স্বাধীনতার সুরক্ষা কীরূপে?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 শক্তির বিকল্প শক্তিই

যে জনপদে বাঘ-ভালুকের ন্যায় হিংস্র জন্তুর বাস, সেখানে যারা বসবাস করে তাদের জন্য অতি অপরিহার্য হলো, হিংস্র পশু হত্যা বা তাড়ানোর সর্বাত্মক প্রস্তুতি। নইলে পশুর পেটে যেতে হয়। শুধু দোয়া-দরুদে সেখানে জীবন বাঁচে না। তেমনি যে সমাজে দুর্বৃত্ত জালেমদের দাপট, তাদের নির্মূলেও লাগাতর যুদ্ধ নিয়ে বাঁচতে হয়। এভাবেই স্বাধীনতার মূল্য দিতে হয়। নইলে সমাজে শান্তি আসে না। তখন দেশ অধিকৃত হয় দুর্বৃত্তদের হাতে। দুর্বৃত্ত নির্মূলের সে যুদ্ধটিই হলো মুসলিম জীবনের জিহাদ। তেমনি জিহাদের প্রস্তুতি থাকতে হয় আগ্রাসী শত্রু দেশের বিরুদ্ধেও।

জিহাদই হলো ইসলামের সর্বোচ্চ ইবাদত – যা স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিয়ে বাঁচার জন্য অপরিহার্য। মানব জীবনের নিরাপত্তার জন্য শুধু বাসস্থান ও পানাহারই যথেষ্ট নয়, অপরিহার্য হলো খুনি জালেমদের হাত থেকে প্রতিরক্ষা। শুধু নিন্দার ভয়ে জালেম তার জুলুম থেকে এবং খুনি তার হত্যার অপরাধ থেকে নিবৃত হয়না। ফিলিস্তিনের গাজাতে দেড় বছরের বেশী কাল ধরে অবিরাম চলছে ইসরাইলী গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞ। ৫৫ হাজারের বেশী ফিলিস্তিনীকে হত্যা করা হয়েছে। শতকরা ৮০ ভাগের বেশী ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে। সারা বিশ্ব নিন্দা জানাচ্ছে। শত শত নগরে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবাদ মিছিল করছে। কিন্তু তাতে ইসরাইলের বর্বরতা একটুও কমেনি।

অপরাধী জালেমগণ শুধু প্রতিপক্ষের শক্তিকে ভয় পায়, নীতি কথা কাজ দেয়না। শক্তির বিকল্প একমাত্র শক্তি। গাজায় ইসরাইলী গণহত্যা অবিরাম অব্যাহত থাকার কারণ, ফিলিস্তিনীদের শক্তিহীনতা। প্রতিরোধে সামর্থ্য ছিল না বলেই আমেরিকা থেকে রেড ইন্ডিয়ানদের প্রায় নির্মূল হতে হয়েছে। প্রায় নির্মূল হতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাব অরিজিন এবং নিউজিল্যান্ডের মাওরীদের। এ বিষয়টি সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার চেয়ে আর কে ভাল জানেন। তাই নির্মূল হওয়া থেকে বাঁচাতে তিনি শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতই ফরজ করেননি, বরং  ফরজ করেছেন জালেমের বিরুদ্ধে জিহাদ এবং জিহাদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি। প্রস্তুতির সে নির্দেশটি এসেছে সুরা আনফালের ৬০ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে,

وَأَعِدُّوا۟ لَهُم مَّا ٱسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍۢ وَمِن رِّبَاطِ ٱلْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِۦ عَدُوَّ ٱللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ

 

অর্থ: “তাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে প্রস্তুত হও; শক্ত করে ধরো ঘোড়ার লাগামকে, এবং তা দিয়ে সন্তস্ত্র করো তোমাদের শত্রু ও আল্লাহর শত্রুদের…”। উপরিউক্ত আয়াতের অর্থ হলো, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রস্তুতির মাত্রা এতোটাই পর্যাপ্ত হতে হবে -যাতে শত্রু তা দেখে ভয় পায়। যে সামরিক প্রস্তুতি শত্রুর মনে ভয় সৃষ্টি হয়না, বুঝতে হবে, প্রস্তুতি নেয়ার ক্ষেত্র মানা হয়নি মহান আল্লাহ তায়ালার উপরিউক্ত হুকুম। তখন বেঈমানী তথা অবাধ্যতা হয় মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে।

 

 

পরাজয়ের শুরু কিভাবে?

উপরিউক্ত কুর’আনী নির্দেশের প্রতি যারাই বেঈমানী দেখায়, তাদের উপর শাস্তি শুরু হয়। এমন বেঈমানদের শাস্তি দেয়াটাই মহান আল্লাহ তায়ালার সূন্নত। তখন শাস্তি নেমে আসে জালেমের হাতে গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ধ্বংস প্রক্রিয়া মধ্য দিয়ে। তাছাড়া যাদের মধ্যে সে প্রস্তুতি নাই এবং প্রস্তুতি নেয়ার আগ্রহও নাই -বুঝতে হবে তারা বেঈমান। এমন অবাধ্য ব্যক্তিগণ নামাজী, রোজাদার ও হাজী হতে পারে, কিন্তু কখনোই তারা মুসলিম হতে পারে না। এ বিষয়ে নবীজী (সা:)’র প্রসিদ্ধ হাদীস: যে কোনদিন জিহাদ করেনি এবং জিহাদের নিয়তও করে না -সে মুনাফিক। আর মুনাফিকগণ কাফিরদের চেয়েও নিকৃষ্ট।

জিহাদের গুরুত্ব বুঝাতে নবীজী (সা:)’র অপর একটি হাদীস হলো: মুসলিমের জীবনে দুই অবস্থা। হয় সে জিহাদে থাকবে অথবা জিহাদের প্রস্তুতি নিতে থাকবে। অপরদিকে শয়তানের এজেন্ডা হলো: মুসলিম জীবন থেকে জিহাদকে বিলুপ্ত করা। এ জন্যই যে দেশের রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ইসলাম থেকে দূরে সরা সেক্যুলারিস্ট, ফ্যাসিস্ট ও বামধারার লোকদের বিজয়, সে দেশের বিলুপ্ত হয় জিহাদ। বরং জিহাদ গণ্য হয় সন্ত্রাস রূপে। বাংলাদেশ হলো তারই উদাহরণ। শয়তানের এজেন্টগণ আযাবকে তখন অনিবার্য করে তোলে।

মুসলিম উম্মাহর পতন ও পরাজয়ের শুরু তো তখন থেকেই যখন যুদ্ধের প্রস্তুতির বদলে গুরুত্ব পেয়েছে তাজমহল নির্মাণ। উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সেনাবাহিনী এবং উন্নত যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের বদলে গুরুত্ব পেয়েছে বড় বড় প্রাসাদ, প্রাসাদতুল্য মসজিদ, মিনার ইত্যাদি দর্শনীয় স্থাপনার নির্মাণ। অথচ মুসলিমগণ যখন এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে বিশাল ভূ-ভাগ দখলে নিয়েছে তখন তাদের হাতে এসব দর্শনীয় প্রাসাদ ও মিনার নির্মিত হয়নি। বুঝতে হবে, প্রাসাদ, মিনার বা তাজমহল নির্মাণ কোন ইবাদত নয়, ইবাদত হলো অত্যাধুনিক অস্ত্র নির্মাণ ও শত্রুর বিরুদ্ধে মজবুত প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা। অথচ মুসলিম দেশে আজও সেই পতনের ধারাই অব্যাহত রয়েছে। সম্পদের প্রাচুর্যে প্রচুর প্রাসাদ নির্মিত হলেও সামর্থ্য নাই একখানি যুদ্ধ বিমান নির্মাণে।

 

স্বাধীনতার সুরক্ষা কীরূপে?

উপরিউক্ত আয়াত থেকে বাঙালি মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষনীয় বিষয়টি হলো, ফরজ হলো আগ্রাসী ভারতের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে অবহেলা হবে মহান আল্লাহর সাথে গাদ্দারী। সামরিক প্রস্তুতির মাত্রা এতোটা বাড়াতে হবে যাতে ভারত হামলা করতে ভয় পায়। বুঝতে হবে, ভারত আমাদের পরীক্ষিত শত্রু। ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ গড়েছে পাকিস্তানকে দুর্বল করার লক্ষ্যে। শক্তিশালী স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে নয়। ভারত কখনোই চায় না, বাংলাদেশ আরেক পাকিস্তানে পরিণত হোক।  

ভারতের দয়ার উপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঁচবে না। আরো বুঝতে হবে, দুর্বল সেনাবাহিনী দিয়ে কখনোই দেশের স্বাধীনতা বাঁচবে না, শুধু  অর্থের অপচয় হবে মাত্র। দুর্বল সেনাবাহিনী দিয়ে কেবল কিছু পরগাছার প্রতিপালন হবে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে দরিদ্র নয়। এবং ইসরাইলের চেয়ে ক্ষুদ্র নয়। পাকিস্তান তার সামরিক প্রস্তুতিকে এতোটাই বাড়িয়ে নিয়েছে যে  দেশটির উপর হামলা করতে ভারত এখন ভয় পায়। ২০২৫’য়ে মে মাসে সংঘটিত ঝটিকা যুদ্ধে সেটির প্রমাণ মিললো। সেরূপ সামরিক প্রস্তুতির মাত্রায় বাংলাদেশকেও অবশ্যই পৌঁছতে হবে।

বাংলাদেশের সামনে সামরিক প্রস্তুতির বিকল্প নাই। ভারতের ন্যায় আরেক ইসরাইর সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এ অবস্থায় প্রতিটি নাগরিককে যোদ্ধায় পরিণত করতে হবে। দেশরক্ষার প্রতিটি প্রচেষ্টাকে জিহাদে পরিণত করতে হবে। বুঝতে হবে এ ইবাদতে কাজা নাই। এ ইবাদতটি পালিত না হলে, মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আযাব অনিবার্য হবে। সে আযাব আসবে শত্রুর হাতে অধিকৃতি, গণহত্যা, গণধর্ষণ ও জুলুম রূপে। বাংলাদেশ তখন পরিণত হবে আরেক কাশ্মীর বা গাজায়। এ ঐতিহাসিক সত্যটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে, মুসলিমদের জন্য হিন্দুত্ববাদী ভারত ইসরাইলের চেয়ে কম দুশমন নয়।   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *