কাঙ্খিত লক্ষ্যে রোযা কতটুকু সফল?
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on April 13, 2021
- Bangla Articles, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
কতটুকু অর্জিত হচ্ছে তাকওয়া?
রোযার লক্ষ্য কি শুধু এটুকু, মানুষ সকাল থেকে সন্ধা অবধি পানাহার বন্ধ রাখবে? তারাবিহ পড়বে এবং কোর’আন তেলাওয়াত করবে? এবং রমযান শেষে মহা ধুমধামে ঈদ উদযাপন করবে? পথচলায় কত হাজার মাইল পথ চলা হলো -সেটিই কি শুধু গুরুত্বপূর্ণ? সাফল্য যাচায়ে তো গুরুত্বপূর্ণ হলো, কাঙ্খিত লক্ষ্যে আদৌ পৌঁছলো কিনা। রোযার মূল লক্ষ্য, তাকওয়া অর্জন। মহান আল্লাহতায়ালা সে লক্ষ্যটি ব্যক্ত করেছেন এভাবে: ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’’ -(সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৩)। উপরুক্ত আয়াতে যেটি সুস্পষ্ট তা হলো, তাকওয়াই রোযার মূল লক্ষ্য। প্রশ্ন হলো, তাকওয়া বলতে আমরা কি বুঝি? তাকওয়া অর্থ ভয়। তবে সে ভয় এমন নয়, হঠাৎ বাঘের সামনে পড়া ভীতিগ্রস্থ ব্যক্তির ন্যায় তা বাকশূণ্য করবে। সে ভয় এমনও নয়, হঠাৎ গভীর সমুদ্রে পড়া ব্যক্তির ন্যায় আতংকিত ও বিচলিত করবে। তাকওয়া হলো আল্লাহ-সচেতনতার এমন এক মানসিক অবস্থা যা সর্বদা স্মরণে রাখে জাহান্নামের আযাব, ফেরায় সকল প্রকার ভ্রষ্টতা ও পাপ থেকে এবং প্রেরণা জোগায় নেক-আমলে। তখন জন্ম নেয় আল্লাহকে খুশী করার সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা। সৃষ্টি করে মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে জবাবদেহীতার চেতনা। এমন চেতনায় জীবনের প্রতিটি দিন ও প্রতিটি মুহুর্ত মনে হয় মহান আল্লাহতায়ালার অমূল্য নেয়ামত রূপে; এবং এ জীবন গণ্য হয় অবিরাম পরীক্ষাপর্ব রূপে। তখন বিরামহীন ব্যস্ততা বাড়ে সে পরীক্ষায় কি করে ভাল ভাবে তকার্য হওয়া যায় তা নিয়ে। যখন কোন ব্যক্তি মটর হাই্ওয়েতে দ্রুত গাড়ি চালায় তখন একটি ভয় তার মনে সব সময়ে কাজ করে। সেটি হলো, সামান্য নিমিষের অসতর্কতা তার গাড়িকে গভীর খাদে নিয়ে ফেলবে এবং ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটাবে। মুহুর্তের মধ্য সে দুর্ঘটনা তার নিজের ও অন্যান্য আরোহীর জীবনে মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। এমন একটি দূর্ঘটনার জন্য দীর্ঘ মেয়াদী কোন ভূলের প্রয়োজন পড়ে না। সামাণ্য ক্ষণের ভূল, অসচেতনতা বা ঘুমই সে জন্য যথেষ্ট। চালককে তাই প্রতি মুহুর্তে চোখ ও মন খোলা রাখতে হয়। মৃত্যূর ভয়ে তাকে সর্বমুহুর্ত সতর্ক থাকতে হয়। চালকের জন্য এটাই হলো তাকওয়া।
আর মু’মিনের জীবনে তাকওয়া হলো সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত হওয়ার সার্বক্ষণিক ভয়। যে কোন মুহুর্তে সেও বিচ্যুত হতে পারে মহান আল্লাহর নির্দেশিত পথ থেকে; অবাধ্য হতে পারে তাঁর হুকুমের। রোযার মূল কাজ এমন ভয় তথা তাকওয়ার বৃদ্ধি। তাই তাকওয়া নিছক ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও যৌনতাকে দমিয়ে রাখার সামর্থ্য নয়, বরং সর্ব প্রকার জৈবিক,আত্মিক ও আর্থিক কুপ্রবৃত্তি দমনের ঈমানী শক্তি। এমন তাকওয়া থেকেই প্রেরণা আসে আল্লাহপাকের হুকুমগুলি জানার এবং সে সাথে সেগুলি অনুসরণের। কোর’আনের জ্ঞানার্জনকে তাকওয়া-সমৃদ্ধ সে ব্যক্তিটি তখন নিজ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম রূপে গ্রহণ করে। কারণ সে বুঝে, অজ্ঞতা নিয়ে সিরাতুল মুস্তাকীমে চলা সম্ভব নয়। কারণ হাজারো পথের মাঝে কোনটি সিরাতুল মুস্তাকীমের পথ আর কোনটি ভ্রষ্টতার পথ -সেটি জানতে বা বুঝতে হলেও তো জ্ঞান চাই। পথচলায় যে সিগনাল বা বিধিনিষেধ থাকে সেগুলোও তো জানতে হয়। নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের মাঝে ইসলামের জ্ঞানে তাই কোন অজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন না। তাদের শতকরা শতভাগই ছিলেন আলেম। অজ্ঞতা নিযে ইবাদতও সঠিক ভাবে হয় না। তাই নামায-রোযার আগে কোর’আনের জ্ঞানার্জনকে ফরজ করা হয়েছে। সাহাবাদের জীবনে এমন একটি সময় ছিল যখন নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাত ছিল না। জিহাদও ছিল না। ইবাদত বলতে বুঝাতো রাতের একটি বড় অংশে দাঁড়িয়ে বার বার পবিত্র কোর’আনের আয়াতগুলোকে ধীরে ধীরে নিবিষ্ট মনে আবৃত করা এবং আল্লাহর সে হেদায়েতের বাণীগুলোকে হৃদয়ের গভীরে বসিয়ে দেয়া। সে হুকুম এসেছে নবুয়তের অতি প্রথম দিকে নাযিলকৃত সুরা মুজাম্মিল। বলা হয়েছে, “হে বস্ত্রে আচ্ছাদিত (মুহম্মদ), রাতে খাড়া হয়ে যাও, কিছু অংশ বাদে। রাতের অর্ধেক ভাগ, অথবা তা থেকে কিছুটা কম সময়ের জন্য। অথবা তার চেয়ে কিছু অধিক সময়ের জন্য; এবং তেলাওয়াত করো কোর’আন থেকে ধীরে ধীরে সুরভিত কন্ঠে।” -(সুরা মুজাম্মিল, আয়াত ১-৪)। সে সময় খোদ নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের কাছে সমগ্র কোর’আন ছিল না। ছিল সদ্য নাযিলকৃত কিছু সুরা বা আয়াত। তখন তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বটি ছিল, সেগুলোকে হৃদয়ে গেঁথে নেয়া, সেগুলো পূর্ণ অনুসরণ করা এবং অন্যদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া। সে দায়িত্বপালন গণ্য হতো ইবাদত রূপে। ইসলামের ১৪ শত বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আলেম তো গড়ে উঠেছে কোর’আনেকে বুঝা ও কোর’আন অনুসরণের সে অদম্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এ পর্যায়ে হযরত সুমাইয়া ও হযরত ইয়াসিরের মত কিছু সাহাবা কাফেরদের নির্যাতনে শহীদ হয়ে যান।
ভ্রষ্টতা যেখানে ইবাদতে
ঘোড়ার আগে যেমন গাড়ী জোড়া যায় না, তেমনি কোর’আন কোর’আনী জ্ঞানার্জনের আগে ইবাদতও যথার্থ হয়না। অথচ আজ সে জ্ঞানার্জনের দায়ভার চাপানো হয়েছে স্রেফ মসজিদের ইমাম বা মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের উপর। জ্ঞানার্জন যে প্রতিটি মুসলিম নরনারীর উপর ফরজ সেটিও ভূলিয়ে দেয়া হয়েছে। সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে ভ্রষ্টতার শুরু মূলত এখান থেকেই। ফলে প্রচন্ড ভ্রষ্টতা বেড়েছে ইবাদতে। রোযা রেখে দোকানে বসে যে ব্যক্তিটি দ্রব্যমূল্য বাড়ায় বা পণ্যে ভেজাল মেশায় বা অফিসে বসে ঘুষ খায় এমন ব্যক্তি যে তাকওয়াশূণ্য এবং রোযা থেকে সে যে কোন কিছুই লাভ করেনি -তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ থাকে? সে তো পথভ্রষ্টতার পথ বেছে নিয়েছে। এখানে কাজ করছে তার অজ্ঞতা ও তাকওয়াশূণ্যতা। রোযা তার কাছে নিছক উপবাস ছাড়া কি অন্য কিছু উপহার দিয়েছে? অথচ তাকওয়া-সম্পন্ন ব্যক্তির অদম্য অনুপ্রেরণা হলো, প্রতি মুহুর্তে সিরাতুল মুস্তাকীমে চলায়। সর্ব মুহুর্তে তাঁর সতর্কতা থাকে সর্বপ্রকার হারাম কাজ থেকে দূরে থাকায়। যার মনে সে সতর্কতা নাই, বুঝতে হবে তার মনে তাকওয়াও নাই। অনেক গাছই ফল দেয় না। তেমনি অনেকের নামায-রোযা এবং হজ্জ-যাকাতও জীবনে কোন পরিবর্তন আনে না। এরা নামায-রোযা আজীবন করেও বাঁচে পথভ্রষ্টতা নিয়ে। নামে মুসলিম হলেও কর্মজীবনে এরা ফাসেক (অবাধ্য, বিদ্রোহী), জালেম ও মুনাফিক হয়। এদের কারণেই মুসলিম দেশগুলোতে আল্লাহর শরিয়তী বিধান আজ পরাজিত; এবং মুসলিম ভূমি অধিকৃত হয়েছে ইসলামে শত্রুপক্ষের হাতে। অথচ তাকওয়া সম্পন্ন ব্যক্তি গভীর দায়িত্ববোধ পায় আল্লাহর সৈনিক রূপে ইসলামের বিজয়ে পূর্ণ আত্ম-বিনিয়োগে। নবীজীর (সা:) আমলে সে সামর্থ্য পেয়েছিলেন প্রতিটি সাহবা। তাদের জীবনে সর্বক্ষণের প্রচন্ড তাড়াহুড়া ছিল বেশী বেশী নেক আমলের।
তাকওয়া মানব মনে বা দেহে গোপন থাকার বিষয় নয়। সেটি নানা ভাবে প্রকাশ পায় নেক আমলের মধ্য দিয়ে। ইসলাম কবুলের পর মু’মিন ব্যক্তির জীবনে যেটি অনিবার্য রূপে দেখা দেয় সেটি নেক আমলের প্রতি দুর্বার মোহ ও প্রতিযোগিতা। সে তখন প্রস্তুত হয়ে যায় শুধু মালের কোরবানিতে নয়, জানের কোরবানিতেও। অপর দিকে বদ আমল তা যত ক্ষুদ্রই হোক তার মাঝে ঈমানদার ব্যক্তিটি জাহান্নামের আগুনের পূর্বাভাস দেখতে পায়। ফলে তার সর্বক্ষণের সাধনা হয় তা থেকে বাঁচার। যে ব্যক্তির মাঝে বদ আমল থেকে বাঁচায় ও নেক আমলে তাড়াহুড়া নাই, বুঝতে হবে তার মাঝে তাকওয়াও নাই্।