ঈমানদার ও বেঈমানের ভাবনা ও তাড়না
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on May 18, 2025
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
ঈমান দেখা যায় ভাবনা ও তাড়নার মাঝে
ব্যক্তির ভাবনা ও তাড়নার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির ঈমানদারী বা বেঈমানী কথা বলে। আর ব্যক্তির ভাবনা ও তাড়না তো গোপন বিষয় নয়; তা স্পষ্ট দেখা যায় তার কর্ম, চরিত্র, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির মাঝে। ফলে দিনের সূর্যকে যেমন স্পষ্ট দেখা যায়, তেমনি স্পষ্ট দেখা যায় ব্যক্তির ঈমানদারী ও বেঈমানী। কারণ, ঈমানদার ও বেঈমান -এ উভয় প্রকারের মানুষই তাদের ভাবনা ও তাড়নার আলামতগুলি সাথে নিয়ে চলা ফেরা করে। ঈমানদারী ও বেঈমানী হলো মনজগতের বিষয়; খালি চোখে তা দেখা যায়না। কিন্তু সেগুলির প্রকাশ ঘটে তার কথা, কর্ম, চরিত্র রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির মাঝে। ফলে তার ঈমানদারী ও বেঈমানী কখনো গোপন থাকে না। ব্যক্তির ঈমানের পরীক্ষা হয় প্রতি মুহুর্তে; সেটি কর্ম, চরিত্র, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে। স্কুলের পরীক্ষায় যে ফেল করে তার কাছে সে খবর গোপন থাকে না। তেমনি জীবনের পরীক্ষায় যে ফেল করে -সেটিও তার কাছে গোপন থাকেনা। তাছাড়া কে কোন পক্ষের সৈনিক, তা অন্যরা না জানলেও সে নিজে জানে।
তাছাড়া মহান আল্লাহ তায়ালার নীতি হলো, তিনি কারো বেঈমানী বা মুনাফিকি গোপন থাকতে দেন না। সেটি প্রকাশ করে দেয়াই তাঁর নীতি। পবিত্র কুর’আনে এ বিষয়ে মহান আল্লাহর বয়ান:
أَحَسِبَ ٱلنَّاسُ أَن يُتْرَكُوٓا۟ أَن يَقُولُوٓا۟ ءَامَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ
وَلَقَدْ فَتَنَّا ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۖ فَلَيَعْلَمَنَّ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ صَدَقُوا۟ وَلَيَعْلَمَنَّ ٱلْكَـٰذِبِينَ
অর্থ: “মানুষ কি মনে করে নিয়েছে যে, ঈমান এনেছি একথা বললেই ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদের পরীক্ষা করা হবে না? অথচ আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের অবশ্যই পরীক্ষা করেছি এবং আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিয়েছেন এবং প্রকাশ করে দিয়েছেন তাদের মধ্যে কারা ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যাবাদী।” –(সুরা আন কাবুত, আয়াত ২ ও ৩) ।
ঈমান ও বেঈমানীর বড় প্রকাশটি ঘটে রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে
ঈমানদারী ও বেঈমানীর সবচেয়ে বড় প্রকাশটি ঘটে ব্যক্তির রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির মাঝে। তার রাজনীতিই বলে দেয় সে কোন পক্ষের সৈনিক; আল্লাহর পক্ষের, না শয়তানের পক্ষের। মুনাফেকের মুনাফিকি তার নামাজ-রোজা-হজ্জে ধরা পড়ে না। কারণ সেগুলি সে ঈমানদারদের মতই করে। কিন্তু সে তার রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি ভিন্ন ভাবে করে; সে তখণ ইসলামের শত্রুপক্ষের সাথে খাড়া হয়। তখন সে নিজেই নিজেকে মুসলিম ও ইসলাম থেকে আলাদা করে ফেলে। তখন নিজের বেঈমানী সে নিজেই প্রকাশ করে দেয়। নামাজ-রোজা-হজ্জ পালন করা সত্ত্বেও তাকে দেখা যায় মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধের রাজনীতিতে। নবীজী (সা:) যেরূপ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন এবং ১০টি বছর যে রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন, সেরূপ একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সে ঘোরতর বিরোধী।
বেঈমানগণ রাষ্ট্র গড়তে চায় জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, সেক্যুলারিজম ও কম্যুনিজমের ন্যায় হারাম মতবাদের প্রতিষ্ঠা দিতে। মুসলিম রাষ্ট্রের সংহতির চেয়ে মুসলিম রাষ্ট্রের বিভক্তিই তার কাছে রাজনৈতিক এজেন্ডা ও উৎসবের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার লোকদের মাঝে সে বেঈমানী দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে ভারতকে সাথে নিয়ে যুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্র কবরে গেছে, বাকশালী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং বাংলাদেশ ভারতে গোলাম রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে তো সে বেঈমানীর কারণে। আরব জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলারিস্টদের মাঝে সে বেঈমানী দেখা গেছে ১৯১৭ সালে যখন তারা খেলাফত ভাঙ্গতে ইংরেজদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে এবং ইংরেজদের বিজয়ী করতে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তো সে বেঈমানীর কারণে। ইসলাম যেখানে ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে প্যান-ইসলামী হতে বলে, বেঈমান ব্যক্তিটি সেখানে প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্বের বিরুদ্ধে খাড়া হয়। ভাষা, বর্ণ বা অঞ্চল ভিত্তিক পরিচয়টি তার কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায়। তাকে দেখা যায় ব্রিটিশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের ন্যায় কাফির শক্তির পাশে তাদের সহযোদ্ধা রূপে। এভাবেই মুনাফিকগণ তাদের মুনাফিকি নিজেরাই প্রকাশ করে দেয়। ফলে তাদের বেঈমানী দেখার জন্য তাদের হৃদয়ের গভীরে প্রবেশের প্রয়োজন পড়ে না। তাদের কাজগুলি কাফিরদের মতই; কিন্তু তারা যেহেতু নিজেদের মুসলিম বা ঈমানদার রূপে দাবী করে, তাদেরকে কাফির বলা যায় না। মুনাফিক বলতে হয়।
ঈমানের লক্ষণ: কুর’আনী জ্ঞানার্জনের তাড়না
ঈমানদারের বড় লক্ষণটি হলো, কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জনে তার বিরামহীন ব্যস্ততা। মৌমাছি যেমন ফুল খুঁজে খুঁজে মধু সংগ্রহ করে, ঈমানদারও তেমনি পবিত্র কুর’আনের পৃষ্ঠাগুলি থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করে। পবিত্র কুর’আন হলো জান্নাতের রোডম্যাপ। ফলে পথ চলায় নজরটি রোডম্যাপের উপর রাখতে হয়। নইলে পথ হারানোটিই অনিবার্য হয়। জীবন চালনার তুলনাটি চলে ইউরোপ-আমেরিকার ৬ বা ৮ লেনের motor wayতে গাড়ি চালানোর সাথে। সে মটর ওয়ে’তে মাঝে মাঝেই থাকে মূল রাস্তা থেকে exit নেয়া বা বেরিয়ে যাওয়ার সংযোগ রাস্তা তথা junction থাকে। সামান্য ক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হলে যেমন দুর্ঘটনা ঘটে, তেমনি সম্ভাবনা থাকে motor way’র junction দিয়ে ভূল রাস্তায় বেরিয়ে যাওয়ার। তাই গাড়ির চালকের তাকওয়া হলো প্রতিক্ষণ রোড ম্যাপের দিকে নজর রাখা। তেমনি সিরাতাল মুস্তাকীম চলতে হলে প্রতিক্ষণ কুর’আনী রোডম্যাপ অনুসরণে মনযোগী হতে হয়। কুর’আনী রোডম্যাপ ধরে পথ চলায় এরূপ অবিরাম মনযোগ এবং তা থেকে বিচ্যুত হওয়ার লাগাতর ভয়ই হলো মু’মিনের তাকওয়া। তাই যারা জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, কম্যুনিজম, ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের পথে চলে, বুঝতে হবে তারা সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুৎ হয়েছে। সেটিই বেঈমানের লক্ষণ। তারা ভূল রাস্তায় বেরিয়ে গেছে। আর প্রতিটি ভূল রাস্তাই তো জাহান্নামের পথ।
পবিত্র কুর’আন হলো মহান আল্লাহ তায়ালার পবিত্র রশি; পবিত্র কুর’আনের সেটিই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার দেয়া পরিচয। এ পবিত্র রশি মু’মিনের সংযোগ গড়ে তাঁর মহান রব’য়ের সাথে এবং পথ দেখায় জান্নতের। তাই যে ব্যক্তি এ রশিকে আঁকড়ে ধরে সেই আল্লাহকে পায় অর্থাৎ জান্নাত পায়। বলা হয়েছে:
وَٱعْتَصِمُوا۟ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعًۭا وَلَا تَفَرَّقُوا۟
অর্থ: “এবং তোমরা আল্লাহর রশিকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৩)।
উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহর রশি বলতে কুর’আনকে বুঝানো হয়েছে। তাই ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য হলো, সে বলিষ্ঠ ভাবে আঁকড়ে ধরে পবিত্র কুর’আনকে। পবিত্র কুর’আনকে আঁকড়ে ধরার অর্থ, কুর’আনের জ্ঞানকে আত্মস্থ করা এবং পদে পদে তা অনুসরণ করা। তাই ঈমানদারের ভাবনা ও তাড়নায় থাকে কুর’আন বুঝা ও অনুসরণের তাড়না। সেটি না থাকাটিই বেঈমানী। বিষয়টি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ রশিকে তথা কুর’আনকে আঁকড়ে ধরাকে ফরজ করা হয়েছে। অর্থাৎ কুর’আন থেকে দূরে থাকার অর্থ ইসলাম থেকে দূরে থাকা। তাই নিজেকে যে কুর’আন থেকে দূরে রাখে সে মুসলিম হতে পারেনা। বস্তুত নবীজী (সা:) আমলে মুসলিম জীবনের শুরুই হয়েছিল কুর’আন বুঝার মধ্য দিয়ে, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত দিয়ে নয়। ৫ ওয়াক্ত নামাজ এবং মাহে রমজানের মাসব্যাপী রোজা ফরজ হয়েছে নবুয়ত প্রাপ্তির ১১ বছরের বেশী কাল পরে।
ঈমানের পরিচয়: আল্লাহর এজেন্ডার সাথে একাত্মতা
পবিত্র কুর’আনে আরো বলা হয়েছে:
وَكَيْفَ تَكْفُرُونَ وَأَنتُمْ تُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ ءَايَـٰتُ ٱللَّهِ وَفِيكُمْ رَسُولُهُۥ ۗ وَمَن يَعْتَصِم بِٱللَّهِ فَقَدْ هُدِىَ إِلَىٰ صِرَٰطٍۢ مُّسْتَقِيمٍۢ
অর্থ: “এবং তোমরা কিভাবে কুফুরি করো (তথা অবিশ্বাস বা বিদ্রোহ করো)? অথচ তোমাদেরকে তেলাওয়াত শোনানো হয় কুর’আনের আয়াতকে এবং তোমাদের মাঝে রয়েছেন আল্লাহর রাসূল। এবং যে ব্যক্তি শক্ত বন্ধন গড়লো আল্লাহর সাথে নিশ্চিত ভাবে সেই নিজেকে পরিচালিত করলো সিরাতাল মুস্তাকীমের দিকে।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০১)।
উপরিউক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। কারা সিরাতাল মুস্তাকীম তথা জান্নাতের পথ পাবে -সে বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। বলা হয়েছে, সিরাতাল মুস্তাকীমে পরিচালিত হবে তারাই যারা বন্ধন গড়বে মহান আল্লাহর সাথে। প্রশ্ন হলো, মানব সন্তান কিরূপে বন্ধন গড়বে মহান আল্লাহর সাথে? এ বিশ্বমাঝে আল্লাহ তো অদৃশ্য। এ প্রশ্নের উত্তর হলো, মহান আল্লাহ তায়ালা অদৃশ্য হলোও পবিত্র কুর’আনে তিনি তাঁর পরিচিতি ও এজেন্ডাকে সুস্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান করেছেন। সে এজেন্ডা ঘোষিত হয়েছে এভাবে:
هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُشْرِكُونَ
অর্থ: “তিনিই হলেন সেই সত্ত্বা (আল্লাহ) যিনি তার রাসূলকে পথ নির্দেশনা ও সত্য দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন, এবং সেটি এজন্য যে তার দ্বীন (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা পাবে সকল জীবন বিধান, ধর্ম বা মতাদর্শের উপর। যদিও মুশরিকদের কাছে সেটি অপছন্দের।” –(সুরা সাফ, আয়াত ৯)।
উপরিউক্ত আয়াতে ঘোষিত হয়েছে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডা। একই রূপ ঘোষণা এসেছে সুরা তাওবা ও সুরা ফাতাহ’তে। সে এজেন্ডার কথা ঘোষিত হয়েছে সূরা আনফালের ৭ নম্বর আয়তে। বলা হয়েছে:
وَيُرِيدُ ٱللَّهُ أَن يُحِقَّ ٱلْحَقَّ بِكَلِمَـٰتِهِۦ وَيَقْطَعَ دَابِرَ ٱلْكَـٰفِرِينَ
অর্থ: “এবং আল্লা হ চান তাঁর কালিমা তথা কুর’আন দিয়ে সত্যকে সত্য রূপে প্রতিষ্ঠা দিবেন এবং শিকড় কেটে দিবেন কাফিরদের।”
বস্তুত এভাবেই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র এজেন্ডাকে পবিত্র কুর’আনে বার বার তুলে ধরেছেন। ঈমানদার তো তারাই যারা সে এজেন্ডার সাথে একাত্ম হয়। এবং যারা একাত্ম হয়, তারাই বন্ধন গড়ে মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে। এবং যারা বন্ধন গড়ে, একমাত্র তারাই পায় জান্নাতে চলার সিরাতাল মুস্তাকীম। নইলে অনিবার্য হয় জাহান্নামে পৌঁছা। প্রশ্ন হলো, যারা কুর’আন পড়লো না, এবং পড়লেও বুঝলো না, তারা মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার কথা জানবে কিরূপে? সে এজেন্ডার সাথে একাত্মই বা হবে কিরূপে? ফলে জান্নাতের পথই পাবেই বা কিরূপে? এমন অজ্ঞ মানুষেরা বেঈমান হবে এবং আল্লাহর এজেন্ডার প্রতিপক্ষ রূপে দাঁড়াবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? বস্তুত সে ব্যর্থতার কারণেই বাংলাদেশে মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদে লোক নাই।
বেঈমানীর লক্ষণ: কুর’আনের প্রতি অবহেলা ও অবমাননা
পবিত্র কুর’আন হলো ওহীর জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাণ্ডার। মানব জাতির জন্য কুর’আনই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। কুর’আনের আগে যে কিতাবগুলি নাযিল হয়েছিল, সেগুলি বিকৃত হয়ে গেছে। এখন একমাত্র কুর’আনই হলো অবিকৃত এবং বিশুদ্ধ ভাবে সংরক্ষিত কিতাব। অসংখ্য পাহাড়-পর্বত, বিস্তৃত স্থল ভূমি ও সাগর-সমুদ্রে ভরা এ পৃথিবীর সব কিছুই যদি স্বর্ণে পরিণত হয়, তা দিয়েও জান্নাতের এক ইঞ্চি জায়গা কেনা যাবে না। জান্নাতে নেয়ার সামর্থ্য রাখে একমাত্র পবিত্র কুর’আন। এ কুর’আন মুসলিমদের হাতে আছে বলেই বিশ্ববাসীর মাঝে তারাই হলো সবচেয়ে ভাগ্যবান। তবে প্রচণ্ড পরিতাপের বিষয় হলো, কুর’আন থেকে কল্যাণ নিতে পারছে না আজকের মুসলিমগণ। অথচ এ কুর’আনই অতীতে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মাণের সামর্থ্য জুগিয়েছিল। অথচ আজ মুসলিমদের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় অবহেলা হচ্ছে মহান রব’য়ের এই সর্বশ্রেষ্ঠ দানটির সাথে। পৃথিবী পৃষ্ঠে এমন কোন বই নাই যা না বুঝে পড়া হয়, কিন্তু পবিত্র কুর’আন পাঠ করা হয় না বুঝে। ফলে কুর’আন বুঝা এবং তা থেকে হিদায়েত নেয়ার কাজটি হচ্ছে না। পবিত্র কুর’আনের এর চেয়ে বড় অবমাননা আর কি হতে পারে? অথচ তেলাওয়াতের নামে সে অবমাননা ধর্মকর্মে পরিণত হয়েছেবাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ বহু মুসলিম দেশে। রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিচার-আচার, অর্থনীতি ও সমাজ নীতির নীতি প্রণয়নে কুর’আনকে অনুসরণ করা হয়না। অনুসরণ করা হয় নানা রূপ ইসলামবিরোধী মতবাদকে। এভাবেই মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে বন্ধন গড়ার বদলে বিদ্রোহ গড়া হচ্ছে। এরপরও কি বেঈমানদের বেঈমানী গোপন থাকে?
ঈমান চায় লাগাতর পুষ্টি; সে পুষ্টি জোগায় কুর’আনের জ্ঞান। সে জ্ঞান মু’মিনের আমলের ওজন বাড়ায়। পানাহার ছাড়া দেহ বাঁচে না, তাই প্রতিটি ব্যক্তির প্রতি দিনের চিন্তাটি পানাহারের সংস্থানকে সুনিশ্চিত করা। এজন্যই সে পেশা বেছে নেয় এবং উপার্জনে নামে। কিন্তু পানাহার সংগ্রহের সাথে ঈমানদার ব্যক্তির থাকতে হয় একটি বাড়তি চিন্তা; সেটি হলো তার ঈমান বাঁচানোর চিন্তা। সেজন্য তাকে পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞান সংগ্রহে নামতে হয়। এবং সে জ্ঞান অপরিহার্য হলো ঈমানকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে। সে জ্ঞান যতই বৃদ্ধি পায়, ততই মজবুত হয় ঈমান। অপর দিকে সে জ্ঞানের অভাবে মৃত্য ঘটে ঈমানের। মহান আল্লাহ তায়ালা চান তাঁর ঈমানদার বান্দা পবিত্র কুর’আন থেকে নিয়মিত জ্ঞান অর্জন করুক। সে কাজে আগ্রহ দিতেই কুর’আন পাঠে প্রচুর নেকি রেখেছেন। নবীজী (সা:)’র হাদীস: কুর’আনের প্রতিটি অক্ষর পাঠে ১০টি নেকী। দেহের খাদ্য সংগহে এতো নেকী রাখেননি। কারণটি সুস্পষ্ট। দৈহিক দুর্বলতায় কেই জাহান্নামে যাবে না; কিন্তু জাহান্নামে যাবে ঈমানে দুর্বলতার কারণে। তাই আল্লাহ তায়ালা চান তাঁর বান্দা কুর’আন থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করুক এবং ঈমানকে শক্তিশালী করুক। কিন্তু সে সামর্থ্য তাদের জুটে না যারা না বুঝে কুর’আন তেলাওয়াত করে। এমন ব্যক্তিগণ শতবার কুর’আন খতম দিলেও তাদের ঈমান শক্তিশালী হয়না। এরা ঘুষ খায়, সূদ খায়, সেক্যুলার রাজনীতি করে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে এবং ব্যবসার নামে প্রতারণা করে।
না বুঝে কুর’আন তেলাওয়াতে পালিত হয় না জ্ঞানার্জনের ফরজ। তখন কুর’আন থেকে ইলম সংগ্রহের কাজটিও হয়না। তখন কুর’আন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অর্জিত সওয়াবে তার ঈমান বাঁচাতে পারেনা; বরং জ্ঞানশূণ্যতায় মৃত্যু ঘটে ঈমানের। এজন্যই বাংলাদেশে যারা না বুঝে কুর’আন তেলাওয়াত করে তাদের অনেকেই মৃত ঈমানের মানুষ তথা বেঈমান। তাদের সংখ্যাটি বিপুল হওয়াতে নবীজী (সা:)’র ইসলাম বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি। কারণ এরূপ ঈমানশূণ্যরা কখনোই মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী বিচার প্রতিষ্ঠা দিতে জিহাদে নামে না। অসত্য ও অবিচারের নির্মূলে এবং সুবিচারের প্রতিষ্ঠাতেও তারা যুদ্ধে নামে না। দেশের উপর ইসলামবিরোধী শক্তির বিজয় দেখেও তারা নিষ্ক্রিয় ও নীরব থাকে। কুর’আন তেলাওয়াত, দোয়া-দরুদ, নামাজ-রোজা এবং হজ্জ-যাকাত পালন করেই ভাবে, তারা জান্নাতের পথে আছে। অথচ মহান আল্লাহ তায়ালার বয়ান:
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا۟ ٱلْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ جَـٰهَدُوا۟ مِنكُمْ وَيَعْلَمَ ٱلصَّـٰبِرِينَ
অর্থ: “তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো জানেননি
এবং প্রকাশ করেননি তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে এবং এখনো জানেননি এবং প্রকাশ করেননি তোমাদের মধ্যে কারা ছবর ধারন করেছে।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৪২)।
ঈমানের লক্ষণ: নেক আমলে তাড়াহুড়া
ঈমানদারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো, তার থাকে নেক আমলে প্রচণ্ড তাড়াহুড়া। নেক আমলে তাড়াহুড়া আসে মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করা, তাঁর থেকে মাগফিরাত লাভের প্রেরণা থেকে। এবং নেক কর্মে তাড়াহুড়া করার নির্দেশটি এসেছে তাঁর মহান রব থেকেই। হুকুম দেয়া হয়েছে:
وَسَارِعُوٓا۟ إِلَىٰ مَغْفِرَةٍۢ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا ٱلسَّمَـٰوَٰتُ وَٱلْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ
অর্থ: “এবং তোমরা তাড়াহুড়া করো তোমাদের রব থেকে মাগফিরাত লাভে এবং সে জান্নাত লাভে -যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের সমান, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকীনদের জন্য।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৩৩)।
ঈমানদারের কাছে এ , জীবনের সকল চেষ্টা-সাধনার মাঝে মূল তাড়নাটি হলো, মহান রব থেকে মাগফিরাত লাভের জন্য নিজেকে যোগ্যতর করা। কারণ, যে ব্যক্তি মাগফিরাত পায়, একমাত্র সে ব্যক্তিই জান্নাত পায়। অর্থাৎ মাগফিরাত লাভই হলো জান্নাত লাভের চাবি। নবীজীর হাদীস: “রব’য়ের থেকে মাগফিরাত লাভ ছাড়া কেবল নিজ আমলের জোরে কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না।” তাই ঈমানদার শুধু বাঁচার জন্য বাঁচে না; বরং বাঁচে মাগফিরাত লাভের জন্য নিজেকে যোগ্যতর করার সাধনা নিয়ে। সকল নেক আমলের পিছনে সেটিই হলো মূল প্রেরণা। সে জন্যই সে সর্বত্র নেক আমলের রাস্তা খুঁজে এবং তাতে নিজেকে লাগাতর নিয়োজিত করে। সেটি যেমন জ্ঞানদান, অর্থদান, বস্ত্রদান, আশ্রয়দানের ক্ষেত্রে, তেমনি রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি এবং আল্লাহর পথে জিহাদে। বস্তুত নেক আমলই হলো মহান রবকে খুশি করার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। নেক আমলের এমন তাড়নাই ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের বুকে পরিশুদ্ধি আনে। বেঈমানের বাঁচা থেকে ঈমানদারের বাঁচার এখানেই মূল পার্থক্য।
তবে নেক আমলেরও প্রকার ভেদ রয়েছে। পথের উপর থেকে একটি কাঁটা সরিয়ে ফেলাও নেক আমল। কিন্তু সব চেয়ে বড় নেক আমলটি হলো যেসব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও পেশাগুলি মানুষকে জাহান্নামে নেয় -সেগুলি রাষ্ট্রের অঙ্গণ থেকে সরিয়ে ফেলা। সরানোর সে প্রবল ভাবনা ও প্রচেষ্টাই মুমিনের জীবনে জিহাদকে অনিবার্য করে তোলে। এবং জিহাদের পথে শাহাদত হলো মাগফিরাত লাভের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। যে শাহাদত পায় সে নিশ্চিত প্রতিশ্রুত মাগফিরাতও পায়; এবং বিনা হিসাবে জান্নাত পায়। তাই ঈমানদারের ভাবনায় যেমন জিহাদ আসে তেমনি শাহাদতের প্রবল তাড়নাও জাগে।
অপর দিকে বেঈমানের পরিচয় হলো: সে আগ্রহহীন হয় পবিত্র কুর’আন বুঝায়। সে পবিত্র কুর’আন তেলাওয়াত করে না বুঝে। এবং তার আগ্রহ থাকে না নেক আমলে। তার সর্বক্ষণের চিন্তা ও ব্যস্ততা নিজের আরাম-আয়েশ ও সম্পদের আয়োজনের বৃদ্ধিতে। বেঈমান কখনো আখেরাতের ভাবনা নিয়ে বাঁচে না, সে বাঁচে স্রেফ দুনিয়ার ভাবনা নিয়ে। এবং এভাবে সে নিজেকে পরিণত করে তার নিজ সম্পদের পাহারাদারে। ১৮/০৫/২০২৫
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঁচাতে হলে যা করণীয়
- ঈমানদার ও বেঈমানের ভাবনা ও তাড়না
- Shocking Inaction of the World Leaders Against the Israeli War Criminals
- পাকিস্তান কেন ভেঙ্গে গেল?
- বঙ্গীয় বদ্বীপে শয়তানী শক্তির নাশকতা এবং বাঙালি মুসলিমের বিপদ
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- May 2025
- April 2025
- March 2025
- February 2025
- January 2025
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018