আবরার হত্যাঃ দায়মুক্ত কি শেখ হাসিনা?

দুর্বৃত্ত-অধিকৃত রাষ্ট্রঃ দুর্বৃত্তায়নের মূল হাতিয়ার

রাষ্ট্রই মানব সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হলে এটি পরিণত হয় দুর্বৃত্তায়নের ভয়ানক ও অপ্রতিরোধ্য হাতিয়ারে। তখন সুনামি শুরু হয় গুম, খুন, ধর্ষণসহ নানারূপ অত্যাচারের। সরকার প্রধানকে তাই শুধু শাসক হলে চলে না, নাগরিকদের জন্য দায়িত্বশীল অভিভাবক এবং অনুকরণীয় আদর্শও হতে হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি ভোট-ডাকাতির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন, তিনি কি করে অন্যদের জন্য চরিত্রের মডেল হতে পারেন। তিনি তো মডেল দুর্বৃত্তির। অথচ শাসকের আসনে বসেছেন খোদ নবীজী (সাঃ)। এটিই নবীজী (সাঃ)র শ্রেষ্ঠ সূন্নত। এভাবে তিনি শিক্ষ্যণীয় আদর্শ রেখে গেছেন মুসলিম রাষ্ট্রে শাসকের আসনে কে বসবে এবং কীভাবে শাসিত হবে দেশ। নবীজী (সাঃ)র ইন্তেকালের পর এ গুরুত্বপূর্ণ তাই শূন্য থাকেনি। দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃতও হয়নি। বরং নবীজী (সাঃ)র পর সে আসনে বসেছেন নবীজী (সাঃ)র আদর্শের সবচেয়ে কাছের এবং মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ লোকগুলি। বাংলাদেশের চেয়ে ৫০ গুণ বৃহ্ৎ রাষ্ট্রের শাসক হয়েও একটি মাত্র উঠ এবং একজন মাত্র সহচরকে নিয়ে হযরত উমর (রাঃ) ৫০০ মাইলের বেশী পথ সফর করে সরকারি কাজে জেরুজালেম গেছেন। মধ্য রাতে বিছানায় না ঘুমিয়ে খাদ্যের বস্তা নিজ পিঠে টেনে দুস্থ্য মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মিত  হয়েছিল এমন লোকদের দ্বারাই। অথচ বাংলাদেশে সরকারি উদ্যোগে আরবাবের ন্যায় বিবেকবান লোকদের বেঁচে থাকাটিই অসম্ভব করা হচ্ছে।

মুসলিমদের শুধু নামায-রোযা, দাড়ি-টুপি ও পোষাক-পরিচ্ছদের সূন্নত পালন করলে চলে না, রাজনীতির অঙ্গণে নবীজী (সাঃ)র প্রতিষ্ঠিত সূন্নতগুলিও পালন করতে হয়। নইলে সমাজ জীবনে অনিবার্য় হয় বিপর্যয়। শাসন ক্ষমতা যখন হালাকু, চেঙ্গিজ, হিটলার বা কোন ভোট-ডাকাতের হাতে  অধিকৃত হয় তখন যা অনিবার্য হয়ে উঠে তা হলো অন্য গোত্র, অন্য দল ও অন্য ধর্মের মানুষের উপর গণহত্যা,গণধর্ষণ ও গণনির্যাতন। বাংলাদেশের মূল সমস্যাটি এখানেই। ভোট-ডাকাতির অপরাধে যে দুর্বৃত্তের জেলে যাওয়া উচিত  ছিল -সে এখন প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, এক লাশের বদলে দশ লাশ ফেলার রাজনীতি। ফলে বাংলাদেশের পথে ঘাটে -এমন কি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, মানুষ লাশ হচ্ছে। ভোট-ডাকাত প্রধানমন্ত্রীর এমন নীতির ফলে যারা কোনদিন খুন করেনি তারাও নেতাকে খুশি করতে নৃশংস খুনিতে পরিণত হচ্ছে। সেটিই দেখা গেল বুয়েটে আবরার হত্যার মধ্য দিয়ে। বুয়েটের প্রতিটি ছাত্র্ই অতি মেধাবী। বুয়েটে ভর্তির আগে তাদের কেউই খুনি ছিল না। কিন্তু খুনি হয়েছে বুয়েটে ভর্তির পর। খুনি উৎপাদনে বুয়েট এ ক্ষেত্রে যে ইতিহাস গড়লো –বর্বরতায় তা কি কোন ডাকাত পল্লীর চেয়ে কম? খুনি হওয়ার সে প্রশিক্ষণ পেয়েছে বুয়েটে অধ্যয়নরত ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতা-কর্মীদের হাত ধরে। প্রতি হলে টর্চার সেলসহ খুনি উৎপাদনের এ বিশাল কারখানাটি লাগাতর কাজ করেছে ভিসিসহ শত শত শিক্ষকের চোখের সামনে। এবং তারা সেটিকে দেখেও না দেখার ভান করেছে।

