একাত্তর নিয়ে পিনাকী ভট্টাচার্যের ভ্রম
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on May 12, 2025
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, সমাজ ও রাজনীতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
পিনাকী ভট্টাচার্যের কৃতিত্ব ও বিতর্কিত বিষয়
পিনাকী ভট্টাচার্য একজন অতি জনপ্রিয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক, লেখক এবং বুদ্ধিজীবী। বাংলাদেশের রয়েছে তার বহু লক্ষ ভক্ত। তার রয়েছে দেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। আমি নিজেও তার ব্লগের একজন নিয়মিত শ্রোতা। অভিভূত হই তার বাচনভঙ্গি, উপস্থাপন, গভীর বিশ্লেষণ, বহুমুখী জ্ঞান ও গণশিক্ষামূলক বক্তব্য দেখে। দুর্বোধ্য বিষয়কে সহজ ভাবে বোঝানোর সামর্থ্যও অতি প্রশংসনীয়। বাংলা ভাষায় আমি তার মত এতো ভাল প্রাঞ্জল ও চিত্তাকর্ষক উপস্থাপক খুব একটা দেখিনি। ভিডিও উপস্থাপনাকে তিনি শুধু জ্ঞানদানের বাহনে নয়, বিনোদনের মাধ্যমে পরিণত করেছেন। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও কোন কোন ভিডিও’তে ইসলাম ও মুসলিমদের বিষয়ে যা বক্তব্য রাখেন সেটি অতি প্রশংসনীয়। সে কাজটি অনেক মুসলিমও করছে না। কোন হিন্দুর পক্ষে থেকে এরূপ কাজ আগে হয়নি।
কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করি। সেটি হলো ১৯৭১ নিয়ে তার বিচার-বিশ্লেষণ ও বয়ান। একাত্তর নিয়ে তার বয়ানটি ইসলামপন্থীদের বয়ান থেকে ভিন্ন। আমি মনে করি, তার উচিত একাত্তর প্রসঙ্গে ইসলামপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সঠিক ভাবে জানা। দেশের সংহতি, বিভক্তি ও বিচ্ছন্নতা নিয়ে ইসলামের সুস্পষ্ট হালাল-হারামের বিধান রয়েছে। প্রতিটি ঈমানদারকে মেনে চলতে হয় সে বিধানকে। আলেমদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতভেদ থাকলেও একটি মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করা যে হারাম -তা নিয়ে তাদের মাঝে কোন বিরোধ নাই। তাই কোন ইসলামী দল, কোন মুফতি বা আলেম এবং কোন পীর সাহেব বা ইমাম সাহেব পাওয়া যাবে না যারা একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থন করেছে।
পাকিস্তান ভাঙ্গা ছিল আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টি ও হিন্দুত্ববাদীদের প্রজেক্ট। তাদের সে প্রজেক্টের সাথে একাত্ম ছিল ভারত, ইসরাইল ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। যারা পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধীতা করেছিল তাদেরকে কি স্বাধীনতার বিরোধী বলা যাবে? বিচ্ছিন্নত আর স্বাধীনতা এক বিষয় নয়। একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়েছে, স্বাধীন হয়নি। বরং ভারতে একটি আশ্রিত গোলাম রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৭১’য়ের পূর্বেই বাঙালি মুসলিমগণ পূর্ণ স্বাধীন ছিল। এমন কি আওয়ামী লীগও তাদের ১৯৭০’য়ের নির্বাচনি মেনিফেস্টোতে আঞ্চলিক বৈষম্যের কথা বললেও পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলাকে কোথাও পরাধীন বলে উল্লেখ করেনি। একাত্তরে যারা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদের সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ বয়ান রয়েছে। বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী শাসকচক্র ও ফ্যাসিস্ট বুদ্ধিজীবীগণ ইসলামপন্থীদের সে বয়ান এতো কাল সামনে আসতে দেয়নি। পিনাকীর উচিত, সেটি জানা। সে জানলে একাত্তর প্রসঙ্গে তাঁর বয়ান বস্তুনিষ্ঠ হতো।
বুঝতে হবে, ১৯৭১’য়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দুটি বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক বয়ান প্রচলিত ছিল। একটি ছিল ইসলামপন্থী ও পাকিস্তানপন্থীদের বয়ান, অপরটি হলো ইসলাম থেকে দূরে সরা সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, হিন্দুত্ববাদী ও বামপন্থীদের বয়ান। লক্ষনীয় হলো,উল্লেখিত দ্বিতীয় পক্ষটির অধিকাংশই ভারতপন্থী। এ দুটি ভিন্ন বিপরীতমুখী রাজনৈতিক বয়ান এখনো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেঁচে আছে। এবং বেঁচে আছে তাদের অনুসারীরাও। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা গর্তে ঢুকলেও একাত্তরের সেক্যুলার বয়ান এখন ফেরি করছে বিএনপি। পিনাকী ভট্টাচার্যের বক্তব্য থেকে মনে হয়, তিনি একাত্তর প্রসঙ্গে ইসলাম বিরোধী সেক্যুলারিস্ট শিবিরের বয়ানকেই সঠিক মনে করেন। এবং ভান্ত ও অপরাধী মনে করেন ইসলামপন্থীদের। তিনি বিশ্বাস করেন একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙার যুদ্ধটি সঠিক ছিল। এমন কি একাত্তরের ২৫ শে মার্চের গণহত্যার জন্য ইসলামপন্থীদের দায়ী মনে করেন।
২০১৩ সালে শাহবাগী ফ্যাসিস্টদের আন্দোলন চলা কালে ইসলামপন্থীদের অপরাধী আখ্যায়ীত করে পিনাকী একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। সে বিবৃতির ভাষ্যকে তিনি আজও সঠিক মনে করেন। সে বিবৃতিতে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ২৫ শে মার্চের গণহত্যার পরও ইসলামপন্থীরা কেন অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিল? কেন তারা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রীসভায় যোগ দিল? ২৫ শে মার্চের গণহত্যার পরও অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নেয়া এবং পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রীসভায় অংশ নেয়াকে তিন যুদ্ধাপরাধ মনে করেন। এক্ষেত্রে তিনি বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেকুলারিস্ট, হিন্দুত্ববাদী ও বামধারার লোকদের পূর্ণ অনুসারী। বস্তুত সেরূপ এক অভিন্ন চেতনার কারণেই তিনি ২০১৩ সালে শাহবাগের মঞ্চে ইসলাম বিরোধী ফ্যাসিস্টদের সাথে একাত্ম্য হতে পেরেছিলেন। তিনি সাম্প্রতিক এক ভিডিও’তে বলেছেন শাহবাগীদের মঞ্চে যাওযার জন্য তিনি তাওবা করেছেন। কিন্তু লক্ষণীয় হলো, তাওবা করলেও একাত্তর প্রসঙ্গে এখনো তিনি সেই পুরনো ইসলামবিরোধী সেকুলার শাহবাগী বয়ানের পুনরাবৃত্তি করে থাকেন এবং পাকিস্তানপন্থীদের অপরাধী বলেন। এটি কি পিনাকীর দ্বিচারিতা নয়?
কেন এ নিবন্ধ?
পিনাকী ভট্টাচার্যের বহু বক্তব্যের সাথে আমি একমত। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এবং ভারতীয় আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার বহু বক্তব্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সহায়ক। আমি নিজেও সে যুদ্ধে বহু দশক যাবত জড়িত। তার বহু ভিডিও ভাল লাগে বলেই আমি অন্যদের কাছে সেগুলি ফরোয়ার্ড করে থাকি। কিন্তু এর অর্থ এ নয়, ১৯৭১ প্রসঙ্গে যেগুলিকে আমি সঠিক এবং যেগুলিকে ভ্রান্ত মনে করি -সেগুলিকে লুকিয়ে যাবো। তখন তো অপরাধ হবে সত্য গোপনের। ১৯৭১ প্রসঙ্গে আমার নজরে পড়েছে পিনাকী ভট্টাচার্যের কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রাট। লক্ষ্যনীয় হলো, হাসিনার পতন হলেও হাসিনাপন্থীদের কিছু একাত্তরের কিছু সেক্যুলার বয়ান তিনি প্রচার করে চলেছেন। তাতে নতুন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংহতি প্রতিষ্ঠার পথটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি একাত্তরের পাকিস্তানপন্থীদের এখনো যুদ্ধাপরাধী বলছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করছেন। তাঁর ১১ই মে’র ভিডিও তার প্রমাণ। তাতে ভারতীয় RAW এবং ভারতপন্থী ফ্যাসিস্টগণ দারুন ভাবে লাভবান হচ্ছে। তাই এ বিষয় নিয়ে কিছু কথা তুলে ধরা আমি জরুরি মনে করি। এজন্যই এ নিবন্ধটি লেখা। আশাকরি গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি তিনি বুঝার চেষ্টা করবেন।
বুঝতে হবে চিন্তার মডেলটি
কোন একটি ঘটনার বিশ্লেষণে বিচারকের রায় কিরূপ হবে -সেটি নির্ভর করে বিচারকের চেতনায় ধারণকৃত চিন্তার মডেল (pradigm of thought)’য়ের উপর। কারণ, মগজে ধারণকৃত চেতনার সে বিশেষ মডেলটি নির্ধারণ করে দেয় তার সিদ্ধান্ত, কর্ম ও বিচার কিরূপ হবে -সেটি। কোটি কোটি মানুষ একই ভূগোল, একই ভাষা, একই আলো-বাতাস, একই রূপ পানাহার ও একই আকাশের নিচে বসবাস করলেও সবার চেতনার রূপ ও বয়ান এক নয়। সবাই একই ঘটনা কি আমরা একই ভাবে দেখিনা। একই ঘটনার একই রূপ বিচারও করি না। চেতনার মডেলের ভিন্নতার কারণেই আমরা কেউ মুসলিম হই, কেউ হিন্দু হই, কেউ সেকুলার হই, কেউ কমিউনিস্ট হই এবং কেউ নাস্তিক হই।
তাই মানুষের বিচার, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতি পাল্টাতে হলে তার চেতনার মডেল পাল্টাতে হয়। এই ভিন্নতার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠে ভিন্ন ভিন্ন রায়। তাই একজন ব্যক্তির বয়ান দেখে পরিচয় মেলে তার চেতনার মডেলের। কারো কুফুরি, বেইমানী, মুনাফিকি, নাস্তিকতা, পৌত্তলিকতা, ইসলাম বিরোধীতা তার গায়ে লেখা থাকে না, সেটি বোঝা যায় তার বয়ানের মধ্যে। কারণ বয়ানের মধ্যে তার চিন্তার মডেল কথা বলে। সে জ্ঞানগর্ভ কথাটি মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন এভাবে:
قُلْ كُلٌّۭ يَعْمَلُ عَلَىٰ شَاكِلَتِهِۦ فَرَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَنْ هُوَ أَهْدَىٰ سَبِيلًۭا
অর্থ: (হে নবী) বলুন, প্রত্যেক ব্যক্তিই কাজ করে তার মগজে ধারণকৃত ধারণার মডেল অনুযায়ী; অতঃপর একমাত্র তোমাদের রবই জানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে, পথচলায়, কর্ম বা বয়ানে কে সঠিক তথা হিদায়েত প্রাপ্ত।” –(সূরা ইসরা, আয়াত ৮৪। উপরিউক্ত আয়াতে “শাকেলা” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। Advanced Learners’ Arabic to English Dictionery এবং প্রসিদ্ধ আল মাওয়ারিদ ডিকশোনারীতে “শাকেলা” শব্দির অর্থ মডেল, অবয়ব, ফ্যাশন বলা হয়েছে। উপরিউক্ত আয়াতে বর্ণিত সে মডেল, অবয়ব বা ফ্যাশনটি ব্যক্তির দেহের নয় বরং তার চিন্তা-চেতনা ও ধারণার -যা নিয়ন্ত্রণ করে তার কর্ম, চরিত্র, বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনীতি। তাই একাত্তর নিয়ে পিনাকী ভট্টাচার্য যা বলেছেন তার পিছনে তাঁর মনের গভীর কাজ করছে বিশেষ একটি চিন্তার মডেল। এবং সেটি যে ইসলামী নয় তা তো সুস্পষ্ট। বরং সেটি ইসলামী জ্ঞানশূণ্য সেক্যুলারদের অনুরূপ। তাই তার বয়ানটি ২০১৩ সালের শাহবাগী ফ্যাসিস্টদের অতি কাছের।
গভীর অন্ধকারে বিশাল পাহাড়ও অদৃশ্য থেকে যায়। একই কারণ মনের জাহিলিয়াতে তথা অন্ধকারে প্রকট সত্যও অজানা থেকে যায়। সত্য না জানার কারণেই মূর্তি, গরু, সাপ, এমনকি পুরুষের লিঙ্গও পূজনীয় হয়ে ওঠে। সনাতন অজ্ঞতা তখন সনাতন ধর্মে পরিণত হয়। এজন্যই মানব জীবনের সবচেয়ে বড় জিহাদটি হলো অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জিহাদ। অজ্ঞতাই মানুষের বড় শত্রু; কারণ সেটি মানুষকে জাহান্নামের যাত্রী করে। পবিত্র কুরআনের সূরা ফুরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে তাই মহান আল্লাহ সুবহানাতায়ালা অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জিহাদকে “জিহাদে কাবিরা” তথা সবচেয়ে বড় জিহাদ বলেছেন। বলা হয়েছে:
فَلَا تُطِعِ ٱلْكَـٰفِرِينَ وَجَـٰهِدْهُم بِهِۦ جِهَادًۭا كَبِيرًۭا
অর্থ: “সুতরাং কাফিরদের অনুসরণ করবে না; এবং তাদের বিরুদ্ধে কুর’আন দিয়ে বড় জিহাদটি করো।” পবিত্র কুর’আনকে এখানে বড় জিহাদের অস্ত্র রূপে ব্যবহারের হুকুম দেয়া হয়েছে। জিহাদ এখানে রণাঙ্গণের সশস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধে নয়, বরং কাফিরদের জাহেলিয়াতের তথা অজ্ঞতার বিরুদ্ধে। সে সাথে নিজের অজ্ঞতার বিরুদ্ধেও। জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে এ জিহাদে যে ব্যক্তি ব্যর্থ হয়, তার পক্ষে আর কোন জিহাদে অংশ নয়া সম্ভব হয় না। সে তখন অজ্ঞতার জোয়ারে ভেসে যায়; বাঁচে মহান আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধে বেইমানী ও বিদ্রোহ নিয়ে এবং পরিনামে সে জাহান্নামে গিয়ে হাজির হয়। ইসলামে তাই নামাজ-রোজা ফরজ হওয়ার আগে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করা হয়েছে। এটিই হলো জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞ থাকার শাস্তি। এমন অজ্ঞতার শাস্তি জাতীয় জীবনেও ভয়াবহ বিপদ নিয়ে আসে। বাঙালি মুসলিমদের জীবনে সে বিপদ এসেছিল ১৯৭১’য়ে।
মনের অন্ধকারের কারণে মানুষ দূর ভবিষ্যতের বিশাল বিপদ দেখতে পায়না। ভবিষ্যতের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সে বিপদকে দেখতে হলে চাই গভীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দুরদৃষ্টি। অজ্ঞদের সে সামর্থ্য থাকে না। তখন তারা বিভ্রান্ত হয় ও বিপদে পড়ে। তাই প্রজ্ঞা এবং দূরদৃষ্টির অভাবই জনগোষ্ঠীর জীবনে সবচেয়ে বড় বিপদটি ডেকে আনে। তখন তারা রাজনৈতিক প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে। তখন বিজয়ী করে মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্র হত্যাকারী বাকশালী প্রতারক এবং ভারতীয় এজেন্ট। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনে মুজিবের ন্যায় দুর্বৃত্তকে বিজয়ী করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা সে গভীর অজ্ঞতারই প্রমাণ দিয়েছে। সে ভূলের মধ্য দিয়ে একাত্তরে তারা মুসলিমদের পরীক্ষিত শত্রু ভারতকে বিজয়ী করেছে। এটি হলো বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসের দ্বিতীয় বিপর্যয়। প্রথম বিপর্যয়টি ঘটেছিল ১৭৫৭ সালে সিরাজুদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে। তখন চেপে বসেছিল ১৯০ বছরের জন্য উপনিবেশিক বৃটিশের নৃশংস শাসন।
চিন্তার মডেল বা প্যারাডাইম কিভাবে বিচারের রায় পাল্টিয়ে দেয় তার একটি উদাহরণ দেয়া যাক। যদি একজন নারী এবং একজন পুরুষ পারস্পারিক সম্মতিতে বছরের পর বছর বিয়ে ছাড়াই যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলে তথা ব্যভিচার করে, তবে সেকুলারিস্ট ও নাস্তিকের কাছে সেটি আদৌ কোন নিন্দনীয় বিষয় নয়। বরং সেটি প্রেম রুপে নন্দিত হয়। অথচ সে একই ঘটনা একজন ঈমানদার ব্যক্তির কাছে শাস্তিযোগ্য গুরুতর অপরাধ গণ্য হয়। বিবাহিত হলে সেই অপরাধের শাস্তি হলো পাথর মেরে হত্যা; এবং অবিবাহিত হলে শহরের গণজমায়েতে হাজির করে তার পিঠে ১০০ টি চাবুকের আঘাত। এটিই শরীয়তের বিচার। এ বিচার এসেছে সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতালার পক্ষ থেকে। উল্লেখ্য হলো, এ বিচারকে যে অমান্য বা অবজ্ঞা করে সে আর মুসলিম থাকে না, সে কাফির হয়ে যায়।
তেমনি দুটি ভিন্ন রকম রায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল একাত্তরের ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ নিয়ে। পিনাকী ভট্টাচার্যের বয়ান শুনে মনে হয়, ১৯৭১ নিয়ে তাঁর রায়টি ইসলামের উপর ভিত্তি করে হয়নি। তিনি তাঁর বিচারে ইসলামশূণ্য সেকুলার মডেলকে গ্রহণ করেছেন। বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট, কম্যুনিস্ট, নাস্তিক বা হিন্দুত্ববাদীর বিচারে একটি মুসলিম দেশ খণ্ডিত করা অতি প্রশংসনীয় কাজ। কারণ, মুসলিম উম্মাহর দেহ কর্তনের মাঝেই তাদের বিজয় উৎসব। এখানেই পিনাকীর সাথে একজন ইসলামপন্থীর মতের ভিন্নতা। ফলে তার কাছে ইসলামপন্থীরা ভ্রান্ত ও অপরাধী গণ্য হবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। তার কাছে বরং প্রশংসিত হবে এবং অতি গর্বের বিষয় মনে হবে পাকিস্তান ভাঙ্গা। এক্ষেত্রে বাঙালি ফ্যাসিস্টদের বিচার এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের বিচারের সাথে পিনাকীর বিচার এক ও অভিন্ন।
এক অপরাধ কখনোই আরেক অপরাধকে জায়েজ করেনা
এ নিয়ে নিয়ে বিতর্ক নেই যে, একাত্তরে গণহত্যা ঘটেছিল। তবে সে হত্যাকান্ডের শিকার শুধু বাঙালিরা হয়নি, বরং সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে অবাঙালিরা। তবে একাত্তরের পঁচিশে মার্চের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা নিয়ে প্রচুর মতভেদ রয়েছে। প্রকৃত সংখ্যাটি কারোই জানা নেই। কারণ ইচ্ছা করেই সে হিসাব বের করা হয়নি। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে তা নিয়ে প্রচণ্ড মিথ্যাচার হয়েছে। আর মিথ্যাচারীদের আগ্রহ থাকে না সত্য আবিষ্কারে। কারণ তাতে তাদের রটানো মিথ্যাটি ধরা পড়ে যায়। কাদের সিদ্দিকী তার বই “স্বাধীনতা ৭১”য়ে লিখেছে পচিশে মার্চের এক রাতেই তিন লক্ষ মানুষকে ঢাকা শহরে হত্যা করা হয়েছে। এটি হলো পর্বত প্রমান মিথ্যা। কিন্তু শর্মিলা বোসের Death Reckoning বইয়ে এ সংখ্যাটি তার ধারে কাছেও নেই। তার হিসাবে কয়েক হাজারের বেশী হবেনা। দাবী করা শাখারী পট্টিতে ৫ হাজারের বেশী নিহত হয়েছে। শর্মিলা বোস সেখানকার হিন্দুদের সাথে কথা বলে জানতে পারেন সেখানে ১৫জনও মারা যায়নি। তবে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে যত বিতর্কই থাক, একথা কেউ বলে না যে একাত্তরে হত্যাকান্ড হয়নি। তবে বিতর্কের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙা নিয়ে। এখানেই যত রাজনীতি ও যত বিতর্ক।
কথা হলো, একটি দেশে দেশে হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, বৈষম্য, অবিচার এরকম নানারূপ অপরাধ থাকতেই পারে। কিন্তু সে অপরাধ গুলিকে অজুহাত বানিয়ে সে দেশটিকে ভাঙ্গা আরেক বিশাল অপরাধ। ইসলামে এটি ফিতনা; এটিকে মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ বলা হয়েছে। একটি দেশে প্লাবন, সুনামি, মহামারি, ভূমিকম্প ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে লাখ লাখ লোক নিহত হয়। কিন্তু তাতে একটু জাতি শত্রুর হাতে অধিকৃত হয় না, স্বাধীনতাও হারায় না। কিন্তু একটি দেশকে বিভক্ত করার অর্থ হলো, একটি জাতিকে বিভক্ত করা, দুর্বল করা এবং শত্রুর হাতে পরাজিত হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করা। দেশ বিভক্তির কারণে এবং শত্রু শক্তির হাতে অধিকৃত হওয়ার কারণে সে দেশে মুসলমানের জন্য পূর্ণ ইসলাম পালনই অসম্ভব হয়। সে দেশটি অধিকৃত হতে পারে ভারতের ন্যায় ইসলামের শত্রু শক্তির হাতে। তখন মুসলিমদের জন্য বিপদ শতগুণ বেড়ে যায়। তখন মুসলিমগণ অধিকৃত হয়ে যায় হিন্দুত্ববাদী কাফের শক্তি হাতে। তখন মুখে দাড়ি এবং টুপি মাথায় দিয়ে রাস্তায় নামলে জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করা হয়। এবং মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া হয়। গরুর গোশতো ঘরে রাখার সন্দেহে পিটিয়ে লাশ বানানো হয়। বাংলাদেশীরা ভারতীয় অধিকৃতি দেখেছে একাত্তরে। দেশের স্বাধীনতা তখন কবরে গেছে, দেশ নৃশংস ভাবে লুণ্ঠিত হয়েছে এবং তাতে নেমে এসেছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। তাতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেগুলিই তো ঘটেছিল একাত্তরে।
১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতা ও একাত্তরের পরাধীনতা
বাঙালি মুসলিমগণ বহু রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল ১৯৪৭’য়ে, তা হারিয়েছে ১৯৭১’য়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে যে সত্যটি গোপন করা হয় তা হলো, একাত্তরের ৯ মাসে যুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ -এ ২৩ বছরে পাকিস্তানে কখনোই বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা হয়নি। এই ২৩ বছরের সেনাবাহিনী ও পুলিশের হাতে ২৩ জনও বাঙালি নিহত হয়নি। অথচ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বার বার গণহত্যা হয়েছে। যেমন হয়েছে শেখ মুজিবের শাসনামলে, তেমনি হাসিনার শাসনামলে। গণহত্যা হয়েছে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর রাজপথে লগি বৈঠা দিয়ে। ২০০৯ সালে গণহত্যা হয়েছে পিলখানায়। গণহত্যা হয়েছে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে। এরূপ গণহত্যার পাশে অবিরাম চলেছে গুম-খুন-ধর্ষণের রাজনীতি। এবং বিশাল গণহত্যা হয়েছে ২০২৪’য়ের জুলাই-আগস্টের বিপ্লব কালে। এবং সবচেয়ে বড় গণহত্যা হয়েছে ১৯৭৪ সালে ভায়াহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। এ দুর্ভিক্ষ ছিল আওয়ামী দুর্বৃত্ত শাসক শ্রেণীর সৃষ্টি। সে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষটি যৌথভাবে ডেকে আনা হয়েছিল ভারতীয় লুণ্ঠন এবং আওয়ামী দুর্বৃত্তদের লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে।
অতি পরিতাপের বিষয় হলো, বাঙালি মুসলিমের সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বড় অপরাধগুলো সংগঠিত হয়েছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পর, অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে থাকা কালিন সময়ে নয়। পাকিস্তানের ২৩ বছরে এক বারও দুর্ভিক্ষ আসেনি। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার ফলে আসন্ন বিপদটি শুধু ইসলামী দলের নেতাকর্মী, মসজিদের ইমাম, পীর সাহেবগণই শুধু নয়, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামপ্রেমী ছাত্ররাও বুঝতে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল মাদ্রাসার ছাত্ররাও। তাই সেসব ইসলামপন্থীদের কেউ ভারতে যায়নি এবং মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখায়নি। বরং তাদের মধ্য থেকে বহু হাজার ছাত্র সেদিন রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, পিনাকী ভট্টাচার্যের চোখে বাঙালি মুসলিমের সে দেশপ্রেম ধরা পড়েনি। পাকিস্তান তো বাঙালি মুসলিমদেরই গড়া দেশ ছিল। মুসলিম লীগকে তারাই ঢাকাতে জন্ম দিয়েছিল। বাংলা ছিল মুসলিম লীগের দুর্গ। সে দেশের সুরক্ষায় বাঙালি নাগরিকগণ রাজাকার হবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। তাই রাজাকারদের বয়ানে সেদিন ইসলাম দেখা গেছে।
পিনাকীর অপূর্ণতা
মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিম দেশ ভাঙ্গাকে হারাম করেছেন, এবং একতাকে ফরজ করেছেন। পবিত্র কুর’আনে সে হুকুম বার বার এসেছে। মুসলিমের রাজনীতির ভিত্তি কখনোই তার ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও আঞ্চলিকতা হতে পারেনা। সেটি হারাম। তাকে এসব ক্ষুদ্রতার উর্দ্ধে উঠে প্যান-ইসলামী হতে। মসজিদের জায়নামাজে আরব, ইরানী, কুর্দি, তুর্কী, হাবসী ইত্যাদি কাঁধে কাঁধে লাগিয়ে নামাজে খাড়া হতে হয়। সেরূপ বুনিয়ান মারসুস তথা সীসাঢালা প্রাচীর সম একতা থাকতে হয় রাজনীতির ময়দানেও। সে সামর্থ্যটি বাঙালি মুসলিমদের জীবনে দেখা গেছে ১৯৪৭’য়ে। তারা তখন পাঞ্জাবী, পাঠান, বিহারী, গুজরাতী, সিন্ধি, বেলুচ ইত্যাদি নানা পরিচয়ের মুসলিমদের সাথে একতাবদ্ধ হয়েছে। একতাবদ্ধ হওয়ার সে সামর্থ্য না থাকাটিই চরম বেঈমানী। সে বেঈমানী দেখা গেছে বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট, কম্যুনিস্ট ও বামধারার রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জীবনে। অথচ পিনাকীর কাছে এরূপ বেঈমানেরাই হলো প্রশংসনীয় এবং গণহত্যার দায়ে অপরাধী হলো ইসলামপন্থীরা।
পিনাকীর বয়ান থেকে বুঝা যায় বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাস করলেও ইসলামের মৌলিক পাঠটি তিনি পাননি। ফলে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁর মনকে ইসলামের মৌল শিক্ষায় আলোকিত করতে। এ ব্যর্থটি অধিকাংশ বাঙালি হিন্দুর। সে অজ্ঞতার কারণে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তান ভাঙ্গার হারাম বয়ানে ইসলাম আবিস্কার করেছেন। তার এ অজ্ঞতা স্বাভাবিক। এমন কি মুসলিম নামধারিগণ অনেকেই ইসলাম থেকে দূরে সরার কারণে পাকিস্তান ভাঙ্গার বিপদ বুঝতে পারেনি। ফলে তারা ভারতের কোলে আশ্রয় নিয়েছে এবং ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতকে বিজয়ী করার যুদ্ধে নেমেছে। ভারত আজ শক্তিশালী; ভারতের এ শক্তির পিছনে তো ১৯৭১ সালের বিজয়। এবং সে বিজয় ভারতের ঘরে তুলে দেওয়ার পিছনে কাজ করেছে বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট, কম্যুনিস্ট ও বামধারার রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা।
বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নভঙ্গ
অথচ ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান বেঁচে গেলে বাঙালি মুসলিমের ইতিহাস ভিন্নতর হতো। পাকিস্তান হতো ৪৪ কোটি জনসংখ্যার বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তি। পাকিস্তান খন্ডিত হয়ে গেছে; কিন্তু এরপরও দেশটি ভারতের বিরুদ্ধে সমানে সমানে লড়াই করছে। বিশাল ভারত এ ক্ষুদ্র দেশটিকে হারাতে পারছে না। সেটি বুঝা গেল কদিন আগের যুদ্ধে। অখণ্ড পাকিস্তানে থাকলে সে রাষ্ট্রের ড্রাইভিং সিটে থাকতো দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালি মুসলিমরা। অখন্ড পাকিস্তানের ২৩ বছরে চারজন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন বাঙালি মুসলিম। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর তার চেয়ারে বসেছিলেন বাঙালি খাজা নাজিম উদ্দিন। দেশটির তিনজন স্পিকার হয়েছেন বাঙালি। কয়েকজন প্রধান বিচারপতি হয়েছে বাঙালি। পাকিস্তানের বহু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছে বাঙালি। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে বাঙালি মুসলিমের সে অর্জনের ইতিহাস পড়ানো হয় না। বরং পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ ভাবতে শেখানো হয়েছে।
পাকিস্তান ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র । ভারত, ইসরাইল ও সোভিয়েত রাশিয়াসহ ইসলামের কোন শত্রু রাষ্ট্রই চায়নি পাকিস্তান বেঁচে থাকুক। বাঙালি মুসলিমরা মুজিবের নেতৃত্বে ইসলামের শত্রুদের বিজয়ী করেছে। যার হৃদয়ে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান আছে -সে কি এতো বড় জঘন্য নাশকতার কর্ম করতে পারে? সাড়ে ১৪ শত বছরের মুসলিম ইতিহাসে উম্মাহর বিরুদ্ধে এরূপ নাশকতার কর্ম কি কখনো ঘটেছে? বাঙালি ফ্যাসিস্টগণ, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার লোকেরা আর কোন কারনে না হোক, মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে এই নাশকতার কারণে শত শত বছর ইতিহাসে বেঁচে থাকবে।
পাকিস্তানের সামনে প্রচুর সম্ভাবনা ছিল। মুসলিমদের জন্য হতে পারতো বহুভাষা ও বহুবর্ণের মানুষদের নিয়ে একটি সিভিলাইজেশনাল রাষ্ট্র – যেমনটি হয়েছিল মুসলিমদের গৌরব কালে। খেলাফত ভেঙে যাওয়ার পর একটা সিভিলাইজেশনাল স্টেট নির্মাণই ছিল বাঙালি মুসলিমদের ১৯৪৭’য়ের স্বপ্ন। তাই মুসলিম লীগেরর স্লোগান ছিল: “পাকিস্তান কা মতলাব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। যারা “জয় বাংলা”র রাজনীতি করে তাদের কাছে রাষ্ট্র নির্মাণের সে ইসলামী ভিশন ভাল লাগার কথা নয়। বরং বিভক্তির মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি সাধনের মধ্যেই তাদের আনন্দ। সেরূপ একটি নাশকতার নেশায় তারা ভারতকে সাথে নিয়ে ইসলামের শত্রুরা পাকিস্তানের বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে উঠার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়।
পাকিস্তান ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহর যে এই অপূরণীয় ক্ষতি হলো সেটি পিনাকী ভট্টাচার্যের চোখে ধরা পড়েনি। কারণ, পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার বেদনা তার মত একজন অমুসলিমের না বুঝারই কথা। সেটিই স্বাভাবিক। শুধু তিনি কেন, মুসলিম নামধারী কোটি কোটি বাঙালি মুসলিমের চোখেও সে বিপদটি ধরা পড়েনি। ধরা পড়ছে না এমন কি একালের বহু আধুনিক জামায়াত-শিবির কর্মীদের চোখেও। তাই তারা ১৬ ডিসেম্বর এলে বিজয় উৎসের নামে। সে বিপদটি কেবল তারাই বুঝতে পারে যারা মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ নিয়ে বাঁচে। কারণ, তারা গণমুখী নয়, বরং আল্লাহমুখী। তারা বাঁচে একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার ব্রত নিয়ে। যারা সে ইসলামী ভিশন, মিশন ও জিহাদ নিয় বাঁচে না তারা চোখ থাকলেও চোখে দেখে না কিসে মুসলিমের গৌরব এবং কিসে বিপদ। ১৬ই ডিসেম্বর নিয়ে তারা তাই উৎসবে মাতে। অথচ এ দিনটি ভারত এবং ভারতের সহযোগী ইসলামের শত্রু পক্ষের কাছে সবচেয়ে বড় বিজয়ের দিন, কিন্তু প্রতিটি ইসলামপন্থীর কাছে প্রচণ্ড দুঃখভরা মাতমের দিন।
পিনাকীর ভ্রম
একাত্তরের গণহত্যা একটি যুদ্ধাপরাধ। তবে সে অপরাধকে অজুহাত বানিয়ে পাকিস্তান ভাগাটি ছিল আরেক বিশাল অপরাধ। বুঝতে হবে, একটি অপরাধ কখনোই আরেকটি ভয়ানক অপরাধের কারণ হতে পারে না। এরূপ অপরাধ সব সময়ই হারাম। সে বিষয়টি একাত্তরের সকল ইসলামপন্থী দল, সকল আলেম, সকল পীর, সকল ইসলামপন্থী লেখক ও বুদ্ধিজীবী বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তারা ভারতে যাননি; পাকিস্তান ভাঙার পক্ষে অবস্থানও করেনি। বরং হাজার হাজার ইসলামপন্থী যুবক এবং স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্ররা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। তাদের সংখ্যা ও মনবল দিন দিন আরো বাড়ছিল। এদের কারণেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধে নামার আগে সাড়ে আট মাস যুদ্ধ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের একটি জেলা ও মহকুমা দূরে থাক, একটি থানাকেও দখলে নিতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী সে ব্যর্থতা দেখে তাদের সহায়তা ভারত যুদ্ধে নামে আড়াই লক্ষ সৈন্যের বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে।
পিনকী ভট্টাচার্যের অভিযোগ, জামায়াতে ইসলামী কেন ২৫ মার্চের গণহত্যা দেখেও পাকিস্তানের পক্ষ নিল? তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারের মন্ত্রিসভায় কেন অংশ নিল? পিনকীর যুক্তি ২৫ মার্চ এর গণহত্যার পর জামায়াতের উচিত ছিল পাকিস্তান ভাঙার পক্ষে অবস্থান নেওয়া। অথচ সেটি হারাম। সেটি করলে তা হতো এক অপরাধকে অজুহাত বানিয়ে আরেক ভয়ানক অপরাধের অংশীদার হওয়া। বরং তখন আরেকটি ফরজ দায়িত্ব তাদের সামনে হাজির হয়। সেটি হলো হিন্দুত্ববাদী কাফিরদের গ্রাস থেকে পাকিস্তান বাঁচানো। শুধু জামায়াত নয়, সকল ইসলামী দল, সকল আলেম ও সকল পীর সাহেবগণ সেটি বুঝতেন। তাই পাকিস্তান ভাঙ্গার বিশাল অপরাধে তারা কেউ যোগ দেননি। প্রশ্ন হলো, সে জন্য পিনাকী কেন শুধু জামায়াতকে অপরাধী বলছেন? এমন কি কিছু বামপন্থীগণও পাকিস্তান ভাঙ্গার মাঝে বিপদ দেখেছেন। পাকিস্তান ভাঙ্গার বিপদ দেখেছেন ভাষানী ন্যাপের সিনিয়র নেতা রংপুরের মশিউর রহমান যাদু মিয়া, যশোরের পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টির আব্দুল হক এবং এমন কি আওয়ামী লীগেরও বহু নেতা। তারাও একাত্তরে ভারতে যায়নি এবং পাকিস্তান ভাঙ্গার ভারতীয় প্রকল্পে অংশ নেয়নি।
প্রশ্ন হলো, এসব ইসলামপন্থী ও পাকিস্তানপন্থীরা কি ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ড দেখেননি? অবশ্যই তারা দেখেছেন। অনেকের আপনজনও একাত্তরে মারা গেছে। কিন্তু সেটি দেখার সাথে তারা স্পষ্ট ভাবে দেখতে পেয়েছিলেন ধেয়ে আসা আগ্রাসী ভারতীয় প্রকল্পের ভয়াবহ বিপদ। সে প্রকল্পের ধারাবাহিকতা নিয়েই মুজিব, এরশাদ ও হাসিনার স্বৈরাচার এসেছে। এবং এসেছে বাকশাল ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদ। এসেছে ভারতীয় লুণ্ঠন ও দুর্ভিক্ষ। এসেছে গণহত্যা, আয়নাঘর, নেতাদের ফাঁসি, ইসলামপন্থীদের দলন ও গণতন্ত্রের কবর।
পরিতাপের বিষয় হলো, পিনাকী ভট্টাচার্যের চোখে আগ্রাসী ভারতের পদতলে পিষ্ট হওয়ার সে বিপদ ধরা পড়েনি -যেমনটি ধরা পড়েছিল ইসলামপন্থী ও কিছু প্রজ্ঞাবান বামন্থীদের চোখে। বিস্ময়র বিষয় হলো, পিনাকীর কাছে অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্বই বেশী বিপদজনক মনে হয়েছে, হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী ভারত নয়। এজন্যই তার কাছে পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থীরা বড্ড অপরাধী গণ্য হয়। এখানেই পিনাকীর প্রচণ্ড ভ্রম। ১২/০৫/২০২৫
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- একাত্তর নিয়ে পিনাকী ভট্টাচার্যের ভ্রম
- রাজনীতিতে মুসলিম এজেন্ডা এবং হিন্দু এজেন্ডা
- আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার এখনই কেন উপযুক্ত সময়?
- The Unfettered Crimes of Israel and the Death of Humanity
- The Criminal Israel, the Complicit USA and the Silent Ummah
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- May 2025
- April 2025
- March 2025
- February 2025
- January 2025
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018