এবং পরকালের উপর ঈমানও নাই। ঈমানের দাবীতে সে যত সোচ্চারই হোক, তার সে ঈমানদারী নিতান্তই মেকী। নেক আমলের প্রেরণায় সাহাবাগণ এতটাই অস্থির থাকতেন যে, মাঝ রাতে না ঘুমিয়ে আটার বস্তা কাঁধে নিয়ে গরীবের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। চাকরকে উঠের পিঠে চড়িয়ে নিজে রশি ধরে টেনেছেন। সে কাজ করেছেন এমন কি রাষ্ট্রপ্রধান তথা আমীরুল মো’মিনুনও। নিজেরা অভূক্ত থেকে তারা মেহমানকে খাইয়েছেন। নিজের অসংখ্য ফলবান গাছের বিশাল বাগানকে আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়েছেন। জিহাদের ময়দানে আহত ও অতি তৃষ্ণার্ত হয়ে পানি নিজে না পান করে পাশের তুষ্ণার্ত মুজাহিদকে দিতে বলেছেন। সর্বোপরি তারা ছটফট করতেন অর্থের পাশাপাশি নিজের জীবনকে আল্লাহর পথে জিহাদে বিলিয়ে দেয়ায়। এরাই হলেন তেমন ব্যক্তি যাদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, তাদের জানমাল তিনি ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। এমন মানুষদের আধিক্যের কারণেই তখন নেক আমলের প্লাবন এসেছিল সমগ্র মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে। তাকওয়ার সে গুণেই ইসলাম যেমন গড়ে তুলেছিল মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, তেমনি সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।
শ্রেষ্ঠ দান ও প্রত্যাশা
মাহে রমযান হলো রহমত ও মাগফেরাতের মাস। এ মাসেই নাযিল হয়েছিল পবিত্র কোর’আন – অর্থাৎ মর্তের বুকে নেমে এসেছিল মহান আল্লাহর নিজস্ব বাণী। এভাবে মানব জাতি পেয়েছিল মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় নেয়ামত – মূক্তি ও সফলতার একমাত্র এবং সর্বশেষ পথ। ইসলামী পরিভাষায় যা হলো সিরাতুল মুস্তাকীম। মানব জাতির কল্যাণে আর কোন ঘটনা কি এতটা গুরুত্বপূর্ণ? মানব জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এ কোর’আনের বরকতেই। এই একটি মাত্র ঘটনাই রমযানের এই মাসটিকে অন্য যে কোন মাসের তুলনায় অতি সম্মানিত করেছে। এ ঘটনাটির বরকতেই এ মাসটিতে মহান আল্লাহতায়ালার অতি প্রিয় কাজটি হলো তিনি তাঁর বান্দার প্রার্থনাকে কবুল করা। এভাবেই এ মাসটি সম্মানিত হয় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে। এবং সে সন্মানেরই প্রতীক হলো, এ মাসেই রয়েছে হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রাত লায়তুলু ক্বদর। দোয়া কবুলের এটিই শ্রেষ্ঠ রাত।
তবে দোয়া কবুলটি নিঃশর্ত নয়। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সে শর্তটি হলো, কোর’আনে বর্নীত নির্দেশাবলীর পূর্ণ অনুসরণ। পবিত্র কোর’আনে সে শর্তটি বলা হয়েছে এভাবে, “..(হে মহম্মদ) এবং যখন আমার বান্দারা আমার ব্যাপারে আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে, (তাদেরকে আপনি বলে দিন) বস্তুত আমি রয়েছি অতি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা আমি কবুল করি। অতএব তাদেরও অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হলো, আমার হুকুম পালন করা এবং আমার উপর ঈমান আনা।” (-সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৬)। এ আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, তিনি প্রতিটি বান্দার অতি নিকটে। সুরা ক্বাফে বলা হয়েছে তিনি গর্দানের রক্তের শিরার চেয়েও নিকটবর্তী। তিনি যে শুধু বান্দার প্রতিটি দোয়া শুনেন তাই নয়, সে দোয়া কবুলও করেন। এবং সে ওয়াদাটি অতি সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষিত হয়েছে এ আয়াতে। তবে সে সাথে তিনি সুস্পষ্ট শর্তও রেখেছেন। শর্ত হলো, হুকুম পালন করা এবং তাঁর উপর পরিপূর্ণ ঈমান আনা। অর্থাৎ সর্বসামর্থ্য দিয়ে আল্লাহর পক্ষে খাড়া করা। সে জন্য কোন দল বা নেতার অপেক্ষায় বসে থাকারও অনুমতি নাই। তাই পবিত্র কোর’আনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, “(হে মহম্মদ) বলে দিন, “তোমাদের জন্য আমার একটি মাত্র ওয়াজ (নসিহত): খাড়া হও আল্লাহর জন্য (আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য) জোড়ায় জোড়ায় অথবা (সেটি সম্ভব না হলে) একাকীই; অতঃপর তোমরা চিন্তাভাবনা করো।”–(সুরা সাবা, আয়াত ৪৬)।
মহান আল্লাহতায়ালার কাছে বান্দার চাওয়া-পাওয়ার তালিকাটি বিশাল। কিন্তু বান্দার কাছেও তাঁর প্রত্যাশা আছে। সে ন্যূনতম প্রত্যাশাটি হলো, তাঁরা দাঁড়াবে তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে –যেমনটি দাঁড়িয়েছিলেন নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ। তাঁরা যখন এরূপ দাঁড়ায়, তখন তিনিও তাদের ডাকে সাড়া দেন। সেটিই তাঁর সূন্নত। সাহাবাদের ডাকে তাই তিনি ফিরেশতা পাঠিয়েছিলেন এবং বিশাল বিশাল শত্রুবাহিনীর উপর বিজয় দিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার ডাকে সাড়া দিতে। বরং তারা সাড়া দিয়েছে শয়তানের ডাকে; এবং বিজয়ী করেছে শয়তানের এজেন্ডাকে। এবং যারা শয়তানের পক্ষে দাঁড়ায়, তাদের জীবনে নেমে আসে প্রতিশ্রুত আযাব -সেটি শুধু এ দুনিয়ার জীবনে নয়, অনন্ত-অসীম আখেরাতের জীবনেও। পবিত্র কোর’আনে সে ঘোষণাটি এসেছে বার বার। কথা হলো, আজকের মুসলিমগণ মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে খাড়া হওয়ার বদলে যে শয়তানের পক্ষে খাড়া হয়েছে -সে প্রমাণ কি কম? মুসলিম ভূ-খন্ড আজ বিভক্ত, শরিয়ত বিলুপ্ত, বিজয় জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমের, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সূদ, ঘুষ, জুয়া, মদ ও দেহব্যবসা –এগুলো কিসের আলামত? মুসলিম ভূমিতে তারা যে শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করেছে –এগুলো কি তারই প্রমাণ নয়? তবে কি তাদের দোয়া কবুল করে শয়তানের বিজয়কে আরো বাড়িয়ে দিবেন?
রেকর্ড দুর্বৃত্তি ও বিদ্রোহে
নামায-রোযা নিয়মিত আদায় করে এমন মুসলিমদের সংখ্যা আজ পৃথিবীতে কোটি কোটি। কিন্তু সে তুলনায় তাকওয়া অর্জিত হচ্ছে কতটুকু? কতটুকু বেড়েছে নেক আমল? বরং বিপরীতমুখী কর্ম ও চরিত্রই কি প্রবলতর হচ্ছে না? নেক-আমলের বিপরীত হলো, মিথ্যা, সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, ব্যভিচার , ঘুষ ও ধোকাবাজির ন্যায় নানাবিধ পাপাচার বা দুর্বৃত্তি। ইসলামী পরিভাষায় এগুলো হলো মুনকার। মুসলিম দেশ হওয়ার বরকতে এটাই কি কাঙ্খিত ছিল না যে, এদেশগুলি সুনীতি, সত্যবাদীতা ও সৎকর্মে বিশ্বে রেকর্ড গড়বে? সৃষ্টি হবে নেক আমলের প্লাবন। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে তার উল্টোটি। বেড়েছে দূর্নীতি। ফলে রোযা যে তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে সফল হচ্ছে না -তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? তবে এ বিফলতা নিয়েই বা ক’জন ভাবছে? আল্লাহতায়ালার নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রতিটি বিদ্রোহই তো শয়তানের অনুসরণ। এমন বিদ্রোহে বিজয়ী হয় শয়তান ও তার অনুসারীরা। অথচ প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে চলছে সে প্রবল বিদ্রোহ। আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ পাচ্ছে প্রতিটি মিথ্যা, পাপ ও দূর্নীতির মধ্য দিয়ে। এমন বিদ্রোহে মুসলিমরা বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে। কাফেরদের হারিয়ে দূর্নীতিতে তারা বিশ্বে প্রথম হয়েছে। বাংলাদেশ প্রথম হয়েছে ৫ বার। প্রতিটি মুসলিম দেশে এমন বিদ্রোহীরাই বার্থ করে দিচেছ মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম তথা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার প্রতিটি উদ্যোগ। শুরুতে মুসলিমদের একাধিক রাষ্ট্র ছিল না, কিন্তু যেটি ছিল সেটি প্রতিষ্ঠিত ছিল শরিয়ত তথা আল্লাহর আইনের উপর। কোর’আনে বর্নীত আল্লাহর হুকুমকে তারা শুধু পাঠই করতো না, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রয়োগও করতো। কিন্তু আজ শুধু পাঠই হয়, প্রয়োগ নেই। মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে নানা ভাষা ও নানা জাতীয়তার নামে বহু জাতীয় ঝান্ডা। এবং সে সাথে বেড়েছে আল্লাহর হুকুমের তথা শরিয়তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝান্ডাও। সে ঝান্ডা উড়িয়েছে মুসলিম দেশের ব্যাংকগুলো সূদকে হালাল করে। বিদ্রোহের ঝান্ডা উড়িয়েছে পতিতালয়গুলো। সে বিদ্রোহ মুসলিম দেশের আদালতগুলোতেও। সেটি কোর’আনী আইনের স্থলে কাফেরদের প্রণীত আইন প্রয়োগ করে -যে আইনে ব্যভিচার বা পতিতাবৃত্তিও শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়।
সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝান্ডা তুলতে মহিলারাও পিছিয়ে নেই। তারা সে ঝান্ডা তুলেছে পর্দার হুকুম অমান্য করে এবং নারী-পুরুষের মাঝে অবাধ মেলামেশার মধ্য দিয়ে। বেপর্দাগী নিজেই আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা। এবং সে ঝাণ্ডা উড়িয়ে যারা প্রকাশ্যে চলাফেরা করে তাদেরকে এসব নামাযী ও রোযাদার মুসলিমগণ নেত্রী গণ্য করে এবং তাদেরকে ভোটে নির্বাচিতও করে। তাদের পিছনে রাজপথে মিছিলও করে। আল্লাহতায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহী তাদের ভোট দিলে বা তাদের রাজনীতিকে সমর্থন করলে কি নামায-রোযা পালনের অর্থ থাকে? বান্দার মনে ইবাদত আনুগত্য বাড়াবে সেটাই কি কাঙ্খিত নয়? কিন্তু কোথায় সে আনুগত্য? কোথায় মহান আল্লাহতায়ালার পথে নিবেদিত প্রাণ সে সৈনিক? বরং অধিকাংশ মুসলিম যেন তাদের কর্ম, চরিত্র, রাজনীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ঘোষণা দিচ্ছে, আল্লাহতায়ালার হুকুমের প্রতি তাদের কোন পরওয়া না্ই। যা গুরুত্ব পাচ্ছে তা হলো তাদের ব্যক্তিগত, দলগত, জাতিগত ও গোষ্ঠিগত স্বার্থচিন্তা; আল্লাহতায়ালার হুকুম নয়। মহান প্রভুর হুকুমকে তারা সীমাবদ্ধ রেখেছে জায়নামায, বিয়ে-শাদী, মুর্দাদাফন, মসজিদের নামায এবং রোযা-হজ্জ পালনে। এবং তাঁর বিধানের প্রয়োগ নিষিদ্ধ করেছে শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও আইন-আদালতের অঙ্গণে। এমন আচরণ কি মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ নয়? এমন বিদ্রোহী বান্দারা – পোষাক-পরিচ্ছদ ও নামে যতই মুসলিম হোক, যদি সারা মাস রোযা রাখে, সারা রাত নামায পড়ে এবং সারা রাত কেঁদে কেঁদে মোনাজাত করে, তবে কি সে ইবাদত ও মোনাজাত রাব্বুল আলামিনের কাছে কবুল হয়? কবুল যে হচ্ছে না সে প্রমাণই কি কম? কবুল হওয়ার নমুনা কি এই – মুসলিম দেশে আগ্রাসী বিদেশী শক্তি আধিপত্য পাবে এবং মুসলিম নর-নারি প্রতিদিন নিহত,আহত, ধর্ষিতা ও পদপিষ্ট হবে?
দোয়া কবুলের শর্ত
তিরমীযি শরিফের হাদীসে আছে: তিন ব্যক্তির দোয়া কখনোই বৃথা যায় না। সে তিন প্রকার ব্যক্তি হলো: রোযাদার, ন্যায় পরায়ন শাসক এবং যিনি মজলুম। কিন্তু এ হাদীসটির পাশাপাশি এ হাদীসটিও এসেছে যে, দোয়া কবুলের শর্ত হলো তার রিযিক হালাল অবশ্যই হতে হবে। ফলে যে ব্যক্তির সেহরী ও ইফতার যদি হয় ঘুষ, সূদ, মদবিক্রয়, জুয়া, ধোকাবাজি ও নানা দূনীতির মধ্য দিয়ে উপার্জিত অর্থে হয়; এবং বসবাস যদি হয় সূদী অর্থে কেনা বা জবরদখল ও দূর্নীতির মধ্য দিয়ে অর্জিত গৃহে, তবে তার দোয়া কি কবুল হয়? দোয়া কবুলের জন্য রোযাদার হওয়ার পাশাপাশি ঈমানদার ও নেককার হওয়াও তো শর্ত। পবিত্র কোর’আনে একবার নয়, বহুবার বলা হয়েছে, যারা ফাসেক ও জালেম তাদের দোয়া কবুল দূরে থাক, মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে হিদায়েত দেন না। হিদায়েত লাভের শর্ত হলো,পাপের পথ তথা দূর্নীতি থেকে প্রথমে ফিরতে হবে। ঔষধের আগে বিষ-পান ত্যাগ যেমন জরুরি, তেমনি হিদায়াত লাভের জন্য জরুরি হলো পুরাপুরি বর্জন করতে হয় পাপের পথকে। মহান আল্লাহতায়ালার সবচেয়ে বড় দান ধন-দৌলত, সন্তান-সন্ততি বা প্রতিপত্তি নয়, বরং সেটি হিদায়েত। সে হিদায়েত লাভের জন্যই প্রতি নামাযের প্রতি রাকাতে “ইহদিনাস সিরাতুল মুস্তাকীম” বলে দোয়া করতে হয়। এর চেয়ে বড় দোয়া যেমন নেই, তেমনি হিদায়েত প্রাপ্তির চেয়ে মহান আল্লাহতায়ালা থেকে শ্রেষ্ঠতর প্রাপ্তিও নাই। এই হিদায়েত প্রাপ্তিই ঈমানদারকে একজন কাফের থেকে আলাদা করে। হিদায়েত লাভের ফলেই সম্ভব হয় সিরাতুল মোস্তাকিমে চলা। কাফের, জালেম ও ফাসেকের জীবনে হিদায়েত নাই; ফলে তাদের জীবনে যা বাড়ে তা নিছক বিভ্রান্তি। এমন বিভ্রান্তিতে কেবল জাহান্নামে পৌঁছা সম্ভব, জান্নাতে নয়। কারণ, জান্নাতের জন্য তো চাই সিরাতুল মুস্তাকীম। আর ফাসেক ও জালেম তো তারাই যারা সমাজে দুবৃর্ত্ত ও দূর্নীতিবাজ এবং আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী। ফলে যে দেশটি দূর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হয়, সে দেশের মসজিদগুলো মুসল্লিতে যতই পূর্ণ হোক না কেন -তারা কি রহমত পায়? হিদায়েত লাভের জন্য শুধু মুখে কালেমা পড়লেই চলে না। শুধু মূর্তিপুঁজা ছাড়াটাই যথেষ্ট নয়। দূর্নীতি ছেড়ে সুনীতি এবং দুষ্কর্ম ছেড়ে নেক আমলের পথও ধরতে হয়। দোয়া কবুল তো এ পথেই আসে।
রোযার পরিপূর্ণ ফায়দা নিতে যা জরুরি তা হলে পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়া। রোযা পালনের কোর’আনী আহবান তো এসেছে ঈমানদারদের উদ্দেশ্য -জালেম, ফাসেক, কাফের ও মুনাফিকদের উদ্দেশ্যে নয়। মূল লক্ষ্য, ঈমানদারের তাকওয়া বৃদ্ধি। প্রাসাদ গড়তে ভিতটা প্রয়োজন, তাকওয়ার নির্মাণে ঈমান হলো সেই ভিত। তবে ঈমানদারীর অর্থ শুধু আল্লাহকে বিশ্বাস করা নয়। মক্কার কাফেরগণও আল্লাহকে বিশ্বাস করতো। সন্তানদের নাম নবীজীর (সা:) জন্মের পূর্বেও তাদের আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান রাখত। কিন্তু কাফেরদের এ বিশ্বাস বেশীদূর এগুয়নি। এ বিশ্বাসে তাই তাকওয়া সৃষ্টি হয়নি, ফলে ব্যক্তি ও সমাজ কোনটাই বিশুদ্ধ হয়নি। আল্লাহর উপর ঈমান আনাতে ব্যক্তির জীবনে পরিশুদ্ধি শুরু হয় মাত্র,পরিপূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার জন্য মুসলিমকে আরো অনেক দূর এগুতে হয়। তাকে পরিপূর্ণ অংশ নিতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার পরিকল্পিত প্রশিক্ষণে। শুধু একদিন দুদিন নয়, বরং জীবনের সবগুলো দিন ধরে। নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ হলো সে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।
রোযার ট্রেনিং কেন অপরিহার্য?
ভালো মানের কৃষক, শ্রমিক, ডাক্তার বা ইঞ্জিনীয়ার গড়ার জন্য লাগাতর ট্রেনিং চাই। তেমনি ট্রেনিং চাই নিষ্ঠাবান মুসলিম গড়ার জন্যও। সে ট্রেনিংয়ের মূল কথা হলো জিহ্বা, পেট ও যৌনতার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। জিহ্ববার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মিথ্যাচার, গিবত ও কলহ-বিবাদ থেকে নাযাত মেলে না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে অশান্তির মূল কারণ হলো লাগামহীন জিহ্ববা। তেমনি পেটের লালসার উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে পানাহারে অবাধ্যতা হয় শরিয়তী বিধানের। মানুষ তখন উপার্জনে দূর্নীতির আশ্রয় নেয়। তেমনি যৌন লালসার উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে মানুষ ব্যাভিচারে ধাবিত হয়। নবীজী (সা:) বলেছেন, অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে জিহ্ববা ও যৌনাঙ্গের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে। রমযানের মাস ব্যাপী রোযা মূলত সে নিয়ন্ত্রণকেই প্রতিষ্ঠা করে। রমযানের রোযা যদি সে নিয়ন্ত্রণ স্থাপনেই ব্যর্থ হয় তবে বুঝতে হবে রোযাদারের মাসব্যাপী ট্রেনিং সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে। রোযা তাকে দিনভর উপবাসের কষ্ট ছাড়া আর কিছু্ই দেয়নি। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের রোযা যে তাদের জীবনে কোনরূপ নিয়ন্ত্রণ আনতে পারিনি তা শুধু রমযানের মাসে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিতে ধরা পড়ে না, প্রকট ভাবে ধরে বিশ্বব্যাপী দূর্নীতিতে প্রথম হওয়ার মধ্য দিয়েও।
কোন প্রশিক্ষণই নিছক শারীরিক কসরতের বিষয় নয়। চাই জ্ঞান। রমযানের প্রশিক্ষণের সাথে অপরিহার্য হলো তাই কোর’আনের জ্ঞান। আর রমযান তো কোর’আন নাযিলের মাস। ওহীর এ জ্ঞান আনে ঈমানদারের মনোজগতে রুহানী বা আধ্যাত্মিক বিপ্লব। যেখানেই পরিশুদ্ধি ও পরিমর্জিত জীবন কাম্য, সেখানেই এরূপ কোর’আনী জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। লাগাতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছাড়া মানুষের জীবনে উৎকর্ষ অসম্ভব। পশু পশুরূপে জন্ম নেয়, মারাও যায় পশু রূপে। এদের জীবনে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি কোনরূপ চারিত্রিক উৎকর্ষ নেই। তাই পশুকুলে সমাজ গড়ে উঠে না, সভ্যতাও নির্মিত হয় না। কিন্তু মানুষকে পশু থেকে ভিন্নতর ও উন্নততর হতে হয়। এটিই জীবনের মূল সাধনা। নইলে মানুষরূপে জন্ম নিয়েও সে মারা যেতে পারে পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে। মানব সমাজে যে সেটি ঘটে সে সাক্ষ্যটি দিচ্ছেন খোদ আল্লাহতায়ালা। তাদের বিষয়েই পবিত্র কোর’আনে বলা হয়েছে ‘‘উলায়িকা কা’আল আনয়াম, বাল হুম আদাল।’’ অর্থ: “তারাই পশুর ন্যায় বরং পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট’’। অর্থাৎ এদের জীবনে উপরে উঠার কাজটাই হয়নি। বয়স বাড়ার সাথে তাদের ঈমান ও আমল বাড়েনি, বরং বেড়েছে নীচে নামাটি।
অপর দিকে জ্ঞান-সাধনায় অর্জিত উচ্চতর গুণে মানুষ ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর হতে পারে। এবং সে সামর্থ্য অর্জনের কাজটি ব্যক্তিকে জীবনভর করতে হয়। উচচতর সমাজ ও সভ্যতা নির্মিত হয় তো এমন মানুষের আধিক্যেই। আর এরূপ উচ্চতর মানুষ ও উচ্চতর সভ্যতার নির্মাণের মধ্য দিয়েই তো যাচাই হয় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব; সাম্রাজ্য বিস্তার বা পারমানবিক বোমা নির্মাণের সামর্থ্য দিয়ে সেটি হয় না। বস্তুত ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের আমৃত্যু আয়োজনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি পায় নেক আমলের সামর্থ্য। নেক আমল তখন ব্যক্তির জীবন-সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। এমন সংস্কৃতির নির্মাণে রোযার অবদান অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রোযায় শেখায় জীবন যাপনে সংযম, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তীতা। আনে আল্লাহ সচেতনতা, এবং সেটি সমগ্র দিন জুড়ে। প্রতি ওয়াক্তের নামায মাত্র কয়েক মিনিটের। এদিক দিয়ে রোযা সবচেয়ে দীর্ঘ ইবাদত। এবং সে ইবাদত ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও সংযমের মধ্য দিয়ে। একান্ত নির্জনেও ক্ষুধাগ্রস্ত ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে মুখে খাদ্য তুলে নেয় না। আল্লাহতায়ালা যে সব কিছু দেখেন -সে চেতনা এভাবেই রোযাদারের মনে আজীবন বদ্ধমূল হয়। সর্বকাজে এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর এমন ভয় এবং এমন আল্লাহ-সচেতনতাই হলো তাকওয়া। এমন তাকওয়া অর্জিত হলেই বুঝতে হবে রোযাদারের রোযা সফল হয়েছে।
ব্যর্থ হচ্ছে কেন এ প্রশিক্ষণ?
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সৈনিকের খাতায় নাম লেখালে বা প্রশিক্ষণ নিলেই কেউ ভাল সৈনিক রূপে গড়ে উঠে না। ভাল সৈনিক হতে হলে সৈনিক জীবনের মূল দর্শন ও মিশনের সাথেও সম্পূর্ণ একাত্ব হতে হয়। দেশের স্বাধীনতা ও সংহতিতে তাকে পূর্ণ বিশ্বাসী হতে হয়। এখানে আপোষ চলে না। সৈনিকের জীবনের মূল মিশন তো দেশের স্বাধীনতা ও সংহতির সংরক্ষণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রটিতেই যদি সংশয় থাকে তবে ভাল সৈনিক হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। সৈনিকবেশী এমন ব্যক্তিটির পক্ষে তখন বিদেশী শত্রুর চর হিসাবে কাজ করাও রুচিসিদ্ধ মনে হয়। কোর’আনের কসম খেয়েও এরা গাদ্দারী করে। এরাই কাফেরদের অস্ত্র নিয়ে নিজ দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। মুসলিম দেশকে এরা খন্ডিত করে বা পরাধীন করে। এবং উল্লাস ভরে মুসলিম হত্যাও করে। মুসলিম ইতিহাসে এমন বিশ্বাসঘাতক সৈনিকের সংখ্যা কি কম? তেমনি জীবনভর নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাতের প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েও বহু মানুষের জীবনে পরিশুদ্ধি আসে না। পরিশুদ্ধি তো একমাত্র তখনই আসে যখন নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাতের পাশপাশী একাত্ব হয় জীবন ও জগত নিয়ে ইসলামের মূল দর্শনের সাথে। কথা হলো, সে দর্শনটি কি? সেটি হলো, আল্লাহকে একমাত্র প্রভূ, প্রতিপালক, আইনদাতা ও রেযেকদাতারূপে মেনে নেওয়া এবং তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে নিজেকে আত্মসমর্পিত সৈনিক রূপে পেশ করা।
মুসলিমের মিশন মূলত আল্লাহর কাছে এক আত্মসমর্পিত গোলামের মিশন। সে দায়িত্ব নিছক নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাতে পালিত হয় না। সে দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রটি বরং বিশাল। সেটি সমগ্র দেশ, সমগ্র সমাজ, সমগ্র রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি জুড়ে। দায়িত্বপালনের লক্ষ্যে কখনো তাকে দ্বীনের প্রচারক হতে হয়, কখনো রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা হতে হয়, আবার কখনো সৈনিক বা জেনারেলের বেশে যুদ্ধও লড়তে হয়। মুসলিম শব্দটির উদ্ভব তো হয়েছে আত্মসমর্পণ থেকে, যার নমুনা পেশ করেছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ:)। যিনি আল্লাহর প্রতিটি হুকুমে – সেটি শিশু পুত্রের কোরবানি হোক বা নিজ দেশ ছেড়ে হিজরত হোক – সব সময়ই লাববায়েক (আমি হাজির এবং মেনে নিলাম) বলেছেন। নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাতের মত কোর’আনী প্রশিক্ষণ তো এমন আত্মসমর্পিত মুসলিমদের জন্যই; বেঈমান ও মুনাফিকদের জন্য নয়। যারা জান্নাত চায়, মহান আল্লাহতায়ালার এ প্রশিক্ষণ তো তাদেরকে সে মহাপুরস্কার লাভের জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলে। প্রতিটি ঈমানদার যেমন এ প্রশিক্ষণ থেকে ফায়দা পায়, তেমনি এর সাথে একাত্মও হয়।
অবমাননা যেখানে কোর’আনের
প্রশ্ন হলো, কোর’আনের জ্ঞান ছাড়া আল্লাহর নির্দেশিত প্রশিক্ষণ থেকে লাভবান হওয়া কীরূপে সম্ভব? চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়া কেউ কি রোগ-চিকিৎসার প্রশিক্ষণে যোগ্য বিবেচিত হয়? প্রচন্ড পরিহাসের বিষয়, মহান আল্লাহতায়ালা কোর’আনী জ্ঞানার্জনের তাগিদ দিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন বার বার, কিন্তু সে দিকে মুসলিমদের ভ্রুক্ষেপ নেই্। অনেক মুসলিমদের ব্যস্ততা দেখা যায় শুধু তেলাওয়াতে, কিন্তু কোর’আন বুঝায় নয়। তারাবিহ নামাযে কোর’আন খতমের আয়োজন হয় মসজিদে মসজিদে। কিন্তু আয়োজন নেই তেলাওয়াতকৃত আয়াতের অর্থ বুঝায়। কোর’আনের প্রতি এর চেয়ে বড় অবমাননা আর কি হতে পারে? অথচ সারা রমযান জুড়ে মুসলিম দেশগুলিতে পবিত্র কোর’আনের প্রতি সে অবমাননাটাই হচ্ছে। না বুঝে কোন শিশুও কোন বই পাঠ করে না। অথচ না বুঝে কোর’আন পাঠ হচ্ছে ঘরে ঘরে। কোর’আনী জ্ঞানের সে শূণ্যতাটি দেখা যায এমন কোর’আন পাঠকের আমলে, চরিত্রে ও রাজনীতিতে। ফলে এমন কোর’আন পাঠকারি ব্যক্তি মাসভর রোযা রাখলে কি হবে, আল্লাহর শরিয়ত প্রতিষ্ঠার পক্ষে সে কথা বলে না, বরং পক্ষ নেয় ইসলামের বিপক্ষ শক্তির বিজয় আনতে।
কথা হলো, যে ব্যক্তিটি চিন্তা-চেতনায় সেক্যুলার, যার সকল কর্মকান্ড ও অঙ্গিকার হলো আল্লাহর বিধানকে আইন-আদালত, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সকল অঙ্গণে পরাজিত করা -সে ব্যক্তি আজীবন নামায-রোযায় লিপ্ত হয়েও কি কোন পরিশুদ্ধি পায়? সে তো বরং কর্ম জীবনে মিথ্যুক, স্বৈরাচারি, জালেম ও দূর্নীতিবাজ হয়। রাজনীতিতে এরাই শয়তানী শক্তির একনিষ্ঠ সহযোগী হয়। এদের কারণেই শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের দেশ হয়েও বাংলাদেশ দূর্নীতিতে বিশ্বে বার বার প্রথম হয়। দেশে মসজিদ বাড়ছে। মসজিদে নামাযী ও রোযাদারদের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু তাতে দেশের ইজ্জত বাড়ছে না। যে সমাজ ও রাষ্ট্র চোর-ডাকাত ও ভোটডাকাত দুর্বৃত্তদের দ্বারা অধিকৃত সে সমাজে রোযা যে তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে -সেটি কি প্রমাণের অপেক্ষা রাখে? এ ব্যর্থতার কারণেই বছর ঘুরে বার বার মাহে রমযান এলেও মুসলিম সমাজে পরিশুদ্ধি আসছে না। এবং সমাজও সভ্যতর হচ্ছে না। বরং দিন দিন দুর্বৃত্তি এবং বিশ্বজুড়া অপমানই প্রকটতর হচ্ছে। ২২/০৭/২০১২
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- সেক্যুলারিস্টদের ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ এবং যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে
- বাংলাদেশে হিফাজতে ইসলাম ও ইসলামের হিফাজতে ভয়ানক ব্যর্থতা
- তাবলীগ জামায়াত কতটা দূরে সরেছে ইসলাম থেকে?
- Bangladesh: A Tale of Success of a Robber and the Failure for the Opposition
- বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের তাণ্ডব এবং সংকটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Mohammad Arifur Rahman on জিন্নাহ’র সাদকায়ে জারিয়া ও মুজিবের গুনাহে জারিয়া
- সিরাজুল ইসলাম on জিন্নাহ’র সাদকায়ে জারিয়া ও মুজিবের গুনাহে জারিয়া
- Abdul Aziz on বিবিধ ভাবনা ৮২
- Fazlul Aziz on বাঙালি ও অবাঙালি মুসলিমের বৈষম্য এবং ফ্যাসিবাদী মিথ্যচার
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের তান্ডব: মুক্তি কীরূপে?
ARCHIVES
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018