শেখ হাসিনার শুধু প্রধানমন্ত্রী নয়, তিনি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছসেবক লীগের ন্যায় আওয়ামী ঘরানোর সকল সংগঠনের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক অভিভাবকও। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গণে এসব সংগঠনের নেতাকর্মীগণ যা কিছু করে তাতে প্রতিফলন ঘটে খোদ শেখ হাসিনার রাজনৈতিক স্বপ্ন, নীতি ও আদর্শের। সে বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আসামী অনিক সরকার তার জবানবন্দীতে। আসামী অনিক সরকারও একজন মেধাবী ছাত্র। নটরড্যাম কলেজ থেকে পাস করে সে বুয়েটে ভর্তি হয়। ভর্তির আগে সে খুনি ছিল না। কিন্তু কি ভাবে খুনের আসামী হলো সে বিষয়টি তার জবানবন্দীতে বলেছে এভাবে, “সিনিয়র জুনিয়র যাই হোক, আমরা তাদের (সরকারের সাথে ভিন্নমত পোষণকারিদের) এভাবেই পেটাতাম। কিন্তু দুর্ঘটনাক্রমে আবরারের মৃত্যু হয়েছে। মতের সাথে না মিললে কাউকে পিটিয়ে বের করে দিতে পারলে ছাত্রলীগের হাই কমান্ড আমাদের প্রশংসা করতো। ছাত্রলীগের এ সিস্টেমই আমাদের নিষ্ঠুর বানিয়েছে।” (দৈনিক সংগ্রাম, ১৫.১০.২০১৯)। প্রশ্ন হলো, ছাত্রলীগের হাই কমান্ড কেন এরূপ নিষ্ঠুর নীতি নীচের ক্যাডারদের উপর চাপিয়ে দিত? এর উত্তর একটিই। ছাত্রলীগের হাই কমান্ড এমন নিষ্ঠুরতায় নামতো তাদের অভিভাবক শেখ হাসিনাকে খুশি করতে। কারণ হাসিনার নির্দেশ তো এক লাশের বদলে দশ লাশ ফেলার। হাসিনার কাছে ছাত্রদের চরিত্র গঠন গুরুত্ব পায়নি। বরং গুরত্ব পেয়েছে ছাত্রদের চরিত্র ধ্বংস করে হলেও নিজের গদির নিরাপত্তা দেয়াটি।

 

