ভাষা-আন্দোলন: বাঙালী সেক্যুলরিস্টদের ষড়যন্ত্র ও নাশকতা
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on February 23, 2021
- Bangla Articles, ইতিহাস
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
লক্ষ্য রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক
১৯৫২’এর ভাষা-আন্দোলনের লক্ষ্য শুধু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলার স্বীকৃতি ছিল না। বরং পাকিস্তান এবং যে প্যান-ইসলামী চেতনার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তার বিনাশ এবং ইসলামী চেতনাবর্জিত বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই যে পাকিস্তান খন্ডিত হয়েছে –সে কথাটি এখন বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ, হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি ও কম্যুনিস্টগণ অতি গর্বের সাথেই বলে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হলেও ইসলামি চেতনা বিনাশের কাজটি এখনো শেষ হয়নি এবং নির্মূল হয়নি ইসলামের পক্ষের শক্তি। তাই শেষ হয়নি ভাষা আন্দোলনের নামে বাঙালীর চেতনা জগতে সেক্যুলার ধারার সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক বিপ্লবের কাজ। তাই এ আন্দোলনের একটি প্রবল আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক এজেন্ডাও আছে। এ আন্দলোনের লক্ষ্য ছিল বাঙালী মুসলিমের সাংস্কৃতিক কনভার্শন। তেমন একটি আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক এজেন্ডাকে সামনে রেখেই বাংলা ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা রূপে স্বীকৃতি পেলেও পাকিস্তান আমলেই বেগবান করা হয়েছে বাঙালী মুসলিম সন্তানদের মাঝে স্তম্ভপূজা। হিন্দুগণ মন্দিরে গিয়ে যা করে -সেটিই করা হয় ২১ ফেব্রেয়ারীতে স্তম্ভের পাদদেশে ফুল ও ভক্তি দিয়ে। ভাষা আন্দোলনের নাশকতা তাই শুধু পাকিস্তান ধ্বংসে শেষ হয়নি। এটিকে পরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে ইসলামী চেতনার বিনাশের কাজে।
ভাষা আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের দাবী, ভাষা আন্দোলন না হলে বাঙালী জাতীয়তাবাদ কখনই এতটা প্রচণ্ডতা পেত না এবং স্বাধীন বাংলাদেশও সৃষ্টি হতো না। ১৯৪৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের একতা, কল্যাণচিন্তা, ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিরূপে মুসলিমদের আবার উত্থান -এরূপ নানা স্বপ্ন মাথায় নিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সে স্বপ্নেরই মৃত্যু হয়েছে। তাই ইসলাম বিরোধী শক্তির এটি এক বিশাল বিজয়। বিজয় বেড়েছে ভারতের। বাংলাদেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, আইন-আদালত ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ইসলামপন্থীগণ যেরূপ এক পরাজিত শক্তি এবং বিজয়ী রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ইসলামের বিপক্ষ শক্তি -তার মূল কারণ তো এ ভাষা-আন্দোলন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি এক বিশাল গুণগত পরিবর্তন। উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতিতে বহু ঘটনা ঘটেছে, তবে যে ঘটনাটি ভারতের আধিপত্যবাদী হিন্দুদের প্রচুর আনন্দ জুগিয়েছে এবং সে সাথে তাদেরকে প্রচন্ড লাভবানও করেছে -তা হলো এই ভাষা আন্দোলন। এদের অনেকে ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়েও খুশি হয়েছিল। সিরাজদ্দৌলার পরাজয়কে ইংরেজদের সাথে হিন্দুগণও উৎসবযোগ্যরূপে গণ্য করেছে। কারণ, তাতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার উপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। সিরাজুদ্দৌলার চরিত্রে কালীমা লেপন করে বহু হিন্দু কবি-সাহিত্যিক বহু কবিতা, বহু উপন্যাস ও বহু নাটক লিখেছেন। অথচ সে তূলনায় মীর জাফর ও ক্লাইভের কুৎসিত রূপটি তুলে ধরা হয়েছে সামান্যই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাপদাদাগণই যে শুধু ইংরেজদের প্রশংসায় গদগদ ছিলেন তা নয়, রবীন্দ্রনাথ নিজেও ইংরেজ রাজা পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন উপলক্ষ্যে তাকে ভারতের ভাগ্যবিধাতা রূপে কবিতা লিখে প্রশংসা গেয়েছেন। “জয়ো হে, জয়ো হে, ভারত ভ্যাগ্যবিধাতা” – এ স্তুতি গেয়ে জয়োধ্বণিও দিয়েছেন। তিনি ইংরেজদর থেকে নাইট উপাধীও পেয়েছিলেন।
তবে মুসলিমগণ ১৭৫৭ সালের সে পরাজিত দুরাবস্থা থেকে গাঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারই ফল দাঁড়িয়েছিল, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে যখন থেকে ভারতে নির্বাচন দেওয়া শুরু হয়, তখন থেকে বাংলার শাসন ক্ষমতায় কোন হিন্দুকে বসতে দেইনি। অবিভিক্ত বাংলায় তিন জন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের তিন জনই ছিলেন মুসলিম। অথচ তখন মুসলিমদের সংখ্যা হিন্দুদের তুলনায় খুব একটি বেশী ছিল না। জনসংখ্যার ৫৫% হলেও অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকুরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মুসলিমদের পশ্চাৎপদতা হিন্দুদের তুলনায় ছিল বিশাল। তারপরও শতকরা ৭৫ ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত কলকাতায় বসে ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল অবধি এ ১১ বছর মুসলিম প্রধানমন্ত্রী শাসন করেছে। অবশেষে ১৯৪৭ সালে হিন্দু ও ইংরেজ উভয়ের প্রবল বিরোধীতা সত্ত্বেও লড়াই করে তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল। মুসলিমদের জন্য এ ছিল বিশাল বিজয়। কিন্তু উত্থানমুখী মুসলিমদের কোমর ভেঙ্গে দেয় ভাষা আন্দোলন। মুসলিমদের মধ্যে ভাষা ও অঞ্চল-ভিত্তিক বিভক্তি, ভাতৃঘাতি লড়াই, পাকিস্তানের ধ্বংস এবং ইসলামী চেতনা বিনাশের বীজ বপন করা হয়েছিল এ আন্দোলনে। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই প্রতিষ্ঠা পায় বাংলাদেশ। ফলে যে চেতনার ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ঘটেচে তার মৃত্যু ঘটে পূর্ব পাকিস্তানে। এ জন্যই আজ মহা আনন্দ ভারতীয় আগ্রাসনবাদীদের। কারণ, ১৯৭১’য়ে বিশ্বের সর্ব বৃহৎ মুসলিম দেশ পাকিস্তানই শুধু বিভক্ত হয়নি, বাংলাদেশও পাকাপোক্তভাবে ধরা দিয়েছে ভারতের ফাঁদে। এখন আর বেরুনোর পথ নেই। ভারত এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পেরেছে।
উৎসব শত্রু শিবিরে
নিজেদের ক্ষতিটা অনেকেই বুঝতে পারে না। তবে সে ক্ষতিটি সহজে বুঝা যায় শত্রু শিবিরে উৎসব দেখে। তাছাড়া মুসলিমদের কোন কল্যাণ হলো এবং তাতে হিন্দুগণ খুশি হবে তা কি কখনো ভাবা যায়? আধিপত্যবাদী বর্ণহিন্দুদের কুটিল ও হিংসাত্মক চরিত্রের সাথে যাদের পরিচয়টি গভীর -তাদের অভিজ্ঞতাটি আদৌও সুখের নয়। মুসলিমদেরকে তারা ভৃত্য রূপে গ্রহণ করতে রাজী, বন্ধু হিসাবে নয়। তাদের গৃহে কোন মুসলিম দৈবাৎ প্রবেশ করলে, গোবর দিয়ে না লেপলে তা পবিত্র হয়না। সেটি বুঝা যায় ভারত সরকারের নীতিতে। মুসলিমদের তারা হিন্দুদের সমান নাগরিক অধিকার দিতেও রাজী নয়। লক্ষ লক্ষ মুসলিমদের তারা বাংলাদেশী বলে তাদের বহিস্কারের ফন্দি আঁটছে। ভারতে শতকার ১৫ ভাগ মুসলিম হলে কি হবে, সরকারি চাকুরীতে শতকরা ৫ ভাগও নাই। হিন্দু সংস্কৃতি যা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তা হলো, দাঙ্গা বাধিয়ে তাদের হত্যা, ধর্ষণ ও তাদের গৃহে লুটতরাজ। হিন্দুত্ববাদীদের মিছিল-মিটিং যে স্লোগানটি অহরহ ধ্বনিত হয় তা হলো, মুসলিমদের জন্য দুটি ঠিকানা: হয় পাকিস্তকান, না হয় কবরস্থান।
কায়েদে আজম মহম্মদ তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করেন হিন্দু ও মুসলিমের মিলনের দূত রূপে। সে লক্ষ্য নিয়ে যোগ দেন কংগ্রসে। প্রখ্যাত রাজনীতিবদি সরোজীনী নাইডু তাঁকে হিন্দু-মুসলিম মিলনের দূত বলে অভিহিত করতেন। কিন্তু অচিরেই তাঁর সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ভগ্ন হৃদয় নিয়ে হিন্দুদের সম্পর্কে বলতেন, তারা “incorrigible” তথা সংশোধনের অযোগ্য। হিন্দুদের নিয়ে কাজ করেছেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব শেরেবাংলা ফজলুল হক। হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীকে তিনি তার মন্ত্রী সভায় নেন। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতাও প্রীতিকর ছিলনা। তিনি বলতেন, “কলকাতার হিন্দু পত্রিকাগুলো যখন আমার কোন কর্ম বা সিদ্ধান্তের পক্ষে লেখা শুরু করে, তখনই বুঝতে হবে সেটির দ্বারা মুসলিমদের জন্য বড় রকমের ক্ষতি আশংকা রয়েছে।” ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১’য়ে পাকিস্তানের ভেঙ্গে যাওয়া নিয়ে কোলকাতার পত্রিকাগুলো শুধু পক্ষেই লেখেনি, এখনো বছর ঘুরে প্রতি বছর ২১ ফেব্রেয়ারী এবং ১৬ ডিসেম্বর এলে কলকাতা ও দিল্লীতে উৎসব শুরু হয়। তাই মুসলিমদের ক্ষতির মাত্রা বোঝার জন্য কি কোন গবেষণার প্রয়োজন আছে? সেটি বুঝা যায় তাদের উল্লাসের মাত্রা দেখে। পরিতাপের বিষয় হলো, বাঙালী মুসলিমগণ তাদের নিজেদের কল্যাণের চেয়ে হিন্দুদের বিজয় বৃদ্ধিকেই বেশী গুরুত্ব দিয়েছে। এবং সেটি বাঙালী সেক্যুলারিস্ট জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বে। বাংলাদেশীদের কল্যাণ নিয়ে তাদের আগ্রহ নিলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর ভারতীয় সেনা বাহিনীকে লুটাপাটে নামতো? উপহার দিত কি দুর্ভিক্ষ? সমস্যা হলো, গোলামেরা কখনোই মনিবের দোষগুলো দেখে না, তাদের মনযোগ স্রেফ গোলামী নিয়ে। বাংলাদেশের মাটিতে তার নমুনা হলো বাঙালী সেক্যুলারিস্ট জাতীয়তাবাদীগণ।
ভাষা আন্দোলনে মিথ্যাচার
বাংলাদেশের ইতিহাসে অতি মিথ্যাচার হয়েছে বাংলা ভাষা ও ভাষা-আন্দোলনকে ঘিরে। ভাষা-আন্দোলন নিয়ে সবচেয়ে বড় মিথ্যাটি হলো, বাঙালীর মুখের ভাষা নাকি পাকিস্তান সরকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। এ প্রসঙ্গে যে সত্যটিকে তারা বুঝতে রাজী নয় তা হলো, দেশের অনেক গুলো ভাষার মধ্য থেকে একটিকে রাষ্ট্র বানানোর অর্থ অন্য ভাষাগুলোকে কবরে পাঠানো নয়। বাংলা ছাড়াও পাকিস্তানে পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পশতু, বেলুচ ভাষা রয়েছে। উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা বানানোর অন্য সব ভাষার কোনটিরই মৃত্যু হয়নি। বরং সেগুলোও সমৃদ্ধ হয়েছে। সে সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ঢাকার সন্তান খাজা নাযিম উদ্দীন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন আরেক বাংলাভাষী জনাব নুরুল আমীন। পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৫৪ সালে। বাংলা ভাষার উন্নয়নে বাংলা এ্যাকাডেমী ও বাংলা-উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা এবং বিদেশী ভাষার বিপুল সংখ্যক বইয়ের বাংলায় তরজমার কাজ তখনই শুরু করা হয়। বলা যায়, বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার কাজে সরকারি ভাবে পাকিস্তানের ২৩ বছরে যে কাজ করা হয় তা অতীতে হাজার বছরেও হয়নি। বাংলা ভাষার উন্নয়নে ভারতের পশ্চিম বাংলাতেও এত সরকারি বিনিয়োগ হয়নি।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে আরেক মিথ্যাচার হলো, দুনিয়ার আর কোথাও নাকি ভাষার নামে এতো রক্তদান হয়নি যা হয়েছে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রেয়ারীতে। অথচ হিন্দি ভাষাকে যখন দক্ষিণ ভারতের তামিলদের উপর চাপিয়ে দেয়া চেষ্টা হয়, বহু গুণ বেশী মানুষ প্রাণ দেয় সে চেষ্টা রুখতে। একই ঘটনা ঘটে আসামের কাছাড় ও করিম গঞ্জে। বহু মানুষ সেখানেও প্রাণ দেয় যখন বাংলা ভাষার উপর অসমিয় ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়।
সংস্কৃতি স্তম্ভপূজার
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিলেও ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন বেগবান করা হয়েছে দুটি কারণে। একটি রাজনৈতিক, অপরটি আদর্শিক। রাজনৈতিক প্রয়োজনটি ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃনা সৃষ্টির কাজে এ আন্দোলনকে ব্যবহার করা। আদর্শিক প্রয়োজনটি হলো, বাংলার মুসলমানদের মন ও মনন থেকে ইসলামি চেতনার বিনাশ এবং সে সাথে সেকুলারিজম আবাদে সেটিকে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বটে, কিন্তু সেকুলারাইজেশনের কাজ শেষ হয়নি। ফলে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে অনুষ্ঠানের প্রয়োজনও শেষ হয়নি। থেমে যায়নি প্রভাতফেরীর নামে হাজার হাজার নারীপুরুষকে একত্রে রাতের আঁধারে রাস্তায় নামানোর আয়োজন। বরং ইসলামী চেতনার দ্রুত বিকাশ এবং ইসলামী রাষ্ট্র বিপ্লবের আন্দোলন দেশে দেশে প্রবলতর হওয়ায় গুরুত্ব বেড়ে গেছে একুশে ফেব্রুয়ারির। এবং সেটি বুঝা যায় একুশে ফেব্রুয়ারি উৎযাপনের বর্তমান মাত্রা দেখে। একুশের বই মেলা পরিণত হয়েছে সেকুলার চেতনা-ভিত্তিক সাহিত্যের প্লাবন সৃষ্টির কাজে। পাকিস্তান আমলে ২১’শে ফেব্রুয়ারি পালিত হতো বছরের মাত্র একটি দিনে, এবং সেটিও মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য। এখন শুরু হয়েছে সারা দেশব্যাপী স্তম্ভপূজা। সে আমলে সেকুলার এবং বামপন্থি ছাত্র-ছাত্রীরাই শুধু ২১শে ফেব্রুয়ারিতে নগ্নপদে স্মৃতীস্তম্ভে গিয়ে ফুল চড়াতো। এসব ছাত্র-ছাত্রীরা ছিল মূলতঃ আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ও সমর্থক। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা এ থেকে সচেতনতার সাথে দূরে থাকতো। যাদের মধ্যে ইসলামের সামান্য জ্ঞান ছিল এবং ইসলামের অনুশাসন পালনে সামান্য অঙ্গিকার ছিল, স্তম্ভের সামনে দাড়িয়ে তারা এমন সম্মান প্রদর্শনকে নির্ভেজাল শিরক মনে করতো।
শহীদ শব্দের অপব্যবহার ও সাংস্কৃতিক কনভার্শন
আদর্শের জন্য প্রাণদান ইসলামে নতুন কিছু নয়, নবীজী (সাঃ)র সাহাবাদের অর্ধেকের বেশী শহীদ হয়েছেন। “শহীদ” শব্দটিও এসেছে ইসলাম থেকে। শহীদদের রক্তের বরকতেই আল্লাহর রহমত প্রাপ্তি ঘটেছিল এবং নির্মিত হয়েছিল মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে যা কিছু গর্বের তার বেশীর ভাগের নির্মাতা তারাই। বিশ্বের সকল মুসলিমদের কাছে তাই তারা সর্বকালের পরম সম্মানের পাত্র। কিন্তু ইসলামে সম্মান প্রদর্শনেরও নিজস্ব রীতি আছে। সেটি স্তম্ভ গড়ে নয়। স্তম্ভের গোড়ায় ফুল দিয়ে স্তম্ভপূজাও নয়। রাতে বা প্রভাতে নারী-পুরুষকে রাস্তায় নামিয়েও নয়। শহিদদের স্মৃতিতে স্তম্ভ গড়া সিদ্ধ রীতি হলে শুধু মক্কা-মদীনাতে নয়, মুসলিম বিশ্বের অসংখ্য শহরে হাজার হাজার স্তম্ভ গড়া হতো। সেসব স্তম্ভে বছরের একটি দিনে শুধু নয়, প্রতিদিন ফুল দেওয়া হতো। কিন্তু সেটি হয়নি। কারণ সেটি মুসলিম সংস্কৃতি নয়। ইসলামসিদ্ধও নয়। অথচ বাংলাদেশের নগরে বন্দরের প্রতিটি স্কুল-কলেজে বহু লক্ষ স্তম্ভ গড়ে সেটিকে আজ বাঙালীর সংস্কৃতি রূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এভাবে মুসলিম জীবনে শুরু হয় চরম সাংস্কৃতিক পথভ্রষ্টতা। তাই বাঙালী মুসলিম জীবনে শতভাগ হারাম রীতি চালু করা হয় ভাষা আন্দোলনের নামে। এভাবে খুলে দেয়া হয় জাহান্নামে পথ।
এ সাংস্কৃতিক ভ্রষ্টতা এসেছে আদর্শিক ভ্রষ্টতা থেকে। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে দেহব্যবসার মত ব্যাভিচার যেমন আইনগত বৈধতা পেয়েছে, তেমনি বৈধতা পেয়েছে আরেক হারাম কর্ম স্তম্ভপূজা। এমন সাংস্কৃতিক ভ্রষ্টতার পিছনে ভ্রষ্ট দর্শনটি হলো সেকুলারিজম –যার মূলকথা পরকালের ভাবনা বিলুপ্ত করে মানুষকে দুনিয়ামুখি করা। মানুষের ঢল মসজিদমুখি না করে স্তম্ভমুখি করা। বাঙালী মুসলমানদের জীবনে এভাবেই নেমে এসেছে এক ব্যাপক সাংস্কৃতিক কনভার্শন। সংস্কৃতির পথ ধরে এভাবেই চরম দুষণ ঘটেছে বাঙালী মুসলিমদের চেতনালোকে। ইসলামের শত্রুদের আজকের স্ট্রাটেজী মুসলিমদেরকে হিন্দু বানানো নয়। বরং সংস্কৃতির লেবাসে এমন সব বিশ্বাস ও রীতিনীতিতে অভ্যস্থ করা -যা ইসলামের মূল শিক্ষা থেকেই দূরে সরিয়ে নেয়। এভাবেই মুসলিমদের সরানো হচ্ছে ইসলাম থেকে। ফলে শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশে অনিবার্য পরিণতি হলো ইসলামের লাগাতর পরাজয়। এবং সেটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক অঙ্গণে।
সেক্যুলারিজমের প্রচার ও প্রভাব বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এতটাই গভীরতর হয়েছে যে, বহু ইসলামপন্থী নেতাকর্মীও সে স্রোতে ভেসে গেছে। ফলে এখন আর শুধু আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কম্যিউনিষ্ট পার্টির নেতা-কর্মীগণই নগ্ন পদে ফুলের মালা নিয়ে স্তম্ভপূজায় হাজির হচ্ছে না, হাজির হচ্ছে তথাকথিত ইসলামী আন্দোলনের অনেক নেতাকর্মীও। রাজনৈতিক বিজয়ের পাশে বাংলাদেশের সেকুলারিষ্টদের জন্য এটি হলো এক আদর্শিক বিজয়। হযরত ঈসা (আ:) ও হযরত মূসা (আ:)’র অনুসারিদের সমস্যা এ নয় যে, তারা মু্র্তিপূজায় ফিরে গেছে। বরং তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক অঙ্গণে। এবং সে পথভ্রষ্টতার কারণেই তারা বিদ্রোহী হয়েছে আল্লাহর ফরমানের বিরুদ্ধে। ফলে সমগ্র খৃষ্টান ও ইহুদী জগতে আল্লাহর বিধান আজ পরাজিত। পুরাতন টেস্টামেন্ট বা তাওরাতের বিধানগুলো তাই শুধু কেতাবেই রয়ে গেছে। একই ভাবে গভীর ভ্রষ্টতা নেমে এসেছে বাঙালী মুসলিম জীবনে।
ইন্সটিটিউশন পূজাপালনের
জনগণের মাঝে আদর্শিক বা সাংস্কৃতিক ভ্রষ্টতা সার্বজনীন করার স্বার্থেও ইন্সটিটিউশন চাই। মুর্তিপুজার ন্যায় সনাতন পথভ্রষ্টতা ও মিথ্যাচার বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে মুর্তিগড়া ও এসব মুর্তির পদতলে ফুল দেওয়া হলো হিন্দুদের ধর্মীয় ইন্সটিটিউশন। সে আচার বাঁচিয়ে রাখতে বাংলার হিন্দু সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বারো মাসে তের পার্বন। গড়া হয়েছে লক্ষাধিকর মন্দির ও পূজামন্ডপ। একই আদলে বাংলাদেশের সেকুলারিষ্টগণও ভাষা আন্দোলনের নামে বাংলাদেশের নগর-বন্দরেই শুধু নয়, গ্রাম-গঞ্জেও স্মৃতিস্তম্ভের নামে বিপুল সংখ্যায় ইন্সটিটিউশন গড়ে তুলেছে। চালু করেছে স্তম্ভপূজা। বস্তুত বাংলার সেকুলারিষ্টদের এটিই হলো সবচেয়ে শক্তিশালী ইনস্টিটিউশন। একুশের নামে প্রতিবছর যে অনুষ্ঠান হয় সেগুলীর মূল লক্ষ্য ভাষায় সমৃদ্ধি আনা নয়, বরং তা হলো, সেক্যুলার ধারণাকে আরো প্রবলতর করা এবং সে সাথে দীর্ঘজীবী করা। এমনকি ২১ ফেব্রেয়ারীর বদলে ৮ ফাল্গুনও চালু করতে পারিনি। ভাষায় সমৃদ্ধি আনা লক্ষ্য হলে, সে জন্য কি নগ্নপদে মিছিল করা ও স্তম্ভের বেদীমূলে নত শিরে ফুলদানের প্রয়োজন পড়ে? রাষ্ট্রভাষা রূপেও কি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন পড়ে? উর্দু ভাষা ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র ভাষা ছিল না। কিন্তু সে ভাষার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে সে আমলে। উর্দু ভাষায় পবিত্র কোরআনের বহু অনুবাদ ও বহু তফসির লেখা হয়েছে। বহু তরজমা ও বহু ব্যাখা লেখা হয়েছে হাদীস গ্রন্থগুলিরও। অসংখ্য গ্রন্থ্ লেখা হয়েছে ফিকাহ শাস্ত্র, নবী-জীবনী, সাহাবা-জীবনী, দর্শন ও ইতিহাসের উপর। সমৃদ্ধি এসেছে উর্দু প্রবন্ধ, কবিতা ও গজলে। কিন্তু বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম রাষ্ট্রে রাষ্ট্র-ভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরও বাংলা ভাষায় উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে? বাংলা ভাষার যা কিছু উন্নয়ন হয়েছে তা হয়েছে বাঙালী হিন্দুদের দ্বারা। এবং সে উন্নয়ন হয়েছে তখন যখন বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষা ছিল না।
বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের নামে যা কিছু হয়েছে তা মূলত হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। এমন একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এখনও অপূর্ণ থাকায় একুশে ফেব্রুয়ারী পালনে সেকুলারিষ্টদের উদ্যোগে কমতি আসছে না, বরং দিন দিন সেটিকে আরো তীব্রতর করা হচ্ছে। অথচ মনযোগ নাই বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করায়। বাংলাদেশের মানুষের চেতনার উন্নয়ন, নৈতিকতার উন্নয়ন ও বাংলা ভাষার উন্নয়ন নিয়ে পশ্চিম বাংলার একজন হিন্দুর অভিমতটি শোনা যাক। পশ্চিম বঙ্গের দেবেন্দ্র ভট্টাচার্য নামক একজন শিক্ষক ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের বাঙালীদের নিয়ে যা লিখেছিলেন তা থেকে কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। লিখেছিলেন, “…আপনাদের আর্ট-কালচার দেখেও আমি হতাশ হয়েছে। ২২ বছরে আপনারা এমন একটি বই প্রকাশ করতে পারেননি যা নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে উপভোগ করা যায়।… আমি হুমায়ুন আহমদের কয়েকটি বই পড়বার চেষ্টা করেছিলাম। রচনার মান অতি নিম্নমানের। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের জীবনের কোন সামগ্রিক চিত্র এর মধ্যে পেলাম না। শুনেছি, তিনি নাকি এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। তার কয়েকটা ছোট গল্প এবং একটা উপন্যাস পাঠ করার পর আমার ধারণা জন্মেছে, পাঠকের পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দেয়ার ক্ষমতা তার আছে। এর অধিক কিছু নেই। এরকম একজন লোক জনপ্রিয় হতে পেরেছেন এ দ্বারা এটাই প্রমানিত হয় যে, এদেশের শিক্ষার মান কত নীচু।” -(সরকার শাহাবুদ্দীন আহম্মদ, আত্মঘাতী রাজনীতির তিন কাল, বুকস ফেয়ার; ২০০৪)।
ভাষার দায়িত্ব
মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর মাধ্যম নেই। কিন্তু শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান মানুষ রূপে বেড়ে উঠার স্বার্থে মনের ভাব প্রকাশ করাটাই একমাত্র কাজ নয়। অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো জ্ঞানলাভ করাটাও। নইলে মনের ভাবেরও সভ্যতর প্রকাশ ঘটে না। তাই মাতৃ ভাষাকে শিক্ষার ভাষা, জ্ঞানের ভাষা এবং সংস্কৃতির ভাষাও হতে হয়। এ বিচারে মুসলিমদের ক্ষেত্রে ভাষার দায়িত্বটা আরো বেড়ে যায়। ভাষাকে তখন সিরাতুল মোস্তাকিম তথা জান্নাতের পথ দেখানোর দায়িত্বটা পালন করতে হয়। বান্দাহর উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর মহান রাসূল (সাঃ)’র কথাগুলোও তাই ভাষাকে শেখাতে হয়। একটি ভাষার এটিই হলো সবচেয়ে বড় দায়বদ্ধতা -যেমন খাদ্যের সবচেয়ে বড় দায়বদ্ধতা হলো পুষ্টি জোগানো। তাই খাদ্যে নিছক মুখরোচক স্বাদ থাকলেই চলে না। নিজ দেশে বা নিজ ঘরে খাদ্য না থাকলে এজন্যই বাঁচার তাগিদে খাদ্যের সন্ধানে নামতে হয়। নইলে অনিবার্য হয় মৃত্যূ। তেমনি চেতনার মৃত্যূ ও ঈমানের মৃত্যু ঠেকাতে মুসলিমকে এমন ভাষা শিখতে হয় যে ভাষায় ঈমানের খাদ্য মেলে। এমন এক দায়বদ্ধতার কারণেই লক্ষ লক্ষ বাংলাভাষী আজও আরবী শেখে। অনেকে উর্দুও শেখে। এভাবে অন্যভাষা শিক্ষার মধ্যে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে শত্রুতা কোথায়? ষড়যন্ত্রই বা কোথায়? ইসলামের জ্ঞান না থাকলে মুসলিমানের পক্ষে তখন মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাই অসম্ভব। ইসলামে জ্ঞানার্জন ফরয তো মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার তাগিদেই। মাতৃভাষা ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ না হলে তখন অন্য ভাষার সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। বাংলার মুসলিমদের একারণেই শত শত বছর ধরে প্রথমে আরবী ও ফার্সী এবং পরে উর্দু ভাষার দরবারে ছুটতে হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের বেশীর ভাগই হিন্দুদের রচিত। হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের পার্থক্য শুধু খাদ্য-পানীয়তেই নয়। দেহের খাদ্যের ন্যায় বিশাল পার্থক্য রয়েছে উভয়ের মনের খাদ্যতেও। মুসলিম নিছক সাহিত্যরস উপভোগের স্বার্থে সাহিত্য পাঠ করেনা। তাকে সে পাঠের মাধ্যমে ঈমানকেও বাঁচাতে হয়। ফলে বাঙালী হিন্দুদের রচিত বাংলা সাহিত্যে মুসলিমদের জ্ঞানগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োজন পুরণ হওয়ার ছিল না। বরং তাতে ভয়ানক ক্ষতিসাধনের ভয় ছিল। কারণ হিন্দুগণ বই লিখেছেন তাদের নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োজনে। মুসলিমদের প্রয়োজন তারা পুরণ করবে সেটি কি আশা করা যায়? বিষয়টি এমন কি কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরে পড়ে। তিনি তার এক বন্ধুকে লেখা পত্রে লিখেছিলেন, “আজকের বাঙালা ভাষা যদি বাঙালী মুসলমানদের ভাব সুস্পষ্টভাবে ও সহজ ভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম হয়, তবে তারা বাঙালা পরিত্যাগ করে উর্দু গ্রহণ করতে পারেন।” –(প্রবাসী, ১৩৪১: বৈশাখী সংখ্যা)।
বিশ্বে ভাষার সংখ্যা বহু হাজার। কিন্তু সব ভাষার কি প্রয়োজনীয় সামর্থ্য আছে? বাংলা, পাঞ্জাবী, গুজরাতি, সিন্ধি, কাশ্মিরী, পশতু, অসমীয়, তেলেগুসহ অনেক ভাষা রয়েছে দক্ষিণ এশিয়াতেও। কিন্তু এসব ভাষায় ইসলামী জ্ঞানের বিশাল ভূবন দূরে থাক, মাত্র শত বা দেড় শত বছর আগে কোরআন ও হাদীসের কোন অনুবাদও ছিল না। সমস্যা হলো কোন ভাষায় সেটি রাতারাতি গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। এ কাজে শত শত বছর লাগে। দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমগণ পূর্বে সে অভাব পুরণ করতো ফার্সী ও আরবী ভাষা শিখে। ইংরেজরা ফার্সীকে বিলুপ্ত করে দেয়। তখন উপমহাদেশের মুসলমানগণ মনযোগী হয় সম্মিলিত ভাবে উর্দু ভাষা চর্চা ও সেটিকে সমৃদ্ধ করার কাজে। তাই উর্দু ভাষার আজ যে সমৃদ্ধি তার পিছনে ভারতে বিশেষ কোন একটি প্রদেশের বা এলাকার মুসলিমদের অবদান বললে ভূল হবে। এতে অবদান রয়েছে উত্তর ভারতের মুসলিমদের সাথে দক্ষিণ ভারতের মুসলিমদেরও। অবদান রয়েছে পশ্চিম ভারতের মুসলিমদের সাথে পূর্ব ভারতের মুসলিমদেরও। এদিক দিয়ে মুসলিমগণ হিন্দুদের চেয়েও অগ্রসর ছিল। হিন্দুদের তখনও সর্বভারতীয় কোন ভাষা দূরে থাক, বর্ণমালাই ছিল না। হিন্দিতে দেবনাগরীর প্রচলন আসে অনেক পরে। তাদেরকে শব্দভান্ডার গড়ে তুলতে সাহায্য নিতে হয় সংস্কৃত ভাষার ন্যায় একটি মৃত ভাষা থেকে। অথচ মুসলিমগণ উর্দুকে সমৃদ্ধ করে আরবী ও ফার্সীর ন্যায় দুটি জীবন্ত ভাষা থেকে। ফলে উর্দু পরিণত হয় একটি প্রাণবন্ত ভাষায়। পরিণত হয় একটি প্যান-ইসলামিক ও প্যান-ভারতীয় ভাষা।
উর্দুর সামর্থ্য ও বাংলা ভাষার দৈন্যতা
ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে উর্দুই ছিল একমাত্র ভাষা যা বাংলা, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, হায়দারাবাদ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, কাশ্মির, গুজরাট, মাদ্রাজসহ সর্বভারতের শিক্ষিত মুসলিমদের প্রায় সবাই বুঝতো। কিন্তু সে মর্যাদা বাংলা ভাষার ছিল না। সিন্ধি, পাঞ্জাবী, গুজরাতী বা পশতু ভাষারও ছিল না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষার করার দাবী উঠে বস্তুত সে প্রেক্ষাপটেই। তাই এটিকে বাংলার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র বলা যায়? অথচ বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের পক্ষ থেকে সে মিথ্যাটিই লাগাতর বলা হয়ে থাকে। বাংলার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে দাবী উঠে সেটি নিছক পাকিস্তানে বাঙালীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার কারণে। কিন্তু পূর্ব বাংলার পাশাপাশি পাকিস্তানে যে আরো ৪টি প্রদেশ আছে সে বিষয়টিকে ভাষা আন্দোলনের নেতারা বিবেচনায় আনেনি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই তারা দাবী তুলেছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হলেও বাংলা ছিল নিছক একটি প্রাদেশিক ভাষা, বাংলার বাইরে তার কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এমন একটি ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করলে কি পাকিস্তান লাভবান হতো? অথচ উর্দু পাকিস্তানের কোন একটি প্রদেশের ভাষা না হলেও সব প্রদেশের শিক্ষিত মানুষেরা সে ভাষাকে বুঝতো। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থ হাছিলের লক্ষ্যে ভাষা আন্দোলনের নেতারা সে সত্যটা সেদিন বুঝতে রাজী হয়নি।
পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন কায়েদে আযম মহম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি ছিলেন গুজরাটি। উর্দু তাঁর মাতৃভাষা ছিল না। কিন্তু তাঁর নিরপেক্ষ বিচারে উর্দুর কোন বিকল্প ছিল না, কারণ উর্দুই ছিল সমগ্র পাকিস্তানের কাছে গ্রহণযোগ্য ভাষা। পাকিস্তানী নেতারা তখন পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে একটি মাত্র ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতি ছিলেন। একাধিক ভাষা রাষ্ট্রভাষা হলে তাতে সংহতি না বেড়ে বিভক্তি বাড়বে, সে আশংকা তাদের ছিল। সে বিষয়টি ভাষা আন্দোলনের নেতাগণও বুঝতেন। তাই পাকিস্তান ভাঙ্গা যাদের লক্ষ্য ছিল, ভাষা আন্দোলনের পিছনে তারা একতাবদ্ধ হয় এবং সেটিকে তারা রাজনীতির মূল হাতিয়ারে পরিণত করে। পাকিস্তানের তৎকালীন নেতারা যার আশংকা করেছিলেন ১৯৭১’য়ে সেটিই সত্য প্রমাণতি হয়েছে। সে সময়ের পাকিস্তানী নেতাদের ভূল-ত্রুটি যাই থাক, সে সত্যকে বুঝতে তারা ভূল করেননি।
কুপের ব্যাঙ সমুদ্রে ছেড়ে দিলে সে গর্তের তালাশ করে। বৃহৎ সমুদ্রে বাসে তার রুচি থাকে না। তেমনি বাঙালী জাতীয়তাবাদী নেতারাও নিজেদের বন্দী করে ভারত ঘেরা ক্ষুদ্র বাংলাদেশের চার দেওয়ালের মাঝে। তাই বাংলাদেশের ক্ষুদ্র মানচিত্রে ফিরে আসার সংগ্রামের শুরু একাত্তরে নয়, ১৯৪৭ থেকেই। সে সত্যটিই প্রকাশ পায় যখন শেখ মুজিব পাকিস্তানের জেল থেকে দেশে ফিরে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী সোহরোয়ার্দী উদ্দ্যানের জনসভায় বল্লেন, “স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরু একাত্তর থেকে নয়, সাতচল্লিশ থেকেই।” বাঙালীরা নিজেদের দেশও কখনোই নিজেরা শাসন করেনি। পাল বা সেন রাজাও বাঙালী ছিল না। ফলে বিশ্বের সর্ব বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের দায়িত্বভার হাতে নেওয়ার যে গণতান্ত্রিক সুযোগটি এসেছিল সে দায়ভার নেয়ার আগেই জোয়ালই ঢেলে দেয়। দেশের সংখ্যগরিষ্ঠ জনগণ কোন সংখ্যালঘিষ্টদের থেকে কখনো পৃথক হয়না। মুসলিমগণ ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে কখনোই ভারত থেকে পৃথক হয়ে পাকিস্তান বানাতো না। পাকিস্তান থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর পৃথক হওয়ার বিষয়টি সমগ্র মানব ইতিহাসে তাই এক বিরল দৃষ্টান্ত।
ভাষা পূজা বনাম ঈমান বাঁচানোর তাগিদ
ইমানদারকে শুধু দেহ বাঁচালে চলে না, ঈমানও বাঁচাতে হয়। নইলে জাহান্নামে যেতে হয়। ঈমান বাঁচাতে যে ভাষায় কোর’আনের জ্ঞান পাওয়া যায় মুসলিমকে সে ভাষা থেকেই জ্ঞানাহরন করতে হয়। এটি ফরজ। ভাষা পূজায় সে কাজ উপেক্ষিত হলে ঈমানের মৃত্যু ঘটে। মিশর, সূদান, আলজেরিয়া, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, ইরাক, সিরিয়া, লেবাননের ন্যায় বহু দেশের মানুষ সে ফরজ পালনের তাগিদে নিজেদের মাতৃভাষাকে দাফন করে আরবী ভাষাকে নিজেদের ভাষা এবং সে সাথে রাষ্ট্রের ভাষা রূপে গ্রহন করেছিল। কারণ তারা বুঝেছিল, মাতৃভাষা পূজায় জ্ঞানার্জনের ফরয পালন হবে না। তাতে আত্মা পুষ্টি পাবে না, ঈমানও বাঁচবে না। একমাত্র ইসলামী জ্ঞানই সন্ধান দেয় সিরাতুল মোস্তাকিমের। তখন মুক্তি আসে এ দুনিয়ায় ও আখেরাতে। নইলে ব্যর্থ হয় সমগ্র বাঁচাটাই। এ ঈমানী উপলদ্ধিটি বাংলার ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মনে ১৯৪৭’য়ের পূর্বে যেমন ছিল, ১৯৪৭’য়ের পরও ছিল। এমন একটি আত্মীক ক্ষুধা বাংলার ন্যায় পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্তপ্রদেশ ও বেলুচিস্তানের ন্যায় অ-উর্দুভাষী প্রদেশেও ছিল। ঈমানের এমন দাবীতে অনেক বাঙালী মুসলমান আরবী হরফে বাংলা লেখার চিন্তাভাবনাও করেছিলেন। তাদের যুক্তিটি ছিল, হিন্দুদের রচিত বাংলা সাহিত্য মুসলিম মানসে দুষিত চিন্তার জীবাণু ছড়াবে। পাইপ যোগে ঘরে দূষিত পানি পৌঁছতে থাকলে তাতে দেহ বাঁচে না। তেমনি ঈমানও বাঁচে না চেতনায় দূষিত দর্শনের জীবাণু পৌছতে দিলে। বাঙালী হিন্দুগণ মুসলিমদের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব করতে না পারলেও আজ সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব করছে তো এভাবেই। ফলে রবীন্দ্রনাথের মত মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু আধিপত্যবাদের কবি পরিণত হয়েছে বাঙালী সেকুলারিষ্টদের আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক গুরুতে। অথচ এই সেই রবীন্দ্রনাথ যিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কোলকাতার রাজপথে প্রতিবাদে নেমেছিলেন। তিনি জানতেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ করার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া। মুসলিম-প্রধান পূর্ববাংলার জন্য এ ছিল ব্রিটিশ সরকারের ওয়াদা। কিন্তু মুসলিমদের সে কল্যাণ সাম্প্রদায়ীক রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগেনি। ভাল লাগেনি কোলকাতার হিন্দু পত্রিকাগুলোরও। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তখন মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় বলে ব্যাঙ্গ করতো। জমিদার রূপে রবীন্দ্রনাথ নিজে রাজস্ব তুলতেন পূর্ব বাংলা থেকে। অথচ তিনি তাঁর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দু-অধ্যুষিত বোলপুরে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, যে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলার মুসলিমদের শিক্ষিত হওয়াকে পছন্দ করেননি, তার গান পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে।
হিন্দুদের রচিত মুসলিম বিদ্বেষী বাংলা সাহিত্যের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে যারা বাংলা ভাষার হরফ পাল্টানোর পরামর্শ রেখেছিলেন তাদের যুক্তি ছিল, এতে বাঁচবে বাংলার মুসলিম মানস। এবং সংযোগ বাড়বে আরবী ও উর্দুর সাথে। এতে সমৃদ্ধি আসবে বাংলা ভাষায়। তাদের কথা, হিন্দু সাহিত্য ও মুসলিম সাহিত্য এক নয়। যেমন এক নয় উভয়ের ধর্ম, জীবনবোধ ও দর্শন। উর্দু ও হিন্দির জন্ম মূলত একই ভৌগলিক এলাকায়। কিন্তু দু’টি ভাষার মাঝে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল দেওয়াল এবং সেটি শুধু বর্ণমালার নয়, শব্দ, উপমা ও দর্শনের। একই ভূমিতে জন্ম নেওয়া সত্ত্বেও উর্দু ছুটেছে আরবী-ফারসীর দিকে। আর হিন্দি ছুটেছে সংস্কৃত ভাষার দিকে। ঈমান বাঁচানোর সে তাগিদে বাংলার মুসলিমদেরও অনেকে তাই আরবী হরেফে বাংলা লেখার কথা ভাবতেন। কিন্তু সে জন্য কি পাকিস্তানকে দায়ী করা যায়? কিন্তু সেটিই হয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল -তা সত্য নয়। সেটি ছিল ধর্মপ্রাণ ও ইসলামী জ্ঞান-পিপাসু মানুষের মনের দাবী। সে দাবী ছিল ধর্মপ্রাণ বাঙালী মুসলিমদেরও। বরং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই এ বিষয়টি নানা ভাষাভাষী ভারতীয় মুসলিমদের মাঝে চিন্তাভাবনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। একই রূপ প্রয়োজনের তাগিদে ফার্সী ভাষা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পেয়েছে আফগানিস্তানে।
তবে জ্ঞানের ক্ষুধা সবার থাকে না। ক্ষুধা তো স্বাস্থ্যের লক্ষণ। স্বাস্থ্য-পতনে যেমন ক্ষুধা লোপ পায়, তেমনি ঈমানের পঁচনে লোপ পায় জ্ঞানের ক্ষুধা। বিশেষ করে ইসলামী জ্ঞানের। তখন ক্ষুধা বাড়ে অখাদ্যে। মুসলিমের ঈমানের সে পঁচনটি ধরা পড়ে জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ও সেকুলারিজমের ন্যায় বাতিল মতবাদে দীক্ষা ও ইসলামে অঙ্গিকারহীনতার মাধ্যমে। সেটি আরো প্রকট সিম্পটম রূপে ধরা পড়ে দুর্বৃত্তিতে বার বার শিরোপা পাওয়ার মধ্য দিয়ে। ঈমানের এমন প্রকট রোগে যারা আক্রান্ত তাদের মাঝে কোরআন শিক্ষায় আগ্রহ থাকবে -সেটি কি আশা করা যায়? ইসলামী জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে আরবী, উর্দু বা অন্য কোন ভাষা শেখা এজন্যই তাদের কাছে অনর্থক মনে হয়। সেক্যুলার বা বামপন্থি বাঙালীদের কাছে ভাষার গুরুত্ব বিবেচিত হয় সে ভাষায় কথা বলা, গান করা, সাহিত্য রচনা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অফিস আদালত চালানোর মধ্যে। একারণেই ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মনের আকুতিটি তারা বুঝতেই পারেনি। বরং তারা মনেপ্রাণে ভয় করতো উর্দুকে। কারণ উর্দু নিছক ভাষা ছিল না, ছিল প্যান-ইসলামিক চেতনার প্রতীক। এ ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছিল এমন শত শত প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিক, আলেম ও গ্রন্থকার, যাদের মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। উর্দু ভাষায় সবচেয়ে শক্তিশালী কবি এসেছেন পাঞ্জাব থেকে; এবং তিনি আল্লামা মহম্মদ ইকবাল। এবং সবচেয়ে শক্তিশালী গদ্য লেখক এসেছেন বাংলা থেকে; এবং তিনি হলেন মাওলানা আবুল কালাম আযাদ। অনেক প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক এসেছেন হায়দারাবাদের ন্যায় দক্ষিণ ভারত থেকে। উপমহাদেশের আর কোন ভাষায় এমন নজির নেই। এতে ফল দাঁড়িয়েছিল যেখানেই উর্দু ভাষার চর্চা বেড়েছে সেখানেই জোরদার হয়েছে প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্ব। এমন কি পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে সমগ্র ভারত জুড়ে যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপট তৈরী হয় তার পিছনেও উর্দু ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আজকের পাকিস্তানে এজন্যই সিন্ধুর জিএম সৈয়দের জাতীয়তাবাদী জিয়ে সিন্ধ আন্দোলন এবং সীমান্ত প্রদেশের খান আব্দুল গাফ্ফার খানের পখতুনিস্তান আন্দোলনও মারা পড়েছে। অথচ পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে প্রথম আন্দোলন শুরু করেছিল তারাই। বাংলার সেকুলার বুদ্ধিজীবীদের কাছে সে ইতিহাস অজানা ছিল না, তাই তারা শুধু রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি নিয়েই খুশি থাকেনি। পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ভাষার চর্চাকেও তারা রুদ্ধ করে দেয়। ফলে ভাষা আন্দোলনের নামে বাংলা ভাষার উন্নয়ন যা হয়েছে তার চেয়ে সেটি ব্যবহৃত হয়েছে পাকিস্তানের অবকাঠামোর মধ্যে বাঙালী মুসলমানের একাত্ম হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ রূপে। ফলে প্যান-ইসলামিক চেতনার বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের চেতনা পরিণত হয়েছে এক লৌহ দেয়ালে। রাষ্ট্রভাষা রূপে কোন ভাষাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অর্থ যে সে ভাষাকে মুখ থেকে কেড়ে নেওয়া নয় -সে সত্যটুকুও বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ মেনে নিতে রাজী ছিল না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে বাংলাভাষা কোন কালেই রাষ্ট্র ভাষা ছিল না। শত শত বছর ধরে ফার্সী ভাষা বাংলাদেশে রাষ্ট্র ভাষা ছিল, তখন কি বাংলাকে বাঙালীর মুখ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল? রাষ্ট্রভাষা না হওয়াতে পাঞ্জাবী, সিন্ধি,পশতু বা বেলুচ ভাষাও কি পাকিস্তান থেকে বিলুপ্ত হয়েছে? অথচ কত মিথ্যাচার না হয়েছে এবং আজও হচ্ছে এ নিয়ে।
প্রকল্প অশিক্ষিত করার
আসা যাক ইতিহাসের দিকে। দেখা যাক, বাংলার মুসলিমদের কাছে উর্দু কীভাবে গুরুত্ব পেল সে বিষয়টি। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশের হাতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হওয়ায় মুসলিমদের জীবনে যে শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছিল তা নয়, প্রচন্ড বিপর্যয় এসেছিল মুসলমান রূপে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রেও। তারা যে বাংলার অর্থনীতি, বিশেষ করে বিশ্ববিখ্যাত মসলিন শিল্পকে বিনষ্ট করার লক্ষ্যে মসলিন শিল্পিদের আঙুল কেটেছিল তাই নয়, তারা প্রকল্প নেয় মুসলিমদের অশিক্ষিত করায়। এভাবে অসম্ভব করে তুলেছিল মুসলিমদের মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। কারণ, অশিক্ষায় আর যাই হোক মুসলিম হওয়া যায়। নামায-রোযা ফরজ না করে জ্ঞানার্জন ফরজ করা হয় -জ্ঞানের সে গুরুত্বের কারণেই। ব্রিটিশদের হাতে অধিকৃত হওয়ার আগে বাংলার রাষ্ট্রভাষা এবং সে সাথে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ভাষা ছিল ফার্সী। অথচ ইংরেজ শাসকেরা ফার্সীর বদলে ইংরাজীকে চালু করে এবং ফার্সী ভাষায় জ্ঞানলাভ অসম্ভব করে। ইংরেজদের হাতে এটিই ছিল মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি। ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলায় ৪০ হাজারেরও বেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। বাংলার প্রায় সিকি ভাগ জমি বরাদ্দ ছিল সে মাদ্রাসাগুলো চালানোর খরচ জোগাতে। কিন্তু ইংরেজগণ সে জমি কেড়ে নেয়; ফলে বন্ধ হয়ে যায় মাদ্রাসাগুলো। এভাবেই ইংরেজগণ কার্যকর করে, বাংলার মুসলিমদের দ্রুত মূর্খ এবং সে সাথে দরিদ্র বানানোর প্রকল্প। তারা শুধু মসলিন শ্রমিকদের আঙ্গুলই কাটেনি, তাদের শিক্ষার ভাষাকেও নিষিদ্ধ করে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পে মুসলিমগণ ব্রিটিশদের প্রতিদ্বন্ধি হোক- সেটি তাদের কাম্য ছিল না। তাছাড়া শিক্ষা আত্মসচেনত করে, আগ্রাসনের মুখে প্রতিবাদী ও প্রতিরোধীও করে। সৃষ্টি করে জিহাদের জজবা। তাই ইংরেজদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ইসলামের জ্ঞানচর্চায় বাধা সৃষ্টি করা। জ্ঞানচর্চা থেকে দূরে সরলে, দূরে সরতে হয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতা থেকেও। এভাবেই অশিক্ষার সাথে অর্থনৈতিক দুর্গতিও নেমে আসে বাংলার মুসলিম জীবনে। এমন কি সেটি ধরা পড়েছে ব্রিটিশ শাসনামলের ইংরেজ আমলা ও লেখক ডব্লিও. ডব্লিও. হান্টারের চোখে। তিনি লিখেছেন, “যেসব মুসলমানদের পক্ষে একসময় দরিদ্র হওয়াই অসম্ভব ছিল এখন (ইংরেজ নীতির কারণে) তাদের পক্ষে স্বচ্ছল থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।”
বাংলা ভাষায় হিন্দু সাম্প্রদায়ীকতা
বাংলায় ইংরেজ শাসনের ফলে আনন্দ ও প্রতিপত্তি বেড়েছিল হিন্দুদের। সেটি মুসলিমদের বিস্তর ক্ষতির বিনিময়ে। ইংরেজগণ শুরুতেই বুঝেছিল, মুসলিমগণ কখনই তাদের বন্ধু হবে না। বরং সব সময়ই তাদেরকে হানাদার ভাববে। ফলে ভারত শাসনকে দীর্ঘায়ীত করার লক্ষ্যে তারা পার্টনারশিপ গড়ে তোলে হিন্দুদের সাথে। তখন সবচেয়ে বেশী সুবিধা পায় বাঙালী হিন্দুগণ। মুসলিমদের দাবীয়ে রাখার পাশাপাশি ইংরেজদের পলিসি হয় হিন্দুদের উপরে তোলা। এবং সেটি শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে। ইংরেজগণ তখন মুসলিম শাসনামলের ভূমি আইন পরিবর্তন করে চালু করে চিরস্থায়ী প্রথা যার ফলে সৃষ্টি হয় অর্থশালী হিন্দু জমিদার শ্রেণী। হিন্দুগণ তখন ইংরেজী ভাষা শেখার পাশাপাশি বাংলাভাষা গড়ে তোলাতেও মনযোগী হয়। বাংলাভাষার উন্নতি কল্পে ইংরেজ মিশনারীগণ গড়ে তোলে ছাপাখানা। বাংলাভাষায় সাহিত্য সৃষ্টিতে এগিয়ে আসে বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের ন্যায় বিশাল এক ঝাঁক সাহিত্যিক। তাদের সাহিত্যের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলার হিন্দুদের মাঝে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জাগরণ আনা। এসব হিন্দু সাহিত্যিকদের সাহিত্যে শব্দ, উপমা ও দর্শন সংগৃহীত হত সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেদ, রামায়ন, মহাভারত থেকে। বাংলা মুসলিমদের মাতৃ ভাষা হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুদের রচিত এ সাহিত্যে মুসলিমদের মনের খোরাক ছিল না। মিটতো না তাদের শিক্ষা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন। ফলে হিন্দুদের রচিত এ সাহিত্যে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাঙালী হিন্দুদের মাঝে রেনেসাঁ শুরু হলেও মুসলমিমদের উপর তার কোন প্রভাবই পড়েনি।
মুসলিম রেণাসাঁ ও উর্দু
অশিক্ষা ও বিপর্যয় থেকে বাঁচবার জন্য মুসলিমদেরও নিজস্ব সাহিত্য চর্চায় হাত দিতে হয়। মুসলিমদের তখন ধাবিত হতে হয় অধিকতর সমৃদ্ধ উর্দু ভাষার দিকে। কারণ, বাংলায় ফার্সী ভাষা নিষিদ্ধ হলেও উর্দু ও ফার্সীর চর্চা জোরে শোরে চলছিল দিল্লীসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে। নিছক চাকুরী ও শিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে আজ কোটি কোটি বাঙালী ইংরেজী শিখছে। এবং সে বিদেশী ভাষা শিক্ষায় শত শত ঘন্টা ব্যয়ও করছে। কিন্তু তখন বাংলার মুসলিমদের উর্দু ভাষা শিক্ষার আবশ্যকতা ছিল আরো বেশী। সেটি চাকুরীর প্রয়োজনে ছিল না, ছিল মুসলিম রূপে বাঁচার প্রয়োজনে। অনন্তু-অসীম জীবনের আখেরাত বাঁচাতে। এবং সে প্রয়োজনেই বাংলার বুকে গড়ে তোলা হয় নতুন মডেলের মাদ্রাসা। শুরু হয় উর্দু চর্চা। ১৯৩৭ সালে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির কোয়ালিশন সরকার। এরপর জোরদার হয় উর্দু শিক্ষার উদ্যোগ। ১৯৩৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক দ্বিধাহীন ভাবে ঘোষণা দেন, “আমি দৃঢ় ভাবে এ মত পোষন করি, যাদের মাতৃভাষা বাংলা, সেসব মুসলিম ছাত্রদের সবার জন্য উর্দুভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।” -(Star of India, 9 April, 1936).
এর পূর্বে ১৯৩৮ সালের ৩’রা এপ্রিল মুসলিম লীগের আসানসোল সম্মেলনে বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক মুসলিমনদের সাংস্কৃতিক সংহতির স্বার্থে উর্দুকে মুসলিম ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলক করার উপর জোর দেন। -(Star of India, 9 April, 1938. p6)। বাংলার মুসলিমদের সৌভাগ্য হলো, হিন্দুদের মাঝে রেনেসাঁ মুসলিমদের তুলনায় অনেক আগে শুরু হলেও তারা অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক শাসন ক্ষমতা হাতে নিতে পারেনি। শাসন ক্ষমতা যায় মুসলিম প্রধানমন্ত্রীদের হাতে এবং সেটি একযুগের বেশী স্থায়ী হয়। প্রধানমন্ত্রী হন জনাব ফজলুল হক, জনাব সোহরোওয়ার্দী্ ও জনাব নাজিমুদ্দিন। এবং সে সরকারের শিক্ষানীতির ফল হলো, সে সময় বাংলার বুকে শিক্ষিত এমন কোন বাঙালী মুসলিম পাওয়াই কঠিন ছিল যে উর্দু ভাষা জানতো না। অনেকে ফার্সীও জানতো। শুধু ফজলুল হক নন, উর্দুর পক্ষে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেন হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দী। তিনি বলেছিলেন, “উর্দু এবং উর্দু ও ফার্সীর বর্ণমালা হলো আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষার দুইটি লৌহ দেওয়াল।”-(Star of India, 28th April, 193)। সৈয়দ আমির আলী বলেন, “আরবী এবং উর্দু সমগ্র ইসলামী বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের আবেগ ও অনুভূতির একতা গড়ে তোলে। একতা ছাড়া আর কোথায় অধিক শক্তির সন্ধান পাওয়া যাবে?” -(The Spirit of Islam, London, 1955)।
বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন এমনকি কিছু ইংরেজ পন্ডিত ব্যক্তিও। তখন বাংলার ডি.পি. আই. ছিলেন W.W. Hornwell । তিনি লিখেন, “The question of Urdu is the question of life of death of Mohammadan education in Bengal.” –(The Mussalman, 22 June 1917, p2-3). তার বক্তব্য ছিল, মোঘল শাসনের অবসানের পর ফার্সী চর্চাকে বাংলায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। এবং বাংলার মুসলিমদের বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। অথচ সমস্যা হলো, বাংলা ভাষা হলো হিন্দুদের সাম্প্রদায়ীক ধারণা, ঐতিহ্য এবং দর্শনের ভাষা -যা মুসলিমদের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। তার অভিমত ছিল, বাংলার মুসলিমদের বাংলা শিখতে হবে -কারণ এটি তাদের মাতৃভাষা। তবে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় হলো, সংস্কৃতির ভাষা উর্দু ও ফার্সী। তিনি এ কথাও উল্লেখ করেন, “এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুভব করেই বাংলার উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মুসলিগণ উর্দু ভাষা শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।” এমন একটি উপলদ্ধি নিয়েই তিনি পরামর্শ রাখেন, বাংলার সকল মুসলিমদের জন্য উর্দু ভাষা শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হোক। এছাড়া তিনি উর্দু প্রশিক্ষণ স্কুল এবং উপযোগী উর্দু পাঠ্যবই প্রস্তুতেরও পরামর্শ রাখেন। -(The Mussalman, 22 June 1917, p 2-3)।
বাংলা সাহিত্য নিয়ে হিন্দুদের অভিমত কি ছিল সেটিও দেখা যাক। শনিবারের চিঠিতে লেখক পরিমল গোস্বামী জোরের সাথে লেখেন, “বাংলা সাহিত্য হলো মূলত বাঙালী হিন্দুদের অবদান। সেহেতু বাংলার সাথে হিন্দুর আধ্যাত্মীক সংযোগ। এবং মুসলিমগণ বাংলার উন্নয়নে কোন কাজই করেনি। সুতরাং তাদের এর প্রতি কোন দরদও নেই।”-( শনিবারের চিঠি, ১০ম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, কার্তীক ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ১৩)। এ প্রসঙ্গে জয়া চ্যাটার্জীর লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি দেয়া যাক: “বাংলার হিন্দু জাগরণের কথা লিখতে গিয়ে যদুনাথ সরকার আধুনিক বাঙলার ইতিহাসে মুসলিমদের অবস্থানকেও অস্বীকার করেন। তার কথা, আধুনিক বাঙলা হলো হিন্দু ভদ্রলোকদের সৃষ্টি। ব্রিটিশদের কাছ থেকে আহৃত দীপ্তির সাহায্যে তারা বাঙলাকে পুনরায় ভারতীয় সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে। অধিকার বলেই বাংলা তাই তাদেরই। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নব জাগরণই হলো শুধু ভদ্রলোকের সংস্কৃতির প্রতীক নয়, সেই সঙ্গে একটি হিন্দু বাঙলার, যেখানে মুসলমানের ঠাই নেই। –(জয়া চ্যাটার্জী, বাঙলা ভাগ হলো; ২০০২)
উর্দু শিক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে তখন বাংলায় গড়ে উঠে বহু সংগঠন। অনুষ্ঠিত হয় নানা শহরে সম্মেলন। ১৯১৭ সালে এমনই একটি সম্মেলন হয়ছিল বরিশালে। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বরিশাল কনফারেন্সে যে প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছিল তা হলো:
• আরবী ও ফার্সী ভাষার শিক্ষাদান ৭ম শ্রেণী থেকে নয়, ৫ম শ্রেণী থেকে শুরু করতে হবে
• যাদের মাতৃভাষা উর্দু নয় তাদের জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পরীক্ষায় উর্দুকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃত দিতে হবে।
• কোলকাতা মাদ্রাসা ও অন্যান্য মাদ্রাসার নিম্নশ্রেণীতে বাংলা ও উর্দুকে একে অপরের বিকল্প ভাষা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। -( The Mussalman, 11 May 1917 p3)।
১৯০৮ সালের ১৮ই এপ্রিলে পূর্ণিয়াতে অনুষ্ঠিত হয় মোহমেডান এডুকেশন কনফারেন্স। সে কনফারেন্সে সৈয়দ আব্দুল্লাহ সোহরোওয়ার্দী বাঙলার মুসলিমদের উর্দু শেখার প্রতি আহবান জানান। -(The Mussalman, 24 April 1908 p5.)। ১৯৩৩ সালে ২রা জুলাই কিদিরপুরে অনুষ্ঠিত হয় বেঙ্গল প্রাদেশিক উর্দু কনফারেন্স। সে অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে জনাব এস.ওয়াজেদ আলী মুসলিমদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র ও ঐক্যের উপর জোর দেন। তিনি বলেন, সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা ও জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার স্বার্থে উর্দু জরুরী।-(The Mussalman, 4 July 1933 p.9)।
বাঙালী কেন উর্দু কনফারেন্স করবে? কেনই বা উর্দুর পক্ষে কথা বলবে সেটি আজকের মত সেদিনেও অনেকের মনে উদয় হয়েছিল। তখন তার ব্যাখ্যা দিতে উর্দু সম্মেলনের জনৈক সেক্রেটারি বলেন,“উর্দু সম্মেলন বিশুদ্ধভাবে মুসলিমদের নিজস্ব ব্যাপার। তাই এটি ভিতরের আহ্বান।” -(The Mussalman, 5th July, 1933, p2)। অর্থাৎ উর্দুর প্রতি তাদের এ আগ্রহের পিছনে কোন সরকারের বা গোষ্ঠীর চাপ ছিল না। বরং তারা সেটি করেছেন নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে। পুষ্টিকর খাদ্যের সন্ধানে স্বাস্থ্য-সচেতন ব্যক্তি মাত্রই নিজ গরজে রাস্তায় নামে, কারো চাপের প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাতেও উর্দুর প্রতি এমন এক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি এক প্রয়োজনের তাগিদে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বহু বাংলাভাষী নেতা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী করেছিল তেমনি এক প্রেরণা থেকে। এমন একটি প্রেরণাকে কি পশ্চিম পাকিস্তানীদের চাপিয়ে দেওয়া ষড়যন্ত্র বলা যায়? উর্দুতো পাকিস্তানের কোন এলাকার ভাষা ছিল না। বাঙালী বুদ্ধিজীবীগণ ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গে সে বিষয়টি আদৌ সততার সাথে বিবেচনা করেনি।
উর্দু ও প্যান-ইসলামীজম
ইসলামী জ্ঞানের বিশাল ভান্ডারের পাশাপাশি উর্দু ভাষার মাধ্যমে বাংলার মুসলিমদের আরেকটি রাজনৈতিক সুবিধাও হাছিল হয়। সেটি হলো, আত্মীক সম্পর্ক গড়ে উঠে ভারতের বিভিন্ন কোণের মুসলিমদের সাথে। তখন বাংলার রাজধানী কোলকাতা পরিণত হয় উর্দু ভাষার অন্যতম কেন্দ্রে। তখন ভারতের অন্য যে কোন শহর থেকে অধিক সংখ্যক উর্দু পত্রিকা ও বই ছাপা হতো বাংলার রাজধানী কলকাতা থেকে। এ শহর থেকেই তখন প্রকাশিত হত তৎকালীন ভারতের জাগরণ সৃষ্টিকারি আল-হেলাল ও হামদর্দের ন্যায় বহু উর্দু পত্রিকা। আল-হেলালের সম্পাদক ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আযাদ। তখন তিনি খেলাফত আন্দোলনে পক্ষে জনমত গড়ে তুলছিলেন। হামদর্দের সম্পাদক ছিলেন মাওলানা মহম্মদ আলী জওহর। তিনি ছিলেন খেলাফত আন্দোলনের নেতা। এসব পত্রিকার কারণেই বাংলার মুসলিমদের মাঝেই শুধু নয়, জাগরণ আসে এবং প্যান-ইসলামী চেতনা গড়ে উঠে সমগ্র ভারত জুড়ে। ফলে মহম্মদ আলী, শওকত আলী, আবুল কালাম আযাদ পরিচালিত খেলাফত আন্দোলনে একাত্ম হতে বাংলার মুসলিমদের কোনে সুবিধা হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল অনুপ্রেরণা তো এসেছিল এই প্যান-ইসলামী চেতনা থেকেই। তাই ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো তখন রাষ্ট্র ভাষা রূপে উর্দুই প্রাধান্য পাবে -সেটিই কি স্বাভাবিক ছিল না? বরং সে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই। কিন্তু ইর্ষাকাতর বাঙালী সেকুলারিষ্টগণ সেটিকে দেখেছে বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রূপে।
মুসলিম মানসে বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের নায়কদের বড় সফলতা হলো, বাঙালী মুসলমানদের হাতে এ আন্দোলনটি একটি প্রায়োরিটির তালিকা ধরিয়ে দিয়েছে। সেটি হলো, তারা প্রথমে বাঙালী। তারপর বাংলাদেশী। এবং তারপর মুসলিম। ভাষা আন্দোলন কতটা গভীরভাবে বাংলাদেশের মুসলিমদের ডি-ইসলামাইজড করেছে এ হলো তার উদাহরণ। এটি হলো সেকুলারাইজেশনের এক চুড়ান্ত বিজয়। অথচ মুসলিমদের কাছে তার মুসলিম পরিচিতিটিই মূল। আল্লাহর কাছে বিচার দিনে একমাত্র তাঁর মুসলিম পরিচিতিটাই গুরুত্ব পাবে, বাঙালী বা বাংলাদেশী পরিচয় নয়। প্রশ্ন উঠবে,তার মুসলিম পরিচিতিটি কতটা স্বার্থক, কতটা সফল ও কতটা আপোষহীন। কে কতটা বাঙালী রূপে বাঁচলো -সে প্রশ্ন সেদিন উঠবেই না। প্রশ্ন হলো, যে পরিচয় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে গুরুত্ব রাখে না -সে পরিচয় মুসলিমের কাছে এতো গুরুত্ব পায় কীরূপে? এটি কি ঈমানের স্খলন নয়? অথচ সেটিই বাঙালী মুসলিম জীবনে প্রকট।
ভেসেছে ইসলামপন্থীরাও
ভাষা আন্দোলনের স্রোতে ভাষা থেকে এমন কি অনেক ইসলামপন্থীরাও রেহাই পাননি। প্রচন্ড স্রোত শুধু কচুরীপানাই ভাসায় না, ভাসিয়ে নেয় অনেক শিকড়ধারীদেরও। সে স্খলন যে কতটা ইসলামপন্থীদের আচ্ছন্ন করেছিল তার উদাহরণ দেওয়া যাক। ভাষা আন্দোলন নিয়ে ইসলামী জাগরণের কবি ফররুখ আহম্মদ লিখলেন, “মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা, খোদার সেরা দান”। তিনি ভূলেই গেলেন, মহান আল্লাহতায়ালার সেরাদান ভাষা নয়, সেটি হলো আল-কোরআন। ভাষা শেখাতে নবী পাঠাতে হয় না। ফেরেশতাদেরও দুনিয়াতে আসতে হয় না। অথচ কোর’আন শেখাতে ফেরেশতা ও নবীজী (সা:) পাঠাতে হয়েছে। তাই ভাষাকে খোদার সেরা দান বললে আল-কোরআনের মর্যাদাহানী হয়। মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা সিরাতুল মোস্তাকিম দেখায় না, পরকালীন মু্ক্তিও দেয় না। সে পথ দেখায় কোরআনী জ্ঞান। সবারই মাতৃভাষা থাকে। নিকোবর দ্বীপ ও পাপুয়া নিউগিনিতে এখনও যারা প্রস্তর যুগের অসভ্যতা নিয়ে জঙ্গলে বাস করছে তাদেরও মাতৃভাষা আছে। তবে যা নেই তা হলো তাদের জীবনে সিরাতুল মোস্তাকিম। তাই মায়ের ভাষাকে খোদার সেরা দান বলা যায় কি করে? মায়ের ভাষাতো পশুপাখীরও থাকে। মায়ের ভাষা অন্ধকারেও টানতে পারে, জাহান্নামেও নিতে পারে -যদি সে ভাষা ঈমানের খাদ্য না জুগায়। মায়ের ভাষা সেরা হলে মিশর, ইরাক, সিরিয়া, সূদান, আলজিরিয়া, মরক্কো, তিউনিসা, লিবিয়ার মানুষ ইসলামের প্রাথমিক যুগে কেন মাতৃ ভাষাকে কবরে পাঠালো? ফররুখ আহমদের মত ইসলামের জাগরণের কবির এরূপ কবিতা বাংলাদেশে ইসলামের পক্ষের শক্তির অনেকের মনেই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। তার এ কবিতায় বিভ্রান্ত হয়ে ভাষা আন্দোলনের ন্যায় বাংলার মুসলিম ইতিহাসের একটি আত্মঘাতি ঘটনা নিয়েও অনেকে অহংকার করতে শিখেছে।
অপর দিকে তমুদ্দন মজলিসের নেতারা নিজেদেরকে ইসলামী তাহজিব ও তমুদ্দনের সেবক মনে করেন। অথচ তারা ভাষা আন্দোলনের নামে ইসলাম-বিদ্বেষী সেক্যুলারদের দলে ভীড়ে তাদের মাঠকর্মী রূপে খেটেছেন। ডক্টর শহিদুল্লাহও বলে বসলেন, আমি প্রথমে বাঙালী, তারপর মুসলিম। অনেকের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন একজন সূফী রূপে। তিনি ছিলেন ফুরফুরার পীরের খলিফা। কিন্ত খলিফার মুখে একি কথা! তার প্রধানতম গর্ব ছিল বাঙালী হওয়া নিয়ে, মুসলিম হওয়া নিয়ে নয়। কথা হলো, এটা কি ইসলামের শিক্ষা? অথচ মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ দানটি বাঙালী বা অবাঙালী হওয়া নয়, সেটি মুসলিম হওয়া। অথচ ডক্টর শহিদুল্লাহর গর্ব বাঙালী হওয়া নিয়ে! প্রথম সারীর বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের এই হলো চিন্তা-চেতনার মান।
ইসলাম ব্যক্তিকে শুধু নামায-রোযা ও হজ-যাকাতে নিয়ত বাঁধতে বলে না। বাঁচা-মরা ও প্রতিটি চেষ্টা-প্রচেষ্টার মধ্যেও নিয়ত বাঁধতে বলে। যেমনটি হযরত ইবরাহীম (আঃ) বেঁধেছিলেন। আর সেটি হলো, “আমার নামায, আমার কোরবানী, আমার বাঁচা এবং আমার মৃত্যু –সব কিছুই রাব্বুল আলামীন মহান আল্লাহর জন্য।” হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর এমন নিয়তে মহান আল্লাহতায়ালা এতই খুশি হয়েছিলেন যে তাঁর সে কথাগুলোকে চিরকালের জন্য সকল ঈমানদারদের জন্য অনুকরণীয় করে রেখেছেন। মুসলমানের জীবনে প্রকৃত সফলতা মিলবে কে কতটা এ নিয়ত পালনে সফল হলো তার উপর। বস্তুত মুসলিম তাঁর জীবনে ভিশন, মিশন ও প্রায়োরিটি পায় এ আয়াত থেকে। তাঁর মুসলমানিত্ব নির্ভর করে এমন মিশন নিয়ে বাঁচার মধ্যে। মুসলিমের জীবনে রাষ্ট্র নির্মাণ ও রাজনীতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষা, বন্ধুত্ব ও সম্পৃতির মূল নিয়ন্ত্রক হবে এমন নিয়েত। এখানে ভাষার কোন স্থান নেই। গায়ের রং ও ভূগোলেরও কোন স্থান নেই। রোজ হাশরের বিচার দিনে মহান আল্লাহ কখনই এ প্রশ্ন করবেন না যে তোমার মাতৃভাষা কি ছিল? বরং প্রশ্ন হবে কতটুকু মুসলিম ছিলে -সেটি।
ভাষা আন্দোলনের নাশকতা
মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো ভাষা, বর্ণ, অঞ্চলের বিভেদ ভূলে প্যান-ইসলামিক হওয়া। এক্ষেত্রে ব্যর্থতার অর্থ ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠায় ব্যর্থতা। অর্থাৎ মুসলিম হওয়ায় ব্যর্থতা। প্রশ্ন হলো, যে ব্যক্তির জীবনে প্রথম প্রায়োরিটি হয় বাঙালী হওয়া, তার কাছে কি অন্য ভাষার মুসলিমের সাথে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে একাত্ম হওয়া গুরুত্ব পায়? অথচ মুসলিমদের কাজ তো নানা ভাষা ও নানা অঞ্চলের হয়েও এক দেহে লীন এক উম্মতে ওয়াহেদা গড়া। নামায-রোযা আদায়ের ন্যায় এটিও তো ফরয। কিন্তু যখন বাঙালী হওয়াটাই প্রায়োরিটি হয়, তখন ভাষাগত পরিচয়টিই রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ জীবনের বহু কিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে যায়। অভিন্ন বাংলা ভাষার নামে তখন অন্য বাঙালী -তা সে হিন্দু হোক, খৃষ্টান হোক, বৌদ্ধ হোক বা নাস্তিক হোক, তাদের সাথে একাত্ম হওয়াটাই গুরুত্ব পায়। তখন গুরুত্ব হারায় অন্য ভাষী মুসলিম ভাইয়ের সাথে একতা গড়ার বিষয়টি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের এটিই হলো সবচেয়ে বড় নাশকতা। নানা ভাষাী মুসলিমদের মাঝে একতা গড়ার ন্যায় ফরজ কাজটি তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে বাঙালীদের মনে গুরুত্ব হারায় পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। বরং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় ভারতের পশ্চিম বাংলার সাথে সম্পর্ককে ঘনিষ্টতর করা। ফলে বাঙালী মুসলিম শুধু পাকিস্তান ও উপমহাদেশের মুসলিম থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি, বরং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে মুসলিম জাহান থেকেও। তাই কাশ্মীর,ভারত বা আরাকানের মজলুম মুসলিমদের মুক্তির বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ মাথা ঘামায় না। মনে করে সেগুলো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়। নির্যাতিত ফিলিস্তিনীদের জন্যও বাংলাদেশ থেকে তেমন সাহায্য যায় না। বাংলাদেশের সেকুলার রাজনীতিতে বস্তুত এগুলো কোন প্রসঙ্গই নয়।
যখন কোন মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাষা শিখে তখন তার সাথে শুধু মুখের যোগযোগই বাড়ে না, বাড়ে আত্মার সংযোগও। তখন গড়ে উঠে আত্মীক সম্পর্কও। ভাষার মূল কাজ তো এই সংযোগই গড়া। বাংলা ভাষা চর্চার পাশাপাশি উর্দু শেখার কারণে বাংলার মানুষের যে লাভটি হয়েছিল তা হলো, উপমহাদেশের অন্য মুসলিমদের সাথে তাদের মনের সংযোগটি বেড়েছিল। সে সাথে বেড়েছিল জ্ঞানের ঐশ্বর্যও। বেড়েছিল ঔদার্যতাও। এরই ফলে বাঙালী মুসলিমগণ সামর্থ্য পায় উপমহাদশের অন্য মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ফল দাঁড়ালো, অন্য ভাষার অবাঙালী ভাইয়েরা চিত্রিত হলো ছাতুখোর দুষমন রূপে। অথচ এক মুসলিম যে অন্য মুসলিমের ভাই – সে খেতাবটি মহান আল্লাহতায়ালার দেওয়া। তাই মুসলিমগণ একে অপরের ভাই বলবে -সেটি এক অলংঘনীয় ঈমানী দায়বদ্ধতা। নইলে গাদ্দারী হয় মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশের সাথে। অথচ বাঙালী মুসলিমের মাঝে সে গাদ্দারীই প্রবলভাবে বাড়িয়েছে ভাষা আন্দোলন। এভাবে ছিন্ন করা হয় পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মাঝে প্যান-ইসলামী বন্ধন। অথচ এটি শুধু রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক অপরাধই নয়, ইসলামের দৃষ্টিতে হারামও। এমন বিচ্ছিন্নতাই যে কোন মুসলিম জনপদে আল্লাহর আযাব অনিবার্য করার জন্য যথেষ্ট। এরূপ আযাবের জন্য পুতুল পূজার প্রয়োজন নেই। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে পবিত্র কোর’আনে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে, “এবং তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা সুস্পষ্ট ঘোষণা আসার পরও পরস্পরে মতভেদ ও বিভক্তি গড়লো। তারাই হলো সে সব ব্যক্তি যাদের জন্য রয়েছে বিরাট আযাব। -(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১০৫)।
মহন আল্লাহতায়ালা শুধু একতা গড়াকেই ফরয করেননি, এভাবে হারাম করেছেন বিভক্তি গড়াকেও। তাই ঈমানদার ব্যক্তি শুধু নামায-রোযাতেই মনযোগী হয় না, অতি একনিষ্ঠ হয় মুসলিমদের মাঝে একতা গড়তে এবং অতিশয় সচেষ্ট হয় বিভক্তি এড়াতেও। এমন এক সমৃদ্ধ ইসলামি চেতনার কারণেই ১৯৪৭’য়ে বাংলার মুসলিমগণ অন্যভাষী মুসলিমদের সাথে একত্রিত হয়ে পাকিস্তান গড়েছিল। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের নাশকতায় সেটি বিলুপ্ত হয়েছে। এরই ফল হলো, বাঙালী মুসলিমের মাঝে আজ থেকে শত বছর আগে যে চারিত্রিক, নৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুণ ছিল -তা আজ আর বেঁচে নাই। শত বছর আগে অন্ততঃ অন্য ভাষা, অন্য বর্ণ ও অন্য ভূগোলের মুসলিমদের ভাই বলার ঈমানী সামর্থ্য ছিল; এবং তাদের সাথে একত্রে রাজনীতি করা এবং কাফের শত্রুর বিরুদ্ধে একত্রে যুদ্ধ করারও আগ্রহ ছিল। এখন সেটি বিলুপ্ত। অন্য ভাষার মুসলিমদের সাথে শুধু ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতাই বাড়েনি, বেড়েছে মনের দূরত্বও। দিন দিন সেটি আরো গভীরতর হচ্ছে। অপর দিকে ভারতীয়দের ন্যায় কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব উৎসবে পরিণত হয়েছে। এবং সে সাথে উৎসবে পরিণত হয়েছে অবাঙালী মুসলিমদের সাথে বিচ্ছিন্নতার দিনগুলোও। তাই ১৯৫২’য়ের ভাষা আন্দোলন শুধু বাঙালীর মুসলিমের রাজনৈতিক ভূগোলই পাল্টে দেয়নি, পাল্টে দিয়েছে মনের ভূগোলও। এবং তা অসম্ভব করছে প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। ১ম সংস্করণ ২১/১২/২০১৭; ২য় সংস্করণ ২৩/০২/২০২১।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- Why not the Muslims Should Suffer from Slavery & Subjugation?
- বাঙালি মুসলিম জীবনে মতবাদী রাজনীতির নাশকতা
- বাংলাদেশের বিপদ ও সম্ভাবনা
- সংগঠিত হতে হবে সংগঠন ছাড়াই
- পতিত হাসিনার দুর্বৃত্তায়ন ও হিন্দুত্বায়ন প্রকল্প এবং বাঙালি মুসলিম জীবনে নাশকতা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018