বাঙালী মুসলিম জীবনে ভ্রষ্টতা ও বিপর্যয়

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 প্রসঙ্গ: সাফল্য ও ব্যর্থতা

পার্থিব জীবনটাই বিরামহীন এক পরীক্ষাপর্ব। পরীক্ষায় ফলাফল মিলবে জান্নাতে অথবা জাহান্নামে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা: “(তিনিই সেই মহান আল্লাহ) যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন -এ জন্য যে তিনি দেখবেন তোমাদের মধ্যে কে আমলে উত্তম।”–( সুরা মুলক, আয়াত ২)। এ পরীক্ষা নিয়ে যে ঘোষণাটি সুরা বাকারায় এসেছে তা হলো: “এবং আমরা অবশ্যই পরীক্ষা করবো ভয়, ক্ষুধা এবং জান, মাল ও ফসলের ক্ষতি দিয়ে, তবে সুসংবাদ তাদের জন্য যারা ছবর করলো।” ফলে মানব জীবনে যা কিছু ঘটে -সে গুলো মূলত অনিবার্য সে পরীক্ষাকে সুচারু ভাবে সমাধা করার লক্ষ্যে। কখনো সেটি আসে বিপুলে শক্তি ও সম্পদের প্রাচুর্য নিয়ে, কখনো বা আসে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিয়ে। কখনো বা আসে রোগ-ভোগ ও জুলুম-নির্যাতন নিয়েও। পরীক্ষা যেমন জালেম শাসকের জীবনে আসে, তেমনি আসে দরিদ্র ও নির্যাতিতের জীবনেও। কেউ সে পরীক্ষায় পাশ করে, আবার অনেকেই ফেল করে। মানব জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ভর করে মূলত সে পরীক্ষায় পাশ ও ফেলের উপর। ফলে মানব জীবনে এ পরীক্ষার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নাই। সফল তো তারাই হয় -যারা সে পরীক্ষাকে পরীক্ষা রূপে গ্রহণ করে এবং পাশের জন্য জীবনের সমগ্র সামর্থ্যকে বিনিয়োগ করে।

এজন্যই শতসিদ্ধ সত্যটি হলো, এ জীবনে যা কিছু ঘটে -তা নিজে থেকে ঘটে না। সেটি ঘটে সুনির্দিষ্ট একটি পরীক্ষা পর্বকে সমাধা করা প্রয়োজনে। সেটি ঘটে মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা অনুযায়ী। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কেউ যেমন জন্ম নেয় না, তেমনি কারো উপর কোন বিপদও আসে না। পবিত্র কুর’আনে সে ঘোষণা এসেছে এভাবে: “আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন বিপদ-মুছিবতই তোমাদের স্পর্শ করতে পারে না।” –(সুরা তাগাবুন, আয়াত ১১)। একই রূপ ঘোষণা এসেছে সুরা হাদীদে। বলা হয়েছে, “পৃথিবী পৃষ্টে এবং তোমাদের ব্যক্তি জীবনে যে বিপদগুলি আঘাত হানে, সেগুলি ঘটবার পূর্বেই তা আমরা লিপিবদ্ধ করে থাকি, নিশ্চয়ই সেটি আল্লাহর নিকট সহজ।” -(সুরা হাদীদ, আয়াত ২২)।  তাই মানব জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনার বিচার বিশ্লেষণে ও তা থেকে শিক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো পবিত্র কুর’আনের উপরুক্ত ঘোষণা। তাই জীবনে যে বিপদগুলো ঘটে -সেগুলো দেখতে হবে এবং মোকাবেলা করতে হবে নিজের উপর অর্পিত পরীক্ষায় পাশের প্রেরণা নিয়ে। সে পরীক্ষায় পাশ জুটে সে বিপদে ধর্য্য ধরা এবং সামর্থ্য দিয়ে তা মোকাবিলা করায়। 

মহান আল্লাহতায়ালা চান, তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব এ পরীক্ষায় পাশ করুক এবং জান্নাতের বাসিন্দা হোক। তাই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তিনি গোপন করেননি। বরং বার বার জানিয়ে দিয়েছেন। এবং পবিত্র কুর’আনের বিশাল ভাগ জুড়ে বিবরণ দিয়েছেন সে সব মানব সন্তানদের যারা পরীক্ষায় ভাল ভাবে পাশ করেছেন। এবং বিষদ বিবরন দিয়েছেন তাদেরও যারা শোচনীয় ভাবে ফেল করেছে। সে কথাও বার বার তুলে ধরেছেন, কেন তারা ফেল করেছে। এভাবে বিশ্ববাসীর সামনে তিনি পেশ করেছেন সফল ও বিফল হওয়া মানুষের মডেল। এবং আজাদী দিয়েছেন সে দুটির যে কোন একটি বেছে নেয়ার। এক্ষেত্রে মানব জাতির জন্য অতি শিক্ষণীয় হলো বনি ইসরাইলের ইতিহাস। তারাই হলো মানব ইতিহাসের অতি ব্যর্থ ছাত্র। যারা ব্যর্থ হতে চায় -তার হচ্ছে সে পথে চলার মডেল। মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে নানা ভাবে পরীক্ষা করেছেন। তাদের মাঝে শত শত নবী পাঠিয়েছেন এবং আসমানি কিতাবও দিয়েছেন। এসব ছিল তাদের জন্য বিশাল নিয়ামত; কিন্তু তা থেকে তারা কোন ফায়দাই নিতে পারিনি।  

বনি ইসরাইলীদের জীবনে নিদারুন দাসত্ব ও নির্যাতন এসেছিল। ফিরাউন তাদের পুরুষদের হত্যা করতো। মহিলাদের জীবিত রাখতো এবং দাসী রূপে তাদের ব্যবহার করতো। পবিত্র কুর’আনে বলা হয়েছে, তাদের উপর সে বিপদগুলো এসেছিল পরীক্ষা নেয়ার জন্য। পরীক্ষা নেয়া হয় প্রমোশন দেয়ার জন্য। বনি ইসরাইলীগণ সে পরীক্ষায় পাশ করলে তারা নিশ্চয়ই বিশাল পুরস্কার পেত –যেমন পেয়েছিলেন নবীজী (সা:)’র সাহাবীগণ। কিন্তু সে পরীক্ষাতে তারা শোচনীয় ভাবে ফেল করেছিল। নিদারুন নির্যাতনের মধ্যে থেকেও তাদের মাঝে সে দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভাবে বাঁচার আগ্রহ জাগেনি। মুক্তির জন্য তারা জিহাদ করেনি। বরং বহু ইহুদী ফিরাউনের জুলুমে সহযোগিতা করেছে।

তাদের সে ব্যর্থতার পরও মহান আল্লাহতায়ালা হযরত মূসা (আ:) ও তাঁর ভাই হযরত হারুন (আ:)কে পাঠিয়ে ইহুদীদেরকে ফিরাউনের নির্যাতন থেকে মুক্তি দেন। তাদেরকে রক্ষা দিতে সাগর বিভক্ত করে রাস্তা করে দেন। ফিরাউনের বাহিনীকে সমুদ্রে ডুবিয়ে হত্যা করেন। ফিরাউনের বিশাল সম্পদকে তুলে দেন বনি ইসরাইলীদের হাতে। খাদ্য ও পানি শূণ্য সিনাই মরু উপত্যাকায় বহু লক্ষ ইহুদীকে তিনি আসমান থেকে মান্না ও সালওয়া পাঠিয়ে খাইয়েছেন। সূর্যের উত্তাপ থেকে বাঁচাতে তাদের মাথার উপর তিনি ঘন মেঘের সামিয়ানা লাগিয়ে দেন। পাথর খন্ড চিরে দশটি গোত্রের জন্য পানির ১২টি ঝরণা প্রবাহিত করেন। কিন্তু এতো সব নেয়ামত দেয়ার পরও যখন তাদেরকে হুকুম দেয়া হলো, ফিলিস্তিনে গিয়ে সেখানকার জালেম শাসককে উৎখাত করে সেভূমিতে আল্লাহতায়ালার দেয়া শরিয়ত মোতাবেক ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের –তখন সে হুকুমের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করে। তারা জিহাদে রাজী হয়নি; পরিচয় দিয়েছে নিরেট কাপুরুষতার। বরং চরম ঔদ্ধত্য নিয়ে বলেছিল, “হে মূসা (আ:)! তুমি এবং তোমার আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ করো, আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।” তাদের সে আচরণে হযরত মূসা (আ:) এতোটাই আঘাত পেয়েছিলেন যে ফরিয়াদ তুলেছিলেন, “হে আল্লাহ! একমাত্র আমার ভাই হারুন (আ:) এবং আমি ছাড়া আর কারো উপর আমার কোন এখতেয়ার নাই।” এভাবেই বনি ইসরাইলীরা ব্যর্থ করে দেয় হযরত মূসা (আ:)’য়ের ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ ও সেখানে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তার শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠার মিশন। তারা সেদিন গাদ্দারী না করলে যে ইসলামী রাষ্ট্র হযরত মহম্মদ (সা:) প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন তা সেদিনই প্রতিষ্ঠা পেত। তাদের সে গাদ্দরী তাদের উপর নিদারুন শাস্তি নামিয়ে আনে। তাদের উপর চাপানো হয় ইজ্জতহীন, শক্তিহীন ও নির্যাতিত ভবঘুরের জীবন। পবিত্র কুর’আনে তাদের সে গাদ্দারীর বিবরণ একাধিক বার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আগামী দিনের মানুষদের এই মর্মে সাবধান করা হয়েছে, তারা যেন তাদের ন্যায় গাদ্দারীর পথ বেছে নেয়। গাদ্দারীর জীবনের পরীক্ষায় কৃতকার্য করে না, বরং আযাব আনে।

ঈমানের পরীক্ষা শুধু কথা, কর্ম, চরিত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আচার-আচরণে হয় না, বরং চুড়ান্ত পরীক্ষাটি হয় রাজনীতির অঙ্গণে। বনি ইসরাইলীগণ যে মহান আল্লাহতায়ালা ও হযরত মূসা (আ:)’কে অবিশ্বাস করতো -তা নয়। তারা শুধু বিশ্বাসই করতো না, বরং হযরত মূসা (আ:)’র উপর নাযিলকৃত কিতাব তাওরাতকেও বিশ্বাস করতো এবং সে কিতাব পাঠও করতো। কিন্তু তাদের গাদ্দারী ছিল ইসলামের রাজনৈতিক প্রকল্পের সাথে। তারা সেটিকে কোন রাষ্ট্রে বিজয়ী করতে রাজী ছিল না। রাজী ছিল না শয়তানী শক্তির শাসন নির্মূল করে মহান আল্লাহতায়ালার জমিনে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তার শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠা দিতে। অথচ মুসলিমের দায়বদ্ধতা হলো, তাকে যুদ্ধ করতে হয় তাঁর মহান প্রভূর প্রতিটি হুকুমকে প্রতিষ্ঠা দিতে। জিহাদ তাই মুসলিম জীবনে অনিবার্য। এখানে অবাধ্যতা হলে সে আর মুসলিম থাকে না। সে তখন আযাবের যোগ্য বিবেচিত হয়। সেরূপ সে অবাধ্যতাই বনি ইসরাইলের উপর আযাব নামিয়ে আনে। শাস্তি স্বরূপ ফিলিস্তিনে প্রবেশ করা তাদের জন্য হারাম করা হয়। ফলে উদ্বাস্তুর বেশে ঘুরতে হয় বিভন্ন দেশের জনপদে।

 

বাঙালী মুসলিমের গাদ্দারী

ইসলামের পরাজয় এবং ইসলাম বিরোধী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ নিয়ে বাঁচাটি আদৌ ঈমানদারী নয়। সেটি মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে প্রচণ্ড গাদ্দারী। বাঙালী মুসলিমের বিশাল ব্যর্থতাটি এখানেই। বাংলাদেশী মুসলিমদের উপর আজ যেরূপ চোরডাকাত, ভোটডাকাত এবং গুম-খুন-নির্যাতন ও সন্ত্রাসের নায়কদের শাসন -সেটি শুধু আযাবই নয়, বিশাল এক পরীক্ষাও। পানিতে পড়লে সেখানে ডুবে মরাতে কোন কৃতিত্ব নাই। বরং কৃতিত্ব তো সাঁতার কেটে বেরিয়ে আসায়। মহান আল্লাহতায়ালা দেখতে চান বাঙালী মুসলিমগণ দুর্বৃত্ত শাসনমূক্ত সভ্য জীবনে কতটা রুচি রাখে এবং কতটা আগ্রহী ইসলাম ও তার শরিয়তী বিধান নিয়ে বাঁচায়। এখানে ব্যর্থ হলে তাদের অবস্থা যে বনি ইসরাইলের মতই হবে –তা নিয়ে কি সামান্যতম সন্দেহ থাকে? কারণ বিদ্রোহীদের বিজয় দেয়া নয়, বরং শাস্তি দেয়াই মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। পবিত্র কুর’আনে বনি ইসরাইলের কাহিনী বার বার উল্লেখ করা হয়েছে বস্তুত সে হুশিয়ারীটি শুনিয়ে দেয়ার জন্যই।

মানুষ যা বিশ্বাস করে –সেটিই তা তার ঈমান। এবং যে ভাবে বাঁচে -সেটিই তার সংস্কৃতি। ঈমান সরাসরি দেখা যায় না; কারণ, সেটি অন্তরের বিষয়। কিন্তু ঈমান দেখা যায় সংস্কৃতির মধ্যে। তাই সংস্কৃতির মাঝে ধরা পড়ে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের প্রতি আনুগত্য ও বিদ্রোহের স্বরূপ। প্রতিটি পাপ, প্রতিটি দুর্বৃত্তি, আল্লাহর হুকুমের প্রতিটি অবাধ্যতাই হলো আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা যেমন প্রকাশ পায় বেপর্দাগী, ব্যাভিচার, অশ্লিলতা, নাচগান, মদ্যপান, মাদকাশক্তি, সন্ত্রাস, দূর্নীতি, ইত্যাদির ব্যাপক বৃদ্ধিতে, তেমনি প্রকাশ পায় কুর’আন শিক্ষা, শরিয়তের প্রতিষ্ঠা, সূদমূক্ত ব্যাংক ও ইসলামী অর্থনীতি ইত্যাদি কুর’আনী বিধান প্রতিষ্ঠা না দেয়াতে। জনজীবনে বিদ্রোহের সে প্রবল রূপটি দেখা যায় রাজনীতির মধ্য। বিদ্রোহের সে হারাম রাজনীতিটি হলো, ভাষা ও দেশভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, ফ্যাসিবাদ, সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠা নিয়ে বাঁচা। বাঙালী মুসলিম জীবনে বিদ্রোহের সে রূপটি যে অতি প্রবল –তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? সেটি দেখা যায় রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিজয়, জনজীবনে দুর্নীতির প্লাবন এবং দেশটির উপর ভোটডাকাত দুর্বৃত্তদের অধিকৃতি থেকে।

 

সৈনিক শত্রু শক্তির  

বাংলাদেশের উপর শত্রু শক্তির অধিকৃতি শুধু রাজনৈতিক নয়, সেটি যেমন আদর্শিক তেমনি সাংস্কৃতিক। তারা জানে,  মুসলিমদের শক্তির উৎস তেল-গ্যাস নয়, জনশক্তিও নয়। সেটি হলো ঈমান। এবং ঈমান গড়ে উঠে এবং পুষ্টি চায় কুর’আন ভিত্তিক জ্ঞান থেকে। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা সর্ব প্রথম ফরজ করেন কুর’আনের জ্ঞানার্জন, নামাজ-রোজা নয়। মুসলিম সংস্কৃতির নির্মাণে তাই কুর’আনী জ্ঞানের প্রভাবটি বিশাল। এজন্যই শত্রুপক্ষের আগ্রাসনের শিকার শুধু মুসলিম দেশের ভূগোল নয়, বরং মূল টার্গেট হলো পবিত্র কুর’আন। তারা বিলুপ্ত করে কুর’আনের জ্ঞানচর্চা। এজন্যই ইসলামের বিদেশী শত্রুপক্ষ বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলোতে বোমা বা যুদ্ধ বিমান নিয়ে হাজির হয়নি। তাদের যুদ্ধটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে। বাঙালী মুসলিমদের অপরাধ, তারা সে যুদ্ধে শত্রু শক্তির সৈনিকে পরিণত হয়েছে। তারা সৈনিক রূপে খাটছে কাফেরদের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হাজার হাজার এনজিওতে। তাদের উপর অর্পিত দায়ভারটি হলো, বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতিকে ইসলামের শিক্ষা ও দর্শন থেকে মূ্ক্ত করা। তাই মক্তব ও মাদ্রাসার পাশে তারা সেক্যুলার স্কুল খুলেছে। সেখানে শেখানো হচ্ছে নাচ-গান। মহিলাদের ঘর থেকে বের করে রাস্তায় মাটি কাটা ও তূত গাছ পাহারায় লাগিয়েছে। এভাবে তাদেরকে বেপর্দা হতে বাধ্য করছে। অপর দিকে মাইক্রোক্রেডিটের নামে সাধারণ মানুষকে সূদ দিতে ও সূদ খেতেও অভ্যস্থ করছে। অথচ সূদ খাওয়া বা সূদ দেওয়া –উভয়ই হলো আল্লাহতায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট যুদ্ধ। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে বিদ্রোহ করতে তারা যে সাফল্য দেখিয়েছে তা ইংরেজগণ তাদের ১৯০ বছরের শাসনেও অর্জন করতে পারিনি।

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সেক্যুলারিস্টগণ তাই চায়, যা তাদের সেক্যুলারিস্ট আন্তর্জাতিক প্রভুগণ চায়। মুসলিম বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী কোয়ালিশনের এজেন্ডাটি বুঝা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আফগানিস্তান দখল ও সেখানে চালু করা তাদের কার্যক্রম থেকে। পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ সেখানে মুসলিম সংস্কৃতির বিনাশে হাত দিয়েছিল। তাদের দৃষ্টিতে আফগান মুসলিমদের অপরাধ, অতীতে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের ন্যায় দুটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করেছে। এবং সেটি ইসলামী দর্শন ও সে দর্শন-নির্ভর আপোষহীন জিহাদী সংস্কৃতির কারণে। সে অভিন্ন দর্শন ও দর্শনভিত্তিক সংস্কৃতির বলেই তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে ২০টি বছর যুদ্ধ করেছে এবং অবশেষে তাদের পরাজিত করতে পেরেছে। ফলে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ সে দর্শন ও সে দর্শন-ভিত্তিক সংস্কৃতির নির্মূল চায়। দখলকালীন সে সময়ে নির্মূলমুখী স্ট্রাটেজীর পাশাপাশি বিপুল বিনিয়োগ করছে সেক্যুলার দর্শন ও সেক্যুলার সংস্কৃতির নির্মাণে। সে লক্ষ্য পূরণে গড়ে তুলছে অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তারা এটি করছে সিভিল সোসাইটি গড়ে তোলার নামে। উদ্দেশ্য হলো, ইসলামের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধটি তারা নিজেরা করছে, সেটি যেন তাদের পক্ষ হয়ে দেশী প্রতিষ্ঠানগুলো করে। আফগানিস্তানে লক্ষ লক্ষ শিশু এখনো নানা রোগভোগে মারা যাচ্ছে। তা থেকে বাঁচানোয় তাদের বিনিয়োগ সামান্যই। অথচ শত শত মিলিয়ন ডলার খরচ করছে শিশুদের নাচগান শেখাতে। বিবাহের বয়স বাড়ানোর সাথে সহজতর করা হয়েছে ব্যাভিচারের পথকে। এসবই হলো জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কৌশল।

বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিশরের মত দেশে অতীতে একই রূপ স্ট্রাটেজী নিয়ে কাজ করেছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকেরা। এদেশগুলির উপর তাদের দীর্ঘ শাসনমামলে তেমন কোন শিল্প কলকারখানা বা প্রযুক্তি গড়ে না উঠলেও তারা দেশগুলির শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রচণ্ড সেক্যুলার করেছিল। প্রতিটি শহরে গড়েছিল পতিতাপল্লী । গড়েছিল সুদী ব্যাংক। এভাবে সাংস্কৃতিক কর্মের নামে বাড়িয়েছে ইসলামী বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভ্যাস। ঔপনিবেশিক শক্তির পক্ষ থেকে সৃষ্ট সেক্যুলারিজমের প্লাবনের ফলেই জনগণের মন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে ঈমানী দায়বদ্ধতা। ফলে বাংলাদেশ, মিশর, পাকিস্তান বা তুরস্কের মত দেশে আল্লাহর আইন তথা শরিয়ত প্রতিষ্ঠা রুখতে কোন কাফেরকে অস্ত্র ধরতে হয়নি। সেকাজের জন্য বরং মুসলিম নামধারি সেক্যুলারিস্টগণই যথেষ্ঠ করিৎকর্মা প্রমাণিত হচ্ছে। ইসলামের উত্থান রুখার এটিই সফল মডেল। মার্কিন দখলদার বাহিনী সে কৌশলের বাস্তবায়ন চেয়েছিল আফগানিস্তানে।

 

লক্ষ্য: পরীক্ষায় বিফল করানো

শয়তান চায়, মানব সন্তানেরা ব্যর্থ হোক জীবনের মূল পরীক্ষায় এবং পৌঁছুক জাহান্নাম। সে লক্ষ্য পূরণে শয়তানের স্ট্রাটেজী বহুবিধ। সেটি যেমন রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে, তেমনি শিক্ষা ও সাংস্কৃতির অঙ্গণে। দেশের উপর রাজনৈতিক দখলদারী এজন্যই জরুরি যে, তাতে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে আগ্রাসন চালানো সহজতর হয়। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গণে ইসলামে শত্রুপক্ষের আয়োজনটি বিশাল। তারা হাজির হয়েছে নানারূপ খেলাধুলা, নাচগান, মেলা ও উৎসবের নামে। “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার” এরূপ স্লোগানের মূল উদ্দেশ্য তো সেটিই। এটি হিন্দুদের পূজার উৎসবকে মুসলিমের উৎসবে পরিণত করার ষড়যন্ত্র। প্রশ্ন হলো, এই জীবন যেখানে পরীক্ষার কেন্দ্র, সেখানে বসে কি কেউ নাচগান করে? নাচগান, খেলাধুলা বা উৎসবের আয়োজন তো পরীক্ষায় মনযোগী হওয়াই অসম্ভব করে তোলে। নবীজী(সা:)’র হাদীস,“পানি যেমন শস্য উৎপাদন করে, গানও তেমনি মুনাফিকি উৎপন্ন করে।” মুনাফিকি তো ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্যতা, সেটি তার কথার সাথে আমলের গড়মিল। এরা মুখে নিজেকে মুসলিম রূপে পরিচয় দিলেও তাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনীতির লক্ষ্য হয় ইসলামকে পরাজিত রাখা। এবং তারা বিজয়ী করে জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় কুফরি মতবাদকে। প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের শক্তি ও মর্যাদা বিপুল ভাবে বাড়লেও সে সময় নাচগান বাড়েনি। সংস্কৃতির নামে এগুলো শুরু হলে যা বাড়ে -তা হলো ভ্রষ্টতা। তখন অসম্ভব হয় সিরাতুল মোস্তাকিমে পথচলা।

নতুন বছর, নতুন মাস, নতুন দিন নবীজী(সা:)’র আমলেও ছিল। কিন্তু তা নিয়ে তিনি নিজে যেমন কোন দিন উৎসব করেননি, সাহাবাগণও করেননি। অথচ তারাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়েছিলেন। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগান এ ব্যাপারে অতিশয় মনযোগী ছিলেন যেন শিক্ষা ও সংস্কৃতির নামে সমাজ বা রাষ্ট্রে এমন কিছুর চর্চা না হয় যাতে সিরাতুল মোস্তাকিমে চলাই অসম্ভব হয়। এবং মনযোগে ছেদ পড়ে ধর্মের পথে পথচলায়। ড্রাইভিং সিটে বসে নাচগানে মত্ত হলে কি সঠিক ভাবে গাড়ী চালানো যায়? এতে বিচ্যুতি ও বিপদ তো অনিবার্য। অবিকল সেটি ঘটে জীবনের গাড়ী চালোনার ক্ষেত্রেও। নবীজী(সা:)’র আমলে সংস্কৃতির নামে আনন্দ উপভোগের প্রতি এত আকর্ষণ ছিল না বলেই সিরাতুল মোস্তাকিমে চলা তাদের জন্য সহজতর হয়েছিল। বরং তারা জন্ম দিয়েছিলেন মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কৃতির। সে সংস্কৃতির প্রভাবে একজন ভৃত্যও খলিফার সাথে পালাক্রমে উঠের পিঠে চড়েছেন। এবং খলিফা ভৃত্যকে উঠের পিঠে বসিয়ে নিজে রশি ধরে টেনেছেন। সমগ্র মানব ইতিহাসে এর কোন তুলনা নেই। অথচ বাংলাদেশে আজ সংস্কৃতির নামে কি হচ্ছে? ২০১০ সালে এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা নববর্ষের কনসার্টে কী ঘটেছিল? যৌন ক্ষুধায় অতি উদভ্রান্ত অসংখ্য হায়েনা কি সেদিন নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়িনি? অসংখ্য নারী কি সেদিন  লাঞ্ছিত হয়নি? কিছু কাল আগে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে ব্যান্ড সঙ্গীতের আসরে কী ঘটলো? সেদিন ধর্ষিতা হয়েছিল শত শত নারী। এটিই হলো সেক্যুলার বাঙালী সংস্কৃতির আদি ও প্রকাশ্য রূপ।

 

আয়োজন ইসলাম থেকে দূরে সরার

নববর্ষ উদযাপনের নামে নারী-পুরুষদের মুখে উলকি কেটে বা নানান সাজে একত্রে রাস্তায় নামানোর রীতি কোন মুসলিম সংস্কৃতি নয়। বাঙালীর সংস্কৃতিও নয়। এমনকি বাঙালী হিন্দুদেরও নয়। অতীতে নববর্ষে নামে বাংলায় বড়জোর কিছু হালখাতার অনুষ্ঠান হতো। কিন্তু কোন কালেই এদিনে কনসার্ট গানের আয়োজন বসেনি। জন্তু-জানোয়ারের প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিলও হয়নি। পাশ্চাত্যেও নববর্ষের দিনে এমন উৎসব দিনভর হয় না। বাংলাদেশে এগুলীর এত আগমন ঘটেছে নিছক রাজনৈতিক প্রয়োজনে। যুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যে অনেক সময় নতুন প্রযুক্তির যুদ্ধাস্ত্র সৈনিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। অনেক সময় তাতে বিজয়ও আসে। ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ সাংস্কৃতিক যুদ্ধে সংস্কৃতির নামে এসব অভিনব আয়োজন বাড়ানো হয়েছে তেমনি এক ত্বরিৎ বিজয়ের লক্ষ্যে। তাদের লক্ষ্য: নাচ-গান ও কনসার্টের মাধ্যমে জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো। বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ নিয়ে  নতুন ঢংযের এসব আয়োজন বাড়ানো হয়েছে তেমনি এক ষড়যন্ত্রমূলক প্রয়োজনে। পাশ্চাত্যের যুবক-যুবতীদের ধর্ম থেকে দূরে টানার প্রয়োজন নেই। জন্ম থেকেই তারা ধর্ম থেকে দূরে। নাচগান, মদ, অশ্লিলতা, উলঙ্গতা ও ব্যভিচারের মধ্য দিয়েই তাদের বেড়ে উঠা। তাই নববর্ষের নামে তাদের মাঝে এ সবে অভ্যস্থ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেটির প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশে। সেটি ধর্ম থেকে ও নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরানোর লক্ষ্যে। এসবের চর্চা বাড়াতে কাজ করছে প্রচুর দেশী-বিদেশী এনজিও। এমন অনুষ্ঠানে বিপুল অর্থ ব্যয়ও হচ্ছে। এবং সে অর্থ আসছে বিদেশীদের ভান্ডার থেকে। এভাবে নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশার পাশপাশি অশ্লিলতারও সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এবং লুপ্ত করা হচেছ ব্যভিচার ও অশ্লিলতাকে ঘৃণা করার অভ্যাস -যা পাশ্চাত্য থেকে বহু আগেই বিলুপ্ত হয়েছে।

শুধু বাংলাদেশে নয়, অন্যান্য মুসলিম দেশেও এরূপ নববর্ষ পালনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ পাশ্চাত্য দেশ বিপুল অংকের অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। ইরানী, আফগানী, কিরগিজী ও কুর্দীদের নওরোজ উৎসবের দিনে সম্ভাষণ জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ পাশ্চাত্য দেশের কর্তাব্যক্তিগণ সচারচর বিশেষ বানী দেন। তবে নববর্ষের নামে বাংলাদেশে ইসলামের শত্রুপক্ষের বিনিয়োগটি স্রেফ বানীতে সীমিত  নয়, আসছে বিপুল বিনিয়োগও। কারণ, বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। আফগানিস্তানের চেয়ে ৪ গুণের অধিক। জনসংখ্যার শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম, যাদের আপনজনেরা ছড়িয়ে আছে ব্শ্বিজুড়ে। ফলে এদেশে ইসলামের দর্শন প্রচার পেলে তা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। এ বিশাল জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে সেক্যুলার সংস্কৃতিতে বশ করানো তাদের কাছে তাই অতিগুরুত্বপূর্ণ। তারা চায়, এ পৃথিবীটা একটি মেল্টিং পটে পরিণত হোক। আলু-পটল, পেঁয়াজ-মরিচ যেমন চুলার তাপে কড়াইয়ে একাকার হয়ে যায়, তেমনি বিশ্বের সব সংস্কৃতির মানুষ একক সংস্কৃতির মানুষের পরিণত হোক। এভাবে নির্মিত হোক গ্লোবাল ভিলেজ। আর সে গ্লোবাল ভিলেজের সংস্কৃতি হবে পাশ্চাত্যের সৃষ্ট সেক্যুলার সংস্কৃতি। এজন্যই বাংলাদেশে নারী-পুরুষকে ভ্যালেন্টাইন ডে, বর্ষপালন, মদ্যপান, অশ্লিল নাচ, পাশ্চাত্য ধাঁচের কনসার্টে অভ্যস্থ করায় এসব এনজিওদের এত আগ্রহ। তারা চায়, তাদের সেক্যুলার সংস্কৃতির সীমানা বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশের প্রতি বসতঘরের মধ্যেও বিস্তৃত হোক। তাই দ্রুত বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সীমানা।

 

মহাবিপর্যের পথে

বিপদের আরো কারণ, এতবড় গুরুতর বিষয় নিয়েও কারো কোন  দুশ্চিন্তা নেই। পরিবারের কেউ মৃত্যুশয্যায় পড়লে সে পরিবারে দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না, দৌড়াদৌড়ি শুরু হয় কিভাবে তাকে বাঁচানো যায় -তা নিয়ে। অথচ আজ সততা, নৈতিকতা ও ঈমান-আমলের দিক দিয়ে শয্যাশায়ী সমগ্র বাংলাদেশ। সমগ্র দেশবাসী ছুটে চলেছে মহা বিপদের দিকে। সামনে অনন্ত অসীম কালের জাহান্নাম। অথচ তা নিয়ে ক’জন আলেম, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও লেখক উদ্বিগ্ন? ক’জন মুখ খুলেছেন বা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন? ১৭৫৭ সালের ইংরেজদের কাজে পরাজয় ও আত্মসমর্পণের চেতনা থেকে বাঙালী মুসলিমগণ কি একটুও সামনে এগিয়েছে? তখন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ব্রিটিশের দখলদারি। অস্তমিত হয়েছিল বাংলার মুসলিমদের স্বাধীনতা। সে পরাধীনতা বিরুদ্ধে কোন জনপদে ও গ্রাম-গঞ্জে সাথে সাথে কোনরূপ প্রতিরোধ বা বিদ্রোহের ধ্বনি উঠেছিল -সে প্রমাণ নেই। বরং যে যার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ততা থেকেছে। দেশের স্বাধীনতা নিয়ে কিছু ভাবা বা কিছু করার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেনি। অথচ শত্রুর হামলার মুখে প্রতিরোধের এ দায়ভার প্রতিটি মুসলিমের। এ কাজ শুধু বেতনভোগী সৈনিকের নয়। প্রতিটি নাগরিকের। ইসলামে এটি জিহাদ। মুসলিমদের গৌরব কালে এজন্য কোন সেনানীবাস ছিল না। প্রতিটি গৃহই ছিল সেনানীবাস। প্রতিটি নাগরিক ছিল সৈনিক। প্রতিটি যুদ্ধে ঈমানদারগণ তখন স্বেচ্ছায় নিজ নিজ ঘর থেকে নিজ খরচে যুদ্ধে গিয়ে হাজির হয়েছেন। সে জিহাদের সমুদয় খরচ তারা নিজেরা জুগিয়েছেন। অথচ আজ মুসলিম বিশ্বে সৈন্য ও সেনানীবাসের সংখ্যা বেড়েছে, রাজস্বের সিংহভাগ সৈন্যপালেন খরচ হচ্ছে অথচ শত্রুর হামলার মুখে কোন প্রতিরোধ নেই। দেশের পর দেশ তাই অধিকৃত। এবং অধিকৃত হচ্ছে মুসলিম দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিও। এভাবে দূরত্ব বেড়েছে নবীজী (সা:)’র আমলের ইসলাম থেকে।

সাংস্কৃতিক সীমানা রক্ষার লড়ায়ে পরাজিত হলে পরাজয় অনিবার্য হয় ঈমান-আক্বীদা রক্ষার লড়ায়েও। কারণ, মুসলিমের ঈমান-আক্বীদা কখনো অনৈসলামিক সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠে না। মাছের জন্য যেমন পানি চাই, ঈমান নিয়ে বাঁচার জন্যও তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী সংস্কৃতি চাই। গৌরব যুগে মুসলিমগণ তাই শুধু কুর’আন পাঠ ও নামাজ-রোজা নিয়ে ব্যস্ত থাকেনি, ইসলামী রাষ্ট্র এবং সে রাষ্ট্রে শরিয়ত ও ইসলামী সংস্কৃতিরও প্রতিষ্ঠা করেছে। মুসলিমদের অর্থ, রক্ত, সময় ও সামর্থ্যের সবচেয়ে বেশী ভাগ ব্যয় হয়েছে তো ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির নির্মাণে। নামাজ-রোজার পালন তো কাফের দেশেও সম্ভব। কিন্তু ইসলামী শরিয়ত ও ইসলামী সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও পরিচর্যা তথা ইসলামী বিধানের পূর্ণ পালন কি অমুসলিম দেশে সম্ভব? অতীতের ন্যায় আজকের মুসলিমদের উপরও একই দায়ভার। সেটি শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক সৈনিকের নয়, প্রতিটি আলেম, প্রতিটি শিক্ষক, প্রতিটি ছাত্র ও প্রতিটি নাগরিকেরও। এ লড়াইটি হয় কুর’আনী জ্ঞানের তরবারী দ্বারা। নবীজী (সা:)’র যুগে সেটিই হয়েছে। কিন্তু সে দায়িত্ব পালনের আয়োজনই বা কোথায়?

অনেকেই জ্ঞানার্জন করছেন নিছক রুটিরুজির তালাশে। ফরয আদায়ের লক্ষে নয়। ফলে প্রচণ্ড শূণ্যতা ও বিচ্যুতি রয়েছে জ্ঞানার্জনের নিয়তেই। ফলে সে জ্ঞানচর্চায় তাদের রুটি-রুজী জুটছে ঠিকই, কিন্তু তাতে জ্ঞানার্জনের ফরয আদায় হচ্ছে না। বাড়ছে না  দুর্বৃত্তি নির্মূলের জিহাদে লোকবল। বাড়ছে না ইসলামের প্রতিষ্ঠা। এবং নির্মিত হচ্ছে না সভ্য সমাজ। বাংলাদেশের মুসলিমদের জন্য এটি এক বিপদজনক দিক। আগ্রাসী শত্রুর হামলার মুখে অরক্ষিত শুধু দেশটির রাজনৈতিক সীমান্তুই নয়, বরং প্রচণ্ড ভাবে অরক্ষিত দেশের সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক সীমান্তও। দেশ তাই দ্রুত ধেয়ে চলেছে সর্বমুখী পরাজয় ও বিপর্যের দিকে।

 

পথটি আযাবপ্রাপ্ত ইহুদীদের

আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে গাদ্দারীতে ইহুদীগণ ইতিহাস গড়েছিল। সুরা ফাতেহাতে তাদেরকে “মাগদুব” তথা আযাবপ্রাপ্ত বলা হয়েছে। ফিরাউনের বিরুদ্ধে খাড়া না হয়ে তরা আত্মসমর্পণ করেছিল। ফিরাউনের দাস রূপে বাঁচাকে নিজ জীবনযাত্রার সাথে তারা খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। এমনকি মহান আল্লাহতায়ালা যখন হযরত মূসা (আ:) ও হযরত হারুন (আ:)’কে পাঠিয়ে তাদেরকে উদ্ধারের চেষ্টা করলেন -তখনও তারা গাদ্দারী করেছিল। সভ্য ভাবে ও স্বাধীন ভাবে বাঁচার একটি খরচ আছে। সে খরচ বহনে তারা কখনোই রাজী হয়নি। মর্যাদা নিয়ে বাঁচায় উচ্চতর রুচিও লাগে। কিন্তু তারা সে রুচিও হারিয়েছিল। তারা আগ্রহ দেখায়নি স্বাধীনতা ও সন্মান নিয়ে বাঁচায়। সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা, আসমান থেকে মান্না-সালওয়া, মাথার উপর মেঘের ছাতা, পাথর চিরে পানির ঝরণা –এরূপ বহু মোজেজা তারা নিজেদের চোখের সামনে দেখেছে। কিন্তু হযরত মূসা (আ:) যখন মাত্র ৪০ দিনের জন্য তাদের ছেড়ে চলে যান, তারা গাভী মুর্তি পূজা শুরু করেছিল। তাদের ঈমান ছিল কচুর পাতার পানির ন্যায় গড়িয়ে পড়েছে।  

বাঙালী মুসলিমগণ বেছে নিয়েছে ইহুদীদের অনুসৃত গাদ্দারীর পথ। স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার রুচি তাদের সামান্যই। নিজেদের গাদ্দারীর ফলেই বাংলাদেশ আজ অধিকৃত ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে। আদালতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নাই। স্কুল-কলেজে কুর’আনের অনুশীলন নাই। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ভোটডাকাত দুর্বৃত্তদের নৃশংস শাসন। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার। বিলু্প্ত হয়েছে মৌলিক মানবিক অধিকার। জোয়ার এসেছে গুম, খুন, ফাঁসি, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের। এবং গোলামী বেড়েছে ভারতীয় কাফের শক্তির। যে কোন সভ্য দেশে এমনটি হলে বহু আগেই যুদ্ধ শুরু হতো। কিন্তু বাঙালী মুসলিমের জীবনে সেটি আসেনি। এর কারণ, যারা বেছে নেয় গাদ্দারীর পথ, তাদের জীবনে কখনোই জিহাদ আসেনা। জিহাদকে তারা সযত্নে এড়িয়ে যায় এবং বাঁচে আত্মসমর্পণ নিয়ে।  

পবিত্র কুর’আনের মহান আল্লাহতায়ালা ইসলামের ব্যর্থ ছাত্রদের ইতিহাস যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি তুলে ধরেছেন সফল ছাত্রদের ইতিহাসও। এবং সে সফল ছাত্রগণ হলেন নবীজী (সা:)’র সাহাবাগণ। জীবনের পরীক্ষায় তাদের কৃতকার্যতা নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন পবিত্র কুর’আনে। সে ঘোষণাটি এসেছে, “রাযী আল্লাহু আনহুম” এ বলে। অর্থ: আল্লাহ রাযী আছেন তাদের উপর। সাহাবাগণ মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করেছিলেন তাঁর জমিনে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী বিধানকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে। তাঁর পথে তারা যেমন লাগাতর জিহাদ করেছেন, তেমনি বিপুল সংখ্যায় শহীদও হয়েছেন। জিহাদের পর জিহাদ করে তারা আবির্ভুত হয়েছিলেন বিশ্বের মানচিত্রে সুপার পাওয়ার রূপে।

অথচ বাঙালী মুসলিমদের গাদ্দারীর কারণে বাংলাদেশের উপর বিজয় বেড়েছে শয়তানপন্থীদের। তারা নিজেরা রুচি হারিয়েছে ইসলাম, স্বাধীনতা ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচায়। তাদের সে রুচি হীনতা ও গাদ্দারীর কারণেই বাংলাদেশে নবীজী(সা:)’র ইসলাম বেঁচে নাই। ইসলামের নামে যা বেঁচে আছে -সেটি নবীজী(সা:)’র আমলের কুর’আনী ইসলাম নয়। নবীজী(সা:)’র ইসলামে শরিয়ত, হুদুদ, খেলাফত, শুরা, প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভাতৃত্ব ও জিহাদ ছিল, বাংলাদেশে সে ইসলামের মৃত্যু ঘটেছে বহু আগেই। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বিরুদ্ধে এরূপ গাদ্দারীর ফলে পরকালে যে বিপর্যয় বাড়াবে -তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা ও নামাজ-রোজার সংখ্যা বাড়িয়ে কি সে বিপদ থেকে মুক্তি মিলবে? মহান আল্লাহতায়ালা তো এ প্রশ্ন তো কখনোই তুলবেন কতগুলো মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বরং এ প্রশ্ন তো অবশ্যই করা হবে কতটা প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছিল তাঁর নিজের ভূমিতে তাঁর সর্বময় সার্বভৌমত্ব ও আদালতে কতটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল পবিত্র কুর’আনে বর্ণিত তাঁর শরিয়তী আইন। অথচ এ ক্ষেত্রে বাঙালী মুসলিমদের অর্জন তো প্রকাণ্ড একটি শূণ্য। বরং তারা নিজ হাতে, নিজ ভোটে, নিজ অর্থ ও নিজ রক্তে বাড়িয়েছে ইসলামের পরাজয় ও বিজয় তুলে দিয়েছে তাঁর শত্রু শিবিরে। প্রশ্ন হলো, আল্লাহর দ্বীনের যারা পরাজয় বাড়ায় তাদেরকে কি তিনি জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করবেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *