পাকিস্তান কেন ভেঙ্গে গেল?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

মূল কারণটি চেতনার বৈষম্য

 

বিগত একশত বছরে মুসলিম উম্মাহর জীবনে দু্টি বৃহৎ বিপর্যয় এসেছে। প্রথমটি হলো ১৯২৪ সালে উসমানিয়া খিলাফতের বিলুপ্তি। দ্বিতীয়টি হলো  ১৯৭১ সালে অখণ্ড পাকিস্তানের বিভক্তি। ঘুর্ণিঝড়ে বা ভূমিকম্পে গৃহ ভেঙ্গে গলে গৃহবাসীকে পথে বসতে হবে। তেমনি কোন দশে ভেঙ্গে গেল দেশবাসীকে নানা রূপ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়। সে বিপর্যয় থেকে বাঁচাতেই মহান আল্লাহ তায়ালা বিভক্তিকে হারাম করেছেন এবং একতাকে ফরজ করেছেন। ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়াসহ আরব বিশ্বের দেশগুলি যেভাবে অধিকৃত হলো, গাজা যেরূপ গণহত্যা ও ধ্বংস যজ্ঞের এবং সমগ্র আরব বিশ্বে জুড়ে যে স্বৈরাচারি দুঃশাসন -তার মূল কারণ হলো উসমানিয়া খেলাফতের বিলুপ্তি। উসমানিয়া খেলাফতই আরবদের ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসন থেকে বহু শত বছর যাবত নিরাপত্তা দিয়েছিল। তেমনি পাকিস্তান খণ্ডিত হওয়াতে নিরাপত্তা হারিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমগণ। অধিকৃত কাশ্মীর ও আরাকানের মুসলিমদের জীবনে যেমন গণহত্যা ও দুর্ভোগ বেড়েছে তেমনি গণহত্যা, নির্যাতন ও বঞ্চনা বেড়েছে ভারতীয় মুসলিমদের। অপর দিকে বাঙালি মুসলিমদের গণতন্ত্র, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাও আজ ভারতীয় আগ্রাসনের মুখে। ১৯৭১’য়ের পর বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল এক ভারতীয় অধিকৃত রাজ্যে।  

 

তবে মুসলিম উম্মাহর বিপর্যয় শুধু খেলাফত ও পাকিস্তানের ন্যায় বৃহৎ দুটি রাষ্ট্র ভেঙ্গে যাওয়া নিয়ে নয়, তার চেয়েও বড় বিপর্যয়ের কারণ, মুসলিমদের চেতনার পচন। চেতনার সে পচন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মুসলিম ভূমির বিভক্তির ন্যায় হারাম ও নাশকতার কর্ম নিয়ে মুসলিম বিশ্বে আজ বিজয় উৎসব হয়। যেমন বাংলাদেশে হয় প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর। খেলাফত ভেঙ্গেছে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও ফরাসী কাফিরগণ। সে কাজে তাদের সহায়তা দিয়েছে আরব জাতীয়তাবাদী ও গোত্রবাদীরা। পাকিস্তান ভেঙ্গেছে ভারতীয় পৌত্তলিক কাফিরগণ। তাদের সহায়তা দিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা। খেলাফত ও পাকিস্তান -উভয় দেশই কাফিরশক্তি ভেঙ্গেছে তাদের নিজ স্বার্থে। এবং ভাঙ্গার পর ক্ষমতায় বসিয়েছে তাদের অনুগত দাসদের। ফলে মুসলিম বিশ্বে নতুন করে শুরু হয়েছে দাস বংশের শাসন। বিস্ময়ের বিষয় হলো, কাফিরশক্তির সে বিজয় নিয়ে মুসলিমগণ উৎসব করে। তাই বিপদ শুধু মুসলিম বিশ্বের বিভক্তি নিয়ে নয়, বরং গুরুতর বিপদ হলো মুসলিমদের ঈমানশূণ্যতা ও বিবেকশূণ্য নিয়ে। ঈমান ও বিবেক বেঁচে থাকলে কি তারা কাফির শক্তির বিজয় এবং বিভক্তির ন্যায় হারাম কর্ম নিয়ে কখনো উৎসব করতো?                                                                       

 

পাকিস্তান কেন ভেঙ্গে গেল -তা নিয়ে অবশ্যই গবেষণা হওয়া উচিত। এবং গবেষণা হওয়া উচিত কি করে ভেঙ্গে গেল উসমানিয়া খেলাফত -তা নিয়েও। কারণ তা থেকে মুসলিম উম্মাহর শিখবার বিষয়টি বিশাল। একজন মানুষ মারা গেলে ডাক্তারগণ তার মৃত্যুর কারণ বের করার চেষ্টা করে। কারণ যে মারা যায়, সে জীবিতদের জন্য শিক্ষনীয় বহু কিছু রেখে যায়।  তাই সেটি জানার জন্য এমন কি পোস্টমর্টেম করে অনুসন্ধান করা হয়। প্রয়োজনে কবর খুঁড়ে লাশ বের করা হয়। সে বিষয়টি একই ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে কোতন দেশ ভেঙ্গে গেলে। এ নিবন্ধের আলোচ্য বিষয়,  পাকিস্তান কেন ভেঙ্গে গেল -সেটি। মুসলিম উম্মাহর জন্য অতিশয় ক্ষতিকর বিষয় হলো তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মুসলিম দেশটি ভেঙ্গে যাওয়া। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে মুসলিম উম্মাহ হারিয়েছে বহু ভাষা, বহু বর্ণ ও বহু অঞ্চল নিয়ে গঠিত এ রাষ্ট্রটি। এতে দুর্বল হয়েছে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ভারতের গোলাম রাষ্ট্রে। এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে ভারত পরিণত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে, এবং স্বপ্ন দেখছে বিশ্বশক্তির হওয়ার। বস্তুত ১৭৫৭ সালে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পর ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াটি হলো বাঙালি মুসলিমদের জন্য দ্বিতীয় বড় বিপর্যয়।   

 

পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়া থেকে মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষনীয় বিষয়টি বিশাল। বিশেষ করে তাদের জন্য, যারা বিশ্ব রাজনীতিতে মুসলিম উম্মাহর উত্থান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে ভাবেন। অনেকের অভিমত, পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার মূল কারণ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অবিচার। অথচ পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ যতটা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য, তার চেয়ে অধিক দায়ী হলো নৈতিক ও চেতনার বৈষম্য। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৈষম্যটি ছিল বিশাল। জনগণের নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সামর্থ্যটি গড়ে তোলে কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা। তাই একটি দেশের ভূ-রাজনৈতিক ভূগোলের মতই গুরুত্বপূর্ণ হলো তার চেতনার ভূগোল বা মানচিত্র। রাজনৈতিক মানচিত্র বাঁচাতে হলে তাই সহায়ক চেতনার মানচিত্র গড়তে হয় ও সেটিকে বাঁচাতে হয়। সেটি সামর্থ্যটি উর্দু সাহিত্যের বিশাল। কারণ উর্দু সাহিত্য তার সৃষ্টি থেকে কসমোপলিটান; গড়ে উঠেছে সমগ্র ভারতের নানা প্রদেশের মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও কবি-সাহিত্যিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। ফলে এ সাহিত্যের পাঠকদের মাঝে গড়ে উঠেছে চেতনার সমতা।  উর্দু সাহিত্যের নির্মাণে যেমন উত্তর প্রদেশ, বিহার ও মধ্য প্রদেশের মুসলিম জ্ঞানসাধকদের ভূমিকা রয়েছে তেমনি রয়েছে পাঞ্জাব, বাংলা, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশের জ্ঞান সাধকদের ভূমিকাও। ব্রিটিশ শাসনামলে উর্দু ভাষায় সবচেয়ে বেশী পত্রিকা ছাপা হতো বাংলার রাজধানী কলকাতা থেকে। সে আমলে উর্দু ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকা ছিল মাওলানা আবুল কালাম আযাদের সম্পাদিত “আল হিলাল‍”; সেটিও প্রকাশিত হতো কলকাতা থেকে। ফলে উর্দু ভাষা থেকে বেশী লাভবান হয়েছিল বাঙালি মুসলিমগণ।  

 

 

যুদ্ধ শুরু হয় উর্দুর বিরুদ্ধে

 

ব্রিটিশ আমলে বাংলার স্কুল গুলিতে মুসলিম ছাত্রদের জন্য উর্দু অথবা ফার্সি ভাষঅ বাধ্যতামূলক ছিল। কারণ বাংলা ভাষায় মুসলিম ছাত্রদের চেতনায় পুষ্টি জুগানোর মত কোন সাহিত্যই ছিল না। তাছাড়া বাংলার মাদ্রাসাগুলোতেও শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দু। মাদ্রাসা ও স্কুলে উর্দু থাকায় বাংলার শিক্ষিত মুসলিমগণ উর্দু পত্রিকা ও পুস্তক পাঠের সামর্থ্য রাখতো। এমন কি বহু প্রসিদ্ধ উর্দু বই লিখেছেন বাঙালি মুসলিমগণ। ফলে বাংলার বুকে পাকিস্তানের পক্ষে প্যান ইসলামী চেতনার নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই উর্দু সাহিত্য। এতে বাংলা পরিণত হয় মুসলিম লীগের মূল দুর্গে। ইসলামের শত্রুপক্ষ বিষয়টি বুঝতো। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই যুদ্ধ শুরু হয বাংলার বুক থেক উর্দুর নির্মূলে। সে যুদ্ধের লক্ষ্য, বাঙালি মুসলিমের চেতনায় ইসলামী জ্ঞানের পুষ্টির পথ বন্ধ করে দেয়া।  সে সাথে আলিঙ্গণ করা হয় রবিন্দ্রনাথসহ অন্যান্য পৌত্তলিক হিন্দুদের রচিত হিন্দুয়ানী সাহিত্যকে। তবে এর পূর্বে বাংলার বুকে উর্দুর বিরুদ্ধে যুদ্ধটি ব্রিটিশ আমলেও হয়েছে। কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু বাঙালিদের পত্র-পত্রিকা ও হিন্দু বাঙালি বাবুরা বাংলার স্কুল থেকে উর্দু বিলুপ্তির দাবী তোলে। কিন্তু বাংলার গণশিক্ষা বিভাগের ইংরেজ পরিচালক (DPI) তাদের সে দাবী গ্রহণ করেননি। তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলন বাংলা সাহিত্যে ইসলামের বিষয়ে জ্ঞানদানের জন্য পুস্তক না থাকাতেই উর্দু ও ফার্সির কোন বিকল্প নাই। সেদিন হিন্দু বাবুরা তাদের ষড়যন্ত্রে সফল হলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাই হয়তো সেদিন মারা পড়তো।

 

কিন্তু উর্দুর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বার যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। প্যান-ইসলামী চেতনার বিনাশে সাহিত্য-সংস্কৃতির নামে বাঙালি মুসলিমের মনে বিষ প্রয়োগ শুরু হয়। সেটি হিন্দুদের রচিত পৌত্তলিক সাহিত্যের জোয়ার সৃষ্টি করে। পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নর মোনেয়েম খান ষাটের দশকের মধ্য ভাগে রবিন্দ্র সঙ্গীত বন্ধের উদ্যোগ নেন। কিন্তু বাঙালি বাম ও সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের চাপে তিনি ব্যর্থ হন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মাঝে ইসলামী চেতনাধারীদের সংখ্যাটি ছিল অতি নগন্য এবং দুর্বল। ফলে হিন্দুত্বাবাদী, জাতীয়তাবাদী ও বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের সৃষ্ট জোয়ার রূখতে তারা ব্যর্থ হন। পরিতাপের বিষয় হলো, পাকিস্তানের সে দুর্যোগ মুহুর্তে দেশের আলেমদের ময়দানে দেখা যায়নি। তারা ছিল নিষ্ক্রিয়; সেদিন মাদ্রাসার অঙ্গণ থেকে তারা বাইরে বের হননি।

 

হিন্দুদের রচিত সাহিত্যের জোয়ার আনতে সে সময় নেতৃত্ব দেয় বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার বুদ্ধিজীবীরা। ফলে জোয়ার আসে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির। ১৯৫২’য়ের ভাষা আন্দোলন সে হিন্দুয়ানী জোয়ারকে তীব্রতর করে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গণে শহীদ মিনারের নামে পূজা স্তম্ভ, নগ্ন পদে সে স্তম্ভে ফুল দেয়া, শিখা অনির্বান, বসন্ত বরণ, সড়কে আলপনা আঁকা -এসবই হলো হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির প্রতীক। সে সহায়ক বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে দ্রুত বেড়ে উঠে আওয়ামী লীগের বাঙালি ফ্যাসিবাদী রাজনীতি। তাই যারা বলে ১৯৫২’য়ের ভাষা আন্দোলন থেকেই যুদ্ধ শুরু হয় পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের -তারা মিথ্যা বলে না।  এ যুদ্ধের কেন্দ্র ভূমিতে পরিণত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।     

        

 

বাঙালি মুসলিমের ট্রাইবালিজম বনাম পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্যান-ইসলামিজম

 