ছাত্র রাজনীতিঃ দুর্বৃত্তায়নের সরকারি হাতিয়ার

খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস ও নির্যাতনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের গলার রশি এভাবে ঢিল করে দেয়ারও একটি ইতিহাস আছে। পাকিস্তান আমল থেকেই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মূল হাতিয়ারটি হলো ছাত্র-রাজনীতি। তাই যারা সরকার হটাতে চায় বা সরকারে থাকতে চায় -ছাত্র রাজনীতিতে তাদের বিনিয়োগটি বিশাল। যে দেশে সামরিক বাহিনীর লোকেরা বার বার হাতিয়ার উঁচিয়ে ক্ষমতা দখল করে -তাদের তুষ্ট করতে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বড়  বড় প্লটের ব্যবস্থা করতে হয়ে। তাদের বিবিদের  জন্য ২৪ ঘন্টা গাড়ীর ব্যবস্থা করতে হয়। এবং বাড়ী নির্মাণের জন্য তাদেরকে অতি কম সূদে অর্থ জোগাতে হয়। দেশের খেদমত যেন একমাত্র তারাই করেন! পেশাদারি কাজের বাইরে নিজ দেশ দখলে ভারতীয় সেনাবাহিনী সেরূপ গুন্ডামী করে না বলেই তাদের সে সুযোগ-সুবিধা নেই। ফলে তাদের যেমন প্লট মেলে না, তেমনি স্ত্রীদের জন্য গাড়িও মেলে না। তাই সেদেশে স্কুটার বা মটর সাইকেলে চড়ে সেনা অফিসারদের পারিবারিক কাজ সারতে হয়।

দেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু এবং স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা পাওয়াতে ছাত্রনেতাদের এখন পোয়াবারো। একদিনে জনগণ যেমন শক্তিহীন হয়েছে, তেমনি ক্ষমতা ও কদর বেড়েছে ছাত্র নেতাদের। তাদের সুযোগ সুবিধা সেনাবাহিনীর চেয়েও অধীক। কারণ, প্রতিপক্ষ নির্মূলে ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারদের ন্যায় সেনাসদস্যগণ আবাসিক হলগুলিতে গিয়ে অপারেশন চালাতে অক্ষম। তাছাড়া পিল খানায় ৫৬ সেনা অফিসারকে খুন করে সেনাবাহিনীর মেরুদন্ডই ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। ফলে বড় বড় প্লটের বদলে তাদেরকে এখন ফ্লাট দিলেই চলে। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সামর্থ্যটি এক্ষেত্রে বিশাল। যে কোন সময় সরকারের জন্য তারা বিপদ ঘটাতে পারে। তাই তাদের মনতুষ্টি করে চলতে হয় সরকারকে। এজন্যই লুটপাটের সকল দরজা তাদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে অর্থ-উপার্জনের জন্য ছাত্রনেতাদের এখন আর রাত জেগে লেখাপড়া করা এবং পাশ করে চাকুরি করার ফিকির করতে হয় না। সেনাবাহিনীর অফিসারদের ঢাকায় এক খানি ফ্লাটের মালিক হতে ১০-২০ বছরের চাকুরি শেষ করতে হয়। অথচ ছাত্রলীগের নেতাগণ বহু বাড়ির মালিক হয় এবং বহু কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স গড়ে তোলে ছাত্রাবস্থাতেই। এ ধরণের সুযোগ পেতে তাদের উপর অর্পিত দায়ভারটি হলো, ক্যাম্পাস থেকে সরকার বিরোধীদের নির্মূল। নির্মূলের সে প্রক্রিয়াতেই নৃশংস ভাবে নিহত হয়েছে আবরার ফাহাদ।

 

রাজনীতি খুনি উৎপাদনের

অধীক অর্থলাভ এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দের লোভে মেধাবী ছাত্ররা অতীতে মন দিয়ে লেখাপড়া করতো। পড়াশুনা শেষে ভাল চাকুরির খোঁজ করতো। দেশে ভাল চাকুরি না জুটলে বিদেশী পাড়ি জমানোর চেষ্টাও করতো। কিন্তু এখন সে রীতি পাল্টে গেছে। দেশের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সাথে সাথে ছাত্ররা দেখতে পায় বিপুল অংকের অর্থপ্রাপ্তির অবাধ সুযোগ। এখানেই ছাত্র লীগের নেতাকর্মীগণ ব্যস্ত নিজ দলের সৈন্য সংগ্রহে। তাদের নজরে পড়ে এসব মেধাবী ছাত্রগণ। সরকার দলীয় এ ছাত্র-সৈনিকদের নির্ধারিত কোন বেতন নাই। তবে যা আছে তা বেতনের চেয়েও অধীক। তাদের প্রতিপালনে সরকারি প্রজেক্টের নামে বরাদ্দ হয় বিপুল অর্থ। সে অর্থপ্রাপ্তির লোভে যারা কোনদিনও গুন্ডামী করেনি তারাই পরিণত হয় নৃশংস খুনিতে। তাদের দিয়েই গড়ে উঠে সরকারি দলের ক্যাডার বাহিনী। প্রতি হোস্টেলে গড়ে উঠে টর্চার সেল এবং প্রতিষ্ঠা পায় সন্ত্রাসের সংস্কৃতি। ফলে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজ যে সন্ত্রাস ও খুনখারাবী – তার জন্য কি কোন ডাকাত-পাড়ার খুনিদের দায়ী করা যায়। দায়ী তো দেশের ভোট-ডাকাত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজের গদি বাঁচাতে যেমন ভোট ডাকাতিকে জায়েজ করেছেন, তেমনি বিরোধীদের নির্মূলে মেধাবী ছাত্রদেরও  নৃশংস খুনিতে পরিণত করেছেন। ফলে শহীদ আবরার হত্যার মামলায় কিছু লোককে শাস্তি দিলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? এজন্য যা জরুরী তা হলো চোর-ডাকাত, সন্ত্রাসী ও খুনী উৎপাদনের যে রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তার নির্মূল। সে নির্মূলের কাজে যাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া উচিত সে ব্যক্তিটি হলেন দেশের ভোট-ডাকাত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের সরকার প্রধান রূপে ভোট-ডাকাত গদিতে থাকলে অন্যরাও চোর-ডাকাত ও খুনি হতেই  উৎসাহ পাবে। কারণ, ভোট-ডাকাতি করে যদি দেশের মালিক-মোক্তার হওয়া যদি বৈধ হয়, তবে অন্যরাই বা সৎ হবে কেন?  

 

বিচারের নামে গদি বাঁচানোর রাজনীতি

সরকার খুনিদের বিচারে বাধ্য হচ্ছে স্রেফ গণরোষ দমনের লক্ষ্যে, দেশে খুন-গুম-সন্ত্রাস বন্ধ হোক সে লক্ষ্যে নয়। শহীদ আবরার খুন না হয়ে যদি আহত হতো তবে বিষয়টি হাসিনার কেশাগ্রও স্পর্শ করতো না। তখন আবরারের পিতামাতাকে গণভবনে ঢাকা হতো না। পত্রিকায় বড় জোর খবর হতো জঙ্গি শিবির কর্মীকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। তখন সরকার ও সরকারি মিডিয়া তখন তৃপ্তির ঢেকুর কাটতো। অতীতে এভাবেই সরকারের নাকের ডগার উপর বসে শত শত ছাত্রকে পঙ্গু করা হয়েছে। শাপলা চত্ত্বরের শহীদদের ন্যায় আবরারের লাশ গুম করতে পারলেও কোন খবর হতো না। সে চেষ্টাও কি কম হয়েছে? পত্রিকায় প্রকাশ, খুনিরা পুলিশকে হোস্টেলে ঢুকতে না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে দিয়ে লাশ গায়েবের চেষ্টাও করেছে। এ নৃশংস হত্যাকান্ডকে কি ভাবে ম্যানেজ করা যায় তা নিয়ে ভিসিকে ৩৬ ঘন্টা উপরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছেন। সেসব কৌশল ব্যর্থ হওয়াতেই সরকার বিচারের দোহাই দিচ্ছে। অথচ খুনের বিচারে ভোট-ডাকাত সরকারের সামান্যতম আগ্রহ থাকলে শত শত মানুষ যে এ সরকার আমলে গুম-খুনের শিকার হয়েছে সেগুলিরও বিচার হতো। বিচার হতো ২০১৯ সালের ৬ই মে শাপলা চত্ত্বরে যে অসংখ মানুষকে খুন করা হলো তারও। বিচারের নামেও সরকার তার গদি বাঁচানোর রাজনীতি করে। শহীদ আবরারের বেলায় সে নাটকই শুরু হয়েছে। ১৭/১০/২০১৯        

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *