে দিবেন তাদের নিজদের কল্যাণের ভাবনা এবং প্রশস্ত করবেন জাহান্নামে পথ -সেটিই তো প্রতিশ্রুত শাস্তি। সে শাস্তি যে কতটা গ্রাস করেছে সে প্রমাণই কম? যারা জান্নাতের যাত্রী, ঈমান, নেক-আমল ও জিহাদ নিয়ে বাঁচাটি তাদের জীবনে আমৃত্যু সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। আর যারা জাহান্নামের যাত্রী, তাদের সংস্কৃতি হয় পাপের প্লাবনে ভাসা। প্রশ্ন হলো, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, ফ্যাসিবাদ ও সন্ত্রাসের ন্যায় অসভ্যতার প্লাবনে ভাসাই যাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতি -তাদেরকে স্থান কি কখনো জান্নাতে হয়? মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র জান্নাত কি এরূপ পাপা ভাসা লোকদের দিয়ে পূর্ণ করবেন? ১ম সংস্করণ ২৭/০৪/২০০৭; ২য় সংস্করণ ৩১/১২/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- ভারতীয় আগ্রাসনের হুমকি: বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুরক্ষা কীরূপে?
- ভারতীয় ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
- সম্প্রতি বাংলাদেশে যা দেখলাম
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018