গায়ের রং, পানাহার ও পোষাক-পরিচ্ছদের ভিন্নতা নিয়েও মানুষ একই ভূমিতে একত্রে বসবাস করতে পারে; কিন্তু সেটি অসম্ভব হয় নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও চেতনার ভিন্নতার কারণে। একত্রে বসবাসের জন্য শুধু রাজনৈতিক ভূগোলটি এক হলে হয় না, চেতনার ভূগোলটিও এক হতে হয়। বাঙালি মুসলিমদের সমস্যা হলো অন্য ভাষার মুসলিমদের সাথে বসবাসের নৈতিক সামর্থ্যটি অতি সামান্য। তারা বেড়ে উঠেছে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ট্রাইবালিজম নিয়ে। শেখ মুজিব সেটিকে বাঙালি বর্ণবাদী ফ্যাসিবাদে পরিণত করে। বাঙালি মুসলিমদের এ ব্যর্থতার কারণ, বাংলার বুকে অন্য ভাষী মানুষের বসবাস বড় আকারে না থাকাতে সে সামর্থ্য ও অভ্যাস তাদের গড়েই উঠেনি। তারা বাস করছে অন্য ভাষী মুসলিমদের থেকে বিচ্ছিন্ন এক ট্রাইবাল চরিত্র নিয়ে; ফলে ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাদের মাঝে বিহার, উত্তর প্রদেশ, সীমান্ত প্রদেশ বা ভারতের অন্য প্রদেশ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করতে এসেছে তাদেরকে তারা আপন করে নিতে পারেনি। সেটির অতি সহিংস চিত্র দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।

 

১৯৭১’য়ে নিহত অবাঙালিদের সঠিক সংখ্যটি জানার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। অবাঙালিদের বিরুদ্ধে সেরূপ একটি নৃশংস গণহত্যা যে চলেছে সেটিই বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে এ অপরাধের অপরাধীরা গায়েব করেছে। মুজিব ও হাসিনা আমলে চলেছে বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাসিবাদ; এ বিষয়ে কোন গবেষণার সুযোগ দেয়া হয়নি। তবে অনেকের ধারণা, কমপক্ষে দুই লাখ বিহারীকে একাত্তরে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষিতা হয়েছে বহু হাজার বিহারী নারী। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর সে নৃশংতার বিবরণ এখন সামনে আসতে শুরু করেছে। কারণ, সে নৃশংসতার বহু সাক্ষী এখনো বেঁচে আছে।  

 

একাত্তরের সে নৃশংসতায় প্রতিটি অবাঙালি পরিবারকে হারাতে হয়েছে তাদের গৃহ, দোকানপাট ও চাকুরি। আশ্রয় নিতে হয়েছে খোলা আকাশের নীচে কোন এক বস্তিতে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের চিত্রটি ছিল ভিন্নতর। সেখানে পাঞ্জাবী, সিন্ধু,পাঠান ও বেলুচগণ পাশাপাশি বসবাস করছে শত শত বছর ধরে। একাত্তরে প্রায় ৪ লাখ বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাস করতো; তাদের অধিকাংশই সেখানে ছিল সরকারি চাকুরি সূত্রে।  তারা সবাই ১৯৭৪’য়ের মধ্যেই বাংলাদেশে ফিরে আসে। বাংলাদেশে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানো হলেও তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের কারো হত্যা করা হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে বা তাদের ঘরবাড়ী কেড়ে রাস্তায় বসানো হয়েছে -তার প্রমাণ নাই। এ থেকেই পরিচয় মেলে পশ্চিম পাকিস্তানীদের চেতনার। পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি মুসলিমগণ সেদিন কসমোপলিটান ও প্যান-ইসলামী চেতনার পরিচয় দিয়েছে। করাচী, লাহোর, ইসলামাদ, কোয়েটাসহ পাকিস্তানের প্রতিটি বড় বড় শহরই হলো কসমোপলিটান। এ শহরগুলিতে নানা প্রদেশের জনগণ ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ নিয়ে উর্দুতে কথা বলে, কিন্তু কেউ কারো উচ্চারণ নিয়ে বিদ্রুপ করে না। কারো মুখের ভিন্ন ভাষা নিয়ে সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়না। কিন্তু সে তূলনায় বাঙালিরা অতি আঞ্চলিক ও সংকীর্ণ মনের।

 

নিজ অভিজ্ঞতা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সে কসমোপলিটান চেতনার কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। লাহোরের কিং এডওয়ার্ড মেডিক্যাল কলেজ হলো পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে পুরাতন মেডিক্যাল কলেজ। সেটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজের শতকরা ৯০ ভাগের বেশী ছাত্র-ছাত্রীই পাঞ্জাবী। আমি যখন সে কলেজের ছাত্র, তখন সে প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বৃহৎ ছাত্র সংগঠনের প্রধান ছিলেন একজন বাঙালি ছাত্র। সংসদ নির্বাচনে সে ছাত্র সংগঠনটিই বিজয়ী হতো। আরো বিস্ময়, লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় হলো সমগ্র পাকিস্তানের সবচেয়ে পুরোন ও বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পর সত্তরের দশকে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তারিকুর রহমান নামে বাংলাদেশের শেরপুর জেলার এক ছাত্র। আরেক বিস্ময়: পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পর করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন মহিউদ্দীন নামে নোয়াখালীর এক ছাত্র।

 

উপরিউক্ত এ বিষয়গুলো সামান্য বিষয় নয়, এগুলি একটি জনগোষ্ঠির চেতনার পরিচয় দেয়। বাংলাদেশে কি এটা ভাবা যায় যে, কোন বিহারী বা অন্য কোন অবাঙালি ছাত্র বাংলাদেশের কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদে ছাত্রদের ভোটে নির্বাচিত হবে? কিন্তু পাকিস্তানে সেটি সম্ভব। অথচ এ বাঙালিরা সত্তরের দশকে স্লোগান দিত তারা নাকি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি! কিন্তু সেটি কিসের বলে? শ্রেষ্ঠ হতে হলে তো মনটাও বড় হতে হয়। পাকিস্তানে এখন ২০ লাখের বেশী বাঙালির বসবাস। এরা গেছে ১৯৭১’য়ে স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের পর। সেখানে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলেছে। অথচ বাংলাদেশে বিহারীদের বস্তিতে থাকতে হচ্ছে। তাদেরকে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর কোন জায়গা দেয়া হচ্ছে না। নেয়া হচ্ছে না সরকারি চাকুরিতে। তাদের বঞ্চিত রাখা হয়েছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকে। অথচ এ বিশাল অবিচার নিয়ে কথা বলার মত মানবিকগুণ সমৃদ্ধ বুদ্ধিজীবী বা সাংবাদিক বাংলাদেশে তেমন একটা নাই। জার্মানীর স্কুলে ইহুদীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার ইতিহাস পড়ানো হয়। অথচ বিহারীদের বিরুদ্ধে একাত্তরে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো সেগুলি স্থান পাচ্ছে না বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে। অথচ সেগুলিও তো বাঙালি ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশীরা কি এগুলি নিয়ে ভাববে না?     

 

পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৬০ জন পাঞ্জাবী। অথচ দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ইমরান খান -যিনি একজন পাঠান। পাকিস্তানে পাঠানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ মাত্র। ইমরান খানের দল পাঞ্জাবী নওয়াজ শরীফকে হারিয়ে শুধু পাকিস্তানে নয়, পাঞ্জাব প্রদেশেও ক্ষমতাসীন হয়েছে। সিন্ধিদের সংখ্যা শতকরা ১৬ ভাগ। জুলফিকার আলি ভূট্টো ও তাঁর মেয়ে বেনজির ভূট্টো সিন্ধি হয়েও তারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু। অথচ দেশটির শতকরা ১০ ভাগ মানুষের মাতৃ ভাষা্ও উর্দু নয়। যে পাঞ্জাবীরা শতকরা ৬০ জন, তারা কখনোই এ দাবী তুলেনি যে পাঞ্জাবীকে দেশের রাষ্ট্র ভাষা করতে হবে। বাঙালিরা কি কোনদিন সেটি মেনে নিত? পাঞ্জাবী দেশের বৃহত্তর স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়েছে, ক্ষুদ্র আঞ্চলিক স্বার্থকে নয়।

 

 

আওয়ামী ফাসিস্টদের তাণ্ডব

 

পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্যান-ইসলামী চেতনার ভিত্তিতে। এ চেতনার মূল কথা হলো মুসলিমগণ বেড়ে উঠবে ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল ভিত্তিক পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে মুসলিম ভাতৃত্বের পরিচয় নিয়ে। কিন্তু এর ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত চেতনা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে উঠছিল বাঙালি বর্ণবাদী ফ্যাসিবাদ। এবং সে উগ্র ফ্যাসিবাদের সূতিকাগৃহে পরিণত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিপুল সংখ্যায় জন্ম নিতে থাকে পাকিস্তানের ঘরের শত্রু। একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে “একটা একটা ছাতু ধরো, সকাল বিকাল নাস্তা করো” এ ধরণের কুৎসিত ভাষায় স্লোগান দেয়া হতো। ছাতু বলতে বুঝানো হতো অবাঙালিদের। একাত্তরের শুরুতেইব দৈহিক নির্যাতন শুরু হয় অবাঙালি ছাত্রদের উপর। ফলে তারা ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই এমন ছিল যারা এসেছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে।

 

কুৎসিত মনের এরূপ হিংস্র বাঙালিগণ গড়ে উঠছিল ছাত্র লীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের ন্যায় ইসলামশূণ্য ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায়। পরিতাপের বিষয় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন এরূপ অসভ্য কুৎসিত মানসিকতার চর্চা হচ্ছিল তখন তৎকালীন বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা সে অসভ্যতার বিরুদ্ধে নীরব থাকার নীতি গ্রহণ করে।  ফলে এরূপ অসভ্য বর্বর মানসিকতাকে নিন্দা করে তারা একটি বাক্যও উচ্চারণ করেনি। পত্রিকায় কোন নিবদ্ধও লেখেনি।  ফলে এভাবেই সবার চোখের সামনে দিনের পর দিন অবাঙালিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর জন্য সহায়ক ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। গণহত্যার পূর্বে প্রতি দেশে ফ্যাসিবাদীরা এমনটিই করে থাকে। ইহুদীদের বিরুদ্ধে সেরূপ ঘৃণা সৃষ্টি করেছিল জার্মান ফ্যাসিস্টগণ। পূর্ব পাকিস্তানে সেরূপ একটি পরিবেশ সৃষ্টির ফল হলো, যখন  বিহারীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও লুটপাট চালানো হলো বাঙালি বুদ্ধিজীবী, বাঙালি মিডিয়া ও বাঙালি রাজনীতিবিদগণ সম্পূর্ণ নীরব থাকলো।  

 

শেখ মুজিব তার ৭ মার্চের ভাষনে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থানরত সৈনিকদের অনাহারে হত্যার ঘোষনা দেয়। অবরোধ করা হয় ক্যান্টনমেন্টগুলোকে। হাতের কাছে যার যা আছে তা নিয়ে যুদ্ধে নামার ডাকা দেয়। এভাব মুজিব একটি যুদ্ধকে অনিবার্য করার চেষ্টা করছিল। অথচ পাকিস্তান সরকার আলোচনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। অথচ আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের পক্ষ থেকে প্রচার দেয়া হয় বাঙালিদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।   

 

কাদের সিদ্দিকী হাত-পা বাধা ৪ জন বিহারীকে ঢাকা স্টেডিয়ামে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল। এই অসভ্য আওয়ামী ফ্যাসিস্টের সে নৃশংস বর্বরতার চিত্রটি  আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে প্রকাশিত হলেও ঢাকার কোন পত্রিকায় সে চিত্র প্রকাশিত হয়নি। সে নৃশংসতা তাদের কাছে কোন খবরই গণ্য হয়নি। ঢাকার মিডিয়া জগত যে কতটা বাঙালি ফ্যাসিস্টদের হাতে অধিকৃত হয়েছিল এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা যে কতটা মারা পড়েছিল -এ হলো তার প্রমাণ।  

 

 

অসভ্যতার চাষাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ও মিডিয়ায়

 

পাকিস্তান ১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বর ভূ-রাজনৈতিক ভাবে বিভক্ত হওয়ার আগেই আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বহু আগেই পাকিস্তানের প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনা কবরস্থ হয়েছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুর্বৃত্তদের হাতে।  বিহারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা, গণধর্ষণ ও তাদের ঘরবাড়ী দখলের ন্যায় নৃশংস বর্বরতা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহল এবং দেশের বুদ্ধিজীবী মহল ও মিডিয়া মহলের লোকদের প্রতিক্রিয়াটি ছিল এমন, যেন তারা না কিছু শুনেছে, না কিছু দেখেছে। একাত্তরে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বিবেকহীনতা ও দায়িত্বহীনতার এ হলো দলিল। উল্লেখ্য হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ একই রূপ বিবেকশূণ্যতার পরিচয় দিয়েছে  ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলেও। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুশত শিক্ষক বিবেকশূণ্যতায় এতোটাই নীচে নেমেছিল যে , ২০১৮সালের ভোটডাকাতির নির্বাচনকে তারা সুষ্ঠ নির্বাচন বলে যুক্ত বিবৃতি দিয়েছিল।     

 

পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে পূর্ব পাকিস্তানীদের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৈষম্যের বড় কারণ, বাঙালি সেক্যুলারিস্টগণ বিশ্বটাকে দেখে রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য হিন্দু সাহিত্যিকদের দৃষ্টিতে। তাদের চেতনা পুষ্টি পেয়ে থাকে তাদের রচিত সাহিত্য থেকে। ফলে পৌত্তলিক ভারতের প্রতি রবীন্দ্রনাথের মত তাদেরও আনুগত্য গড়ে উঠে। বাড়ে থাকে ভারত বন্দনাও। অখণ্ড পাকিস্তানের চেয়ে অখণ্ড ভারত তাদের কাছে বেশী প্রশংসা পেতে থাকে। সেরূপ এক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিক গানকে বাংলাদেশীদের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। অনেক বাঙালিরাই ভারতকে দেখে বাংলাদেশের জন্মদাতা রূপে। ভারতও তাই মনে করেন। এরই প্রমাণ, ভারতের The Time of India বাংলাদেশের সৃষ্টিতে ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল ম্যানেক শ’র ভূমিকা নিয়ে একটি বিশাল নিবন্ধ প্রকাশ করে। উক্ত নিবন্ধে ম্যানেক শ’কে father of a nation অর্থাৎ বাংলাদেশের জনক বলে আখ্যায়ীত করে। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ সরকার তার প্রতিবাদ করেনি।

 

তবে প্রতিবাদ না করার কারণও রয়েছে। একাত্তরের পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধটি ছিল শেখ মুজিবের একান্তই দলীয় যুদ্ধ। সে যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল, ক্ষমতা দখল। শেখ মুজিবের লক্ষ্য কখনোই বাঙালির স্বাধীনতা দেয়া ছিলনা। স্বাধীনতা দেয়া লক্ষ্য হলে গণতন্ত্রকে কেন কবরে পাঠাবে? মৌলিক মানবাধিকার কেন কেড়ে নিয়ে বাকশালী স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা দিবে? তার লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশকে ভারতের একটি আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করা। মুজিবের সে এজেন্ডা নিয়ে বাংলাদেশ শাসন করেছে শেখ হাসিনা।

 

একাত্তরের যুদ্ধে জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকাতে মুক্তিবাহিনী একটি জেলা বা মহকুমা দূরে থাক, ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যুদ্ধ শুরুর পূর্ব পর্যন্ত একটি থানাও মুক্ত করতে পারিনি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছে আড়াই লাখ সৈন্যের বিশাল ভারতী সেনাবাহিনী। তারাই মুজিবকে ক্ষমতায় বসায়। অথচ আফগানিস্তানে যখন ১ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন সৈন্যের অবস্থান, তখনও তালেবানরা শতকরা ৬০ ভাগ ভূ-খন্ডের উপর নিজেদের দখল বজায় রেখেছে। এজন্যই হাসিনার ন্যায় বাকশালীগণ বলে, ক্বিয়ামত অবধি ভারতের ঋণ শোধ দেয়া যাবে না। কথা হলো, পিতার ঋণ কি কখনো শোধ দেয়া যায়? যে পিতা, সে তো সব সময়ের জন্যই পিতা। এজন্যই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ বাংলাদেশের পাশে কোন শত্রু দেখে না। কারণ, ভারতের ন্যায় জন্মদাতা পিতাকে তো শত্রু ভাবা যায় না।

 

অপর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বিশ্বটাকে দেখে আল্লামা ইকবালের দৃষ্টিতে। ফলে তাদের রয়েছে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জজবা। তারা ভারতকে দেখে প্রতিদ্বন্দী শত্রু রূপে। সম্প্রতি ২০২৫ সালের মে’মাসের কয়েক দিনের যুদ্ধে পাকিস্তান ভারতকে তার সামর্থ্য ভাল ভাবেই দেখিয়ে দিয়েছে।  ভারত যখন পারমানবিক বোমা বানায়, তখন সে বোমা পাকিস্তানও বানায়।ভারত যখন মিজাইল বানায়, পাকিস্তানও মিজাইল বানায়। ফলে পাকিস্তান  পরিণত হয়েছে ৫৭টি মুসলিম দেশের মাঝে সামরিক দিক দিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশে। অথচ বাংলাদেশ একটি রাইফেলও নিজে বানানোর প্রয়োজনীতা বোধ করে না। সেটিকে অপচয় মনে করে।  কারণ স্বাধীন ভাবে বাঁচার আগ্রহ গোলামদের থাকে না। ভারতসেবী বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার কাপালিকগণ  একাত্তরে বাংলাদেশীদের মনে সে গোলামী চেতনাকেই নির্মাণ করেছে। এমন গোলামী চেতনা নিয়ে কি স্বাধীন ও নিরাপদ দেশ নির্মাণ করা যায়? পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে বস্তুত চেতনার অঙ্গণে এরূপ বিশাল পার্থক্যের কারণে।  

 

 

সামনে নতুন ভাবনা

 

২০২৪ য়ের জুলাই-আগস্ট বিপ্লব শুধু হাসিনার বিরুদ্ধে ছিলনা; সে লড়াইটি ছিল মুজিব-হাসিনার স্থাপিত ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ আজ হাসিনামুক্ত, সে সাথে ভারতমুক্তও। ফলে সুযোগ এসেছে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের। মনে রাখতো হবে বাঙিলত্ব বা সেক্যুলারিজম নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঁচানো যাবে না। শুধু গণতন্ত্র দিয়েও এ স্বাধীনতা বাঁচানো যাবেনা। স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণে অবশ্যই ১৯৪৭ সালের  ইসলামী দর্শনকে ধারণ করতে হবে। একমাত্র সেরূপ দর্শনই স্বাধীনতার পক্ষে বয়ান বা যুক্তি তৈরী করে। সে ইসলামী দর্শনই ১৯৪৭ সালে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সামর্থ্য দিয়েছিল।  সে দর্শনের সামর্থ্য তাই পরীক্ষিত। আজও বাংলাদেশের সামনে ভিন্ন পথ নাই।

 

স্বাধীনতা বাঁচানোর খরচটি বিশাল। সে খরচ জুগানোর সামর্থ্য বাঙালি মুসলিমদের একার নাই। একতা তাই অনিবার্য। এবং সেটিই মহান আল্লাহ তায়ালার বিধান। রাশিয়া ভীতি জার্মান, ফরাসী, ইতালীয়, স্পানিশ, ডাচ, পোলিশদের ন্যায় ইউরোপীয়দের ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন নির্মাণে  বাধ্য করেছে। একই রূপ ভারত ভীতি বাঙালি মুসলিম নেতাদের ১৯৪৭’য়ে অখণ্ড পাকিস্তান নির্মাণে বাধ্য করেছিল। তাছাড়া শত্রুরা একতাবদ্ধ। বাঙালি, গুজরাতী, মারাঠী, বিহারী, পাঞ্জাবী, তামিল ও অসমিয়া হিন্দুদের ন্যায় সকল হিন্দুরা আজ একতাবদ্ধ। অথচ হিন্দুধর্মে এরূপ একতা ফরজ নয়। অথচ একতা ফরজ হলো মুসলিমদের উপর। একতা গড়লে খুশি হন মহান আল্লাহ তায়ালা। বিভক্তি গড়লে খুশি হয় শয়তান। ১৯৭১’য়ে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ও তাদের অনুসারী বাঙালিগণ শয়তান ও তার পৌত্তলিক খলিফাদের খুশি করার পথ বেছে নিয়েছিল।

 

বাঙালি মুসলিমদেরও আজ অবশ্যই বেছে নিতে হবে মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার পথ -যেমনটি বেছে নিয়েছিলেন ১৯৪৭‌’য়ের বাঙালি মুসলিম নেতাগণ। সেটি অন্য মুসলিমদের সাথে একতার পথ। বিভক্তিতে অবাধ্যতা হয় সর্বশক্তিমান মহান রব’য়ের হুকুমের। আর যারা অবাধ্য হয়, তাদেরকে নানা রূপ আযাব দিয়ে শাস্তি দেয়াই তার সূন্নত। সেটি হতে পারে শত্রু শক্তির গোলামী, শোষণ, নির্যাতন ও মৃত্যু। শেখ মুজিব তো বিভক্তি গড়ে এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে বাঙালি মুসলিমদের জন্য সে শাস্তিই ডেকে এনেছিল। ফলে আযাব এসেছিল ভারতের অধিকৃতি, দুর্ভিক্ষ ও ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন রূপে। ফলে সামনে বাঁচার পথটি হতে হবে একতাবদ্ধ উম্মাহ রূপে বেড়ে উঠার।

 

তাই আজকের বাঙালি মুসলিমদের লক্ষ্য হতে হবে শুধু গণতন্ত্র নয়, শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সুবিচারও নয়। এগুলি কল্যাণকর। তবে এগুলি বিভক্তির আযাব থেকে বাঁচাবে না। বাঁচাবে না বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতাকেও। সে আযাব থেকে বাঁচতে হলে এবং নিজেদের স্বাধীনতাকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই একতার পথ ধরতে হবে। একমাত্র এ পথেই বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীন ভাবে বেড়ে উঠা নিশ্চিত হতে পারে। ১৬/০৫/২০২৫          

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *